আজ গোল্লার জন্মদিন। পাঁচ পেরিয়ে ছয়ে পড়বে। মাসখানেক আগে থেকেই সে দিন গুনতে শুরু করেছে। গত মাসে দাদা গুবলুর জন্মদিন ছিল, চিন্তাটা সেদিন থেকে মাথায় ঢুকেছে। একটা করে দিন যাচ্ছে আর উৎসাহ বাড়ছে। সেইসঙ্গে কৌতূহল। বার্থডের দিন কে কে আসবে? কী হবে? কী কালারের বেলুন সাজানো হবে? কেকটা চকলেট হবে তো? যখন যেমন মাথায় আসছে প্রশ্ন করছে। উত্তর দিতে হিমশিম খাচ্ছি আমি। সেদিন যেমন জিজ্ঞাসা করল, যখন আমি হলাম তখন আমি কী করছিলাম?
– কী আর করবে, কাঁদছিলে।
– কাঁদছিলাম কেন?
– খিদে লেগেছিল হয়তো।
– তখন চাউমিন দিলে?
– চাউমিন কী করে খাবে, তখন তো তোমার দাঁত ওঠেনি।
গোল্লা গম্ভীর হয়ে গেল। দাঁত না ওঠার বিষয়টা তার ভালো লাগল না। একটু বোধহয় আত্মসম্মানেও লাগল। কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর দাঁতে দুটো টোকা মারল। টুং-টুং শব্দ হলো। যার উপস্থিতি আজ এতো প্রকট, সেগুলো সেদিন ছিল না! বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে। বিষয়টা যাচাই করতে আবার জিজ্ঞাসা করল, দুটো হাত ছিল?
– ছিল।
– দুটো পা?
– ছিল।
– চোখ, নাক, কান?
– সব ছিল।
– তাহলে দাঁত ছিল না কেন?
এ-ধরনের প্রশ্নের সম্মুখে আমাকে মাঝে মাঝে পড়তে হয়। প্রথম প্রথম খুব বিব্রত হতাম। এখন যা হোক কিছু একটা বলে বুঝিয়ে দিই। বললাম, দাঁত আর চুল ছিল না।
গোল্লা মাথায় হাত দিলো। মাথাভর্তি চুল। ভাবনাটা তখনকার মতো দাঁত থেকে চুলে পরিবর্তিত হলো। আমিও মওকা পেয়ে বললাম, মাথা আঁচড়িয়ে এসো।
গোল্লা ভাবতে ভাবতে মাথা আঁচড়াতে চলে গেল।
আর একদিন জিজ্ঞাসা করল, আমি যখন জন্মালাম, তার আগে আমি কোথায় ছিলাম?
হে রবিঠাকুর, এ-যাত্রায় তুমিই আমার ত্রাতা। তোমাকে ধার করে উত্তর দিলাম, মনের মধ্যে ইচ্ছে হয়ে লুকিয়ে ছিলে।
– তখন আমার কালার কী ছিল?
– কেমন আবার, এখন যেমন! কালো।
– না কালো না, ব্রাউন।
– তাহলে ব্রাউনই হবে। আমি ঠিক জানিনে। আসলে তখনো তোমাকে দেখিনি তো।
গায়ের রং নিয়ে গোল্লার খুব আক্ষেপ। আক্ষেপ দাদার মতো ফর্সা না হওয়ায়। গুবলু আমার রং পেয়েছে, গোল্লা ওর বাবার। তবে গোল্লার পছন্দের রং ব্রাউন। যখন সে দাদার মতো বড় হবে তখন তার গায়ের রং হবে ব্রাউন হবে, এ-কথা সে মাঝেমধ্যেই বলে।
– মা, ইচ্ছা কী?
এখন কী উত্তর দেব! ওকে বোঝানোর মতো ভাষা আমার জানা নেই। এ-ছেলের কী খেলাধুলা করতেও ইচ্ছে হয় না! বললাম, দেখ দাদা কোথায় আছে। দাদার সঙ্গে খেলগে …
– আগে বলো।
কেবল উত্তর দিলে হবে না, উত্তর তার মনমতো হতে হবে। না হলে আরো জ্বালাবে। কান্নাকাটি জুড়ে দেবে। বললাম, সে অনেক কঠিন বিষয়, বাবা জানে। বাবা এলে জিজ্ঞাসা করো। এখন যাও, কাজ করতে দাও আমাকে …
গোল্লা তখনকার মতো চুপ করে। সে জানে, বাবা অনেক মোটা মোটা বই পড়ে, অনেক কিছু জানে। মা পড়ে না। কেবল তাকে পড়ায়।
বিকেলে বাবা স্কুল থেকে ফিরলে গোল্লা মার কোলঘেঁষে দাঁড়িয়ে ফিসফিস করে বলল, বাবাকে জিজ্ঞাসা করো।
– তুই কর।
– না, তুমি করো।
– কী হয়েছে গোল্লা? এদিকে এসো।
বাবা ডাকলে পায়ে পায়ে বাবার কাছে যায় সে।
বললাম, আর বোলো না, সারাদিন কেবল প্রশ্ন আর প্রশ্ন। সত্যি বলছি, এতো প্রশ্নের উত্তর আমার জানা নেই। এ-ছেলে আমায় পাগল করে ছাড়বে।
– প্রশ্নটা কী?
– ইচ্ছা কি?
পুরো ঘটনাটা বললাম। শুনে ওর বাবা হো-হো করে হেসে উঠল। হাসতে হাসতে গোল্লাকে নিয়ে সোফায় বসল। পকেট থেকে দুটো ক্যাডবেরি বের করে গোল্লার হাতে দিয়ে বলল, একটা তোমার আর একটা দাদার। এবার বলো কী জানতে চাও?
বাবার কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে জিজ্ঞাসা করল, ইচ্ছা কী?
– শক্ত প্রশ্ন। কিন্তু তুমি তো এখন ছোট মানুষ, তুমি এখন বুঝবে না। আগে বড় হও, পড়াশোনা করো, তারপর বুঝতে পারবে …
– দাদার মতো বড়?
– দাদার থেকেও বড়। অনেক বড়।
– যখন তোমার মতো গোঁফ হবে?
– এই তো গোল্লা বুঝেছে। তোমরা বুঝিয়ে বলতে পারো না তাই। শেষ
কথাগুলো আমাকে উদ্দেশ করে।
সেদিনের পর থেকেই গোল্লা মাঝেমধ্যে ড্রেসিং টেবিলের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। নিজের মুখের দিকে তাকিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। গোঁফের ওপর হাত বুলায়। কারো চোখে পড়ে গেলে লজ্জা পেয়ে দৌড়ে পালায়।
– বার্থডে হলেই বড় হয়ে যাব? আর একদিন জিজ্ঞাসা করল।
বললাম, সে তো হবেই।
– কেক কাটার পর?
– শুধু কেক কাটলে হবে না, পায়েসও খেতে হবে।
– কত বড় হবো?
– পাঁচ বছর থেকে ছয় বছর হবে।
– ছয় বছর হলে কত বড় হয়? মাথার প্রায় এক বিঘৎ ওপরে হাত রেখে জিজ্ঞাসা করল।
বললাম, অতটা না হলেও বড় হবে।
– বড় হলে কী হবে?
– একা খেতে শিখবে। তখন আমি আর খাইয়ে দেব না। নিজে হাতে ভাত তুলে খাবে।
– দাদা খেয়েছিল?
– খেয়েছিল।
গোল্লা চিন্তায় পড়ে। কিছুক্ষণ গুম মেরে দাঁড়িয়ে থাকার পর খুকখুক করে কাঁদতে শুরু করে।
– কী হলো কাঁদছ কেন?
আমি সাত বছরে বড় হবো, ছয় বছরে হবো না।
দুই
গোল্লার পাঁচ বছরের জন্মদিনটা বেশ বড় করে হয়েছিল। বড় বলতে প্রায় শখানেক লোকের আয়োজন। অনুষ্ঠান হয়েছিল ছাদের ওপর, গার্ডেন ছাঁটা খাটিয়ে। মেনু ছিল সাধারণ। ফ্রায়েড রাইস, আলুর দম, চিলি পনির আর চিকেন কষা। আর ছিল চাটনি পাপড় মিষ্টি। শেষ পাতে আইসক্রিম। রিটার্ন গিফট হিসেবে ছোটদের দেওয়া হয়েছিল একটা করে প্যাস্টেল কালারের বাক্স। আমাদের ক্ষুদ্র সামর্থ্যে এইটুকু করতেই এক বছর আগে থেকে প্রিপারেশন নিতে হয়েছিল।
পঞ্চম জন্মদিনের সমস্ত স্মৃতিই মনে আছে গোল্লার। কী কী রান্না হয়েছিল, কে কে এসেছিল, কে কী দিয়েছিল। গিফটগুলো দেখলে এখনো বলে দিতে পারে। সবকটা খেলনা সে যত্ন করে রেখে দিয়েছে। মাঝে মাঝে একটা বের করে, কিছুদিন খেলে, তারপর তার খেলনা রাখার পিচবোর্ডের বাক্সে তুলে রাখে। ছোটবেলা থেকেই সে গোছানো স্বভাবের। নষ্ট করে না কখনো।
প্রতিদিন সকালে উঠেই জিজ্ঞাসা করে, মা আর কতদিন?
অবশেষে আজ সেই কাঙ্ক্ষিত দিনটি।
সকালটা স্বাভাবিকভাবেই শুরু হলো। একবার ডাকতেই ঘুম থেকে উঠল, ব্রাশ করল, কোনোরকম ওজর-আপত্তি ছাড়াই টিফিন করল। তার মানে এই নয় যে, গোল্লা খুব শান্ত প্রকৃতির। বরং উলটোটা। মাথাভর্তি দুষ্টুবুদ্ধি। সারাদিন দাদার সঙ্গে খুনসুটি করে।
আজ জন্মদিন বলেই হয়তো শান্তশিষ্ট। আজ যে বড় হওয়ার দিন।
একটু বেশিই চুপচাপ মনে হলো তাকে। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে কেমন গম্ভীর হতে শুরু করল। কারো সঙ্গে কথা বলছে না, খেলছে না, সবসময় অন্যমনস্ক। কিছু একটা ভাবছে।
গোল্লা আজ বড্ড বেমানান। ওকে দেখে আমারও খারাপ লাগছে। কী এমন ভাবছে কে জানে! জিজ্ঞাসা করলেও কিছু বলছে না। সরে যাচ্ছে। কাজকর্মের ফাঁকে একসময় কাছে টেনে জানতে চাইলাম, কী হয়েছে গোল্লা?
গোল্লা উত্তর দিলো না। মুখটা কেবল নামিয়ে নিল।
মন খারাপ?
গোল্লা মাথা নাড়ল, না।
শরীর খারাপ লাগছে?
– না।
– তাহলে?
গোল্লা একই রকম মাথা নাড়ে। যতই ও না বলুক, কিছু একটা যে ভাবছে
সে-বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। তবে কি বড় হওয়ার ভয়ে ভীত? বড় হলে নিজে হাতে খেতে হবে। ওকে আশ্বস্ত করে বললাম, ভয় নেই, ভাত তুলে খেতে হবে না। আমিই খাইয়ে দেব।
ওর গোমড়া মুখ দেখতে আমার আর ভালো লাগছিল না।
গোল্লা আমার মুখের দিকে তাকাল। দুচোখে অবিশ্বাস। বললাম, সত্যি বলছি।
একটু যেন হাসি ফুটল মুখে। আমার মুখেও হাসি ফুটল। এতক্ষণে স্বস্তি পেলাম।
তিন
রংবেরঙের বেলুনে ঘরটা সাজানো হয়েছে আর গোল্লার পছন্দের একটা কেক আনা হয়েছে। আয়োজন বলতে এটুকু। আর্থিক কারণেই এ-বছর এমন সাদামাটা অনুষ্ঠান। অতিথি বলতে একমাত্র আমার ছোটভাই, গোল্লার ছোটমামা এসেছে। কাউকেই বলতে পারিনি।
যথাসময়ে গোল্লাকে স্নান করিয়ে নতুন পোশাক পরিয়ে দিলাম। জামা-প্যান্ট ওর বাবা কিনেছে। আমি এখনো কিছু কিনিনি। বিকেলে গোল্লাকে নিয়ে বাজারে যাব, ওর পছন্দসই একটা খেলনা কিনে দেব। ছোটমামাও সঙ্গে করে কিছু আনেনি, গোল্লার পছন্দমতো জিনিস কিনে দেবে বলে।
অনুষ্ঠানের আয়োজন সম্পূর্ণ। আসন পাতা হয়েছে, বাটায় ধান-দূর্বা-চন্দন আশীর্বাদের জন্যে। রেকাবিতে পাঁচরকম মিষ্টি, থালায় পাঁচ ভাজা, পঞ্চব্যঞ্জন, মাছের মাথা। রুপোর বাটিতে পায়েস। একেবারে সনাতন বাঙালি পদ্ধতি। পরপর ঠাকুরদা, ঠাকুমা, বাবা, মামা, সবশেষে আমি আশীর্বাদ করলাম। গোল্লা কোনো কিছুতেই আপত্তি করল না, বাধ্য ছেলের মতো যা যা বলা হলো করল। এমনকি অপছন্দের পায়েসও মুখ বুজে খেয়ে নিল। তবে সবটাই করল গম্ভীর মুখে। মাথাটা সবসময় মাটির দিকে ঝুঁকে থাকল। দুশ্চিন্তাটা এখনো মাথা থেকে যায়নি বুঝতে পারছি।
অনেকবার জিজ্ঞাসার পরও মন খারাপের কারণ জানতে পারলাম না। এমন চাপা স্বভাবের ছেলে তো ও নয়। তবে কি রাতারাতি বড় হয়ে গেল!
সন্ধ্যায় সবাই মিলে বাজারে বেরুলাম। ভ্যান রিকশায় বাটার মোড় পর্যন্ত পৌঁছে, রাস্তাটা পেরোলেই পরপর কয়েকটা খেলনার দোকান। শহরের সবচেয়ে বড় কমিউনিটি হলটা এই মোড়েই। ভেতরে বিয়ের অনুষ্ঠান চলছে। বেশ বড়সড় বিয়ে। বহু লোকের সমাগম। রাস্তার ওপরেও বড়সড় একটা জটলা। পুরো বাড়িটা রংবেরঙের আলোয় সাজানো হয়েছে। মাইকে বাজছে বিসমিল্লার সানাই। আতরের গন্ধে চারপাশ ম-ম করছে। গোল্লা হঠাৎ থমকে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞাসা করল, এখানে কী হচ্ছে মা?
বললাম, বিয়ে।
– এবার বুঝেছি, গোল্লা দুদিকে মাথা নাড়ে, এই জন্যেই …
আমি কিছু বুঝতে পারি না। জিজ্ঞাসা করি, কী?
– সবাই এখানে এসেছে, আমার বার্থডেতে যায়নি। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, সেজন্যে একটা গিফটও হয়নি … বুকের ভেতর দলা-পাকানো একটা কষ্ট গলার কাছে এসে আটকে যায়। গোল্লাকে কোলে তুলে নিয়ে বলি, না আসুক। আমি তোমাকে অনেক খেলনা কিনে দেব।
Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.