বর্ষণকাল

হারাধন ও তারাভূষণের মতো অনাদি দত্ত হয়তো অখিলের শোকও চাপা দিতে পারতেন। দিয়েছিলেনও। সমস্ত ভূসম্পত্তি বিক্রি করে হলেও কালাগাজির দৌড়ের শেষ দেখতে চেয়েছিলেন। কিন্তু মনটা ভেঙে গেল বন্যার পর। এক বছর বিরতি দিয়ে নীলাক্ষিতে আবার বান ডাকল। বান প্রতিবছরই ডাকে। মা যেমন সন্তানকে স্নান করায়, নীলাক্ষিও তেমনি করায় দু-পারের জনপদ। বছরে একবার, কখনোবা দুবার। প্রতি বর্ষায়

কোথাও না কোথাও বাঁধ ভাঙবেই। ভাঙা ছাড়া আসলে উপায় থাকে না। ভারতের লুসাই পাহাড় থেকে নীলাক্ষির উৎপত্তি। কাঠিমারি দিয়ে বাংলাদেশে ঢুকে গগনতলা, কেশরদি, গোকূলনগর, কলিমাবাদ ও চরদুয়ারার বিস্তর গ্রামগঞ্জ পাড়ি দিয়ে বঙ্গোপসাগরে বিলয়। উজানের দিকে নীলাক্ষির বুকটা অজগরের লেজের মতো, ভাটির দিকে পেটের মতো। শুকনো মৌসুমে উজানের কোনো কোনো জায়গা হেঁটেও পার হওয়া যায়। কিন্তু বর্ষা মৌসুমে বাধে বিপত্তি। লেজের মতো সরু পথ দিয়ে একসঙ্গে এত জল আদিমাতা সাগরের কোলে কী করে গড়াবে? ভাঙনটা তখন অনিবার্য হয়ে পড়ে। ভাঙতে ভাঙতে ভাসিয়ে দেয় বিস্তীর্ণ জনপদ। দু-তিন বছর, কখনো চার-পাঁচ বছর পরপর এমন ভাঙন শুরু হয়, মানুষজনের আর দিশা থাকে না। নীলাক্ষি তখন ধাবমান গোখরার রূপ নিয়ে বিষ ঢেলে হরণ করতে থাকে বাড়িঘর, হাঁসমুরগি, গরুছাগল, গাছবিরিক্ষি আর ক্ষেতগেরস্তি। রেয়াত দেয় না হাটবাজার বা মন্দির-মসজিদও। মওকা বুঝে হরণ করে মানুষজনও।

সেবার প্রথম দফায় টানা সাতদিন তুমুল বৃষ্টি হয়েছিল। গোখরার মতো ফুঁসে উঠেছিল নীলাক্ষি, জটারা ও পশ্চিম সীমান্তের নদী অবেহা। পাঁচ-ছয় বছরে এই ত্রিনদীর এমন সর্বনাশা রূপ দেখা যায়নি। মধুগঞ্জের উত্তরে দুটি স্থানে অবেহার বাঁধ ভেঙে তলিয়ে গিয়েছিল কাঠিমারি মেলাতলিসহ মধুগঞ্জ ইউনিয়নের চার-পাঁচটি গ্রাম। নীলাক্ষির বাঁধ প্রথমে ভাঙে রাজারখিলে, তারপর শবরিকান্দি ও কেশরদিতে এবং তারপর জগৎপুরে। তলিয়ে গিয়েছিল বিস্তর বাড়িঘর, রাস্তাঘাট, হাটবাজার। বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল চাঁদমারি-উজানগাঁ রেল যোগাযোগ। তারপর ভাঙে জটারার বাঁধ। প্রথমে ভাঙে গগনতলা থানার কাছে। তলিয়ে যায় গগনতলা বাজার ও আশপাশের প্রায় সবকটি গ্রাম। পরে ভাঙে ভাটির আরো চারটি স্থানে। জটারার উত্তরে বেনোজল ঢোকার জন্য তো বাঁধ ভাঙা লাগে না। জামগড়া থেকে নেমে আসা ধুলানির খাল রাজাকাটার প্রান্তর হয়ে জটারায় মিশেছে। ওপারের বনকরা, জামগড়া, মাতারাপুরা, সুন্দরটিলা, নিখিলগড় এবং এপারের উজানগাঁ, বেতুয়ানি, বাইশকোপ ও রাজাকাটার প্রান্তরের তাবৎ বৃষ্টির জল এই খাল দিয়ে জটারায় ঢোকে। বর্ষায় জটারার জল যখন বাঁধ ছুঁইছুঁই করে, বৃষ্টির জল ঠেলে ধুলানির খাল দিয়ে উত্তরে ঢুকতে শুরু করে বেনোজল। ভাসিয়ে দেয় মাঠঘাট, তলিয়ে দেয় উজানগাঁ-গগনতলা রেলসড়ক। উজানগাঁর উত্তর অংশটা উঁচু। বেনোজল মাঠে ঢুকলেও সহজে বাড়িঘরে ঢুকতে পারে না। কিন্তু নীলাক্ষি সেবার এতটাই ক্ষেপে উঠেছিল যে উঁচু-নিচুর বাছবিচার রাখেনি। উজানগাঁ স্টেশনের উত্তরে বেড়িবাঁধের এপারে কাস্টমস অফিস, ওপারে চেকপোস্ট। যাতায়াতের সুবিধার্থে ওখানটায় বাঁধটা কাটা। নীলাক্ষি ফুঁসতে ফুঁসতে নয়নচর ভাসিয়ে কাটা বাঁধের কাছে ঠেকেছিল। কাটা স্থানে ফেলা হয়েছিল বালুর বস্তা। লাভ হয়নি। নাগিনী নীলাক্ষির বিষাক্ত নিশ্বাসে উড়ে গিয়েছিল বালুর বাঁধ।

এক সপ্তাহ দম নিল বৃষ্টি। এই ফাঁকে কাটা বাঁধে ফেলা হয় আরো বালুর বস্তা। তারপর আবার শুরু হয় তুমুল বৃষ্টি। আবার ফুঁসে ওঠে নীলাক্ষি। এবার ভাঙনের মুখে পড়ে দত্তবাড়ির পেছনের বাঁধটা। ওখানটায় তো নীলাক্ষির কুম। কুমের মুখটা একে তো সরু, তার ওপর ঢালু। ঢালু বাওয়া জল কুমে পড়ে চরকির মতো ঘুরতে থাকে। ঘুরতে ঘুরতে সৃষ্টি করে বিশাল ঘূর্ণি। ঘূর্ণির মধ্যিখানে সৃষ্টি হয় গভীর সুড়ঙ্গ। তাকালে বুকটা তড়াক করে ওঠে। মনে হয় ওই সুড়ঙ্গপথে গোটা উজানগাঁ ঢুকিয়ে দেওয়া যাবে। ঈশ্বরীটিলা থেকেও শোনা যায় ঘূর্ণির ডাক। ঘূর্ণিটা আগে ছিল কুমের মুখে। প্রথম দফার বন্যায় সরে এসেছিল খানিকটা ভাটিতে, পুবের বাঁধের কাছে। ঘূর্ণিস্রোতে ভেঙে পড়ছিল বাঁধ। অস্থির হয়ে উঠেছিলেন অনাদি দত্ত। বাঁধটা ভাঙলে পূর্বপুরুষের স্মৃতিচিহ্ন নিশিমহল টেকানো যাবে কি না সন্দেহ। কিন্তু নদীর লীলা  বোঝা  দায়।  কোথায়  ভাঙে  কোথায়  গড়ে,  তার  কোনো ঠিকঠিকানা থাকে না। দ্বিতীয় দফার বন্যায় ঘূর্ণিটা আবার ফিরে গেল কুমের মুখে। এ-যাত্রায় রক্ষা পেল ভাঙনোন্মুখ বাঁধটা। তবু নিশ্চিন্ত থাকতে পারছিলেন না অনাদি। তার তো শত্রুর অভাব নেই। কেউ যদি রাতের অন্ধকারে বাঁধটা কেটে দেয়! জলের যা চাপ, একটু ফাঁক পেলেই গোটা বাঁধ ধসিয়ে দেবে। বাতেন গাছিকে রেখেছিলেন বাঁধ পাহারায়। বাড়িতে থাকলে নিখিলকেও রাখতেন। বৃষ্টি শুরুর আগেই সপরিবারে ভারতে চলে গেছে নিখিল। সঙ্গে নিয়ে গেছে তারাভূষণের বউ-বাচ্চাকেও। ত্রিপুরার আম্বাসায় জায়গা কিনেছে। আর কখনো ফিরবে না। সঙ্গে সুধনও গিয়েছিল। ওদিকের সব গুছিয়ে চারদিন পর ফিরেছে। বাতেনের সঙ্গে তাকেও বাঁধ পাহারায় রাখা যেত; কিন্তু তার আবার ভূতের ভয়। রাত ন’টা বাজলে একা উঠানেও নামে না। বাবা খুন হওয়ার পর ভয়টা দ্বিগুণ বেড়েছে। তাছাড়া তখন তার বউ অসুস্থ ছিল বলে সে বাড়ির বাইরে কোথাও যাচ্ছিল না।

বাতেন আশ্বস্ত করেছিল, কুনু চিন্তা কইরেন না বাবু, আমি একলাই পাহারাত থাকুম। কিচ্ছু অইতো না। অনাদি দত্ত আশ্বস্ত হয়েছিলেন। বাতেন তার বিশ্বস্ত। উজানগাঁর যে-কজন মানুষের কাছে তিনি মনের কথা ব্যক্ত করেন বাতেন তাদের একজন। শিঙার মাঠের দুই কানি জমি তার কাছে বর্গা দেওয়া। দেবীর পুকুরপাড়ের আটটি খেজুরগাছ তাকে বিনা শর্তে দিয়েছেন। মৌসুমে গ্রামের প্রায় সবকটি খেজুরগাছ বাতেন একাই কাটে। রসের অর্ধেক তার, অর্ধেক গাছমালিকের। দেবীর পুকুরপাড়ের আটটি গাছের সব রসই তার। অনাদিবাবু কখনো দাবি করেন না। চাষাবাদের সময় ছাড়া দিনের অর্ধেক সময় বাতেনের দত্তবাড়িতেই কাটে। নানা ফুটফরমাশ খাটে। সন্ধ্যায় তিন ব্যাটারির টর্চটা নিয়ে চলে যায় বাঘামামার খানকায়। রাতের ট্রেন স্টেশনে ঢুকলে শেকাসহ এসাকের দোকানে ঢোকে। টিভি দেখতে দেখতে চা খায়, বিড়ি ফোঁকে আর বাঘামামার নানা কেরামতির কথা প্রচার করে। ঘড়ির কাঁটা ঠিক ন’টার দাগ ছুঁলে বাড়ির পথ ধরে।

বাতেনের আবার মাছের নেশা। বর্ষা মৌসুমে রাতে সে ঘরে থাকে না, কোঁচ নিয়ে ঘুরে বেড়ায় শিঙার মাঠ কিংবা রাজাকাটার প্রান্তরে। বাপের আমলের চাম্বল কাঠের একটা কোশা আছে। সারা বছর বাড়ির পেছনে জমিনের কোনায় অযত্ন-অবহেলায় পড়ে থাকে। মাঠে বেনোজল ঢুকলে ধুয়েমুছে নতুন করে আলকাতরা লাগায়। রোজ রাতে বেরিয়ে পড়ে কোশাটায় চড়ে। রাতভর কোঁচে মারা মাছ নিয়ে সকালে হাজির হয় স্টেশনে। ড্রাইভার, গার্ড, টিটি কিংবা চাঁদমারির ব্ল্যাকাররা কিনে নেয়।

সেদিন সন্ধ্যার পরপরই টর্চটা নিয়ে বাঁধ পাহারায় চলে গিয়েছিল বাতেন। বাঁধের বাঁশঝাড়টির তলায় বহু পুরনো একটা একচালা। ভেতরে উইপোকায় খাওয়া একটা চকি। দত্তবাড়ির ছেলেপিলেরা দিনের বেলায় চকিটায় বসে মালাঠোলা খেলে। রাতে সাপখোপের ভয়ে কেউ এদিকটায় আসে না। একচালার চকিটায় বসে বাতেন বিড়ি ফুঁকছিল আর কতক্ষণ পরপর বেরিয়ে ডানে-বাঁয়ে টর্চ মারছিল। সারাদিন তুমুল বৃষ্টি হয়েছে। আকাশ দেখে মনে হচ্ছিল রাতে আবার কাছা মেরে নামবে। আকাশের দিকে তাকিয়ে মাঝেমধ্যে বাতেন গেয়ে উঠছিল –    ও বাবা ভাণ্ডারি, তুমি এই ভবের কাণ্ডারি।

রাত বাড়ে। সুসুপ্তির কোলে ঢলে পড়ে চরাচর। জেগে থাকে আকাশের তারা, কাটাখালের চরের শিমুলগাছে মকবুল মিয়া, নীলাক্ষির স্রোত আর বাতেন। রাতের

 সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে নীলাক্ষির জল। বিকেলে জল ছিল বাঁশঝাড়ের এক হাত নিচে, এখন ঝাড়ের গোড়া ছুঁইছুঁই করছে। জলঘূর্ণির ভয়ংকর গর্জনে ভয়ের কাঁটা দিচ্ছে বাতেনের গায়ে। বাঁধ ভাঙার ভয় নয়,

জিন-ভূতের। কেবলই মনে হচ্ছে এই বুঝি কুমের কোনো বেত্তমিজ জিন জলঘূর্ণির সুড়ঙ্গ ধরে পাতাল থেকে উঠে এলো! এই বুঝি রোমশ হাত বাড়িয়ে তাকে টেনে নিয়ে গেল গভীর পাতালে! ভয় তাড়াতে সে ঘনঘন বিড়ি ধরায়। একটা শেষ করে আরেকটা। আর ধরে মুর্শিদের চরণ – ও বাবা ভাণ্ডারি, তুমি এই ভবের কাণ্ডারি। জিন-ভূতে আগুন ভয় পায়। আর মুর্শিদের চরণ জোগায় সাহস।

রাত দশটার দিকে একচালার বাইরে নামে বাতেন। ডানে-বাঁয়ে টর্চ মারে।কোথাও  কেউ  নেই।  আকাশের  দিকে তাকায়। মেঘ অনেকটা হালকা হয়ে এসেছে। ধাবমান মেঘের আড়ে ক্ষণে ক্ষণে উঁকি দিচ্ছে চাঁদ-তারা। আকাশের মতি দেখে বাতেনের মাথায় চড়ে বসে মাছের নেশা। শিঙার মাঠ এখন টইটম্বুর, মাছের দেখা পাওয়া ভার। তবু তার মনে হয় দু-একটা আইড়-বোয়াল মিললেও মিলে যেতে পারে। বেশিক্ষণ থাকবে না, দেড়টা-দুটার মধ্যে ফিরে আসবে। এটুকু সময়ে তো আর বাঁধ ভেঙে পড়বে না। কোনোভাবে একটা বোয়াল যদি ধরা যায়, এক রাতেই নগদ চল্লিশ-পঞ্চাশ টাকা আয়। অবশ্য বন্যার কারণে ট্রেন চলাচল বন্ধ বলে সহজে বিক্রি হবে না। গ্রামের কেউ কি আর মাছ কিনে খায়? কেনে তো ড্রাইভার, গার্ড, টিটি আর ব্ল্যাকাররা। বিক্রি না হোক, বউ-বাচ্চা নিয়ে তো খেতে পারবে।

দেরি না করে বাড়ির দিকে রওনা হয় বাতেন। তার বাড়িটা ভূঁইয়াবাড়ির ঠিক পেছনে। বেনোজলে তলিয়ে গেছে বাড়ির রাস্তাটা। আরেকটু হলেই উঠানে উঠবে। হাঁটুজল ডিঙিয়ে বাতেন উঠানের কোনায় হেঁসেলের চালাটায় ঢোকে। তাক থেকে কুপিটা নামিয়ে আগুন ধরায়। তারপর নামায় কোঁচটা। মাছের নেশার ঘোরে টর্চটা বেমালুম হেঁসেলের তাকে রেখে জোঙরা, কোঁচ আর কুপিটা নিয়ে ঘাটায় নারিকেলগাছের সঙ্গে বেঁধে রাখা কোশাটায় চড়ে বসে। বৈঠা বাইতে বাইতে চলে যায় শিঙার মাঠের মাঝখানে। শোল-বোয়াল দূরে থাক, একটা টেংরা-পুঁটিরও দেখা পায় না। ‘ও বাবা ভাণ্ডারি’ গেয়ে উঠে কোশাটা ঘুরিয়ে দেয় রেলরাস্তার দিকে। ওদিকে মাছ থাকার কথা। মাঠে পানি বাড়লে রাস্তার ধারে মাছেরা ভিড় করে। কিন্তু অনেকক্ষণ বৈঠা বেয়েও রাস্তাটা খুঁজে পায় না। কী আজব কাণ্ড! রাস্তাটা কি হাওয়া হয়ে উড়ে গেল! রাস্তা যে বেনোজলে তলিয়ে গেছে, সে-কথা তার মাথায় নেই। কী করে থাকবে, মাছের নেশায় তো মাথা টাল। দূরে ডুবন্ত শটিবন দেখে মাথায় ঢুকল। শটিবনের ওপর দিয়ে কোশাটা চালিয়ে দেয় পুবে গোদাবনের দিকে। বনের আশপাশে শোল-বোয়াল কিছু থাকলেও থাকতে পারে।

গোদাবন পর্যন্ত যেতে হয় না, শুকনো কচুরিপানার একটা ভাসন্ত স্তূপের কাছে দেখতে পায় একটা শোল। কুপির আলোয় বেচারা শোলের বুঝি চোখ ধাঁধিয়ে গিয়েছিল। পথ বুঝি ঠাওর করতে পারছিল না। কিংবা চোখ ধাঁধায়নি, কুপির আগুন দেখে সে বিস্মিত। জন্মের পর হয়তো কখনো আগুন দেখেনি। প্রথম দেখার বিস্ময় কাটিয়ে উঠতে পারছিল না। সেই সুযোগটা নিয়ে বাতেন শাঁই করে কোঁচটা ঢুকিয়ে দেয় মাছটার ডোরা পিঠে। কোশায় তুলে ছেড়ে দেয় পাটার নিচে ছিরছিরে জলে। আহত শোলটা লাফায়, ঢুঁশ মেরে পাটার কাঠ ভেঙে ফেলতে চায়। বাতেন বৈঠা ধরে। স্তূপটার চারদিকে দুবার চক্কর দেয়। একটা মলাও চোখে পড়ে না। শোলটার দাপাদাপিতে জ্ঞাতিরা হয়তো বিপদ টের পেয়ে গা-ঢাকা দিয়েছে।

বাতেন এবার কোশা ঘুরিয়ে দেয় গোদাবনের দিকে। খানিকটা এগোতেই নজরে পড়ে একটা রুই কি কাতলের পিঠ। কোঁচটা বাড়িয়ে ধরে শক্ত হাতে। যেই না মারতে যাবে, অমনি লেজ নাড়িয়ে ছিড়িক করে মাছটা ঢুকে পড়ে কোশার নিচে। ধুস্ শালা! বাতেন খিস্তি করে। আবার বৈঠা ধরে নিঃশব্দে বায়। চোখদুটি মাছরাঙার মতো স্থির করে রাখে জলের দিকে। কোশা এগিয়ে চলে। হঠাৎ নাকে ঝাপটা দেয় উৎকট গন্ধ। ধারেকাছে কোথাও হয়তো মরা গরু-ছাগল ভাসছে। গলার গামছাটা দিয়ে বাতেন নাক ঢাকে। গন্ধটা এমনই কটু, গামছা ভেদ করে হানা দেয় নাকে। কুপি উঁচিয়ে বাতেন দেখতে পায় একটা ভাসন্ত কুকুর। ফুলে ওঠা পেটে চুপটি করে বসে আছে একটা ঢোঁড়া। দ্রুত কোশা ঘুরিয়ে দেয় বাতেন। এগিয়ে চলে গোদাবনের দিকে। এবার ঝাপটা দেয় দমকা বাতাস। নিভে যাওয়ার উপক্রম হয় কুপিটা। জোঙরাটা দিয়ে বাতাস ঠেকায় বাতেন। আকাশের দিকে তাকায়। গাঢ় মেঘ। চাঁদ-তারারা নিরুদ্দেশ। বৃষ্টি নামতে বুঝি   দেরি   নেই।   বসন্তপুরের   দিকে   ঘন  ঘন  বিজলি চমকাচ্ছে, মেঘ ডাকছে গুড়ুম গুড়ুম।

বাতাস কমে গিয়েছিল। ধীরে বৈঠা বাইছিল বাতেন। গোদাবনের কাছাকাছি যেতেই আগাম নোটিশ ছাড়া দপ করে নিভে গেল কুপিটা। ভেতরে বুঝি বাতাস ঢুকেছে। লুঙ্গির কোঁচা থেকে বাতেন ম্যাচটা বের করে একটা কাঠি জ্বালিয়ে সলতের ওপর ধরে। নাহ্, আগুন ধরে না। সলতে পোড়া গন্ধে ভারী হয়ে ওঠে দম। সলতে পুড়ছে মানে তেল ফুরিয়ে গেছে। ভারী তো বিপদ! সে কুপিটা নাড়া দেয়। সত্যি এক ফোঁটা তেল নেই। হালার কুপি! সে খেদ ঝাড়ে। এতক্ষণে মনে পড়ে টর্চটার কথা। এত বড় ভুলের জন্য নিজের গালে জুতা মারতে ইচ্ছে করে। রাগ ওঠে বউয়ের ওপর। একই গ্রামের মেয়ে। দেখতে-শুনতে খারাপ নয়। কিন্তু রাতকানা রোগী। সন্ধ্যায় খোঁয়াড়ের হাঁস-মুরগি ঢুকিয়েই ছেলেমেয়েদের নিয়ে খেতে বসে যায়। খেয়েই ঘুম। কুপিটায় তেল আছে কি না, ঘুমানোর আগে একটিবার দেখবে না? বউয়ের উদ্দেশে বাতেন খিস্তি করে, মাগী কুনহানের! আগে জানলে ইমুন খানকি-মাগীরে কেডা বিয়া করতো!

বিরক্ত বাতেন কোশার গলুইটা ঘুরিয়ে দেয় বাড়ির দিকে। আর তখন ডেকে ওঠে পুবের আকাশ। ডাক থামার আগেই শুরু হয় গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টি। জোঙরাটা সে মাথায় চড়ায়। এবার শুরু হয় ঝুমবৃষ্টি। বৈঠাতে সে জোর খাটায়। এই ঝুমবৃষ্টিতে জলের গোপন তল থেকে বেরিয়ে আসবে মাছেরা। দ্রুত বাড়ি গিয়ে কুপিতে তেল ভরে আবার ফিরতে হবে। শোলটা পেয়ে নেশাটা দ্বিগুণ চড়ে গেছে। এরকম আরো দু-তিনটা শোল-বোয়াল ধরতে না পারলে দমবে না।

একমনে বৈঠা বাইছিল বাতেন। হঠাৎ সে খেয়াল করে কোথাও একটা গাছপালা নেই, চারদিকে কেবল পানি আর পানি। যেন এক মহাসমুদ্র। উত্তর-দক্ষিণ পূর্ব- পশ্চিম ঠিক করতে পারছে না।

চাঁদ-তারা দেখা গেলে পারত। গাঢ় মেঘ আর ঝুমবৃষ্টি ঢেকে রেখেছে গোটা আকাশ। তবে কি পথ ভুলে সে বেতুয়ানির দিকে চলে যাচ্ছে? দ্রুত সে গলুইটা ঘুরিয়ে দেয়, বৈঠাতে আরো জোর খাটায়। কোশা চলতে থাকে তরতরিয়ে। অনেকক্ষণ পর একটা বাঁশঝাড় দেখতে পেয়ে বাতেন স্বস্তি পায়। এ নিশ্চয়ই ভূঁইয়াদের ঝাড়। তখন একটা ব্যাঙ ডেকে ওঠে কোঁয়াক কোঁয়াক। হয়তো সাপের মুখে পড়েছে। ঝাড়টা বাঁয়ে রেখে সোজা বৈঠা বায় বাতেন। সামনে তাকিয়ে অবাক হয়। এ কী! কেবল পানি আর পানি। ঝাড়টা ভূঁইয়াদের হলে সামনে তো বাড়িঘর থাকার কথা। বাতেনের গায়ে কাঁটা দেয়। কার পাল্লায় পড়েছে বুঝতে দেরি হয় না। কানাওলা, নিশ্চয়ই কানাওলা হারামজাদা চড়ে বসেছে তার কাঁধে। বৈঠাটা রেখে ঝটপট সে লুঙ্গিটা উলটিয়ে পরে। নিচে দেয় শক্ত গিঁট। গেঞ্জিটাও পরে নেয় উলটো করে। কানাওলা ধরলে কাপড়চোপড় উলটিয়ে পরতে হয়।

কোঁচা থেকে বান্ডিলটা বের করে বাতেন বিড়ি ধরায়। ধোঁয়া ছাড়তে গিয়ে ঠাওরে আসে একটা আলোকবিন্দু। দূরে। মিটিমিটি জ্বলছে। হয়তো কুপির আলো। হয়তো তার মতো অন্য কেউ মাছ মারছে। কিংবা বাউয়া হাকিম বাউয়া ব্যাঙ ধরছে। বছরের ছয় মাস সে বাউয়া ব্যাঙ ধরে চাঁদমারি নিয়ে বিক্রি করে। বাতেন বিন্দুটা লক্ষ করে বৈঠা চালায়। বৃষ্টির গতি আরো বাড়ে। হুট করে বিন্দুটা চলে যায় নজরসীমার বাইরে। হতাশা ভর করে তার মাথায়। বুঝতে পারে রাতে যে আর বাড়ি ফেরা হবে না। কানাওলা ধরেছে, শত চেষ্টা করলেও বাড়ির পথ খুঁজে পাবে না। বর্ষা মৌসুমে মাছুয়ারা প্রায়ই দুষ্টু কানাওলার পাল্লায় পড়ে। সে-ও পড়েছিল একবার। যুদ্ধের পর যে-বছর গর্কি হয়, তার বয়স যখন সাতাশ-আটাশ, একদিন রাত দশটার দিকে রেলরাস্তা ধরে গগনতলা থেকে ফিরছিল। রেলরাস্তা থেকে তাদের বাড়িতে যেতে হয় একটা চওড়া আল ধরে। আলপথটা তার মুখস্থ। চোখ বেঁধে দিয়ে রেলরাস্তা থেকে ছেড়ে দিলে ঠিকঠিক বাড়ি পৌঁছে যেতে পারবে। কিন্তু সে-রাতে অন্ধকার এতটাই গাঢ় ছিল যে, স্লিপারগুলোও ঠিক ঠাওরে আসছিল না। বুদ্ধি করে সে ব্রিজের গোড়া থেকে স্লিপার গোনা ধরেছিল। গুনে গুনে হাঁটছিল। সে জানত গগনতলা রেলব্রিজ থেকে তেরশো ছাব্বিশটা স্লিপার পেরোলেই আলপথটা পড়ে। বহুবার গুনেছে। গুনতে গুনতে তেরোশো ছাব্বিশে এসে নেমে পড়েছিল বাঁদিকে। সত্যি একটা আলপথ পেয়ে গিয়েছিল। সোজা হাঁটছিল আলটা ধরে। খানিকটা গিয়ে টের পায় আলটা মিলিয়ে গেছে ধানকাটা মাঠে। কোথাও আলটাল কিছু নেই, চারদিকে কেবল নাড়া আর নাড়া। তার খটকা লাগে। উত্তর-দক্ষিণ মেলাতে পারে না। একবার পেছনে হটার কথা ভাবে। কিন্তু পেছনে হটে কোথায় যাবে? বাড়ি তো বাঁদিকে। খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে হাঁটা ধরে নাক বরাবর। আচমকা একটা আলের সঙ্গে উষ্ঠা খেয়ে দুম করে পড়ে যায়। দুহাতে ভর দিয়ে চট করে উঠে দাঁড়ায়। টের পায়, ওপরের ঠোঁটটা ফেটে গেছে, গালে ঢুকছে নোনা রক্ত। সহসা মুচড়ে ওঠে বুকটা। ঘাড়ের কাছে টের পায় কানাওলার শ্বাস। সারাজীবন কানাওলার কথা শুনেছে, কখনো দেখেনি, কখনো তার পাল্লায় পড়েনি। জীবনে প্রথম কানাওলার পাল্লায় পড়ে ভয়ে ভীষণ কাবু হয়ে পড়ে। মনে পড়ে দাদির কথা। দাদি বলত, কানাওলায় ধরলে জামাকাপড় উলটো করে পরতে হয়। নইলে দুষ্টু কানাওলা নাকে রশি লাগিয়ে সারারাত ঘোরায়। কিন্তু সে তখন ভয়ে এতটাই কাবু, একটুখানি দাঁড়িয়ে লুঙ্গিটা উলটে নেওয়ার সাহস পাচ্ছিল না। ওলটাতে গেলে কানাওলা রাগ করে যদি ঘাড়টা মটকে দেয়! আচমকা সে দেয় দৌড়। তাড়া খাওয়া চোরের মতো ছুটতে থাকে। কোনদিকে ছুটছিল বুঝে উঠতে পারছিল না। উত্তরে বা দক্ষিণে হতে পারে, পুবে বা পশ্চিমেও হতে পারে। ছুটতে ছুটতে হঠাৎ তার নজরে আসে একটা আলোকবিন্দু। আলোটা এই কমে তো সেই বাড়ে। হয়তো বিড়ির আগুন। কেউ হয়তো বসে বসে ফুঁকছে। সে ছুটে চলে বিন্দুটার দিকে। কাছাকাছি গিয়ে গলাখাঁকারি দেয়। ভেসে আসে পরিচিত কণ্ঠ – ধইরা আইনা মাইরালা। আরজ খালাসিকে চিনতে তার দেরি হয় না। এই কণ্ঠ তো তার চেনা। কোনো কোনো রাতে তাকে দেখা যায় মাতঙ্গীবাড়ির সামনের মাঠে। বাতেন বুঝতে পারে, পথ হারিয়ে সে চলে এসেছে শিঙার মাঠের উত্তর সিথানে।

সেদিনের কথা মনে পড়ায় পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকে বাতেনের ভয়। বুকটা ধুকপুক করছে ভীষণ। মরার বৃষ্টি থামছেই না! কোনো মাছুয়ারও দেখা পাচ্ছে না। কারো দেখা পেলে তার সঙ্গ ধরে বাড়ি ফিরতে পারত। দুই কাঁধে দুবার ফুঁ দিয়ে সে আবার বিড়ি ধরায়। টানতে টানতে বান্ডিলের বিড়িগুলো গোনে। মাত্র চারটা বাকি। রাত এখন দেড়টা-দুটার কম হবে না। ভোর হতে আরো তিন-চার ঘণ্টা। বেশি টানা যাবে না বিড়ি। এই চারটা দিয়েই রাত কাবাড় করতে হবে।

বিড়িটা শেষ করে বাতেন বৈঠা ধরে। ধীরে ধীরে বায়। কতক্ষণ বায় বুঝে উঠতে পারে না। দেড় ঘণ্টা হতে পারে, দুই ঘণ্টাও হতে পারে। হঠাৎ পুবের আকাশে দেখতে পায় লালিমা। তার শুকনো বুকে বৃষ্টি নামে। ধুকপুকানিটাও থামে। এতক্ষণে মনে পড়ে মুর্শিদের কথা। গেয়ে ওঠে মুর্শিদ নামের চরণ – ও বাবা ভাণ্ডারি, তুমি এই ভবের কাণ্ডারি।

বৃষ্টি ধরে আসে। জোঙরাটা এক পাশে সরিয়ে বৈঠার আগাটা পাটার নিচে ঢুকিয়ে দেয় বাতেন। শোলটা লাফিয়ে ওঠে। এখনো জ্যান্ত। শোলের প্রাণ বড় শক্ত। দশবার কোঁচের ঘা খেলেও মরতে চায় না। বাতেন বলে, তর নাম কী লো? কুনহানে

থাহস? শিঙার মাডে মরতে গেছিলি কেরে? হা হা হা। জানতি না আমার হাতে ধরা পড়বি!

সহসা বাতাসে ভেসে আসে দূরাগত শোরগোল। বাতেন চমকে ওঠে। শব্দটা কোথা থেকে আসছে বাতাসে কান পেতে বোঝার চেষ্টা করে। একবার মনে হয় উত্তর থেকে, আবার মনে হয় পশ্চিম থেকে। সে ভালো করে কান পাতে। এবার বুঝতে পারে। ঠিক উত্তর থেকে আসছে শব্দটা। তার বুকটা মোচড় দিয়ে ওঠে। এই ভোররাতে কারা শোর-চিৎকার করছে? কোথাও কি আগুন লাগল! এই ঝুমবৃষ্টিতে তো আগুন লাগার কথা নয়। ভিজে চুপসে আছে জগৎ-সংসার। নিশ্চয়ই নীলাক্ষির বাঁধ ভেঙেছে। কোথায় ভাঙল? কুমের বাঁধ না তো! আবার ধুকপুকানি শুরু হয় তার বুকে। শব্দের উৎসের দিকে কোশাটা ঘুরিয়ে জোরসে বাইতে থাকে বৈঠা।

ধীরে ধীরে দিগন্ত ফর্সা হয়, আরো পষ্ট হয় শোরগোলের শব্দ। স্রোতের গতি বোঝার চেষ্টা করে বাতেন। কুমের বাঁধটাই যে ভেঙেছে, স্রোতের তোড় দেখে সন্দেহ থাকে না তার। পুবে দেখা দেয় আবছা গাছগাছালি। এবার নিজের অবস্থান বুঝতে পারে সে। নাকে রশি লাগিয়ে কানাওলা তাকে রাতভর ঘুরিয়ে বেতুয়ানি রাস্তার মাথায় নিয়ে এসেছে। কানাওলার উদ্দেশে বাতেন খিস্তি করে, শাউয়ার পুত শাউয়া, তর মা-বইনরে পাইলে চুইদ্দা গাঙ কইরা দিতাম হালার পুত।

স্রোতের তোড়ে বাঁধ ভেঙেছে, এ-কথা ঠিক বিশ্বাস হয় না অনাদিবাবুর। বাতেনেরও না। কী করে হবে? রাতে

যে-অবস্থায় সে বাঁধটা দেখে গেছে, তাতে এত তাড়াতাড়ি তো ভেঙে পড়ার কথা নয়। ভাঙলেও দু-একদিন পরে ভাঙত। নিশ্চয়ই শত্রুতা করে কেউ কেটে দিয়েছে। অনাদি সন্দেহ করেছিলেন বাতেনকে। নিশ্চয়ই সে কালাগাজির টাকা খেয়ে সর্বনাশটা করেছে। বাতেন তো কেঁদেকেটে অস্থির, আপনে ইমুন কথা কইতে পারলেন বাবু! জীবনে কুনুদিন নিমোহারামি করছি? ঘণ্টাহানেকের লাইগা কুশাডা লইয়া বাইর অইছিলাম। হালা কানাওলা হারাডা রাইত নাকে দড়ি লাগাইয়া ঘুরাইছে। অন্যায় করলে ইডাই করছি, আপনেরে না কইয়া মাছ মারতাম গেছি।

অনাদিবাবুর সন্দেহটা এবার কেটে যায়। ফিরে আসে বাতেনের প্রতি হারানো বিশ্বাস। মাছের প্রতি বাতেনের উগ্র নেশার কথা তার জানা। শত্রুতা যে কালাগাজিই করেছে, আর সংশয় থাকে না তার। পরদিন টান ধরে নীলাক্ষির জলে। বৃষ্টিও থামে। 

 স্রোতের তোড়ে নিশিমহলের উত্তরাংশের মাটি সরে গেছে। ভাগ্যিস বৃষ্টিটা থেমেছে। নইলে ভবনটা টেকানো মুশকিল হয়ে পড়ত। অনাদি সরে যাওয়া মাটি ভরাটের উদ্যোগ নিলে অরূপ তার হাত দুটো ধরে বলে, আর না দাদা, বহুত অইছে, অহন লন। ভাইয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকেন অনাদি। বেশ খানিকক্ষণ। তারপর হাতটা ছাড়িয়ে চলে গেলেন দিঘির ঘাটে। সারা বিকেল চুপচাপ বসে থেকে ফেরেন সন্ধ্যায়। কারো সঙ্গে একটা কথাও বলেন না। দোতলায় শোবার ঘরে রবীন্দ্রনাথের ছবিটার সামনে দাঁড়ান। মনে পড়ে ওপারের আত্মীয়স্বজনের কথা। যুদ্ধের সময় যারা শরণার্থী হিসেবে গিয়েছিল তাদের অনেকে ফেরেনি। কেউ সুন্দরটিলায়, কেউ জামগড়ায়, আর কেউ নিখিলগড়ে বসতি গেড়েছে। তিনি তো প্রায়ই ওপারে যান। আগে তাদের সঙ্গে দেখা হলেই বলতেন, দেশ ত অহন স্বাধীন। আইয়া পড় তোরা। ইন্ডিয়া কি আমরার দেশ? কেরে পইড়া রইছত? ভিনদেশে থাইকা লাভ কী? অখিল দত্ত খুন হওয়ার পর তারাই তার কাছে খবর পাঠায়, অহনো সময় আছে বাবু, এইপার আইয়া পড়েন। না অইলে একদিন সব হারাইয়া ভিক্ষুকের মতো পথে পথে ঘুরন লাগবো। অনাদি এখন বুঝতে পারছেন, তাদের কথা ধরা উচিত ছিল। অরূপ যখন প্রথমবার বলেছিল তখনো যদি চলে যেতেন, তবে অখিলকে হারাতে হতো না। অরূপের কথাই ঠিক, কদিন পর নিখিল যাবে, তারপর সুধন যাবে। মওকা বুঝে একদিন হয়তো অরূপকেও সরিয়ে দেবে।

পরদিন ভোরে, সূর্যোদয়ের আগে, অরূপকে ঘুম থেকে ডেকে তোলেন অনাদি। চোখ দেখে অরূপ বুঝতে পারে দাদা যে সারারাত ঘুমাননি। অনাদি বলেন, নেওনের মতো যা আছে সব ঘুচায়া ল। আজ রাইতেই বর্ডার পার অমু।

অরূপ বলে, এত জলদি!

যা কইছি তা কর ভাই, কথা বাড়াইস না।

কথা বাড়ায় না অরূপ। নেওয়ার মতো যা কিছু আছে সব গুছিয়ে নেয়। বাতেন যায় আদম কারবারি মিলনের কাছে। ইন্ডিয়া যাওয়ার পথ নির্বিঘ্ন রাখার দায়িত্ব মিলনের। সে উজানগাঁ ক্যাম্পের অঘোষিত ক্যাশিয়ার। সপ্তায় সপ্তায় ব্ল্যাকারদের কাছ থেকে চাঁদা তোলে। কাস্টমস ইন্সপেক্টরও তাকে বিশ্বাস করে। চেকপোস্ট দিয়ে প্রতিদিন যেসব আদম এপার-ওপার করে, বেশির ভাগেরই পাসপোর্ট-ভিসা থাকে না। মিলনের মতো কুটুম থাকতে পাসপোর্ট-ভিসার কী দরকার? মাথাপিছু তাকে তিনশো করে টাকা দিলে সব ঝামেলা সে নিজের মাথায় তুলে নেয়।

সব ঠিকঠাক করে বাতেন ফেরে দুপুরে। রাত ঠিক সাড়ে বারোটায় জামগড়া সীমান্ত দিয়ে ঢুকতে হবে। বারোটার পর ওখানটায় বিএসএফ থাকে না। রায়বাড়ির রাজেশের সঙ্গেও কথা হয়েছে। সে ওদিকটা সামাল দেবে। সীমান্তরক্ষীদের সঙ্গেও কথা পাকা। রাতে ওদিকে টহলদল পাঠাবে না হাবিলদার। পাঠালেও সমস্যা নেই, মিলন সব সামাল দেবে। চার হাজার টাকা তাকে অগ্রিম দেওয়া হয়েছে, বাকি দুই হাজার দেওয়া হবে যাওয়ার সময়। সুধন থাকবে ওপারে। সকালেই পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে তাকে। তবে মিলন বলেছে, সবাই একসঙ্গে যাওয়া ঠিক হবে না। দুই রাতে দুই দফায় গেলে ভালো হয়। কিন্তু অনাদি একসঙ্গেই যাবেন। মরতে হলে একসঙ্গেই মরবেন।

রাত এগারোটায়, যখন ঘুমিয়ে পড়ে উজানগাঁর মানুষজন, গাঁটরি-বোঁচকা সব নামানো হয় উঠানে। নামে দত্ত পরিবারের মোট একুশ সদস্য। অনাদির গিন্নি মহিমা দেবী সারাদিনে চারবার অজ্ঞান হয়েছে। কেঁদে কেঁদে এখন বুক ভাসাচ্ছে। ছেলেমেয়েরা তাকে সান্ত্বনা দিচ্ছে। বাতেন তাড়া দেয়, চলেন বাবু। ঠিক সময়ে না গেলে ঝামেলা হবে। 

নিজ নিজ গাঁটরি-বোঁচকা নিয়ে সবাই যখন রওনা হয়, অমনি করুণস্বরে ডেকে ওঠে লাল কুকুরটি। উথলে ওঠে মহিমা দেবীর কান্না। তার দেখাদেখি অরূপের বউও কাঁদতে শুরু করে। অরূপ ধমক লাগায়, চুপ করো! মাইনষের ঘুম ভাঙাইয়া ঝামেলা বাধাইবা? সবাই চুপ করে। হাঁটতে হাঁটতে দেবীর পুকুরের কোনায় আসে। তখন অনাদির নাকে ঝাপটা দেয় শিউলি ফুলের ঘ্রাণ। যুদ্ধশেষে দেশে ফেরার সময় বনকরা থেকে আনা শিউলির চারাটা ঘাটলার কাছে লাগিয়েছিলেন। কত বড় হয়ে গেছে গাছটা! কখন ফুল ফোটে, কখন ঝরে যায়, কখনো খেয়াল করেননি। গাছটার তলায় টর্চের আলো ফেললেন তিনি। আকাশের তারার মতো গাছতলায় পড়ে আছে বিস্তর ফুল। আলোটা ডানে ঘোরাতেই তিনি চমকে ওঠেন। গাছটার কাছে গুটি মেরে বসে আছেন আবু তোয়াব ওরফে বাঘামামা। চমকে ওঠে বাকিরাও। অনাদিবাবু হেসে ওঠেন। মুহূর্তে আবার হাসিটা উবে যায়। টর্চের আলোটা বাঘামামার পায়ের কাছে ধরে রেখে তিনি নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে থাকেন। বাঘামামা উঠে দাঁড়ান। অনাদির কী যে হয়, বাঘামামাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ওঠেন হু-হু করে। বের করে দিতে থাকেন সারাদিনের চেপে রাখা সব কান্না।

কেঁদেকেটে বুকটা হালকা করে চোখ মুছে বলেন, অরূপ!

আজ্ঞে দাদা।

সবাইরে লইয়া তুই যা।

আপনে?

আমি যামু না।

দাদা!

কইছি তো যামু না। আমি এই বাড়ি পাহারা দিমু।

দাদার কথার সুর ধরতে ভুল করল না অরূপ। তেতাল্লিশ বছর ধরে সে দাদাকে দেখছে। কথার সুরেই বুঝতে পারে কোনটা মনের আর কোনটা মুখের। কিছু বলতে চাওয়া মহিমা দেবীকেও সে থামিয়ে দেয়। টর্চের আলোয় সে দেখে, অনাদি দত্ত নন, প্রবল প্রতাপশালী অনন্ত দত্ত ঘাটলার দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন হাত দুটো পেছনে মুড়ে। অরূপ আর দেরি করে না, সবাইকে নিয়ে রওনা হয় বর্ডারের দিকে, চিরতরে দেশত্যাগের উদ্দেশ্যে।

নিশিমহলের সরে যাওয়া মাটি ভরাটের পর বউকে নিয়ে মামাবাড়িতে ওঠে সুধন। সংসারটা আগলে ধরে প্রভাতি। অনাদি দত্ত মুক্ত করে দেন দুই হাত। বনজঙ্গল সাফ করে ঈশ্বরীটিলার যে-অংশটুকুতে বর্গাচাষিরা বাড়ি করেছে সেটুকু লিখে দেন তাদের নামে। বাকিটা তো জঙ্গল। সাপ-শেয়াল আর জিন-ভূতের বাস। উজানগাঁয় এত বড় সাপুড়ে পাড়া, তেপ্পান্নটি সাপুড়ে পরিবারের বাস, অথচ কোথাও একটা মনসা দেবীর মন্দির নেই। একটা মন্দির গড়ে দেওয়ার জন্য অনাদি দত্তের কাছে সাপুড়েদের বহুদিনের দাবি। এবার দাবিটা পূরণ করলেন তিনি। জঙ্গলের মাঝখানে কিছু গাছপালা কেটে গড়ে দেন একটা মন্দির। মন্দিরের দরজায় খোদাই করে লিখে দেন, ‘শ্রী মহিমা দেবী সার্বজনীন মা মনসা মন্দির।’ বছর ঘুরে আবার বর্ষা আসে। টানা চারদিনের বৃষ্টিতে আবার রাক্ষুসীর রূপ নেয় নীলাক্ষি। কাটাখালের চরটা বেচে দিতে জাকের মোড়লের সঙ্গে আলাপ করতে সেদিন মেলাতলি গিয়েছিলেন অনাদি। ফেরার সময় যখন খেয়াঘাটে পৌঁছালেন রাত তখন প্রায় সাড়ে আটটা। মেঘলা আকাশ। ঘাট পার হয়ে তিনি বেড়ির পথ ধরে বাড়ির দিকে হাঁটছিলেন। যেই না কুমটার কাছাকাছি এলেন, অমনি কুমবাসী অসংখ্য জিনের কোনো একটি পেছন থেকে তাকে জোরসে ধাক্কা মারে। জলঘূর্ণির সুড়ঙ্গপথ ধরে উঠে আসা আরেকটি জিন রোমশ হাত বাড়িয়ে তার দুই পা ধরে টেনে নেয় গভীর পাতালে।