বন্দী-বিবেক সমাজ ও কবিমানস

আবদুল গনি হাজারী

যে -কথাটা লোকেরা নিজেদের মধ্যে অনেক কাল থেকে বলাবলি করে আসছে, অথচ সাহস করে বলতে পারছে না, কিংবা বলবার মত সময় আসে নি বলে ভেবেছে, আমার মনে হয় সেই কথাটা বলার প্রয়াসই প্রবন্ধটিতে (সংস্কৃতি-চিন্তা, সমকাল : কার্তিক, ১৩৭১) ছিল।

সাহসের কথা বলার মধ্যে একটা পরোক্ষ আত্মশ্লাঘা রয়েছে বলে অনেকে সন্দেহ করতে পারেন। কিন্তু এখানে সাহসের চাইতে একটা বিবেকী অস্থিরতাই কাজ করেছে বেশি। দেখেছি, সত্য কথাটা লোকে বলতে চায় না সহজে। সেটা সাহসের অভাব কিনা, সে বিষয়ে আমি নিঃসন্দেহ নই।

এই প্রবন্ধটির খসড়া বাংলা একাডেমীতে স্বল্পসংখ্যক শ্রোতার সামনে একবার পড়া হয়েছিল গত বৎসর। কতিপয় পণ্ডিত অধ্যাপক ছিলেন সে সভায়। আলোচনা করতে উঠে তাঁদের কেউ কেউ প্রবন্ধটির ‘প্রচণ্ড পাণ্ডিত্য’ সম্পর্কে শ্লেষ করেই মন্তব্য করলেন, কেউ এর তত্ত্বগত ভুল-ত্রুটি নিয়ে এলোপাতাড়ি আলোচনা করলেন। কিন্তু সভাশেষে দু’একজন পণ্ডিত সমালোচক আড়ালে ডেকে নিয়ে লেখককে বললেন : “দেখুন, কিছু মনে করবেন না। আপনি যা লিখেছেন, বলা বাহুল্য, তার সংগে আমি একমত;  কিন্তু কি জানেন, আমার পক্ষে এর বিরোধিতা না করে উপায় নেই।”

আমি স্তম্ভিত হইনি, কিন্তু চিন্তিত হয়েছিলাম এই ভেবে যে, অধ্যাপক নামে খ্যাত এই ব্যক্তির কোন উক্তিটাকে সত্য বলে গ্রহণ করব?

আর একজন বললেন : “আপনার মত দুঃসাহস দেখাবার অবস্থা আমাদের কারো থাকলে আমরাও নিশ্চয় এই সব কথাই লিখতাম। কিন্তু তা যখন সম্ভব নয়, আপনি লিখে যান। আমাদের অনেক কাজ হবে।”

এঁরা হচ্ছেন এক বন্দী-বিবেক বুদ্ধিজীবী সমাজের সাক্ষাৎ প্রতিনিধি।

এখানে সাহস কিংবা দুঃসাহসের প্রশ্ন কিছু আছে বলে মনে হয় না। আমার মনে হয় কোনো উপলব্ধি আপনার সাহিত্যিক বিবেককে কতটা অস্থির করে তুলেছে এবং আপনি পারিপার্শ্বিকের বন্ধন থেকে নিজেকে কতটা মুক্ত-চৈতন্য রাখতে পেরেছেন তার পরই নির্ভর করে আপনি সত্য কথাটা বলবেন কিনা। এখানে অবশ্য খানিকটা স্থান কালের বিচার-বুদ্ধির প্রশ্ন রয়েছে; কিন্তু বিবেক তো আর ট্যাকটিক্স-সর্বস্ব নয়? সাম্প্রতিক বিষয়ে সত্যানুসন্ধান এবং সে সম্পর্কে বক্তব্য স্পষ্ট ভাষায় উপস্থিত করাকে আমি নিছক সাহিত্যিক দায়িত্বের চাইতে সামাজিক দায়িত্বের বিষয় বলে মনে করি বেশি। এবং আমার মনে হয় যাঁরা সাহিত্যের পঠন ও পাঠনকে জীবনের বৃত্তি হিসেবে গ্রহণ করেছেন, তাঁদের জন্য এ দায়িত্ব সব চাইতে জরুরী।

সত্য কথনের কথা বলছিলাম। আপনি লক্ষ্য করে থাকবেন আমাদের এই সময়টাতে সত্যই যেন সব চাইতে বড় ক্যাযুয়াল্টি হয়ে পড়েছে। পৃথিবীর সর্বকালের সাহিত্যিক দার্শনিক ও অধ্যাপকরাই সত্যের সবচাইতে বড় পূজারী হিসেবে নন্দিত হয়েছেন। কিন্তু এ কথা বল্লে হয়ত মিথ্যা বলা হবে না যে, আমাদের এ-কালে আমরা সবাই সুবিধের পূজারী হয়েছি; সত্য হনন চলছে নির্বিকারভাবে।

দেশবিভাগের আগে কলকাতার এক অধ্যাপককে দেখেছি বাংলা ভাষার উন্নতির জন্য আমাদের কথ্য ভাষায় বিদেশী, বিশেষ করে আরবী-পারসী শব্দ কত আছে তার একটা অভিধান তৈরি করছেন। লোকজনের সংগে কথা বলতে বলতে হঠাৎ কোন বিদেশী শব্দ কানে লাগলে সংগে সংগে সেটা তাঁর ছোট্ট একটা নোট বইতে টুকে রাখেন। একদিন ঘটনাক্রমে তাঁর বাসায় গেলাম। তখনো আমি ছাত্র হলেও আগ্রহ করে তিনি একখানা মোটা খাতা আমায় দেখালেন, তাতে আক্ষরিক পর্যায়ে তিনি তাঁর সংগৃহীত শব্দগুলো লিখে রেখেছেন। আমার স্ব-ভাষার প্রতি অনুরাগবৃদ্ধিতে সেদিনের এই ঘটনাটির দান অপরিসীম বলে এখনো মনে হয়। (তখন আমি কলকাতায় ইসলামী তমদ্দুন মজলিসের তামদ্দুনিক সম্পাদক হিসেবে উর্দুকে জাতীয় ভাষা করা যায় কিনা, তা নিয়ে গুরুতর লড়াই করছিলাম। ভাষা সম্পর্কে  পড়া-শুনা অবশ্য তখন আমার খুব অল্পই ছিল।) সেই অধ্যাপক আজ শিক্ষাজগতে হোমরাচোমরা ব্যক্তি। কিন্তু বাংলা ভাষার পক্ষে এখনো উচ্চ শিক্ষার মাধ্যম হবার দায়িত্ব নেওয়া যে সম্ভব নয়, সে-বিষয়ে তিনি প্রচুর পাণ্ডিত্যপূর্ণ প্রবন্ধ লিখছেন। তাঁর কোন কোন প্রবন্ধ পড়ে বাংলা ভাষা সম্পর্কে তাঁর উন্নাসিক মনোভাব সম্পর্কে সন্দেহ জাগার অবকাশটুকুও থাকে না।

তিনি কি সত্যই এমন উপলব্ধি করেন? না, পারিপার্শ্বিক, বিশেষ করে জীবিকাজাত বন্ধন থেকে তিনি মুক্ত-চৈতন্য নন বলেই এমন হয়?

১৯৫৪ সালে প্রাদেশিক সাহিত্য সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছিল ঢাকায়। তাতে সকল দল ও মতের সাহিত্যিকদেরই জমায়েত করা হয়েছিল এবং প্রচুর উদ্দীপনার সৃষ্টি করেছিল সে সম্মেলন এ দেশে। কিন্তু সম্মেলনের শেষে কোনো সংবাদপত্র কি করে সেই সম্মেলনের উদ্যোক্তাদের কম্যুনিষ্ট ও রাষ্ট্রদ্রোহী আখ্যা দিয়ে কেন তাদের গ্রেফতার করে কয়েদখানায় পাঠান হচ্ছে না তা নিয়ে দিনের পর দিন সম্পাদকীয় বিক্ষোভ চালিয়েছেন এবং চিঠিপত্র ছাপিয়েছেন, তাও হয়ত অনেকের মনে আছে। তাঁদের প্রথম অভিযোগ ছিল দু’টো – প্রথমতঃ এই সম্মেলনে ভারত থেকে কতিপয় সাহিত্যিককে নিমন্ত্রণ করে আনা হয়েছিল, দ্বিতীয়তঃ এই সম্মেলনের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানগুলিতে, বিশেষ করে সংগীত ও নাটকে দেশের তৎকালীন অনাচার, উৎপীড়ন ও মিথ্যাচারের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ ঘোষিত হয়েছিল। সেই সংবাদপত্র গোষ্ঠী প্রচার করছিল যে, উদ্যোক্তারা যুক্ত বাংলার ধারক এবং পাকিস্তানবিরোধী। তাঁদের উদ্দেশ্য কি ছিল তা তাঁরাই জানেন; কিন্তু সত্য কথা যে তাঁরা বলছেন তা তাঁরা বুকে হাত দিয়ে বলতে পারতেন না। কেননা, তাঁদের চোখের সামনে, বিবেকের সামনে প্রত্যহ তিনবেলা আমাদেরই রাষ্ট্র পরিচালিত রেডিওতে ভারতীয় সাহিত্যিক রচিত ভারতীয় শিল্পীদের গাওয়া ভারতীয় সংগীতের ভারতীয় রেকর্ড বাজানো হতো, এখনো হয়। এতে কি সত্যই পাকিস্তানী সাংস্কৃতিক আদর্শ স্থাপিত হচ্ছিল? এতে কি যুক্ত-ভারত স্থাপিত হয়েছে? কিন্তু কলকাতা থেকে ক’জন খ্যাতনামা সাহিত্যিক অতিথি হিসেবে এসে সম্মেলনে যোগ দিলেই আমাদের সাংস্কৃতিক সতীত্ব নষ্ট হয় এবং পাকিস্তান ধ্বংসের মুখে চলে যায়, এবং দুই বাংলা এক হয়ে যায়!

আবার যে সব অনাচারের ফলে দেশ উচ্ছন্নের পথে চলে যাচ্ছিল, তার সুযোগে যখন আরো চার বৎসর পর জনৈক সার্থককাম তথাকথিত বিপ্লবী সেনাপতি এক আঁচড়ে দেশের প্রতিটি মানুষের জন্মগত অধিকারকেই নস্যাৎ করে দিলেন, তখন এই সব পত্রিকার মহারথীরাই তাঁর গলায় গলা মিলিয়ে দশ বৎসরের অনাচারের বিরুদ্ধে গান গাইলেন ‘বিপ্লবী’ ভাষায়, পরিত্রাতা বলে তাঁকে অভিনন্দিত করলেন। অথচ যে সব মানুষ বঞ্চনা ও শোষণের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদে সেই সংগীত রচনা করেছিলেন এবং গেয়েছিলেন একদিন, তাঁদের তাঁরা তখন রাষ্ট্রবিরোধী বলতে দ্বিধা করেন নি।

আমাদের সমাজে স্ব-বিরোধিতা একটা চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য হয়ে গিয়েছে। এর মূলে অর্থনৈতিক কারণ বর্তমান। এই স্ববিরোধিতা সমাজের সর্বস্তরে ব্যাপক হয়ে দেখা দিয়েছে – অর্থনীতি, ধর্ম, শিক্ষা-সংস্কৃতি, রাজনীতি – সর্বক্ষেত্রে। নীচের তলা থেকে উপরতলা – সর্বত্র।

আমি এক শিল্পপতিকে জানি। দশ বৎসর আগেও ইনি শিল্পপতি ছিলেন না। ছিলেন ব্যবসায়ী এবং রাজনীতিক। একটা ছোট কারখানা ছিল তাঁর। প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানী, কিছু নিজের সঞ্চিত অর্থ এবং কিছু রাজনৈতিক প্রভাবের বলে সংগৃহীত ‘স্বেচ্ছামূলক’ শেয়ার নিয়ে এই কারখানাটি স্থাপিত হয়। একজন আত্মীয়কে ম্যানেজার করে কারখানাটির শুরু হয় বৎসর পনের আগে। এই সময় এই তৎকালীন রাজনৈতিক নেতাকে বলতে শুনেছি – এ কারখানায় তাঁর কোন ব্যক্তিগত স্বার্থ নেই, শ্রমিকের সংগে শেষ যৌথ মুনাফাভোগী কারখানা হিসেবে এটি পরিচালিত হবে। এবং প্রতিষ্ঠানটিকে তিনি একেবারে সমাজতান্ত্রিক নিয়মে চালাবেন। তখন অবশ্য এতে কোন মুনাফা হতো না, বরং আয়কর নীতি অনুযায়ী লোকসান হতো। কালক্রমে এই কারখানাটি ক্রমেই বেড়ে যেতে লাগলো এবং পরে ম্যানেজারটিকে বলতে শুনেছি, যে-বৎসর থেকে আয়কর নীতি অনুযায়ী লাগলো এবং পরে ম্যানেজারটিকে বলতে শুনেছি, যে বৎসর থেকে আয়কর নীতি অনুযায়ী লোকসান দেখাবার সব পদ্ধতি প্রয়োগ করার পরও মুনাফা উদ্বৃত্ত থাকছিল বলে দেখা গেল, তখন থেকে এই সমাজতান্ত্রিক রাজনৈতিক ব্যক্তিটি ক্রমশঃ ব্যবসায়ের নিয়ন্ত্রণ এবং সিন্দুকের চাবি নিজ হাতে বেশি করে নিতে লাগলেন। এখন কার্যতঃ তিনি সবটাই নিয়ন্ত্রণ করেন এবং মুনাফার প্রতিটি পয়সার ওপর যাতে সতর্ক পাহারা কার্যকরী হয় তার জন্য হিসাব-বিভাগ বিস্তৃত হয়েছে এবং কারখানা থেকে পণ্য বাজরে বেরুবার পরের পর্যায়ের কোন খবরই সেই কর্মদক্ষ ম্যানেজারের গোচরে রাখা হয় না। এবং শ্রমিকরা যখন পাওনার দাবী নিয়ে তাঁর কাছে যায়, তখন সেই সমাজতান্ত্রিক শিল্পপতি দেশে মূলধন সংরক্ষণের প্রয়োজনীতার দোহাই দিয়ে উদ্বৃত্ত মুনাফাকে আরো বেশী করে মূলধন হিসেবে খাটাবার প্রয়োজনীয়তার উপর জোর দেন। মুনাফায় যৌথভোগের কথা তিনি ভুলে যান নি, তবে সেটা অবাস্তব বলে মনে করেন। তিনি আজ চার-পাঁচটি কারখানার মালিক।

একে অবশ্য আমি স্ববিরোধিতা বলছিনে – এখানে এই শিক্ষিত ব্যক্তিটি এক শ্রেণী থেকে অন্য শ্রেণীতে উত্তীর্ণ হয়েছেন – তাঁর শ্রেণীচরিত্র পরিবর্তিত হয়েছে অর্থনৈতিক স্বার্থের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের ফলে। কিন্তু তাঁর স্ববিরোধিতা দেখা যায় রাজনীতির ক্ষেত্রে। তিনি একজন অনমনীয় গণতান্ত্রিক ব্যক্তি। অর্থনীতির প্রশ্নে সমাজতন্ত্রকে এখনও মর্যাদা দেন। কিন্তু উদার গণতন্ত্রের সকল স্বাধীনতা তাঁর আদর্শের কথা হলেও, যে গণ আন্দোলন এই স্বাধীনতা আজ আদায় করতে পারে, বিচক্ষণ রাজনীতিক হিসাবে তিনি সেই সার্বিক সংগ্রামের পথ সযত্নে পরিহার করতে চান নিয়মতান্ত্রিকতার নামে। অকুণ্ঠভাবেই, হয়ত শ্রোতারা কি অর্থে নেবে তা না ভেবেই, তিনি বলেন, “এই জন অক্ষৌহিনীকে একবার উত্তেজিত করে তুললে তারা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে, দেশে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হবে।”

নিয়ন্ত্রণটা কিসের? নিয়ন্ত্রণ হচ্ছে নেতাদের। এবং নেতা কারা? আপনি যদি লক্ষ্য করে থাকেন, দেখবেন এঁরা প্রত্যেকেই হয় অর্থনীতি না হয় রাজনীতির সিঁড়ি বেয়ে ওপরতলায় উঠবার চেষ্টা করছেন এবং স্থায়ী উপার্জনের উপায় হিসেবে স্বনামে কি বেনামে কিংবা সন্তান-সন্ততি বা জামাতাদের নামে, এক কিংবা একাধিক শিল্প-কারখানা স্থাপনের আশা রাখছেন। (দুই একজন যদি এর ব্যতিক্রম থাকেন, তাঁরা হয় শীঘ্রই সে পথ ধরবেন, না হয় ‘বিদ্রোহী’ হয়ে বেরিয়ে আসবেন। এমন ঘটেছেও।) নিয়ন্ত্রণটা হচ্ছে আসলে সর্বসাধারণের ন্যায্য অধিকারের দাবীর উত্তরোত্তর বৃদ্ধির ওপর, আপন উচ্চাকাংখা সাধনের – অর্থনৈতিক প্রসার, শোষণ এবং তা কায়েম রাখবার জন্য শাসনের – স্বাধীনতা। এঁরা আজ গণতান্ত্রিক আদর্শে উদ্দীপ্ত বুর্জোয়া লিবারেল এবং জনসাধারণের সার্বিক সাহায্যে সার্থককাম হলে হবেন আপন শ্রেণীর স্বার্থরক্ষার খাতিরে জাতীয়তাবাদী ফ্যাসিস্ট (তার লক্ষণ কি দেখছেন না এখনই?)।

ঐ ভদ্রলোকটির সমাজতন্ত্রবাদের কি হলো? তিনি সমাজতন্ত্র এখনো চান, কিন্তু ব্যক্তিগত সম্পত্তি উচ্ছেদের কথা শুনলে শিউরে ওঠেন। শুধু ভারী শিল্পের সমাজীকরণ হওয়া উচিত। কিন্তু আমি জানি, তিনি যখন ব্যাংক ও ইন্সিওরেন্স কোম্পানীরও মালিক হতে পারবেন, মূলধনের কোন পরোয়া থাকবে না, তখন তিনি শুধু ভারী শিল্পকে প্রাইভেট সেক্টরেই নিতে চাইবেন না, বরং সকল শিল্পের কার্টেল এবং মনোপলিকেও জাতীয় উন্নতির পক্ষে অপরিহার্য মনে করবেন। এবং আজকের বহিরাগত কার্টেলপতিদের যে বিরোধিতা তিনি করছেন, তখন তিনি তাঁদের সংগে প্রত্যক্ষ না হলেও পরোক্ষভাবে হাত মেলাবেন। তাঁর বিবেক আজ মুমূর্ষু, সেদিন নিহত হবে।

সাহিত্যিকদের কথা বলি। দেশ বিভাগের আগের কথা। আমরা তখন একদিকে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী চেতনায় উদ্বুদ্ধ, জমিদার মহাজনের হাতে শোষিত অগণিত মুসলিম কৃষকের মানবেতর জীবনে বিক্ষুব্ধ এবং শহর সমাজে জীবিকার প্রতিটি ক্ষেত্রে শিক্ষিত হিন্দু মধ্যবিত্তের সংগে প্রতিযোগিতায় জর্জরিত উদীয়মান মুসলমান মধ্যবিত্ত এবং সমগ্র অবস্থাটাকে পাশ্চাত্য জড় সভ্যতার দান বলে তার বিরুদ্ধে মারমুখী। এর মধ্যে আবার মুসলিম সমাজেও উপরতলার সীমিত সংখ্যক সার্থককাম ব্যক্তির স্বার্থপরতায় বিভ্রান্ত। ব্যক্তিগত সম্পদ ও ক্ষমতা সংগ্রহের যে বস্তুনিষ্ঠ সংগ্রাম উপরতলায় চলছিল তা থেকে আমাদের উঠতি বুর্জোয়ারাও বাদ যায়নি। এর সব যে ধনতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থার পরিণাম – তা অতটা স্পষ্টভাবে আমরা বুঝতে না পারলেও এ যে পাশ্চাত্য মেটেরিয়ালিষ্ট অর্থনীতি ও দর্শনতত্ত্বের ফল তা আমাদের কেউ কেউ মোটামুটি আন্দাজ করতে পেরেছিলেন। এঁদের মধ্যে বিবেক যাঁদের সংগ্রামবিমুখ নয় – তাঁরা আর্তনাদ করে উঠেছিলেন এমন এক অবস্থার বিরুদ্ধে :

Ye, materialist civilisation!

the slaves of a dead culture, the bloated exploiting class

take the denouncement of Man to today,

then when time comes

we will kick at the lump of your fettered flesh

and drag you to the threshold of hell,

of this tormented death-torn World today

               you carry the curse :

               Perish

               and be damned!

(ফররুখ আহমদ। ইংরেজী অনুবাদ লেখকের।)

কেন? কারণ :

              “men and women

       – the Stone House

              the prison of Death

the clever garishly whore has opened her

             parlour door with sweet greetings,

someones are ravishing the Earth

            with exploitation and Power

of which the witness is in the dust of

            the royal road where

the three and half cubit bone builds

           the last sepulchre of Humanity.

(ফররুখ আহমদ। ইংরেজী অনুবাদ লেখকের।)

কবিতাগুলো ইচ্ছে করেই আমি ইংরেজীতে বললাম, কারণ আমার মনে হয়েছে আজকের পৃথিবীর সকল শোষিত মানুষেরই আর্তনাদ এ। তা পাকিস্তান হোক ভারত হোক, হংকং কি সিঙ্গাপুর, ম্যানিলা কি জাকার্তা, বার্লিন কি রোম, হার্লেম কি বেডফোর্ড। কিন্তু পাকিস্তান হবার পর কি এই সংগ্রামমুখীতার শেষ হয়ে গিয়েছে? না বৃদ্ধি পেয়েছে?

কোন সমালোচক সম্প্রতি প্রকাশিত এক গ্রন্থে বলেছেন এই কবি অপেক্ষাকৃত পরিণত বয়সে আজ লক্ষ্যস্থলের সন্ধান পেয়েছেন, যেখানে তিনি কামনা করছেন :

“নামুক সেখানে তাওরাত ধারা, নামুক নূরানী আলকোরান

পূর্ণ মুমিন জমায়েত হেথা আনুক আবার নতুন বান।”

(ফররুখ আহমদ)

আসল কথা, যেমন কবি নিজে, তেমনি সমালোচকও এক আত্মপ্রতারণার ফাঁদে পা দিয়েছেন স্বেচ্ছায়। এও এক স্ববিরোধী বিবেকের পলায়নী মনোভাবের কথা।

“মন্দির আজ বন্দীর ঘানি

নিজিত ভীত সত্য, বন্ধ রুদ্ধ স্বাধীন-আত্মার বাণী,

সন্ধি-মহলে ফন্দীর ফাঁদ, আন্ধি-অন্ধকার।

হাঁকিছে নকীব, হে মহারুদ্র, চূর্ণ কর এ ভণ্ডাগার।”

(নজরুল ইসলাম)

এই বলে যে-কবি আমাদের কৃতির ক্ষেত্রে কঠিন সংগ্রামের উদ্বোধন করেছিলেন, তিনিও অবশ্য নির্মম অর্থনীতি-ভিত্তিক সমাজের আসল রূপ ধরতে পারেন নি; কিন্তু বিভ্রান্ত বিবেক হয়েও তিনি শেষ সচেতনমুহূর্ত পর্যন্ত বিকল্পকে সত্য বলে গ্রহণ করেননি :

“ঈমানদার হইয়া কি কেহ বহে শয়তানী বোঝা?”

(নজরুল ইসলাম)

সত্য, আমার মনে হয়, বন্ধনের স্বরূপ সন্ধান এবং মুক্তির উপায় নির্ধারণের জটিল প্রচেষ্টার পথে কোথাও অপেক্ষা করছে। যেহেতু দেশে দেশে, জাতিতে জাতিতে সমাজ তাদের ভিন্ন রূপ নেয় যদিও মূল আবেদন এক। কিন্তু আমাদের সাহিত্যিক, দার্শনিক এবং শিক্ষাদাতারা সে প্রচেষ্টায় কতটুকু সক্রিয় তা আমাদের সাম্প্রতিক সংস্কৃতির ক্ষেত্রে প্রতিফলিত হবে, তা স্বাভাবিক।

নজরুল থেকে যে প্রেরণা নিয়ে ফররুখ আহমদ আমাদের স্বাধীনতা-উত্তর কালের সাহিত্যিক নেতৃত্ব দিতে এগিয়ে এসেছিলেন, পরিপার্শ্ব বন্ধনে বন্দী তাঁর সংগ্রামী বিবেক স্তিমিত-চৈতন্য হলেও তাঁর পরে যাঁরা এসেছেন তাঁরা এই সত্য সন্ধানে কতটুকু দান করেছেন? ফররুখ আহমদের সমকালীনদের কথা বাদ রেখেই সে সন্ধান আমরা করতে পারি।

ধরুন একজনের কথা :

“ধুলো গিলে ভিড় ঠেলে উকুনের উৎপাত উজিয়ে

ক্লান্তি ঠেলে রাত্তিরে ঘুমুতে যাই মাথা ব্যথা নিয়ে।

না-জ্বেলে ক্ষয়িষ্ণু মোমবাতি স্বপ্নচারী বিছানায়

গড়াই, লড়াই করি ভাবনার শত্রুদের সাথে –

হাত নাড়ি লাথি ছুঁড়ি পৃথিবীর গোলগাল মুখ

লক্ষ্য করে। বিবেকের পিঁপড়ে যদি সত্য হেঁটে যায়

পিচ্ছিল দেয়ালে, মন থেকে মুছে নেবে ছোটো খাটো

পাপবোধ অল্প বিস্তরেণ … পোষমানা মূল্যায়নে

পাবো সুখ … দেখবো কি নেড়ে চেড়ে একটুকরো হলদে

নিষ্প্রাণ কাগজে মোড়া আত্মা, সত্যি এক বৃত্তি সেই

আধ্যাত্মিক পিণ্ড …”

(শামসুর রাহমান)

আজকের এক বন্দী স্বল্পবিত্ত মনের বিভ্রান্তির এক আশ্চর্য স্বীকারোক্তি এ। কিন্তু

“শুধু প্রশ্নে বিদ্ধ আমি …

                                … পড়ি খানাখন্দে

আবর্তে তলিয়ে যাই, মাথা ঠুকি পাথুরে গুহায়।

সন্দেহ ক্রমশঃ কেন হতাশায় হয়ে যায় লীন

বুদ্ধির জটিল চৌমাথায়?”

(শামসুর রাহমান)

হতাশা বুদ্ধির এক বন্ধন হয়ে আসে। কিন্তু মুক্তির পথ সন্ধান করতে হয় বুদ্ধির জটিল চৌমাথাতেই, সেখানে এসে কবির সত্য-সন্ধানী মনের প্রাথমিক লক্ষণ – সন্দেহ লীন হতে বসেছে। তারপর কি হয়?

“যেহেতু উপায় নাই ফেরবার আমার সম্মুখে

দুটি পথ অবারিত, আমন্ত্রণে প্রকট চটুল –

গলায় বিশ্বস্ত ক্ষুর কিংবা অলৌকিক বিশ্বাসের …”

(শামসুর রাহমান)

অতএব

“ইচ্ছে হয় মুখ ঘষি খেলনার দোকানের কাঁচে

বড় ইচ্ছে হয় ঘষি দুটি চোখ। …’

(শামসুর রাহমান)

বিশ্ব মানবতার ইতিহাসের প্রেক্ষিতে এ বিক্ষুব্ধ উপলব্ধি নতুন না হলেও আমাদের সাম্প্রতিক সমাজের প্রেক্ষিতে এ ঘোষণা করুণ ঐতিহাসিক।

উপলব্ধি রয়েছে – কখনো তীব্র কখনো স্তিমিত কিন্তু তা বিশ্বস্ত ক্ষুর এবং অলৌকিক বিশ্বাসের আমন্ত্রণের বাইরে কোন নতুন জিজ্ঞাসার ক্ষেত্রে উত্তীর্ণ হয়নি। বুদ্ধির চৌমাথায় হতাশায় আক্রান্ত হয়েছেন কবি। কিন্তু আমি বিশ্বাস করি অলৌকিক বিশ্বাসের আমন্ত্রণ গ্রহণে যে-কবি রাজী নয় বিশ্বস্ত ক্ষুরের ধারকে উপেক্ষা করেই তাঁর বিবেক সত্য সন্ধানের পথে এগিয়ে যাবে।

একই কালের আর একজন কবিকে টানি :

“আমার প্রকৃতি এই, অল্পবিত্ত মানুষের ভীড়ে

ঠেলাঠেলি, সুযোগ শিকারে

সিঁড়ি-বাওয়া ধ্যানে। অনন্ত ক্ষুধার আর একান্ত সজ্ঞান

মিথ্যাচারে

শ্বাপদের শান্তি জ্বলে ওঠে,

আমরা কেউই ঠিক কারো নই।”

(হাসান হাফিজুর রহমান)

সাম্প্রতিক সমাজকে যাঁরা বিচারের দৃষ্টিতে দেখেছেন তাঁরা বুঝতে পারবেন এখানে এই সামান্য ক’টি কথায় সাম্প্রতিক সমাজের মূল সংকটের কথা উল্লেখ করা হয়েছে।

কিন্তু ঠেলাঠেলির সমাজে অল্পবিত্ত মানুষটি ব্যক্তি সীমায় বন্দী – ত্রিশংকু। তাই

“সময়ের দাঁতে উদ্বন্ধনে ঝুলে আছি

ঝুলে আছি আহা ঝুলে আছি”

(হাসান হাফিজুর রহমান)

এবং ইতিমধ্যে তাঁর মনে হয়

                  “সময় আমার নয়,

সাহসে অভ্যাস নেই, ভিটাছাড়া হয়ে তবু

সরবে রোদন করি, ডালভাঙা হতশ্রী গাছের মত

করুণায় বিগলিত হই, মাটিকে নিলামে তুলে

পূজরক্তে দেহকে বাড়াই। আমিও শকুন এক অন্যতর,

আহত মাটির শব খুঁটে খাই, ঘাতকের উচ্ছিষ্টের বেশি

আর চাই না কিছু আপোষের অন্ধ গলিঘরে পলাতক মাথা গুঁজে

জীবনের দাম গুণি আত্ম-পরিচয় ভুলে।”

(হাসান হাফিজুর রহমান)

আত্মবিস্মৃত শকুন-চিত্ততায় সমাজ-সচেতন কবি-মানস তৃপ্ত হতে পারে না। এবং এমন আত্মহননের দিনে প্রস্তাবিত বিবর্তনবাদী শুভবুদ্ধির প্রতিও সে সন্দিগ্ধ :

“তবুও আমরা শুভবুদ্ধির খেয়ালে

নিশ্চুপ সবে, আসবেই ভালো, স্বভাবে;

আস্থায় বাঁচি, এর বেশী আর কে ভাবে!”

(হাসান হাফিজুর রহমান)

বুদ্ধির চৌমাথায় এসে এ-কবির সন্দেহ হতাশায় লীন হয় নি। বিবর্তনের অর্থাৎ স্বভাবের টানে সমাজের সংকট দূর হবে এমন সত্যি তিনি মনে করেন না। হতাশার দেয়ালে তিনি একটা ছিদ্র সন্ধান করেছেন – তাতেই চোখ রেখে তিনি দেখতে পান :

“মাটি তুমি আর আমি একাকার অস্ফুট একি ধৈর্যে

বিস্ফোরণের আগ্নেয় মুখ নিশ্চুপ যেন শৌর্যে

আকাশ-বাতাস থেকে, মাটির রসের থেকে

তোমার প্রাণের গানের বাণীর, আমার দেহের

                         রক্তের ফোঁটা এ ফুল

অনিবার্য, অবধারিত এ ফুল তোমাকে দিলাম।”

(হাসান হাফিজুর রহমান)

এ অনিবার্যতার বিশ্বাস কবির কতটা বুদ্ধিতে নিষিক্ত তা জিজ্ঞাসা না করে এইটুকু শুধু বলা যায় যে, এমন এক উৎসর্গের মধ্যেই কবি তাঁর জীবনের সার্থকতা খুঁজছেন। এইভাবেই সংকটের সীমানা উত্তীর্ণ হতে চাইছেন। এ একটা ধারার কথা – চেতনা এখানে বুদ্ধির চৌমাথায় এসে একটা পথ নেবার জন্য চঞ্চল-চরণ হয়েছে, হতাশ হয় নি, অর্থাৎ বন্ধনকে স্বীকার করতে চাইছে না। বিবেকের বন্দীত্ব অস্বীকৃত হচ্ছে।

একজন কবির কথা বলবো, যার প্রকাশিত একমাত্র কাব্যগ্রন্থে রচিত সমাজ-চেতনার প্রত্যক্ষ সংবাদ লক্ষ্য করা যায়। ইনি আপন ব্যক্তিসত্তায় নিবদ্ধমন, উল্টেপাল্টে শুধু নিজেকেই দেখছেন। কিন্তু বাইরের চোখ দু’টি তাঁর অন্ধ নয়, মনে হয় বাহিরের সংঘাতের তীব্রতাই তাঁকে আপন হৃদয়ের অলিগলিতে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায়। কখনো হৃদয়ের জানালা দিয়ে পৃথিবী দেখেন তিনি – কখনো তীব্র অবিশ্বাসে :

“কিন্তু যারা প্রাসাদে যায় সেই

সংগে আলো লণ্ঠনের দোলা

এবং কেউ চতুর্দিকে নেই

তারাই জানে সব কিছু যায় ভোলা।

লণ্ঠনে তার রঙ্গীন আলো পড়ে

নকশা করা দেয়ালপটে আর

সামিয়ানার চিত্রাবলি জুড়ে

নিয়তি আর রাজার সমাচার

তারাই জানে সিঁড়ির পরে সিঁড়ি

ঊর্ধ্বে শুধু উঠেছে একরোখা

পশ্চাতের পদধূলির ভার

এড়িয়ে গেছে কুটিল কালো রেখা …”

(সৈয়দ শামসুল হক)

নানা প্রতীকে পরোক্ষ থাকতে চেয়েও কবির বিবেক শেষ পর্যন্ত এক ইচ্ছায় উত্তীর্ণ হয়েছে – তা বুদ্ধির আলোয় প্রদীপ্ত না হলেও হৃদয়ের বেগে উত্তীপ্ত

                       “পরিপূর্ণ শস্য পতনের

সবুজ গোধূলিকালে অতিক্রান্ত পাখীদের মত

মৃত্যু হোক যত দেবতার।”

(সৈয়দ শামসুল হক)

এরপর যে কবির উল্লেখ করবো তিনিও পূর্বোক্ত দু’জনের সময়ে এসেছেন, তাদের পরিপার্শ্বে বেঁচেছেন, বাস করেছেন এবং আপন সত্তায় বিবর্তিত হয়েছেন।

ন’বছর আগে প্রকাশিত তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থে তাঁর বিশ্বাসী মনের চিড় যে গভীর হচ্ছে তা স্পষ্ট হয়ে উঠছিল দেখেছিলাম। কিন্তু দ্বন্দ্বে দ্বিধায় এবং ব্যর্থতাবোধে তিনি ভেঙে পড়েন নি, বা শুধু হৃদয়ের দরোজা দিয়ে আপন ব্যৈক্তিক কন্দরে প্রবেশ করেন নি। করলে যে কবি হিসেবে তিনি অপরাধ করতেন, তা বলিনে। তবে তাঁর কবি-চরিত্র অন্যরূপ নিতো তা সত্য।

১২-১৪ বছর আগে তিনি যখন লিখেছিলেন :

“মজুরের মুষ্টিবদ্ধ দৃঢ় মুক্তি অঙ্গিকার

সাধুশ্রম কৃষকের অফুরন্ত শস্য ফলাবার

বয়ে আনে আশার ইঙ্গিত

গড়ে তোলে শান্তি ঘেরা মুক্ত জীবনের দৃঢ় ভিত।”

(আতাউর রহমান)

তখন কিন্তু কোন বিজ্ঞানী ব্যক্তি তাঁকে এ বলে সাবধান করে দিতে পারতো যে, আপনার আশা বাস্তবতার সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে এবং এর পরিণাম নিদারুণ হতাশা।

কেউ তাঁকে সে-কথা বলে দেয়নি, তাই কিছুকাল তাঁর কেটেছে গভীর প্রত্যাশায়। কিন্তু কবি যদি সমাজ-বিমুখ হতেন, পলায়নপর ঐতিহ্যবাদী হতেন তা হ’লে ব্যর্থতার মুখে পড়েও তাকে অস্বীকার করতে চাইতেন – কেননা অতীতের কালান্তরে আমরা যে একদা জয়ী হয়েছিলাম তাই তাঁকে এক অপূর্ব ডিল্যুশনে ডুবিয়ে রাখতে পারতো; ব্যক্তিকেন্দ্রিক যদি হতেন আপন ইন্দ্রিয়ানুভূতি এবং হৃদয়ের নানা বর্ণ নিয়ে খেলা করতেন নিজের সংগেই। কিংবা অন্ধকারে ভুতুরে জায়গা দিয়ে যাবার মত করে বিরোধের দিকে চোখ বুঁজে তাকে অস্বীকার করতে চাইতেন বুকে হাত চেপে। কিন্তু তিনি তা করেননি। তাই এক সময় লিখেছিলেন :

“রৌদ্রদগ্ধ পৃথিবীতে ঝড় আসে এলোচুলে বয়ে

মুমুর্ষু এ উপগ্রহে উর্বর বর্ষার প্রতিশ্রুতি”

(আতাউর রহমান)

ক্রমশঃ সে দৃষ্টবিভ্রম কেটে যেতে লাগলো – বিলম্বিত বর্ষা কবিকে নতুন জিজ্ঞাসায় উত্তীর্ণ করে গেল :

“সূক্ষ্মতার ধ্যানে ধ্যানে মনগুলি অথর্ব মৃত তীর্থভূমি

সরল সহজ কথা ঘোলা করি তর্ক আর যুক্তির কাদায়

কাগজে-কলমে শুধু ঘোরে ফেরে বিপ্লবের নাম – হাস্যকর!”

(আতাউর রহমান)

এ জিজ্ঞাসা আর এক নতুন প্রশ্নের সামনাসামনি এনে দাঁড় করালো কবিকে;

“মুমুক্ষু আমারও মনে বহুবার এসেছে প্রত্যয়

রাত বুঝি শেষ হলো – মুক্তির মনজিল এলো কাছে।

সে প্রত্যয় ভেংগে গেছে দেখেছি যখন

সেই সব প্রতিশ্রুতি কুটিল মরিচী।”

(আতাউর রহমান)

বিবেকের সন্ধিক্ষণে এসে বন্দী-চৈতন্য কবি বার বার অধৈর্য

হয়েছেন :

“কতদিন – আর কতদিন

কুড়াবে কেবল – চিন্তার ঝিনুক

আর কল্পনার দুর্লভ পালক?”

…                    …

“বারুদের গন্ধে ভরা রাজপথে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে

উদার ঊষার জন্য গতকাল নির্ঘুম কাটাবে?”

(আতাউর রহমান)

এর পরও যখন বর্ষার দেখা পাওয়া যায় না তখন মন বিধ্বস্ত হয়, নৈরাশ্য ভবিষ্যতের পথ ঢেকে দেয়, কিংবা সংগ্রামবিমুখ হয়ে মন আপোষ করে ফেলে বঞ্চনার সংগে। কিন্তু এ কবির ক্ষেত্রে হয়নি তা :

“বঞ্চনার দেবতাকে মেনে নিতে এখনো কুণ্ঠিত

মিথ্যার কোরাস গানে আজো আমি ধরিনিকো তাল

গড্ডালিকা স্রোতে আমি ভাসাইনি মানব সত্তাকে।”

(আতাউর রহমান)

এমন ঘোষণা আমাদের খুব কম লোকই করতে পারে। কেননা বঞ্চনার দেবতাকে মেনে না নেবার সাহস শুধু দারুণ প্রত্যয়ী ব্যক্তিরই থাকতে পারে – এ কবির তা আছে কিনা জানি না। তবে মেনে যে নেননি তা আমি দেখতে পেয়েছি। আর তিনি যে “কোন বিচ্ছিন্ন  বন্ধুকে” তাঁর হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলেছিলেন :

“সূর্যহীন পৃথিবীতে অন্ধকার প্রেত মেলে ডানা

তস্কর ঘাতক গুপ্ত পাকা ধানে মই দেয় আজও।

এ-নৈরাজ্যে আমাদের প্রাণ-সম্মেলন

একদিন এনে দেবে সুমহৎ জীবনের সুখ”

(আতাউর রহমান)

সে হাত এখনো কেউ না ধরলে তা সরিয়ে নেবারও সময় আসেনি।

*                  *                  *

ওপরে যাঁদের কথা বললাম, তাঁদের বিবেকচৈতন্যের জন্ম হয়েছে রবীন্দ্র-নজরুলের ফুৎকারেই এবং স্বভাবতঃই তাঁরা পরবর্তীকালের জীবনানন্দ ও ফররুখের সমাজের মাইনর অংশীদার হিসেবে সমবিবেকী অনেকটা। কিন্তু এমন একজন কবির কথা বলতে পারি যাঁর বিচারবুদ্ধির বয়েস পনের বছরের বেশি নয়; অতএব, সমাজচেতনা পিতার সংসারে পুত্রের সংসার চেতনার মত। পিতার বিরাট স্বপ্নে তাঁর অংশ নেই। ব্যর্থতায়ও ভেঙেপড়া নেই। ভীষণ সংকটের বড় কি ছোটোখাটো বহিঃপ্রকাশকে সাময়িক দুঃখের ছায়া হিসেবে ভেবে নিয়ে সে-ছায়াতে বসেও বিকেলের তেল ঝাল-মুড়ির স্বাদ গ্রহণ করতে পারেন এবং পিতার বা মায়ের মুখে বিষণ্নতা দেখে বেদনা বোধ করতে পারেন। এর চাইতে গভীরে গেলে হয়ত মুড়ির স্বাদ উবে যাবে, কিংবা দুঃখের ছায়া সাপের চাইতেও বিষাক্ত মনে হবে।

তা নিয়ে আমার কোন ভাবনা নেই, কিন্তু আমার বক্তব্য হচ্ছে এই যে, তারা পলায়নী মনোবৃত্তি থেকে এমন আচরণ করছে না, আসলে তিনি আমাদের সেই সব বঞ্চনায় দেবতা কিংবা পাকা ধানে মই দেওয়া তস্কর ও গুপ্ত ঘাতকদের চেহারাই ভালো করে দেখেননি। (আমরা নিজেরা আরো দেখেছি এই জন্যে যে, ঐ সব ঘাতকদের হাত মজবুত হয়েছে আমাদেরই হাতিয়ারে।) না দেখলেও, এ কবি তাদের অস্তিত্ব সম্পর্কে, তাদের সৃষ্ট হৃদয়হীন সমাজ সম্পর্কে মোটেই অচেতন নন। কিন্তু এই চেতনা তাঁর সকল পারিপার্শ্বের মধ্যে ছড়িয়ে থাকে, মায়ের বেদনার্ত মুখ যেমন শিশুর সমগ্র পৃথিবীকে ক্লিষ্ট করে তোলে, তেমনি। তখন সংসারকে অরণ্য মনে হয় এবং

“একাকি আমিই শুধু, আমি যেন কেমন অলস

বনে কারো দুঃখ নেই আমি ছাড়া, আমারই অসুখ।”

(আল মাহমুদ)

দিনও ভয়ানক হয়ে ওঠে কখনো কখনো। বাতাসে বিশ্বাস থাকে না, আঙিনার ধবল পাথরে দোজখের আগুন ঠিকরে ওঠে। তখন এ পৃথিবীতে বসন্ত আনার কথা ভাবতে শংকা জাগে :

“নির্জন নির্দয় দেশে পেটে নেবে আমার সন্তান

আঙিনায় রক্ত-ঢেলে বসন্তকে ফেরাবে কি নারী

জলের প্রার্থনা ছেড়ে আকাশে তুলবে তরবারি?”

(আল মাহমুদ)

কিন্তু এমন কঠিন প্রশ্ন করে তার জবাবের জন্য বসে থাকার ধৈর্য জন্মায়নি, – তাই,

“তাই হোক! তুমি এসো কোমরে পেঁচিয়ে নীল শাড়ী

দুঃখের ঘরকে করো শোকাত্তীর্ণ প্রাণের বাগান।”

(আল মাহমুদ)

এমন স্বপ্নের ছিদ্র দিয়ে ক্রমশঃ চৈতন্য স্বচ্ছ হয়ে আসে, প্রত্যাশী জীবনকে মুখোমুখী দেখে কবি মেতে ওঠে :

“কে তুমি প্রতিজ্ঞাবদ্ধ আমার বয়েসী

হাওয়ায় নদীর গন্ধ পাওয়া যাবে, এমন আশায়

এ কোন শুকতার গভীরে এসেছো?

তাকাও এখানে কারো মুখ নেই, দেহ নেই, সমস্ত কিছুই

নিষ্ফলা বালুতে বিলীন। ১৯৬২টি উষ্ট্র যায়

শূন্য পিঠ নির্গন্ধ বালুতে

খৃষ্টের মৃত্যুর পর একে একে মন্থর নিয়মে।”

(আল মাহমুদ)

কিন্তু বুদ্ধির দরোজা খুলে দিয়ে এ অতিথিকে গ্রহণ করা হয় না। কারণ

“যতই অসহ্য হই ঘাম ঝরে তত

ফুটপাত তেতে ওঠে সারাদিন রোদে

সন্ধ্যায় ঘরে ফিরি ক্ষতবিক্ষত …

তারপর নষ্ট এক গণিকার মত

অন্ধকার ডাক দেয় নিবিড় প্রবোধে :

আসুন বাবুজী।”

(আল মাহমুদ)

অন্ধকারের এই প্রবোধ যে কবিকে বুদ্ধির রৌদ্র থেকে চিরকাল আগলে রাখবে এমন ভাবার কোন কারণ নেই।

এতদূর এসেছি শুধু আমাদের মধ্যে সমাজ-চেতনার নানা স্তর সম্পর্কে দৃষ্টান্ত দেবার জন্য। উল্লেখিত কবিদের কাব্যকৃতি সম্পর্কে পণ্ডিতী করার জন্য নয়।

সমাজ-চেতনায় অবশ্য একটি দিক সম্পর্কেই আমি কথা তুলেছি, তা হচ্ছে : যে-দ্বন্দ্ব মানুষের সব স্বাধীনতাকে সীমিত করছে, যার একদিকে রয়েছে ধনতন্ত্রের উপাসক এবং তাদের স্বার্থবাহীরা অন্যদিকে সাধারণ মানুষ – সে সম্পর্কে আমাদের নিতান্ত সাম্প্রতিক কবিমন কতটা সচেতন এবং সে দ্বন্দ্বে সে নিজেই বা কি অবস্থান গ্রহণ করছে। আমি অবশ্য এ মনে করি না যে কবিকে একটা অবস্থান নিতেই হবে, তবে যে-কবি মানুষের সংগে এক শ্রেণীভুক্ত বলে নিজেকে মনে করে, সে তার অজ্ঞাতেই একটা অবস্থানের দিকে এগিয়ে যায়, যেমন একটি পরিবারের লোক নানা চিন্তা-ভাবনা না করেই পরিবারে একটি ভূমিকা গ্রহণ করে থাকে।

আমাদের উল্লেখিত কবিরা সবাই অনুভূতিতে তীক্ষ্ন, তাই ব্যক্তি-মানসের তীর্থযাত্রী হয়েও সামাজিক বাস্তবতা সম্পর্কে সংবেদনশীল। যান্ত্রিক সভ্যতার চারিত্র, নাগরিক জীবনের নৈর্ব্যক্তিক টানাপোড়েনই তাঁদের পরিপার্শ্ব চেতনার আঙিনা থেকে টেনে নিয়ে আসে আধুনিক আত্মার যন্ত্রণার উৎস সন্ধানে। কবি যদি আত্ম-প্রতারণায় নিমজ্জমান না হয়ে থাকেন, যদি এই বন্দী সমাজের মানব-বিরোধী শক্তির সংগে আপোষ না করে বসেন, কিংবা হতাশায় লীনচৈতন্য হয়ে ভবিষ্যতের হাতে আপন জনসমাজের কল্যাণচিন্তা না ছেড়ে দেন তবে এক কঠিন আপোষহীন বিবেকচৈতন্যে উত্তীর্ণ হতে তিনি বাধ্য। তাঁর কাব্যের শরীরে সে চৈতন্য স্পিরিটের আগুনের মত অদৃশ্যপ্রায় হয়েও তাপ ছড়াতে পারে। এবং তাপ-ছড়ানো কবি-জীবনের আদর্শ কিনা, তা বিশেষ করে লিখে  রাখবার প্রয়োজন হয় না।

Prufrok-এর কবিতায় ইলিয়ট এমনি এক পরিপার্শ্ব চেতনা থেকে ১৯২০-এর কবিতায় সামাজিক বাস্তবতার ভেতর দিয়ে যে চেতনায় উত্তীর্ণ তা তাঁকে Waste Land-এর কালে এক শ্লেষোত্তীর্ণ অনুধাবনের বিন্দুতে দাঁড় করিয়ে যায়। এইখানে দাঁড়িয়ে তাঁর যে প্রত্যয়ের উদ্বোধন তা পরবর্তীকালে, অনেকের বিস্ময়ের কারণ ঘটিয়েই, ইলিয়টকে ধর্মের পথে সত্য-সন্ধানে পরিচালিত করে। এই পরিণতি ‘নর্মের’ দিক দিয়ে বাঞ্ছনীয় কিনা তা এখানে তুলবো না, শুধু পরিণতির কথা উল্লেখ করবো।

ফররুখ আহমদকে ইলিয়টের সামনে রেখে বিচার করা যায়। Waste Land I Hollow Man-এর দুঃস্বপ্নকে ‘সাত সাগরের মাঝিতে’ বার বার চমকে উঠতে দেখি। দেশ ও তার জন-জীবনের রোগ ধরা পড়ছে, কিংবা রোগের লক্ষণ ধরা পড়ছে এবং তা থেকে যে হতাশা উদ্ধত মাথা তুলে দাঁড়াচ্ছে তার বিরুদ্ধে আশ্বাস সন্ধানে দু’জনেই ধর্মীয় প্রেরণার দিকে, ঐতিহ্যের দিক মুখ ফিরিয়েছেন। ইলিয়টের Four Quartet-এ :

                              …. and the rest

is prayer, observance, discipline, thought and action.

                                          (The Dry Salvage)

ফররুখ আহমদের সুরও অবিকল তাই তা আগেই বলেছি। লক্ষণীয় যে দু’জনেই মানবতাবাদকে, সমাজের জরাকে মানুষের ধর্মীয় নীতি-বোধকে উন্মেষের সাহায্যে ব্যবহার করেছেন সার্বিকভাবে। তবে তা ক’রে তাঁরা সত্যি তাঁদের সত্যাশ্রয়ী বিবেককে মুক্তি দিতে পেরেছেন কিনা, সে সম্পর্কে আমি নিঃসন্দেহ নই।

ফররুখ আহমদের পর আর কেউ তাঁর প্রত্যয় নিয়ে এ পথে এগোননি। প্রত্যয়ের অভাব তার একটা বড় কারণ বৈকি। কিন্তু তার চাইতে বড় কারণ হলো বুদ্ধির চৌমাথায় দাঁড়িয়ে কেউ এ পথ নেয়াকে বিচার ও বিবেকসম্মত মনে করেন নি।

এক সময় হাসান হাফিজুর রহমানের সদ্য প্রকাশিত ‘বিমুখ-প্রান্তর’ সম্পর্কে কোন কবি বলেছিলেন তাতে বুঝি ইলিয়টের Waste Land-এর ছায়া পড়েছে। আমি কিন্তু আমাদের বেশির ভাগ সাম্প্রতিক কবি সম্পর্কেই এ কথা বলতে চাই। তবে Waste Land না পড়েও তার ছায়া কারো কবিতায় পড়তে পারে। কেননা আমাদের সমাজ এবং ইলিয়টের সমাজের মধ্যে আজ বস্তুগত পার্থক্য, যাকে quantitative difference বলা হয় তা থাকতে পারে কিন্তু মৌল গুণগত অর্থাৎ qualitative পার্থক্য নেই, যেটুকু আছে তা স্তর বা পর্যায়ভেদের। একই ধনতান্ত্রিকতায় আমাদের উভয় সমাজ আক্রান্ত। ‘The characteristics of mechanical civilisation and urban squalor provide the necessary starting  point for Eliot’s investigation of distress peculiar to the modern soul.’ (Maxwell, The Poetry of Eliot.)

এই কথা কি শামসুর রাহমান, হাসান হাফিজুর রহমান প্রমুখ কবিদের পক্ষেও খাটে না? (উদ্ধৃত বক্তা এখানে mechanical civilisation বলেছেন – কথাটা আসলে ধনতান্ত্রিক সভ্যতা। চুলোকে চুলো বলতে চক্ষুলজ্জার কিছু নেই।)

সমাজ নিয়ে এত বাক-বিস্তার করে আমি এই কথা বলতে চাইনে যে কবিকে মরালিস্ট হতে হবে, যেমন হয়েছিলেন ইলিয়ট, ফররুখ আহমদ এবং এক কালের সমাজবাদী কবিরা, লাস্কি যেমন বলেছেন কবিদের কাজ হলো : Ôgiving their fellow citizens counsel on the vital issues they have to solve.Õ

 এমন একটা দৃষ্টিভংগী ডগ্মায় পরিণত হলে কবিতার শরীর ও মন কি ভাবে আড়ষ্ট হতে পারে তা আমরা আমাদের কালেই দেখেছি। শুধু এই দৃষ্টিভঙ্গী নয়, বস্তুতঃ ডগমা কখনোই কাব্যের জন্য কল্যাণকর নয় সে ডগমা কোন আদর্শগত হলেও নয়।

আমি যে কবির কথা ভাবি সে হলো আধুনিক সমাজের অবিচ্ছেদ্য অংশ শিক্ষিত, আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের সংগে পরিচিত, ঐতিহ্য, রাজনীতি ও অর্থনীতি সম্পর্কে অবহিত এবং তীক্ষè সংবেদনশীল অথচ বিশ্লেষণী মনের মালিক। এই সব মিলিয়ে তার সমাজ-চৈতন্য রচিত তার সামাজিক কর্তব্যবোধ বিবেক সংহত। এমন এক কবি যখন সৃষ্টিশীলতায় উদ্বুদ্ধ হয়, তখন তার কবিতায় আমরা সমাজের হৃদপিণ্ডের স্পন্দন শুনতে পাই। q

[প্রথম প্রকাশ : সমকাল, সম্পাদক : সিকান্দার আবু জাফর, অষ্টম বর্ষ, ‘কবিতা সংখ্যা’, ১৩৭১-৭২ বঙ্গাব্দ, ডিসেম্বর ১৯৬৫ খ্রিষ্টাব্দ]