বিমূর্ত চেতনায় রক্ত-আঙুল

হাসান অরিন্দম

আমি জানতাম কোনো-না-কোনো দিন এমন একটি অপ্রত্যাশিত ঘটনা ঘটবে। কয়েক দিন তীব্র জ্বরে ভোগায় অফিস থেকে ছুটি নিতে হয়েছিল। শেষরাত থেকে ঘোর-ধরানো দুঃস্বপ্নের মতো জ্বরের সেই উত্তাপটা আর নেই। রুটি-ডিম ভাজি দিয়ে সকালে নাস্তা করার পর মাথাটা বেশ হালকা বোধ হওয়ায় ল্যাপটপ নিয়ে পুবের বারান্দায় বসি অফিসের পেন্ডিং কাজগুলো করব বলে। খানিক পর দুজোড়া নীল কাচের চুড়িপরিহিত একখানা শুভ্র নারীহাত আমার টেবিলে কম্পিউটারের ডান পাশে এক কাপ ধোঁয়াওঠা চা রেখে যায়। মিনিটখানেক পর চায়ের কাপে মুখ দিয়ে নোনতা স্বাদ পেয়ে আমি কাপের দিকে তাকিয়ে দেখি কাপভর্তি চা তো নয়, টকটকে লাল ঘন তরল। আমার কোনো ভুল হচ্ছে না – দৃষ্টির সামনে টাটকা উষ্ণ রক্তভর্তি কাপ। আমি ভালো করে নেড়েচেড়ে কাপটা যখন পরখ করছি ততক্ষণে ধীরে ধীরে তরলের লালচে ভাবটা নিজে থেকে ফিকে হয়ে আসে, ক্রমে তা নীলচে জলে পরিণত হয়। আমি খেয়াল করি কাপভর্তি তরল ক্রমে গতি পায় – যেন উত্তাল সমুদ্রের জল দুদিকে আছড়ে পড়ছে, সিরামিকের সাদা দেয়াল হয়ে উঠেছে কোনো সমুদ্রের তীর। হঠাৎ দেখি কাপের ভেতর মানুষের একটি কাটা আঙুল ডুবে আছে। আঙুলটা হুবহু আমার কনিষ্ঠ আঙুলের মতো বলে মনে হলো। আঙুলের কাটা জায়গা থেকে রক্ত চুঁইয়ে পড়ে কাপের নীলচে জলকে আবারো দ্রুত রক্তিম করে তুলছে। কাছাকাছি কোথাও একজোড়া কাক ডানা ঝাপটাচ্ছে। তখন আমি আমার ডান হাতের কনিষ্ঠ আঙুলে টনটনে ব্যথা টের পাই। বাইরে সূর্যের তাপ ক্রমবর্ধমান। আমার স্থির সময়ের জমাট বরফ গলে চুঁইয়ে চুঁইয়ে শীতল স্বচ্ছ জলের ফোঁটা পড়তে থাকে। বারান্দার গ্রিলে কখন একটা দাঁড়কাক এসে বসেছে খেয়াল করিনি। আমি আঙুলসহ কাপের তরল বাইরে ছুড়ে ফেললে কাকটি কা-কা করে উড়ে যায়, কালো নোংরাঘাঁটা রক্তলোভী পাখিটা সম্ভবত ছিন্ন পরিত্যক্ত আঙুলটার পিছু নেয়। আমার মনে হয় আমাদের এই হতভাগা শহরে কাক ছাড়া আর সব পাখি বিলুপ্ত হয়ে যাবে খুব শিগগির।

বারান্দায় ধীরপায়ে পায়চারি করতে করতে আমি হিসাব করে দেখি ওই ঘটনাগুলো ঘটেছিল আজ থেকে ঠিক চার মাস আগে জুনের চার তারিখে, সেটা গ্রীষ্মের রাত। একুশ বছর বয়সী রুমানার সঙ্গে আমার বিয়ে হয়েছিল প্রেম করেই। ওর প্রথম সন্তান এর আগে সাত মাসে গর্ভে মারা যাওয়ায় দ্বিতীয়বার অন্তঃসত্ত্বা হওয়ার পর থেকে ও সবসময় উদ্বিগ্ন থাকত। নির্জন দুপুরে পাশে শুয়ে কিংবা বিকেলে চা খেতে খেতে আমি ওর মাথায় হাত বুলিয়ে বলতাম, ‘একবার এমন হতেই পারে, তাই বলে বারবারই কি হবে –    তুমি অহেতুক ভয় পেও না।’ ও বলত, ‘ডাক্তারই তো বলেছেন – একবার এমন হলে আশঙ্কা থেকেই যায়। তবে তুমি আমার পাশে

থাকলে কোনো ভয় নেই।’ সত্যি কথা বলতে সন্তানের জন্ম নিয়ে আমার ভেতরেও বিশেষ উদ্বেগ, আশঙ্কা আর উত্তেজনা কাজ করত। আমিও ভাবতাম, রুমানা যদি এভাবে কেবল মৃত সন্তান জন্ম দিতে থাকে? কিংবা সন্তানরা জন্মের দু-একদিনের মধ্যেই যদি মরে যায়? গর্ভধারণের প্রথমদিকে দু-সপ্তাহ পরপর আর শেষের দিকে প্রতি সপ্তাহে ওকে নিয়ম করে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গিয়েছি। ন’টা মাস কেটে যায় নির্বিবাদেই। নির্দিষ্ট দিনে আমি হাসপাতালে ওটির বিছানা পর্যন্ত রুমানাকে পৌঁছে দিতে গিয়ে লক্ষ করি এয়ারকন্ডিশন্ড রুমেও ও দরদর করে ঘামছে, নিশ্চয়ই বিবিধ আশঙ্কা ওর বুকে চেপে বসেছে। আমি যখন ওর হাতের তালুর উলটো দিকে একটা আলতো চুমু দিয়ে বিদায় নিতে যাচ্ছি তখন ও কান্নামাখা কণ্ঠে বলে, ‘কথা দাও আমাকে কখনো ছেড়ে যাবে না।’ আমি বলি, ‘রুমানা, তুমি ছাড়া আর কিছুতেই আমার মন নেই, তুমি নিজেও জানো; ছেড়ে যাওয়ার  প্রসঙ্গ অবান্তর, যদি আমি মরে না যাই।’ ততক্ষণে দুজন নার্স ওকে নিয়ে ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়েছে। একজন নার্স আমাকে বলল, ‘আপনাকে এবার বাইরে যেতে হবে।’ আমি শুনেছি পশ্চিমের নানান দেশে সন্তান জন্মের সময় পিতাকেও ওটিতে বা লেবার রুমে থাকতে দেওয়া হয়, এমন একটা দেশে আমার সন্তান ভূমিষ্ঠ হলে আমি স্ত্রীর কাছে দিব্যি থাকতে পারতাম – এ-কথা ভাবতে ভাবতে ওই  ঘর থেকে বেরিয়ে আসি। ওটির বাইরে ছোট রুমটাতে বসে রাত নয়টা দশ মিনিটে আমি সদ্যোজাত শিশুর কান্না শুনে ব্যাকুল হয়ে উঠি, ভেতর থেকে খবর আসে সিজারিয়ানে রুমানা এক সুস্থ-সবল পুত্রসন্তান জন্ম দিয়েছে। সন্তান কোলে নেবার পর থেকে ক্লিনিকে নানান কাজে ব্যস্ত থাকতে হয় – ওষুধ আনা, শিশুর দিকে খেয়াল রাখা, ডাক্তার ও নার্সদের সঙ্গে নানা দরকারি বিষয়ে কথা বলা – কীভাবে আমার তিনটে ঘণ্টা পার হয়ে যায় আমি নিজেও টের পাইনি। শাশুড়িকে রুমানার কাছে রেখে আমি রাত পৌনে একটার দিকে বিদায় নিই। দশ মিনিটের রিকশার পথ পেরিয়ে বাসায় ফিরলে কলিংবেল বাজানোর সঙ্গে সঙ্গে সুহিতা দরজা খুলে দেয়। সে টেবিলে খাবার সাজিয়ে আমার জন্য অপেক্ষা করছে অনেকক্ষণ ধরে, ওর চোখে ঘুমের লেশমাত্র নেই। সুহিতা আমাদের দুঃসম্পর্কের আত্মীয়া, একটি কলেজে সমাজবিজ্ঞানে অনার্স পড়ছে। রুমানার পরামর্শেই এ-পরিস্থিতিতে ও আমাদের সাহায্য করার জন্য এসেছে। এর আগে বছর তিনেক পূর্বে ওকে আমি দেখেছিলাম যেদিন আমার মা মারা যান, চেহারাটা স্পষ্ট মনে ছিল না। সুহিতা বলে, ‘ফেসবুকে বাবুর ছবি দেখলাম। সব খবর ভালো তো?’ ওর স্বতঃস্ফূর্ত ভঙ্গিমা আমার ভালো লাগে। আমি নিজের ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বলি, ‘এখনো পর্যন্ত সব ঠিকঠাকই আছে।’ হাতমুখ ধুয়ে খাবার টেবিলে বসলে ও আমার বিপরীত দিকের চেয়ারটায় বসে। ‘তুমি খেয়েছ সুহিতা?’

‘একা একা কি খাওয়া ঠিক? আপনারা হাসপাতালে আর আমি হাপুস-হাপুস করে খাব, তা কি হয়?’

‘তাতে দোষের কী? তুমি খেয়ে নিতে, রাত এখন একটা বিশ।’

‘বাবুর নাম কি ঠিক করেছেন?’

‘তোমার ভাবি কী-যেন দুটো নাম বলেছিল আমার মনে নেই, আগে সব বাড়ি  তো আসুক, তারপর দেখা যাবে।’

এরপর খানিক নীরবে কাটে, মনে হয় টেলিভিশনটা চালু থাকলে ভালো হতো। আমি খেতে খেতে কেমন অপ্রস্তুত বোধ করি, মনের ভেতর এখনো ওষুধের গন্ধভরা হাসপাতালের বাতাস। প্রসঙ্গ খুঁজে না পেয়ে সুহিতার মুরগি আর ডাল রান্নার প্রশংসা করি। অবশ্য প্রশংসাটা মিথ্যে ছিল না, সুহিতা রুমানার চেয়ে ভালো রান্না করে তা আমি এই দুবেলা খেয়েই বুঝতে পারছি। ও জিজ্ঞেস করে, ‘ভাবি তো দু-তিনদিন পরেই চলে আসতে পারবে, না?’ ‘দেখা যাক’ বলতে বলতে ওর চোখের দিকে তাকাতে আমার কেমন অস্বস্তি বোধ হয়। সুহিতার চোখজোড়া কি এমন টানাটানা – নাকি কাজল এঁকেছে? ধুর, এসব একান্ত ওর ব্যাপার – আমি এসব ভাবছি কেন? আমি মনে মনে ক্লিনিকে দেখা রুমানার ফোলা ফোলা মুখখানা আর কাতর কণ্ঠ মনে করার চেষ্টা করি। ড্রইং স্পেসের দেয়ালে ঠিক তখনই একটা টিকটিকি টিকটিক করে আওয়াজ করে উঠল। টিকটিকির তো তেমন সেন্সই নেই – সিক্সথ সেন্সের প্রসঙ্গ অবান্তর, মনে মনে আমি ভাবি।

দুটো দিন না-পেরুতেই আমি নিজের অপরাধ নিজের কাছে লঘু করে ফেলেছি এই যুক্তিতে যে সে-রাতে সুহিতাই আমার ঘরে এসেছিল, আমি তার ঘরে যাইনি। ওর প্রত্যাশার বাইরে কিছুই সম্ভব ছিল না, ঘটেওনি এক বিন্দু। সে-রাতে সুহিতা সম্ভবত মিথ্যে বলেনি, কিংবা ও-ও আগে থেকে কিছু জানতো না। দু-হাতের নখ খুটতে খুটতে কেবল নতদৃষ্টিতে বলেছিল, ‘নতুন জায়গা, একা ঘরে ঘুমাতে পারছি না, কেমন ভয় ভয় করছে।’ আমি দরজা লক করিনি, সামান্য খোলা ছিল, আমারও মনে হয়েছিল মেয়েটা আবার ভয়টয় পায় কি না। ওর কথা শুনে আমি মশারির ভেতর থেকে বেরিয়ে ঘরের বাতি জ্বালি। রাত আড়াইটার সময় নির্জন বাড়িতে আমার ঘরে সুহিতার উজ্জ্বল মুখখানায় চোখ রেখে ফ্যানের বাতাসে ওর রেশমি চুল দুলতে দেখে আমার কেমন ভয় হয়, বুকটা ঢিপঢিপ শুরু করে। হঠাৎ ঘরের বাতাস সুরভিত মনে

 হওয়ায় আমি ভাবি সুহিতা কি কোনো সুগন্ধি মেখেছে? এই সুবাস তো আমার চেনা নয়। তখন আমার রুমানার কথা মনে পড়ে – ও আমাকে এতটা বিশ্বাস করতে গেল কেন? আমি তো কোনো সাধু-সন্ত নই। সুহিতাকে এভাবে রেখে না-গিয়ে অ্যারেজমেন্টটা ভিন্নভাবে করতে পারত। আমাকে নিয়ে আশঙ্কা নেই, সেটা তো উপেক্ষার কারণে নয়? এতটা নির্বিকার হওয়া কি ভালো? কিন্তু আজ যে হাসপাতালে ও আমাকে ভালোবাসার কথা জানাল; বলল, আমি পাশে থাকলে তার কোনো ভয় নেই! আমার মোবাইল ফোনটা বন্ধ ছিল। রাত সাড়ে তিনটের দিকে শ্বাসকষ্টে নীল হয়ে আমার সদ্যোজাত পুত্রসন্তানটি মারা যায়। পরে অনেকে বলেছে, ছোট বাচ্চার ফুসফুস অনেক সময় অপরিণত দুর্বল থাকে, ওকে হয়তো যথাসময়ে অক্সিজেন দেওয়া হয়নি, নইলে পুরো ব্যাপারটা অন্যরকম হতে পারত।

টানাটানা চোখের বাইশ বছর বয়সী মেয়ে সুহিতার সঙ্গে আমার সম্পর্কটি সেখানেই থেমে থাকেনি। আমাদের মধ্যে আজো সুগভীর যোগাযোগ রয়েছে, সম্পর্ক হয়েছে আরো সূক্ষ্ম ও জটিল, বেড়েছে উষ্ণতাও। চার জুনের রাতটিকে সুহিতা কোনো কুক্ষণ বলে বিবেচনা করেনি। বরং ওই প্রহর থেকেই তার ভেতর নতুন এক স্বপ্নের সম্ভাবনা ক্রমে ডালপালা আর নতুন কিশলয় সহযোগে বিস্তার লাভ করতে থাকে। শিশুটির মৃত্যুঘটনা সত্ত্বেও আমি সুহিতাকে কোনোভাবে দায়ী করতে পারিনি, একবারও তাকে মায়াবিনী বলে শঙ্কা বা ঘৃণা হয়নি। বরং আমার একটি দায়বোধ ক্রমে গভীর হতে থাকে ওই ক্ষীণকটি মেয়েটির প্রতি। কিন্তু আমি ভেবে পাই না সুহিতা কেন এত সহজেই আমার প্রতি সমর্পিত হতে গেল? ও তো নিজের জীবনটাকে অন্যভাবেও ভাবতে পারত। আমি যে খুব বেশি অর্থশালী তা নয়। এ কি প্রেম – ও আমার রূপে মুগ্ধ, নাকি ব্যক্তিত্বে? নাকি অন্য একজন প্রতিদ্বন্দ্বী নারীকে সহজেই পরাজিত করার সুখ লাভ করতে চায় সুহিতা? ও যদি হাত এগিয়ে রাখে আমি কেন দু-হাত একেবারে গুটিয়ে রাখব? আমি তো পুরুষ মানুষ। আমি জানি, আমার হাতের ভেতর যে-জ্বলন্ত কয়লা তা একসময় শীতল হয়ে এলে সহনীয় হয়ে উঠবে। একদিকে রুমানা অন্যদিকে সুহিতা আর মাঝখানে শ্বাসকষ্টে নীল হয়ে মারা-যাওয়া একটি শিশু আমাকে প্রবলভাবে পীড়িত করতে থাকলেও আমি এই বিশ্বাস নিয়ে বেঁচে থাকি যে, আমাদের জীবনের খুব কম পরিণতিই আসলে আমাদের নিজেদের হাতে থাকে। আমি বিস্মিত হয়েছি সে-রাতে আমার ফোন বন্ধ থাকায় পুত্রের মৃত্যু নিয়ে রুমানা আমাকে দায়ী করেনি, একবার প্রসঙ্গটি তুলেছিল  মাত্র।  আমি আমতা-আমতা করে জবাব দেওয়ার পর আর কখনো ও-কথা তোলেনি সে। প্রথম সন্তান গর্ভে মারা যাওয়ার পর দ্বিতীয় সন্তানের মৃত্যুও সম্ভবত ও অনিবার্য ভবিতব্য বলে ভেবে নিয়েছিল। শোককাতর রুমানার প্রতি ভালোবাসার চেয়ে ওর প্রতি সহানুভূতির তীব্রতা বাড়তে থাকে, সম্ভবত সেই অবসরে সুহিতার সঙ্গে সেই রাতের মুহূর্তগুলো বারংবার আবৃত্তি করে স্বস্তি পেতে চায় বিচিত্র আবেগে ক্লান্ত ও বিধ্বস্ত আমার মন। আমার চোখের সামনে রুমানা ক্রমে শুষ্ক লতার মতো বিবর্ণ-নির্জীব হয়ে ওঠে। চারপাশ দেখেশুনে আমার ভেতরে কে যেন বারবার বলে ওঠে, মোটাদাগের পাপপুণ্য-বোধের চেয়ে জীবনে আরো বহু সূক্ষ্ম উপভোগ্য অনুভব রয়েছে। একটি-দুটি শোক বুকে পুষে সেগুলোকে জীবন্ত কবর দেওয়ার কোনো মানে হয় না। সে-রাতে আমার ফোন খোলা থাকলে, খবর পেয়ে আমি তৎক্ষণাৎ হাসপাতালে ছুটে গেলে শিশুটি যে বাঁচত এমন দিব্যি তো কেউ দেয়নি। এ-ধরনের যুক্তির জয়লাভে সুহিতার মুখখানা আমার অন্তরজুড়ে ক্রমে উজ্জ্বলতর হয়ে ওঠে। আর আমি হাতের ভেতর জ্বলন্ত কয়লা নিয়ে খেলায় পারদর্শী হয়ে উঠি। পেছনের চার বছরের সংসার ক্রমেই বিবর্ণ হতে থাকে আমার ধোঁয়াশা আচ্ছন্ন মনে।

পুবের বারান্দায় পায়চারি করতে করতে খেয়াল করি কাটা আঙুলটা ঠোঁটে নিয়ে কালো কাকটা উড়াল দিলো। তখন আমি মনে করার চেষ্টা করে আজকে সকালে খানিক আগে যে-নারী আমাকে চায়ের কাপটা দিয়ে গিয়েছিল সে কি রুমানা, নাকি সুহিতা? কাপের তরলের এমন আচরণের কারণই বা কী হতে পারে? নাকি আমি নিতান্তই মতিচ্ছন্ন, দিগ্ভ্রান্ত? হয়তো সবকিছু ঠিক আছে, বস্তুত এই রূপান্তর আমার দৃষ্টিভ্রম, আমার পাপিষ্ঠ মনের অন্তর্দ্বন্দ্ব। তখন আমার হঠাৎ মনে পড়ে কাপের ভেতরকার আঙুলটা মেহেদিরাঙা ছিল। তাহলে নিশ্চিত যে, ওটা পুরুষের নয়, নারীর আঙুল – সে কি রুমানা, নাকি সুহিতা, কিংবা তৃতীয় কোনো রমণী? – এই কথা যখন ভাবছি তখন রান্নাঘর থেকে একটি আর্তচিৎকার শুনে ছুটে যাই। দেখি একটা ছিন্ন কনিষ্ঠ মেহেদিরাঙা আঙুল মেঝেতে তড়পাচ্ছে। মুরগি কাটতে গিয়ে আঙুল কেটে ফেলেছে এক নারী। নীল-কমলা সুতি শাড়ি পরিহিত নারীটিই এখন আমার জীবনসঙ্গিনী। পেছন থেকে আমি তাকে ঠিক চিনে উঠতে পারি না। কে এ? রুমানা, নাকি সুহিতা? তাহলে অপরজন কোথায়? এসব ভাবতে ভাবতে আমার কানে একটি সদ্যোজাত শিশুর তীব্র ক্রন্দন ভেসে আসে। চিৎকারে আমার অন্তঃকরণ বিদীর্ণ হবার উপক্রম। নিরুপায় আমি রক্ষা পেতে দু-কানের ভেতর দু-হাতের তর্জনি ভরে দিই। তখনো বুকটা ভীষণ ধুকপুক করতে থাকে।

আমি রান্নাঘরের রক্তপিছল মেঝেতে হঠাৎ আছড়ে পড়তে পড়তে দেয়াল ধরে টাল সামলে নিই। সে-সময় শিশুর আর্তচিৎকার থেমে গিয়ে আমার মগজের ভেতর উত্তাল বাতাস তোলে সেই রাতে সুহিতার মাতাল করা তপ্ত নিশ্বাসের সৌরভ। অনেকক্ষণ ধরে বাইরে গুমোট ভাব, বাতাস নেই। পাখিরা নিরাপদ আশ্রয় খুঁজছে। বোধ হয় ঝড় উঠবে। হঠাৎ আমার মনে পড়ে, আজ থেকে এগারো-বারো দিন আগে এক তরুণীর শেষকৃত্য অনুষ্ঠানে আমি হাজির ছিলাম। তার কাফনমোড়া লাশটি যখন কবরে নামানো হয় তখন আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নেমেছিল, কবরের ভেতর জল জমে ওঠায় সবুজ কলাগাছের ওপর রাখা হয়েছিল নারীর মৃতদেহ। আমি তরুণীটির মৃত্যুর কারণ স্পষ্ট মনে করতে পারি না। সে কি খুন হয়েছিল? বাইরে ধুলোঝড়। জানালার ওপাশের দেবদারু গাছগুলো বাতাসের তোড়ে দুমড়ে যাচ্ছে। আমার মন বলছে বৃষ্টি নামুক। বিচ্ছিন্ন আঙুলের কম্পন থেমেছে অনেক আগেই। সাদা কাপড়ে ক্ষতস্থান মুড়িয়ে আমার পাশে দাঁড়িয়ে কাতরাচ্ছে এক নারীমূর্তি। আমি বলি, ‘তোমাকে এক্ষুনি হাসপাতালে নিতে হবে, ভীষণ রক্তপাত হচ্ছে, কিন্তু ঝড়ের দাপট যে প্রবল হয়ে উঠল!’ মেঝের ওপর জমাটবাঁধা রক্ত দেখে নিজেকে খুনি বলে আশঙ্কা হচ্ছে। এবার আকাশ ভেঙে আরো ভয়ঙ্কর বৃষ্টি নামুক। সবকিছু ভাসিয়ে নিয়ে যাক। চারপাশের পরিবেশ ও বাস্তবতা ক্রমাগত আমার বিশ্বাস ও সহ্যসীমার বাইরে চলে যাচ্ছে। আমি মনে মনে প্রার্থনা করি আমার মাথার ওপরকার আকাশ বিচূর্ণ হোক। ক্রমাগত বজ্রপাতে জ্বলন্ত অগ্নিকুণ্ড হোক এই গ্রহ। কিংবা এবার প্লাবনে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাক যাবতীয় জনপদ, সভ্যতা – সমগ্র ভূভাগ!  সে-মুহূর্তে সত্যি সত্যিই আমাদের জানালার কাছে প্রচণ্ড শব্দে একটি বজ্রপাত হলে আমরা কেঁপে উঠি। তখন আমার ভেতর থেকে কে যেন বলে ওঠে, ‘নিহত শিশুটির জন্য আজ অবধি তোমার চোখ থেকে এক ফোঁটা জলও কিন্তু গড়ায়নি, অথচ তুমি তার জনক।’ বজ্রপাতের পর বৃষ্টির দাপট বেড়েছে। হঠাৎ আমার বুকের ভেতরটা কেন যেন ফেনিয়ে ওঠে, শরীর জুড়ে অদ্ভুত কাঁপুনি – আমি দুহাতে মুখ ঢেকে কান্নার বিস্ফোরণ রোধ করার চেষ্টা করি।