বাঁকবদলের কবিতা

পিয়াস মজিদের লেখা বইয়ের নামটি আমাদের মনে একটা নস্টালজিক আবহ নিয়ে হাজির হয়। ধারণা হয়, কৈশোরে কোনো ভালো-লাগা কিশোরীর স্কার্টের পার্পল প্রহেলি একদা এক কিশোরকে ভুলিয়েছিল, আজ সেই মেয়েটির নাম কিংবা চেহারাটি মনে নেই, স্মৃতিতে শুধু ঝুলে আছে উজ্জ্বল পার্পল রঙের স্কার্টের সর্পিল জ্যামিতিক ঢেউ।

কবিতার বইটি পড়তে গেলে ধারণা ভাঙবে পাঠকের। অতীত প্রাসঙ্গিক হলেও বড় অনুষঙ্গ নয় এ-বইয়ের। একদম আটপৌরে গোটাকতক বিষয়বস্তু নিয়ে লেখা আটান্নটি কবিতা নিয়ে বেরিয়েছে এই বই। মহৎ কোনো ভাব, কিংবা শিল্পের আকাক্সিক্ষত বিষয়বস্তু নিয়ে কবিতা এ-বইয়ে ঠাঁই পায়নি, ধারণা করি, কবিতা বাছাইয়ের কাজটি কবি সচেতনভাবেই করেছেন। তিনি লিখেছেন সেসব বিষয় নিয়ে, যেগুলি নিয়ে কবিতা লেখার কথা কবিদের মনে সহসা আসে না। যাপিত জীবনের অনানুষ্ঠানিক নানা উপকরণকে শব্দ দিয়ে ধরার চেষ্টা ভুলে যাওয়া স্কার্টের সিঁড়ির কবিতাগুলিতে।

বইটি নেড়েচেড়ে দেখে প্রথমদৃষ্টে মনে হতে পারে, এতদিন সোনালি ফসল ফলানো কৃষক কি এ-মৌসুমে তাঁর জমিতে আগাছা ধঞ্চের আবাদ করলেন? কাব্য-ফসলের ক্রেতা পাঠক মহাজন আগাছায় তুষ্ট হবেনই বা কেন? সে প্রশ্নের জবাব খুঁজতে আজকের লেখাটি লিখতে বসা। রবিঠাকুরের এক অভিভাষণ স্মর্তব্য : ‘মেয়াদ ফুরোলে যে গাছ মরে যায়, অনেকদিন থেকে ঝরা পাতায় সে মাটি তৈরি করে; সেই মাটিতে খাদ্য জমে থাকে পরবর্তী গাছের জন্য। ভবিষ্যতের সাহিত্যে আমার জন্য যদি জায়গার টানাটানিও হয়, তবু এ কথা সবাইকে মানতে হবে যে সাহিত্যের মাটির মধ্যে গোচরে অগোচরে প্রাণের বস্তু কিছু রেখে গেছি।’ (‘কবির অভিভাষণ’, ১৩৩৮ বঙ্গাব্দ)

দুই

ভুলে যাওয়া স্কার্টের সিঁড়ি বইয়ের কবিতাগুলিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ হিসেবে আসে সময়। সময়কে ধরে রাখা যায় না, মাস-তারিখ-সাল, শনি-রবি-সোম, শীত-বর্ষা-হেমন্ত, সকাল-সন্ধ্যা এসব নিশানা দিয়ে চিহ্নিত করা যায়। এই কবিতার বইটিতে আমরা বেশ কিছু কবিতার শিরোনাম পাই সময়বাচক। যেমন : শুভ শুক্রবার, বৃহস্পতিবার বিকেল, বৃহস্পতিবার রাত থেকে, ভাদুর মাইসা প্রেম, সামিরার সহিত সন্ধ্যা, সকাল সকাল, শীতের সূত্রে, মুভি আওয়ার, আবারও ঈদ এসে যাচ্ছে ইত্যাদি। কবিতার মধ্যেও এর কমতি নেই –

‘ঢিলেঢালা শনিবার/ ব্যস্ত রবিবারের দিকে হেলে থাকে’

অথবা,

‘শুক্রবার দুপুরের দিকে ঘুরতে গেলাম/ কবি শোয়াইব জিবরানের দিয়াবাড়ির বাসায়’

এবং,

‘বাংলার ঋতু মরে ঢুকে গেছে/ সিরিয়াল ও সিরিজের/ সিজনে সিজনে’

কিংবা

‘ভরা আমের মওসুমেও কারও মনে হতে পারে আপেলের কথা।’

‘এই ঝড় বাদলার দিনে/ বৃষ্টির বেদিতে দাঁড়ায়ে-বসে/ বুঝতে পারি/ আষাঢ়িয়া পানির ফোঁটা পেলে/ শুরু হয়/ আমার মতো সুবোধ শালাদের/ মগজের মাস্তানি’ বইয়ের কবিতাগুলি বিভূতিভূষণকে মনে করিয়ে দেয়। তাঁর একেকটা গল্পে বাংলার গ্রামীণ জীবনের তুচ্ছাতিতুচ্ছ একেকটা ঘটনা, জীবনের একেকটা চিত্র কী পরম মমতায় আঁকা হয়েছে। যেন তাঁর লেখক-জীবনের ব্রত ছিল গল্পে বা উপন্যাসে কোনো গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটতে না দেওয়া। পিয়াসের বইটিতে কবিতাগুলির বিষয়বস্তু ক্ল্যাসিক নয়। প্রতিদিনের মধ্যবিত্তের যাপিত জীবন, যে-জীবনে স্ক্রল করা নিউজ পোর্টালে ইউক্রেন যুদ্ধ, ডলার সংকট, মূল্যস্ফীতিজনিত নাভিশ্বাস, যে-জীবনের একমাত্র অবলম্বন এক কেরানির চাকরি – যে চাকরিকে রোজ হুমকিতে ফেলছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার উৎকর্ষের সংবাদ। সেই কেরানি চাকরির ফাঁকে ফাঁকে শখ করে দুয়েক লাইন কবিতা লিখত; এখন শুনছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা তার চেয়ে ঢের ভালো কবিতা চোখের পলকে লিখে দিতে পারে।

সময়ের মন্টাজে সাজানো কবিতাগুলি পড়ার অনুভূতি ঢাকা শহরের এঁদো গলিতে সন্ধ্যাবেলা উদ্দেশ্যবিহীন হাঁটার মতো।
যে-গলির দু-পাশে সারি সারি দালান – দালানের আলো-জ্বলা ঘরের কিংবা অন্ধকার ব্যালকনির চমকহীন জীবন।

বর্তমান সময়কে আমরা বলতে পারি ‘স্কিপ করার কাল’। চারপাশে এত তথ্যের প্রবাহ-সুরে-বেসুরে এত কিছু বাজছে – এত খবর, এত বিজ্ঞাপন – যে যা পারছে বেচছে। মাণিক্যের খোঁজে বিস্তর ছাই ঘেঁটে দিন কাটছে আমাদের। আমাদের বেঁচে থাকা ইদানীং হয়ে উঠেছে নানাকিছু ‘স্কিপ’ করতে করতে বেঁচে থাকা। একটা চটকদার শিরোনাম দেখে খবরের লিংকে ঢুকি, স্ক্রল আর স্কিপ করে খুঁজতে থাকি কাজের কথাটুকু কোথায় আছে। ভিডিওর থাম্বনেইল দেখে ক্লিক করে টেনে টেনে দেখতে থাকি প্রতারিত ক্রেতার মতো। অবসর কাটাতে বই খুলে সাহিত্য যদি পড়তে যাই – মনে ঘোর সন্দেহ, ‘এ ব্যাটা পড়াশোনা করে লিখেছে তো, না কি হুজুগের বশে?’ অথচ কথিত আছে এক জবরদস্ত ইউরোপীয় ঔপন্যাসিকের জনৈক ভক্ত পাঠক তাঁর পরের উপন্যাসটি পড়ে রেস্তোরাঁয় লেখকের সামনে পড়তেই মাথায় জগভর্তি পানি ঢেলে দিয়েছিলেন, কারণ তাঁর পরের লেখাটা প্রথমটার তুলনায় নাকি ‘অখাদ্য’ হয়েছে। অনেক আগে আড্ডায় শোনা এ-গল্পের রেফারেন্স আজ দিতে পারব না। তবে শুনে মনে হয়েছিল, বেশ করেছেন ওই পাঠক। পাঠকের কাছে জবাবদিহির অভাবে আজ পাঠকবিচ্ছিন্ন লেখক-কবিরা বিস্তর বাজে লেখাও ছেপে যাচ্ছেন।

ভুলে যাওয়া স্কার্টের সিঁড়ির কবিকে সাধুবাদ অন্তত এজন্য যে, তিনি এড়ানোর মতো আশেপাশের স্কিপযোগ্য অনেক কিছুকে এড়িয়ে না গিয়ে কবিতার বিষয়বস্তু করেছেন।

বইটির কবিতাগুলিতে আরেকটি উপকরণ অনেক পরিমাণে আছে – তা হলো শ্লেষ। কবিতায় শ্লেষাত্মক হতে পারাটা এখন পর্যন্ত একান্তভাবে মানব-সাধ্য, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা শ্লেষে বা কৌতুকে এখনো তেমন উন্নতি করতে পেরেছে বলে খবর পাইনি।

বইয়ের কবিতাগুলিতে ব্যবহৃত সব সংখ্যা কবি কথায় না লিখে অঙ্কে লিখেছেন। যেমন : ০১টা হাত, ০২ পয়সা দাম, ০১টা যুদ্ধ, ০১টা অক্ষর, ০২ ফোঁটা বৃষ্টি ইত্যাদি। কবি এটিও হয়তো করেছেন শ্লেষের আবহে। আজকের দিনে আমরা হয়ে পড়েছি অনেক সংখ্যার বিন্যাস। আমাদের যাবতীয় বৈষয়িক প্রশ্নের উত্তরই কোনো না কোনো সংখ্যা দিয়ে হয়।

তিন

ভুলে যাওয়া স্কার্টের সিঁড়ি বইটার বিশেষত্ব হলো, এতে বিস্তর পরীক্ষা-নিরীক্ষা, ভাঙা-গড়া আছে। কবির অপরাপর কবিতার বইয়ের চেয়ে তো বেশিই। এ-বইয়ের কবিতাগুলি কবির আগের বইগুলিতে তিলে তিলে নির্মিত ‘নন্দনতত্ত্ব’কে হত্যা করতে তৎপর। এই প্রয়াস কেবল এই বইটিতে নয়, কবির সর্বশেষ প্রকাশিত এইসব মকারি বইটিতেও লক্ষণীয়। ধ্রুপদী হয়ে ওঠার আকাক্সক্ষা এই বইয়ের কবিতার নির্মাণে চোখে পড়ে না। শব্দচয়নে কবি অনেকটা আটপৌরে। এখানে তাঁর প্রথম কবিতার শিরোনাম হয় ‘টাইপো’, সেখানে দেখা যায় ‘মজলুম মেঘদল’, ‘ভগিচগি আর বেখুদি’র মতো শব্দবন্ধ। প্রিয়াকে সম্বোধন করেন ‘জানেমন’। স্বল্প চেনাজানা কনিষ্ঠ কবির আত্মহননের খবরসূত্রে লেখেন ‘ইটস নট সুইসাইডাল’ নামের কবিতা। কবিতার নন্দনে কবির অনাস্থা আরো প্রকাশ পায় ‘এই আরকি’ কবিতায় – ‘এই দুনিয়া, এই কবিতা/ আর কিছু না, নন্দনের ললিত বিজনেস/ বিজনেসে তোমার উন্নতি হোক/ কিংবা ১২টা বাজুক – মন মাখিয়ে চাকরি করে যাও’। অথবা আরেক কবিতায় – ‘জীবনজুড়ে আমরা তাহলে/ কোন এক অলীক নাটকে/ বোবার ভূমিকায় অভিনয়ের স্বপ্নটাই/ বলতে থাকি ইনিয়ে বিনিয়ে?’ [‘মুভি দেখার ফাঁকে’]

বইয়ের অন্তত তিনটি কবিতায় পাওয়া যাবে একেবারে প্রথম দিকের কবিকে। ‘ধূলিবিধৌত’, ‘কবি’ ও ‘ঘুমের রচনা’ কবিতা তিনটি তাঁর আগের লেখার অনুকার এবং এরা বইয়ে বেমানান হয়ে পড়েছে। ‘আইফোন’ নামক ক্ষুদ্র কবিতাটিও কাক্সিক্ষত নতুনত্বের অভাবে ভোগে। সে-তুলনায় ‘মিউজিক মাস্টার’ নামক কবিতাটি পুরনো ধাঁচে লেখা হলেও সুন্দর অনুভূতি প্রকাশ করেছে। 

কবিতার বইটিতে বিশ্ব-চলচ্চিত্র আর মাস্টার চলচ্চিত্র নির্মাতাদের আনাগোনা লক্ষণীয়। অন্য যে-কোনো বইয়ের চেয়ে এ-বইয়ে তিনি কালোত্তীর্ণ চিত্রনির্মাতাদের হাত ধরে বেশি পথ ভ্রমণ করেছেন। নির্মাতা বেলা তারের মুভির তুরিনের ঘোড়া কবির সাধ্যে ধরা দেয় গুলিস্তানের ছ্যাকড়া গাড়িতে ভ্রমণে। [কবিতা : ‘বেলা তারের মুভি দেখতে দেখতে’] আরেক নির্মাতা সামিরা মাখমালবাফকে কবিতায় তুলে এনে তাঁর সঙ্গে করেন একান্ত বোঝাপড়া। [কবিতা : ‘সামিরার সহিত সন্ধ্যা’] প্রয়াত আব্বাস কিয়ারোস্তমির বার্থডে নোট লিখতে কবিকে যেতে হয় না তেহরানের সমাধিক্ষেত্রে, নবোদয় হাউজিংয়ের বিছানায় শুয়ে-বসে সারতে পারেন কাজটি। শাহবাগ টু বছিলার বাসে চড়ে তাঁর দেখা হয় জঁ লুক গদারের ছবির ১৯৬২ সালের মেয়েটির সঙ্গে, ফ্রান্সের রাস্তায় দুদিক থেকে আসা গুলি খেয়ে যে মরে গিয়েছিল। [কবিতা : ‘মুভি আওয়ার’]

ভুলে যাওয়া স্কার্টের সিঁড়িতে চিত্রনির্মাতাদের পাশাপাশি কবিদেরও মুখোমুখি হন পিয়াস। এ-কারণে ‘বৃষ্টি প্রসঙ্গে শুধু তো রবীন্দ্রসঙ্গীত না/ ভুনা অথবা লেটকা খিচুড়ির কথাও মনে আসে’। [কবিতা : ‘প্রসঙ্গ পেরিয়ে’] এবং বিনয় মজুমদার বাংলা কবিতার শান্ত আলোর অত্যাচার ছেড়ে হারিকেনের আলোয় তাঁর জন্মস্থান বার্মা মুলুকে থ্রিলিং গোলাগুলির মধ্যে ঢুকে যান। [কবিতা : ‘বিনয় মজুমদারের হারিকেন’]

অগভীর প্রেমের যুগে কবির পর্যবেক্ষণ : ‘ছুটতে ছুটতে দেখেছি তো জানেমন/ মূলের বদলে যা পাই/ তা তোমার অনূদিত আভা’ [কবিতা : ‘টাইপো’] এবং ‘তুমি শব্দটাকে বারবার ঠেকিয়ে রাখতে চাইলেও/ অতর্কিত হামলার মত তুমি এসে পড়ো’ [কবিতা : ‘সংযুক্তা’]। এহেন অগভীরতায় নয়, প্রেমকে তলিয়ে দেখতে আগ্রহী কবি। তাই ‘ইনভেস্টেড’ প্রেমিক কবির স্বীকারোক্তি : ‘হুটহাট আমার মুছে যাওয়া/ এক লাফে তোমার আয়ু বাড়িয়ে দেবে,/ তারপরও উত্তরোত্তর বাড়ে/ বেঁচে থাকার বর্বর বাসনা।’ [কবিতা : ‘তোমার সার্কাস’]

চার

বইটিকে আরো যে-কারণে আলাদা করা যায়, এ-বইটির কবিতাগুলি কবির বেশিরভাগ কাব্যগ্রন্থের মতো গীতবহুল থাকেনি; বরং কবিতাগুলিতে এসে গেছে গল্পের অঙ্কুর। গল্পকে আশ্রয় করে উত্তীর্ণ কবিতার সংখ্যা কম নয়। কবি আল মাহমুদ-রচিত ‘প্রত্যাবর্তনের লজ্জা’ এই ধরনের অনন্য একটি কবিতা। কবি আবুল হাসানের ‘বনভূমির ছায়া’ কবিতাটি গল্পের ভিতে দাঁড়িয়ে বাঙালি মধ্যবিত্তের মননকে অতি সার্থকভাবে উন্মোচন করেছে। তবে এ-দুটি কবিতার গল্প শেষ পর্যন্ত পাঠককে রিলিফ দেয়। অন্যদিকে কবিতার গল্পগুলি কোনো রিলিফ ছাড়াই শেষ করার প্রবণতা পিয়াসের। বিনয় মজুমদারের ‘আজ বৃহস্পতিবার’ কবিতাটি অনেকটা সমগোত্রের।

ভুলে যাওয়া স্কার্টের সিঁড়ির সবচেয়ে সার্থক কবিতাগুলি গল্পধর্মী। তবে যেহেতু সেসব গল্পের শেষটা পাঠক এসব কবিতায় পায় না, শেষটা কেমন হতে পারে তার নানান সম্ভাব্যতা পাঠককে ভাবায়। যেমন, ‘কেউ দাওয়াত না দিলেও/ শুক্রবার দুপুরগুলো ভেসে থাকে দাওয়াত দাওয়াত গন্ধে।’ [‘শুভ শুক্রবার’]

এবার লিখছি এই বইটির কিছু শক্তিশালী কবিতার কথা। আমার মতে, বইটির অন্যতম উত্তীর্ণ কবিতা ‘শোয়াইব জিবরানের বাসায় কাহলিল জিবরান’।

গল্প-আশ্রিত কবিতাটিতে আমরা দেখি, কবি এক শুক্রবার দুপুরে ঘুরতে যান কবি শোয়াইব জিবরানের বাসায়। বেল টিপতে দরজা খুলে দেন পৃথিবীর আরেক কবি কাহলিল জিবরান। তাঁর দু-হাতে ধরা দুটি বই, প্রফেট এবং কাঠ চেরাইয়ের শব্দ। অভ্যর্থনা করে কাহলিল জিবরান অভ্যাগত কবিকে বলেন, ‘একটু রেস্ট নেন, কফি হচ্ছে চুলায়। আর আমাদের দুঃখগুলো ছেপে আনতে প্রেসে গেছেন শোয়াইব জিবরান।’ আগন্তুক কবি ধন্দে পড়ে যান – ‘এটা কি বৈরুত, না ঢাকা!’ কফি আর আড্ডা শেষে কাহলিল জিবরান তাঁর কবিতার সম্প্রসারিত রূপটিই পিয়াস মজিদের সামনে মেলে ধরেন, ‘তোমাদের সন্তানেরা শুধু তোমাদের না হলেও/ যেকোন কবির বাড়িই পৃথিবীর সব কবির বাড়ি।’ এ-ভাবনা একেবারেই নতুন এবং মৌলিক। পাঠক হিসেবে যেন চোখের সামনে ঘটতে দেখা গেল এ-ঘটনা। দুই সময়ের দুই ভূগোলের দুই কবির এই অদল-বদল কবি পিয়াসের মুনশিয়ানার দৃষ্টান্ত হয়ে রইবে।

হালের বাঙালি মধ্যবিত্ত শ্রেণির বিত্তের টানাপড়েনের এক অনুপম উদ্ঘাটন আমরা পাই ‘বন্ধুর গাড়িতে চড়ে’ শিরোনামের কবিতাটিতে। হঠাৎ ধনী হয়ে প্রাইভেট গাড়ি কেনা বন্ধুদের গাড়িতে সময়ে সময়ে লিফট পান গাড়ি-নেই কবি। গাড়ির মালিক বন্ধুদের নানারকম টিপ্পনি-উপহাস, সিটবেল্ট বাঁধার সদুপদেশ, গাড়িওয়ালা বন্ধুদের মধ্যকার গাড়ির মডেলের গল্প (অবশ্যই

লিফট-পাওয়া বন্ধুকে শুনিয়ে শুনিয়ে) এসবই লিফট-পাওয়া কবি লিফটের সঙ্গে ফ্রিতে পেয়ে থাকেন। শেষতক কবির শ্লেষাত্মক স্বীকার্য – ‘আজকাল বন্ধুত্ব বজায় রাখতে হলেও তো থাকতে হয় বিচিত্রবিধ হজমের ক্ষমতা’। আগে আমরা সবাই মিলে গরিব ছিলাম। এখন মধ্যম আয়ে উত্তীর্ণ দেশের নাগরিক হিসেবে এ-সমস্যা আমাদের জন্য নতুন। সমাজ-মনঃস্তত্ত্বের এ-পঠন প্রশংসার দাবি রাখে। কবির কবিতায় সমস্যাক্লিষ্ট অসুখী মধ্যবিত্ত ‘সমকালে ঠকে গিয়ে মহাকালে টিকে যাওয়ার গপ্পো ফাঁদে’ এবং সেই সঙ্গে ‘ফ্রুটিকার গ্রেপ জুস টানতে টানতে গরিবি ওয়াইনের স্বাদ পায়/ দেখেশুনে কনডম কিনতে মহল্লার ফার্মেসিটা খালি হওয়ার চান্সে থাকে’। [কবিতা : ‘সাজপোশাক’ ]

একটু অন্যরকম কবিতা ‘ডায়ানার অভিশপ্ত প্রেমিকেরা’। এক প্রজন্মের কিশোরবেলায় রাজকুমারী বা রাজবধূ বলতে পৃথিবীর সবার মনে ভেসে উঠত প্রিন্সেস ডায়ানার মায়াবি মুখচ্ছবি। ডায়ানা সেদিনকার অভিমানী কিশোরদের অঘটিত প্রেমের নায়িকা। প্রেমিকের সঙ্গে প্যারিসে সড়ক দুর্ঘটনায় তাঁর অকাল মৃত্যু সে-সময়ে সব প্রেমিক-কিশোরকেই বিরহের শূন্যতায় ঠেলে দেয়। সেসব কিশোর পরে হয়তো জানতে পারে প্রাসাদ ষড়যন্ত্র সম্পর্কে, জেনে ফেলে ডায়ানার বঞ্চিত হওয়ার কথা। ব্রিটেনের রানী না হতে পারা বেয়াড়া রাজবধূ ডায়ানা হয়ে রইলেন কোটি কোটি চিরকিশোরের হৃদয়ের রানী। তাঁর শেষকৃত্যে গাওয়া গানটার কথাই যেন সত্যি ‘You lived your life like a candle in the windÕ।

‘ধমক’ এবং ‘আবারও ঈদ এসে যাচ্ছে’ কবিতাদুটি এক বাবাহারা পরিবারের স্কেচ। আর চিত্রকল্পের দেখা মেলে ‘শীতের সূত্র’ কবিতায় – ‘ঋতুনিরপেক্ষ আমরাও তো চেয়েই থাকি/ সবসময় গায়ে লাগুক/ সহনীয় শীতের কোমল হাল্কা হাওয়া।’ 

‘আচ্ছা’ শিরোনামের কবিতাটি বইয়ের সবচেয়ে লম্বা কবিতা। এ-কবিতায় রয়েছে অ্যাবসার্ডিটির উপকরণ, সঙ্গে তীব্র শ্লেষের অবতারণা। এরকম একটি ভালো বিদ্রƒপ রয়েছে ‘ফরাসি অনুষঙ্গে দেশি কবিতা’য়। আমাদের মার্জিত ইউরোপীয় তথা ফরাসি ভেক ধরার প্রবণতাকে শক্ত চপেটাঘাত করেছেন কবি। আলিয়ঁস ফ্রঁসেজের সামনে রাস্তার ট্রাফিকে আটকে কবি সোশ্যাল মিডিয়ায় দেখেন প্রবাসী বন্ধুযুগলের আইফেল টাওয়ারের সামনে তোলা ছবি। তাতে লাইক দিয়ে কবি কিছুটা ফরাসি অনুভব পান। মাথায় দু-ফোঁটা বৃষ্টি পড়লে কালিদাস নয়, বোদলেয়ারের কবিতা মনে পড়ে তাঁর। বৃষ্টিটা মুষলধারে নামলে একটা ক্যাফেতে ঢুকে অর্ডার করেন ফ্রেঞ্চ ফ্রাই। কবির ভাষায় – ‘আমাদের দেহ তো নয় শুধু আমাদের রক্তমাংস/ একই সঙ্গে এ দেহ বাংলা আলুর সমাধিগৃহ।’ [‘ফরাসি অনুষঙ্গে দেশি কবিতা’ ]

ঘরে ফিরে ফরাসি মুভি অন রেখে কবি ডুবে যান ঘুমের কাদায়। আর অঝোর বর্ষণে প্রায় অর্ধেক দেশ ডুবে যায় বন্যায়। ঘুম নিয়ে আরেক ব্যঙ্গ কবিতা ‘সেমিনারে ঘুমাতে ঘুমাতে’। এখানে সেমিনারে বিদূষকের ঘুমিয়ে পড়া নিয়ে কবির বক্তব্য –

‘আমাদের রাতেরা জাগরণ-পাগল/ আমাদের সেমিনারেরা ঘুমপ্রদ/ হায় সেমিনার, শতাব্দীর সুসজ্জিত দূষিত আলো।’ পুরো বইয়ে কবির সবচেয়ে বড় আঘাত কবিদেরই –

‘ভেতরে ভেতরে

পৃথিবীর ০১ কবি

আর ০১ কবিকে

০২ পয়সার দাম দেয় না!

তাদের নিজেদের

এই দাম না দেওয়ারে যে

পাবলিক কোনো দাম দেয় না 

সেইটারে কবিরা

কোনো গনায় ধরে না!’ অতঃপর

             ‘পৃথিবীর কবিরা গোপনে

এপিটাফের মত

০১টা-০২টা কবিতা লিখে জমায় 

জঘন্য জীবন শেষে

মৃত্যুর পর তাঁর কবরটা

একটু আলাদা দেখায়।’ [কবিতা : ‘ডেড পোয়েটস সোসাইটি’]

‘কলকাতার রাস্তায়’ এবং ‘মিখাইল গর্বাচেভের ০১টা ব্যর্থতা’  কবিতাদ্বয় বিশ্বরাজনীতির ব্যাপারে সচেতন। ‘দীঘা’ শীর্ষক কবিতাটি উপলব্ধির। সমুদ্রে ফেলে দেওয়া একটি ডাবের খোসা ডুবতে ডুবতে একটু থমকে দাঁড়ায়। শেষবারের মতো অতলে তলিয়ে যেতে যেতে ডাবের খোসার কল্পনায় কবি উপলব্ধি করেন, ‘ডাবের স্বাদের মতই/ মানুষ প্রথম সমুদ্রের স্বাদ নেয়,/ তৃষ্ণার তৃপ্তি মেটায় যথেচ্ছ।/ তারপর সমুদ্রকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে/ সৈকতের স্তূপীকৃত পাথর বুকে নিয়ে/ যে যার বাড়ি ফিরে যায়!’ [কবিতা : ‘দীঘা’ ]

পাঁচ

ভুলে যাওয়া স্কার্টের সিঁড়ির কবিতাগুলির কয়েকটি পঙ্ক্তি প্রবচন হয়ে ওঠার যোগ্য। কয়েকটি উদাহরণ :

০১টা যুদ্ধ বিষয়ে আমাদের এত এত চুলচেরা বিশ্লেষণ পরবর্তী ০১টা যুদ্ধের সম্ভাবনা তিলমাত্র রহিত করে না। [‘ট্র্যাজেডি’]

সাপের মহিমা নাকি/ বিষেই প্রকাশ [‘আমি, তুমি, আপনি’]

মানুষ তুমি/ কী মায়ায়/ পোশাক পরাও/ নিজের ছায়ায় [‘মানুষ তুমি’]

০১ জন ভূমিহীন মানুষও তো/ বয়ে নিয়ে চলে/ আস্ত ০১টা কবরের মানচিত্র  [‘মালিকানা’]

কখনও বর্ণের বিলুপ্তিও/ বাড়াতে পারে বর্ণমালার বৈভব [‘ঝিনেদায় পূর্ণিমা’]

সবশেষে, ভুলে যাওয়া স্কার্টের সিঁড়ি বইটি কালের পরিক্রমায় টিকে যাবে কি না তা আমাদের অজানা। তবে বইটি কবি পিয়াস মজিদের কবিতার এক বাঁকবদলের সাক্ষী হয়ে থাকবে। সময়ের গ্রাসে লুপ্ত হয়ে গেলেও এর কাব্যরস সার হিসেবে ভবিষ্যতের কবিতাকে পুষ্ট করবে।