‘মধুচন্দ্রিমায় কোথায় যেতে চাও?’

হবু বরের প্রশ্নের তাৎক্ষণিক উত্তরটা জিভের ডগা দিয়ে প্রায় বেরিয়ে যাচ্ছিল। অনেক কষ্টে রিপা সেটি গিলে ফেলল। স্কুল-কলেজে থাকতে বান্ধবীরা মিলে সুইজারল্যান্ডে মধুচন্দ্রিমায় যাওয়ার স্বপ্ন দেখত। না, তারা কেউ কেউকেটা লোকের মেয়ে ছিল না। শুধু ফারজানা কিছুদিন মধ্যপ্রাচ্যে ছিল আর তুলি একবার ভারতের আজমির শরিফ গিয়েছিল। কিন্তু কিশোরী বয়সে স্বপ্ন দেখতে পয়সা লাগে না। হিন্দি চলচ্চিত্রগুলোর জর্জেট শাড়িপরা নায়িকারা সে-স্বপ্নের রসদ জোগাত। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় অবশ্য সে-স্বপ্ন অনেকটাই অদৃশ্য। তবে নিশ্চিহ্ন নয়। স্বপ্নগুলো তখন তারুণ্যের বাস্তবতার ছাঁকনিতে আটকে যাচ্ছে। তবুও তা আছে অনেকটা সেই পুরনো কাগজের মতো, যাকে ঠিক এই মুহূর্তে দরকার নেই, আবার ফেলেও দেওয়া যাচ্ছে না যদি কোনোদিন কাজে লাগে মনে করে। এ-ধরনের কাগজকে আমরা সাধারণত আলমারির সবচেয়ে অদৃশ্যমান স্থানে ফাইলবন্দি করে রাখি। বিশ্ববিদ্যালয়জীবন হচ্ছে ছাঁকনির হাঁ-করা মুখে লাগাম টেনে ধরা। রিপাদের স্বপ্নহরণের স্থান, হতাশার পাদপীঠ। রিপারা জেনে যায়, সুইজারল্যান্ডে শুধু হিন্দি ফিল্মের নায়ক-নায়িকারাই মধুচন্দ্রিমায় যায়। পাহাড়ের ওপর উঠে মেঘেদের সাথে নেচেকুদে বাতাসের সাথে সুর মিলিয়ে গেয়ে বেড়ায়। পরিচালক অনেক যত্নে এক টুকরো স্বপ্ন তৈরি করেন। দর্শকরা সে-স্বপ্ন গিলে খায়। এভাবেই দুধের স্বাদ ঘোলে মেটে। তাই বুদ্ধিমান রিপা নাঈমের কাছে প্রথমেই খাঁটি দুধের আবদার করে বসল না, পাছে যদি নাঈম ঘাবড়ে গিয়ে সটকে পড়ে। তখন রিপার কন্যাদায়গ্রস্ত মা বিপদে পড়বে। এ-ধরনের মুহূর্তে রবিবাবুই সবচেয়ে বড় ভরসা। সফেদ শ্মশ্রুমণ্ডিত এই ভদ্রলোক বাঙালির মনে উদয় হওয়া এমন কোনো ভাব নেই যে দিয়ে গান-কবিতা লিখে যাননি।

‘কোথাও আমার হারিয়ে যাওয়ার নেই মানা, মনে মনে মেলে দিলেম গানের সুরের এই ডানা, মনে মনে।’

‘বাহ তুমি তো খুব রোমান্টিক!’

রিপা তার নিজের প্রতিভায় মুগ্ধ হলো। কী সহজেই বারো হাজার মাইল দূরত্বে

থাকা অদেখা একজন মানুষকে পটিয়ে ফেলা যায়। আম্মাকে বললে খুশি হবে।

‘তারপরও একটা জায়গার নাম বলতে হবে।’

নাঈমের চাপাচাপিতে রিপা শেষ পর্যন্ত কক্সবাজারের নাম বলতে বাধ্য হলো। হাজার হোক আমেরিকায় কয়েক বছর প্রকৌশলীর চাকরি করে নাঈম ভালোই ডলার কামিয়েছে। নাঈমের নিজস্ব একটা স্বপ্ন তো থাকতেই পারে। তার সে-স্বপ্ন বাস্তবায়ন করার সামর্থ্যও আছে। সে সেটি তার মতো করে পূরণ করুক। রিপা হবে তার স্বপ্নসঙ্গী।

দুই

বিয়ে-বউভাতের ঝামেলা মিটে যাওয়ার পর রিপা যখন তার মধুচন্দ্রিমায় যাওয়ার প্রহর গুনছিল, তখনই নাঈম তার কাছে এসে কিছুটা কাঁচুমাঁচু হয়ে বলল, ‘শোন, আসলে আমাদের মধুচন্দ্রিমার পরিকল্পনাটা একটু বাদ দিতে হচ্ছে।’

রিপা কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই নাঈম উত্তর দিলো, ‘অনেকদিন পর দেশে এলাম। যতদিন আছি ততদিন আব্বা-আম্মার সাথেই বরং সময়টা কাটাই, কী বলো? আমেরিকা গেলে তো তোমাকে আমি অনেক জায়গাতেই ঘুরতে নিয়ে যেতে পারবো।’

রিপা সহাস্যেই বলে ওঠে, ‘জানি। এজন্যই কিন্তু আমি তোমাকে আগে থেকে মধুচন্দ্রিমার প্রস্তাবটা বাদ দিতে বলেছিলাম।’

রিপা হাসিমুখে অবস্থার সাথে নিজেকে মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছে। আগে সে গল্প-উপন্যাসে যা পড়ত, নাটক-সিনেমাতে যা দেখত, তার বাস্তবরূপ যে সে এত দ্রুত দেখতে পাবে তা কল্পনাও করতে পারেনি। আগের দিন ডাইনিংরুমে গিয়েছিল এক গ্লাস পানি খাওয়ার জন্য। শ্বশুর-শাশুড়ির শোবার ঘর একেবারে পাশেই। রিপা শুনতে পেল শ্বশুর বলছেন, ‘রিপাকে তো আমার বন্ধু-বান্ধব আত্মীয়স্বজন অনেক সোনার গয়না উপহার দিয়েছে। ওগুলো ওকে দিয়েছ?’

শাশুড়ি রীতিমতো ফোঁস করে উঠলেন, ‘খবরদার একটা কথাও বলবা না। আমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে হুটহাট করে এই বিয়ে ঠিক করেছ। এখন থেকে আর তোমার ইচ্ছা চলবে না। আমার ইচ্ছামতো সবকিছু চলবে। শুধু আমার ভাইবোনদের দেওয়া কিছু গয়না রিপাকে দিব। আর বাকি সব আমার।’

‘ছি ছি রিপা কী ভাববে?’

‘আবার কথা বলো? চুপ। ওই মেয়ে নিজে বাপের বাড়ি থেকে কী নিয়ে আসছে?’

‘আহা কী মানী লোকের মেয়ে, শোনো নাই মেয়ে খুব সাধারণ থাকতে পছন্দ করে?’

‘ঢং! কেউ কি আর শখ করে সাদাসিধা থাকে? আমার বান্ধবী গুলবাহার তার মেয়ের জন্য কত উৎসাহ দেখাল। গুলবাহাররা যেমন বড়লোক, মেয়ে তেমন সুন্দরী আর শিক্ষিত। আর উনি কি না কোত্থেকে রিপাকে ধরে নিয়ে এলেন।’

আর কিছু যাতে না শুনতে হয় তাই রিপা তাড়াতাড়ি সে-জায়গা থেকে চলে আসে। নিজের শোবার ঘরে আসার পরই তার প্রচণ্ড মাথা ধরে। তাই দেখে নাঈম খুব ব্যস্ত হয়ে পড়ে। নাঈমের এই উতলা ভালোবাসা দেখে রিপা ভুলে যেতে চায় কিছুক্ষণ আগের ঘটনাটি। হাজার হোক শাশুড়ি তো তার স্বামীর মা। একটা সময় নিজেকে সম্পূর্ণ উজাড় করে দিয়ে ছেলেকে মানুষ করেছেন। এখন এক রাতের মধ্যে তার ছেলের দখল আরেকটা মেয়ে নিয়ে নিল। এভাবে ছেলেদখলের ঘটনাটি মহিলারা স্বাভাবিক নিয়মে মানতে পারতেন যদি তাদের নিজস্ব একটা ভুবন তৈরি করতে পারতেন। খুব কম ক্ষেত্রেই তারা সেই ভুবন তৈরি করতে পারেন। যাও বা করেন তাও আবার ধর্মভিত্তিক। ধর্ম পালন তো আর যেই-সেই সহজ ব্যাপার না। অনেক কষ্টের কাজ, সাধনার কাজ। সেই সাথে মানসিক চাপ তো আছেই। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, এই মানসিক চাপ তৈরি করে আরেক দূরত্ব। নিজের রক্ষণশীল চিন্তাভাবনা দিয়ে বউয়ের কাজের কোনো যুক্তি খুঁজে পাওয়া যায় না। বউকে মনে হয় স্বাধীনচেতা, বেয়াদব। নিজের আত্মীয়স্বজন আর বোনদের জীবনে এত শাশুড়ি-বউ ঝামেলা দেখেছে যে এখন নিজের জীবনের এই ঘটনাকে মনে হলো, এরকমই তো হওয়ার কথা, না হলেই বরং মনে হতো কী জানি মিলছে না। বউ বড় না মা বড় –    ছেলেরা সামলায় কী করে এই ঝামেলা? কী সব কর্কশ নারীবাদীরা খালি পুরুষদের মাথায় পেরেক ঠুকতে বলে! তার থেকে বরং এমন নারীবাদের চল হওয়া উচিত যেখানে নারীরা একজন পুরুষকে বউ আর শাশুড়ির যন্ত্রণা থেকে মুক্ত রাখবে। বিনিময়ে সে-পুরুষও নারীর জীবনে কোনো সমস্যা তৈরি করবে না। নিজের সন্তানকে নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করতে করতে কমবেশি সব নারীই

এক-একজন মনস্তত্ত্ববিদ হয়ে ওঠে – এই গূঢ় জ্ঞান এখন শুধুই নিজের সন্তানকেন্দ্রিক না হয়ে সমাজকেন্দ্রিক হওয়া উচিত। ঘষেটি বেগমদের দিন শেষ হয়ে গেছে, এখন আমাদের দরকার অনেক বেগম রোকেয়া, জাহানারা ইমাম। আচ্ছা, নতুন বউ হয়ে রিপা এত দার্শনিক চিন্তাভাবনা করছে কেন? রিপা জানে, দুদিন পরেই সে আমেরিকা চলে যাবে। শাশুড়ি থেকে যোজন যোজন দূরে। এখনি তো সময় দার্শনিক হবার। তাই নাঈমের মধুচন্দ্রিমার পরিকল্পনা খারিজ হয়ে যাওয়াতেও রিপা খুশি। আর তাছাড়া নাঈম তো এখনো আধা অপরিচিত। এই অবস্থায় কতক্ষণ আর একজন লোকের সাথে বসে বসে গলদা চিংড়ি আর রূপচাঁদা মাছ চিবুতে চিবুতে সমুদ্রের ঢেউ গোনা যায়? আবার সেই বিকেলেই শাশুড়ি এসে রিপাকে তার মনের দুঃখের কথা জানিয়ে গেলেন। জীবনে অনেকবার কক্সবাজার যেতে চেয়েছিলেন, কিন্তু কিপটে শ্বশুরমশাই সে-আশা আর পূরণ করেননি। অবশ্য শ্বশুর অফিসের কাজে নিজে অনেকবার কক্সবাজার গিয়েছিলেন। পতির পুণ্যে সতীর পুণ্য, নহিলে খরচ বাড়ে। ইস্! আগের প্রজন্মে জন্মগ্রহণ করলে জীবন জড়িয়ে থাকত হাজারো দীর্ঘনিশ্বাসের তপ্ত বলয়ে।

তিন

‘কোথায় যাচ্ছ?’

‘লাস ভেগাস।’

‘আমেরিকায় আসতে না আসতেই তোমাকে হজে নিয়ে যাচ্ছে?’

রিপার মেজো দুলাভাই ফোন করেছিল অ্যারিজোনা থেকে। রিপারা থাকে বেকারস ফিল্ডে। লাস ভেগাস আর লস অ্যাঞ্জেলসের মাঝামাঝি একটা ছোট শহর। আমেরিকা এসে প্রথম তিন মাস আমাদের কোথাও যাওয়া হয়নি। নাঈমের অফিসে অনেক কাজের চাপ ছিল। সেদিন ওর ম্যানেজার ডেকে বলল, ‘এখন কিছুদিন বিশ্রাম করো। বউকে নিয়ে লাস ভেগাস ঘুরে এসো।’

রিপা চোখ বড় বড় করে বলল, ‘লাস ভেগাস যাব?’

‘হুমায়ূন আহমেদ আমাদের লাস ভেগাস

সম্পর্কে কিছুটা ভুল ধারণা দিয়েছেন। জায়গাটা অত খারাপ না। অনেক কিছু দেখার আছে। মেরাজ, ট্রেজার আইল্যান্ড, আইফেল টাওয়ার, সার্কাস, এথেন্স, প্যারিস বিভিন্ন রকম থিম নিয়ে এক একটা হোটেল বানিয়েছে। হোটেলগুলোর সামনে আবার সেই থিমের ওপর ভিত্তি করে মঞ্চনাটকের মতো বিভিন্ন প্রদর্শনী চলছে। বেলাজিও নামে খুব সুন্দর আর দামি একটা হোটেল আছে। তার সামনে অনবরত ফোয়ারার নাচ চলছে।’

এভাবেই গল্প শুনতে শুনতে লাস ভেগাসে পৌঁছে যাওয়া। দেশে থাকতে নাঈম যা বলেছিল রিপা দেখল তা একেবারে মিলে গেল। আমেরিকা মানেই ঘোরাঘুরি। সপ্তাহে পাঁচদিন কাজ আর দুদিন ছুটি। কাজ মানে অফিসের কাজ, সংসারের কাজ, আর রিপার পড়াশোনা। ছুটির দুদিন চুটিয়ে ঘোরাঘুরি। হয় কোনো বাংলাদেশির বাড়িতে দাওয়াত নয়তো আশেপাশে কোথাও ঘুরতে যাওয়া। ছুটি একটু বড় হলে আরো দূরে কোথাও চলে যাওয়া। টোনাটুনির সংসার। লেখাপড়া শেষ করে ততদিনে রিপাও চাকরি শুরু করেছে। সন্তানের মা হলো। তখন দেশ থেকে শ্বশুর আর শাশুড়ি এলেন। রিপা আর নাঈমের ঘোরাঘুরির নেশা পেয়ে গেছে। তবে এবার তাতে যোগ হয়েছে ওদের সন্তান আর তার দাদা-দাদি। আপাত দৃষ্টিতে সবকিছুই চলছে। সন্তান এখনো কিছু বোঝে না; কিন্তু তার দাদা আর দাদি নতুন কিছু দেখলেই খুশি হয়ে ওঠেন। আগের প্রজন্মের মধ্যবিত্ত বাবা-মা; নিজেদের সব শখ আর আহ্লাদ ত্যাগ করে সন্তানদের বড় করেছেন। এক প্রজন্মের মধ্যেই মানুষের জীবন কত বদলে গেল। তবে সবসময় সবকিছুই যে মধুরেণ সমাপয়েৎ হয় তা নয়।

রিপা দেখেছে তার ভারতীয় আর চায়নিজ সহকর্মীদের বাসাতেও প্রায়ই তাদের বাবা আর মায়েরা এসে থাকছেন। বিশেষ করে যাদের ছোট বাচ্চা আছে। একদিন ক্রিস্টিনকে রিপা জিজ্ঞেস করলো, ‘আচ্ছা তোমার শাশুড়ি তো তোমার সাথে অনেকদিন ধরে থাকছে। কোনো সমস্যা হয় না?’

ক্রিস্টিন তাইওয়ানের মেয়ে। ওরা চায়নিজদের থেকে ভালো ইংরেজি বলে আর বেশ মিশুকেও।

‘কেন তোমার হয়?’

‘না, সামনাসামনি আমরা খুবই ভালো। সবসময় হেসে হেসে কথা বলছি। কিন্তু সমস্যা হয় তখন যখন শাশুড়িকে পাশের ঘরে আমার নামে বদনাম করতে শুনি। হয়তো শ্বশুরের কাছে নয়তো ফোনে নিজের মেয়ের কাছে।’

‘তুমি শুনছো – এটি জেনেই কি উনি এমনটা করে?’

‘না, ঠিক তা নয়। উনি মনে করছেন যে আমি ঘরে নাই। কিন্তু আমি হয়তো হঠাৎ করেই বাইরে থেকে ঘরে এসেছি এবং তখন পাশের ঘর থেকে শাশুড়ির কথা শুনতে পাই।’

‘আমারও এরকম হয়। তখন আমি ভান করি কিছু শুনতে পাইনি।’

‘ভালো বুদ্ধি, চাকরি করার জন্য আমাদের এত লেখাপড়া করতে হয় অথচ সংসার করার জন্য তেমন কিছুই আগে থেকে শিখিয়ে দেওয়া হয় না। অথচ সংসারটাও তো একটা বড় চাকরিক্ষেত্র। সংসারের সম্পর্কগুলো তো আর এমনি এমনি টিকে যায় না।’

‘আমাদের কিছু তাইওয়ানিজ প্রথা আছে। এমনকি ঠিক কোনো সময় সন্তান নিলে সে-সন্তান বুদ্ধিমান হবে ঠিকুজি করে সেটাও বের করা হয়।’

‘তাই কি তোমরা এতও উন্নতি করছ?’

‘কোথায় আর উন্নতি দেখলে? আমাদের দেশের সরকারের সার্ভিস খুবই অদক্ষ। এটা নিয়ে দেশের মধ্যে অনেক সমালোচনা হচ্ছে।’

‘সরকারের সমালোচনায় কাজ দেয়?’

‘সিভিল সোসাইটি আছে কি করতে? তারা তো সরকারের ভুল দেখিয়ে দেবে, জনগণের অধিকার সম্পর্কে সোচ্চার

থাকবে।’

‘তোমাদের সরকার চাইলে তো সিভিল সোসাইটির কথা পাশ কাটিয়ে যেতে পারে?’

‘এজন্যই আমরা গণতন্ত্র পছন্দ করি। চায়নিজদের থেকে আলাদা।’

দুপুরের খাবারের বিরতিতে অফিসের ক্যাফেটেরিয়াতে প্রায়ই ওদের গল্প হয়। কোনোদিন ওরা তন্দুরি চিকেন বা লেমন চিকেনের রন্ধনপ্রাণালি আদানপ্রদান করে, কোনোদিন বা সন্তানদের লেখাপড়া নিয়ে আগাম কথাবার্তা হয়। আজকের বিষয়বস্তু ছিল রাজনীতি – পারিবারিক এবং দেশকেন্দ্রিক।    

চার

একটি আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে সংস্কারমুক্ত মন নিয়ে মিশতে পারলে আখেরে অনেক লাভ হয়। ভারতীয় চিত্রার সাথে পরিচয় হয়ে রিপা অফিসের বুক ক্লাবে যোগ দেয়। অনেক বিষয়ের ওপর লেখা বই পড়ার পাশাপাশি গভীরভাবে ধ্যান করার ব্যাপারে তার আগ্রহ জন্মে। এই পৃথিবীর তুলনায় কত ক্ষুদ্র এই মানব সম্প্রদায়, তারও থেকেও ক্ষুদ্র তুচ্ছ বিষয় নিয়ে অকারণে কত মন খারাপ করি। চিত্রা একদিন রিপাকে বলে, ‘কারো কাছ থেকে তুমি কোনোদিন কিছু আশা করবে না, বরং পারলে কোনোকিছুর প্রতিদান না ভেবে আরেকজনকে উপহার দাও।’

চিত্রা ছিল সাহিত্যের ছাত্রী। আমেরিকায় এসে কম্পিউটার সায়েন্সে স্নাতক হয়। তাই চিত্রা ঠিক আর দশজন নারী-প্রকৌশলীর মতো নয়। অনেক মায়াবতী আর স্নেহময়ী। ওর পাশাপাশি থাকলে নিজের মনের মধ্যেও খুব ধীরে ধীরে কুলকুল করে শান্তির ঝরনা বইতে থাকে। এবার দেশে গিয়ে

শ্বশুর-শাশুড়িকে নিয়ে রিপা কক্সবাজার বেড়াতে যায়। দেরি করে হলেও অবশেষে রীতার শাশুড়ি কক্সবাজারের সমুদ্রের কাছে আসেন। কিন্তু সমুদ্রের বিশালত্ব মনের গহিনে অনেকদিন ধরে জমে থাকা অভিমান ভাঙতে পারে না। উনার জন্য তা ছিল পুরোপুরিই শুষ্ক সমুদ্র-দর্শন। রিপা সাগরের জলরাশির সাথে খেলতে খেলতে ভাবতে থাকে, একটা সময় দৃশ্যমান সবকিছুই অদৃশ্য হয়ে যায় – পাশের ঝাউগাছ, বেলাভূমি, চারপাশের মানুষজন, তীরে ঠিকরে-পড়া ঢেউ – সবকিছু। অদৃশ্য অভিমান অথবা ভালোবাসারাও কি বিলীন হয়ে যায়, নাকি শক্তির কোনো স্তরে তারা আটকে থাকে? থাকলেও থাকতে পারে সেরকম কোন রহস্যময় স্তর। সে-স্তরে হয়তো আমাদের অনুভূতিগুলো আটকে থাকে। তারপর ভালোবাসা থেকে ঠিকরে পড়ে রোদেলা সোনালি আলো আর অভিমান থেকে নীল অশ্রুবিন্দু।                                      

পাঁচ

দেখতে দেখতে রিপা আর নাঈমের সংসারজীবনের সাত বছর পূর্ণ হয়।

‘মধুমঙ্গলায় কোথাও যেতে চাও বলো তো?’ রিপা নাঈমকে জিজ্ঞেস করে। 

‘মধুমঙ্গলা আবার কী জিনিস?’

‘মধুচন্দ্রিমার বস।’

‘কী রকম?’

‘এই যেমন বিয়ের আগে একদিন তুমি জানতে চেয়েছিলে যে আমি মধুচন্দ্রিমায় কোথায় যেতে চাই। তখন আসলে সাহস করে বলতে পারিনি মনের কথাটা। আসলে তখন বেকার ছিলাম তো তাই তোমার ওপর আর চাপ তৈরি করতে চাইনি। এখন আমার পকেটে পয়সা হয়েছে। এখন আমরা আমার পছন্দের জায়গায় মধুমঙ্গলা করতে যাব।’

‘তা তুমি কোথায় যেতে চাও?’ ‘সুইজারল্যান্ড।’