বিদ্যাবতী ও ভ্রামণিক নবনীতা দেবসেন

২০০৭ সালে কলকাতার ধ্রুবপদ সাহিত্য পত্রিকা ‘অন্যরকম বাঙালি’ নামে ৪৩৬ পৃষ্ঠার একটি বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ করেছিল। সাহিত্য-শিল্প ও সামাজিক আন্দোলনে ষোলোজন অন্যরকম বাঙালির জীবন ও কর্ম নিয়ে ছিল এই সংকলন। সম্পাদকের ভাষায়, ‘অন্যরকম বলতে গড়পড়তা জীবন নয় যাঁদের, বেশ ব্যতিক্রমী ও উদাহরণীয়, তবে সঙ্গে সঙ্গে হয়তো অননুসরণীয় বটে, তাঁদের জীবনকথা এবারের উপজীব্য।’ সংখ্যাটি নানা দিক থেকে খুবই মনোগ্রাহী হয়েছে। সম্পাদনা করেছিলেন সুধীর চক্রবর্তী। পরিকল্পনাপ্রসূত এই সংখ্যাটি নানা দিক থেকে তাৎপর্যময় হয়ে উঠেছিল।
ধ্রুবপদের এই সংখ্যায় নবনীতা দেবসেনকে নিয়ে একটি দীর্ঘ প্রবন্ধ পত্রস্থ হয়েছিল। প্রবন্ধটির নাম ‘গেছো মেয়ে বিদ্যাবতী’। শৈশব থেকেই তাঁর বৃক্ষপ্রেম ধমনিতে উজ্জ্বল; এ সঞ্চারিত হয়েছিল দেহ ও মনে। দীর্ঘদিন তিনি তা লালন করেছিলেন। চল্লিশের দশকে কৈশোরকালে তিনি বৃক্ষের সাহায্যে এ-বাড়ি ও-বাড়ি যেতেন।
সে-সময়ে একবার তিনি খেজুরগাছে আরোহণ করে রক্তাক্ত হয়েছিলেন। তাঁদের বাড়ির দীর্ঘদিনের গৃহসহায়ক গুনিয়াভাই তাঁকে সেজন্য তিরস্কার করেছিলেন। এসব খুবই তুচ্ছ বিষয়। তবু আমাকে বিষয়টি খুবই বিস্মিত করেছিল। হিন্দুস্থান পার্কের কোন গৃহের কোন গাছ কী রকম, কোন ফল কোন ঋতুতে ফলবান হয়ে ওঠে, পুষ্পের সৌরভ কোন বাড়ির বাগান থেকে এদিক-ওদিক যায়-আসে এবং বৃক্ষসমূহে পাখির বসবাস এবং তাদের কূজন ও যাতায়াত Ñ এ তাঁর নখদর্পণে ছিল। অবাধ যাতায়াতের সূত্রে তিনি হিন্দুস্থান পার্কের বেশ কয়েকটি বাড়ির অন্দরমহলের কন্যা হয়ে উঠেছিলেন। বৃক্ষে আরোহণ করা, বৃক্ষের পাখি পর্যবেক্ষণ তাঁর নিয়মিত জীবনের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে গিয়েছিল। সেই সময় থেকেই তিনি উচ্ছল, প্রাণশক্তিতে ভরপুর, সজীব ও প্রাণবন্ত। হিন্দুস্থান পার্ক সড়কের প্রতিটি বাড়িতেই সেকালে বৃক্ষ ছিল। বর্তমানে প্রমোটারের থাবায় হিন্দুস্থান পার্ক সে-আভিজাত্য ও কুলীন চরিত্র হারিয়েছে। বহুতল ভবনের দৌরাত্ম্যে সেই বাগানঘেরা আবাসিক ও পরিচ্ছন্ন চরিত্রের বাড়িগুলো আর নেই। অভিজাত এই এলাকায় এখন অনেক দোকানপাট ও শপিংমল হয়েছে। সুনীতি চট্টোপাধ্যায়ের হিন্দুস্থান পার্কের সুর্ধমা বাড়িটিতে এখন ফেব ইন্ডিয়ার দোকান। এই বাড়িটি ঐতিহ্যম-িত। দেশি-বিদেশি বহু খ্যাতনামা প-িত মানুষ, বিদ্যার্থী ও বিদ্যাচর্চার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অধ্যাপকদের পদচারণে একদা মুখর ছিল এ-বাড়ি।
নবনীতার ভাল-বাসা বাড়ির তিনদিকে বারান্দা। এখনো সেই বাড়ি ও বারান্দা তেমনি আছে। এই বারান্দা থেকে এ-বাড়ি ও-বাড়ির উঠোন ও রাস্তার মানুষের চলাচল দেখা যেত। নবনীতা শৈশব থেকে বার্ধক্য পর্যন্ত কত না দৃশ্য দেখেছেন এই বারান্দা থেকে। চেনা মানুষের পদচারণসহ বহু দৃশ্য তাঁর চোখে ধরা পড়ত। এ নিয়ে কৌতুকে উজ্জ্বল বর্ণনা আছে নবনীতার নোট বই ও ভাল-বাসার বারান্দা গ্রন্থে। তাঁদের বাড়ির কাছেই ছিল শিল্পী সুনীল মাধব সেন ও কবি যতীন্দ্রমোহন বাগচীর ইলাবাস নামের বাড়ি। এই কবির একটি কবিতা এখনো বহু মানুষের হৃদয়ে অমøান হয়ে আছে। এখনো বহু কিশোর-কিশোরীর চোখ সজল হয়ে ওঠে তাঁর সেই কবিতা পাঠ করলে। আর সামনের বাড়িটি পশ্চিমবঙ্গের প্রয়াত মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুর। এখন অবশ্য এই বাড়ি ৫২/বি হিন্দুস্থান পার্ক রেস্ট হাউস। এই বাড়ি এবং জ্যোতি বসুর ক্রমউত্তরণ; পার্টিতে সমীহ-জাগানিয়া দায়িত্বশীল নেতা হয়ে ওঠা; সিপিআই(এম) পার্টির অভ্যন্তরে জ্যোতি বসুর একচ্ছত্র আধিপত্য অর্জন ও মুখ্যমন্ত্রীর পদ গ্রহণ নবনীতার চোখের সামনেই ঘটেছে। জ্যোতি বসুর স্ত্রী, পুত্র ও পুত্রবধূর সঙ্গে শ্রদ্ধামিশ্রিত পারিবারিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে নবনীতার। জ্যোতি বসুর বাড়ির সম্মুখে প্রতিবাদী মিছিলও দেখেছেন বারান্দায় দাঁড়িয়ে। এমনকি বাঁশি বাজিয়ে পুলিশি প্রযতেœ মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুর আপিস থেকে বাড়িতে আগমন ও আপিসে যাওয়াও প্রত্যক্ষ করেছেন। যদিও মুখ্যমন্ত্রী পদে অধিষ্ঠিত হওয়ার কিছুদিন বাদে তিনি সল্টলেকে সরকারি আবাসনে চলে যান। জ্যোতি বসু, তাঁর পরিবার-পরিজন ও বাড়ির অন্দরমহল নিয়ে নবনীতা-রচিত স্বজনসকাশে গ্রন্থে সরস বর্ণনা আছে।
নবনীতা দেবসেনের ব্যক্তিস্বরূপ, সৃজন-উৎকর্ষ, জীবনসংগ্রাম, বৃক্ষপ্রেম, ভ্রমণ, অপরাজেয় নারীত্ব নিয়ে ধ্রুবপদে লেখাটি লিখেছিলেন অঞ্জলি দাশ। এই লেখাটি প্রকাশের তেরো বছর পরও এ আমার হৃদয়ে অমোচনীয় হয়ে আছে। প্রাণপ্রাচুর্যে ভরপুর সদাহাস্যময়ী নবনীতার পথচলা এবং গবেষণা ও অধ্যাপনাজীবন যে খুব সহজ ও মসৃণ ছিল না, এ-লেখাটি পাঠ করে আমরা তা বুঝতে পারি। সংগ্রামী এক নারীর অবয়ব ঝলমল করে ওঠে। এ প্রসঙ্গে ধ্রুবপদে প্রকাশিত ওই লেখাটির বিবরণ আমার কাছে খুবই আগ্রহসঞ্চারী হয়ে উঠেছিল। মানুষ এবং সাহসী এক বাঙালি নারী অনমনীয় দৃঢ়তায় ভিন্ন ধরনের সংগ্রামে জীবনকে করে তুলেছিলেন যেভাবে অর্থময় তা নিয়ত আমাকে বিস্মিত করে। তাঁর চারিত্রিক দৃঢ়তা ও গ্লানিমুক্ত জীবনযাপনের বৈশিষ্ট্য সকল কিছুর ঊর্র্ধ্বে ছিল। বেঁচে থাকার আর্তি এবং এক মানবিক চেতনা ধারণ তাঁর জীবনসংগ্রামকেও উজ্জ্বল করে তোলে। নোবেলজয়ী খ্যাতনামা অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেনের সঙ্গে মাত্র কয়েক বছরের দাম্পত্যজীবনের পর তাঁর যখন বিবাহবিচ্ছেদ হলো লন্ডনে, তখন স্বাভাবিকভাবে বেদনা ও কষ্ট পেয়েছিলেন তিনি। সে-কষ্টের এবং হৃদয়যন্ত্রণার কথা এমন নিরাসক্ত ভঙ্গিতে তিনি বলেছেন, যাতে শুধু তাঁর পক্ষেই এই বিচ্ছিন্নতা গ্রহণ করা সম্ভব হয়েছিল। কেননা সর্বদা নবনীতা বিশ্বাস করতেন বাস্তবতায়। কোনো তিক্ততা ছিল না মন্তব্যে। এ নিয়ে কোনো কালিমালেপনও করেননি। কোনো ক্ষোভ বা অভিযোগ ছিল না। তিনি এক সাক্ষাৎকারে বলেন : ‘অমর্ত্য সেন আরেকজনের প্রেমে পড়েছিলেন। নতুন করে জীবন গড়তে চেয়েছিলেন। এমন তো ঘটেই থাকে জীবনে। এ তো নতুন কিছু নয়, কতই ঘটছে চতুর্দিকে। ওঁর জায়গায় আমিও থাকতে পারতুম।’
এরকম নিরাসক্ত ও নির্মোহ মন্তব্য ও ঔদার্যের প্রকাশ তাঁর পক্ষেই সম্ভব ছিল। কেননা জীবনের সকল সংকট, সকল আনন্দ-বেদনাকে তিনি যে প্রসারিত চেতনায় অনুধাবন করেছিলেন তার কোনো তুলনা নেই।
অমর্ত্য সেন যখন নোবেল পুরস্কার পেলেন, অসাধারণ একটি লেখা লিখেছিলেন তিনি অমর্ত্য সেনের অর্থনীতিবিষয়ক গবেষণা ও সাফল্য নিয়ে। অমর্ত্য সেনের উত্তরণ ও সিদ্ধির কথা ছিল। লেখাটি পত্রস্থ হয়েছিল পরের সপ্তাহে দেশ পত্রিকায়। সম্পাদক মশাইয়ের অনুরোধে তিনি এ-লেখাটি লিখেছিলেন। তিনি অভিনন্দিত করেন তাঁকে। লিখেছিলেন হৃদয় দিয়ে; যদিও আবেগ ছিল এবং তাতে অতীত বন্ধুত্বের সঙ্গে বর্তমানের অনুষঙ্গে এ-লেখাটি শ্রদ্ধামিশ্রিত বন্ধুত্বের উদাহরণ হয়ে উঠেছিল। অমর্ত্য সেনের সঙ্গে কত না স্মৃতি ছিল তাঁর। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে প্রতিভাবান একুশ বছরের যুবক অমর্ত্য সেনকে দেখেছিলেন তিনি; সেই প্রথম দেখা এবং কিছুদিন পরে অমর্ত্য সেন যাদবপুর ছেড়ে বৃহত্তর অর্থনীতির জগতে চলে যাবেন বলে যে-সংবর্ধনা অনুষ্ঠান হয়েছিল যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে তারও বর্ণনা দেন নবনীতা। তাঁর মনোগহনে যে-বেদনার ছায়া ফেলেছিল তা পাঠকের হৃদয়ও ছুঁয়ে গিয়েছিল। ভিন্ন এক আবেগে স্মৃতির পথে হাঁটতে হাঁটতে সেগুলো গ্রথিত করেছিলেন এ-লেখায়। শেষ করেছিলেন এভাবে Ñ ‘দিল্লি, তেসরা নভেম্বর, ১৯৯৮, ভোর পাঁচটা। সারারাত্রি জেগে লেখাটি লিখে ফেললুম, যা মনে এলো, তাই। আজ নোবেল লরিয়েট অমর্ত্যর জন্মদিন। দুর্জয় সাফল্য ব্যক্তিমানুষটাকে ক্রমশ গিলে ফেলতে থাকে। এ-ই জগতের নিয়ম। বাহিরে ভিড় করে এসে ভিতরটাকে একা করে দেয়। তাই প্রার্থনা করছি, এমা যেটাকে বলেন ‘Amartya’s great big laugh- সেটি শত সাফল্যেও চিরঅমøান থাকুক। আর অমর্ত্যকে জন্মদিনে বলি – ‘Treat this article as flowers|’সারাজীবন নানা লেখায় অমর্ত্য সেনের সঙ্গে তাঁর বন্ধুতার, সৌহার্দ্যরে কথা বারংবার উচ্চারণ করেছেন তিনি। স্মৃতিচারণায় এসব মন্তব্যে আমরা নবনীতার মহৎ হৃদয়বত্তা এবং বাস্তবকে গ্রহণ করার উচ্চ মন প্রত্যক্ষ করেছি। এ গুণাবলি সহসা খুঁজেও পাওয়া যায় না। কল্যাণ মিত্রের সম্পাদনায় প্রকাশিত আলাপ গ্রন্থে একটি দু-লাইনের মন্তব্য করেছিলেন তিনি তাঁদের বিবাহবিচ্ছেদ নিয়ে, যা আমরা উদ্ধৃত করেছি। এছাড়া সে-সময়ের কথা আছে ধ্রুবপদে অঞ্জলি দাশ-রচিত প্রবন্ধে। সেই সময়ে লন্ডনে, দুটি ছোট শিশুকে নিয়ে নতুন এক জীবনসংগ্রাম শুরু করেছিলেন। এ-বিবরণ পাঠ করলে হৃদয় দীর্ণ হয়। সঙ্গে পাই তাঁর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যকে। ‘গেছো মেয়ে বিদ্যাবতী’ থেকে উদ্ধৃতি দিচ্ছি সেই সময়ের কষ্টকে উপলব্ধির জন্য। এই বিবরণ পাঠ করলে আমরা তাঁর ব্যক্তিস্বরূপকে চিনে নিতে পারি। অঞ্জলি দাশ বলেছেন, ‘বিদেশে সংসার সন্তান ভালোবাসা নিয়ে পূর্ণ তাঁর সুখের বৃত্তটি একদিন দমকা হাওয়ায় ভেঙে গেল। থমকে গেলেন, কিন্তু ভেঙে পড়লেন না। দাম্পত্য সম্পর্ক ছিন্ন হওয়ার ক্ষেত্রে সচরাচর দেখা যায় অনেক তিক্ততা, অনেক কাটাকুটি, রক্তপাত-কাদা ছোড়াছুড়ির মধ্য দিয়ে সম্পর্কটা ভাঙে। নবনীতার ক্ষেত্রে যেটা মনে হয়, তা হলো সমাপন। একটি সম্পর্কের সমাপ্তি। যে-জীবন থেকে দাম্পত্য সম্পর্কটা চুরি হয়ে গেছে। যতেœ-ভালোবাসায় গড়ে তোলা একটি মৃৎভাস্কর্য অনবধানে হাত থেকে পড়ে, কিন্তু সেই ভাঙা টুকরো আঁকড়ে তিনি লুটিয়ে পড়েননি, এক পাশে সরিয়ে দিয়েছেন শুধু। কোথাও তো ক্ষতচিহ্ন থাকেই, থাকে অশ্রুর দাগও। তাকে সময়ের হাতে ছেড়ে দিয়েছেন। বরং ‘শ্বশুরবাড়ি’, এসব শ্রীছাঁদের সঙ্গে বরণডালায় সাজানো, সিঁদুর মাখানো, লক্ষ্মীর ঝাঁপিতে তোলা শব্দগুলি, ধমনির স্রোতের সঙ্গে যা এক হয়ে গিয়েছিল কখন আবার ডিভোর্স শব্দের প্রবল প্রতাপে তারা খরচ হয়ে গেল।’
নবনীতা এক সাক্ষাৎকারে সেই সময়ের কথা এভাবে বলেন, ‘ওই রকম ভয়ংকর খুনখারাবি রঙের নাঙ্গা তলোয়ারের মতো শব্দ ‘ডিভোর্স’ যে কোনোদিন এই আমারই হাতবাক্সতে এসে ঢুকবে, এ কেউ ভেবেছিল?’
দুই শিশুকন্যাসহ তখন ইংল্যান্ডে তিনি একা এই পাঁচিল ডিঙানোর চেষ্টা করে গেছেন অনেকদিন। চাকরির জন্য ক্রমাগত চেষ্টা চালিয়ে গেছেন কলেজে-স্কুলে, এমনকি টাইপিস্টের চাকরির জন্যও নিজের এবং কন্যাদের দায় নিজে বহন করার তাগিদে। ইংল্যান্ডে তাঁর ড্রাইভিং লাইসেন্স ছিল। পরিচিত রুটে – হিথরো এয়ারপোর্টের রাস্তাটা ভালো চিনতেন বলে শুধু ওই রুটে Mini Cab চালিয়ে উপার্জন করেছেন। দিনে মেয়েদের দেখাশোনা, তাদের স্কুলে পাঠানো ছিল, তাই রাতে যেতেন ড্রাইভিংয়ে। Poetry Circle-এ এক ভেটেরিনারি ডাক্তার দম্পতির সঙ্গে পরিচয় ও বন্ধুত্ব হয়েছিল। তাঁরা রাতে এসে মেয়েদের কাছে থাকতেন, নবনীতা যেদিন ড্রাইভিংয়ে যেতেন। আত্মীয়পরিজন থেকে দূরে, বিদেশে, ঝোড়ো হাওয়ার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে তাঁর এই লড়াই করার শক্তি দেখে বিস্ময় তো লাগেই Ñ বোঝা যায় তাঁর মনের জোর, যা সত্যিই একজন বাঙালি মেয়ের পক্ষে কল্পনা করা আমাদের জন্যও বেশ গর্বের।
ভগ্নহৃদয়ে দেশে ফিরলেন, কিন্তু জীবন সম্পর্কে হতাশ হননি; বরং কলকাতায় ফিরে এক প্রত্যয় নিয়ে নতুন জীবন শুরু করেছিলেন। দৃঢ়তা ও প্রত্যয় তাঁর জীবনকে পরিণত করেছিল। অমিয় দেব তখন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভাগীয় প্রধান, নবনীতাকে ডেকে নিলেন যাদবপুরের তুলনামূলক সাহিত্য বিভাগে; শিক্ষক হিসেবে। বন্ধু ও সহপাঠী অমিয় দেব ঠিকই উপলব্ধি করেছিলেন তাঁর বিদ্যানুরাগ এবং তুলনামূলক সাহিত্যে তাঁর প্রগাঢ় প্রীতির প্রসঙ্গ। সেই থেকে অধ্যয়ন ও অধ্যাপনা তাঁর মননধর্মের সঙ্গে একাত্ম হয়ে পড়েছিল। বিভাগে যোগদানের পর অবসরগ্রহণের সময় অবধি বহু বিদ্যার্থীকে তুলনামূলক সাহিত্য সম্পর্কে দীক্ষিত করেছেন। পড়িয়েছেন বাংলা সাহিত্য ও বিদেশের ক্লাসিক এবং সমকালীন সাহিত্য। পরবর্তীকালে স্মৃতিচারণা করেছেন অনেকে। ছাত্র ও শিক্ষার্থীদের তিনি কীভাবে বন্ধুজ্ঞানে আপন করে নিতেন এবং তাঁর সরব উপস্থিতিতে বিভাগটি কীভাবে প্রাণবন্ত হয়ে উঠত সে-বর্ণনা দিয়েছেন তাঁর এক ছাত্রী। ইলিয়ড পড়েছিলেন তিনি তাঁর কাছে। ইলিয়ড পড়াতে গিয়ে তিনি গ্রিক সাহিত্যের মানবিকতা, ঐতিহ্যপ্রীতি, মহাকাব্যের গুণাবলি, সমাজ ও রাষ্ট্রের ইতিহাস যে অত্যাবশ্যক সে-সম্পর্কে বিস্তারিত বলেছেন। এক বিদ্যার্থী বলেছেন, ‘আমাদের শিক্ষক নবনীতাও আমাদের কাছে তখন খুবই গুরুত্ববহ হয়ে ওঠেন।’
নবনীতা দেবসেনের প্রসঙ্গে কথা উঠলেই আমাদের মনে পড়ে, অবিশ্বাস্য মনের জোর আর সদাহাস্যময় একটি মুখ এবং প্রখর ব্যক্তিত্বের অধিকারী নারীর অবয়ব, যিনি পরাজিত হননি ভাগ্যের নির্মমতায়। এছাড়া তাঁর বহুধারার সৃজনও অধিক প্রবাহিণী হয়ে দ্যুতিময় হয়ে এক আবহ তৈরি করে।
তাঁর ধমনিতে ছিল পঠন-পাঠনের ব্যাপ্তি এবং কৈশোরকালে প্রবলভাবে বিশ্বসাহিত্যে ভ্রমণের আগ্রহ Ñ এই বোধই তাঁকে জ্ঞানচর্চায় আরো অধীর করে তোলে। বারো বছর বয়সে বাবা নরেন্দ্র দেবের সঙ্গে জাহাজে বিলেত ভ্রমণ করেন। পরবর্তীকালে লেডি ব্রেবোর্নে একটি পর্যায়ে পাঠ গ্রহণ ও সুকুমারী ভট্টাচার্যের কাছে শিক্ষাগ্রহণ তাঁর বোধে নবীনধারা সঞ্চার করেছিল। এখানেই সংস্কৃতের অধ্যাপক হিসেবে পান সুকুমারী ভট্টাচার্যকে; যে-সুকুমারী বিদ্যাজগতে খুব অল্প সময়েই প্রতিষ্ঠা অর্জন করেন এবং মেধাবী, পঠন-পাঠন ও জিজ্ঞাসার ব্যাপ্তি নিয়ে তখনই খ্যাতিনাম হয়ে ওঠেন। এই সুকুমারী ভট্টাচার্যের সৃজন-উৎকর্ষ, ব্যক্তিত্ব নিয়ে তিনি তাঁর রচিত একটি প্রবন্ধে অসামান্য চিত্র অঙ্কন করেছেন।
এই প্রবন্ধে তিনি খেদও প্রকাশ করেছেন সুকুমারী ভট্টাচার্য খ্রিষ্টান হওয়ায় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়-প্রবর্তিত ঈশান স্কলারশিপ পাননি বলে। তিনি সুকুমারী ভট্টাচার্য সম্পর্কে এক প্রবন্ধে বলেন, ‘কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিএর ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে সর্বোচ্চ নম্বর পাওয়া সত্ত্বেও আপনার প্রাপ্য ঈশান স্কলারশিপ থেকে আপনি বঞ্চিত হয়েছিলেন। সে-কলঙ্কের কাহিনী আমাদের সময়ে কারোর অজানা ছিল না। ঈশানচন্দ্র বসুর তৈরি করা স্কলারশিপের যোগ্যতার নিরিখে বাধা ছিল ‘বর্ণহিন্দু’ হওয়া চাই। বিধর্মী বলে হিন্দু সংস্কৃত কলেজে চাকরিও দেওয়া হয়নি আপনাকে।’
কিছুদিন পরে প্রেসিডেন্সি কলেজে উচ্চতর শিক্ষাগ্রহণের জন্য যখন ভর্তি হন, তখন তাঁর মানসচৈতন্যে প্রেসিডেন্সি কলেজের বিভিন্ন বিভাগের ডাকসাইটে সব অধ্যাপক যে-জিজ্ঞাসার তরঙ্গ তুলেছিলেন বিদ্যাচর্চায়, তা কোনোদিন মøান হয়নি। প্রেসিডেন্সি পেয়েছিল তারক সেন, অমল ভট্টাচার্য, সুবোধ চন্দ্র সেনগুপ্ত, জনার্দন চক্রবর্তী, শশীভূষণ দাশগুপ্ত, সুশোভন সরকার ও মাসুদ সাহেবকে। যদিও তাঁরা অনেকেই নবনীতার বিভাগের শিক্ষক ছিলেন না তবু তাঁদের বিদ্যাবত্তা তাঁকে স্পর্শ করেছিল। নবনীতার ভাষায়, আরো কত মহৎ মানুষ ছিল সময়ে Ñ ‘সেই পঞ্চাশের দশকের প্রেসিডেন্সি কলেজ, যেদিকে তাকাই জ্যোতিষ্কম-লীর দ্বারা পরিবৃত তখন আমরা। এত নির্বোধ ছিলুম, কিছুই যথাযথ মর্যাদা দিয়ে গ্রহণ করতে পারিনি। কত ভাগ্য করে এসেছি, কাদের সামনে বসে আছি, কারা সামনে দিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন, তা বুঝতে বুঝতে দিন পার হয়ে গেল। সেই আগ্রহ যেন আরো পরিণত হলো পরবর্তীকালে।’
তিনি এই প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকেই স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএ পাশ করেন এবং প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হন। হার্ভার্ডে ডিস্টিংকশন নিয়ে এমএ এবং ইন্ডিয়ানা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচ.ডি ডিগ্রি অর্জন করেন। এই হচ্ছে তাঁর বিদ্যাক্ষেত্রে প্রাথমিক পরিচয়। পরবর্তীকালে পৃথিবীর বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সম্মানসূচক ডিগ্রি ও শ্রদ্ধা পেয়েছেন। একই সঙ্গে পড়িয়েছেন পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে। আমার কাছে তাঁর সৃজনের ধারাবাহিকতা এবং তুলনামূলক সাহিত্যে অব্যাহত ধারায় জ্ঞানার্জন এবং তাঁর রচিত প্রবন্ধগুচ্ছ দেখে কেবলই মনে হয়, এই মানুষটি তুলনামূলক সাহিত্য পাঠ ও পরিগ্রহণে যে-বোধ সঞ্চার করেছিলেন তা হয়ে উঠেছিল বাংলা ভাষায় নবদিগন্তের উন্মোচন। জীবনের একপর্যায়ে রামায়ণ নিয়েও তাঁর ব্যতিক্রমী ভাবনা এবং যুগ-যুগবাহিত রামায়ণ পরম্পরা নিয়ে গবেষণা আরেক তৃপ্তিকর অভিজ্ঞতা হয়ে ওঠে। ভিন্ন দৃষ্টিতে রামের পর্যবেক্ষণ ও সীতার প্রতি তাঁর সহমর্মিতা, সমাজে সীতার অবস্থান যে প্রসারিত চেতনা নিয়ে বিশ্লেষণ করেছেন রামায়ণ গবেষণায় Ñ তা মাইলফলক হয়ে আছে। চন্দ্রাবতী-রচিত রামায়ণকে তিনি বিশ্লেষণ করেন আরেক চেতনায়। চন্দ্রাবতীর রামায়ণ নিয়ে তিনি গহন ও গভীরভাবে ভেবেছেন। এ-রামায়ণ তাঁর গবেষণার বিষয় হয়ে উঠেছিল।
রাম নয়, সীতাই তাঁর হৃদয় ও মনকে গভীরতা নিয়ে স্পর্শ করেছিল। ভারতবর্ষের পুরুষমানসে রাম আজ যেভাবে অধিষ্ঠিত, সেক্ষেত্রে সীতাদের প্রসঙ্গ যেভাবে এড়িয়ে যাওয়া হয় তা তিনি উপলব্ধি করেছিলেন।
তিনি চন্দ্র-মল্লিকা এবং প্রাসঙ্গিক প্রবন্ধ গ্রন্থে আদিকাল থেকে ভারতবর্ষে মেয়েদের হৃদয়ের গভীরে যে সীতার অবস্থান তা বিশ্লেষণ করেছেন। ভারতবর্ষের এক এক রাজ্যে সীতাও ভিন্ন ভিন্ন রূপ নিয়ে উন্মোচন হয়। রাম নয়, পৌরুষের আস্ফালন ও আধিপত্যের মধ্যেও সীতার মনোবেদনা এবং অগ্নিপরীক্ষা ভিন্ন আদল, অধিকার নিয়ে পরিস্ফুট হয় তাঁর এসব প্রবন্ধে।
নানা অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে, আলাপচারিতায় নবনীতা দেবসেনের সঙ্গে সখ্য হয়েছিল আন্তর্জাতিক অঙ্গনের খ্যাতনামা অনেক লেখকের। জাক দেরিদা, নাদিন গর্ডিমার, নীরদ সি চৌধুরী ও পাকিস্তানি লেখিকা জাহিদা হিনার সঙ্গে নৈকট্যের প্রসঙ্গ তিনি লিখেছেন স্বজনসকাশে গ্রন্থে। এ-গ্রন্থে আমরা পাই তুলনামূলক সাহিত্যের একজন মেধাবী ছাত্রীকে, যিনি প্রজ্ঞাবতী, যাঁর পঠন-পাঠনে ঈর্ষণীয় ব্যাপ্তি, উজ্জ্বল একজন অধ্যাপক, গবেষক ও প্রাবন্ধিক, বিশ্বনাগরিক, ভ্রামণিক, আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন লেখক এবং বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলের কবি-লেখকদের সঙ্গে তাঁর সখ্য ও আলাপেরও ভিন্ন এক ছবি।
রম্য সাহিত্যেরও অন্যতম স্রষ্টা তিনি এবং নারী অধিকারের প্রবক্তা Ñ এজন্য মিছিলে উচ্চকিত হননি। লেখনী ও তাঁর ‘সই’ সংগঠনটি নারীকে জীবনে প্রতিষ্ঠার জন্য প্রাণান্ত পরিশ্রম করেছে। এই প্রয়াসে তাঁর একনিষ্ঠ মানবিক চেতনাসম্পন্ন অবয়বটিও উজ্জ্বল হয়ে ওঠে; যদিও তিনি কোনোদিনই নিজেকে নারীবাদী হিসেবে চিহ্নিত করেননি। বিভিন্ন সময়ে ভারতবর্ষ ও পশ্চিমবঙ্গে নারীর অবমাননা ও লাঞ্ছনা যখন হয়েছে, প্রতিবাদে মুখর হয়েছেন তিনি। লেখনী ধারণ করেছেন। সুসভ্য এক নাগরিক সমাজের জন্য আকুলতা প্রকাশ করেছেন। সমাজে ও সাহিত্যে নারী-লেখকদের সম্মান ও মর্যাদার আসন প্রতিষ্ঠার জন্য গড়ে তুলেছিলেন ‘সই’। এই ‘সই’ ঘিরে পশ্চিমবঙ্গের নারীলেখকরা সম্মিলিত হয়েছিলেন এক মঞ্চে। তাঁদের সৃজন ও প্রতিকূলতা নিয়ে কথা বলেছেন। তাঁকে ঘিরে প্রবীণ ও নবীন লেখিকাদের একটি বৃত্ত গড়ে উঠেছিল। আলোচনা চক্রে, কখনো লেখক সম্মিলনে। বাংলায় ‘সই’ মানে তাঁর ভাষায় তিনটি ব্যঞ্জনা – ‘সখী, স্বাক্ষর ও সহ্য করি’। এই সংগঠনটি প্রতিষ্ঠার পর শুধু নারীলেখকদের বই নিয়ে প্রতিবছর পৃথক বইমেলার আয়োজন, লেখা পাঠ, জন্মদিন পালন, সেমিনার কত কিছু না তাঁরই নেতৃত্বে পরিচালিত হয়েছিল; তাঁর বাড়িটি হয়ে উঠেছিল ‘সই’ সদস্যদের মিলনক্ষেত্র। এ-বছর একুশ বছরে পড়ল ‘সই’। এ-সংগঠনের সর্বশেষ সম্মিলন হয়েছিল নবনীতার ড্রইংরুমে। তাঁর মৃত্যুর পর একটি কাগজে এ নিয়ে হৃদয়গ্রাহী বর্ণনা দিয়েছেন এক ‘সই’-সদস্য।
সমাজে নারীত্বের লাঞ্ছনা ও অবমাননা সর্বদা তাঁকে প্রতিবাদী করেছিল। তাঁর-রচিত ভাল-বাসার বারান্দা ও নবনীতার নোট বই নিয়ে বহু নিবন্ধে তার স্বাক্ষর আছে। ভাবতে ভালো লাগে, পশ্চিমবঙ্গের হাইকোর্ট ধর্ষণের সংজ্ঞা নিয়ে যে-রায় দিয়েছিলেন তিনি ক্ষুব্ধকণ্ঠে তার প্রতিবাদ ও মুক্তকণ্ঠে সমালোচনা করেছিলেন। হাইকোর্ট রায় দিলেও মুক্তকণ্ঠে নারীর অবমাননা নিয়ে কথা বলতে দ্বিধা করেননি। ভয় পাননি তিনি। তবে কোনো নারী সংগঠনকে সরব হতে দেখেননি। উচ্চকণ্ঠে প্রতিবাদ করেছেন তিনিই। এই নিবন্ধে তিনি যে-ভাষা ব্যবহার করেছিলেন তাতে এক সাহসী নবনীতার সাক্ষাৎ পাই আমরা। অঞ্জলি দাশ পূর্বে উল্লিখিত ‘অন্যরকম বাঙালি’ সংখ্যায় নবনীতা দেবসেনের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যসহ এই বিষয়গুলো যেমন ছুঁয়েছেন, তেমনি তাঁর ব্যক্তিত্ব ও অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রামকেও খুবই বিস্তৃত পরিসর নিয়ে আলোচনা করেছেন। নবনীতাকে নিয়ে এত বিস্তৃত আলোচনা সে-সময় চোখে পড়েনি।
তাঁর বেড়ে ওঠা এবং সৃজনশীল ও সংস্কৃতিমনস্ক উদার মা রাধারানী দেবী ও বাবা নরেন্দ্র দেব প্রসঙ্গে আমাদের মনে যে-ছবিটি ফুটে ওঠে তা হলো, উদার সাহিত্যানুরাগী এক পিতা-মাতার প্রতিকৃতি। স্বজনসকাশে গ্রন্থের দুটি প্রবন্ধ ‘কাছের মানুষ’ এবং ‘আমার উনিশে এপ্রিল’ নরেন্দ্র দেবকে নিয়ে লেখা। তিনি এ-দুটি রচনায় ও নবনীতার নোট বইয়ে বাবা ও মায়ের ব্যক্তিত্ব, সৃজন ও দৈনন্দিন জীবনযাপনের অন্তরঙ্গ যে চিত্র অঙ্কন করেছেন তা মহৎ হৃদয়ের পিতা ও মাতাকেও চিনিয়ে দেয়। এই বাড়িটিতে তাঁদের জীবদ্দশায় আড্ডা দিয়েছেন এবং সাহিত্যের নানা বিষয়ে আলাপচারিতায় মুখর হয়েছেন পিতা ও মাতার সমকালীন লেখকবৃন্দ। বাবা ও মা দুজনেই ছিলেন লেখক। সেই সূত্রে নবীন ও প্রবীণ লেখকরা নিয়মিত আসতেন এ-বাড়িতে। ব্যক্তিগতভাবে আমি মোহিত ও সমৃদ্ধ হয়েছিলাম তথ্যসমৃদ্ধ এ-লেখাটি পাঠ করে। বাবা ও মাকে নিয়ে ভাল-বাসার বারান্দা ও নবনীতার নোট বই গ্রন্থেও তিনি শ্রদ্ধা নিবেদনের সঙ্গে তাঁদের সৃজন ও তাঁদের দাম্পত্য বন্ধু সমাগম এবং সম্মিলনের যে-ছবি অঙ্কন করেছেন, তা শুধু হৃদয়গ্রাহী নয়, সেকালের বুধম-লীর ভিন্ন চেহারা পাই আমরা।
নবনীতা দেবসেন-রচিত ভাল-বাসার বারান্দা ও নবনীতার নোট বই চারিত্রিক দিক থেকে সগোত্র। ভাল-বাসার বারান্দা তিনি লিখেছিলেন প্রতিদিনের ঋতুপর্ণ ঘোষের অনুরোধে। ঋতুপর্ণ শুধু চলচ্চিত্র নির্মাণে নবদিগন্তের উন্মোচন করেননি, তিনি ছিলেন বহুগুণের অধিকারী। সাহিত্য অন্তপ্রাণ। তিনি এই পত্রিকার সাহিত্য বিভাগটিকেও সমৃদ্ধ করেছিলেন। ঋতুপর্ণ এই পত্রিকার সাহিত্য বিভাগে দায়িত্ব গ্রহণের পর সাময়িকীটি বিষয়বৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ হয়ে বৃহত্তর পাঠকমহলে অনুকূল সাড়া ফেলেছিল। সাহিত্যের বিভাগীয় সম্পাদক হিসেবে তিনি এই সাময়িকীটিকে আকর্ষণীয় করে তুলেছিলেন এবং অচিরকালের মধ্যে সেটি জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল। পাঠকেরা নানা স্থান থেকে অনুকূল সাড়া দিয়েছেন। নবনীতা দেবসেন বস্তুত এই কলামের মধ্য দিয়ে অজস্র পাঠকের হৃদয় ও মন জয় করেন। পরে এই কলাম নিয়ে ভাল-বাসার বারান্দা কয়েক খ-ে গ্রন্থ হয়ে প্রকাশিত হয়। হিন্দুস্থান পার্কের বাড়িঘর, উঠোন, বৃক্ষ এবং এই বৃক্ষে বসবাসকারী পাখির ঘরগেরস্তালি নবনীতা দেবসেনের এই কলামে নানা সময়ে সজীব, প্রাণবন্ত ও সরস হয়ে ফুটে উঠেছে। নিজেকে নিয়েও পরিহাস করেছেন তিনি এই কলামে। তাঁর নিপুণ গদ্যশৈলীর বিচ্ছুরণ, কৌতুকপ্রবণতা, অভিজ্ঞতা
ভাল-বাসার বারান্দা বৃহত্তর পাঠকের কাছে আদরণীয় হয়ে উঠেছিল। এছাড়া ছিল সৃজনে সংশ্লিষ্ট নানাজনের আনাগোনা। গদ্য ছিল সরস অথচ রম্য নয়। এমনভাবে সবকিছু বর্ণনা করতেন Ñ এক নিশ্বাসে পড়া যেত। এই গদ্যশৈলী তাঁর মেজাজের সঙ্গে জড়িয়ে গিয়েছিল। তাঁর কলামে বর্ণিত হিন্দুস্থান পার্কের বাড়িগুলোর সমবয়সীদের সঙ্গে বিচরণ সমগ্র জীবন তাঁর স্মৃতিতে অমøান হয়ে ছিল। অনেকের সঙ্গে সখ্যও হয়েছিল। এখন অনেকে প্রয়াত। সেজন্য পরিণত বয়সে এসে খেদ প্রকাশ করেছেন তাঁদের জন্য। অনেক বাড়ির অভিভাবকতুল্য ব্যক্তি ও গৃহিণীরা তাঁকে স্নেহ করতেন। এই স্নেহের আরেক ছবি পাই যখন বাড়ির অন্দরমহলে তাঁর অবাধ প্রবেশ, যখন তাঁর মাসিও বউদি হয়ে উঠতেন। এভাবে শৈশবের স্মৃতি ও বন্ধুতা সকল সময় তাঁকে তাড়িত করেছে। ভাল-বাসার বারান্দা ও নবনীতার নোট বই এ-দুটি গ্রন্থের অসংখ্য রচনায় হিন্দুস্থান পার্কের যে-ছবি পাই তাতে আছে মনন-সৌন্দর্য এবং এ-বাড়িগুলোর সংস্কৃতি ও বিদ্যানুরাগের বিবরণ। এছাড়া চারপাশের পরিবেশ ও নিজেকে নিয়ে পরিহাসেরও প্রাবল্য উঁকি দিয়েছে কখনো-সখনো। এই বিবরণ যে-কোনো পাঠককেও অভিজ্ঞ করে তোলে। তাঁর বিদ্যাবত্তা ও মননের ধর্ম ও সৃজন-উৎকর্ষ সম্পর্কে আমরা অনেকেই জানি। ভাল-বাসার বারান্দা ও নবনীতার নোট বই Ñ এ-দুটি গ্রন্থ পাঠ করার আগে জানতাম না তাঁর গাছের প্রতি অনুরাগের কথা। এ-সম্পর্কে কৌতূহলে উজ্জ্বল যে-বিবরণ দিয়েছেন অঞ্জলি দাশ ‘গেছো মেয়ে বিদ্যাবতী’ প্রবন্ধে তা থেকে উদ্ধৃতি দিচ্ছি। এ যেমন তাঁর ব্যক্তিস্বরূপকে উজ্জ্বল করে, তেমনি মানুষটিকে তাঁর সঙ্গে বিদ্যার্থীদের সহজ সম্পর্ক চিনতেও সহায়তা করে।
‘১৯৮১-৮২ সালের কথা। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীদের নিয়ে শান্তিনিকেতন গেছেন। দুপুরবেলায় দেখলেন তাঁর ছাত্রীরা করুণ চোখে ঊর্ধ্বমুখে চেয়ে একটি গাছের নিচে দাঁড়িয়ে আছে। প্রায় মহীরুহ আকারের এক পেয়ারা গাছ। উঁচুদিকের ডাল ভর্তি পেয়ারা। খুব স্বাভাবিকভাবে ছাত্রীদের বললেন Ñ ‘যাও না, ওঠো, কয়েকটা পেড়ে খাও, কিছু হবে না Ñ দেখো গাছ ভেঙো না।’ শুনে সেই সব প্যান্ট-টি শার্ট পরা স্মার্ট মেয়েরা হেসেই অস্থির। এমন আজগুবি কথা তারা যেন আগে শোনেনি। অতএব তাদের গেছো দিদিমণি শাড়ির আঁচল কোমরে জড়িয়ে অবলীলায় মগডালে চড়ে ছাত্রীদের পেয়ারা পেড়ে দিলেন। দেখে ছাত্রীদের বিস্ময়ের অন্ত নেই। ওমা! দ্যাখ দ্যাখ ড. দেব সেন গাছে চড়ে পেয়ারা পাড়ছেন।’
নবনীতাকে নিয়ে অঞ্জলি দাশের এই বিস্তৃত আলোচনা সে-সময় আমাদের অনেকেরই ভালো লেগেছিল। সংবাদপত্রের জন্য রচিত ভাল-বাসার বারান্দা ও নবনীতার নোট বই বা কোনো গবেষণাগ্রন্থ নিয়ে অবশ্য আলোচনা ছিল না এই প্রবন্ধে। তবে তাঁর কৈশোর ও যৌবনের দিনগুলো এবং মেধাবী ছাত্রী হিসেবে তিনি আত্মপ্রতিষ্ঠা করেন কেমন করে, কীভাবে কলকাতার বুদ্ধিবৃত্তিক ও মননচর্চায় নিজের আসন শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড় করিয়েছিলেন সে-প্রসঙ্গে অঞ্জলি দাশ সবিস্তারে আলোচনা করেছিলেন। তাঁর জন্ম, শৈশব কেটেছিল হিন্দুস্থান পার্কে। কৈশোরকালে তাঁর প্রতিভার স্ফুরণ হয়েছিল। প্রেসিডেন্সিতে পাঠ গ্রহণকালে তাঁর মেধা ও বুদ্ধিবৃত্তিক নানা অনুষঙ্গ প্রত্যক্ষ করে মাস্টারমশাইরা তাঁকে স্নেহছায়ায় বেঁধেছিলেন। তিনি হয়ে উঠেছিলেন সম্ভাবনাময় প্রজ্ঞায় দীপ্ত এক মেধাবী ছাত্রী।
সর্বোপরি তাঁর কৈশোর ও যৌবনের দিনগুলো এবং মেধাবী ছাত্রী হিসেবে তিনি কীভাবে কলকাতার সৃজনউদ্যানে ও শিক্ষকতার জগতে আলোচিত ব্যক্তিত্ব হয়ে ওঠেন এবং কবিতা রচনার মধ্য দিয়ে অনেকের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন সে-কথা তাঁর লেখাটিতে পাওয়া যায়। বিশেষত প্রেসিডেন্সি ছেড়ে তিনি যখন বুদ্ধদেব বসুর অনুজ্ঞায় নবসৃষ্ট যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনামূলক সাহিত্য বিভাগে বিদ্যার্থী হিসেবে যোগ দিলেন তখন এই বিভাগের ভবিষ্যৎ নিয়ে অনেকেই সন্দিহান ছিলেন। শিক্ষার্থী হিসেবে প্রেসিডেন্সিতেই তিনি প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছিলেন এবং শিক্ষকরা সে-সময়ে তাঁর ভেতর অমিত সম্ভাবনা প্রত্যক্ষ করেছিলেন। এ নিয়ে শুভার্থী ও মাস্টারমশাইরা মেধাবী ও উজ্জ্বল এই ছাত্রীর ভবিষ্যৎ নিয়ে সন্দিহান হয়ে পড়েছিলেন। প্রেসিডেন্সি ছেড়ে যাওয়ায় অনেকেই ব্যথিত হয়েছিলেন। নবনীতা দেবসেন যখন প্রেসিডেন্সিতে পড়তে চাইলেন মা-বাবা কেবল শর্ত দিয়েছিলেন, ‘প্রেসিডেন্সিতে পড়ো, কিন্তু কফি হাউসে যেতে পারবে না।’ নবনীতার উচ্চশিক্ষা নিয়ে রাধারানী দেবীর কোনো দ্বিধা ছিল না। নবগঠিত তুলনামূলক সাহিত্য বিভাগের প্রথম ব্যাচের ছাত্রী ছিলেন নবনীতা। মোট ছয়জন শিক্ষার্থী নিয়ে বিভাগটি শুরু হয়েছিল। সহপাঠী হিসেবে পেয়েছিলেন অমিয় দেব, প্রণবেন্দু দাশগুপ্ত, শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়, মানব বন্দ্যোপাধ্যায়কে। পরবর্তীকালে সকলেই সারস্বত সমাজে দেদীপ্যমান হয়ে উঠেছিলেন।
সৃজন-উৎকর্ষে প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছিলেন প্রথম ব্যাচের এই শিক্ষার্থীরা। অনেকেই বাংলা ভাষা ও সাহিত্যেও নক্ষত্রতুল্য ব্যক্তি হয়ে উঠেছিলেন। এই বিভাগে শিক্ষক হিসেবে পেয়েছিলেন বুদ্ধদেব বসু, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, নরেশ গুহ ও অলোকরঞ্জন দাশগুপ্তকে। একপর্যায়ে সুকুমারী ভট্টাচার্যকেও। পরে অবশ্য সুকুমারী চলে যান সংস্কৃত কলেজে। অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত কিছুদিন পর বাংলা বিভাগে চলে যান।
এই সময় থেকে বুদ্ধদেব বসুর ২০২ রাসবিহারী অ্যাভিনিউর কবিতাভবনে নিয়মিত যাতায়াত তাঁর মননধর্মে ছাপ ফেলেছিল। বন্ধুত্ব হয়েছিল মীনাক্ষী ও দয়মন্তী বসুর সঙ্গে। পরবর্তীকালে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনামূলক সাহিত্য বিভাগের বুদ্ধদেব বসুর অকালপ্রয়াত পুত্র শুদ্ধশীল বসুর সঙ্গে সখ্য গড়ে উঠেছিল। কবিতাভবনে বুদ্ধদেব বসু ও প্রতিভা বসুর সান্নিধ্য এবং স্নেহ বহুদিন পেয়েছেন। একটি প্রবন্ধে তিনিই এই দুই মানুষের মনন ও সৃজনের অন্তরঙ্গ ছবি এঁকেছেন। তাঁর প্রত্যক্ষণে ধরা পড়েছিল Ñ নিরন্তর আড্ডার পরও বুদ্ধদেব বসুর সৃজনধর্মিতা কীভাবে গহনসন্ধানী আর প্রতিভা বসু আড্ডা দিয়ে ঘরসংসারের অজস্র কাজ করে কোনোদিনই ক্লান্তি বোধ করতেন না।
নবনীতা দেবসেন স্বজনসকাশে গ্রন্থে একটি প্রবন্ধে অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত সম্পর্কে এক দীর্ঘ রচনায় তাঁর মাস্টারমশাইয়ের যে-চিত্র ও ব্যক্তিত্ব নির্মাণ করেছেন তা কৌতূহলোদ্দীপক। বর্তমানে অলোকরঞ্জন বিশ্বনাগরিক। থাকেন জার্মানির হাইডেলবার্গে। দার্শনিক ও ভাবুকবৃত্তে তিনি সদা সমুজ্জ্বল। কবি ও প্রাবন্ধিক। অন্যদিকে সমকালীন শীর্ষ ভাবুকম-লীতে তাঁর অনায়াস যাতায়াত এবং এই দিক উন্মোচন আমাদের যৌবন বাউলের কবি, অনুবাদক ও শীর্ষ এই কবি প্রাবন্ধিককে ভিন্নভাবে চিনিয়ে দেয়। তাঁর প্রথম কবিতার বই প্রথম প্রত্যয় বের হয়েছিল ১৯৫৭ সালে আর আমি অনুপম প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৭৬ সালে। উপন্যাসটি ছিল নকশাল আন্দোলনকেন্দ্রিক। এই উপন্যাসটি নকশালদের নিয়ে রচিত প্রথম উপন্যাস। চরিত্র ডাকসাইটে বুদ্ধিজীবী ও সাংবাদিক। ম্যাগসেসাই পুরস্কারপ্রাপ্ত। তাঁর বিবেকিতা ও নকশালদের প্রতি সহমর্মিতা প্রাথমিক পর্যায়ে এক মাত্রা সঞ্চার করলেও পরে বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে তাঁর দ্বন্দ্ব ও পরাজয় নকশাল আন্দোলনে বুদ্ধিজীবীর ভূমিকার এক আলেখ্য হয়ে ওঠে।
নবনীতার মা-বাবার বিয়ের আসরে মন্ত্রপাঠ করেছিলেন আচার্য সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়। সেকালে এ-বিয়ে বেশ আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। প্রেমের ও বিধবা বিয়ের এই অনুষ্ঠানে নিজেই নিজেকে সম্প্রদান করেছিলেন রাধারানী দেব। নবনীতার জন্ম ও শৈশব কেটেছিল হিন্দুস্থান পার্কে বহুল আলোচিত ভাল-বাসা বাড়িটিতে। লিলুয়া থেকে এসে তাঁর পিতা নরেন্দ্র দেব হিন্দুস্থান পার্কে জমি কিনে ভাল-বাসা বাড়িটি নির্মাণ করেছিলেন। নবনীতার জন্মের পর তাঁর নামটি রেখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। নবনীতার সৃজনশীল বাবা ও মায়ের প্রতি রবীন্দ্রনাথের স্নেহাশীর্বাদ ছিল। শরৎচন্দ্রও এই দম্পতিকে খুব ভালোবাসতেন। নবনীতার যখন তিন বছর বয়স সেই সময়ে রবীন্দ্রনাথ নরেন্দ্র দেব-রাধারানী দম্পতিকে খেতে নিমন্ত্রণ করেছিলেন। খেতে বসে নবনীতা বলল, ‘এ কেমন নিমন্ত্রণবাড়ি, খাবার মধ্যে পোলাও নেই। শুধু ভাত!’ রবীন্দ্রনাথ রান্নার ঠাকুরকে ডেকে বলেন, ‘ছোট এলাচ ভেজে কিশমিশ সহযোগে ঘি ঢেলে পোলাও করে দাও।’
নবনীতার মৃত্যুর পর ভেবেছিলাম, তাঁর সৃজন ও জীবনসংগ্রাম নিয়ে ও বাংলা সাহিত্যে তাঁর ভিন্ন মর্যাদাবান আসন নিয়ে শ্রদ্ধাজ্ঞাপক কিছু লেখা বেরোবে। আনন্দবাজার এবং এই সময় পত্রিকায় কিছু লেখা বের হয়েছে বটে, তবে সব কটি ছিল অন্তরঙ্গভাবে তাঁকে পর্যবেক্ষণ ও ব্যক্তি নবনীতার সঙ্গে সান্নিধ্যের খতিয়ান। যদিও এই পর্যবেক্ষণে আমরা ভিন্ন মানবিকবোধে উজ্জ্বল বৈচিত্র্যে ভরপুর, নানা অভিজ্ঞতাসম্পন্ন এক নবনীতা দেবসেনকে পেয়েছি; তবু মন তৃপ্ত হয়নি। কেবল আমার ভালো লেগেছিল শিকাগো থেকে পাঠানো ঐতিহাসিক দীপেশ চক্রবর্তীর এবং অর্থনীতির ডাকসাইটে অধ্যাপক ও প্রাবন্ধিক সৌরীন ভট্টাচার্যের লেখা। তাঁর মৃত্যুর পর আমার কেবলই মনে হয়, যাদবপুরের তুলনামূলক সাহিত্য বিভাগ ও বাংলা গবেষণা সাহিত্যের একটি অধ্যায়ের অবসান হলো; যেখানে নবনীতা দেবসেন ছিলেন শিখরস্পর্শী। বাংলা সাহিত্যকে তিনি গবেষণা, রম্য রচনা, পত্রিকায় কলাম রচনা, শিশুসাহিত্য, ভ্রমণসাহিত্য দিয়ে যেভাবে ঋদ্ধ করেছেন তার ছিটেফোঁটাও খুঁজে পাইনি সেসব ফিচারধর্মী রচনায়। তুলনামূলক সাহিত্য আলোচনায় তিনি যে নবদিগন্তের সূচনা ও পথিকৃতের ভূমিকা পালন করেছেন তা নবীন আলোকে আজ আমরা উপলব্ধি করি।
তিনি নিজে গাড়ি ড্রাইভ করতেন; যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে আলোচনা সভা, কবিতা পাঠের আসর বা ‘সই’ অনুষ্ঠানে বন্ধুদেরও নিয়ে যেতেন গাড়ি ড্রাইভ করে। একবার ভারত ক্রিকেটে শিরোপা পেল। এ উদ্যাপনের জন্য গাড়িতে মেয়েদের সঙ্গে নিয়ে রাত্রিতে বেরিয়ে পড়লেন আনন্দে উচ্ছল কলকাতার রাস্তায়। এ-ওকে অভিনন্দন জানাচ্ছে গাড়িতে হর্ন ও সেøাগান দিয়ে। নবনীতাও অনেক রাত অবধি ভারতের জয় উদ্যাপন করলেন। অনেক রাত্রিতে বাড়ি ফেরার মুখে গেলেন পাঞ্জাব ধাবাতে চা খেতে। আনন্দে উচ্ছল অপরিচিত একজনকে ‘হাই’ করলেন সেই রেস্টুরেন্টে।
তাঁর রচিত অসামান্য গ্রন্থ ঈশ্বরের প্রতিদ্বন্দ্বী ও অন্যান্য ১৩৮৪ সনে প্রকাশিত হয়েছিল। এমন মনন-উজ্জ্বল মেধাবী গ্রন্থ বাংলা সাহিত্যে বিরল। এই গ্রন্থের কয়েকটি প্রবন্ধ প্রথমে ইংরেজি ভাষায় রচিত হলেও পরে বাংলায় গ্রন্থভুক্ত হয়। প্রতিটি প্রবন্ধেই জিজ্ঞাসার বিচ্ছুরণ আছে।
এই গ্রন্থের দ্বিতীয় সংস্করণে তিনি কমলকুমার মজুমদারকে নিয়ে দুটি প্রবন্ধ সংযুক্ত করেছিলেন। প্রথম প্রবন্ধটির নাম ‘পিঞ্জরে বসিয়া পাঠক এবং অথবা তান্ত্রিকের শব্দ সাধনা’। দ্বিতীয় প্রবন্ধটির নাম ‘একটি মেট্রোপলিটন শিল্পীমন ও মধ্যবিত্ত বিদ্রোহের উদাহরণ কমলকুমার মজুমদার বিষয়ে দু-একটি ভাবনা’। অসাধারণ এ-দুটি প্রবন্ধ প্রকাশের পরপরই বাংলাভাষী সাহিত্যাগ্রহী পাঠকের মধ্যে খুবই চাঞ্চল্য, আলোড়ন ও বিরূপতা সৃষ্টি হয়েছিল। কারণ সেকালে জীবনভাবনা ও গদ্যশৈলীর জন্য কমলকুমার মজুমদার একটি মিথে পরিণত হয়েছিলেন। তাঁর গদ্যশৈলী ও বিষয় অসামান্য হলেও এ যে ভবিষ্যৎ বাংলা গদ্যকে প্রভাবিত করবে না এবং মূলধারা থেকে ক্রমে এ-গদ্য হয়ে পড়বে বিচ্ছিন্ন Ñ তিনি প্রত্যয়ের সঙ্গে সে-কথা বলেন। অনেকে এমন ধারণা পোষণ করতেন যে, কমলকুমার মজুমদার লেখকের লেখক। কমলকুমার ব্যাকরণ ভেঙে, কোনো নিয়মনীতি মান্য না করে বাক্যগঠনে নতুন রীতি প্রবর্তন করেছিলেন। নবনীতার ভাষায়, তাঁর অব্যয়-ব্যবহার, কারক-বিভক্তি ব্যবহার, পদ-ব্যবহার Ñ সবই ছিল বাংলা ব্যাকরণবহির্ভূত। তিনি এই দীর্ঘ প্রবন্ধে বাংলা ভাষার ক্রমবিকাশ প্রসঙ্গও আলোচনা করেন। বিস্তৃত পরিসর চলে আসে তাঁর আলোচনায়। বৌদ্ধ যুগ থেকে মোগল আমল ও ইংরেজদের সময় ঘিরে যে ভাষা-ব্যবহার ও ভাষাচেতনা তার আলোচনার বিষয় হয়ে ওঠে। দীর্ঘ এই বিশ্লেষণের পর তিনি এ-ধরনের সিদ্ধান্তে আসেন যে, কমলকুমার পাঠকের সঙ্গে কোনো সহযোগিতার যোগাযোগের সেতু নির্মাণ করতে পারেননি। সেজন্য প্রতিভাও যে কখন ভুলপথে যাত্রার ফলে ক্ষীয়মাণ হয়ে পড়ে, সে-কথা প্রত্যয়ের সঙ্গে উচ্চারণ করেন। এও বলতে দ্বিধা করেন না যে, ‘প্রাসঙ্গিক হোক, অথবা অপ্রাসঙ্গিক Ñ আবার বলে রাখছি, আধুনিক বাংলা সাহিত্যে শ্রীকমলকুমার মজুমদার এক তুলনাহীন নষ্ট-প্রতিভা, একটি কক্ষচ্যুত নক্ষত্রবিশেষ। তাঁর চেয়ে অনেক অনেক কম ক্ষমতা নিয়ে অনেকেই বাংলা সাহিত্যের হাটে স্থায়ী দোকান দিয়ে গেছেন। অথচ বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসের মূলধারায় কমলবাবুর স্থান থাকবে না, তিনি থেকে যাবেন পার্শ্বভূমিকায় Ñ শুধু একটি ব্যতিক্রম হিসেবে উৎসাহের খোরাক জুগিয়ে। এই ট্র্যাজেডির মূল খুঁজতেই এই প্রবন্ধের সূচনা।’
নবনীতা দেবসেনের ঈশ্বরের প্রতিদ্বন্দ্বী ও অন্যান্য গ্রন্থে বিশেষত রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে দুটি প্রবন্ধ ও ‘ঈশ্বরের প্রতিদ্বন্দ্বী : শশী ও রিউ’-এ মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় ও আলবেয়ার কাম্যুর উপন্যাসের তুলনামূলক আলোচনা এবং পর্যবেক্ষণ কত গভীর তা এতদিন বাদেও আমাদের কাছে ভিন্ন মর্যাদা দাবি করে। তাঁর গবেষণালব্ধ এই প্রবন্ধে তিনি দেখাতে চেয়েছেন বাংলা সাহিত্যে অ্যাবসার্ডিটি পাশ্চাত্যের দান নয়; পশ্চিম থেকে এ গৃহীত হয়নি। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় শশী চরিত্রের মধ্য দিয়ে এই বোধের প্রকাশে উজ্জ্বলতম উদাহরণ হিসেবে স্বাক্ষর রেখেছেন। পুতুল নাচের ইতিকথার নানা চরিত্রকে তাঁর মতো করে কেউ গভীরভাবে চিত্রিত করেননি। আমাদের ভাগ্য ভালো, আলবেয়ার কাম্যুর রিউ চরিত্র তিনি নির্মাণ করেছিলেন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের পুতুল নাচের ইতিকথা রচনার পরে। ভাবতে ভালো লাগে যে, এই দুটি উপন্যাসে সাদৃশ্য থাকা সত্ত্বেও দুই লেখকের আউটসাইডার বোধ, মানুষের জন্য কল্যাণ-আকাক্সক্ষা, রোগবালাই দূর করার জন্য শশী ও রিউ এ দুজনের ঐকান্তিক প্রয়াস, জটিল ঘূর্ণাবর্তের দিনযাপন ও দুজনেরই ভাগ্যবিড়ম্বিত পরাজয় নিয়ে তিনি যে আলোচনা করেছেন বাংলা সাহিত্যে এমন আলোচনা চোখে পড়ে না। এছাড়া রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে দুটি প্রবন্ধের একটিতে তিনি ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ করেছেন কী কারণে পাশ্চাত্যে রবীন্দ্রনাথ নোবেলপ্রাপ্তির দু-এক বছরের মধ্যে মøান ও অনালোচিত থেকে যান। তিনি এ-প্রবন্ধে পাশ্চাত্যের সামাজিক-রাজনৈতিক পরিবেশ এবং হৃদয়ের গহিনে রাখা ধর্মবোধকে উপেক্ষা করেননি। একদা বিশেষত নোবেল বিজয়ের সময়ে যুদ্ধোত্তর ইউরোপ গীতাঞ্জলিতে দেখেছিল ঈশ্বরে নিবেদন প্রশান্ত সৌম্য ভাব ও রবীন্দ্রনাথের ব্যক্তিত্বে ঋষিকল্প এক প্রতিমা, যা নোবেলপ্রাপ্তির সময়ে ইউরোপীয়দের হৃদয়-মন ও কাব্যরুচিকে প্রবলভাবে আলোড়িত করেছিল, এ অচিরকালের মধ্যে অবসিত হয়েছিল কী কারণে Ñ নবনীতা এ অনুসন্ধান করেছেন দীর্ঘ পরিসর ও পরিপ্রেক্ষিত নিয়ে।
এছাড়া ছিল তিরিশের কবি সুবীন্দ্রনাথ দত্তকে নিয়ে হৃদয়গ্রাহী আলোচনা। তিরিশের এই কবির চরিত্র, কাব্যের বৈশিষ্ট্য এবং প্রজ্ঞার মিশ্রণ। শব্দের ব্যবহার ধ্বনিময়তা নিয়ে নবনীতা বাঙালির মননচেতনায় নতুন মাত্রা সঞ্চারিত করেছিলেন। আমি ব্যক্তিগতভাবে ঋদ্ধ ও সমৃদ্ধ হয়েছি এ-গ্রন্থের আরো তিনটি প্রবন্ধ পাঠ করে। ভার্জিলের ঈনিড অনুবাদ করেছিলেন লাতিন থেকে হৃষীকেশ বসু ও ফাদার রব্যের আতোঁয়ান। বইটি প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৭২ সালে। প্রকাশের পর নবনীতা দেবসেন বইটির অনুবাদ প্রসঙ্গে যে-আলোচনা করেন তাতে তিনি অনুবাদের সমস্যা নিয়ে দীর্ঘ আলোচনার সূত্রপাত করেন। মহাকাব্যের অনুবাদ প্রসঙ্গে মৌলিকতা ও যথাযথ শব্দের ব্যবহার নিয়ে তিনি বিশ্লেষণ করেন। যুগ্ম অনুবাদককে এই গ্রন্থটির জন্য অভিনন্দিত করেন। এই প্রবন্ধে তিনি আশা প্রকাশ করেন, অনুবাদ তো আক্ষরিক অনুবাদ নয়। অনুবাদ পাঠকের সঙ্গে কখন কীভাবে সেতুবন্ধ রচনা করে সে-প্রসঙ্গও উত্থাপন করেন তিনি। এ নিয়ে আলোচনাকালে কখন কীভাবে মহাকাব্য বৃহৎ পরিসরে অনুবাদ হয়েছে তা ব্যাখ্যা করেন। প্রসঙ্গক্রমে রাজশেখর বসুর রামায়ণ মহাভারতের অনুবাদ প্রসঙ্গও চলে আসে তাঁর আলোচনায়। এই প্রবন্ধে তিনি বলেন।
এছাড়া এ-গ্রন্থের আরো একটি মৌলিক ভাবনাঋদ্ধ প্রবন্ধ ‘অমৃতেরে করি নমস্কার’ শীর্ষক, বুদ্ধদেব বসুর বোদলেয়ার অনুবাদ প্রসঙ্গে একটি রচনার কথা না বললেই নয়। এই প্রবন্ধটিতে তিনি অনুবাদের সমস্যা নিয়ে যেমন আলোচনা করেছেন, অন্যদিকে বুদ্ধদেব বসুর এই অনুবাদটি যে মৌলিকত্বে বিশিষ্ট সে-কথা যথাযথভাবে বর্ণিত হয়েছে।
বোদলেয়ারের কবিতার অনুবাদ ও গ্রন্থভুক্ত ভূমিকা বাংলা সাহিত্যকে, বিশেষত বাংলা কবিতাভুবনকে কতভাবে যে স্পন্দিত করেছিল তা তিনি বোদলেয়ারের অনুবাদ প্রসঙ্গে এ-প্রবন্ধে বিশ্লেষণ করেছেন। আমরা অবশ্য জানি যে, বুদ্ধদেব বসুর বোদলেয়ার অনুবাদ প্রকাশিত হওয়ার পর কলকাতার কয়েকজন কবিকে ক্লেদ, বিবমিষা, বিষাদ ও অমঙ্গলবোধের তাড়না কীভাবে সৃজনধর্মেও দীপিত করেছিল। বহুদিন তাঁরা এ-গ্রন্থে আচ্ছন্ন ছিলেন। এ নিয়ে ধীমান ভাবুক আবু সয়ীদ আইয়ুব আমাদের দৃষ্টিকে প্রসারিত করেছেন।
নবনীতা দেবসেন একই সঙ্গে প্রমাণ করেছেন, এই বোদলেয়ার অনুবাদের পর বুদ্ধদেব বসুর ভুবন ও মৌলিক কবিতার সৃজনধর্মে কীভাবে পরিবর্তন সাধিত হয়েছিল। শব্দ-ব্যবহারে ও ভাবনার বৃত্তে এই পরিবর্তন বুদ্ধদেব বসুর কবিত্বশক্তিকে বলীয়ান করেছিল। বিশেষত বুদ্ধদেব-রচিত যে আঁধার আলোর অধিক কাব্যগ্রন্থে তিনি বোধকরি বাঁক ফিরিয়েছিলেন। নবনীতা প্রত্যয়ের সঙ্গে সে-কথা উচ্চারণ করেছিলেন। তিনি দেখান যে, অনূদিত বোদলেয়ারের বহু শব্দ যে আঁধার আলোর অধিক বুদ্ধদেব বসু-রচিত এই কাব্যগ্রন্থের অনেক কবিতায় মর্যাদাবান হয়ে ওঠে। নবনীতা-রচিত ঈশ্বরের প্রতিদ্বন্দ্বী ও অন্যান্য গ্রন্থটি প্রকাশের পর যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সারস্বত সমাজে কিঞ্চিৎ আলোড়ন তুললেও পরবর্তীকালে এ কোনো বড় তরঙ্গ বা কোনো ঢেউ তোলেনি।
এমন সজীব, প্রাণবন্ত ও কর্মচঞ্চল জীবনীশক্তিতে ভরপুর মানুষ খুব কমই দেখা যায়। আর ভ্রমণে ছিলেন তিনি সর্বদা উদগ্রীব। হাসপাতাল বা নার্সিংহোম থেকে ফিরে বিশ্রামে থাকতে হতো অনেকদিন। কিন্তু এই সময়ে কোথাও ভ্রমণের সম্ভাবনা দেখা দিলে তিনি তা উপেক্ষা করতে পারতেন না। কন্যাদ্বয় বা দীর্ঘদিনের গৃহসহায়ক গুনিয়াভাই, কারো বারণ তিনি মানতেন না। তাঁর শরীরে বহু বছর পূর্বে হাঁপানি রোগ বাসা বেঁধেছিল; শ্বাসকষ্টেও ভুগতেন দীর্ঘদিন ধরে, অ্যালার্জি ছিল ধুলোবালিতে। সঙ্গে ছিল উচ্চ রক্তচাপ ও অন্যান্য ব্যাধি। এতদসত্ত্বেও পৃথিবীর এক অঞ্চল থেকে অন্য অঞ্চল চষে বেড়িয়েছেন শীত-গ্রীষ্মে। ব্যাধিজর্জর শরীর কোনো কিছুকেই তোয়াক্কা করেনি। অদম্য ছিল তাঁর ইচ্ছাশক্তি ও মানুষ দেখার দুর্নিবার আকাক্সক্ষা। সঙ্গীহীন একা বেরিয়ে পড়তেন দুর্গম ও কখনো বিপদসংকুল অঞ্চলে, যেখানে প্রকৃতি ও মানুষের হৃদয় উদার। ভ্রমণে অচেনা-অজানা স্থান দেখা তাঁর স্বভাবধর্মে পরিণত হয়েছিল। পথে-বিপথে চেনা নেই, জানা নেই এমন বহু লোকের সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ হতো। তখন আশ্রয় ও খাদ্য মিলত। কোনো অসুবিধা হতো না। আতিথেয়তা তাঁর হৃদয়কে নাড়া দিত। অনেক সময় সহযাত্রীদের শঙ্কাকে আমল দেননি। এসব একা ভ্রমণে তাঁর গন্তব্য ছিল না নির্দিষ্ট। অনেক ক্ষেত্রে আহার, নিদ্রা ও রাত্রিযাপনের ব্যবস্থাও থাকত না। তবু সবকিছুই কেমন করে যেন সহজ হয়ে যেত। কখনো দুর্গম পথ বিঘœময় হয়ে উঠত, অজানাকে জয় ও উপলব্ধির নতুন আকাক্সক্ষা নিয়ে ছুটে বেড়িয়েছেন পৃথিবীর এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্ত। জনমানবহীন আলাস্কায় গেছেন বহু কাঠখড় পুড়িয়ে, পেট্রোল কোম্পানির ছোট্ট প্লেনে চড়ে। কোনো পরিকল্পনা ছাড়াই আবাসন ও রাত্রিবাসের ব্যবস্থা ছাড়াই এলাহাবাদের কুম্ভমেলায় গিয়ে উপস্থিত হয়েছিলেন। শাড়িপরিহিতা বাঙালি মেয়ে, পায়ে যে তাঁর সরষে ছিল! সেজন্য সর্বদা ভ্রমণে কোনো বাধাকে বিঘœ মনে করেননি। আন্তর্জাতিক সাহিত্য অঙ্গনের সেমিনার ও সিম্পোজিয়ামে লেখিকা, ভাবুক ও চিন্তাবিদ হিসেবে ভারতের প্রতিনিধিত্ব করেছেন অসংখ্যবার। খোলা মন নিয়ে নানা বিষয়ে প্রজ্ঞামিশ্রিত আলোচনায় অংশ নিয়েছেন এবং এসব আলোচনাসভায় যোগ দিয়েই খোঁজ নিয়েছেন কোথায় ভ্রমণে যাওয়া যায়। হোক তা ভারত-চীন সীমান্তে জনবিরল ম্যাকমোহন লাইন, বা তুন্দ্রা পরিভ্রমণও তাঁকে সুখী করেছিল। নানা দেশের নিসর্গ, মানুষ ও পর্বত বা সমুদ্রের বৈশিষ্ট্য চোখ ভরে দেখা তাঁর স্বভাবের অন্তর্গত হয়ে পড়েছিল।
তিনি ছিলেন বিদুষী অধ্যাপক, ব্যতিক্রমী নারী, সৃজনধর্মে সিরিয়াস, আশিটি গ্রন্থের রচয়িতা; প্রতিটি গ্রন্থই ভিন্ন; সে রূপকথা বা শিশুতোষ গ্রন্থ যা-ই হোক না কেন; কৌতুকপ্রিয়, ভেতরে ভেতরে আধুনিক মানুষের মতো নিঃসঙ্গ। শামসুর রাহমানের মতো আমারও বলতে ইচ্ছে করে, তাঁর ব্যক্তিত্বে দুঃখ নাম লিখিয়েছিল। এই নিঃসঙ্গতার ও দুঃখের প্রবল তাপ কাউকে বুঝতে দেননি। হাসি ও রসিকতা দিয়ে নবনীতা কি কিছু লুকাতে চেয়েছিলেন।
সর্বদা ছিলেন ভ্রমণে উৎসাহী। একবার সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় খবর পেলেন নবনীতা দেবসেন গুরুতর অসুস্থ। হিন্দুস্থান পার্কের বাড়িতে গিয়ে শোনেন নবনীতা আলাস্কায়। বিস্মিত হননি Ñ এই তো তাঁর বন্ধু নবনীতা! অসুস্থ শরীরে পেরু ভ্রমণে উদ্বেগের কারণ হয়ে উঠেছিলেন।
লোকপ্রিয়তা তাঁর ভাগ্যে জুটেছিল। অজস্র পাঠক ও বিভাগের শত শত বিদ্যার্থী প্রাণ দিয়ে তাঁকে ভালোবেসেছিল। বহুজনকে প্রাণিত করেছেন তাদের ব্যক্তিগত দুঃসময়ে। কিছুদিন ধরে কর্কট রোগে জর্জর হচ্ছিলেন। এ নিয়ে কোনো বিলাপ করেননি বা কোনো অভিযোগ ছিল না। মননে উজ্জ্বল একজন সৃজনশীল মানুষ ৭ নভেম্বরে চলে গেলেন। বহু স্বজন অনুরাগীজনকে অশ্রুসিক্ত করে। বাড়িতে তাঁর মরদেহ যখন শ্রদ্ধায় ও ভালোবাসায় সিক্ত তখন গাওয়া হলো রবীন্দ্রনাথের ‘প্রাণ ভরিয়ে তৃষা হরিয়ে’ আর তাঁর প্রিয় যাদবপুরে যখন মরদেহ পৌঁছাল, অগণিত বিদ্যার্থী গাইল ‘আকাশ ভরা সূর্যতারা’। এই গান সঙ্গী করে তিনি পাড়ি দিলেন অজানার পথে। আমিও আত্মীয়-বিয়োগের মতো ব্যথিত হয়েছি তাঁর চলে যাওয়ায়।