বিবর্তনের ধারায় প্রাচীন ঢাকার খাদ্যসংস্কৃতি

সপ্তদশ শতকের একদম গোড়ার দিক। বুড়িগঙ্গা গিয়ে এগিয়ে চলেছে এক শাহি নৌবহর। একদিকে পাঠান আর অন্যদিকে পর্তুগিজ আর মগদের দৌরাত্ম্যে দক্ষিণবঙ্গে মোগল শাসনের ভিত বেশ নড়বড়ে। এই সময় সম্রাট জাহাঙ্গীর নিজের বিশ্বাসভাজন শেখ আলাউদ্দিন ইসলাম খাঁর হাতে সুবে বাংলার শাসনভার তুলে দিলেন। অভিজ্ঞ সুবেদার বুঝলেন যে সেই সুদূর রাজমহলে বসে মগ আর আরাকানিদের জব্দ করা যাবে না। বরং নিম্ন গাঙ্গেয় উপত্যকার বিস্তীর্ণ এলাকা থেকে যাবে এই লুটেরা-জলদস্যুদের কব্জায়। তাই তিনি নতুন রাজধানীর খোঁজে বেরিয়ে পড়লেন।

কৌশলগত গুরুত্ব বুঝে একটি জায়গা পছন্দ হলো সুবেদারের। নামলেন ডাঙায়। সেখানে দেখলেন যে কিছু মানুষ ঢাক বাজিয়ে তাঁদের দেবতার উপাসনা করছে। ইসলাম খাঁ তাদের এক জায়গায় একত্রিত করে নির্দেশ দিলেন যত জোরে পারে ঢাকে বোল তুলতে। সেইসঙ্গে নিজের তিন অনুচরের হাতে তিনটি ঝাণ্ডা দিয়ে নির্দেশ দিলেন পূর্ব, পশ্চিম এবং উত্তর দিকে যেতে। যেখানে ঢাকের আওয়াজ শেষ শোনা যায়, সেখানেই পুঁতে দিতে হবে হাতের ঝাণ্ডাটি। এভাবেই একদিকে নদী রেখে বাকি তিনদিকের সীমানা ঠিক হলো সুবে বাংলার নতুন রাজধানীর। শহরের নাম হলো ঢাকা, যার সঙ্গে মিশে রইল সেই ঢাক আর ঢাকিদের অনুষঙ্গ। রহমান আলীর ফার্সি বই তারিক-ই-ঢাকা থেকে প্রাপ্ত সূত্র দিয়ে এভাবেই শহরের নামকরণের উৎসকথা শুনিয়েছেন সৈয়দ হুসেন তাঁর Echoes From Old Dacca-তে।

রাজধানী হওয়ার সেই সূত্রেই রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও প্রশাসনিক প্রয়োজনে কাছের ও দূরের নানা মুলুকের মানুষ এসে ডেরা বাঁধে এখানে। সেই নানা দেশের নানা জনের হাতের ছোঁয়ায় গড়ে ওঠে শহরের নিজস্ব এক মিশ্র সংস্কৃতি, যার অবিচ্ছেদ্য অংশ ঢাকার খাবার। ঢাকার খাদ্যসম্ভারের এই বিশাল ব্যাপ্তির পেছনে নানা দেশের নানা সংস্কৃতির মানুষের ছোট ছোট অবদানের কয়েকটি আমরা ফিরে দেখার চেষ্টা করছি এই নিবন্ধে। খাদ্য যে সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ, সেটা প্রাচীনকাল থেকেই বারবার প্রমাণিত হয়েছে। শাসনব্যবস্থা বদলের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের সাংস্কৃতিক পরিচয়ে তার প্রভাব পড়েছে আর এই প্রভাবের সবচেয়ে বড় উপাদান হয়ে উঠেছে খাদ্য। একসময় বাংলায় আমিষ খাবারের বিশেষ জনপ্রিয়তা ছিল। কিন্তু পাল যুগে বৌদ্ধধর্ম এবং সেন যুগে ব্রাহ্মণ্য ধর্মের প্রভাবে নিরামিষ খাবারের প্রচলন বাড়ে। খাদ্যাভ্যাসের এই বদল সে-যুগের ধর্মীয় প্রাধান্যের দিকে ইঙ্গিত করে। আবার সুলতানি আমলে বাংলায় ইসলামি সংস্কৃতির প্রসার প্রভাবিত করে এখানকার খাদ্যাভ্যাসকে। অধ্যাপক শরিফউদ্দিন আহমেদ দেখিয়েছেন যে, একসময় ঢাকা প্রাদেশিক মুসলিম শাসকদের রাজধানী হলে এখানকার খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন আসে। তখন থেকে ঢাকার রন্ধনপ্রণালিতে পারসিক খাদ্যরীতির প্রবেশ ঘটে এবং জন্ম নেয় এক বিশেষ খাদ্যসংস্কৃতি যাকে আজ আমরা ‘ঢাকাই খাবার’ নামে জানি। কিন্তু ঢাকার খাবারের মধ্যে ঔপনিবেশিক শাসনের উপাদানগুলোও উপেক্ষা করার মতো নয়। বিশেষ করে নানা ধরনের সবজির আমদানি, যেগুলো পর্তুগিজদের হাত ধরে এদেশে এসেছিল, যেমন – আলু, টমেটো, বিভিন্ন ধরনের কপি ইত্যাদি। এভাবে খাদ্যাভ্যাস কোনো জনগোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক জীবনকেও প্রভাবিত করে। আবার মোগলাই খাবার বলতে আমরা যে একধরনের খাবারের কথা বুঝি, তার মধ্যেও লুকিয়ে থাকে বিশ্বের নানা প্রান্তের খাদ্যসংস্কৃতির উপাদান, যা চট করে নজরে পড়ে না। যেমন অন্নদামঙ্গল কাব্যে আমরা দেখছি –

কচি ছাগ মৃগ মাংসে ঝোল ঝাল রসা

কালিয়া দোল্মা বাঘা সেকিচ সমসা

অন্য মাংস শিক ভাজা কাবাব করিয়া

রান্ধিলেন মুড়া আগে মসলা পুরিলা।

এখানে যে দোলমার কথা পাচ্ছি তার উৎস কিন্তু আর্মেনিয়া ও সন্নিহিত অঞ্চলে। বাদশা আকবরের সময় থেকেই আর্মেনীয়রা মোগল দরবারে প্রতিপত্তি লাভ করে এবং তাদের খাবার ঢুকে পড়ে মোগলাই রন্ধন-সংস্কৃতিতে। অবশ্য সেই আলাদা উৎস হারিয়ে তা আজ মিশে গেছে মোগলাই খাবারের পরিচয়ে। এখানেই খাদ্যসংস্কৃতি চর্চার গুরুত্ব।

যাই হোক, দরবারি খাবার ছেড়ে আমরা না হয় শুরু করি আমাদের আটপৌরে ডাল আর ভাতের গল্প থেকেই।

দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিস্তীর্ণ অঞ্চলে সাধারণ মানুষের মূল খাদ্য ভাত। গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার এই ভূখণ্ডও সেই নিয়মের ব্যত্যয় নয়। এই এলাকায় আবহমানকাল ধরে চাষ হয়ে এসেছে বিভিন্ন প্রজাতির ধান। সেই ধান থেকে চাল তৈরি করে বাঙালি ভরিয়ে তুলেছে নিজের খাদ্যবৈচিত্র্য।

টোডরমল বাংলার ভূমিব্যবস্থার সংস্কার করার পর দেখা গেল যে, পূর্ববঙ্গের ‘ভাটি’ অর্থাৎ নদীব্যবস্থার নিম্ন অববাহিকা অঞ্চলের কৃষি উৎপাদন ও জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার তৎকালীন পশ্চিম বাংলা থেকে অনেক অনেক বেশি। বস্তুত এর জন্য কৃতিত্ব মোগল সম্রাটের থেকে বেশি দাবি করতে পারেন প্রকৃতি। দীর্ঘ সময় ধরে বাংলার প্রধান নদীগুলোর পূর্বদিকে ধারাবাহিকভাবে সরে সরে যাওয়ায় জমিতে উর্বর পলি জমে ধান চাষের পক্ষে আদর্শ পরিস্থিতি তৈরি হয়। ভূগোলবিদরা সাধারণত নদীর এই সরে যাওয়াকে স্বাভাবিক অধঃক্ষেপণ (sedimentation) প্রক্রিয়ার ফল বলে ব্যাখ্যা করেন। নদীর মোহনায় পলি জমার ফলে ধীরে ধীরে গড়ে উঠতে থাকল এক-একটি বদ্বীপ। ক্রমে এই পলি জমতে জমতে বদ্বীপ অঞ্চলটি দক্ষিণ দিকে বঙ্গোপসাগরের মধ্যে বাড়তে লাগল। অন্যদিকে নদী-পরিবাহিত বেশ খানিকটা পলি জমা হচ্ছিল নদীর বুকেই। ফলে নদীর নাব্য কমে একসময় নদীগর্ভ আশপাশের জমি থেকে উঁচু হয়ে গেল। ফলে পুরনো নদীর খাত থেকে সরে এসে জল প্রবাহিত হতে থাকল কাছাকাছি অন্য চ্যানেলগুলো দিয়ে। এইভাবে গঙ্গার মূল স্রোত, যা একসময় ভাগিরথী-হুগলী ধরে বয়ে যেত, তা এক সময়ে চলে গেল ভৈরব, মাথাভাঙ্গা, গড়াই-মধুমতী, আড়িয়াল খাঁ হয়ে এবং ক্রমে থিতু হলো পদ্মা-মেঘনার খাতে।

গঙ্গার মূল স্রোত এবার যে উর্বর পলির ভাণ্ডার বয়ে নিয়ে আসতে থাকল, তার সিংহভাগ ছড়িয়ে পড়তে লাগল বাংলার  পূর্ব অংশে। ফলে আরো ব্যাপক ও বিস্তীর্ণ এলাকায় কৃষিকাজ, বিশেষ করে ভিজে মাটির ধান চাষ (wet rice cultivation) সংঘটিত করে তার থেকে উৎপন্ন সমৃদ্ধি ঘরে তোলার সুযোগ বেশি করে পেতে শুরু করল পূর্ববঙ্গ। সামগ্রিকভাবে মানুষের ঢল আর বদ্বীপের উন্নয়ন এক পূর্বমুখী খাতে প্রবাহিত হতে থাকল। নদীব্যবস্থার এই দিক পরিবর্তনের ফলে পূর্ববঙ্গের সঙ্গে উত্তর ভারতের সরাসরি যোগাযোগের সুযোগ সৃষ্টি হলো। এই নৌপথে পূর্ববঙ্গ থেকে উত্তর ভারতে যাতায়াত ও পণ্য-পরিবহন সুগম হয়ে গেল। ফলে ভৌগোলিক নৈকট্যের সঙ্গে সঙ্গে মোগল সাম্রাজ্যের অন্যান্য অংশের সঙ্গে বাংলার রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক একীকরণ সহজতর হলো।

রাজধানী ঢাকার গুরুত্ব যেমন বাড়ল, তেমনি চাল বা ভাত শুধু খাদ্য নয়, হয়ে উঠল সমৃদ্ধি ও সংস্কৃতির গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। ঢাকার খাদ্যসংস্কৃতিতেও বেশ উঁচু আসন পেয়ে গেল সে। বিরিয়ানির জনপ্রিয়তা অনেক পরের কথা। সাদা জুঁই ফুলের মতো ঝরঝরে সুগন্ধি ভাতের সঙ্গে সে-আমলে ঘি-ভাত আর পোলাও কদর পেত উৎসব বা পার্বণের খাদ্যতালিকায়। পোলাওয়ের ইতিহাস বেশ গোলমেলে। ল্যাজা-মুড়োর জটলা ছাড়ানো বেশ মুশকিল। ভারতীয় উপমহাদেশ থেকে পশ্চিম এশিয়া, মধ্য এশিয়া থেকে পূর্ব আফ্রিকা, ইউরোপ থেকে আমেরিকা – নানা দেশে নানা নামে পোলাওয়ের ইতিহাস পাওয়া যায়। তবে, পণ্ডিতেরা মোটামুটি মেনে নিয়েছেন যে, পোলাও রান্নার প্রণালি প্রথম লিপিবদ্ধ করেন বিখ্যাত চিকিৎসক ও দার্শনিক আবু ইবনে সিনা। উপমহাদেশের অন্যান্য জায়গায় আখনীর পোলাও যে আধিপত্য নিয়ে বিরাজ করে, ঢাকায় সেই একচ্ছত্র শাসনের ওপর অনেকটা ভাগ বসিয়েছে মুর্গা পোলাও। মোরগের মাংসের টুকরোগুলো ঘি আর চালের সঙ্গে মিলেমিশে তৈরি করত এক অদ্ভুত আবেশ। এছাড়া ঢাকার পোলাও-বিলাসের তালিকায় রয়েছে মাছের পোলাও, ডিমের পোলাও বা বুন্দিয়া পোলাও – যেখানে মটরদানা আকারের মাংসের কোফতা ব্যবহার করা হয়। পোলাও বিরিয়ানি বাদ দিয়ে ঢাকার তেহারির কথা আলাদা করে উল্লেখ করতে হয়, চাল আর মাংসের মিশেলে তৈরি পদগুলির তালিকায়।

সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সংস্কৃতির ধারার বদল হয়েছে অনেক। তবে পোলাওয়ের সঙ্গে সঙ্গে অন্নসংস্কৃতির অংশ হিসেবে আমনি আর পান্তার কথাও বলতে হয়। এই ঝরঝরে সাদা ভাতের সঙ্গে বাংলার মানুষ কাদা কাদা ভাতও খেত। আবার নিরন্ন দরিদ্র বাঙালির জুটত শুধু আমনি, মানে পান্তা ভাতের জল আর খুদের জাউ। বাংলা সাহিত্যে সেই ইতিহাস লিপিবদ্ধ করে গেছেন আমাদের কবিরা। কবিকঙ্কনের অন্নদামঙ্গল কাব্যে কালকেতুর ভোজনের বর্ণনায় আমরা পাচ্ছি।

এক শ্বাসে সাত হাঁড়ি আমানি উজাড়ে

চারি হাঁড়ি মহাবীর খায় খুদ-জাউ

আবার এই ধারায় যুক্ত হয়েছে নতুন নতুন পদ, যেমন নববর্ষ বরণে পান্তা ও ইলিশ খাওয়ার রেওয়াজ। এই রেওয়াজ খুব পুরনো নয়। হালে শুরু হয়েছে। কিন্তু এর মধ্যেই বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে এই প্রথা। যদিও এই প্রথার ফলে ইলিশ সংরক্ষণের ওপর কী প্রভাব পড়ছে, সেটা ভেবে দেখা দরকার।

ভাতের পর খানিক ডালের কথা বলি। নিতান্ত আটপৌরে ডাল-ভাত খাওয়ার অভিধায় যে-ডালের কথা আজ আমরা বলে থাকি, সেই ডাল কিন্তু প্রাচীন বাঙালির খাদ্যতালিকায় নেই বলে জানিয়েছেন নীহাররঞ্জন রায়। এখানে ডাল চাষ করার উল্লেখও তিনি খুঁজে পাননি মধ্যযুগের আগে। মধ্যযুগে ডাল এলো বটে, তবে সেটা অভিজাত শ্রেণির খাদ্য হিসেবেই প্রবেশ করল বাঙালির খাদ্যতালিকায়। নীহাররঞ্জন রায় বরিশাল ও ফরিদপুর অঞ্চলে সাবেক প্রথা হিসেবে শেষ পাতে ডাল খাওয়ার কথা মনে করিয়ে দিয়ে বোঝাতে চেয়েছেন যে, এই বস্তুটির দাম ও মান – দুটোই ছিল উচ্চ কোটির। তাই খাবার শেষে খাওয়ার চল হলো। সেকালে ভাতের সঙ্গে ডাল মেখে খাওয়াটাও ছিল বিলাসিতা। আর তেমনটা হবে না-ই বা কেন! মোগল আমলে বাদশাহী হেঁসেলে ডালের প্রতি পক্ষপাতিত্ব ছিল সুপরিচিত। জাঁকজমকপ্রিয় জাহাঙ্গীরের প্রিয় লাজিজাহ নামে জোয়ার, চাল ও ডাল দিয়ে গুজরাটি কায়দায় রান্না করা খিচুড়ি হোক কিংবা কৃচ্ছ্রসাধনে অভ্যস্ত আওরঙ্গজেব আলমগীরের প্রিয় খাদ্য ছোলার ডাল আর চাল দিয়ে তৈরি কুবুলি অথবা তাঁর ভাই শাহজাদা মুরাদের প্রিয় মোরাদাবাদী ডাল, এমন বহু উদাহরণ রয়েছে। ঢাকায় খাদ্যসংস্কৃতির কথা ডালসমৃদ্ধ খিচুড়ি আর হালিম বাদ দিয়ে হতেই পারে না। বর্ষায় খিচুড়ি আর ঈদের হালিম ছাড়া ঢাকার খাবারের তালিকা রংহীন।

ডালে আর চালে তৈরি খিচুড়ির কথা বাঙালির খাদ্য-আলোচনার প্রসঙ্গে অবশ্যই আসবে। এই one-pot meal সাধারণত যাত্রাপথের খাবার হিসেবে জন্ম নিয়েছে। তীর্থযাত্রীদের জন্য সবচেয়ে কম ঝামেলার খাবার যেমন খিচুড়ি, তেমনি যুদ্ধ-অভিযানে আগুয়ান সেনাবাহিনীর জন্যও খিচুড়ি পরিবেশিত হয়েছে। মনসামঙ্গল কাব্যে আছে ডাবের জল দিয়ে রান্না করা মুগের ডালের খিচুড়ি খেতে চেয়েছিলেন পার্বতীর কাছে স্বয়ং শিব। কৈলাসে তো নারকেলগাছ নেই যে ডাব পাওয়া যাবে! মনসামঙ্গলের লেখক বিজয় গুপ্ত ছিলেন বরিশালের মানুষ। যেখানে নারকেল ও ডাব সহজলভ্য। ফলে বিজয় গুপ্তের কল্পনায় শিব যে ডাবের জল দিয়ে রান্না করা খিচুড়ি খেতে চাইবেন, সে আর আশ্চর্য কী!

প্রজ্ঞাসুন্দরী দেবী তাঁর বিখ্যাত রান্নার বই আমিষ ও নিরামিষ আহারে জানিয়েছেন যে, ‘সৈন্যের গুণে যেমন সেনাপতির খ্যাতি বর্ধিত হয়, সেই রূপ আনুষঙ্গিক খাদ্যের গুণে প্রধান খাদ্য সমধিক রুচিকর হইয়া ওঠে। খিচুড়ির এই আনুষঙ্গিক খাদ্যের মধ্যে তখনো প্রধান হলো ইলিশ। আরো নির্দিষ্ট করে বললে ইলিশ ভাজা। গলা খিচুড়ি আর ভুনা খিচুড়ি উভয়ই বাঙালির অন্যতম প্রিয়।’ খিচুড়ির সঙ্গে পরিবেশিত আনুষঙ্গিক খাদ্যগুলো ঢাকার নিজস্ব ঐতিহ্যের স্বাক্ষর।

সেই ঐতিহ্যের ধারা টিকিয়ে রেখে খিচুড়ি পরিবেশনের জন্য ঢাকার সাধারণ মানুষ থেকে নামজাদা রেস্তোরাঁ সকলেই প্রস্তুত। আলু ভর্তা, কালিজিরা ভর্তা, সরিষা ভর্তা ও বেগুন ভর্তা থাকবে প্লেটের চারপাশে সাজানো। সঙ্গে অর্ধেক ডিম ভাজি। খিচুড়ির জন্য আলাদা পরিচিতি পাওয়া দোকানের অস্তিত্বও লুকিয়ে আছে এই ঢাকা শহরে। পুরান ঢাকার মাহুতটুলীর ভুনা খিচুড়ি বা গুলশান ১ নম্বরের বিন্নি চালের খিচুড়ির কথা এই সূত্রে মনে পড়ে। চিনিগুঁড়া চাল ও মুগের ডাল দিয়ে রান্না করা ভুনা খিচুড়ি খাসির মাংস দিয়ে পরিবেশন করা হয়। আর বিন্নি চালের খিচুড়ি পরিবেশিত হয় খাসি, গরু, হাঁস বা মুরগির মাংসের সঙ্গে। মুন্সীগঞ্জ এলাকায় খুদ দিয়ে ভাত বা খিচুড়ি বেশ প্রচলিত। স্থানীয়ভাবে তা পরিচিত ‘বউয়া ভাত’ নামে। সেই স্থানীয় আঞ্চলিক পদও সমৃদ্ধ করেছে রাজধানী ঢাকার খিচুড়ির মেন্যুকে।

হালিম আরবীয় খাদ্য। বিশ্বের সবচেয়ে প্রাচীন আরবীয় স্বাদের রেসিপি বই কিতাব-আল তাবিকে হালিম খাদ্যের কথা উল্লেখ আছে। হালিমের আগমন মোগল আমলেই। সম্রাট শাহজাহানের আমলে বাচ্চা খাসির মাংস, মসলা, লেবুর রস ও গমের সাহায্যে এক ধরনের খাবার তৈরি হতো, যা ছিল আধুনিক হালিমের পূর্বসূরি। ঢাকায় রমজান ও মহররম উপলক্ষে বাড়িতে বাড়িতে হালিম তৈরির রেওয়াজ রয়েছে। দীর্ঘ উপবাসের সময় প্রয়োজনীয় পুষ্টির জোগান দিতে হালিমের ওপর ভরসা রাখে মানুষ।

হালিম তৈরিতে গমের ভাঙা অংশ পোলাওয়ের চাল, গরু বা খাসির মাংস এবং নানান পদের মসলার সংমিশ্রণে অল্প আঁচে প্রায় আট-নয় ঘণ্টায় হালিম তৈরি করা হয়ে থাকে। হালিমের সাথে লেবু, পুদিনা, কাঁচা লংকা, ধনেপাতা কুঁচি এবং ভাজা পেঁয়াজের চূর্ণ মিশিয়ে আরো উপাদেয় করা হয়।

শুরু করেছিলাম মগ ও পর্তুগিজ জলদস্যুদের দমন করার লক্ষ্য নিয়ে ইসলাম খাঁ’র বুড়িগঙ্গার কূলে নৌবহর ভেড়ানো দিয়ে। ফিরে আসি তাদের গল্পে। আরাকান অঞ্চলের অধিবাসীদের সঙ্গে মোগল বাহিনীর সংঘর্ষ স্থায়ী হয় দীর্ঘদিন। মোগল আমল পেরিয়ে বাংলা তথা সমগ্র উপমহাদেশে শাসন বিস্তার করল ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। উনিশ শতকে আরাকান সর্দার কিং ব্রিং তাঁর পঞ্চাশজন অনুগামী নিয়ে ব্রিটিশদের আশ্রয় প্রার্থনা করেন। সরকারের পক্ষ থেকে তাদের মাসে বারো টাকা ভাতা এবং থাকার জায়গা দেওয়া হয়। সেই জায়গা ক্রমে পরিচিত হয় ঢাকার মগবাজার নামে। এই মগদের কাছেই লুকোনো আছে ঢাকার সাবেক অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান খাদ্যের উত্তরাধিকার।

এদেশে এসে সাহেবদের সব থেকে বড় সমস্যা হতো এখানকার খাবারের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়া। একে তো বিলেতের সাধারণ রান্নার উপকরণ পাওয়া যায় না। তার ওপর এমন রাঁধুনি পাওয়াও সমস্যা হয়, যারা সব ধরনের মাংসই রান্না করবে। তেমন রন্ধনশিল্পীর খোঁজ পাওয়া গেল মগদের মধ্যে। পর্তুগিজ ও মগদের মধ্যে সাংস্কৃতিক আদান-প্রদান হওয়ার ফলে মগেরা শিখে নেয় অনেক ইউরোপীয় রান্নার কায়দা। মগ খানসামারা শুধু যে সব রকমের মাংস রান্না করতেন তাই নয়, তাঁরা সিদ্ধহস্ত ছিলেন বিলিতি উপকরণের দেশি বিকল্প খুঁজে সাহেবের দেশের খাবারের স্বাদ ফিরিয়ে দেওয়ায়ও। এই মগ খানসামাদের হাত ধরেই চপ কাটলেট ঢুকে পড়ে ঢাকার খাদ্যসংস্কৃতিতে। পুরনো ঢাকার কিছু খাবারের দোকানে এখনো দেখা মেলে এই ঘরানার কিছু পদের। যেমন বাংলাবাজার পার হয়ে প্যারীদাস রোডে লালকুঠির ঠিক আগের মোড়ের কাছে ‘কাফে কর্নার’। এখানে পাওয়া যায় ক্রাম্ব চপ। খাসির মাংস দিয়ে তৈরি এই চপ এখনো সমান জনপ্রিয়। যদিও মেন্যুতে লেখা আছে ‘ক্রাম্প চপ’। খাসির মাংসের কিমার সঙ্গে মরিচ-পেঁয়াজ-ধনেপাতা-পুদিনাপাতা মিশিয়ে ভিনিগারে ভিজিয়ে রাখার পর জল ঝরিয়ে ডিমে চুবিয়ে খুব করে বিস্কুটের গুঁড়ো মাখিয়ে ডুবো তেলে বাদামি করে ভেজে নেওয়া হয় এই চপ। বিস্কুটের গুঁড়ো মাখানো থেকেই এর নাম হয়েছে ক্রাম্ব চপ। ক্রাম্ব চপের পাশাপাশি ফিশ ফ্রাই, চিংড়ি ফ্রাই, কিমা-আলুর চপ, কাটলেট, চিকেন ফ্রাইও পাওয়া যায়। এখানে উল্লেখ্য যে, এই ধরনের দোকানগুলি শুধু খাবার জায়গা হিসেবেই নয়, সমকালীন বুদ্ধিজীবীদের আড্ডার কেন্দ্র হিসেবেও জনপ্রিয় ছিল। এইভাবে খাদ্য ও সংস্কৃতি এগিয়ে চলত হাতে হাত ধরে।

ঢাকার অন্যতম ম্যাস্কট বা আইকন পিঠা বহন করে আসছে এক প্রাচীন সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য। চালের মণ্ড থেকে পিঠা তৈরির এই   সংস্কৃতি উপমহাদেশের  প্রাচীনতম   খাদ্যগুলোর    অন্যতম।   তবে ঢাকা এবং সন্নিহিত অঞ্চলে শিল্পসৌকর্যের যে-উচ্চতায় পৌঁছে গেছে পিঠা, তার তুলনা মেলা ভার। শীতে পিঠা খাওয়ার রীতি হয়ে উঠেছে বাঙালি সংস্কৃতির অংশ। ঢাকায় টাটকা খেজুরের রস দিয়ে পিঠা খাওয়ার শখ মেটানো একটু দুরূহ হলেও ভাপা আর চিতই পিঠা পাওয়া যায় সহজেই। শীতের শুরু থেকেই ঢাকার বাতাস ম-ম করে ওঠে পিঠার সুবাসে। বাড়িতে বাড়িতে শুরু হয়ে যায় পিঠা-পার্বণ। রাজধানীর কারওয়ান বাজার, গুলিস্তান, পল্টন, বেইলি রোড, ফার্মগেট, মিরপুর, উত্তরাসহ বিভিন্ন স্থানে বসে যায় পিঠার দোকান। সন্ধ্যার সময় মানুষজন এসব দোকানে পিঠা খেতে ভিড় জমায়। অনেকে নিয়ে যায় প্রিয়জনের জন্য। ভাপা ও চিতই পিঠার জনপ্রিয়তাই সর্বাধিক। নারকেল আর খেজুর গুড়ে তৈরি ভাপা পিঠার সঙ্গে এই দোকানগুলোতে পাওয়া যায় পাটিসাপটা, চাঁদপুলি, মালপোয়া, দুধচিতই, বিবিখানা, চাপড়ি, মুগ পাক্কন, নারকেল পুলির মতো নানা রকমের পিঠা। একটানা মিষ্টি খাওয়ার পর মুখে স্বাদ ফেরাতে সরিষা ও শুঁটকির হরেক পদের ভর্তাসহ চিতই পিঠার সম্ভার হাজির হয় ক্রেতার সামনে। ঢাকায় পিঠার জনপ্রিয়তার আন্দাজ পাওয়া যায় বিভিন্ন পিঠা উৎসবের ভিড় থেকে, যার আয়োজন আজকাল পাঁচতারা হোটেলেও করা হচ্ছে।

ঢাকার খাদ্য-ঐতিহ্যকে বিশেষ মর্যাদার আসনে বসিয়েছে যে-খাবারগুলো, তার মধ্যে বিখ্যাত বাখরখানি রুটির কথায় আসা যাক। বাখরখানির একটি রকমফের পাঞ্জাবের কাশ্মিরি নান বিক্রেতাদের কাছে পাওয়া যায়। ইতিহাসের কষ্টিপাথরে যাচাই করলে এই সিদ্ধান্ত নিতে হয় যে, ঢাকার বাখরখানির উৎস কাশ্মিরিদের হেঁসেল, যা মোগল আমলে আরো নানা খাদ্যসম্ভারের সঙ্গে সুবে বাংলার রাজধানীতে প্রবেশ করে। গুরুত্বপূর্ণ প্রাদেশিক রাজধানী হওয়ার সুবাদে কাশ্মিরি জনগোষ্ঠীর ঢাকায় আস্তানা নেওয়ার ইতিহাস বেশ পুরনো। কাশ্মিরিটোলা এলাকায় ছিল তাদের বাস। কাশ্মির এই রুটির উৎস হলেও স্থানীয় কারিগররা ঢাকার বাখরখানিকে তার বৈশিষ্ট্য দিয়েছেন, গড়ে তুলেছেন তার নিজস্বতা। বাংলা সংস্কৃতির অন্দরমহলে বাখরখানির স্থানটি বোঝা যায় প্রতুল মুখোপাধ্যায়ের গানেও তাকে উঁকি দিতে দেখি –

আলু বেচো, ছোলা বেচো, বেচো বাখরখানি

বেচো না বেচো না বন্ধু তোমার চোখের মণি।

ঢাকা ও কাশ্মির ছাড়াও লখনৌ ও পাকিস্তানের কিছু জায়গায় বাখরখানি রুটির দেখা মেলে। তবে তাদের প্রত্যেকের চরিত্র আলাদা। ঢাকার প্রকৃত বাখরখানি রুটি তৈরি হতো খাঁটি ঘি, দুধ, ময়দা, মাওয়া, খমির দিয়ে। সঙ্গে যোগ হতো বিভিন্ন রকম মাংস, পনির, চিনি, ছানা, নারকেল। উনিশ শতকের চল্লিশের দশকে প্রকাশিত হাকিম হাবিবুর রহমান তাঁর Dhaka Pachash Barash Pahley গ্রন্থে ঢাকার বিভিন্ন খাদ্যদ্রব্য তৈরি সম্পর্কে বিস্তারিত বর্ণনা দিয়েছেন। তিনি প্রধানত গও জোবান, শুকি এবং নিমশুকি – তিন ধরনের বাখরখানির কথা বলেছেন। চিনশুখা রুটিও একপ্রকার বাখরখানি, যা বিশেষত চিনি দিয়ে তৈরি করা হয়।

ফার্সি অভিধান ঘেঁটে দেখা যায় যে, ‘বাখর’ শব্দটির অর্থ ‘ফ্লেভার্ড’ অর্থাৎ সুরভিত। এর থেকে আন্দাজ করা যায় যে, ঢাকার বিখ্যাত সুগন্ধিত রুটিকে বাখরখানি বলা হতো। এর সঙ্গে হয়তো আগা বাখর আর খনি বেগমের প্রেমকাহিনির উৎস খুঁজতে যাওয়া কল্পনাপ্রবণতার নামান্তর। কিন্তু খাদ্য-ইতিহাসের চর্চা থেকে কিংবদন্তি আর রূপকথাকে পুরোপুরি আলাদা করা যায় না, কারণ দেশের এক বৃহৎ জনসংখ্যার কাছে খাবার আজো রূপকথাই রয়ে গেছে।

পুরনো আমলের কথা থাক। আজকের বাখরখানির কথায় আসি। এখন বাখরখানি তৈরি হয় ময়দা, চিনি, বনস্পতি তেল ও লবণ দিয়ে। বাখরখানি আরো সুস্বাদু করতে ময়দার সঙ্গে পনির, ছানা ও মাংস মেশানো হয় অনেক সময়।

পুরনো ঢাকার চানখাঁরপুল পার হয়ে নাজিমুদ্দিন রোডের দুপাশে পরপর কয়েকটি দোকান আজো ধরে রেখেছে ঢাকার এই ঐতিহ্য। এছাড়া লক্ষ্মীবাজার, তাঁতীবাজার ও লালবাগেও কিছু বাখরখানির কারিগর ও দোকান রয়েছে। আগে অসংখ্য পদের বাখরখানি পাওয়া যেত। বর্তমানে মিষ্টি বাখরখানি, নোনতা বাখরখানি, পনির বাখরখানির কয়েকটি রকমফের পাওয়া যায়। এছাড়া ঢাকার অভিজাত কনফেকশনারিতে এখন বাখরখানি প্যাকেজড রূপে পাওয়া যায়।

খাবারের কথা অনেক হলো। এবার একটু খাবারের জায়গার কথা বলি। সব শহরেই কিছু ঐতিহ্যশালী হোটেল বা রেস্তোরাঁ রয়েছে, যাদের স্থাপত্যে সেই শহরের সমাজ-সংস্কৃতি ও ইতিহাসের নানা বিবর্তনের কথা নিরুচ্চারে লেখা থাকে। ঢাকার অস্তিত্বের সঙ্গে বুড়িগঙ্গা নদীর নাড়ির টান। এই নদীর কথা বাদ দিয়ে ঢাকার কথা বলা যায় না। আর তার খাদ্যসংস্কৃতি নিয়ে বলতে গেলে ঢাকার অধুনালুপ্ত ভাসমান হোটেলের খাবারের কথা এসেই যায়।

ঊনবিংশ শতকের মাঝের দিকেও ঢাকায় থাকার হোটেল বিশেষ ছিল না। কাজকর্মে বাইরের মানুষদের রাত্রিবাসের সমস্যা ছিল। কয়েক দশকের মধ্যে কিছু হোটেল গড়ে উঠল, কিন্তু প্রয়োজনের তুলনায় নিতান্তই অপ্রতুল। ঢাকার মানুষ এই সমস্যার সমাধান বের করলেন নিজস্ব উদ্ভাবনী শক্তি দিয়ে। তৈরি হলো বুড়িগঙ্গার তীরে ‘ভাসমান হোটেল’।

কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, দূর-দূরান্ত থেকে আগত ক্ষুদে ব্যবসায়ী, মামলা-মোকদ্দমাকারী ও সরকারি কর্মচারীরা কোনো কাজে ঢাকা এলে হোটেল বা ভাড়া বাসার বিকল্প হিসেবে বজরা নৌকায় বসবাস করতেন। বুড়িগঙ্গার পাড়ে প্রথম হোটেল নির্মিত হয় ১৮৭৫ সালে। আইনজীবী হৃদয়নাথ মজুমদার (১৮৬৪-১৯০৫) ঢাকায় অবস্থানকালে লিখেছেন, ‘ভাসমান হোটেলে হাজার হাজার বহিরাগত রাত কাটাত।’ স্বাস্থ্যগত কারণেও অনেকে বজরা নৌকায় বসবাস করত। বজরা নৌকার এই নৌ-হোটেল জনসাধারণের কাছে গ্রিন বোট হিসেবেও পরিচিত ছিল।

শিল্পী রফিকুন নবীর (রনবী) স্মৃতিচারণ থেকে যে-বজরার বর্ণনা পাওয়া যায় তার নাম ছিল ‘পিনিস’। এর মধ্যে রেস্টুরেন্ট ছিল অনেকগুলো। কোনো কোনোটি ছিল ‘মুসলিম হোটেল’ নামে। আবার পাশাপাশি কোনোটি ছিল আদর্শ ‘হিন্দু হোটেল’।

এ-সবের খাবারের দারুণ সুনাম ছিল। কয়েকটির খ্যাতি ছিল আকাশচুম্বী। লাইন ধরে অপেক্ষায় থাকতে হতো প্রায়ই। হিন্দু হোটেলগুলোর নিরামিষ-ভাজি, মাছ (বিশেষ করে কই, মাগুর আর ইলিশ, আর ঘন ডাল ছিল সবচাইতে মুখরোচক। মুসলিম হোটেলগুলো বিখ্যাত ছিল গরুর মাংস, খাসি আর মুরগি রান্নার জন্য। মুখে চোঙা লাগিয়ে গ্রাহক ডাকত মেন্যু বলে বলে। হাঁক ছাড়ত ছড়া কেটে –

ইলিশ ভাজা বড় কই, খাওইনারা গেলো কই?

আহেন আহেন আহেন, বহেন বহেন বহেন।

ভাসমান হোটেলগুলোর মধ্যে অনেকগুলো ছিল ভাওয়ালের রাজা, রূপলাল বাবু, নরেন্দ্র নারায়ণ রায় বা মদনমোহন কুণ্ডুর মতো বিভিন্ন অভিজাত মানুষের ব্যক্তিগত বজরা। তাঁদের সম্মানের প্রতীক। দেশভাগের পর সেই সব বজরা মালিকানা হস্তান্তর হয়ে মেস ও বোর্ডিংয়ে রূপান্তরিত হয়। সত্তরের দশকে হোটেলগুলোতে থাকার ব্যবস্থা ছিল কেবিনে। কেবিনের বাইরে ছিল খাবার জায়গা। থাকার জন্য হোটেল কর্তৃপক্ষকে কোনো টাকা দিতে হতো না। শুধু খাবার বিল দিলেই চলত। পরবর্তীকালে ভাড়ার হার নির্ধারিত ছিল ১ টাকা।

সময়ের বিবর্তনে এখন আর খাওয়ার ব্যবস্থা নেই। আছে শুধু থাকার ব্যবস্থা। একসময় যে ভাসমান হোটেলগুলোর প্রধান খদ্দের ছিল অভিজাতরা, বর্তমানে তা শুধু নিম্নবিত্ত-শ্রমজীবী মানুষের মেস-জীবনে পরিণত হয়েছে।

মানুষের মূল চাহিদাগুলোর মধ্যে অন্যতম, খাদ্য শুধু উদরপূর্তির উদ্দেশ্য ছাড়িয়ে আজ সংস্কৃতির এক অংশ হিসেবে গড়ে উঠেছে। ঢাকার মতো প্রাচীন শহরের খাদ্য সংস্কৃতির ওপর ছাপ রেখে গেছে তার ইতিহাস। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তার মানচিত্রে যেমন বদল এসেছে, তেমনি বদলেছে তার সংস্কৃতি। খাদ্যসংস্কৃতিতেও এই পরিবর্তনের ছাপ পড়েছে। নানা সময়ে নানা জনগোষ্ঠীর প্রভাবে এক প্রবহমান গ্রহণ-বর্জন প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে আজকের চেহারায় এসেছে ঢাকার খাবার। কিন্তু দেখা যায় যে, নগর সভ্যতার উৎকর্ষলাভের পথে হাজার পরিবর্তনেও ঢাকার খাবারের সংস্কৃতিতে তার মূল নবাবি আমলের সুরটি কিন্তু বজায় রয়েছে। সেটি থেকেছে তার সুপ্রাচীন ঐতিহ্যের প্রতি শ্রদ্ধাশীল।

টীকা

১.  মুর্গা পোলাও https://dhakaritihas.com/dhakar-polao/

২.  খিচুড়ি, প্রজ্ঞাসুন্দরী https://irabotee.com/banglarkhawa/

৩. খিচুড়ি https://www.prothomalo.com/lifestyle/recipe/ এখন-তো-সময়-খিচুড়ির।

৪.  ক্রাম্ব চপ https://www.prothomalo.com/bangladesh/কাফে-কর্নারের-মুচমুচে-ক্রাম্ব-চপ।

৫. পিঠা https://www.prothomalo.com/lifestyle/recipe/শীতের-পিঠা-হাতের-নাগালেই।

৬. বাখরখানি – https://www.prothomalo.com/lifestyle/recipe/ পুরনো-ঢাকার-ঐতিহ্য-শত-বর্ষের-স্বাদ-নিয়ে-মুচমুচে-বাখরখানি।

৭. http://bn.banglapedia.org/index.php?title = বাখরখানি। ৮. ভাসমান হোটেল – https://www.banglanews24.com/cat/news/bd/268674.details.