বাঙলা উপন্যাস : রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

অনুবাদ : সুব্রত বড়ুয়া

বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ, দর্শনশাস্ত্রজ্ঞ পণ্ডিত, লেখক ও রাজনীতিক অধ্যাপক হুমায়ুন কবির ১৯৬৭ সালে আমন্ত্রিত হয়ে আমেরিকার ম্যাডিসনের ইউনিভার্সিটি অব ভিসকনসিন-এ ‘টেগোর মেমোরিয়াল লেকচার’ প্রদান করেন।  তাঁর এই চারটি বক্তৃতা পরবর্তীকালে ১৯৬৮ সালে The Bengali Novel নামে কলকাতা থেকে পুস্তকাকারে প্রকাশিত হয়। এটিও মোট চারটি অংশে উপস্থাপিত হয়েছে। সে অংশগুলি হলো যথাক্রমে : (1) Bankimchandra and the birth of the Bengali Novel; (2) Rabindranath Tagore; (3) Sarat Chandra Chatterjee and the Realistic Novel; Ges (4) The Novel in Contemporary Bengal। হুমায়ুন কবিরের জন্ম ১৯০৬ সালে, মৃত্যু ১৯৬৯ সালে। কালি ও কলম-এর এই সংখ্যায় গ্রন্থটির দ্বিতীয় অংশটির বঙ্গানুবাদ পত্রস্থ করা হলো।

অতীতকে গৌরবান্বিত করার লক্ষ্যে রচিত ঐতিহাসিক উপন্যাসগুলির সাহায্যে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় উদীয়মান বাঙালি মধ্যবিত্ত শ্রেণির সৃজনস্পৃহাকে একটি নতুন উৎসারপথ দেখিয়েছিলেন। বাঙলায় নতুন মধ্যবিত্ত শ্রেণির নির্ভরতা ছিল পাশ্চাত্যের সঙ্গে ক্রমবর্ধমান বাণিজ্যের উপর এবং এটিই স্বাভাবিক ছিল যে, এই শ্রেণির পশ্চিমের ধারণাসমূহ ও জীবনধারা গ্রহণ করতে চাওয়াই উচিত। আমরা ইতোমধ্যেই দেখেছি, ইয়ং বেঙ্গল হুজুগের অবিচল সমর্থনকারীরা প্রাচীন ভারতীয় ঐতিহ্য প্রত্যাখ্যান ও পাশ্চাত্যের আদর্শসমূহ গ্রহণের ব্যাপারে চূড়ান্ত পর্যায়ে চলে গিয়েছিল। তারা প্রভাবিত হয়েছিল ইউরোপের ক্রমবিকাশমান জাতীয়তাবাদ দ্বারা এবং রাজনৈতিক স্বাধীনতার ও শিল্পকারখানার অগ্রগতির স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছিল। অবশেষে তারা মর্মাহত হলো যখন তারা দেখল যে, ব্রিটিশ শাসকরা তাদের ক্রমবর্ধমান শক্তিকে স্বীকৃতি প্রদান করল না এবং তাদের স্ব-সরকারের দাবিগুলি রূঢ়ভাবে প্রত্যাখ্যান করল। তাদের আহত গৌরববোধ কিছুটা টিকে রইল প্রাচ্যবাদী ও থিয়সফিস্টরা (দিব্যপ্রেরণাবাদী) প্রাচীন ভারতীয় সংস্কৃতির প্রতি নতুন করে যে মনোযোগ দিচ্ছিলেন তার মধ্যে। উড-এর অহহধষং ড়ভ জধলধংঃযধহ এবং মারাঠা সাম্রাজ্যের কাহিনিগুলি তাদের দেশাত্মবোধক হৃদয়ানুভূতিতে জোগান দিয়েছিল রোমান্টিক শৌর্যবীর্যের গল্পকথা। তারা যেহেতু ছিল প্রধানত হিন্দু, অতএব এটি কোনো বিস্ময়ের ব্যাপার ছিল না যে, নতুন মধ্যবিত্ত শ্রেণির সদস্যরা উগ্র হিন্দু জাতীয়তাবাদের দৃঢ় প্রবক্তা হবেন।

বঙ্কিম এসব ঘটনাস্রোত দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন এবং তাঁর যুগের রোমান্টিক স্বজাতিশ্রেষ্ঠতার অবাধ প্রকাশ ঘটিয়েছিলেন। এটি তাঁকে একজন দেশপ্রেমিক হিন্দু জাতীয়তাবাদী হিসেবে তাৎক্ষণিক সফলতা এনে দিয়েছিল; কিন্তু তা একজন নিবেদিতপ্রাণ ঔপন্যাসিক হিসেবে তাঁর বিকাশের পথে বাধাও সৃষ্টি করেছিল, যে-ঔপন্যাসিক দেশের সমস্যাগুলিকে সমগ্রতার ভিত্তিতে বিচার করতে ও তুলে ধরতে পারতেন। ভাবনায় পাশ্চাত্যের প্রলেপ থাকা সত্ত্বেও তিনি গোঁড়া হিন্দু দৃষ্টিভঙ্গির ঊর্ধ্বে উঠতে পারেননি।

তাঁর অসাধারণ উপন্যাসগুলির মধ্যে কয়েকটি, আমরা যেমনটা ইতোমধ্যেই দেখেছি, সমসাময়িক হিন্দু সমাজের নৈতিক নিয়মাবলির প্রতি তাঁর দুর্বলতার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বিশেষভাবে। বিষবৃক্ষ এবং কৃষ্ণকান্তের উইল হতে পারত দুটি মহৎ মনস্তাত্ত্বিক উপন্যাস; কিন্তু সেগুলি বৈশ্বিক মান অর্জনে ব্যর্থ হয়েছে, যেহেতু বঙ্কিম তাঁর চিন্তার ক্ষেত্রে প্রচলিত পথগুলি পরিত্যাগ করতে সক্ষম হননি। বাঙলা উপন্যাসকে এর সংকীর্ণ সামাজিক আবহ থেকে তুলে এনে বিশ্বজনীন গ্রহণযোগ্যতার চরিত্র প্রদান করার দায়িত্ব পড়েছিল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের উপর।

এখানে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জীবন ও সাহিত্য সাধনার বিস্তারিত বিবরণ দেওয়ার কোনো প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না। তুলনামূলকভাবে অচেনা একটি ভাষা বাঙলাকে নোবেল পুরস্কার জয়ের মাধ্যমে বিশ্বমানের মর্যাদায় তুলে এনেছিলেন এই কবি। গল্পকার, ঔপন্যাসিক, গীতিকার ও প্রবন্ধকার হিসেবেও প্রায় সমরূপ মহত্ত্ব¡ দাবি করতে পারেন তিনি। এখানে এটুকু বলাই যথেষ্ট হবে যে, তাঁর অভিজ্ঞতার পরিধি ছিল বঙ্কিমের চাইতে অনেক বেশি ব্যাপক। বঙ্কিম ছিলেন উদীয়মান মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষ এবং নবপ্রতিষ্ঠিত কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম স্নাতকদের মধ্যে একজন। স্নাতক ডিগ্রি অর্জনের পর খুব অল্প সময়ের মধ্যেই প্রভিন্সিয়াল সিভিল সার্ভিসে যোগ দেন এবং জীবনের অবশিষ্ট সময় তিনি অতিবাহিত করেন বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির বিভিন্ন অংশে একজন প্রশাসক হিসেবে। এর ফলে তিনি বাঙলা, বিহার ও উড়িষ্যায় হিন্দু মধ্যবিত্ত শ্রেণির জীবন সম্পর্কে গভীর জ্ঞান অর্জনের সুযোগ পান। কিন্তু অন্যান্য শ্রেণি ও সম্প্রদায় সম্পর্কে তাঁর জ্ঞান অত্যন্ত সীমিত থেকে যায়। আর প্রেসিডেন্সির বাইরের ভারত সম্পর্কে তাঁর জ্ঞান থেকে যায় এমনকি আরো অনেক কম।

এর বিপরীতে, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জন্মেছিলেন এমন এক পরিবারে, যে-পরিবার ধারণ করেছিল প্রাচীন ও মধ্যযুগের ভারতের ঐতিহ্যসমূহ। তাঁর পিতা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন উপনিষদের একজন মহান ব্যাখ্যাকারী এবং একই সঙ্গে ফারসি ভাষায়ও সুপণ্ডিত। বলা হয়ে থাকে, মহর্ষি প্রতিদিন ভোরে তাঁর দিন শুরু করতেন উপনিষদের শ্লোক ও হাফিজের কবিতা আবৃত্তি করে। এই পরিবারের উপর পাশ্চাত্য সংস্কৃতির প্রভাবও পড়েছিল। রবীন্দ্রনাথের পিতামহ ছিলেন তাঁর সময়ের সবচেয়ে ধনাঢ্য বণিকদের অন্যতম এবং তিনি যখন ইংল্যান্ড ভ্রমণে গিয়েছিলেন তখন মহারানি ভিক্টোরিয়া তাঁকে অভ্যর্থনা জানান। ছেলেবেলাতেই রবীন্দ্রনাথ বেড়াতে গিয়েছিলেন বাঙলার বাইরে এবং পিতার সঙ্গে ডালহৌসি পাহাড়ে থেকেছিলেন। সেখানে হিমালয়ের রহস্য ও বিশালতা তাঁর মনে গভীর প্রভাব ফেলেছিল। কিশোর বয়সেই তিনি পশ্চিম ভারতে দীর্ঘদিন ছিলেন। সেখানে ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিসের প্রথম ভারতীয় সদস্য তাঁর মেজদাদা চাকরিতে নিয়োজিত ছিলেন। তিনি এরপর শীঘ্রই ইউরোপ-যাত্রা করেন। কুড়ি বছর বয়সে পৌঁছার আগেই এসব ভ্রমণ তাঁর দৃষ্টিভঙ্গিতে উদার সংস্কারমুক্ততা নিয়ে আসার পক্ষে সহায়ক হয়েছিল এবং তাঁর সাহিত্যকর্মকে সংকীর্ণতার বাইরে নিয়ে এসে একক স্বাধীনতা দান করেছিল।

বাঙলা উপন্যাসের বিবর্তনে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অবদান সম্পর্কে যথার্থ ধারণা পেতে হলে আমাদের অবশ্যই কখনো ভুলে যাওয়া চলবে না যে, তিনি ছিলেন মূলত একজন কবি। সব কবিই, বিশেষত যাঁরা গীতিকবিতা লিখে থাকেন তাঁরা, সাধারণত একাকী ও নির্জনতাপ্রিয় এবং অন্তর্মুখী হয়ে থাকেন। পক্ষান্তরে একজন ঔপন্যাসিক অনিবার্যভাবে একজন সামাজিক মানুষ এবং তাঁকে অবশ্যই বহির্মুখিনতাকামী হতে হয়। উপন্যাস কবিতার চেয়ে অনেক বেশি পরিমাণে সামাজিক ফসল। এ থেকেই বুঝতে পারা যায়, রবীন্দ্রনাথ কেন তাঁর বিশ বছর বয়সের আগেই কবিতার ক্ষেত্রে নিজস্বতা ও পারদর্শিতা অর্জন করতে পেরেছিলেন। উপন্যাসে এবং সাধারণভাবে তাঁর গদ্যরচনাসমূহে, প্রায় চল্লিশ বছর বয়সে উপনীত হওয়ার পূর্বে তিনি তাঁর নিজস্ব শৈলী গড়ে তুলতে পারেননি। উপন্যাসের রচনাশৈলীর ক্ষেত্রেও রবীন্দ্রনাথ দীর্ঘকাল ধরে বঙ্কিম-প্রবর্তিত ঐতিহ্যের অনুসারী ছিলেন। তিনি কেবল ধাপে ধাপেই এই অনুসরণ থেকে সরে গিয়েছিলেন এবং এমন শৈলী আবিষ্কার করতে পেরেছিলেন যেখানে তাঁর কবিচিত্ত মিলে যেতে পেরেছিল ঔপন্যাসিকের চাহিদাসমূহের সঙ্গে।

বঙ্কিমের মতো রবীন্দ্রনাথও তাঁর উপন্যাস রচনা শুরু করেছিলেন একটি ঐতিহাসিক উপন্যাস দিয়ে। সেটি বৌ-ঠাকুরাণীর হাট। এটি অবশ্য মেজাজ ও রচনাভঙ্গির দিক থেকে বঙ্কিমের উপন্যাসগুলি থেকে যথেষ্ট আলাদা ছিল। আমরা দেখেছি, জাতীয়তাবাদী উদ্দীপনা বঙ্কিমের দৃষ্টিভঙ্গিকে আচ্ছন্ন করে রেখেছিল এবং সামাজিক পূর্বধারণাগুলি তাঁর মানবিক সহানুভূতিগুলি বাঁকিয়ে দিয়েছিল। এসবের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল তাঁর অবস্থানের প্রেক্ষাপট ও অভিজ্ঞতার সীমাবদ্ধতাসমূহ। এর ফলে রাজা ও রাজপুত্রদের সম্পর্কে তাঁর ধারণার মধ্যে কিছু অবাস্তবতা ছিল। তাদের জাঁকজমক কখনো কখনো তাঁর চোখকে এমনভাবে আচ্ছন্ন করেছিল যে, তিনি তাদের মধ্যে এমনসব গুণ ও কর্মকাণ্ড জুড়ে দিয়েছিলেন যা আমাদের বিশ^াসপ্রবণতাকেও চাপের মধ্যে ফেলে দেয়। রবীন্দ্রনাথ, এমনকি তাঁর প্রথম উপন্যাসেও, রাজকীয়তার প্রতি এই মোহ থেকে একক স্বাধীনতার পরিচয় প্রদান করেছেন। বৌ-ঠাকুরাণীর হাট উপন্যাসটির বিষয়বস্তু বাঙলার ইতিহাসের একটি চমকপ্রদ কাহিনি, কিন্তু রবীন্দ্রনাথ রোমান্টিকতা বা জাত্যভিমান এই দুয়ের কোনোটিকেই তাঁর অন্তর্দৃষ্টি আচ্ছন্ন করার সুযোগ দেননি। প্রতাপাদিত্য বেশ কয়েক দশক ধরে বাঙলার ইতিহাসের একটি নায়ক চরিত্র ছিলেন। মোগল শক্তিকে অগ্রাহ্য করে তিনি প্রশংসিত হয়েছিলেন, যে-কারণে মানুষ তাঁর চরিত্রের অনেক নেতিবাচক দিককে তেমন কোনো গুরুত্ব দেয়নি। রবীন্দ্রনাথ তাঁর সামর্থ্য ও সাহসকে স্বীকৃতি দিয়েছেন, কিন্তু তিনি অসাধারণ বাস্তবতার আশ্রয় নিয়ে প্রতাপাদিত্য চরিত্রের নিষ্ঠুরতা, চতুরতা  ও প্রবল অহমিকতার দিকটিও চিত্রিত করেছেন।

বৌ-ঠাকুরাণীর হাট রবীন্দ্রনাথের প্রথম উপন্যাস এবং এতে স্পষ্টত বঙ্কিমের প্রভাবের ছাপ রয়েছে। বঙ্কিমের মতো রবীন্দ্রনাথও মানবিক প্রেম ও ঘৃণার গল্প বলার জন্য একটি ঐতিহাসিক পটভূমি নির্বাচন করেছেন। বঙ্কিমের মতো রবীন্দ্রনাথের উপন্যাসেও ইতিহাসের সঙ্গে অত্যন্ত ক্ষীণ একটি সম্পর্ক রয়েছে। আমরা যদি রবীন্দ্রনাথ ও বঙ্কিমচন্দ্রকে রমেশচন্দ্র দত্তের সঙ্গে তুলনা করি, তাহলে আমাদের বলতে হয় যে, রমেশচন্দ্র দত্তের ক্ষেত্রে, বিশেষভাবে তাঁর জীবনসন্ধ্যা ও জীবন প্রভাত-এ, ইতিহাসই হচ্ছে উপন্যাসের মূল বিষয়। একমাত্র রাজসিংহ উপন্যাসটির দৃষ্টান্ত ছাড়া বঙ্কিমের উপন্যাসগুলিতে ইতিহাসের সঙ্গে এরূপ অচ্ছেদ্য কোনো সম্পর্ক নেই। ইতিহাস শুধু পটভূমিই তৈরি করে দিয়েছে সেগুলিতে এবং বঙ্কিমের অধিকাংশ উপন্যাস মূলত ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে সামাজিক উপন্যাস। রবীন্দ্রনাথের প্রথম উপন্যাসের ক্ষেত্রে বহুলাংশে এটিই সত্য।

রবীন্দ্রনাথ ইতিহাসের প্রতি তাঁর দৃষ্টিভঙ্গিতে যে ব্যাপকতর বাস্তবতা দেখিয়েছেন তা ছাড়াও রয়েছে অপর এক বৈশিষ্ট্য, যা তাঁকে বঙ্কিম থেকে আলাদা হিসেবে চিহ্নিত করে। বঙ্কিমের উপন্যাসগুলিতে, সেগুলি ঐতিহাসিক বা সামাজিক যাই হোক না কেন, প্রধান আকর্ষণ কেন্দ্রীভূত থাকে ঘটনাপ্রবাহের মধ্যে। অবশ্যই একজন কবি হিসেবে রবীন্দ্রনাথ ধরে রাখতে পারেন অনুভূতির সূক্ষ্মতম দ্যোতনাগুলি। আমরা দেখতে পাই, এমনকি তাঁর প্রথম উপন্যাসেও তিনি বঙ্কিম তাঁর সবচেয়ে পরিণত রচনায় যা করতে পেরেছেন তার চেয়ে অনেক বেশি প্রবণতা প্রদর্শন করেছেন মনস্তাত্ত্বিক পরিস্থিতি ও সেসব পরিস্থিতি বিশ্লেষণের উপর।

বৌ-ঠাকুরাণীর হাট অবশ্যই উপন্যাস হিসেবে কবির প্রথম রচনা। এর বাস্তবতা ও মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্বের প্রতি অন্তর্দৃষ্টি উপন্যাসটিকে বাঙলা উপন্যাসের একজন ছাত্রের কাছে আকর্ষণীয় করে তোলে, কিন্তু একে একটি সার্থক উপন্যাসরূপে বিবেচনা করা যায় না। উপন্যাসটির অনেক চরিত্রই গৎবাঁধা ধরনের এবং সেগুলি কোনোরকম প্রাতিস্বিকতা অর্জন করেনি, উপন্যাসের আখ্যান-গঠন শিথিল এবং শেষ পর্যন্ত সন্তুষ্টি অর্জন সম্ভব হয়ে ওঠে না। অবশ্য উপন্যাসটি কৌতূহলোদ্দীপক, কারণ সেটি ঘটনাবলি ও আখ্যান থেকে চরিত্র ও মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণের দিকে গুরুত্ব সরিয়ে নেওয়ার মাধ্যমে বাঙলা উপন্যাসে একটি নতুন ধারার নির্দেশ দিয়েছে।

বেশ কয়েকটি বিষয়ের ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথ বঙ্কিমের প্রভাব থেকে বেরিয়ে আসা সত্ত্বেও বৌ-ঠাকুরাণীর হাট ছিল বঙ্কিমের ঐতিহ্যানুসারী উপন্যাস। রবীন্দ্রনাথের পরবর্তী গুরুত্বপূর্ণ উপন্যাস চোখের বালি বঙ্কিমের প্রভাব থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত। আমরা ইতোমধ্যেই দেখেছি যে, ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে কাহিনির উপস্থাপন সত্ত্বেও বঙ্কিমের অনেক উপন্যাসই সামাজিক রীতিনীতিকেন্দ্রিক উপন্যাস এবং সেগুলিতে যে-সমাজ চিত্রিত হয়েছে তা বঙ্কিমের সমসাময়িক সমাজ। তাঁর সীমিত অভিজ্ঞতার কারণে এই সমাজে প্রতিফলিত হয়েছে বাঙলার হিন্দু মধ্যবিত্ত শ্রেণির গতানুগতিক দৃষ্টিভঙ্গি ও বিশ্বাস। এটি বিস্ময়ের ব্যাপার যে, বঙ্কিমের উপন্যাসে খুব কদাচিৎ পাশ্চাত্যের জীবন ও চিন্তার ছাপ পরিলক্ষিত হয়। সে-সময় পাশ্চাত্যের প্রভাবপুষ্ট একটি নতুন শিক্ষিত শ্রেণি গড়ে উঠছিল এবং তারা হিন্দু সমাজের কাঠামো ও চিন্তায় একটি পরিবর্তন নিয়ে আসছিল। বঙ্কিমের কাছে এই সমাজটি প্রায় অচেনাই থেকে গিয়েছিল। চোখের বালিতে এই সমাজই রবীন্দ্রনাথকে তাঁর উপন্যাসের বিষয়বস্তু জুগিয়েছে। উদীয়মান এই শ্রেণিকে রবীন্দ্রনাথের পক্ষে ব্যাপকভাবে বুঝতে পারার ও সেইসঙ্গে তাদের প্রতি তাঁর সহানুভূতির পেছনে অবশ্য একটি কারণ ছিল। হিন্দু সমাজের রূপান্তরসাধনের ক্ষেত্রে তাঁর পরিবারের সদস্যরা ছিলেন পথিকৃৎ। তাঁর পিতা ছিলেন সংস্কারক নেতাদের অন্যতম এবং তিনি নিজে ইঙ্গ-ভারতীয়দের সঙ্গে অবাধে মেলামেশা করেছিলেন। অতএব তাদের আশা-আকাক্সক্ষার প্রতি তাঁর সহানুভূতি ছিল এবং তিনি তাদের ভয় ও প্রত্যাশার অংশীদার হতে পেরেছিলেন।

রবীন্দ্রনাথের অনেক উপন্যাসের ক্ষেত্রে যেমন তেমনি চোখের বালির আখ্যান অংশও বেশ সরল। মহেন্দ্র এক স্নেহময়ী মায়ের একটি নষ্ট হয়ে যাওয়া ছেলে। তিনি মহেন্দ্রের বিয়ে ঠিক করেন প্রাণোচ্ছলা, বুদ্ধিমতী ও সুন্দরী তরুণী বিনোদিনীর সঙ্গে। মহেন্দ্র অবশ্য অনুরক্ত হয়ে পড়ে অন্য একটি মেয়ে আশার প্রতি, যার সঙ্গে তার বন্ধু বিহারীর বিয়ে ঠিক হয়েছে। বিহারীর অনুভূতির কথা একটুও না ভেবে মহেন্দ্র আশাকে বিয়ে করে। দুজনের জীবন প্রেমে-ভালোবাসায় পূর্ণ হয়ে থাকে তরুণী বিধবা বিনোদিনীর মহেন্দ্রের জীবনে আবার ফিরে আসা পর্যন্ত। মহেন্দ্র হঠাৎই আবিষ্কার করে, আশার তুলনায় বিনোদিনী কত বেশি ভালো। সে তার জন্য কাতর হয়ে পড়ে। বিনোদিনীও মহেন্দ্রের প্রতি আকৃষ্ট হয়, কিন্তু শীঘ্রই বুঝতে পারে যে, মহেন্দ্র একজন স্বার্থপর ও অস্থিরচিত্ত মানুষ। তার মধ্যে বিহারীর জন্য ভালোবাসাসম অনুরাগ জন্ম নেয়, কিন্তু বিহারী সবসময় আড়ালেই থাকে এবং মহেন্দ্রের জন্য নিজেকে উৎসর্গ করে চলে। বিনোদিনীর হৃদয় জয় করার জন্য মহেন্দ্র তার পক্ষে যা যা সম্ভব তার সবকিছুই করে এবং তার নিজের চরিত্র সম্পর্কে সাফাই অর্জনের জন্য বিশ্বাস করতে শুরু করে যে, বিহারীর একদা কনে আশার মধ্যে এখনো বিহারীর প্রতি দুর্বলতা রয়েছে। বিনোদিনী বুঝতে পারে মহেন্দ্র কী ধরনের মানুষ এবং তাকে ঘৃণা করতে থাকে। বিহারী বিধবা বিনোদিনীকে বিবাহের প্রস্তাব দেয়, কিন্তু বিনোদিনী তার প্রস্তাব ফিরিয়ে দেয়, যদিও সে এখন বিহারীর প্রতি গভীর ভালোবাসা পোষণ করে।

এই আখ্যানটির নিছক কাঠামোটি আমাদের কাছে তুলে ধরে যে, এখানে স্বাভাবিক মানব-মানবী এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হচ্ছে যা পৃথিবীর প্রায় যে-কোনো স্থানে সৃষ্টি হতে পারে। এ-কথা বলার অর্থ এই নয় যে, উপন্যাসটিতে কোনো স্থানীয় বৈশিষ্ট্য নেই। বস্তুত, কাহিনির অগ্রগতি এমনসব ঘটনার উপর নির্ভর করছে যেগুলি বাঙলার বৈশিষ্ট্যসূচক এবং শুধু বাঙলাদেশেই ঘটতে পারত। তবে স্থানীয় প্রকার ও সর্বজনীন আবেদনের মধ্যে অবশ্য কোনো বিরোধাভাস নেই। সব মহৎ শিল্পেই আমরা সব চরিত্র পাই যারা একই সঙ্গে দেশীয় ও বৈশ্বিক। টলস্টয়ের অনেক উপন্যাসে আছে সর্বজনীন আবেদন, আবার একই সঙ্গে সেগুলি তাদের যুগ ও শ্রেণির বিচারে একান্তভাবে রুশী। একই বিবেচনা প্রযোজ্য চোখের বালি-র চরিত্রগুলির ক্ষেত্রেও।

উপন্যাসটির প্রধান আকর্ষণীয় দিক হচ্ছে মনস্তাত্ত্বিক পরিস্থিতিগুলির সযত্ন নির্মাণ যেখানে চরিত্রগুলি নিজেদের উন্মোচিত করে। এখানে বাঙলা উপন্যাসে এই প্রথম আখ্যান নির্ভর করেছে চরিত্রগুলির উপর, চরিত্র আখ্যানের উপর নয়। মহেন্দ্রেরও রয়েছে একজন ধনী যুবকের মতো গুণাবলি ও দোষত্রুটি, যে যুবকটির ইচ্ছাগুলি কখনো অপূর্ণ থাকেনি। সে অবশ্যই একজন খারাপ মানুষ নয়, কিন্তু নিজের অনুভূতির উপর তার কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই এবং তার আচরণে অন্যদের মধ্যে কী প্রতিক্রিয়া ঘটতে পারে তা নিয়েও তার কোনো চিন্তা নেই। সে সুচিন্তিতভাবেই বিনোদিনীর পরিবর্তে আশাকে পছন্দ করেছিল, কিন্তু বিয়ের পর নিজের সিদ্ধান্তের জন্য তার মনে অনুশোচনার সৃষ্টি হয়। সে একজন জেদি ও প্রবৃত্তিতাড়িত মানুষ। যদি শুধু বিনোদিনী রাজি থাকে, তাহলে সে তার মা ও স্ত্রীর সুখও ধ্বংস করে দিতে প্রস্তুত। তার চরিত্রের সবচেয়ে খারাপ দিকগুলি প্রকাশ পায় যখন বিনোদিনী তাকে প্রত্যাখ্যান করে। সে বিহারীর প্রতি উন্মাদপ্রতিম ঈর্ষান্বিত হয়ে ওঠে এবং ভুলে যায় যে, মহেন্দ্র যখন আশাকে বিয়ে করতে চেয়েছিল তখন বিহারী স্বেচ্ছায় আশার উপর তার দাবি ছেড়ে দিয়েছিল। সে নিজে যে বিনোদিনীকে বিয়ে করতে উদ্গ্রীব সে-কথাটি সম্পূর্ণ ভুলে গিয়ে বিহারীকে বিয়ে করার ইচ্ছা প্রকাশ করায় বিনোদিনীকে সে অভিযুক্ত করে। শেষদিকে সে সংবিৎ ফিরে পায় তার নিজের চরিত্রের কোনো পরিবর্তনের কারণে নয়, বরং আশার সরল ও নিবেদিতচিত্ত ভালোবাসা এবং বিনোদিনীর দৃঢ় নৈতিক মনোভাবের কারণে। মহেন্দ্র, অতএব, কোনোভাবেই একটি শ্রদ্ধাভাজন চরিত্র নয়, কিন্তু এ-কথা অবশ্যই উল্লেখ করতে হয় যে – তার সকল দোষত্রুটি সত্ত্বেও সে একজন পছন্দের মানুষ হিসেবে থেকে যায় যার প্রতি আমরা করুণা ও সহানুভূতি উভয়ই অনুভব করি। এই দিকটি বাঙলা উপন্যাসে একটি নতুন উপাদান যোগ করে। এর আগের অনেক উপন্যাসে শৈল্পিক নিরপেক্ষতা বজায় রাখার জন্য ঔপন্যাসিকদের সহানুভূতি অথবা নিন্দা প্রকাশের বিষয়টি ছিল অত্যন্ত প্রবল ধরনের।

বাঙলা উপন্যাসের সবচেয়ে আকর্ষণীয় চরিত্রগুলির একটি হচ্ছে বিনোদিনী। শীলতা ও সৌন্দর্যে পরিপূর্ণা বিনোদিনী বুদ্ধিতেও অদ্বিতীয়া। রবীন্দ্রনাথের পরবর্তী উপন্যাসের নায়িকা হেমনলিনীর সঙ্গে তার কিছু মিল রয়েছে, তবে হেম অধিক শিক্ষিতা আর বিনোদিনী অনেক বেশি মার্জিতা এবং বিচক্ষণ বা উপস্থিত-বুদ্ধিসম্পন্না। সে বুদ্ধিদীপ্ত ও আত্মমর্যাদাসম্পন্ন এবং আমাদের চিরায়ত সংস্কৃত সাহিত্যের কয়েকজন নায়িকার কথা সে মনে করিয়ে দেয়। কালিদাস ও ভবভুতির রচনায় উচ্চমর্যাদাসম্পন্না নায়িকাদের সাক্ষাৎ পাওয়া যায়, যারা পরিশীলিত আচরণের সঙ্গে সঙ্গে বুদ্ধি ও চাতুর্যে নিজেদের উজ্জ্বলভাবে উপস্থিত করেছিল। অবশ্য সংস্কৃত সাহিত্যে এ-ধরনের চরিত্রের সাক্ষাৎ পাওয়া যায় শুধু রাজসভাতেই। অন্যদিকে বিনোদিনী একান্তভাবেই মধ্যবিত্ত শ্রেণির প্রতিনিধিত্বকারী একজন নারী এবং সে আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় বহু ইউরোপীয় উপন্যাসের নায়িকাদের কথা। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হয়তো এ-কথা জানতেন না, কিন্তু এ-বিষয়ে খুব সামান্যই সন্দেহ রয়েছে যে, সংস্কৃত ও ইউরোপীয় সাহিত্যের যুগপৎ প্রভাবের ফলেই তিনি বিনোদিনীর মতো একটি চরিত্র সৃষ্টি করতে পেরেছেন।

বিনোদিনীকে বাঙলা উপন্যাসে আধুনিক নারীদের প্রথম প্রতিনিধি বিবেচনা করা যায়। সে আধুনিক কিন্তু ইংরেজিয়ানার ধারক নয়। পাশ্চাত্যের জীবনধারা দ্বারা প্রভাবিত হয়ে সে একজন আত্মসচেতন ও প্রগতিপন্থী ব্যক্তিত্ব। বিনোদিনীর অনুভূতিগুলির পরিবর্তন তুলে ধরার ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথ অনেকখানি মনোযোগ দিয়েছেন। আমরা যখন প্রথম তার কথা শুনি তখন সে একটি বুদ্ধিমতী তরুণী যে ভবিষ্যতের সুখী জীবনের জন্য উন্মুখ হয়ে আছে। মহেন্দ্র তাকে বিয়ে করতে রাজি না হওয়ার ব্যাপারটি তার কাছে কঠিন একটি আঘাতের মতো ছিল। এরপর একজন অযোগ্য স্বামীর সঙ্গে তার বিয়ে ছিল তার জন্য আরো বড় অবমাননা। দুর্বল চরিত্রের একজন নারী হয়তো এসব আঘাতের কাছে আত্মসমর্পণ করত, কিন্তু বিনোদিনী নয়। এমনকি বৈধব্যও তাকে ধ্বংস করেনি যদিও যে সমাজের মানুষ সে ছিল সেই গোঁড়া হিন্দু সমাজে বৈধব্য ছিল সবচেয়ে বড় অভিশাপ। সে যখন মহেন্দ্রের মায়ের সঙ্গে দেখা করতে আসে তখন সে পূর্ণসচেতন ছিল যে, ভিন্ন পরিস্থিতিতে সে এই সুখী ও সম্পন্ন বাড়ির বধূ হতে পারত। আশা তার বিজয়িনী প্রতিদ্বন্দ্বী এবং দুজনের প্রথম সাক্ষাৎকালে একধরনের মানসিক চাপ দুজনের মধ্যেই ছিল। বিনোদিনী কোনো সরল বা বোকাসোকা কিংবা ভাবালুতাপূর্ণ গ্রাম্য বালিকা ছিল না যে আশার দয়াদাক্ষিণ্য দ্বারা সে অভিভূত হয়ে পড়বে কিংবা সে এমন কপটস্বভাবও ছিল না যে বাড়ির গৃহবধূর সঙ্গে তার সুপ্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতা সে গোপন করবে। আশার সরলতাপূর্ণ ও প্রেমময় প্রকৃতি তাকে আকৃষ্ট করে, কিন্তু সে ভুলতে পারে না যে, এই বোকাসোকা মেয়েটিই কোনো চালাকি-চতুরতা ছাড়াই তার জীবনটা নষ্ট করে দিয়েছে। আশা যখন তার সঙ্গে বন্ধুত্ব করার প্রস্তাব দেয়, সে তখন আশার প্রস্তাব ফিরিয়ে দেয় না, কিন্তু নিঃশর্তভাবে তা গ্রহণও করে না। কিছুটা মজার ছলে ও কিছুটা আন্তরিকতার সঙ্গে সে আশাকে মনে করিয়ে দেয় যে – তাদের দুজনের সম্পর্কের মধ্যে সবসময় একটা টানাপড়েন ভাব থাকবে।

মহেন্দ্রের প্রতি বিনোদিনীর মনোভাবও সমভাবে দোদুল্যমান। সে স্বভাববতই তার প্রতি মহেন্দ্রর মুগ্ধতা পছন্দ করে এবং তার প্রতি এক ধরনের আকর্ষণও অনুভব করে। তবে সে কখনো ভুলতে পারে না যে, এই মহেন্দ্রই একদিন আশার কারণে তাকে বাতিল করে দিয়েছিল, যে আশা সবদিক থেকেই তার চেয়ে অপকৃষ্টা বলে সে মনে করে। আশার উপর প্রতিশোধ গ্রহণের ইচ্ছা তার মনে কখনও কখনো জাগে, কিন্তু তার চেয়ে কমবয়সী মেয়েটির ছলাকলাহীন সরলতা তার সহানুভূতিই জিতে নেয়। মহেন্দ্রকে সে তার সমকক্ষ বলেও মেনে নিতে পারে না। অল্প সময়ের মধ্যেই সে মহেন্দ্রের চরিত্রের দুর্বলতাগুলি ধরতে পারে।

তার প্রতি বিনোদিনীর মনোভাব হচ্ছে নিজের আত্মনিয়ন্ত্রণ অক্ষুণ্ন রেখে তাকে প্রলোভিত করা। সে তাকে কামনার শেষ পর্যায়ে পর্যন্ত টেনে নিয়ে যেতে চায়, কিন্তু তার মনে স্পষ্ট ধারণা রয়েছে যে, সে মহেন্দ্রের কাছে নিজেকে সমর্পণ করবে না। এতে মনে হয় তাকে নিয়ে খেলা করার মধ্যে তার মনে এক ধরনের সন্তুষ্টি আসে যেহেতু সে-খেলা তার আহত অহংবোধের উপর প্রলেপের কাজ করে। সে যেহেতু মূলত সদাচারিণী ও দয়াবতী সেজন্য সে শীঘ্রই বুঝতে পারে যে, তার সামান্য ছলাকলা মহেন্দ্রকে বেশ নাড়া দিয়েছে। আশার সুখ নষ্ট করার কোনো ইচ্ছাই তার নেই। সেজন্য সে মহেন্দ্রের এগিয়ে আসাকে কঠোরভাবে বারিত করে। এতে অবশ্য সে আরো বেশি বেপরোয়া হয়ে উঠতে চায়, কিন্তু ইতোমধ্যে বিনোদিনী মনস্থির করে ফেলে যে, মহেন্দ্রকে সে অবশ্যই আর কোনো উৎসাহ জোগাবে না।

আশার প্রতি মমতা ছাড়াও, যা বহমান ছিল ফল্গুধারার মতো, মহেন্দ্রের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করার আরো একটি কারণ ছিল বিনোদিনীর। সে প্রথমদিকে বিহারীকে তেমন লক্ষও করেনি। বস্তুত বিহারীর প্রতি তার প্রথম প্রতিক্রিয়া ছিল কিছুটা অনৌৎসুক্য, যদি তা অবজ্ঞা না হয়েও থাকে। মহেন্দ্রের প্রতি বিহারীর আত্মবিলোপী বন্ধুত্বকে সে দুর্বলতার পরিচয় বলে মনে করত। তীক্ষ্ন মেধার সাহায্যে শীঘ্রই সে দেখতে পেল যে, আশার প্রতি বিহারীর একরূপ গোপন অনুরাগ রয়েছে, কিন্তু সে আশা ও মহেন্দ্র উভয়ের প্রতি শুভকামনার কারণে বিবেকিতার সঙ্গে তার অনুভূতিকে চাপা দিয়ে রেখেছে। মাঝেমধ্যে এই গোপন ক্ষতটি উস্কে দেওয়ার লোভ সে সংবরণ করতে পারে না। কিন্তু বিহারীর মনের অন্তর্নিহিত ভালোত্ব ও চরিত্রগুণের দৃঢ়তার খোঁজ  পাওয়ার পর সে নিজেই তার প্রতি নিরাশামূলক তীব্র আবেগের শিকার হয়ে পড়ে। সে জানে, বিহারী যখন তাকে বিয়ে করার প্রস্তাব দেয় তখন সে তা করেছে তার প্রতি ভালোবাসার চেয়ে বরং অনেক বেশি আশাকে তার জীবনের সম্ভাব্য অসুখী ঘটনাবলি থেকে বাঁচানোর অভিপ্রায়ে। বিহারীর প্রতি গভীর ভালোবাসা থাকা সত্ত্বেও সে তার সহানুভূতি বা অনুকম্পা গ্রহণে ইচ্ছুক নয়। বিহারীর ভালোবাসা যদি সে না পায় তাহলে তার বরং বন্ধনমুক্ত থাকাই উচিত। দুঃখের সঙ্গে কিন্তু অনেক বেশি মর্যাদাসহকারে সে বিহারীকে বিয়ে করতে অস্বীকার করে এবং আশা ও মহেন্দ্রের জীবন থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে নেওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে।

বিনোদিনীর চরিত্র বিষয়ে আমি এখানে কিছুটা বিশদভাবে দীর্ঘ আলোচনা করেছি। বাঙলা উপন্যাসে সে যে কেবল প্রথম আধুনিক রমণী শুধু তা নয়, নারীহৃদয়ের ভাবনাচিন্তার নিবিড় ও বিশদ মনস্তাত্ত্বিক বিচার-বিবেচনারও প্রথম উদাহরণ সে। শৈবলিনী চরিত্রে বঙ্কিম আধুনিক নারীর একটি নকশা উপস্থাপন করেছিলেন, কিন্তু বঙ্কিমের এই বিশ্লেষণ ভাসা ভাসাই রয়ে গেছে। নৈতিক বিষয়ে তাঁর পূর্বধারণাসমূহও শৈবলিনীর অনুভূতিগুলির শৈল্পিক ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। রবীন্দ্রনাথেরও নৈতিকতার প্রতি প্রবল ঝোঁক ছিল, কিন্তু তিনি তাঁর ভিতরের নীতিবাগীশ মানুষটিকে বিনোদিনীর জন্য সহানুভূতির পথে বাধা সৃষ্টিতে জয়ী হতে দেননি। তার হৃদয়ে যে বিদ্রোহ অঙ্কুরিত হয়েছিল রবীন্দ্রনাথ যেমন সে-বিদ্রোহের নিন্দা করেননি, তেমনি তিনি তার শাস্তিও কামনা করেননি যেমনটা বঙ্কিম করেছিলেন শৈবলিনীর প্রতি। সে কারণে বিনোদিনী তার বিপরীতধর্মী অনুভূতি ও ইচ্ছাসমূহ নিয়ে এবং ভিন্ন ভিন্ন দিকে আকর্ষণকারী প্রতিদ্বন্দ্বী ভাবানুভূতি দ্বারা ক্ষতবিক্ষত হয়েও অসাধারণ সুন্দর ও আকর্ষণীয়া এক নারী হিসেবে জীবন্ত একটি চরিত্র হয়ে উঠেছে।

বিনোদিনী চরিত্রের মধ্য দিয়েই বাঙলা উপন্যাস সাবালকত্ব অর্জন করেছে এবং বিশ্বসাহিত্যের মূলধারার সঙ্গে যুক্ত হতে পেরেছে। পরিত্যক্ত হয়েছে অতিলৌকিকতা অথবা অস্বাভাবিকতার উপর নির্ভরতা। রোমান্সের জন্য আকুলতা যেমন অদৃশ্য হয়েছে, তেমনি চমকের জন্য ইতিহাসের কুয়াশাচ্ছন্নতার উপর নির্ভরতাও শেষ হয়েছে। জীবন বয়ে চলে জলস্রোতে মসৃণ গতিতে ভেসে-চলা নৌযানের মতোই আর সাধারণ নরনারীরা জীবনের এই ঘটনাবলিতেই তাদের ভূমিকা পালন করে চলে। জোর দেওয়া হয় জীবনের বড় ঘটনাগুলির উপর নয়, বরং চরিত্রগুলির মনের অনুভূতির সূক্ষ্ম দ্যোতনাগুলির উপর। মনস্তাত্ত্বিক ঘটনাপ্রবাহ মনোযোগের ক্ষেত্রে কোনো বাধা তৈরি করে না এবং ঔপন্যাসিক খুব কদাচিৎ হাজির হন উপন্যাসের পাতায়। তিনি ঘটনাপ্রবাহ ঘটতে দেন চরিত্রগুলির অনুসরণে এবং দক্ষতা ও কল্পনার সঙ্গে চিত্রিত করেন চরিত্রগুলির অনুভূতির আন্তঃক্রিয়া।

বৌ-ঠাকুরাণীর হাট থেকে বিনোদিনী পর্যন্ত পৌঁছা এক সুস্পষ্ট অগ্রগমন। অবশ্য এই অগ্রগতি রক্ষা করা যায়নি এবং পরবর্তী উপন্যাসেই রবীন্দ্রনাথ অধিকতর প্রথাগত পথে ফিরে গেছেন। চোখের বালি ইতোমধ্যেই বাঙলা উপন্যাসকে প্রাত্যহিক জীবনের চিত্র তুলে ধরার পর্যায়ে নিয়ে এসেছিল, কিন্তু নৌকাডুবিতে রোমাঞ্চকর ঘটনাপ্রবাহ ও অভাবিত যোগাযোগের উপাদান আবার প্রাধান্যবিস্তারকারী বিষয় হয়ে ওঠে। চোখের বালি উপন্যাসে এসব আকর্ষণসূচক দিক বাদ দেওয়া হয়েছিল। কোনো অসংশ্লিষ্ট পরিস্থিতি কাহিনির গতিপথে বাধা সৃষ্টি করেনি। ঘটনাবলি এবং এমনকি আখ্যানও চরিত্রচিত্রণ ও বিভিন্ন ব্যক্তিত্বের মধ্যে অনুভূতির আন্তঃক্রিয়ার তুলনায় গৌণ বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। নৌকাডুবিতে আখ্যান আবার মূল ভাবকে অতিক্রম করে গেছে। যে-ঝড়ের কবলে পড়ে রমেশের স্ত্রী জলে ডুবে গেছে সেই ঝড়ই আখ্যানের অগ্রগতির জন্য প্রয়োজনীয় হাতিয়ার হয়ে দাঁড়িয়েছে। একইভাবে, চূড়ান্ত গ্রন্থিমোচনও নির্ভর করে ক্রমিক সুখপ্রদ সমাপতনসমূহের উপর। এটি এমন যে, এসব চরিত্রের জীবন এবং ঔপন্যাসিকের চাহিদা অনুযায়ী ঘটনাবলির বিন্যাস সাধনের ক্ষেত্রে ভাগ্যই একমাত্র নিয়ন্তা রূপে কাজ করছিল।

নৌকাডুবি উপন্যাসের নায়ক রমেশের জন্ম একটি ঐতিহ্যগত হিন্দু পরিবারে এবং তার জীবনের মূল নিহিত সেই জীবনধারায়। একই সঙ্গে তার শিক্ষার মাধ্যমে সে আধুনিক আন্দোলনগুলির সঙ্গেও সম্পর্কিত। এর কারণে সে একটি আলোকপ্রাপ্ত ব্রাহ্ম পরিবারের সংস্পর্শে আসে যে-পরিবারটির মধ্যে প্রতিফলন ঘটেছিল বাঙলায় জায়মান মধ্যবিত্ত শ্রেণির সবচেয়ে প্রগতিশীল জীবনধারার। গোঁড়া রক্ষণশীল সমাজে যুবক-যুবতীরা সামাজিক জীবনে কদাচিৎ পরস্পর মেলামেশা করে। ব্রাহ্ম সমাজে মেলামেশা করার ও বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তোলার সুযোগ অনেক বেশি ছিল তাদের জন্য। এটি কোনো বিস্ময়ের ব্যাপার নয় যে, রমেশ শিক্ষিতা ব্রাহ্ম যুবতী হেমনলিনীর প্রেমে পড়বে। সমকালীন বাঙালি সমাজের আরো অনেক দুর্বল চরিত্রের মতো তারও অবশ্য সাহস হয় না তার পিতা কর্তৃক নির্ধারিত কন্যার সঙ্গে বিবাহ প্রত্যাখ্যান করার। বিবাহ অনুষ্ঠানের পর তারা যখন নৌকাযোগে ফিরে আসছিল তখন ঝড়ের কবলে পড়ে তাদের নৌকা ডুবে যায়। রমেশ সলিলসমাধি পাওয়া থেকে রক্ষা পায় এবং যখন তার জ্ঞান ফিরে আসে তখন সে তার পাশে একটি যুবতী মেয়েকে দেখতে পায়। সে ধরে নেয় যে, সেই মেয়েটি তার নবপরিণীতা স্ত্রী। কিন্তু শিগগিরই সে বুঝতে পারে যে, সেই মেয়েটি অন্য কারো নববধূ, অথচ সে বিশ্বাস করে যে – রমেশই তার স্বামী। একটি সরল অশিক্ষিতা মেয়ে সে।

পিতৃপরিচয় কিংবা বাড়িঘরের কোনো বিবরণ মেয়েটি দিতে পারে না বলে তাকে তার পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দেওয়াও সম্ভব হয় না। এমনকি তার পরিবারের খোঁজ যদি পাওয়াও যেত তবু তাকে তারা যে ফিরিয়ে নিত সে-বিষয়েও সন্দেহ থেকে যায়, যেহেতু সে রমেশের গৃহে বাস করেছে।

উপন্যাসটি প্রধানত রমেশের মনের মধ্যে যে দ্বন্দ্ব চলে তারই অনুক্রমিক বর্ণনা। সে ক্ষতবিক্ষত হতে থাকে হেমনলিনীর প্রতি তার ভালোবাসা এবং ভাগ্য যাকে তার জীবনের সঙ্গে জুড়ে দিয়েছে সেই কমলার জন্য উদ্বেগ নিয়ে। সে প্রথমে চিন্তা করে যে, কমলাকে সে ভালোভাবে লেখাপড়া করাবে যাতে সে নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারে। তবে কমলা মেনে নিতে চায় না যে সে শুধুই রমেশের একজন পরিচিতা। তাছাড়া সে এও মনে করে যে, স্ত্রী হিসেবে রমেশের উপর তার অধিকার রয়েছে। তার প্রতি রমেশের ঔদাসীন্য এবং এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা তাকে বিস্মিত ও আহত করে। এদিকে রমেশের অদ্ভুত আচার-আচরণে হেমনলিনীও দূরে সরে যায়। বিক্ষিপ্তচিত্ত ও উদ্বিগ্ন রমেশ এক পর্যায়ে স্থির করে, যেহেতু ভাগ্য কমলাকে তার জীবনে এনে দিয়েছে, অতএব সে অবশ্যই তাকে গ্রহণ করবে এবং হেমনলিনীকে নিয়ে সব চিন্তা মন থেকে মুছে ফেলবে। কমলা অবশ্য ভাগ্যক্রমে হঠাৎ আবিষ্কার করে যে, তার বিয়ে রমেশের সঙ্গে হয়নি। একজন অজানা ব্যক্তির প্রতি কোনো হিন্দু স্ত্রীর চিরাচরিত প্রতিক্রিয়া তার মধ্যে জাগ্রত হয় এবং রমেশকে নিয়ে সব ভাবনা তার মন থেকে মুছে দেয়। এই জটের সমাধান ঘটে যখন শেষ পর্যন্ত কমলার স্বামী আবিষ্কৃত হয়। এই লোকটি সেই ব্যক্তি যে হেমনলিনীর প্রণয় কামনা করছিল। সব ঘটনার জট খুলে যায় এবং কমলা তার স্বামীর কাছে ফিরে যায় হেমনলিনীর সঙ্গে রমেশের পরিণয়ের পথ নিষ্কণ্টক করে দিয়ে।

এই সংক্ষিপ্ত বর্ণনা থেকে দেখা যাবে, পাশ্চাত্যের প্রভাব ও ঐতিহ্যগত হিন্দু চিন্তাধারার মধ্যে সংঘাতের ফলে যেসব সমস্যার সৃষ্টি হয়েছিল রবীন্দ্রনাথ সেগুলির বিষয়ে সচেতন ছিলেন। তিনি নিজ নিজ জগতে বসবাসকারী হিন্দু মধ্যবিত্ত শ্রেণির জীবনধারার একটি উজ্জ্বল চিত্র অঙ্কন করেছেন। তাদের মনস্তাত্ত্বিক সন্দেহ ও সংঘাতের দিকগুলিও দক্ষতা ও সহানুভূতির সঙ্গে তুলে ধরা হয়েছে। তবে উপন্যাসের সমাপ্তি থেকে দেখা যায় যে, রবীন্দ্রনাথ ঐতিহ্যের প্রভাব ছাড়িয়ে বের হতে পারেননি। তিনি অনেক সহানুভূতি ও দক্ষতার সঙ্গে কমলার হৃদয়ে রমেশের প্রতি ধীরে ধীরে ভালোবাসা গড়ে ওঠার বিষয়টি বর্ণনা করেছেন। সেই ভালোবাসা সাধারণ বন্ধুতা থেকে অনুরাগে পরিণত হয় এবং আবেগপূর্ণ গভীর অনুরক্তির পর্যায়ে পৌঁছে যায়। রমেশের এড়িয়ে যাওয়ার সব চেষ্টাই তাকে হতবুদ্ধি ও হতভম্ব করে, কিন্তু কোনোভাবেই রমেশের জন্য তার উদ্বেগ কমাতে পারে না। তবে এটি কিছুটা বিস্ময়ের ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায় যখন দেখা যায়, কমলা যখনই জানতে পারে যে – রমেশ তার স্বামী নয়, তখনই তার প্রতি কমলার প্রেমানুভূতি অকস্মাৎ শুকিয়ে যায়, যে-অনুভূতি তাদের দীর্ঘদিনের সাহচর্যের ফলে গড়ে উঠেছিল। যদি রমেশের জন্য তার ভালোবাসা শুধু স্বামী হিসেবে ধারণার কারণেই গড়ে উঠে থাকে তাহলে অনুরূপ পরিবর্তন আপাতগ্রাহ্য হতে পারত। কমলার ভালোবাসা অবশ্য একজন রক্তমাংসের বাস্তব মানুষের জন্য এবং তা গড়ে উঠেছে দীর্ঘকালের দৈনন্দিন সাহচর্যের মাধ্যমে। যে মুহূর্তে কমলা জানতে পারে যে, নলিনাক্ষই তার স্বামী সে মুহূর্ত থেকে রমেশের প্রতি তার অনুরাগের আকস্মিক তিরোধান এবং সমভাবে নলিনাক্ষের প্রতি তার ভালোবাসার আকস্মিক স্থানান্তর হিন্দু সমাজের প্রচলিত ধারণাগুলির সঙ্গে মিলতে পারে বটে, কিন্তু তা সম্ভাবনার আইন এবং মানব-মনস্তত্ত্বকে লঙ্ঘন করে।

এসব ত্রুটি সত্ত্বেও নৌকাডুবিতে সমকালীন সমাজ ও এর সমস্যাগুলির প্রতি যে মনোযোগ দেওয়া হয়েছে তার মাধ্যমে বাঙলা উপন্যাসের বিকাশে তা ভূমিকা রেখেছে। লেখক যদিও প্রচলিত রীতিসমূহ মেনে নিয়েছেন তাঁর উপন্যাসে, তবু তাঁর সৃষ্ট চরিত্রসমূহ মোটামুটি বলিষ্ঠ এবং তারা রক্তমাংসের মানব-মানবী হিসেবেই উপন্যাসে উপস্থিত হয়েছে। চোখের বালিতে ঐতিহাসিক প্রণয়োপাখ্যান থেকে বেরিয়ে আসার প্রথম যে প্রয়াস রবীন্দ্রনাথ গ্রহণ করেন তা এতে আরো দৃঢ় হয়েছে। রবীন্দ্রনাথ আবারও দেখিয়েছেন যে, সমকালীন বাঙালি সমাজ এবং এর মধ্যবিত্ত শ্রেণির গতানুগতিক জীবনধারার মধ্যেও অত্যন্ত নাটকীয় ঘটনাসংঘাত সৃষ্টির যথেষ্ট উপাদান রয়েছে। বঙ্কিমচন্দ্র তাঁর বিষবৃক্ষ উপন্যাসে যে উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন এবার তার পূর্ণতাসাধন সম্পন্ন হলো। পরবর্তী অর্ধশতাব্দী পর্যন্ত বাঙলা উপন্যাস আবর্তিত হয়েছে প্রধানত বাঙলার বিশাল মধ্যবিত্ত শ্রেণির বিভিন্ন স্তরের সাধারণ নারী ও পুরুষদের জীবনকে কেন্দ্র করেই।

নৌকাডুবি উপন্যাসের অল্প কিছুকাল পরে প্রকাশিত গোরা উপন্যাসটিকে সাধারণত রবীন্দ্রনাথের মহত্তম উপন্যাস হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। প্রকৃতপক্ষে অনেক বিদগ্ধ সমালোচকই গোরাকে এখনও পর্যন্ত বাঙলা ভাষায় রচিত উপন্যাসগুলির মধ্যে মহত্তম রচনা বলে বিবেচনা করেন। দৃষ্টিভঙ্গি ও উপস্থাপন-রীতির দিক থেকে চোখের বালির সঙ্গে এর নিকট সম্পর্ক থাকলেও গোরার প্রেক্ষাপট অনেক বিশাল, যা একে রবীন্দ্রনাথের অন্যান্য উপন্যাস থেকে একেবারে পৃথক ও বিশিষ্ট করে তুলেছে।

এতে উঠে এসেছে বিগত শতকের [উনিশ শতক] শেষের দিকের জীবনধারার বহু দিক এবং একটি বিবেচনা থেকে একে ঐতিহাসিক উপন্যাসও বলা যায়। প্রাচ্যের একটি বড় অংশের সঙ্গে সঙ্গে ভারতও [বর্তমান ভারত, বাংলাদেশ ও পাকিস্তান] তখন এগিয়ে যাচ্ছিল একটি নতুন জীবনের দিকে। জাপান, ভারত ও তুরস্কের মতো দূরবর্তী অঞ্চলগুলিতে তখন সচেতনতার একটি আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছিল। ভারতে পুনরুজ্জীবনকামী মধ্যবিত্ত শ্রেণি প্রত্যক্ষ সংগ্রামের মাধ্যমে রাজনৈতিক শক্তি অর্জন করতে চাইছিল। সামাজিক আদর্শগুলিরও রূপান্তর ঘটছিল দ্রুত। প্রচলিত রীতিতে আবদ্ধ ও গোঁড়া রক্ষণশীল সংখ্যাগরিষ্ঠ যেসব মানুষ শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে কদাচিৎ পরিবর্তনের স্বাদ গ্রহণ করেছে তারা মুখোমুখি হয়ে পড়ে ক্ষুদ্রসংখ্যক সংখ্যালঘু কিছু মানুষের, যারা শতাব্দীপ্রাচীন প্রথাগুলিকে অগ্রাহ্য করে পাশ্চাত্য নিদর্শের ভিত্তিতে নতুন এক সমাজ গড়তে চাইছিল। যে-বিশে^ সবকিছুই বিশৃঙ্খলায় পূর্ণ সেখানে এসব সমাজের সীমানাও নির্দিষ্ট ছিল না। যৌবনে যারা বিদ্রোহী গ্রুপগুলির সদস্য ছিল তাদের মধ্যে অনেকেই বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রচলিত ব্যবস্থার দৃঢ় সমর্থক হয়ে ওঠে। তবে অনেকের মধ্যেই আবার সময়ের অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে সংস্কারবাদিতার উৎসাহ বৃদ্ধি পেল। মধ্যপন্থী ও চরমপন্থীরা রাজনীতি, সামাজিক বিষয়াদি, ধর্মীয় বিবেচনা ও বুদ্ধিবৃত্তিমূলক দৃষ্টিভঙ্গির ক্ষেত্রে একে অপরের সঙ্গে বিবাদে জড়িয়ে পড়ল।

কাঠামোগত নির্মাণ অথবা জীবনের সমগ্রতা বিষয়ে অনুভবের ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথের উপন্যাসগুলির মধ্যে গোরা সবচেয়ে বেশি তৃপ্তিদায়ক। গঠনবিন্যাসের দিক থেকে এটি চোখের বালির চেয়ে শ্রেয়তর এবং এমনকি নৌকাডুবির চেয়েও। রবীন্দ্রনাথের পরবর্তী উপন্যাসগুলির বেশ কয়েকটির মধ্যে কাব্যিকতার যে অতিরিক্ততা দেখা যায় এটি তা থেকেও মুক্ত। এর অনেক চরিত্র এবং ঘটনাবলির জটিলতার মাধ্যমে এটি বিগত শতাব্দীর শেষের দিকের বাঙালি জীবনের সবচেয়ে পূর্ণাঙ্গ চিত্র উপস্থাপনে সফল হয়েছে। রবীন্দ্রনাথ তাঁর গল্পগুচ্ছের গল্পগুলিতে পল্লিবাঙ্লার চমৎকার সব চিত্র তুলে ধরেছেন। এই গল্পগুলি বাঙলার পল্লিজীবনের পটভূমিতে আদিম অনুভূতিগুলির ক্রিয়াসমূহ উপস্থিত করেছে। প্রেম ও স্নেহ-ভালোবাসা, ভোগলিপ্সা ও ঘৃণা চিত্রিত হয়েছে সহানুভূতি ও বক্রাঘাতের সঙ্গে। স্থানীয় জীবনোপাদানের বৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ এই গল্পগুলিতে রয়েছে মৌলিক মানবতাবোধ যা যে-কোনো বিশেষ যুগ বা আবহকে অতিক্রম করে যায়। এর বিপরীতে গোরা অনিবার্যভাবে একটি বিশেষ সময়ের বাঙলার চিত্র। এটিই সম্ভবত রবীন্দ্রনাথের একমাত্র বই যেখানে কলকাতা এসেছে গল্পের এক আবশ্যিক উপাদান হিসেবে। তাঁর অনেক বইতে কলকাতা হচ্ছে একটি স্থান যেখানে ঘটনাগুলি সংঘটিত হয়, কিন্তু সেগুলির সঙ্গে নগরীটির সম্পর্ক ক্ষীণ। এই রাজধানী নগরীটি বহু পরম্পরবিরোধী ঘটনা ও চিন্তাভাবনার মিলনস্থল। সন্দেহ, প্রশ্ন ও অন্তর্দ্বন্দ্বসমূহ এর আত্মাকে পীড়িত করে, কিন্তু অন্যান্য উপন্যাসে সেগুলি কদাচিৎ কোনো আলোড়ন হিসেবে ঢেউ তোলে। একমাত্র গোরা উপন্যাসেই এই নগরজীবন এর অন্তর্দ্বন্দ্ব ও উত্তাপসমূহ নিয়ে কাহিনির অবিচ্ছেদ্য অংশরূপে স্থান পেয়েছে।

রবীন্দ্রনাথের অধিকাংশ উপন্যাসের মতো গোরার প্লট বা আখ্যানও তুলনামূলকভাবে সরল। আইরিশ পিতামাতার সন্তান গোরা সিপাহী বিদ্রোহের সময়কার পিতৃমাতৃহীন সন্তান। কৃষ্ণধন নামে ইংরেজি ভাবাপন্ন এক বাঙালি তাকে বাঁচিয়েছিলেন এবং তাঁর স্ত্রী আনন্দময়ী তাকে লালনপালন করে বড় করেছিলেন।

বয়সে বৃদ্ধ হয়ে যাওয়ার পর তাঁর সংস্কারবাদী উৎসাহ অন্তর্হিত হয়েছিল এবং তিনি ধীরে ধীরে গোঁড়া মতবাদের দিকে ঝুঁকে পড়েছিলেন। অন্যদিকে আনন্দময়ীর তো জীবনই শুরু হয়েছিল চিরাচরিত হিন্দু স্ত্রী হিসেবে। কিন্তু তাঁর স্বামীর বৈধর্মিক বিশ^াস ও সাধারণ আচরণগুলি তাঁকে গোঁড়ামি থেকে বের করে এনেছিল। তাঁর রক্ষণশীলতার উপর চূড়ান্ত আঘাত এসে পড়ল তাঁর জীবনে গোরার আগমন ঘটার মাধ্যমে। তিনি শিশুটিকে গ্রহণ করলেন নিজের সন্তানের মতো এবং তাঁর সকল স্নেহ-ভালোবাসা উজাড় করে দিলেন সেই পিতৃমাতৃহীন অনাথ শিশুটির উপর। সম্ভবত যে বৈধর্মিক পরিবেশে গোরা বড় হয়ে উঠেছিল তার প্রতিক্রিয়া হিসেবেই সে হয়ে উঠেছিল একজন যুদ্ধংদেহী বা জঙ্গি হিন্দু। তার উগ্র জাতীয়তাবাদ এমনকি হিন্দু ধর্মের কুসংস্কারগুলিকেও সমর্থন জোগায়। এই মনোভাব ও আচরণের ফলে একটি ব্রাহ্ম পরিবারের সঙ্গে তার দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয় এবং উপন্যাসটির বিরাট একটি অংশ জুড়ে রয়েছে গোঁড়ামি ও সংস্কারবাদের সমর্থকদের মধ্যে উত্তপ্ত বিতর্ক এবং যুক্তি উপস্থাপনের বিবরণ।

বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে, গোরা সংস্কারপন্থার প্রবক্তাদের সব আক্রমণ প্রতিহত করে, কিন্তু একটি নতুন জটিলতার সৃষ্টি হয় যখন সে অত্যন্ত আকর্ষণীয়া ও সুন্দরী এক ব্রাহ্ম তরুণীর প্রতি প্রণয়াসক্ত হয়। গোরা তাকে স্বমতে নিয়ে আসার চেষ্টা করে এবং তার প্রভাবে সেও [সুচরিতা] কিছুকালের জন্য হিন্দু রক্ষণশীলতার প্রতি সমর্থনদানে প্রয়াসী হয়। গোরা এমনকি তাকে এমন পরামর্শদানের পর্যায়েও চলে যায় যে, সুচরিতার উচিত তার নিজের জাতের একজনকে বিয়ে করা যদি সে বুদ্ধিবৃত্তি ও নৈতিকতার দিক থেকে তার চেয়ে অনেক হীনতরও হয়। এমন কিছু ঘটার আগেই গোরা তার জন্মের গোপন কথাটি জানতে পেরে যায়। উগ্র হিন্দুত্ববাদের যে স্বপ্নসৌধ সে তৈরি করেছিল তার পুরোটাই ধসে পড়ে এবং সে ভালোবাসা ও সান্ত্বনার জন্য সুচরিতার কাছে ফিরে যায়। শেষ দৃশ্যটি হয় মা আনন্দময়ীর কাছে তার পুনর্বার ফিরে যাওয়া। এর আগে পর্যন্ত সে জাতপাত ও আনুষ্ঠানিক হিন্দু ধর্মের অন্যান্য বিধান সম্পর্কে সুচরিতার অবিশ্বাসের বিরুদ্ধাচরণ করেছে, কিন্তু এখন সে বুঝতে পারছে সামাজিক বিধিবিধানের চেয়ে মানবিক মূল্যবোধের প্রতি সুচরিতার অধিক আকর্ষণ কতটা বিচক্ষণতার কাজ ছিল।

নিছক গঠন-কাঠামোর বিবরণ পাঠকের কাছে উপন্যাসটির চমৎকারিত্ব ও জটিলতার বিষয়টি তুলে ধরতে পারবে না। গোরার জীবনে দুটি প্রধান তীব্র আবেগ রয়েছে। একটি হচ্ছে হিন্দু ধর্মকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরা ও এর ভিত্তিতে ভারতীয় জাতীয়তাবাদ নির্মাণের সচেতন প্রয়াস। অপরটি হচ্ছে সুচরিতার জন্য তার গোপন ও ব্যাকুল প্রতীক্ষা। ভালোবাসার আহ্বানের সঙ্গে কর্তব্যনির্দেশিত পথের দ্বন্দ্ব তৈরি হওয়ার শঙ্কায় সে মনে মনে ক্ষতবিক্ষত হতে থাকে। আবার পটভূমিতে রয়েছে আনন্দময়ীর সীমাহীন স্নেহ, যা সামাজিক রীতিনীতি ও পূর্বসংস্কারকে অগ্রাহ্য করে, কিন্তু যারা সেগুলিকে আঁকড়ে ধরে থাকে তাদের প্রতি কোনো বিরাগও পোষণ করে না। তাঁর মধ্যে রয়েছে সহানুভূতি এবং মৃদু বিড়ম্বনা সহ্য করার গুণ; এবং কোনো কোনো বিবেচনায় তা রবীন্দ্রনাথের জীবনদৃষ্টির সবচেয়ে কাছাকাছি। উপন্যাসটি বিতর্ক ও যুক্তিতর্কে পরিপূর্ণ, কিন্তু আনন্দময়ী ছিলেন এসবের ঊর্ধ্বে। পরেশবাবু একজন শিক্ষিত ও নিষ্ঠাবান ব্রাহ্ম, তাঁর উদার মানবিকতায় ছিলেন এদিক থেকে আনন্দময়ী চরিত্রের প্রতিমূর্তি। সুবিবেচনামূলক ও যৌক্তিক দৃষ্টিভঙ্গির অধিকারী পরেশবাবু একজন যথার্থ ধার্মিক মানুষ, কিন্তু আনন্দময়ীর তুলনায় তিনি একজন অস্পষ্ট ও অনির্দিষ্ট চরিত্রই থেকে যান। তিনি কোনো সজীব চরিত্র হিসেবে উপন্যাসে উপস্থিত হন না, অথচ এর বিপরীতে আনন্দময়ী তীব্রভাবে সজীব। কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা যেমন তাঁর নেই, তেমনি প্রচলিত অর্থে কোনোভাবেই তিনি একজন আধুনিকা নারীও নন; তিনি শুধুই একজন গৃহকর্ত্রী এবং তবু যে-কোনো ধরনের পূর্বসংস্কার থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত। তিনি রবীন্দ্রনাথের উপন্যাসে অথবা অন্যত্র অতি অল্প কয়েকটি চরিত্রের মধ্যে একজন যেখানে সদ্গুণ শুধু একটি গতানুগতিক চরিত্রের মধ্যেই মূর্ত হয়ে ওঠে না, বরং তা একটি শক্তিশালী জীবন্ত সত্তাও তৈরি করে। গ্রীক ট্র্যাজেডিতে এবং অনেক বেশি পাশ্চাত্য-সাহিত্যে নায়ক-নায়িকারা সচেতন বা অসচেতনভাবে পাপের শিকার। এটি সম্ভবত নিয়তি সম্পর্কে গ্রীক ধারণা ও আদি পাপ-এর খ্রিষ্টীয় ধারণা থেকে এসেছে। অন্যদিকে ভারতীয় ধারণায়, মানুষ পাপ থেকে জন্ম নেয় না, জন্ম নেয় আনন্দ থেকে। পাশ্চাত্যের সাহিত্যে একজন ভালো মানুষ বা ভালো নারী প্রায়শ বিমর্ষ ও প্রাণহীন সত্তা হিসেবে উপস্থাপিত হয়ে থাকে এ-কারণেই। আনন্দময়ী ভালো, কারণ তিনি সুখী এবং তিনি সুখী, যেহেতু তিনি ভালো।

সমকালীন বাঙালি সমাজে যেসব দ্বন্দ্ব নানা বিশৃঙ্খলার ঢেউ তুলেছিল সেগুলির অনেক কথা গোরা উপন্যাসে স্থান পেয়েছে, কিন্তু একে সমস্যাবলিভিত্তিক উপন্যাস বলা ভুল হবে। রবীন্দ্রনাথ এ-বইয়ে কোনো প্রচার-প্রচারণা চালানোর চেষ্টা করেননি, বরং সমকালীন জীবনের একটি বিশদ চিত্র তুলে ধরতে চেয়েছিলেন। আমরা সুচরিতার জন্য গোরার গোপন ভালোবাসার কথা সামান্য একটু বলেছি। আনন্দময়ী কিভাবে এক হিন্দু গৃহিণী থেকে বিশ্বজনীন সহানুভূতি পোষণকারী সত্যিকারের মহৎ নারী হয়ে উঠলেন তার কথাও কিছু উল্লেখ করেছি। উপন্যাসটিতে বিনয় ও ললিতার মধ্যে ভালোবাসার একটি সমান্তরাল কাহিনিও রয়েছে। এর বিপরীতে ললিতা ও সুচরিতার চরিত্রদ্বয় আমাদের বিশেষ মনোযোগের দাবি রাখে। তারা দুজনে আজন্ম বান্ধবী এবং একের প্রতি অন্যের গভীর অনুরাগ রয়েছে। দুজনেই পরমা সুন্দরী ও আকর্ষণীয়া দুই তরুণী। ললিতা প্রাণোচ্ছলা ও জীবনীশক্তিতে পরিপূর্ণা, অন্যদিকে সুচরিতা শান্ত ও কোমল, ধর্মপ্রাণা এবং গভীরমনা। ললিতার শক্তি নিজেই প্রকাশ পায় তার বিদ্রোহে, কিন্তু সুচরিতার রয়েছে ধরিত্রী মাত্রার মতো ধৈর্য ও সহনশীলতা। বিনয়ের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে ললিতা এমনকি তার বান্ধবীর প্রতিও ঈর্ষান্বিতা। সে গোরার প্রতি বিনয়ের আনুগত্যভাব পছন্দ করে না এবং গোরার প্রভাব থেকে বিনয়কে মুক্ত করার অভিপ্রায়ে গোরাকে অপদস্থও করতে চায়। সেও গোরার মতো যুদ্ধংদেহী এবং প্রয়োজনবোধে তার সঙ্গে ঝগড়া করতেও দ্বিধা করে না। এর বিপরীত স্বভাবের সুচরিতা মূলত সহিষ্ণু ও শান্ত স্বভাবের।

গোরার অন্য চরিত্রগুলি কিছুটা নকশাধর্মী; তবু অনেক চরিত্রই বিশিষ্টতা অর্জন করেছে। হরিমোহিনী ও কৈলাসের কাহিনি আমাদের এমন এক জগতের প্রাক্বীক্ষণ জোগায় যেটি পরে শরৎ চন্দ্র চট্টোপাধ্যায় পূর্ণভাবে অঙ্কিত করবেন। তবে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং শরৎ চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের মধ্যে লক্ষণীয় পার্থক্য রয়েছে। শরৎ চন্দ্র তাঁর অপছন্দনীয় চরিত্রগুলিকেও বিস্তারিত বর্ণনায় উপস্থাপিত করেছেন। রবীন্দ্রনাথ সন্তুষ্ট থেকেছেন ক্ষীণ আভাস ও ইঙ্গিত প্রদানের মধ্যে। তাঁদের মধ্যে অনেক চরিত্রই অপ্রধান চরিত্র, তবু মহিম, বরদাসুন্দরী, হরিমোহিনী ও কৈলাস সবাই ত্রিমাত্রিক। এদের সবার শীর্ষে রয়েছে গোরা যার এক পা ভারতে এবং অপর পা ইউরোপে। যেভাবেই বিবেচনা করা হোক না কেন, গোরা এক কথায় অতুলনীয়, কারণ রবীন্দ্রনাথের রচনাগুলির মধ্যে এমন পৌরুষদীপ্ত চরিত্র আর একটিও নেই। সাধারণভাবে বলতে গেলে বাঙলার ঔপন্যাসিকরা নারী-চরিত্র অঙ্কনে অত্যন্ত পারদর্শী। এটি যেমন সত্য বঙ্কিমের ক্ষেত্রে, তেমনি সত্য রবীন্দ্রনাথ এবং শরৎ চন্দ্রের ক্ষেত্রেও। এর একটি কারণ হয়তো এই যে, রাজনৈতিকভাবে পরনির্ভরশীল এবং   ধর্মীয় ও সামাজিক প্রথাসমূহ দ্বারা শৃঙ্খলিত একটি দেশ প্রকৃত পৌরুষব্যঞ্জক চরিত্র বিকাশের জন্য খুব সামান্য সব সুযোগই দিতে পেরেছিল। বাইরের জীবনে সীমাবদ্ধ হয়ে থাকা ভারতীয় অনেক পুরুষই তাদের গার্হস্থ্য জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রেও মা অথবা স্ত্রীদের প্রভাবাধীনে থাকে। অন্যদিকে নারীরা রাজনৈতিক নিগ্রহের পূর্ণপ্রভাব কখনো পুরোপুরি অনুভব করতে পারেনি, যেমনটা পুরুষদের ক্ষেত্রে ঘটেছে। নারীরা
এ-ধরনের প্রথাসমূহ ও রীতিনীতিকে তাদের জীবনের স্বাভাবিক বিষয়সমূহের একটি অংশ বলে মেনে নিতে পারে। পক্ষান্তরে যে পুরুষ মানুষেরা জীবনের অন্যান্য দিকের সাহচর্যে এসেছে তারা সহজে তেমন করতে পারে না। পুরুষেরা গভীরতর হতাশায় ভোগে, কারণ তাদের অভিজ্ঞতা ব্যাপকতর এবং তারা বৃহত্তর সম্ভাবনাসমূহের স্বপ্ন দেখে যা তাদের জীবনে অধরাই থেকে যায়। নারীরা তাদের নিয়ন্ত্রিত জীবনযাপনের মধ্যেও অধিকতর স্বাধীনতা ও উদ্যোগের সুযোগ পায়। এটি হয়তো একটি কারণ হতে পারে কেন নারী চরিত্রগুলিই বাঙলা উপন্যাসে অধিকতর উজ্জ্বল। গোরা তার ঔদ্ধত্য ও শক্তি নিয়ে একটি ব্যতিক্রমী চরিত্র। সে বুদ্ধিমান ও আগ্রাসী মনোভাবাপন্ন। বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে সচেতন সে যেমন, তেমনি সে তার কাজেও সরাসরি ধরনের। পূর্ণ প্রাপ্তবয়স্ক, সে একজন প্রেমিক যেমন, তেমনি একজন যোদ্ধাও। অন্যদিকে তাকে বুঝতে হলে মহিমের বিপরীত চরিত্র হিসেবে বিচার করে দেখতে হবে সে কিভাবে ভারতের গড়পড়তা নাগরিকদের চেয়ে স্বতন্ত্র।

গোরার চরিত্রগুলি এখনো বেঁচে রয়েছে, কিন্তু সেখানে উপস্থাপিত বেশিরভাগ বিতর্ক ও আলোচনা এখন অপ্রচলিত ও অযুগোপযোগী হয়ে গেছে। তবে সেগুলি অবশ্য আমাদের সামনে বিগত উনিশ শতকের শেষ তিন দশকের ও বিশ শতকের প্রথম দশকের বাঙলা তথা সম্ভবত ভারতেরও একটি চিত্র তুলে ধরে। আমরা পূর্বেই উল্লেখ করেছি যে, রবীন্দ্রনাথ বাঙলা উপন্যাসকে সমকালের সংকীর্ণতার সীমাবদ্ধতার ঊর্ধ্বে নিয়ে গেছেন। এটি গোরা উপন্যাসে চমৎকারভাবে প্রকাশ পেয়েছে। নায়কের যুদ্ধংদেহী স্বদেশপ্রেম লেখককে আক্রান্ত করতে পারেনি। গোঁড়া হিন্দুত্ব ও উগ্র ব্রাহ্মবিশ^াস উভয়ই তাঁর রচনায় মৃদু বিড়ম্বনার বিষয়ে পরিণত হয়েছে। গোরা পূর্ণতা খুঁজে পায় যখন সে তার অভারতীয় উৎসমূল গ্রহণ করে নেয় এবং সুচরিতার প্রতি ভালোবাসায় নিজেকে সমর্পণ করতে পারে। মুসলমান-অধ্যুষিত গ্রামগুলির সংস্পর্শে যখন সে আসে তখন তার মধ্যে জীবনের প্রতি আরো বেশি ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি হয়। অবশেষে সে আত্মসমর্পণ করে আনন্দময়ীর কাছে যিনি জাতপাত ও ধর্মের ঊর্ধ্বে অবস্থান করেন এবং তাঁর নিজ মহিমা দিয়ে ভারতের প্রতিভূ। গোরা যে জন্মসূত্রে ইউরোপীয় এবং তবু গোঁড়ামির একজন অন্ধ সমর্থক এই বিষয়টি সমানুপাত ও ভারসাম্যের একটি ভাব বজায় রাখতে সাহায্য করে। রবীন্দ্রনাথের বিশ^াসের মৃদু প্রকাশ ঘটে এই প্রত্যয়ে যে, প্রায়শ উগ্র ধর্মোন্মত্ততার ভিত্তি হয় মিথ্যাভাষণ।

ঐতিহ্যগত ধারানুসরণে রচিত উপন্যাসগুলির মধ্যে গোরাই রবীন্দ্রনাথের সর্বশেষ রচনা। পরবর্তী উপন্যাস চতুরঙ্গকেই অনেকে রবীন্দ্রনাথের শ্রেষ্ঠ শিল্পকুশতার নিদর্শনগুলির মধ্যে অন্যতম বলে মনে করেন। এই উপন্যাসেই তিনি আখ্যান বর্ণনার প্রভাব থেকে সরাসরি সরে আসেন, উপন্যাসের প্রধান উপাদান হয়ে ওঠে মানবিক অনুভূতি – ঘটনার বর্ণনাকে ছাপিয়ে। চতুরঙ্গের পর রবীন্দ্রনাথ উপন্যাসের অনেক প্রকরণ ও পদ্ধতি নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন, কিন্তু তখনও পর্যন্ত বাঙলা উপন্যাসে যেটি আদর্শ প্রকরণ রূপে পরিগণিত ছিল সেই সরাসরি অগ্রসর হওয়ার দীর্ঘদৌড়ের দ্বারা সেসব পরীক্ষা-নিরীক্ষা অপসারিত হয়। এ-কথা বলা হয়েছে যে, সাহিত্য-সমালোচনার ঐতিহ্য না থাকাই রবীন্দ্রনাথের উপন্যাস প্রায়শ অর্জনের শীর্ষদেশে পৌঁছতে না পারার একটি কারণ। তাঁর উপন্যাস সবসময় আকর্ষণীয়। সেগুলির আখ্যান ও চরিত্রগুলি কখনও কখনও অসাধারণ, কিন্তু উপন্যাসটি পড়ার পর আমাদের মনে এই অনুভূতি জন্মায় যে, এতে কিছু একটা আমরা পাইনি। একজন প্রতিভাবান মানুষ তাঁর নিজের অভিজ্ঞতা থেকে একটি ছোটগল্প অথবা একটি গীতিকবিতা সৃষ্টি করতে পারেন। কিন্তু নাটক বা উপন্যাসের ক্ষেত্রে একটি অসাধারণ সৃষ্টির জন্য এমনকি একজন প্রতিভাবান মানুষেরও প্রয়োজন হয় সামাজিক পৃষ্ঠপোষকতা ও সমালোচনার। সেরূপ সামাজিক প্রেক্ষাপট অথবা সমালোচনা সমকালীন বাঙলা জোগান দিতে পারেনি।

চতুরঙ্গকে উপন্যাস না বলে বরং একটি বড় গল্প বলা যেতে পারে। এতে রবীন্দ্রনাথের উপর অন্যান্য পরিণত মনের অভিঘাতের ছায়া পড়েছে। বিশ শতকের দ্বিতীয় দশকে ভারতের বাইরে ভ্রমণ তাঁকে সুযোগ করে দিয়েছিল ইউরোপের কয়েকজন অসাধারণ মনীষীর সংস্পর্শে আসার। এই অভিজ্ঞতা তাঁকে চতুরঙ্গ রচনার জন্য যে বুদ্ধিবৃত্তিক উদ্দীপনা প্রয়োজন তা দিয়েছিল। এর আখ্যানপর্বের ধারণা তৈরি করা ও সেই ধারণাকে বাস্তবায়িত করার কাজটি যেমন প্রতিভাদীপ্ত একটি প্রয়াস, তেমনি অসাধারণ এর চরিত্রচিত্রণ। আমাদের দুঃখ এখানে যে, নিজ প্রতিভার দীপ্তিকে পূর্ণবিকাশের সুযোগ দেওয়ার জন্য রবীন্দ্রনাথ এই পর্যায়ে একটি পূর্ণাবয়ব উপন্যাস লেখার চেষ্টা করেননি। এমনকি গোরা উপন্যাসেও রবীন্দ্রনাথ কবি ও ঔপন্যাসিকের সম্মিলন অর্জনে সমর্থ হননি। চতুরঙ্গ সেরূপ সম্মিলনের একটি দৃষ্টান্ত, কারণ সেটির নির্ভরতা গল্প বা আখ্যানের চেয়ে বিষয়বস্তু ও উপস্থাপনের ধরনের উপরই বেশি। প্রকৃতপক্ষে এর আখ্যান অংশটি যতটুকু ক্ষীণ হওয়া সম্ভব ছিল ততটুকুই ক্ষীণ, তবে তা কবি রবীন্দ্রনাথের জন্য সুযোগের সৃষ্টি করেছে। আখ্যান প্রায়শ যান্ত্রিক ধরনের হয়ে থাকে এবং এর উপর মনের কর্তৃত্বই বেশি। অতএব আখ্যাননির্ভর উপন্যাসের ক্ষেত্রে বৈচিত্র্য ও নতুনত্ব অত্যাবশ্যক। বিষয়বস্তু লেখকের ব্যক্তিত্বেরই প্রকাশ। বিষয়বস্তুর ক্ষেত্রে মৌলিকতা নিহিত থাকে রচনারীতির মধ্যে, ঘটনাবলির গঠন-কাঠামোর মধ্যে নয়। বাঙলার জীবনযাত্রার সীমাবদ্ধতা অ্যাডভেঞ্চার বা নতুনত্বের সুযোগ খুব কমই প্রদান করে। এই সীমাবদ্ধতা বাঙালি ঔপন্যাসিককে স্বাভাবিকভাবেই আখ্যানের চেয়ে বরং বিষয়বস্তুর উপরই নির্ভর করতে বাধ্য করা উচিত, কিন্তু তাঁকে তো প্রভাবিত করে রেখেছে উনিশ শতকের ইংরেজি উপন্যাসের দৃষ্টান্ত। স্যার ওয়াল্টার স্কট এবং জর্জ এলিয়টই ছিলেন সেই মডেল বা আদর্শ, অধিকাংশ বাঙালি ঔপন্যাসিক যাঁদের অনুসরণ করেছেন। বঙ্কিমচন্দ্র মনোনিবেশ করেছেন আখ্যানের উপর এবং দূরবর্তী সময় ও স্থানের মধ্যে বৈচিত্র্য ও নতুনত্বের সন্ধান করেছেন। তিনি প্রায়শ মানসিক বিকাশের বিষয়টিকে অবহেলা এবং অনুভূতির সূক্ষ্ম দ্যোতনাগুলিকে অগ্রাহ্য করেছেন। রবীন্দ্রনাথের বাস্তববুদ্ধি তাঁকে তাঁর সামাজিক প্রেক্ষাপটের সীমাবদ্ধতাগুলি সম্পর্কে সচেতন করে তুলেছিল এবং শুরু থেকেই তিনি ঘটনাবলির চেয়ে অনুভূতির উপর অনেক বেশি জোর দিয়েছিলেন। এতে সাহায্য জুগিয়েছিল ফরাসি, রুশ ও অন্যান্য ইউরোপীয় সাহিত্যের সঙ্গে তাঁর ক্রমবর্ধনশীল পরিচয়। এর ফলে অবশ্যম্ভাবী হয়ে দাঁড়াল যে, ইউরোপ মহাদেশে যে ধারায় উপন্যাসের বিকাশ ঘটেছে অধিক থেকে অধিকতর সে ধারা দ্বারাই তিনি প্রভাবিত হবেন। বঙ্কিমচন্দ্র ও তাঁর সমসাময়িক ঔপন্যাসিকরা সম্ভবত ফরাসি ঐতিহ্য সম্পর্কে অনবহিত ছিলেন। রবীন্দ্রনাথ শুধু ফরাসি নয় বরং রুশ উপন্যাস দ্বারাও প্রভাবিত হয়েছিলেন। গোরা টলস্টয় ও দস্তয়েভস্কির যে-কোনো কাজ থেকেই অত্যন্ত ভিন্ন, কিন্তু ক্লান্তিকরভাবে উপন্যাসটির বিস্তৃত পটভূমি এবং দীর্ঘ তর্কবিতর্ক আমাদের তবু মহান রুশ ঔপন্যাসিকদের কথাই মনে করিয়ে দেয়। গোরার পর, ফরাসি প্রভাব মনে হয় বৃদ্ধি পেয়েছিল এবং রবীন্দ্রনাথ নিয়মিতভাবে আখ্যানের চেয়ে বরং বিষয়বস্তুর প্রাধান্যের দিকেই ক্রমশ এগিয়ে গিয়েছিলেন। এবং একই সঙ্গে হৃদয়ের চেয়ে বরং মনের প্রতিই।

চতুরঙ্গের পর রবীন্দ্রনাথ ক্রমাগত বিষয়বস্তু এবং সেইসঙ্গে উপন্যাসের রচনাকৌশল নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে গেছেন। ঘটনাবলির মন্থরগতি বর্ণনার পরিবর্তে আমরা পেয়ে যাই চিন্তাধারা ও অনুভূতির এক রুদ্ধশ্বাস সংবেগ, যা পাঠককে প্রায়শ ভাসিয়ে নিয়ে যায়। প্রায়শ নিরেট চরিত্রচিত্রণের স্থান দখল করে নিতে চায় বুদ্ধিবৃত্তিক আতশবাজি। চতুরঙ্গের বিষয়বস্তু হচ্ছে ত্রিমুখী প্রেম। অপরিহার্য নারী দামিনী আকৃষ্ট হয় শচীশের বুদ্ধিবৃত্তিক প্রাখর্য দ্বারা। শচীশ অবশ্য জীবনের চ্যালেঞ্জ গ্রহণে অপারগ। সে আশ্রয় খোঁজে একধরনের ধর্ষকামাশ্রয়ী ধর্মে যা রক্তমাংসের আবেদনকে অস্বীকার করে। মরিয়া হয়ে দামিনীর আসক্তি ধাবিত হয় অধিকতর নীরস ও অটল শ্রীবিলাসের প্রতি, যে স্বাভাবিক অনুধাবন ও স্বাভাবিক আবেগের অধিকারী। শ্রীবিলাসের উপর দামিনীর নির্ভরতা শচীশের মনে ক্ষুব্ধতার সৃষ্টি করে, কিন্তু তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। যখন দামিনী তাকে জানায় যে, তার আর কিছু করার নেই। তখন সে তার জীবন থেকে দূরে চলে যায় এবং দামিনীও চিরপ্রচলিত নিত্যনৈমিত্তিক জীবন শুরু করে শ্রীবিলাসের স্ত্রী হিসেবে।

নিছক কাহিনি তুলে ধরার প্রয়াস দ্বারা উপন্যাসটির প্রতি সুবিচার করা হয় না, যে-উপন্যাসের মূল অর্জন নিহিত কবি ও গল্পকথকের একীভূত মিলনে। এই সংমিশ্রণের কাজটি রবীন্দ্রনাথ প্রথম করেছিলেন গল্পগুচ্ছের গল্পগুলিতে, কিন্তু সেগুলিতে তাঁর ভূমিকা ছিল একজন জীবন দর্শকের। চতুরঙ্গে আমরা প্রথমাবরের মতো অনুভব করি জীবনদৃষ্টি ও কারুকার্যের সচেতন অনুসন্ধান। উপন্যাসটির ভাষায় অর্জিত হয় এমন সজীবতা ও স্বচ্ছতা যা বাঙলা ভাষায় আগে কখনও দেখা যায়নি। একক ব্যক্তিসত্তাকে বিসর্জন দেওয়ার মতো ভাবানুষঙ্গ এতে এসেছে বিরল সূক্ষ্মতা ও শক্তির মাধ্যমে। উপন্যাসটিতে কাহিনি বা গল্পটি বর্ণিত হয় প্রধান চরিত্রগুলির দ্বারা তাদের ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে। স্বভাবতই, একই ঘটনাবলির পুনরাবৃত্তিমূলক বর্ণনা ক্লান্তিকর হয়ে উঠতে পারত, কিন্তু কবির তীক্ষ্ন অন্তর্দৃষ্টি ও গল্পকথকের নিখুঁত দক্ষতা একসঙ্গে মিলিত হয়ে জাদু ও রহস্যের আবহ সৃষ্টি করেছে, যা আমাদের মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখে। রবীন্দ্রনাথের প্রতিভার একটি বড় প্রমাণ এই যে, অতিশয় তীক্ষè বুদ্ধিবৃত্তিকতাভিত্তিক চতুরঙ্গ তিনি লিখেছিলেন প্রায় একই সময়ে, ঘরে-বাইরে রচনাকালে, যে-উপন্যাস দারুণভাবে প্রভাবিত ছিল গীতিকবিতার তীব্রতাধর্মী অনুভূতি দ্বারা।

ঘরে-বাইরে নিয়ে আলোচনার পূর্বে হয়তো এক মুহূর্ত থেমে আমরা বিবেচনা করতে পারি মানব-ত্রিভুজতার সমস্যাটির কথা যা দীর্ঘকাল ধরে রবীন্দ্রনাথের আকর্ষণের বিষয় ছিল। চোখের বালির পর তিনি আবার এই বিষয়টি নিয়ে এসেছিলেন নষ্টনীড়-এ। একে উপন্যাস না হলে বড় গল্প বলাই ভালো এবং এতে তিনটি চরিত্রের অনুভূতির আন্তঃক্রিয়ার বিরল সৌন্দর্য ও সূক্ষ্মতা উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছে। চারুর স্বামী ভূপতি একজন বিষয়সম্পত্তিজ্ঞানশূন্য ও ভুলোমনের মানুষ, যার আগ্রহের প্রধান বিষয় হলো তার নিজের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড ও সাহিত্যকর্ম। স্বামী কর্তৃক অবহেলিতা চারু তার স্বামীর সম্পর্কিত-ভ্রাতা অমলের সাহচর্যে আনন্দ খুঁজে পায়। দুজনের বন্ধুত্ব ভালোবাসায় রূপ নেয়, তাদের নিজেদেরই অজান্তে ও অব্যক্তভাবে।

এই ভালোবাসার আবিষ্কার চারুলতার সুখের সংসার তছনছ করে দেয়, এমনকি যদিও অমল এই স্বাভাবিক পূর্ণতা থেকে নিজেকে পিছিয়ে নিয়ে আসে যে মুহূর্তে সে সম্পর্কের এই পরিবর্তন আবিষ্কার করে। কাহিনিটি লেখা হয়েছে অতিশয় সূক্ষ্মতা ও নির্ভার বর্ণনার মাধ্যমে যার অন্য কোনো তুলনা বাঙলা সাহিত্যে নেই। এটি অপাপবিদ্ধতা ও আমোদ-প্রমোদের একটি জগৎ, যেটি প্রথমে বিঘ্নিত হয় ও পরে ধ্বংস হয়ে যায় তীব্র আবেগের কারণে। রবীন্দ্রনাথ এতে সঞ্চারিত করেন আদর্শবাদ ও যৌবনশক্তির একটি বৈশিষ্ট্য। আর এই বৈশিষ্ট্যই একে পাপ অথবা মালিন্য থেকে অনেক ঊর্ধ্বে নিয়ে যায়।

নষ্টনীড়-এ বিবাহবহির্ভূত প্রেমের সমস্যা বিভূষিত হয়েছে মোহিনীমায়া ও কাব্যসৌন্দর্য দ্বারা যা এর বিপজ্জনক পরিণতিসমূহ আড়াল করে রেখেছে। রবীন্দ্রনাথ এরূপ পরিস্থিতির বেদনা ও বিয়োগান্ত দিক সম্পর্কে পূর্ণসচেতন ছিলেন। এই সমস্যা মনে হয় তাঁকে বিশেষভাবে আকৃষ্ট করেছিল এবং তিনি বারবার এর স্বরূপ অনুসন্ধানে ফিরে গেছেন। চতুরঙ্গে এ-সমস্যার একটি দিক বিবৃত হয়েছে। ঘরে-বাইরে উপন্যাসে অন্য আরেকটি দিক। নিখিলেশ ও বিমলা দীর্ঘদিন ধরে সুখী দাম্পত্যজীবন যাপন করে আসছিল। এই সুখী জীবনে প্রবেশ ঘটে সন্দ্বীপের, যে বিদ্রোহ ও বিপ্লবের প্রতীক। নিখিলেশ বিমলাকে স্বাধীনতা দিতে চেয়েছিল   যাতে সে তার নিজের মতো করে গড়ে উঠতে পারে। সে কখনও কখনও অনুভব করেছে যে, বিমলা তাকে ভালোবাসে একজন স্ত্রী হিসেবে, কোনো নারী হিসেবে নয়। বিমলাও, সন্দ্বীপ তার মনে সন্দেহ ও দ্বন্দ্ব জাগিয়ে না তোলা পর্যন্ত তার স্ত্রীসুলভ আনুগত্যেই সন্তুষ্ট ছিল। সন্দ্বীপ সরাসরি তাকে প্রেম নিবেদন করেনি, তবে সে চেয়েছিল বিমলাকে রাজনৈতিক আন্দোলনের মধ্যে সংশ্লিষ্ট করতে যাতে তার গার্হস্থ্য জীবনের বন্ধনগুলি ভেঙে চুরমার হয়ে যায়। সে চেষ্টা করেছিল বিমলা যেন অবশ্যই জাতীয় আন্দোলনে নেতৃত্বের ভূমিকা নেয়। এ-কাজটি করার জন্য তার অবশ্যই শুধু বিদেশি সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করলেই চলবে না, বরং সেসব সামাজিক প্রথার বিরুদ্ধেও বিদ্রোহ করতে হবে যেগুলি নারীদের পুরুষের অধীন করে রেখেছে। এই বার্তা তাকে প্রায় ভাসিয়ে নিয়ে যায় এবং সন্দ্বীপের কাছে আত্মসমর্পণের মুহূর্তে যখন হঠাৎ তার কামনা ও ভেতরকার স্থূলতার প্রকাশ সে দেখতে পায়, তখন তা তার বিরক্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। চূড়ান্ত পদক্ষেপ নেওয়ার পূর্বমুহূর্তে এভাবে সে রক্ষা পায়। সেই সঙ্গে সে আবিষ্কার করে, যা সে তার স্বামীর দুর্বলতা বলে মনে করেছিল তা আসলে তার শক্তি। সে তার স্বামীর কাছে ফিরে আসে এবং যে দুঃখজনক ঘটনা ঘটতে পারত তা পরিহার করা সম্ভব হয়। তবে অনেক প্রশ্নেরই উত্তর এখানে পাওয়া যায় না। নিখিলেশকে নৈতিক দিক থেকে এতো উচ্চমানের চরিত্র হিসেবে তৈরি করে রবীন্দ্রনাথ প্রকৃতপক্ষে প্রথম থেকেই সন্দ্বীপের পরাজয় নিশ্চিত করে রেখেছিলেন। সন্দ্বীপ যদি নৈতিক অবস্থানের দিক থেকে নিখিলেশের সমান হতো তাহলে ঔপন্যাসটির সমাপ্তি কি একই রকম থাকত? স্বামীর অন্তর্জাত মহত্ত্বের আবিষ্কারই কি তার প্রতি বিমলার ভালোবাসাকে পুনরুজ্জীবিত করেছিল অথবা এ কি শুধু উচ্চতর নৈতিক সত্তার কাছে আত্মসমর্পণের একটি ঘটনা?

রবীন্দ্রনাথ তাঁর উপন্যাস রচনার শেষ পর্বে আরো দুটি উপন্যাসে এই বিষয়বস্তুতে ফিরে গিয়েছিলেন। দুই বোন এবং মালঞ্চে আবার অবৈধ প্রণয়ের সমস্যাগুলি নিয়ে এসেছিলেন। শশাঙ্ক অনেক বছর ধরে তার স্ত্রী শর্মিলার সঙ্গে রীতিগতভাবে সুখী জীবন যাপন করেছে। যতদিন সে একটি আশ্রিত জীবন কাটিয়েছে ততদিন সে শর্মিলার যত্ন ও আদরে তৃপ্ত ছিল। শর্মিলার অনুভূতিগুলি ছিল মাতৃস্নেহ ও স্ত্রীর ভালোবাসার একটি অদ্ভুত মিশ্রণ। শশাঙ্ক যখন শিল্প সংগঠনের কাজে ঝাঁপিয়ে পড়ল তখন সে নতুন আত্মবিশ^াস লাভ করল এবং অশেষ প্রাণশক্তির তাগিদ অনুভব করতে লাগল। শর্মিলা তার জীবন থেকে প্রায় অপসৃত হয়ে গেল, কিন্তু তার সাফল্য ও সম্মানে সেও তৃপ্তিবোধ করতে পারল। এই পর্যায়ে সে হয়ে পড়ল গুরুতর অসুস্থ এবং শর্মিলার বোন ঊর্মিমালা এলো তার সংসারের দেখাশোনা করতে। যৌবন ও প্রাণশক্তিতে পরিপূর্ণা ঊর্মিমালা শশাঙ্কের চোখে এমন এক নারী হয়ে দেখা দিলো যে ধরনের নারী সে এর আগে কখনও দেখেনি। তার পৌরুষশক্তির নবজাগ্রত ইন্দ্রিয় আকৃষ্ট হলো ঊর্মিমালার একান্তই নারীসুলভ প্রকৃতির প্রতি। শর্মিলা শীঘ্রই বুঝতে পারল, তার বোন তাকে তার স্বামীর হৃদয় থেকে সরিয়ে দিয়েছে। এটি ছিল একটি কঠিন আঘাত, কিন্তু আত্মসমর্পণের অদ্ভুত মনোভাব নিয়ে সে নিজের ভাগ্য বরণ করে নিতে নিজেকে প্রস্তুত করল। সে নিজেই প্রস্তাব করল যে, তার স্বামীর উচিত হবে ঊর্মিমালাকে বিয়ে করা। কিন্তু ছোট বোন তাতে সম্মত হলো না এবং এই দৃশ্যপট থেকে অদৃশ্য হয়ে গেল। এখানে উচ্চপর্যায়ের একটি বিয়োগান্ত উপন্যাসের উপাদান ছিল; রবীন্দ্রনাথ এই কাহিনিটিকে মৌলিক কামনার কাছে মানুষের সার্বিক অসহায়ত্বের একটি কাহিনি হিসেবে রূপায়িত করতে পারতেন। অথবা, তিনি কাহিনিটিকে বাস্তব বুদ্ধিমত্তা ও ঔদাসীন্যের একটি গল্প হিসেবে দাঁড় করাতে পারতেন। তিনি কোনোটিই করেননি। একজন কবি হিসেবে তিনি আবেগকে পুরোপুরি প্রত্যাখ্যান করতে পারেন না। অন্যদিকে তিনি তাঁর নবলব্ধ বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার পরিপ্রেক্ষিতে আবেগকে জয়ী করতেও পারছেন না। পরিণামে তৈরি হয় এক অদ্ভুত নিরাসক্তি, যা তাঁকে নিবৃত্ত করে ট্র্যাজেডির শিখরে পৌঁছা থেকে অথবা নোংরা চক্রান্তের জায়গায় অবস্থান করা থেকে। অতএব উপন্যাসটি সমাপ্ত হয় স্বামী ও স্ত্রীর মধ্যে পুনর্মিলনের এক দুর্বল প্রচেষ্টায়।

মালঞ্চ এই একই সমস্যার আরও একটি নিরীক্ষণ। নীরজা একজন পঙ্গু অক্ষম নারী। সে চোখের সামনে দেখতে পায় তার স্বামী ধীরে ধীরে তারই এক দূরসম্পর্কিত বোন সরলার প্রতি প্রণয়াসক্ত হয়ে উঠছে। নীরজা যখন সুস্থ-সবল ছিল তখন সে ছিল আদিত্যর স্ত্রী ও সেই সঙ্গে সহকর্মী। সে অসুস্থ হয়ে পড়ার পর প্রথমদিকে আদিত্য তার জীবনসাধনার মূল ক্ষেত্র বাগানের কাজে সরলার সাহায্য চাইত। ধীরে ধীরে সে নীরজার বিকল্প হয়ে উঠল শুধু বাগানের কাজে নয়, বরং আদিত্যর হৃদয়েও। নীরজা এই পরিস্থিতি মেনে নিতে প্রস্তুত নয় এবং মৃত্যুশয্যায় শুয়ে থেকেও সে আদিত্যর অবিশ^স্ততার প্রতিবাদ জানায়। নীরজা দুই বোনের শর্মিলার মতো নয়। মালঞ্চের নীরজা তার স্বামীর চরিত্রকে বিনা প্রতিবাদে মেনে নিতে পারে না এবং তার ওষ্ঠদ্বয়ে এই না-মেনে নেওয়ার চিহ্ন প্রকাশ করেই মৃত্যুবরণ করে।

পাঠক অনতিবিলম্বে লক্ষ করবেন যে, এই উপন্যাসগুলিতে বিবৃত হয়েছে একই বিষয়বস্তু। ত্রিভুজ প্রেম অবশ্যই সমস্যার সৃষ্টি করে, এমনকি পাত্রপাত্রীরা যদি অবিবাহিত এবং স্বাধীনও হয়ে থাকে। তারা অনেক বেশি উদগ্র হয়ে ওঠে, এমনকি যখন পাত্রপাত্রীর মধ্যে একজন বিবাহিত বা বিবাহিতা হয়। সমাজ এমন ভালোবাসাকে কটাক্ষ করে, কিন্তু শিল্পীকে তা ক্রমবর্ধমান আগ্রহের জোগান দেয়। চোখের বালি উপন্যাসে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন নিষিদ্ধ প্রেমের গল্প এবং এই বিষয়বস্তু নিয়ে তিনি কিভাবে কাজ করেছেন সে-সম্পর্কে আমরা কিছুটা দীর্ঘ আলোচনা করেছি। নষ্টনীড়ে পাত্রপাত্রীর তারুণ্য ও নিষ্পাপ সারল্য সে আঘাত কমিয়ে দিয়েছে এবং কাব্যিক সৌন্দর্য এর রূঢ়তা ও নিষ্ঠুরতাকে আড়াল করেছে। পরবর্তী চতুরঙ্গ, ঘরে-বাইরে, দুই বোন ও মালঞ্চ উপন্যাসগুলিতে আমরা দেখা পাই পরিণত ও প্রাপ্তবয়স্ক মানুষদের, যারা তাদের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয় নিজেদের কাজের সম্ভাব্য পরিণাম সম্পর্কে পূর্ণ সচেতন থেকেই। চতুরঙ্গ আমাদের বেদনাবোধকে অসাড় করে দেয় এর ভাষার জাদু দিয়ে। ঘরে-বাইরে উপন্যাসে বাইরের ঘটনাবলির ভিড় আমাদের অবস্থানকে দূরে সরিয়ে দেয়। দুই বোন ও মালঞ্চে রবীন্দ্রনাথ এভাবে নিশ^াস ফেলার বা পালিয়ে যাওয়ার কোনো সুযোগই আমাদের দেন না। স্বদেশপ্রেমের মহিমা সেখানে আর নেই। অবৈধ প্রেম এবং একজন বিবাহিত মানুষের হৃদয়ে নতুন আবেগানুভূতি জেগে ওঠার ঘটনা সেখানে আঁকা হয়েছে নগ্ন বাস্তবতা ও কোনোরূপ সমবেদনার সুযোগ না রেখেই। উভয় উপন্যাসেই স্বামীসঙ্গবঞ্চিতা স্ত্রী সন্তানহীনা ও চলাফেরায় অসমর্থ। উভয় ক্ষেত্রেই নতুন ভালোবাসা তৈরি হয়েছে আত্মীয়সম্পর্কিতের সঙ্গে। আর উভয় ক্ষেত্রেই এর সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে স্ত্রীর অসুস্থতার কারণে। আপাত পার্থক্য কিছুটা থাকলেও উভয় উপন্যাসেই উপসংহার মূলত একই। নীরজার মৃত্যু হয় অসুস্থতার কারণে, ভগ্নহৃদয়ে। শর্মিলা মারা যায়নি, কিন্তু তার সুখের সংসার ভেঙে যায় এবং দূরদেশে গিয়ে তাকে নতুন করে জীবন শুরু করতে হয়। এটা বলা কঠিন কে অধিকতর ভাগ্যহীনা। নীরজা অন্তত মৃত্যুর মধ্য দিয়ে কিছুটা শান্তি পেয়েছিল, কিন্তু শর্মিলাকে সারাজীবন তার স্বামীর অবিশ^স্ততার কথা মনে রাখতে হয়েছে।

প্রশ্ন উঠতে পারে, কেন রবীন্দ্রনাথ বারবার এই বিষয়বস্তুতে ফিরে এসেছিলেন। মনে হয়, রবীন্দ্রনাথ চোখের বালি এবং
ঘরে-বাইরের উপসংহার নিয়ে সন্তুষ্ট ছিলেন না। এই দুটি উপন্যাসে তাঁর শিল্পীসত্তা সামাজিক সমীচীনতার কাছে পরাজিত হয়েছে। এমনকি চতুরঙ্গেও ট্র্যাজেডি শূন্যে ঝুলে থেকেছে। দুই বোন এবং আরও বেশি মালঞ্চে তিনি স্থিরসিদ্ধান্ত ছিলেন যে, এমনটা হওয়া উচিত নয়। এর ফলে তিনি ঘটনাবলিকে নিজেদের স্বাভাবিক পথে চলতে দিয়েছেন। দুই বোন উপন্যাসে শশাঙ্ক ও ঊর্মিমালার সম্পর্ক গড়ে ওঠার বিষয়টি তিনি চিত্রিত করেছেন যত্নের সঙ্গে, কিন্তু মালঞ্চে আদিত্য ও সরলার ভালোবাসা আমাদের সামনে এসে উপস্থিত হয় আকস্মিকভাবে। নির্দয় বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড়ানোর দৃঢ়সংকল্পে রবীন্দ্রনাথ সম্ভবত অন্য এক চরমের দিকে চলে গিয়েছেন। একজন ঔপন্যাসিককে অবশ্যই নির্মম এবং শৈল্পিক দিক থেকে নিরপেক্ষ হতে হয়, কিন্তু চরিত্রগুলির প্রতি কেন তিনি নিষ্ঠুর হবেন তার কোনো কারণ নেই। দুই বোন ও মালঞ্চে যে নিষ্ঠুরতার উপাদান উপস্থিত তা এসেছিল সম্ভবত রবীন্দ্রনাথের নৈরাশ্য ও মোহমুক্তির বোধ থেকে। জীবনব্যাপী প্রয়াস সত্ত্বেও – রবীন্দ্রনাথের বয়স তখন সত্তরোর্ধ্ব – বিশ্বভারতী অর্থসংকটের সম্মুখীন। রাজনীতির জগতে সুস্থতার জন্য তাঁর বার্তার প্রতি কেউ কর্ণপাত করেনি। সর্বক্ষেত্রে কুসংস্কার ও সংকীর্ণতা আসন গেড়ে বসছিল। দুঃখের পেয়ালা পূর্ণ হওয়ার জন্য তাঁর সুন্দর স্বাস্থ্য ভেঙে যাচ্ছিল এবং কষ্টদায়ক অসুস্থতায় তিনি দীর্ণ হয়ে পড়ছিলেন। এটা কি কোনো বিস্ময়ের ব্যাপার যে, এই দুটি উপন্যাস, উদাসীনতা না হলেও নিষ্ঠুরতার আবহ দ্বারা, এমন ভারি হয়ে ওঠা উচিত?

আমরা এখন রবীন্দ্রনাথের অন্য আরো কয়েকটি উপন্যাস সম্পর্কে শুধু সংক্ষিপ্তভাবে কিছু উল্লেখ করব। শেষের কবিতা যখন প্রথম প্রকাশিত হয় তখন বিশেষ আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছিল। দীর্ঘকাল ধরে অবিমিশ্র অতিপ্রশংসার পর বাঙলার তরুণ লেখকরা এবার রবীন্দ্রনাথের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী হয়ে ওঠেন। তাঁদের মধ্যে অনেকেই মনে করলেন যে, রবীন্দ্রনাথ অনেক বেশি শান্তশিষ্ট ও স্বপ্নাবিষ্ট এবং জীবনের নিষ্ঠুর বাস্তবতার মুখোমুখি হননি। তাঁরা ঘোষণা দিয়ে বললেন, তাঁর লেখা আবেগাতিশয্যে পরিপূর্ণ এবং তিনি প্রায়শই প্রচলিত দৃষ্টিভঙ্গি ও বিশ্বাসগুলির কাছে নতিস্বীকার করেছেন। শেষের কবিতায় রবীন্দ্রনাথ তাঁদের চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করলেন এবং দেখিয়ে দিলেন যে, তাঁদের নিজেদের খেলায় তিনি তাঁদেরকে পরাস্ত করতে পারেন। তিনিও তাঁদের যে-কারো মতো শাণিত ও আধুনিক উপন্যাস লিখতে পারেন। তিনি তাঁদের সচেতন আধুনিকতাকে উপহাস করলেন, কিন্তু একই সঙ্গে সেসব সম্ভাবনার দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করলেন যেগুলি তাঁরা বুঝতে পারেননি। পরবর্তীকালে, দুই বোন ও মালঞ্চ উপন্যাসদ্বয়ে তিনি দেখিয়ে দিলেন তাঁদের মধ্যে সবচেয়ে তরুণ ও বেপরোয়াদের মতো নিষ্ঠুর তিনিও হতে পারেন।

 শেষের কবিতার তীক্ষ্নতা ও বলিষ্ঠতা সুস্পষ্ট শুধু এর পরিস্থিতি ও চরিত্রগুলির মধ্যেই নয়, বরং এমনকি এর ভাষায়ও। বুনিয়াদি ইংরেজির মতো বাঙলা ভাষায়ও ক্রিয়াপদগুলি কিছু মৌলিক রূপের মধ্যে সংক্ষেপিত হয়ে গেছে। ক্রিয়ার অধিকাংশ ধরনই প্রকাশ করা হয় বিশেষ্য ও মৌলিক ক্রিয়াপদগুলির একটি সমন্বয় সাধনের মাধ্যমে। ক্রিয়াপদের স্বল্পতার ফলে পুনরাবৃত্তি চলে আসে। বিশেষ্যর সঙ্গে সেগুলির সমন্বয় বাক্যপ্রকরণ ভারি করে তোলে এবং এর ফলে তা বাঙলা গদ্যে দুর্বলতার একটি উৎস হয়ে দাঁড়িয়েছিল। শেষের কবিতায় রবীন্দ্রনাথ প্রমাণ করেছেন যে, এই ঊনতা অতিক্রম করা যায়। ক্রিয়াপদের ব্যবহার কমিয়ে এবং প্রয়োজন অনুযায়ী নতুন ক্রিয়াপদ তৈরি বা সন্ধান করে তিনি ভাষাকে কিছুটা বদলে দিয়েছিলেন এবং নিজ ইচ্ছানুযায়ী একে সচল বা নিশ্চল করে নিয়েছিলেন।

ঘরে-বাইরে উপন্যাসের ভাষায় তিনি একটি বিপ্লব শুরু করেছিলেন। শেষের কবিতায় এই বিপ্লব সমর্থিত ও সংহত হয়। মুখের ভাষা থেকে নতুন বিশেষ্য ও ক্রিয়াপদ নিয়ে আসা হয় এবং বাঙলা গদ্যকে একটি নতুন ছন্দ দেওয়ার জন্য বাক্যরীতিরও পরিবর্তন সাধিত হয়। শেষের কবিতায় কাজ করা হয়েছে পরিশীলিত সমাজ নিয়ে। সব চরিত্রের অবস্থান একই সামাজিক শ্রেণিতে এবং সবারই একই ধরনের শিক্ষাগত পটভূমি। যেসব উপন্যাসে ভিন্ন ভিন্ন সামাজিক স্তরের মানুষদের উপস্থিতি ও সম্মিলন ঘটে সেসব উপন্যাসে লেখক চরিত্রগুলির একক বৈশিষ্ট্য নির্দেশ করার জন্য ভাষা-ব্যবহারে ভিন্নতা প্রয়োগ করতে পারেন। শেষের কবিতায় লেখক এই কৌশলটি ব্যবহারের সুযোগ পাননি, ফলে সব চরিত্র রবীন্দ্রনাথের ভাষাতেই কথা বলেছে। শিক্ষিত পুরুষ ও মহিলাদের মধ্যে অনেক বিষয়ে অভিন্নতা থাকে, কিন্তু তাদের নিজ নিজ বাগ্রীতিও থাকে। শেষের কবিতায় তেমনটা দেখা যায়নি। এর ফলে চরিত্রগুলি কিছুটা অবাস্তব হয়ে পড়েছে। এমনকি উপন্যাসের নায়ক অমিত রায় শেষ পর্যন্ত মাত্র বাক্যগুচ্ছের জোগানদাতাতে পরিণত হয়। অমিত রায় ও অন্যান্য প্রধান চরিত্র বুদ্ধিদীপ্ত ও প্রহেলিকাময় কথাবার্তার জন্য তীব্র আবেগানুভূতিতে এত বেশি নিমজ্জিত যে কখনও কখনও তারা স্বাভাবিক মানবিক অনুভূতিবর্জিত একক ব্যক্তিসত্তা হয়ে ওঠে। উপন্যাসটির বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় সমালোচনা এই যে, এর ধারণা তৈরি ও রচনা সম্পন্ন হয়েছে বুদ্ধিবৃত্তিক স্তরে। চরিত্রগুলি আবেগ নিয়ে খেলা করে এবং বীরদর্পে কথা বলে, কিন্তু অন্তিমে লেখকের হাতের সুতোর টানে চালিত পুতুল নাচের পুতুলের মতো পুতুলই থেকে যায়।

চার অধ্যায় রবীন্দ্রনাথের সর্বশেষ উপন্যাস, যদিও তিন সঙ্গী তিনি লিখেছিলেন ১৯৪০ সালে। চার অধ্যায়ের সঙ্গে ঘরে-বাইরে উপন্যাসের কিছু মিল আছে, তবু দুটি উপন্যাসই একটি অপরটি থেকে যথাসম্ভব ভিন্ন। ঘরে-বাইরে উপন্যাসে ছিল দুটি মূল বিষয় এবং সে-দুটি নিয়ে কাজ করা হয়েছে দুটি ভিন্ন স্তরে। এতে একটি বিষয় ছিল বিবাহ-বহির্ভূত প্রেম এবং একজন নারীর ব্যক্তিত্বের পূর্ণ বিকাশ। এর পাশাপাশি ছিল তাদের ব্যক্তিগত ও সামাজিক পরিপ্রেক্ষিতের আলোয় মানবিক সম্পর্কগুলির বিচার। নিখিলেশ ঘোষণা করে বলেছিল যে, ব্যক্তিক ও সামাজিক জীবনে মানবিক মূল্যবোধগুলি অবশ্যই একই রকম হওয়া উচিত। ব্যক্তি এবং সর্বজনের নৈতিক আদর্শগুলির মধ্যে কোনো পার্থক্য থাকতে পারে না। সন্দ্বীপ এই নীতিকে চ্যালেঞ্জ করে এবং বলে যে, ব্যক্তিগত বিচ্যুতিসমূহ শুধু সমর্থনযোগ্যই নয়, বরং জনস্বার্থে সেগুলির যথার্থতাও আছে। চার অধ্যায়ে রবীন্দ্রনাথ সমস্যাটিকে অন্য এক দৃষ্টিকোণ থেকে তুলে ধরেছেন। আমরা ব্যক্তিক সম্পর্কগুলির ক্ষেত্রে সহিংসতাকে নিন্দা করি, কিন্তু সর্বজনসম্পর্কিত বিষয়গুলির ক্ষেত্রে প্রায়শ সেগুলিকে বিবেচনায় গ্রহণ করি না এবং প্রশংসাও করি। বাহ্যত চার অধ্যায়ে ব্যক্তিগত পর্যায়ে সন্ত্রাসমূলক কার্যাদির মাধ্যমে ভারতের স্বাধীনতা অর্জনের যে প্রয়াস ছিল সেই বিপ্লবী আন্দোলনের বিষয়টিই তুলে ধরা হয়েছে। রবীন্দ্রনাথ সরাসরি বিবৃত না করে বরং এরূপ বিশ্বাসের প্রতি তাঁর অননুমোদনের ইঙ্গিতই দিয়েছেন। তিনি স্পষ্টই দেখিয়েছেন যে, সন্ত্রাস যদি একবার নীতিগত হাতিয়ার হিসেবে গৃহীত হয়, তাহলে এটি শুধু জনস্বার্থ আদায়ের জন্যই ব্যবহৃত হবে না, ব্যক্তিগত প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার জন্যও ব্যবহৃত হবে।

তবে চার অধ্যায়কে সন্ত্রাসবাদের উপর একটি নিবন্ধরূপে বিবেচনা করা অবশ্য ভুল হবে। এর মূল বিষয় হচ্ছে অতীন ও এলার প্রেম। অতীন অনিবার্যভাবে একজন কবি, কিন্তু সে বৈপ্লবিক আন্দোলনের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছে যেহেতু তার সংবেদনশীল চরিত্র বিদ্যমান নিপীড়নের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছে। তার এই সংশ্লিষ্টতার একমাত্র কারণ অবশ্য দেশপ্রেম নয়; এলার প্রতি তার তীব্র অনুরাগ সমভাবে এর কারণ। এতে কোনো সন্দেহ নেই যে, দেশের প্রতি ভালোবাসাই তাকে এই বিপজ্জনক পথের দিকে আকৃষ্ট করেছে। একই রকম সমগুরুত্বপূর্ণ প্রেষণা হচ্ছে এলার চোখে নিজেকে উপযুক্ত প্রতিপন্ন করার অভিপ্রায়। সন্ত্রাসবাদী আন্দোলনের রোমান্টিকতা শীঘ্রই শুকিয়ে যায়। অতীনের প্রকৃতি এর নিষ্ঠুরতা ও হীনতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে। তবে এ থেকে পালিয়ে যাওয়ার কোনো উপায় নেই এবং অতীনকে তার প্রকৃতির ওপর এই আক্রমণ সহ্য করে যেতে হয় যতটা বেশি সে তা করতে পারে। সে এমনকি এলার প্রতি তার ভালোবাসার ক্ষেত্রেও পূর্ণতা পায় না, যেহেতু বিপ্লবীর কোনো ব্যক্তিগত জীবন থাকতে পারে না। উপন্যাসটি শুরু হয় উচ্চ রাজনৈতিক দৃঢ়সংকল্পের ঘোষণা দিয়ে, কিন্তু খুব শিগগিরই আশাবিহীন ভালোবাসা এর প্রধান বিষয়বস্তু হয়ে দাঁড়ায়।

চার অধ্যায়কে কখনও কখনও এলিজাবেথীয় যুগের নাটকের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। এই রচনাটির মধ্যে নিশ্চয়ই একটি পূর্ণাঙ্গ উপন্যাসের উপাদান রয়েছে, কিন্তু রবীন্দ্রনাথ বিষয়বস্তুর এসব সম্ভাবনার সুযোগ ব্যবহার করেননি। এর রচনাশৈলী উপন্যাসধর্মিতার চাইতে বরং অধিকতর নাটকীয় এবং আমরা এতে দৃশ্যাবলির দ্রুত পরিবর্তন দেখতে পাই। চরিত্রগুলির অনুভূতি প্রকাশ পায় তাদের বক্তব্য ও কাজকর্মের মাধ্যমে। বস্তুত পুরো উপন্যাসটিই হচ্ছে একটি প্রলম্বিত সংলাপ। সেখানে রয়েছে অতীন ও এলার দীর্ঘ সংলাপ। অপ্রধান চরিত্রগুলিও কদাচিৎ তাদের কথা বলা বন্ধ করে। এতদ্সত্ত্বেও তারা অস্পষ্ট ও অনির্দিষ্ট থেকে যায়। উপন্যাসটির দুর্বলতাগুলির মধ্যে কয়েকটি হচ্ছে উপন্যাসটি আচ্ছাদিত এর নীতিকবিতাধর্মী গুণ এবং ভাষার দীপ্তি দ্বারা। তা সত্ত্বেও এটি আমাদেরকে এক ধরনের অসম্পূর্ণতা ও অপরিতৃপ্তির অনুভূতির মধ্যে রেখে যায়।

গোরার পর রবীন্দ্রনাথের অধিকাংশ উপন্যাসই বুদ্ধিবৃত্তির আতিশয্য দ্বারা আক্রান্ত। সেগুলি তীক্ষ্ন ও চাতুর্যপূর্ণ এবং ধীশক্তি ও বুদ্ধিদীপ্ততায় পরিব্যাপ্ত। কিন্তু কেন যেন সেগুলিতে মানবিক অনুভূতির উষ্ণতা পাওয়া যায় না। আবহমণ্ডল যেমন পৃথিবীকে ঘিরে রাখে এবং সেখানে জীবনের উপস্থিতি সম্ভব করে তোলে, তেমনি অনুভূতিসমূহও বাস্তবতার কঠিন সত্যগুলিকে মানবিক গ্রহণযোগ্যতার উপযোগী করার প্রয়োজনীয় স্থান প্রদান করে। অনুভূতির এই পরিবেষ্টনকারী আবহও তেমনি রবীন্দ্রনাথের প্রথম দিকের উপন্যাসগুলিকে, সেগুলির অনেক অসম্পূর্ণতা সত্ত্বেও, জীবনীশক্তি ও গভীরতা দিয়েছিল। পরবর্তী উপন্যাসগুলিতে এর উপস্থিতি না থাকায়, রবীন্দ্রনাথের ক্রমবৃদ্ধিশীল অভিজ্ঞতা ও মানব প্রকৃতি সম্পর্কে ব্যাপকতর উপলব্ধি সত্ত্বেও সেগুলি ভঙ্গুর হয়ে পড়েছিল। সেসব উপন্যাসের, অধিকাংশ সম্পর্কে আমাদের মনে হয় যে, সেগুলি মনের ফসল, হৃদয়ের নয়। সম্ভবত গোরা তাঁর একমাত্র উপন্যাস যার মধ্যে রয়েছে অন্তর্দৃষ্টি ও বিন্যাসচিন্তা এবং সেটিতে এমন মানসিক শক্তি ও স্থৈর্য প্রকাশ পায় যা গড়ে উঠেছে বিশ্বসৃষ্টির ক্ষমতা থেকে। শুধু আর একবার, জীবনের শেষপ্রান্তে পৌঁছে ও বিদেশে ব্যাপক ভ্রমণ শেষে, রবীন্দ্রনাথ তাঁর জীবনের পূর্ণ উপলব্ধি প্রকাশ করার উদ্দেশ্যে একটি উপন্যাস রচনার প্রয়াস পেয়েছিলেন। যোগাযোগ শুরু হয়েছিল তিন পুরুষ নামে এবং এর মূল বিষয়বস্তু ছিল মধুসূদন ও কুমুদিনীর মধ্যে ব্যক্তিত্বের মৌলিক সংঘাত। তারা একজন আরেকজনকে আকর্ষণ ও বিকর্ষণ করে, কোনো সামাজিক আদর্শ বা ঐতিহ্যের কারণে নয়, বরং তারা নিজেরা যা সেজন্যই। রবীন্দ্রনাথ সম্ভবত এই উপন্যাসে পাশ্চাত্যের অভিঘাতের ফলে ভারতীয় সামাজিক রীতিনীতি ও বিশ^াসের ক্ষেত্রে যেসব পরিবর্তন ঘটেছিল সেগুলিই চিত্রিত করতে চেয়েছিলেন। তিনি তাঁর দীর্ঘ জীবনে মধ্যযুগীয় ভারতকে ধীরে ধীরে আধুনিক ভারতে রূপান্তরিত হতে দেখেছিলেন। গোরা উপন্যাসে তিনি এই রূপান্তরের একটি অংশের চিত্র তুলে ধরার চেষ্টা করেছিলেন। সম্ভবত তিনি ভেবেছিলেন, তিন প্রজন্মের একটি জরিপে বিগত উত্তাল একশ বছর ধরে ভারতীয় জীবনে যে পরিবর্তন ঘটেছে তার একটি পূর্ণাঙ্গ ও সন্তোষজনক চিত্র তুলে ধরতে পারা যাবে। এটি দুর্ভাগ্যজনক যে, তিনি জীবনশেষের দিকে অনেক বিলম্বে কাজটি শুরু করেছিলেন। প্রথম কয়েকটি অধ্যায় লেখার পর সম্ভবত তিনি উপলব্ধি করতে সক্ষম হন যে, তাঁর উপন্যাসের পরিকল্পনা চমৎকার হলেও তা বাস্তবায়িত করার শারীরিক সামর্থ্য ও সময় তাঁর নেই। প্রথম অংশটিই তখন কেবল লেখা হয়েছে এবং এমনকি তাও করতে পারা গেছে পরিকল্পনার চেয়ে ঊনমাত্রায়। যোগাযোগ উপন্যাসটি এখন আমরা যেভাবে পাই সেখানে দেখা যায়, সামাজিক পরিবর্তনের বড় আন্দোলনগুলির উল্লেখ কদাচিৎ করা হয়েছে। রবীন্দ্রনাথ তাঁর মনোযোগ কেন্দ্রীভূত করেছেন একটি মানবিক সমস্যার উপর, কিন্তু সমস্যাটি উদ্ভূত হতে পারে এমন একটি সমাজে যেখানে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য একটি জোরালো শক্তিতে পরিণত হয়েছে। নারী ও পুরুষের মধ্যেকার সম্পর্কের মৌলিক সমস্যা তীব্র হয়ে ওঠে কেবল তখনই যখন সামাজিক প্রথাগুলি ব্যক্তিক দাবিগুলিকে জায়গা দিতে থাকে। মধুসূদন ও কুমুদিনীর দ্বন্দ্ব কোনো বাইরের কারণে সৃষ্ট বিরোধ নয়, বরং তার উদ্ভব ঘটেছে তাদের স্বভাবের মৌলিক বৈপরীত্য থেকে। মধুসূদন জাগতিক দিক থেকে সফল, অমার্জিত, স্থূল ও প্রভুত্বপরায়ণ। সে কুমুদিনীকে পেতে চায় তাকে ভালোবাসে বলে নয়, পারিবারিক দ্বন্দ্বে বিজয়ের অধিকার হিসেবে। কুমুদিনী সেই আদর্শ চরিত্রগুলির একজন যাকে জীবনের ধুলাবালি ও মালিন্য স্পর্শ করতে পারে না। সে চলাফেরা করে তার স্বপ্নের এক জগতে এবং তার স্বভাবগত সব সৌকুমার্য ও ব্যাকুল ইচ্ছা মধুসূদনের কাছে সমর্পণ করতে ইচ্ছুক। মধুসূদন তাকে বুঝতে পারে না, যেহেতু সে সম্পূর্ণভাবে এক ভিন্ন জগতের মানুষ। এতে সম্ভবত Forsyte Saga-এর Soames ও Irene-এর সঙ্গে একটি অসচেতন সমান্তরালতা রয়েছে, তবে কুমুদিনী আইরিনের চেয়ে অনেক বেশি পরিশীলিত স্বভাবের এবং মধুসূদন Soames-এর চেয়ে স্থূলতর।

গোরার পরে রবীন্দ্রনাথ যেসব উপন্যাস লিখেছিলেন রচনাশৈলী ও ভাষার দিক থেকে সেগুলি প্রায়শই ছিল চমৎকার, কিন্তু মানবিক সহানুভূতির অভাব ছিল সেগুলিতে। সেসব উপন্যাসে অনেক আকর্ষণীয় ও পছন্দনীয় চরিত্র থাকা সত্ত্বেও এটিই হচ্ছে সত্য। যোগাযোগে রবীন্দ্রনাথ তাঁর পূর্বেকার মনমেজাজে ফিরে গিয়েছিলেন এবং সেটিতে আমরা অসাধারণ সহজ ও সুন্দর কিছু দৃশ্য দেখতে পাই। তবে অপাপবিদ্ধতার দিনগুলি অবশ্য ফিরে আসেনি। ব্যতিক্রম কুমুদিনী ছাড়া যোগাযোগের অন্য সকল চরিত্র বিভিন্ন মাত্রার পরিশীলিততা প্রদর্শন করে। উপন্যাসটির শুরু আমাদের শেষের কবিতার ভাষার তুবড়ির কথা মনে করিয়ে দেয়। কিন্তু কুমুদিনীর প্রবেশের পর পুরো আবহটিই বদলে যায়। যোগাযোগ, এর সকল অসম্পূর্ণতা ও ব্যর্থতা সত্ত্বেও, মহৎ একটি উপন্যাসের সম্ভাবনাপূর্ণ কাজের চমৎকার এক অংশ হিসেবে থেকে গিয়েছে।

রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যজীবন বিস্তৃত বাঙলা উপন্যাসের বিবর্তনের সম্পূর্ণ ইতিহাস জুড়ে। বঙ্কিমের ঐতিহাসিক উপন্যাসের দুর্বলতর অনুকৃতি  বৌ-ঠাকুরাণীর হাট দিয়ে এর সূচনা। রবীন্দ্রনাথের উপন্যাস রচনার সমাপ্তি ঘটেছে শেষের কবিতা অথবা দুই বোনে এসে, যেগুলিতে রয়েছে সবচেয়ে বেশি উন্নাসিক আধুনিকতার সৌকুমার্য ও রূঢ়তা। বঙ্কিম ছিলেন প্রকৃতিগতভাবেই একজন ঔপন্যাসিক এবং আখ্যানের সন্ধান তাঁর কাছে আসত সহজভাবে। বস্তুত, বিষয়বস্তু ও ঘটনাবলির প্রাচুর্য প্রায়শ তাঁর কল্পনার দারিদ্র্যকে আড়াল করে রাখত। রবীন্দ্রনাথ ছিলেন অবধারিতভাবে একজন কবি এবং তাঁর নৈপুণ্যের মূল নিহিত ছিল অনুভূতির প্রকাশ চিত্রণের মধ্যে। বৌ-ঠাকুরাণীর হাট এবং এমনকি নৌকাডুবিতেও আখ্যান ও অনুভূতির মধ্যেকার অসংগতি প্রায়শ ধাক্কা দেয়। দুটি উপন্যাসই ঘটনায় পরিপূর্ণ, কিন্তু তুলনামূলকভাবে চরিত্রগুলি কাষ্ঠপুত্তলীবৎ। সাহিত্যজীবনের একেবারে প্রথমদিকেই রবীন্দ্রনাথের প্রতিভা তাঁকে ইঙ্গিত দিয়েছিল একজন ঔপন্যাসিক হিসেবে কোন ধারায় তিনি নৈপুণ্যের সর্বোত্তম প্রকাশ ঘটাতে পারবেন। অনেক দিক থেকে চোখের বালি একটি অপরিণত রচনা, কিন্তু এতে প্রতিভার ছাপ থেকে গেছে। এর জোর সৃষ্টি হয়েছে ঘটনাবলির সংগঠন ও উপস্থাপনে নয়, বরং হৃদয়ের অভ্যন্তরীণ ক্রিয়াকর্মের বর্ণনায়। যে দক্ষতার সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ এতে আবেগের জোয়ার-ভাটার চিত্র এঁকেছেন তা উপন্যাসটির কিছুটা অসন্তোষজনক সমাপ্তির সম্পূর্ণ বিপরীত। অনুভূতিগুলির বিশ্লেষণ ও বর্ণনায় রবীন্দ্রনাথের কবিসত্তা যথার্থভাবে ক্রিয়াশীল, কিন্তু সামাজিক ঐতিহ্যের সঙ্গে কাািহনির সাযুজ্য নির্মাণে তাঁর ঔপন্যাসিক সত্তা তালগোল মিলিয়ে ফেলেছে।

কবিদের মধ্যে প্রায়শ উদ্ভাবনী দক্ষতার অভাব দেখা যায় এবং তাঁরা আখ্যান নিয়ে তেমন বেশি ভাবিতও থাকেন না। শেক্সপিয়ার কদাচিৎ কোনো আখ্যান তৈরি করেছেন এবং অন্যদের তৈরি কাহিনি ধার করেই সন্তুষ্ট ছিলেন। রবীন্দ্রনাথও আখ্যান নির্মাণের ক্ষেত্রে অপটু ছিলেন, তবে তাঁর জীবনের প্রথমদিকের বছরগুলিতে এই উনিশ শতকীয় ধারণায় আক্রান্ত ছিলেন যে, উপন্যাসের জন্য আখ্যান অনাবশ্যক। চোখের বালিতে তিনি প্রথম এই ঐতিহ্য থেকে বেরিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু তাতে পুরোপুরি সফল হননি। আখ্যানের প্রতি আকর্ষণ তবুও তাঁর এত প্রবল ছিল যে, এমনকি চোখের বালি রচনার পরও তিনি নৌকাডুবিতে আবার সেই পুরোনো ঐতিহ্যেই ফিরে গিয়েছিলেন। বস্তুত নৌকাডুবি প্রায় সর্বপ্রকার বিবেচনার দিক থেকেই চোখের বালি থেকে নিকৃষ্ট এবং রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যজীবনে পশ্চাদ্গমনের অল্প কয়েকটি উদাহরণের মধ্যে একটি।

অন্য একটি কারণে রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যজীবনের ইতিহাসে বৌ-ঠাকুরাণীর হাট আমাদের কাছে কৌতূহলের বিষয়। এই উপন্যাসে আমরা প্রথম একটি চরিত্রের নকশা পাই যে চরিত্রটি বারবার রবীন্দ্রনাথের লেখার একটি বিষয়বস্তু হয়েছে, তা সেটি উপন্যাস, নাটক অথবা কবিতা – যাই হোক না কেন। এই চরিত্রটি হচ্ছে একজন বৃদ্ধ মানুষের চরিত্র যিনি পূর্ণজীবন যাপন করেছেন, কিন্তু থেকেছেন নিরাসক্ত। সংগীত ও হাসি প্রকৃতির অংশ। এক অন্তর্নিহিত জ্ঞান তাঁকে সাধারণ মানুষের সঙ্গে তাঁর আত্মীয়তার সম্পর্ক তৈরিতে সাহায্য করেছে। বৌঠাকুরাণীর হাটে বিদ্রোহী চরিত্রের একটি নিজস্ব ধরনও তৈরি করা হয়েছে যে চরিত্রটি পৈতৃক ও রাজার কর্তৃত্বকে চ্যালেঞ্জ জানায় এবং নিজের আদর্শের জন্য প্রাণ দিতেও প্রস্তুত। এভাবে বসন্ত রায় ও উদয় হয়ে ওঠে সেই চরিত্রগুলির প্রথম খসড়া যেসব চরিত্র রবীন্দ্রনাথের লেখায় বারবার ফিরে এসেছে। অবশ্য রবীন্দ্রনাথ শীঘ্রই বুঝতে পেরেছিলেন যে, এ ধরনের চরিত্র উপন্যাসের চাইতে বরং নাটকে উপস্থাপনের পক্ষেই অধিকতর উপযোগী।

গ্রামীণ সমাজকেন্দ্রিক পুরোনো ঐতিহ্যবাহী হিন্দু সমাজ এবং শহরাঞ্চলে ক্রমবর্ধমান নতুন মধ্যবিত্ত শ্রেণির মধ্যেকার দ্বন্দ্ব ঔপন্যাসিকদের জন্য আকর্ষণীয় উপাদান-সম্ভার উপহার দিয়েছিল। রবীন্দ্রনাথের আগে কেউ কল্পনাশক্তি ও দক্ষতার সঙ্গে এই উপাদান-সম্ভার নিয়ে কাজ করেননি। এর পূর্বে ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় ও প্যারীচাঁদ মিত্রের মতো লেখকেরা উঠতি মধ্যবিত্ত শ্রেণির আতিশয্যমূলক আচরণকে ব্যঙ্গ করেছিলেন।

বঙ্কিমচন্দ্রও সংশ্লিষ্টকরণ দ্বারা এই শ্রেণির নিন্দা করেছিলেন। রমেশচন্দ্র দত্ত নিজে এই শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত ছিলেন এবং এদের সংস্কারবাদী প্রবণতাগুলির প্রতি তাঁর বিশেষ সহানুভূতি ছিল। তাঁর দুটি সামাজিক উপন্যাসে তিনি এর পক্ষ অবলম্বন করেছিলেন, কিন্তু সেগুলি সফল শিল্পরূপ গ্রহণের পরিবর্তে সংস্কারবাদমূলক নিবন্ধের রূপ নিয়েছিল। তাঁর সামাজিক উপন্যাসগুলি ব্যর্থ হয় আংশিক এ কারণে যে, চরিত্রগুলি একটি নির্দিষ্ট ধরনের নমুনাচরিত্র হয়ে পড়ে এবং আংশিকভাবে এ জন্যও যে, তিনি দুই সমাজের মধ্যেকার আদর্শের দ্বন্দ্ব দ্বারা সৃষ্ট সমস্যাগুলিকে এড়িয়ে যান। তাঁর উপন্যাসগুলির সমাপ্তি ঘটে বিধবাবিবাহ এবং অসবর্ণ বিবাহের মাধ্যমে, কিন্তু এর ফলে যেসব সমস্যার উদ্ভব হয় সেগুলি সম্পর্কে তাঁর মধ্যে সচেতনতার কোনো ইঙ্গিত সেখানে ছিল না। কোনো বিধবার পুনর্বিবাহের পর কী ঘটে তার জীবনে? সে কী পরিবারে গৃহীত হয় এবং তার সন্তানদের সামাজিক মর্যাদাও বা কী হয়? সে-সময়ে হিন্দু সমাজের জন্য এমনকি আরো বেশি গুরুতর বিষয় ছিল অসবর্ণ বিবাহের সমস্যা। হিন্দু সম্প্রদায়ের একটি অত্যন্ত ক্ষুদ্র অংশের জন্য ব্যতীত এমনকি আজকের দিনেও অসবর্ণ বিবাহ হিন্দু সামাজিক জীবনে একটি সমস্যা। রমেশচন্দ্র দত্ত এসব সমস্যার কোনোটিরই মুখোমুখি হতে চাননি এবং তাঁর উপন্যাসগুলিকে শূন্যে ভাসমান রেখে গেছেন। রবীন্দ্রনাথ এসব সমস্যা নীতিমূলক বিষয় হিসেবে উত্থাপন করেননি, কিন্তু পাশাপাশি দুটি সমাজের অস্তিত্বের ফলে যে জটিল জীবনের উদ্ভব ঘটেছে তা তুলে ধরতে চেয়েছিলেন। এ কারণেই চোখের বালি, নৌকাডুবি ও গোরা বাঙলা উপন্যাসের বিবর্তনের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ নতুন যুগ সৃষ্টিমূলক সাহিত্যকর্ম হয়ে উঠতে পেরেছে।

গোরা বিশ্লেষণ করতে গেলে আমরা বুঝতে পারি, কেন উপন্যাসটিকে সম্ভবত সবচেয়ে কঠিন সাহিত্যরূপ হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। এতে যে শুধু একটি বা একাধিক গল্প আছে তা নয়, বরং লেখকের আলোচনা, বক্তব্য ও চিন্তাভাবনার প্রকাশ, সমাজভাবনা, রাজনীতি, ধর্ম, দর্শন, বিজ্ঞান ও সমসাময়িক ইতিহাসও স্থান পেয়েছে। এটি আধুনিক যুগের এক মহাকাব্য এবং কবিতা ও উপন্যাস, ইতিহাস ও ভূগোল, ধর্ম ও দর্শন সম্পর্কে আমাদের জানার ইচ্ছাকেও নিবৃত্ত করে। কবিতা যদি আমাদের আবেগগুলিকে পরিশীলিত করে, তাহলে উপন্যাস আলো ফেলে জীবনের সমগ্রতার ওপর। ঔপন্যাসিকের অবশ্যই রচনার ধরন সম্পর্কে বিশদ ধারণা থাকতে হবে এবং তিনি তাঁর কাহিনি গড়ে তুলবেন একজন স্থপতির মতো। যুগপৎ তাঁর মধ্যে অবশ্যই জীবনের ভাটা ও প্রবাহ সম্পর্কে অনুভূতি এবং যেসব অনুভূতি মানবসত্তাকে চালিত করে সেগুলির সূক্ষ্ম দ্যোতনাসমূহ প্রকাশ করার শক্তি থাকতে হবে। উপন্যাসের এই জটিল চরিত্রই উপন্যাসের বিচারকে এত কঠিন করে তোলে।

জীবন নিজেই প্রায়শ নির্দিষ্ট কোনো গঠন ধারণ করে না অথবা যেভাবেই হোক না কেন, আমরা কেবল বুদ্ধিবৃত্তি দ্বারা জীবনকে যাচাই করতে পারি না। শিল্প হচ্ছে জীবনের আবেগমূলক অবহিতি, কিন্তু তা চিন্তার ভূমিকাকে অস্বীকার করতে পারে না। জীবনকে বিভিন্ন উপায়ে উপস্থাপনই বিভিন্ন প্রকাশশৈলীর দিকে আমাদের চালিত করে। উপন্যাস যেহেতু জীবনকে এর সমগ্রতার ভিত্তিতে প্রতিফলিত করার চেষ্টা করে, অতএব এটি কোনো বিস্ময়ের ব্যাপার হয় যে, ঔপন্যাসিকরা তাঁদের লক্ষ্য অর্জনের জন্য বহু ভিন্ন ভিন্ন প্রকাশশৈলী ব্যবহারের চেষ্টা করেছেন। সবচেয়ে পুরোনো ও সম্ভবত সবচেয়ে সরল শৈলী হচ্ছে সেটি যেখানে নাায়ক নিজেই তার গল্পটি বলে। সে তার অভিজ্ঞতার কথা বলে এবং স্বাভাবিকভাবেই সেটি তার নিজের দৃষ্টিকোণ থেকে। এটি ঔপন্যাসিকের স্বাধীনতাকে গুরুতরভাবে সীমিত করে দিয়েছিল। সেজন্যই তিনি এমন একটি শৈলীর সন্ধান করেন এবং পেয়েও যান, যেখানে তিনি নিজে কাহিনির বাইরে থাকতে পারেন। এ ধরনের উপন্যাসে ঔপন্যাসিক একজন সর্বত্রবিরাজমান ঈশ্বরের ভূমিকা পালন করেন। তিনি কোনো অংশগ্রহণকারী নন, কিন্তু তিনি সবকিছু পর্যবেক্ষণ করেন এবং নিজের ইচ্ছানুযায়ী সেসব বিষয়ে মন্তব্য করেন। এই রচনাশৈলীই অধিকাংশ ঔপন্যাসিক অনুসরণ করেছেন এবং এখনও অনুসরণ করে যাচ্ছেন। আর একটি তৃতীয় পদ্ধতি রয়েছে যা উপন্যাসের চেয়ে বরং ছোটগল্পের ক্ষেত্রে অধিক সফল যেখানে বর্ণনাকারী একটি অপ্রধান চরিত্র। আবার পরিমার্জনাও একটি কৌশল যে ক্ষেত্রে গল্পটি বর্ণিত হয় বিভিন্ন চরিত্র দ্বারা তাদের নিজেদের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে। এই রীতি ঔপন্যাসিককে ব্যাপকতর স্বাধীনতা দেয়, কিন্তু পুনরাবৃত্তির বিপদ ছাড়াও, যেহেতু একই ঘটনা বর্ণিত হয় ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে, এই কৌশলে কৃত্রিমতার ভাব সৃষ্টির প্রবণতা থেকে যায়।

বঙ্কিম এসব রচনাকৌশলের মধ্যে বেশ কয়েকটি অনুসরণের চেষ্টা করেছেন। এজন্যই ইন্দিরায় নায়িকা নিজেই তার নিজের গল্প বলে, অন্যদিকে রজনীতে বিভিন্ন চরিত্র তাদের নিজ নিজ ভাষ্যই বলে যায়। এরূপ অল্প কয়েকটি ব্যতিক্রমসহ তাঁর উপন্যাসগুলি অবশ্য বর্ণনাধর্মী, যেগুলিতে ঐতিহ্যবাহী ধাঁচই অনুসরণ করা হয়েছে। এখানে ঔপন্যাসিক ঘটনাপ্রবাহের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকেন এবং যা কিছু আকর্ষণীয় পান তার সঙ্গে তাঁর আনন্দকে যুক্ত করেন। জন্মগতভাবে গল্প-বলিয়ে বঙ্কিম ঐতিহ্যবাহী ধরনটিকেই পুরোপুরি সন্তোষজনক মনে করেছিলেন। ঔপন্যাসিক হিসেবে তাঁর পড়ে-ওঠা ছিল উল্লেখযোগ্যভাবে দ্রুত। দুর্গেশনন্দিনীতে কাঠামো ও রচনারীতির অনিশ্চয়তার পর তিনি কপালকুণ্ডলা রচনা করেন রচনাশৈলীর ক্ষেত্রে দক্ষতার পরিচয় দিয়ে। আখ্যানের জটিলতা অব্যাহত থাকে, কিন্তু প্রথম দশকটির পর বিষয়বস্তু বা রচনাকৌশলের ক্ষেত্রে কদাচিৎ কোনো পরীক্ষা-নিরীক্ষা দেখা গেছে। তাঁর উপন্যাসগুলি একেবারে প্রথম দিক থেকেই পরিণত রচনার রূপ পেয়েছে এবং এর পর তাঁর আর কোনো পরিবর্তন ঘটেনি।

বিপরীতে, রবীন্দ্রনাথ ক্রমাগত পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে চলেছিলেন। তিনি তাঁর প্রথম তিনটি বা চারটি উপন্যাসে ঐতিহ্যগত ধরন অনুসরণ করেছিলেন, তবে এর পর তাঁর রচনারীতি ও রচনার কৌশল নিরন্তর পরিবর্তিত হয়েছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে তাঁর উপন্যাস স্থানীয় সমস্যাগুলির প্রতি আরোপ করেছে প্রথম বৈশ্বিক দৃষ্টিভঙ্গি। পরিশীলিত ও শিক্ষিত মনের মানুষ রবীন্দ্রনাথ বহু বাঙালি লেখকের মধ্যে যে স্থূলতা ছিল তার ঊর্ধ্বে উঠতে পেরেছিলেন। এই পরিশীলিত মানসিকতাই তাঁকে বিষয়বস্তু, রচনাশৈলী ও এমনকি ভাষার ক্ষেত্রেও ক্রমাগত পরীক্ষা-নিরীক্ষার দিকে চালিত করেছিল। তাঁর একটি উদ্ভাবন ছিল উপন্যাসের ভিত্তি হিসেবে আখ্যানের পরিবর্তে বিষয়বস্তুর প্রয়োগ। বঙ্কিমের উপন্যাসগুলিতে অবধারিতভাবে আখ্যানই ভিত্তি হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের পর থেকে বাঙলা উপন্যাস অধিক থেকে অধিকতরভাবে ঘটনাবলির পরিবর্তে বরং বিষয়বস্তুর উপরই নির্ভর করেছে।

সমভাবে চমকপ্রদ ভাষা নিয়ে রবীন্দ্রনাথের পরীক্ষা-নিরীক্ষা। তিনি শুরু করেছিলেন বঙ্কিমের ঐতিহ্য নিয়ে, কিন্তু খুব শীঘ্রই তিনি তাঁর নিজের গদ্যের বিশেষ রূপটি খুঁজে পান। এটি এমন নয় যে, তিনি শুধু কথ্যভাষার রূপটিই গ্রহণ করেছিলেন। তাঁর বিপ্লবের মূলকথা হলো, তিনি তাঁর লিখিত রচনায় কথ্যভাষার শব্দের স্বচ্ছন্দ প্রবাহ ও শক্তি যোগ করা। গোরা উপন্যাসটি লেখার আগে পর্যন্ত রবীন্দ্রনাথ তাঁর ব্যক্তিগত চিঠিপত্র ব্যতীত অন্য সব ক্ষেত্রে প্রধানত ঐতিহ্যগত রূপটিই ব্যবহার করেছিলেন। তাঁর চিঠিপত্র ও দিনলিপিতে তিনি আনুষ্ঠানিক গদ্যরূপ পরিহার করেছিলেন। বাক্যরীতির রূপান্তর ও ক্রিয়াপদ ব্যবহারের ক্ষেত্রে উদ্ভাবন-কুশলতার মাধ্যমে তিনি বাংলা গদ্যকে নতুন শক্তি ও ক্রিয়াপদ দিতে পেরেছিলেন। এমনকি যখন তিনি বঙ্কিমকে অনুসরণ করতেন তখনও তাঁর ভাষা ক্রমাগত কথ্যভাষার খুব কাছাকাছি চলে আসত। গোরায়ও বক্তাকে অনুসরণ করে তাঁর ভাষার পরিবর্তন ঘটেছে, কিন্তু ঘরে-বাইরে উপন্যাসেই রবীন্দ্রনাথের গদ্য এর চূড়ান্ত ও চমৎকার বিকাশের রূপ লাভে সক্ষম হয়। ঘরে-বাইরে রচনার অব্যবহিত পূর্বেই তিনি চতুরঙ্গ উপন্যাসটি লিখেছিলেন। চতুরঙ্গের ভাষার রূপটি ঐতিহ্যানুসারী, কিন্তু ইতোমধ্যেই সেটি মুখের ভাষার স্বাদুতা পেয়েছিল। ঘরে-বাইরেতে রবীন্দ্রনাথের ভাষা সম্পূর্ণ স্বাধীন হয়ে ওঠে, কিন্তু স্বাধীনতার প্রথম উচ্ছ্বাসের কারণে নিজস্বতার ফলেই এতে আনন্দের ছোঁয়া ছিল বিরল। আবার গতিশীলতা ও কথ্যরীতির প্রভাবে এতে রবীন্দ্রনাথ তখনও পর্যন্ত যেসব গদ্য রচনা লিখেছিলেন সেগুলির যে-কোনোটির চেয়ে অধিক শিল্পগুণ রয়েছে।

বাঙলা উপন্যাসের বিবর্তনে রবীন্দ্রনাথের অবদানের চেষ্টার মূল্যায়নের মাধ্যমে আমরা এখানে সমাপ্তি টানতে পারি। আমরা ইতোমধ্যেই বলেছি যে, তিনি বাঙলা উপন্যাসের বিকাশক্রমের প্রায় সম্পূর্ণ পরিসর জুড়ে কাজ করে গেছেন। বঙ্কিমের ঐতিহ্যে ঐতিহাসিক কাহিনি দিয়ে শুরু করে তিনি শিগগিরই উপলব্ধি করেন যে, এ যাত্রা শেষ হবে একটি আবদ্ধ প্রান্তে। বঙ্কিম প্রায় ক্ষেত্রেই তাঁর উপন্যাসগুলিতে মর্মবস্তু গঠনকারী ইতিহাস, রোমান্স ও ঘটনার সমাহারের মধ্যে শৈল্পিক ঐক্য সাধনে ব্যর্থ হয়েছেন। সেজন্য রবীন্দ্রনাথ এর জায়গায় অভিজ্ঞতার ঘটনাগুলির সঙ্গে একটি নিকটতর সম্পর্ক গঠনের চেষ্টা করেন। তিনি ঐতিহাসিক প্রণয়কাহিনির বন্ধন থেকে মুক্ত করে উপন্যাসকে বাস্তবতার দৃঢ়তর অর্থবহতার দিকে নিয়ে যাওয়ার সূচনা করেন। ঐতিহাসিক প্রণয়গাথার পরিবর্তে তিনি জীবনের সাধারণ অভিজ্ঞতাগুলির মধ্যে রোমান্স খোঁজার চেষ্টা করেন এবং দেখান যে, আমরা যে জগৎকে জানি সেখানে প্রচুর কবিতা ও জাদুকরী ঘটনা রয়েছে। রোমাঞ্চকর ঘটনা ও নতুনত্ব খোঁজার পরিবর্তে তিনি মানবহৃদয়কে অধিকার করে থাকা সূক্ষ্ম অনুভূতিগুলি বর্ণনা ও বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করেছেন। কবির কল্পনাশক্তি তাঁকে দৈনন্দিন জীবনের ঘটনাবলির মধ্যে রোমান্স আবিষ্কারে সমর্থ করেছে। অভিজ্ঞতাকে পুঁজি করে রবীন্দ্রনাথ বাঙলা উপন্যাসে বাস্তবতার একটি নতুন পর্যবেক্ষণের সূত্রপাত করেছেন।

রবীন্দ্রনাথের কাছে বাঙলা উপন্যাসের ঋণের বিষয়টি স্বীকার করে নেওয়ার পাশাপাশি আমাদের তাঁর এই শিল্পকর্মের একটি বড় সীমাবদ্ধতার কথাও উল্লেখ করতে হবে। তাঁর প্রায় সব উপন্যাসই শুধু বিত্তবান শ্রেণিগুলিকে নিয়ে। বিশালসংখ্যক গরিব মানুষদের জীবন তাঁর এই কাজে কোথাও প্রতিফলিত হয়নি। তবে এমন নয় যে, তিনি দুঃখ-দারিদ্র্য ও অভাব সম্পর্কে অবহিত ছিলেন না। তাঁর কয়েকটি ছোটগল্প ও কবিতায় আমরা কৃষক ও নিম্নতর মধ্যবিত্ত শ্রেণিসমূহের জীবনের উজ্জ্বল চিত্রণ দেখতে পাই। তবে তাঁর উপন্যাসগুলিতে কদাচিৎ দারিদ্র্যের চিত্র খুঁজে পাওয়া যায়। এর কারণ সম্ভবত তাঁর নিজেরই এ স্বীকৃতি যে, তিনি গরিব মানুষদের নিয়ে ছোটগল্প বা কবিতা লিখতে পেরেছেন, কিন্তু তাদের জীবন সম্পর্কে তাঁর অভিজ্ঞতা একটি পূর্ণাঙ্গ উপন্যাস লেখার জন্য পর্যাপ্ত ছিল না। বাঙলার জনবহুল গ্রামগুলির কলহদ্বন্দ্বপূর্ণ পারিবারিক জীবন তাঁর রচিত উপন্যাসগুলির চৌহদ্দির বাইরে থেকে গেছে। তাঁর কাজগুলি থেকে আমরা কখনও জানতে পারব না সেই অভাব ও দারিদ্র্যের কথা, যা চরিত্রের অবনয়ন ঘটায় এবং ব্যক্তিত্বের বিকৃতিসাধন করে। তাঁর প্রথমদিককার উপন্যাসগুলিতে অব্যবহিত বাস্তবতার সঙ্গে সম্পর্ক বেশি ছিল, কিন্তু গোরার পর থেকে সংস্কৃতিবান নারী ও পুরুষেরাই তাঁর উপন্যাসে ভিড় জমিয়েছে। সেগুলিতে পার্থিব বিষয়াদি নিয়ে দ্বন্দ্বের উল্লেখ রয়েছে। কিন্তু যে শোচনীয়তা আমাদের সামাজিক জীবনের বৈশিষ্ট্য নির্দেশ করে সেগুলিকে তার বাইরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। সংঘর্ষগুলি প্রধানত চিন্তাভাবনা ও আবেগের পর্যায়েই রয়ে গেছে। এমনকি যখন ক্রোধের অনুভূতি তীব্র হয়ে ওঠে তখনও পরিমার্জনার একটি আবহ তার তীব্রতাকে কমিয়ে নিয়ে আসে। তাঁর
নায়ক-নায়িকাদের আমরা কখনও আমাদের প্রাত্যহিক জীবনের প্রতিবেশী ভাবতে পারি না।

রবীন্দ্রনাথ ছিলেন বাঙলা উপন্যাসে বাস্তবতার অগ্রদূত; তবু রোমান্টিক আদর্শবাদের একটি উপাদান তাঁর পরবর্তী উপন্যাসগুলিকে রঞ্জিত করে রেখেছে। তিনি বাঙলা উপন্যাসকে নিয়ে গেছেন প্রাত্যহিকতার জগতে, যেখানে রয়েছে ভালোবাসা ও ঘৃণা, ক্লান্তি ও দ্বন্দ্ব, কষ্ট ও বেদনা; কিন্তু সেগুলিকে নিজেদের কাজের নির্মাণের মধ্যে বয়নের দায়িত্ব পড়েছিল তাঁর উত্তরসূরিদের ওপর। মুসা নবীর মতো রবীন্দ্রনাথও বাস্তবতার সম্ভাবনাময় অঞ্চলটির প্রতি অঙ্গুলিনির্দেশ করেছিলেন, কিন্তু তিনি নিজে সেখানে যেতে পারেননি।