বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব : একুশ শতকের ভাবনা

১৯৭১ সালে ফরাসি দার্শনিক অঁদ্রে মালরো বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের অভিপ্রায় প্রকাশ করেছিলেন। তিনি  পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে একটি ট্যাঙ্কবহর পরিচালনা করতে চেয়েছিলেন। ১৯৭১ সালের সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে ভারতের সর্বোদয় আন্দোলনের নেতা জয়প্রকাশ নারায়ণ একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলনের আয়োজন করেন – এতে মালরোকে আমন্ত্রণ জানানো হয়। মালরো যোগদান করেননি। তবে প্রত্যুত্তরে একটি ঐতিহাসিক চিঠি লেখেন – তাতে  লিখেছিলেন :

সম্মেলনে আলোচনা হবে, প্রবন্ধের মাল মশলা তৈরী হবে, কিন্তু ততক্ষণে পাকিস্তানী  ট্যাঙ্কগুলো আরো অনেকদূর অগ্রসর হবে। আর বাংলাদেশের পক্ষে সেসব বুদ্ধিজীবীরাই কথা বলতে পারবেন যারা যুদ্ধ করতে প্রস্তুত। আমি মুক্তিবাহিনীর অধীনে একটি দল পরিচালনা করতে চাই।

তিরিশের দশকে স্পেনের সিভিল ওয়ারে জেনারেল ফ্রাঙ্কোর  জাতীয়তাবাদী বাহিনীর বিরুদ্ধে রিপাবলিকানদের সমর্থনে  মালরো যুদ্ধ করেছেন। পাবলো নেরুদা, অক্টাভিও পাজের মতো কবি-লেখকরাও ফ্রাঙ্কোর বিরুদ্ধে এই যুদ্ধে যোগ দিয়েছিলেন। মালরোর পক্ষে তাই এরকম সাহসী অভিপ্রায় ব্যক্ত করা ছিল স্বাভাবিক। কিন্তু তাঁর বয়স তখন সত্তর বছর। এ-বয়সের একজনকে যুদ্ধ পরিচালনার দায়িত্ব প্রদান স্বাভাবিকভাবে সম্ভব ছিল না। কিন্তু বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে তাঁর এই সমর্থন ছিল অবিস্মরণীয় ঘটনা। মালরোর এই ঘোষণা হয়তো নাটকীয় ছিল; কিন্তু মুক্তিকামী মানুষের পক্ষে দাঁড়ানোর প্রত্যয়ে তিনি তাঁর সারাজীবনের দার্শনিক সততাকে পুনর্ব্যক্ত করেছিলেন।

আমাদের মুক্তিযুদ্ধের এই দৃঢ় সমর্থক ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশে এসেছিলেন। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তখন তাঁর সাক্ষাৎ হয়েছে। মালরোর নিজ নায়ক ছিলেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালে ফরাসি প্রতিরোধ যুদ্ধের নায়ক (পরে প্রেসিডেন্ট) শার্ল দ্য গল – তাঁর কাছে দ্য গল ও বাঙালির  অবিসংবাদিত নেতা বীর মুজিব দুজনে ছিলেন কিংবদন্তি। মুজিবকে তাঁর মনে হয়েছিল অশ্বারোহী একজন সেনানায়কের মতো। ১৯৭৩ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি  গ্রহণকালে অঁদ্রে মালরো তাঁর ভাষণে বলেছিলেন :

জগৎ মনে হয় বুঝতে চায়নি আপনাদের। বুঝতে চায়নি আপনাদের নিঃসঙ্গ সংগ্রামের মর্মকথা, কেবল ভারত ছাড়া, যে ভারত কবলিত হয়নি কোনো সামূহিকতাবাদী একনায়কত্বের কবলে। স্টালিন নয়, হিটলার নয়, মাও নয় – গান্ধী ও শেখ মুজিবুর রহমান। যদি জগৎ এখনো না বুঝে থাকে এঁদের মতের মর্মবাণী, তবে সময় এসেছে এ বিষয়ে দৃষ্টি উন্মোচনের। আর আমি হতে চাচ্ছি এই কর্মেরই শরিক।

দুই

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের জীবনদর্শন ও বস্তুনিষ্ঠ সংগ্রামের মর্মকথা  আলোচনায় অঁদ্রে মালরোর এ-কথাগুলো খুব গুরুত্বপূর্ণ। পৃথিবীতে বিভিন্ন  দেশে  স্বাধীনতা বা বিপ্লব-উত্তরকালে সহিংসতা ও নৈরাজ্যের অনেক উদাহরণ আছে। এসব দমন-পীড়ন, গণহত্যা ঘটেছে আদর্শের নামে, জাতির নামে, কখনো ধর্মের নামে। মধ্যযুগের বিভিন্ন পর্বে ধর্মীয় সহিংসতা ও অসহিষ্ণুতার বহু দৃষ্টান্ত আছে – আধুনিক যুগেও এর উদাহরণ কম নয়। গত তিনটি শতাব্দীতে পৃথিবী বিপ্লব ও সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে অনেক জাতিরাষ্ট্র্রের প্রতিষ্ঠা দেখেছে। ফরাসি বিপ্লব, বলশেভিক বিপ্লব, চীনে কমিউনিস্ট রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা ইত্যাদি বহু ঘটনা পৃথিবীর ইতিহাসের গতিধারা বদলে দিয়েছে। বিখ্যাত ঐতিহাসিক এরিক হবসবম অষ্টাদশ ও ঊনবিংশ শতাব্দীকে তাই Age of Revolution বলে আখ্যা দিয়েছেন। সাম্য, মুক্তি ও স্বাধীনতার বাণী নিয়ে এসেছিল ফরাসি বিপ্লব। কিন্তু পরবর্তীকালে নেতিবাচক পরিস্থিতি ও নৈরাজ্যে অনেকটাই ম্লান হয়ে গেছে বিপ্লবের বাণী। বিপ্লবের অন্যতম নেতা রোবোসপিয়ের ও তাঁর সহযোগী সেইন্ট জাস্ট, যাঁকে বলা হতো মৃত্যুর দূত (Angel of death) ও অন্যরা ভিন্নমতাবলম্বীদের গিলোটিনে হত্যা করেছে – তাঁরাও পরে এর শিকার হয়েছেন। ফরাসি দেশে নেপোলিয়নের ক্ষমতা দখলের পটভূমি তৈরি করেছিল তৎকালীন নৈরাজ্য। বলশেভিক বিপ্লব-পরবর্তীতে সোভিয়েত ইউনিয়নেও মতাদর্শগত ভিন্নতার কারণে স্টালিনের আমলে বহু বিপ্লবীকে,
কবি-লেখককে জীবন দিতে হয়েছে, না হয় নির্বাসনে যেতে হয়েছে। চীনে সাংস্কৃতিক বিপ্লবের নামে বাড়াবাড়ি – শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী সরকারি কর্মচারীদের হত্যা ও হয়রানির বহু ঘটনা ঘটেছে – কম্বোডিয়ায় পল পট, খিউ সাম্পান  ইয়েংসারিদের গণহত্যা, অত্যাচার-নির্যাতনের ইতিহাস নিকট অতীত।

একটি সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা হলেও বঙ্গবন্ধু জধফরপধষ ছিলেন না। তাঁর হৃদয়ে তখনো রক্তক্ষরণ – পাকিস্তানিদের নির্মম গণহত্যার ক্ষতচিহ্ন। তবু নতুন রাষ্ট্রে তিনি  শান্তি ও সম্প্রীতির কথা বলেছেন। গণতান্ত্রিক মূল্যবোধকে সমুন্নত রেখেছেন। চরমপন্থায় বঙ্গবন্ধু বিশ্বাসী ছিলেন না। বরং আজীবন লালিত আদর্শ গণতন্ত্র, অসাম্প্রদায়িকতা, মানবতাবোধকে সমুন্নত রেখেছেন। বঙ্গবন্ধুর জীবনব্যাপী আন্দোলন-সংগ্রামের মূল লক্ষ্য ছিল একটি বৈষম্যহীন সমাজ নির্মাণ – শান্তি-সম্প্রীতির সহাবস্থানে সোনার বাংলা গড়ে তোলা। স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়েও তিনি এই স্বপ্নের ধারাবাহিকতা লালন করেছেন। রাষ্ট্রপরিচালনার শুরুতেই তিনি গুরুত্ব দিয়েছেন সমন্বয়চিন্তাকে। সারাজীবন দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর স্বপ্ন দেখেছেন। রাষ্ট্রপরিচালনায় তাই চরম কোনো পন্থা নয়, বরং গণতান্ত্রিক মূল্যবোধকে সমুন্নত রাখাই ছিল তাঁর লক্ষ্য। যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশ পুনর্গঠনের পাশাপাশি তিনি ব্রতী হয়েছিলেন একটি মানবিক সংবিধান রচনায়।

তাঁর একটা বিশাল হৃদয় ছিল, এ-হৃদয়ে তিনি পরম শত্রুকেও স্থান দিয়েছেন। এবিএম মূসা লিখেছেন – ‘আসলে তিনি সমগ্র বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষকে একটি পরিবার মনে করতেন, নিজে ছিলেন সেই পরিবারের প্রধান। পরিবারের সবাই ছিল স্বজন, আপনজন ও আত্মার আত্মীয়।’ তারা যেমন ছিল তাঁর শক্তি, তেমনি ছিল দুর্বলতা। সম্ভবত এই আত্মবিশ্বাসের চড়া মূল্য দিতে হয়েছে তাঁকে।

যে বিশ্ব-অভিজ্ঞতার কথা বললাম তার উল্টোটা ঘটেছে বাংলাদেশে। বঙ্গবন্ধুর সমন্বয়চিন্তার বিপরীতে রাজনীতিতে চরমপন্থাকে অবলম্বন করেছে প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠী ও হঠকারী কিছু  দল। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে একাত্তরের পরাজিত শক্তি। আরো ছিল দ্বিমেরু-বিশ্বের রাজনীতি। তিনি রাষ্ট্রপরিচালনার শুরুতেই হিমালয়সম চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছিলেন। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ, ধ্বংসপ্রাপ্ত অবকাঠামো, বিপুল পরিমাণ আর্থিক ক্ষয়ক্ষতি ও ব্যাংক-রিজার্ভের শূন্যতা, কোটি শরণার্থীর পুনর্বাসন, প্রশাসনিক পুনর্বিন্যাস এরকম নানা চ্যালেঞ্জ ছিল তাঁর সামনে।

স্বাধীনতা-পরবর্তীকালে বঙ্গবন্ধুর ডাকে মুক্তিযোদ্ধারা অস্ত্র জমা দিলেও উগ্র বামপন্থী বিশেষ করে চরমপন্থী মাওবাদীরা অস্ত্র জমা দেয়নি। স্বাধীনতার পরে যখন তিনি পর্বতপ্রমাণ সমস্যা নিয়ে যুদ্ধবিধ্বস্ত স্বাধীন বাংলাদেশ গঠনে ব্যাপৃত হলেন – শ্রেণিশত্রু খতমের নামে চরমপন্থী সর্বহারা ও সন্ত্রাসী গোষ্ঠী হত্যা, লুণ্ঠন শুরু করে। এরা বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে স্বীকার করেনি। এদের সঙ্গে একাত্তরের পরাজিত শক্তিও যুক্ত হয়। বাংলাদেশের কিছু অঞ্চলে উগ্র বামরা আঞ্চলিক বাহিনীও গড়ে তোলে। অন্যদিকে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার নামে একদল রাজনীতিবিদ জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল গঠন করে। এদের সঙ্গে যুক্ত হয় অনেক বিভ্রান্ত তরুণ। এরাও উগ্রবাদীদের সঙ্গে মিশে সহিংসতার পথ অবলম্বন করে। সমাজতন্ত্রের কথা বললেও মূলত বঙ্গবন্ধু সরকারের বিরোধিতা ও সরকারকে অস্থিতিশীল করাই ছিল এদের মূল উদ্দেশ্য। ১৯৭৩ সালে চিলির সাম্যবাদী প্রেসিডেন্ট সালভাদর আয়েন্দে এক সামরিক অভ্যুত্থানে নিহত হওয়ার পর জাসদের তৎকালীন প্রভাবশালী এক নেতা তাঁর বক্তৃতায় বলেছিলেন, আলেন্দে লাথি খেয়ে পড়ে গেছে! তাঁর এই কথা তখনকার পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। এই বক্তব্য থেকেই স্পষ্ট এদের সমাজতন্ত্র-প্রীতি! মওলানা ভাসানীর হক কথা ও জাসদের গণকণ্ঠ পত্রিকায় ছড়ানো হয় হিংসার বিষবাষ্প। আবদুল হকের মতো তথাকথিত মার্কসবাদী-লেনিনবাদী অস্ত্র চেয়ে চিঠি লিখেছিল ভুট্টোকে। বঙ্গবন্ধু সরকারের দেশ পুনর্গঠনের যাত্রাকে বাধাগ্রস্ত  করার জন্য, নাশকতা – হত্যাকাণ্ড – পাটের গুদামে  আগুন  এ-ধরনের চরম পন্থা অবলম্বন করেছে তারা – অপপ্রচার করেছে, দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করার চেষ্টা করেছে। অবাধ স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের নামে বাধাগ্রস্ত করেছে দেশের অগ্রগতিকে। কেউ কেউ বলেন,  বঙ্গবন্ধু আরো কঠোর হতে পারতেন, কিন্তু তিনি একনায়ক হতে চাননি। হতে চেয়েছেন জনগণের নেতা – তা না হলে মালরোর ভাষায় – তিনি মাও, কিংবা স্টালিনের মতো একনায়ক হতেন – কিন্তু আজ তিনি মহাত্মা গান্ধী, কিংবা নেলসন ম্যান্ডেলার সমগোত্রীয় মানবতাবাদী একজন নেতা।

এ-পরিস্থিতিতে বঙ্গবন্ধু বিপ্লবের রূপরেখা ঘোষণা করেন। তিনি ঘুণে ধরা সিস্টেম বদলে দিতে চেয়েছিলেন। তাঁর ‘বাকশাল’ প্ল্যাটফর্মে সকল শ্রেণি-পেশার মানুষ সমবেত হয়েছিল। তিনি প্রশাসনিক ব্যবস্থার পরিবর্তন এনেছিলেন, সেইসঙ্গে গুরুত্বারোপ করেছেন সাধারণ মানুষের সামাজিক-অর্থনৈতিক উন্নয়নে। চেয়েছেন সমবায়ের মাধ্যমে গ্রামের সাধারণ মানুষের ভাগ্য উন্নয়ন করতে। তাঁর এই দ্বিতীয় বিপ্লবও কোনো রেডিক্যাল পন্থা ছিল না, বরং ছিল পরিবর্তনের সূচক। তিনি একে সাময়িক ব্যবস্থাও বলেছেন। সে-সময়ে গৃহীত ব্যবস্থার সুফলও দেখা দিয়েছিল সমাজে। কিন্তু ষড়যন্ত্রকারী ও প্রতিক্রিয়াশীলদের তৎপরতা, ষড়যন্ত্র ও সহিংসতায় অসমাপ্ত থেকে গেছে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নযাত্রা।

তিন

১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্টের ভোররাতের মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ড  আমাদের ইতিহাসের সবচেয়ে কলঙ্কিত ও শোকাবহ ঘটনা। ঘাতক ও অপশক্তি, সামরিক স্বৈরাচার, হঠকারী বাম ও একাত্তরের পরাজিত শক্তি শকুনের মতো ডানা মেলেছিল আমাদের নীল আকাশে – প্রতিবাদের ভাষাকে স্তব্ধ করে রাখা হয়েছিল বন্দুকের নলের নিচে। বস্তুত ১৬ই আগস্ট জাতির পিতার মরদেহ নিয়ে যখন টুঙ্গিপাড়ার উদ্দেশে হেলিকপ্টার যাত্রা করেছিল সেদিনই শুরু হয় বাঙালি হৃদয়ের অনন্তহীন শোকযাত্রা। এ-যাত্রা এখনো শেষ হয়নি।

ঘাতকরা ভেবেছিল, মুজিবের মৃত্যু মানে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার মৃত্যু, বঙ্গবন্ধুর আদর্শের মৃত্যু। না, তাদের স্বপ্ন পূরণ হয়নি। বিপরীত ও প্রতিকূল স্রোত পেরিয়ে পরবর্তী সময়ে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে পুনঃপ্রতিষ্ঠা হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ, লাল সবুজের বৈজয়ন্তী উড্ডীন হয়েছে আকাশে। শোক পরিণত হয়েছে জাগরণে।

১৯৯২ সালের ১৫ই আগস্ট রাষ্ট্রবিজ্ঞানী সরদার ফজলুল করিম ‘সেই ১৫ আগস্ট ১৯৭৫’ নামে একটি লেখা লিখেছিলেন ভোরের কাগজ পত্রিকায়। সেখান থেকে একটি উদ্ধৃতি দিচ্ছি -’৭১ সালের শেষ দিকে যখন আমাকে পাকিস্তানি বাহিনী ধরে নিয়ে গেল, আটকে রাখল ঢাকা জেলের ২০ ডিগ্রির একটা নিঃসঙ্গ সেলে এবং যখন হতাশায়, আঘাতে প্রায় মুষড়ে পড়ছিলাম, তখন পাহারারত সেপাইটি আমাকে অভয় দিয়ে বলল, সাহেব, আপনি তো আগেও জেল খেটেছেন। মন খারাপ করছেন কেন? এই সেলে একদিন শেখ মুজিব ছিলেন। আর যেদিন তাঁকে গভীর রাতে আগরতলা মামলায় বিচারের জন্য ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে যায়, সেদিন সেপাইদের মধ্যে আমিও ছিলাম। নিশ্চিত ফাঁসির মঞ্চের দিকে যাওয়ার মুখে দেখলাম, শেখ সাহেব সেলের বাইরে এসে নত হয়ে একমুঠো মাটি নিয়ে নিজের মুখে, মাথায় ছোঁয়ালেন, বলে উঠলেন, ‘বাংলা মা আমার, আমি তোমায় ভালোবাসি।’ তারপর পাহারাদার-সেপাই আমাদের জড়িয়ে ধরে বলেন, ‘যাই ভাই, তোমরা আমায় দোয়া কোরো’।

এভাবেই, বাংলা ও বাঙালির প্রতি তাঁর নিবেদন ছিল আমৃত্যু। পাকিস্তানিরা তাঁকে  হত্যা করতে পারেনি, কিন্তু অভাবিত যে, তিনি স্বদেশে হন্তারকের হাতে শাহাদতবরণ করেছেন। ১৯৭২ সালে ডেভিড ফ্রস্টের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে বঙ্গবন্ধু বলেছেন – আপনি একজন মানুষকে হত্যা করতে পারেন সে তার দেহ। কিন্তু তার আত্মাকে কি আপনি হত্যা করতে পারেন? না, তা কেউ পারে না। সরদার ফজলুল করিম লিখেছেন –  ‘শেখ মুজিবের দিকে নিক্ষিপ্ত হত্যাকারীর বুলেটের আওয়াজ থেকে মুহূর্তের মধ্যে জন্ম নিয়েছে অপর এক আওয়াজ : এক মুজিবের রক্ত থেকে লক্ষ মুজিব জন্ম নেবে।’

চার

অঁদ্রে মালরোর কথায় আবার ফিরে আসি। তিনি বলেছিলেন, আমরা এখনো শেখ মুজিবকে বুঝতে পারিনি। বস্তুত, এখন সময় এসেছে  বঙ্গবন্ধুর দর্শন, রাষ্ট্রভাবনা ও তাঁর সংগ্রামের মর্মকথা উপলব্ধি করার। আগামী প্রজন্মের কাছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের  জীবনদর্শন ও সংগ্রামের মর্মবাণী পৌঁছে দিতে হবে। তাঁকে হত্যার পরে বহু অপ্রপ্রচার হয়েছে – তরুণ প্রজন্মকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের অবদান ও আত্মত্যাগের ইতিহাস থেকে দূরে রেখেছিল ঘাতক ও প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি। বিকৃত করা হয়েছে স্বাধীনতার ইতিহাস। কালের যাত্রায় এইসব অপচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। বঙ্গবন্ধু এখন চিরন্তন মুজিব হিসেবে বাঙালি হৃদয়ে সমাসীন।

জাতির পিতার জন্মের শতবর্ষ অতিক্রান্ত – শাহাদতবরণের  ৪৭তম বার্ষিকীও পালিত  হয়েছে শোক ও শ্রদ্ধায়। একুশ শতকে বদলে গেছে পৃথিবীর চেনা রূপ – প্রযুক্তির  উৎকর্ষে চতুর্থ বিপ্লবের ভার্চুয়াল জগৎ ও করোনা বিশ্বমারির মৃত্যুলীলায় পৃথিবী এখন নতুন অভিজ্ঞতার মুখোমুখি। ষাট ও সত্তরের দশকের পরিবেশ পরিস্থিতি এখন আর নেই। কিন্তু এখনো পৃথিবীতে দারিদ্র্য, বৈষম্য, ক্ষুধা আছে – জাতিগত, ধর্মীয় সংঘাত ও সাম্প্রদায়িকতা এখনো দেশে দেশে তুলে রেখেছে বিভাজনের দেয়াল। বঙ্গবন্ধুর মর্মবাণীর মূলে আছে শান্তি ও মানবতা, দারিদ্র্য বিলোপ ও দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর অভিপ্রায়। বর্তমান বিশ্বের টেকসই উন্নয়নের মর্মবাণী আমরা বহু আগে শুনেছি জাতির পিতার কণ্ঠে। শতবর্ষ পরেও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের সংগ্রাম, স্বাধীনতা ও মানবমুক্তির এই মর্মবাণী বিশ্বব্যাপী প্রাসঙ্গিক।

তথ্যসূত্র

১.        খান সারওয়ার  মুরশিদ, কালের কথা, মাওলা ব্রাদার্স দ্বিতীয় মুদ্রণ ২০১৭, পৃ ২৪।

২.       ওই, পৃ ২৭।

৩.       এ বি এম মূসা,  মুজিব ভাই,  প্রথমা ২০১৯, দ্বিতীয় সংস্করণ, পৃ ৮১।

 ৪.      সরদার ফজলুল করিম, ‘এই সেই ১৫ই আগস্ট ১৯৭৫’, ভোরের কাগজ, ১৫ই আগস্ট ১৯৯২।

৫.       ওই।