বিষয় : কাব্যনাটক

অভিমুখ

বিষয় ও আঙ্গিক – সব শিল্পকর্মের প্রধান দুটি দিক। কাব্যনাটকে বিষয়ের ক্ষেত্রে কোনো নির্দিষ্টতা নেই, যে-কোনো বিষয় নিয়েই কাব্যনাটক রচিত হতে পারে। এর উদাহরণ সব যুগের কাব্যনাটকেই বিদ্যমান। গ্রিসীয়-ফরাসি-এলিজাবেথীয়-সংস্কৃত-মৈমনসিং গীতিকা বা পরবর্তীকালের এশিয়া-আফ্রিকা-ইউরোপের কাব্যনাটকে নানা বিষয়ই স্থান পেয়েছে – মিথকথা-রূপকথা-উপাখ্যান-পৌরাণিক কাহিনি-উপকথা-ধর্মকথা-লোকগাথা-সমাজপ্রসঙ্গ প্রভৃতি অগ্রাধিকার পেয়েছে বিষয় হিসেবে।

তবে কাব্যনাটকের আঙ্গিকের ক্ষেত্রে কিছুটা নির্দিষ্টতা দেখা যায়। নাট্যক্রিয়া-কাব্যবোধ-কাব্যালংকার-ছন্দ ইত্যাদি থাকতেই হবে। শুধু কাব্যবোধ প্রকাশিত হলেই কাব্যনাটক বলা যাবে না – তৎসঙ্গে নাট্যক্রিয়ার সংমিশ্রণ ঘটাতেই হবে। তাহলেই তা কাব্যনাটক পদবাচ্য হয়ে উঠবে, নচেৎ নয়। কাব্যনাটক বা নাটক – দুটোই লিখিত টেক্সট তথা ড্রামা বা পেস্ন, যা একজন নাটককার লিখে থাকেন। আর নাট্য বা থিয়েটার হচ্ছে সেই ‘লিখিত টেক্সট’কে মঞ্চে পরিবেশন করার একটি প্রক্রিয়া যেখানে দরকার হয় মঞ্চ বা স্থান, পাত্র তথা অভিনয়শিল্পী, উপকরণ তথা সেট, প্রপস, কস্টিউম, মেকআপ, আলো, আবহসংগীত ইত্যাদি। আর দর্শক। কাব্যনাটকে, নাটকের আঙ্গিক বা কাঠামোটি থাকতেই হবে। নাটক সম্পর্কে লেখা হয়েছে :

ক. Drama is the art of make-believe. (…) The primary ingredients of drama are characters, represented by players; action, described by gestures and movement; thought, implied by dialogue and action; spectacle, represented by scenery and costume; and, finally, audience, who respond to this complex mixture.1

খ. A play written in prose or verse that tells a story through dialogue and actions performed by actors impersonating the characters of the play.2

গ. Aristotle categorized drama into the following six elements, which are listed here in their order of importance as he viewed them : Plot, Character, Thought, Diction, Music and Spectacle.3

 

আর নাট্য সম্পর্কে লেখা হয়েছে :

ক. The theatre is also the most complex of the arts, since in a single production it utilizes many creators Ñ the actor, the playwright, the director, the scene designer, the costumer, the light designer, the choreographer, the musician. This complexity has led many to call the theatre a mixed art since it usually combines the written word of the literary artist, the visual background of the architect and painter, the speech and movement of the actor, the music of the composer and the dance patterns of the choreographer.4

 

উপর্যুক্ত উদ্ধৃতিসমূহে নাটক ও নাট্য সম্পর্কে যা বলা হয়েছে তা হচ্ছে – নাটকে চরিত্র থাকবে, যে-চরিত্রে অভিনয়শিল্পী অভিনয় করবেন; নাট্যক্রিয়াও থাকবে যা অভিনয়শিল্পীদের অঙ্গভঙ্গি-চলাফেরার মধ্য দিয়ে সাঙ্গ হবে; নাটকের এক বা একাধিক বক্তব্য থাকবে যা সংলাপ ও অভিক্রিয়ার মাধ্যমে সম্পন্ন হবে; সংলাপ কাব্যধর্মী অথবা গদ্যবর্তী হতে পারে; কাহিনি তো থাকবেই; মঞ্চসজ্জা হিসেবে সেট ও পোশাক-পরিচ্ছদ ব্যবহৃত হবে; সর্বোপরি পুরো নাট্যযজ্ঞটি আস্বাদনের জন্য দর্শকবৃন্দের উপস্থিতিও প্রয়োজন। অ্যারিস্টটলের কাব্যতত্ত্বানুযায়ী নাটকে পস্নট, চরিত্র, চিন্তা, কাব্যানুকূল সংলাপ, সংগীত ও পরিবেশনার বিষয়টি থাকবে। দেখা যাচ্ছে, অ্যারিস্টটলসহ সবাই নাটক ও নাট্যকে এক করে দেখেছেন – আসলে বিষয় দুটিকে আলাদা করে দেখা উচিত।

যাই হোক, নাটক সম্পর্কে যা বলা হয়েছে তা কাব্যনাটক সম্পর্কেও সমান প্রযোজ্য। তবে কেবল গদ্যবর্তী সংলাপের স্থলে পদ্যবর্তী সংলাপ বসালেই তা কাব্যনাটক হয়ে উঠবে না – তাকে হতে হবে নাট্যক্রিয়ামূলক তথা নাটকের ঘটনাগত ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার অংশীদার। এ-প্রসঙ্গে টিএস এলিয়টের বিবেচনা এরকম – চড়বঃৎু রং বংংবহঃরধষষু ফৎধসধঃরপ ধহফঃযব মৎবধঃবংঃ ঢ়ড়বঃৎু ধষধিুং সড়াবংঃড়ধিৎফং ফৎধসধ; ফৎধসধ রং বংংবহঃরধষষু ঢ়ড়বঃরপ ধহফঃযব মৎবধঃবংঃ ফৎধসধ সড়াবংঃড়ধিৎফং ঢ়ড়বঃৎু.৫ অর্থাৎ কবিতায় অপরিহার্যভাবে নাটকীয়তার প্রবেশ ঘটে থাকে এবং উচ্চমানের কবিতা সতত নাটকে পর্যবসিত হয়; নাটকও অপরিহার্যভাবে কাব্যধর্মী এবং উচ্চমার্গের নাটক কবিতার দিকেই ধাবিত হয়।

কাব্যাক্রান্ত সংলাপ কাব্যনাটকের একটি উপকরণ মাত্র। কাব্যনাটকের সংলাপে নানা ধরনের ছন্দ ব্যবহৃত হতে দেখা গেছে। অমিত্রাক্ষর ছন্দ, মুক্তছন্দ প্রভৃতি। গদ্যাক্রান্ত কথ্যরীতিও সংলাপের বাহক হয়েছে। তবে সংলাপে ছন্দ ব্যবহৃত হলেও সতত তা কাব্যনাটক পর্যায়ভুক্ত না-ও হতে পারে। কাব্যাঙ্গিকের অন্যান্য উপকরণের মধ্যে রস, বাক্ভঙ্গি, উপমা, অনুপ্রাস, উৎপ্রেক্ষা ইত্যাদিও পড়ে – এগুলোও সংলাপ রচনার ভেতর পাওয়া যায়। চরিত্রের জন্ম হয় সমাজস্থ দ্বন্দ্ব থেকে, আর সংলাপের জন্ম হয় চরিত্র ও দ্বন্দ্বের সংঘর্ষে – স্থান, কাল ও পাত্রানুযায়ী কাব্যবোধ প্রকাশ পায় সংলাপে। চরিত্রের মর্মদ্রাবী হাহাকার কাব্যাক্রান্ত সংলাপেই খোলে বেশি। কাব্যধর্মী সংলাপের ভেতর দিয়েই ঘটনা-প্রধান ও অপ্রধান দ্বন্দ্ব-চরিত্রের মনস্তত্ত্ব – মানব অস্তিত্বের নানামুখী সংকট-উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা-নাটকের বক্তব্য প্রভৃতি প্রকাশ পায় নান্দনিক সুষমায়। বর্তমান নাতিদীর্ঘ রচনায় কাব্যনাটকের স্বরূপ ও দেশে-দেশে

কালে-কালে এর চর্চার দিকটিই কেবল ক্ষীণভাবে আলোচিত হয়েছে। এর সামগ্রিক দিক, সংগত কারণেই অনালোচিত থেকে গেছে।

 

কাব্যনাটক : কী এবং কেন

কাব্যনাটক, কাব্যালংকারসমৃদ্ধ শ্রব্যকাব্য এবং একই সঙ্গে অভিনেয় তথা দৃশ্যকাব্যও। কাহিনি বা ঘটনাকে সাজিয়ে রসবৃত্তে পরিণত করা, রসরূপে ব্যক্ত করাই কাব্যনাটক রচনার প্রাথমিক লক্ষ। লেখা হয়েছে –  ‘যে রচনায় কাব্যগুণ নাট্যগুণকে অতিক্রম করে না, এবং সমশক্তি সম্পন্ন হয়ে ওঠে, এবং নাট্যধর্মের সঙ্গে সহযোগিতা অথবা আনুগত্য সম্পর্কে আবদ্ধ হয়, তা হল কাব্যনাট্য।’৬ আরো বলা হয়েছে – ‘নাটকে যদি কবি হৃদয়ের রহস্য, গভীর সত্যোপলব্ধির অভিব্যক্তি থাকে … তখন তাকে কাব্যনাট্য বলে।’৭

নাটক ও নাট্যবিদগণ নানাদিক থেকে কাব্যনাটককে বুঝতে চেয়েছেন, এর সংজ্ঞা নির্ধারণ করেছেন। উত্তম দাশের বিবেচনায় – ‘কবিতার গঠনগত রূপে এই আঙ্গিকগত পরিবর্তন পাঠককে দিশেহারা করেছে, আবার পাঠকের কথা ভেবেই এমন এক আঙ্গিকের কথা ভেবেছেন কবিরা, যাতে পাঠকের সঙ্গে হারিয়ে যাওয়া যোগ নতুন করে প্রতিষ্ঠার সুযোগ ঘটে। এই অন্বেষণেরই ফল কাব্যনাট্য। কবি আর নাট্যকারের দ্বৈতসিদ্ধি সমাহৃত হয়েছে এখানে। কবিকে জানতে হয়েছে নাট্যকারের প্রয়োগ কৌশল আবার নাট্যকারকে বুঝতে হয়েছে কবিতার তাৎপর্য।’৮ কাব্যনাটক সম্পর্কিত আরো কয়েকটি বিবেচনা নিচে পরপর উদ্ধৃত করছি, যা থেকে কাব্যনাটকের সংজ্ঞা এবং এর প্রকৃতি বিষয়ে একটি প্রেক্ষিত পেতে সাহায্য হবে :

ক. [T. S. Eliot]

The Poetic drama must have an emotional unity, let the emotion be whatever you like, It must have a dominant tone, and if this be strong enough, the most heterogeneous emotions may be made to re-enforce it.9

 

খ. [শান্তনু কায়সার]

সাধারণ বিবেচনায় কাব্যে লেখা নাটককেই কাব্যনাটক বলা যায়। কাব্যনাটক বা কাব্যনাট্য, ইংরেজিতে ঠবৎংব চষধু বা চড়বঃরপ উৎধসধ-র সাধারণ অর্থ তাই। কিন্তু ছন্দে রচিত রচনামাত্রই যেমন কবিতা নয়, তেমনি নাটক কাব্যে রচিত হলেই তা কাব্যনাটক হয় না। কাব্য ও নাটক – উভয়ের শর্ত পূরণ এবং পরস্পরের মধ্যে আত্মস্থ, বাহুল্যবর্জিত ও অপরিহার্য হয়ে নিজেকে সমৃদ্ধ করে যে-শিল্পমাধ্যম তাই কাব্যনাটক। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষাংশ থেকে বিংশ শতাব্দীর প্রারম্ভিক কাল পর্যন্ত ইংল্যান্ড ও ইউরোপীয় বাস্তববাদী বন্ধ্যা নাট্যক্রিয়ার প্রতিক্রিয়ার ফলে এলিয়ট প্রমুখের মধ্য দিয়ে কাব্যনাটক কথাটির বহুল প্রচার ঘটে। কিন্তু পৃথিবীর দুটি শ্রেষ্ঠ নাট্যকাল গ্রীক ও এলিজাবেথীয় যুগের নাট্যকলাই ছিলো কাব্যনাটকের। অবশ্য তখন কাব্যনাটক কথাটার আলাদা প্রচলনের প্রয়োজন হয়নি, কারণ কাব্যে নাটক রচনাই ছিলো তখনকার সাধারণ রীতি।১০

 

গ. [সুশীল কুমার গুপ্ত]

যেখানে কাব্য পরিবেশনই মুখ্য উদ্দেশ্য এবং কাব্যের আধার হিসাবে নাট্যপদ্ধতি গৃহীত, সেখানে রচনাকে কাব্য আখ্যায় চিহ্নিত করা যুক্তিযুক্ত। ইংরাজিতে এই জাতীয় কাব্যকে উৎধসধঃরপ ঢ়ড়বঃৎু বলে। আর বাংলায় একে বলা যায় নাট্যকাব্য বা নাট্যিক কাব্য। কিন্তু যে স্থলে নাট্য সৃষ্টিই প্রধান লক্ষ এবং নাট্যরীতিতে কাব্য এক উপায় হিসেবে ব্যবহৃত, সে স্থলে রচনাকে কাব্যনাটক বলে চিহ্নিত করা উচিত। ইংরাজিতে এই ধরনের রচনাকে ‘চড়বঃরপ উৎধসধ’  আর বাংলায় একে বলা যায় ‘কাব্যনাট্য’ বা ‘কাব্যিক নাট্য’ বা ‘কাব্যনাটক’।১১

 

ঘ.  [অনুপম হাসান]

নাটকের আঙ্গিকে কবিতা পরিবেশিত হলেই তা কাব্যনাটক হয় না; তারও অধিক কিছু যেন কাব্যনাটকে আভাসিত। এ প্রসঙ্গে উত্তম দাশ বলেন : ‘নাটকের আঙ্গিকে কবিতা একথা সত্য কিন্তু কবিতা ও নাটক এখানে পরস্পরে সম্পৃক্ত। নাটক এখানে তীব্র নাটকীয়তাকে দমন করেছে, কবিতাও শুধু আবৃত্তিযোগ্য না হয়ে দৃশ্যরূপে উদ্ভাসিত।’ কাব্যনাটকের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে রাম বসু বলেন : ‘কাব্যনাটক জীবনের আবিশ^ সার্বিকতার সন্ধান, তাই কাব্যনাট্য কি নাট্যকাব্য এই তর্ক অর্থহীন। কাব্যনাটক জৈবিক ঐক্য – ‘অর্গানিক হোল’। এলিয়ট ন্যাচারালিস্ট নাট্যপদ্ধতিতে বিশ্বাসী হয়েও স্বীকার করেছেন কাব্যনাটকে কবিতা ও নাটক জৈবিক ঐক্যে একটি অনন্য।১২

উপরস্থ উদ্ধৃতিসমূহ স্ব-ব্যাখ্যাত বলে এগুলোর বিস্তারের আর প্রয়োজন নেই বলেই মনে করি।

কাব্যনাটক : দেশে দেশে কালে কালে

প্রাচীন গ্রিসেই কাব্যনাটক প্রথম রচিত হয়েছে বলে সকলের ধারণা। এমনিতে ‘কাব্য’ একটি ভাব প্রকাশের শিল্পাঙ্গিক হিসেবে তো সর্বদা ক্রিয়াশীল ছিলই, যেমন ‘গিলগামেশ’ কাব্যে রচিত গাথা – ‘রামায়ণ’ ও ‘মহাভারত’ও তা-ই। নাটকের সংলাপে এই কাব্যকলার প্রয়োগ যখন ঘটে, সঙ্গে নাট্যক্রিয়া যুক্ত হয়, তখনই তা কাব্যনাটক হয়ে ওঠে – যদিও ‘কাব্যনাটক’ অভিধাটির প্রচলন তখনো ঘটেনি। এই অভিধাটি কবি-কাব্যনাট্যকার-শিল্পতাত্ত্বিক টিএস এলিয়ট      কর্তৃক প্রদত্ত, বিংশ শতাব্দীর প্রথমদিকে। শান্তনু কায়সার এ-বিষয়ে লিখেছেন :

কাব্যনাটক কথাটির সৃষ্টি আধুনিক যুগে, এই (বিংশ) শতাব্দীর প্রারম্ভে। টি. এস. এলিয়টের মতো ব্যক্তিপ্রতিভায় তা এক বিশেষ পরিণতি লাভ করলেও এটি ছিলো সময়ের সচেতন সৃষ্টি। প্রক্রিয়াটির প্রাথমিক প্রয়াস শুরু হয়েছিলো ঊনবিংশ শতাব্দীতেই। এই শতাব্দীর প্রায় সব প্রধান কবিই, যেমন ওয়ার্ডসওয়ার্থ, কোলরিজ, শেলী, কীটস্, বায়রন, টেনিসন, ব্রাউনিং, আর্নল্ড, শুইনবার্গ, এমন কি হপকিন্স কাব্যে নাটক লেখার চেষ্টা করেছেন। তাঁরা হয় শেক্সপীয়রীয় নয় গ্রীক নাট্যকলার অনুকরণে এই প্রয়াস চালিয়েছিলেন, যদিও নাটক হিসেবে সে-সবের সার্থকতা ছিলো খুবই সীমাবদ্ধ।১৩

গ্রিসের নাটককারদের মধ্যে সফোক্লিস, এস্কিলাস, ইউরোপিদিস, এরিস্টোফেনিস প্রমুখের নামই উচ্চারিত হয় বেশি। তাঁদের পূর্বে   থেসপিস জুরির দল নিয়ে ডিথিরাম্ব শীর্ষক নাটক পরিবেশন করেছেন, যাতে কাব্যও স্থান করে নিয়েছিল, যা একস্বরিক ছিল। পরে অনেক স্বরের সমন্বয়ে নাটক রচনার চল শুরু হয়। আমাদের এখানে ‘রামায়ণ গান’ পরিবেশনরীতির সঙ্গে থেসপিসের পরিবেশনরীতির মিল দেখা যায়। তবে এসব কাব্যনাটক নয়। পরবর্তীকালে প্রাচীন রোমে কাব্যে নাটক রচিত-পরিবেশিত হয়েছে। এসব নাটকে অতিলৌকিকতা, মানবিক মূল্যবোধ, নৈতিকতা, গুহ্য ধর্মানুষ্ঠানসহ নানাদিক বিধৃত হয়েছে।

তারপর কাব্যে রচিত নাটকের চর্চা ও বিস্তার ঘটে ইংরেজিভাষী অঞ্চলে বেন জনসন, ক্রিস্টোফার মার্লো, উইলিয়াম শেক্সপিয়র প্রমুখের প্রচেষ্টায়। তাঁরা প্রধানত বস্ন্যাঙ্ক ভার্স তথা অমিত্রাক্ষর ছন্দে কাব্যনাটক রচনা করেন, অমত্ম্যমিলযুক্ত চরণ ও গদ্যে রচিত চরণও এঁদের কাব্যনাটকে বিদ্যমান। এ-সময় প্রধানত ট্র্যাজেডিই কাহিনির মুখ্য বিষয় হয়ে উঠেছিল। এঁদের পর বাস্তববাদী ধারায় নাটক রচনার প্রভাব বেড়ে যায়। বিশেষত উনিশ শতকে গদ্যময় ও আলাপচারিতার ধরনে তথা কথ্যরীতিতে নাটক রচনার চল শুরু হয় প্রধানত নরওয়ের নাটককার হেনরিখ ইবসেনের নাটক রচনার সূত্রে। এর প্রভাব পড়ে ইংরেজ নাটককার জর্জ বার্নার্ড শ প্রমুখের নাটক রচনার কৌশলে। কাব্যনাটক রচনার প্রবণতা তখন কিছুটা কমে যায়। জানা যায় যে, বাস্তববাদী নাট্যধারার বিপরীতে এলিয়ট কাব্যনাটক রচনার প্রয়োজনীয়তার কথা প্রথম অনুভব করেন। এ-সূত্রে নিজে নাটক রচনা করেন এবং এতদ্বিষয়ে তাত্ত্বিক প্রবন্ধ লিখে কাব্যনাটক রচনার প্রকরণ ও পরিচর্যা সম্পর্কে অভিমত প্রকাশ করেন।

বিংশ শতাব্দীতে ডবিস্নউবি ইয়েটস, টি. এস. এলিয়ট প্রমুখ কাব্যনাটক লেখা শুরু করেন। তখন বার্নার্ড শ, গলস্ওয়ার্দি প্রমুখ গদ্যে বাস্তববাদী ধারায় নাটক লিখছেন। কিছুটা ক্লিশে হয়ে যাওয়া এই বাস্তববাদী ধারার বন্ধন ভেঙে বেরিয়ে যাওয়ার চেষ্টা থেকেই কাব্যনাটক রচনার নবসূত্রপাত ঘটে। এক্ষেত্রে যাঁদের নাম সদা উচ্চারিত হয় তাঁরা হলেন জেএম সিঙ, সীন ও’ কেসি, ডবিস্নউএইচ অডেন, স্টিফেন স্পেন্ডার – ইয়েটস ও এলিয়ট তো ছিলেনই। বিংশ শতাব্দীর তিন দশক থেকেই এঁরা কবিতা ও নাট্যের মিশ্রণে কাব্যনাটক লেখা শুরু করেন। বলা যায়, সময়ের প্রয়োজনেই কাব্যনাটক লিখিত হতে থাকে। ফরাসি প্রতীকবাদ, জাপানের ‘নোহ’ থিয়েটারের কিছু বৈশিষ্ট্য নতুনভাবে ইউরোপে কাব্যনাটক রচনায় প্রেরণা জোগায় – তাঁদের নাটকে রিচুয়াল তথা লোকাচার, কাব্য, সংগীত, নৃত্য, কৃত্য, ঘটনাগত ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া প্রভৃতি স্থান করে নেয়। এগুলো হয়ে ওঠে কাব্যনাটকের মৌলিক উপকরণ। আইরিশ নাটককারগণ তাঁদের কাব্যনাটকে এসব উপকরণ ব্যবহার করেন অত্যন্ত সৃষ্টিশীল উপায়ে।

কাব্যনাটকের রূপ-রূপান্তর সম্পর্কে ভাবনা-ব্যাখ্যা এখনো চলছে। এসব ভাবনা থেকে কাব্যনাটকের উৎসমুখ ও বিবর্তনরেখা সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। নিচে সেরকম দুটি ভাবনা উপস্থিত করা হলো :

ক.  [বেগম আকতার কামাল]

আমরা চেতনার দাসত্বে বিরোধহীনভাবে টি. এস. এলিয়টের কাব্যনাটক-সম্পর্কিত বক্তব্যকেই মেনে নিয়েছি। তিনি নাটকে জৈবিক ঐক্যের ওপর জোর দিয়ে কবিতাকে দ্বিতীয় স্থান দিয়েছেন। এটা তো বাস্তববাদের প্রতিই শর্তহীন আবেগ, তার কারণ বোধ করি তিনি ছিলেন ‘রোমান্টিকতার বিরোধী ও ধ্রম্নপদী সাহিত্যের প্রতি আসক্ত’ (রাম বসু, নন্দনতত্ত্ব জিজ্ঞাসা, ১৯৯৪)। নাট্যমঞ্চ বহুমাত্রিকতা ধরার জন্য পরোক্ষভাবে কবিতার কাছেই হাত পেতেছে এবং বাস্তববাদ থেকে সরে যেতে চেয়েছে। যেমন আইরিশ নাটক প্রত্যক্ষভাবে কবিতার ব্যবহার করেছে। কিন্তু জৈবিক ঐক্যের চেয়েও কাব্যনাটকের আকাঙ্ক্ষা হলো মানবিকতার সামগ্রিক রূপকে ধারণ করা।১৪

খ. [Saradindu Haldar]

The later half of the nineteenth century is associated in the minds of most people with the rise of problem plays. George Bernard Shaw and John Galsworthy were the fine products of this movement. But side by side with this realistic drama and, perhaps, transcending it in the depths which it plumbs, was coming into existence the poetic and symbolic play. While the problem play chose to concentrate on the earthlier realities of daily living, getting and spending, marriage and divorce, problems of adjustment between man and woman, the poetic play aimed at sounding a deeper note.15

বেগম আকতার কামালের কথায় কাব্যনাটক কেন বাস্তবতার বন্ধন থেকে মুক্ত হতে চেয়েছে তা প্রকাশিত। কাব্যনাটক যে দেশে দেশে কালে কালে মানুষের মানবিক দিকগুলোকে বরাবর ধরতে চেয়েছে, সে-বিষয়ে তিনি জোর দিয়েছেন। শরদিন্দু হালদারের কথাতেও এই মুক্ত হওয়া বা ‘সরে’ যাওয়ার কারণগুলো উলিস্নখিত হয়েছে। তাঁর মতে, উনিশ শতকের শেষদিকে সামাজিক সমস্যাভিত্তিক নাটক তথা ‘প্রবলেম পেস্ন’ রচনার ধারাটি পরিপক্ব হয় জর্জ বার্নার্ড শ, জন গলস্ওয়ার্দি প্রমুখের উদ্যোগে। এই ধারার পাশাপাশি নাটকে

কাব্য-প্রতীকের ব্যবহারও লক্ষ করা যায়। প্রবলেম পেস্ন যেখানে সমাজের বাস্তব দিকগুলোর নাট্যায়নে তৎপর, পোয়েটিক পেস্ন তথা কাব্যনাটক সেখানে এসব সমস্যার ইমোশনাল-মানসিক দিকগুলো উন্মোচনে উৎসাহী হয়ে ওঠে বলে শরদিন্দুর অভিমত।

কাব্যনাটককে ইংরেজিতে ভার্স ড্রামা বা পোয়েটিক ড্রামা বলা হয়েছে। বলা বাহুল্য, এ-ধাঁচের নাটক কাব্যেই রচিত হয়েছে। বহুকাল ধরে ইউরোপ ও ইউরোপের বাইরে কাব্যনাটক রচনার ধারাটিও প্রবল ছিল। গ্রিক ট্র্যাজেডি, সতেরো শতকের ফরাসি নাটককার জ্যঁ রাসিনের নাটক, শেক্সপিয়র-গ্যেটের নাটক (ফাউস্ট) – সবই কাব্যে রচিত। মূলত নাট্যমূলক ট্র্যাজেডি রচনার ক্ষেত্রেই কাব্যকলার প্রয়োগ বেশি ঘটেছে। অমত্ম্যমিলযুক্ত নাটকের চরণ মুখস্থ রাখা সহজ বলেও এর কদর সব যুগেই ছিল। তবে ইংরেজিভাষী অঞ্চলে বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে কাব্যনাটক রচনার প্রবণতা কমে যেতে দেখা গেছে।১৬ সত্য এই যে, ওই অঞ্চলে এই ধারা অবসন্ন হয়ে এলেও আফ্রিকায় কাব্যনাটক রচনার ধারা আজো বহমান। এ-প্রসঙ্গে নোবেলজয়ী নাটককার ওলে সোয়িঙ্কার কথা স্মরণ করা যেতে পারে – তিনি তাঁর প্রায় সব নাটকই কাব্যনাটক হিসেবে রচনা ও পরিবেশন করেছেন।

 

কাব্যনাটক : বাংলাভাষী অঞ্চলে

প্রত্যক্ষ প্রমাণ থেকে দেখা যাচ্ছে যে, ভারতবর্ষে সংস্কৃত ভাষায় কাব্যে মঞ্চায়ননিমিত্ত নাটক লিখিত হয়েছে। এক্ষেত্রে কালিদাস, ভাস, শূদ্রক, ভবভূতি, অশ্বঘোষ, হর্ষবর্ধন প্রমুখের নাম করা যায়। স্মর্তব্য যে, একসময় এ-অঞ্চলে রচিত সকল লেখ্যকর্মকেই সাহিত্য বা কাব্য বলা হতো, নাটককে বলা হতো দৃশ্যকাব্য। অন্যদিকে চর্যাপদ-মঙ্গলকাব্য-লোকনাট্য তথা ঐতিহ্যবাহী নানা

নাট্যরীতি-যাত্রাপালা ইত্যাদি কাব্যনাটক পর্যায়ভুক্ত না-হলেও এগুলোর মধ্যে কাব্যনাটকের নানা উপাদান বিদ্যমান বলেও অনুমিত হয়েছে। বৌদ্ধনাটক-মৈমনসিং গীতিকা-মধ্যযুগের মঙ্গলকাব্য-

শ্রীকৃষ্ণকীর্তন-পদ্মাপুরাণ-মণিপুরী নটপালা-অষ্টকগান – এগুলোকে কিছুটা ছাড় দিয়ে হলেও কাব্যনাটক হয়তো বলা যায়। কারণ এগুলোতে কাহিনি-ঘটনা, নাট্যক্রিয়া, গীতাত্মক বা কাব্যাক্রান্ত সংলাপ, বাদ্য, নৃত্য, অভিনয়, সর্বোপরি দর্শক-সামাজিকগণের সামনে পরিবেশনার দিকসমূহ আছে। এগুলো সবই কাব্যধর্মী সংলাপাত্মক ও অভিনেয়, মৌখিক বা লিখিতরূপে বিদ্যমান। কী জানি, এমনও হতে পারে এলিয়ট-কথিত কাব্যনাটকের উপস্থিতি বাংলাভাষী অঞ্চলে ইউরোপের পূর্বেই রচিত-পরিবেশিত হয়েছে – এ-বিষয়ে গবেষণা হলে এ-বিবেচনার যথার্থতা সম্পর্কে অবগত হওয়া যাবে।১৭

বাংলাভাষী অঞ্চলে কাব্যনাটক পড়া ও মঞ্চে পরিবেশনার জন্য রচিত হয়েছে বেশ পরে। এক্ষেত্রে পূর্ববঙ্গের মাইকেল মধুসূদন দত্ত, পশ্চিমবঙ্গের গিরিশচন্দ্র ঘোষ, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, অমরেন্দ্রনাথ দত্ত, ক্ষীরোদপ্রসাদ বিদ্যাবিনোদ, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, বুদ্ধদেব বসু, দিলীপ রায়, মঙ্গলাচরণ রায়, গিরিশংকর, রাম বসু, শম্ভু মিত্র, জয় গোস্বামী প্রমুখ অন্যতম। শম্ভু মিত্রের চাঁদ বণিকের পালা বা জয় গোস্বামীর যারা বৃষ্টিতে ভিজেছিলও কাব্যনাটক, কেননা এগুলো কাব্যালংকারসমৃদ্ধ আখ্যানমূলক রচনা। তবে আমার বিবেচনা সঠিক না-ও হতে পারে।

পূর্ববাংলার আলাওল (যিনি পদ্মাবতী নামে বাংলাভাষায় কাহিনিকাব্য রচনা করেছেন), কবি জসীমউদ্দীন, ফররুখ আহমদ, আ. ন. ম. বজলুর রশীদ, শাহাদাৎ হোসেন, গোলাম মোস্তফা, বন্দে আলী মিয়া, শামসুর রাহমান, আলাউদ্দিন আল আজাদ, আবদুল্লাহ আল-মামুন (শপথ) প্রমুখের কথা বলা যায়। বাংলাদেশ পর্বে অনেকেই কাব্যনাটক লিখেছেন। অনুপম হাসানের বিবেচনায় এঁদের মধ্যে অগ্রগণ্য হচ্ছেন :

বাংলাদেশের সাহিত্যে সৈয়দ শামসুল হকের পর অনেক কবি-সাহিত্যিক কাব্যনাটক রচনা করেছেন। এঁদের মধ্যে আবদুল মান্নান সৈয়দ, জিলস্নুর রহমান সিদ্দিকী, কাশীনাথ রায়, আবুল হাসান, সাজেদুল আউয়াল, এনামুল হক, রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ, আবিদ আজাদ প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য। এঁদের মধ্যে সৈয়দ শামসুল হক সর্বাধিক সফল কাব্যনাট্যকার; সংখ্যায়ও তাঁর রচনা অন্যদের চেয়ে বেশি। অন্যদের রচনা সংখ্যা সীমিত হলেও শিল্পের মানদ– অনুলেখ্য নয়। বিশেষত কাশীনাথ রায়ের ‘ডিভাইন কমেডি’ এবং আবুল হাসানের ‘ওরা কয়েকজন’ কাব্যনাটক হিসেবে অসামান্য শিল্প সফল ও আধুনিক বৈশিষ্ট্যম–ত। এছাড়া আবিদ আজাদের ‘লালচোখ’ ও ‘সুন্দর’ বাংলাদেশের কাব্যনাটক শাখায় অনন্য সংযোজন। সাজেদুল আউয়ালের ‘ফণিমনসা’, এনামুল হকের ‘সুবিশাল অস্থিরতা’ এবং রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহর ‘বিষ বিরিক্ষক্ষর বীজ’ প্রভৃতি কাব্যনাটকের বাহন কাব্য হলেও বিষয়বস্ত্ত সামাজিক। সামাজিক বিষয়বস্ত্ত নিয়ে কাব্যনাটক রচনা করা কঠিন। তারপরও এসব রচনায় ব্যক্তি মানুষের অন্তর্দ্বন্দ্ব, মানস সংকটের চিত্র প্রতিফলিত হয়েছে।১৮

উলিস্নখিতজনদের বাইরেও, ধারণা করি বাংলাদেশে আরো অনেকে কাব্যনাটক লিখে থাকবেন – নিরঞ্জন অধিকারী (কর্ণ-সংবাদ), মোস্তফা আনোয়ার (কোনো ডাকঘর নেই), নূরুল হুদার নাম উল্লেখ করা যায়। পশ্চিমবঙ্গেও এরকম অনেকে নিশ্চয় আছেন। এ-বিষয়ে কাজ হলে হয়তো সেসব কাব্যনাটককারের নাম, তাঁদের কর্ম সম্পর্কে জানা যাবে। নাট্যাচার্য সেলিম আল দীনের নাম কাব্যনাটককার হিসেবে প্রবন্ধে উলিস্নখিত না-হওয়ার কারণ হিসেবে বলা যায় যে, তিনি সচেতনভাবেই কাব্যনাটক রচনা করেননি, যদিও তিনি ‘কবিতার ন্যায় অজস্র বাক্প্রতিমা, অলংকার ব্যবহার করেছেন।’১৯

 

অভিনিষ্পত্তি

কাব্যনাটক শুধু যে অভিনীত হওয়ার জন্য লিখিত হতে হবে এমন কোনো কথা নেই – শুধু সাহিত্যকর্ম হিসেবে পঠিত হওয়ার জন্যও লিখিত হতে পারে। বায়রন, শেলি প্রমুখ ইংরেজ কবি আঠারো শতকের দিকে পড়ার জন্যই কাব্যনাটক লিখেছেন, মঞ্চস্থ হবে এই ভেবে তাঁরা কাব্যনাটক লেখেননি। আসলে ভিক্টোরীয় যুগে কাব্যনাটক এপিকধর্মী রচনার জায়গাটা নিয়ে নেয়। প্রাচ্যদেশে মাইকেল মধুসূদন দত্ত, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বুদ্ধদেব বসু প্রমুখ রচিত কাব্যনাটক প্রধানত সাহিত্যকর্ম হিসেবেই রচিত। পশ্চিমবঙ্গে সুকান্ত ভট্টাচার্য (অভিযান), অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত (বাঁশের কেল্লাটা চলছে), সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শঙ্খ ঘোষ, রাম বসু প্রমুখ কাব্যনাটক লিখেছেন, সেগুলো প্রধানত পাঠনিমিত্ত রচিত। প্রশ্ন হচ্ছে, বর্তমান বাংলাভাষী অঞ্চলে কাব্যনাটক রচনার ধারা-প্রবণতা অপস্রিয়মাণ কেন?

উত্তরে বলা যায় – নাটক অনেকেই লিখতে পারেন, কাব্যনাটক লেখেন কেউ-কেউ। এই কেউ-কেউ-এর সংখ্যা কবিতার ক্ষেত্রে যেমন কম, তেমনি কাব্যনাটক রচনার ক্ষেত্রে আরো কম। কাব্যনাটক লিখতে হলে কবিতা এবং নাটক ও নাট্য – তিনটি বিষয়েই দক্ষতা থাকতে হবে, যা সব যুগে সহজপ্রাপ্য নয়। মঞ্চে কাব্যধর্মী সংলাপ নাট্যক্রিয়ার সঙ্গে গুঁজে দেওয়া সহজকর্ম নয়। নাটকস্থ দ্বন্দ্ব উন্মোচন ও মীমাংসা প্রদান; কাব্যধর্মী সংলাপ ও ঘটনাগত ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার মাধ্যমে মঞ্চমাঝে গতি তৈরি করা; চরিত্রবর্গের মানসিক সংকট উপস্থাপন – কঠিনকর্মই বটে। সহজাত প্রতিভার সঙ্গে নাটক ও নাট্যবিষয়ক পরিজ্ঞান মিশ্রিত না-হলে কাব্যনাটক রচনা সম্ভব নয়।

বলা হয়েছে যে, শুধু পদ্যে রচিত নাটকই কাব্যনাটক নয়, গদ্যও কখনো কখনো কাব্যনাটক রচনার বেলায় কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে। কবিতা ও নাট্যিক উপাদানের সংমিশ্রণেই কাব্যনাটক প্রাণ পায়। পদ্য এখানে নাটকের অবিচ্ছেদ্য অংশ, পস্নট ও চরিত্রবর্গের মধ্যকার অভ্যন্তরীণ ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার উপায়, শুধু সৌন্দর্য-নান্দনিকবোধ সৃষ্টির উপকরণ নয়। অন্যদিকে নাট্যিক উপাদানসমূহেরও কাব্যিক গাঢ়তা ও মাধুর্যময় বাচন ধারণ করার ক্ষমতা থাকতে হবে। এ-কথাও উচ্চারিত হয়েছে যে, কাব্যনাটকের থিম-চরিত্র কাব্যময় হতে হবে এবং সাধারণ জীবনযাত্রার নীরসতা থেকে বৃহৎ অর্থধারী হতে হবে; বৃহৎ পরিসরের অনুভূতি-অনুরাগের কাব্যিক প্রকাশ ঘটানোর সক্ষমতা অর্জন করতে হবে। এতে করে দর্শকগণের মন প্রাত্যহিক আনন্দ-বেদনার সীমানা পেরিয়ে আত্মবিমোক্ষণের দিকে ধাবিত হবে।২০

এলিয়ট এটা বিশ্বাস করতেন যে, দর্শক আকৃষ্ট করার ক্ষেত্রে গদ্যে রচিত নাটকের চেয়ে কাব্যনাটকের ক্ষমতা বেশি। তবে শুধু কবিতার জন্য কবিতাকে নাটকে ব্যবহার করার পক্ষপাতী তিনি ছিলেন না, কবিতা যেন নাটকীয় ঘাত-প্রতিঘাত সৃষ্টিতে অংশ নেয় এটাই তাঁর কাম্য ছিল। যে-নাটক গদ্যে লেখা সম্ভব সেটা পদ্যে তথা কাব্যে না লেখার কথাও তিনি বলেছেন।২১ আরো বলেছেন, কাব্যনাটককারের কাজ আর কবির কাজ এক নয়। তাঁর বিবেচনায় যিনি কাব্যধর্মী কাজ পূর্বে করেছেন তাঁরই উচিত কাব্যনাটক রচনার ক্ষেত্রে এগিয়ে আসা। এ-ধরনের কাজের সঙ্গে তাঁর পূর্বপরিচিতি থাকাও দরকার, কারণ একেবারেই আলাদা ধরনের মানসিকতা দাবি করে এ-ধরনের কাজ। দীর্ঘদিন কাজ করার ফলে তাঁর একটা আলাদা স্বরই তৈরি হয়ে যায় বলে এলিয়টের অভিমত।২২

এলিয়ট-কথিত লেখকের সংখ্যা সবদেশেই কম, বাংলাদেশও তার ব্যতিক্রম নয়। কাজেই কাব্যনাটকের সংখ্যা কিছুটা কম তো হবেই। কবিতার চরণ লেখা যত সহজ, কাব্যনাটকের সংলাপ রচনা তত সহজ নয়। আবার কাব্যযুক্ত সংলাপের সঙ্গে নাট্যক্রিয়ার সংমিশ্রণ ঘটানোর কাজটিও সৃষ্টিক্ষম প্রজ্ঞার দাবি করে – দুটির ঐকত্রিক রূপই কাব্যনাটকের জন্মদুয়ার। মানবের গভীরতম দুঃখবোধের প্রকাশ কাব্যধর্মী-গীতাত্মক সংলাপেই মূর্ত হয়ে ওঠে অধিক পরিমাণে। দর্শক-শ্রোতার মধ্যেও এই বোধের সঞ্চার ঘটে তাৎক্ষণিক-তাৎস্থানিকভাবেই, বিমোক্ষণ তো ঘটেই। নানা রসে রঞ্জিত হয় দর্শকের মন। কাব্যনাটকের কাজই তো নির্বাচিত

কাহিনি-ঘটনাপুঞ্জকে কাব্য-ক্রিয়ার দ্বারা রসবৃত্তে পরিণত করে পরিবেশন করা। তাছাড়া কাব্যনাটক কম সংলাপ তথা শব্দ ব্যবহার করার প্রস্তাব করে বিধায় নৈঃশব্দ্যকেও কাব্যনাটকের বড় একটি উপাদান বলে গণ্য করা সংগত হবে। কাব্যনাটকে এই নৈঃশব্দ্যের স্থান করে দেওয়াও সহজ কর্ম নয়। অমেত্ম বলা যায়, পৃথিবীর কোনো শিল্পধারার বৈশিষ্ট্যই পুরোপুরি অবলুপ্ত হয় না – কাব্যনাটক রচনার ধারাটিও টিকে থাকবে তার প্রচলিত উপাদানসমূহ নিয়েই – বাংলাভাষী অঞ্চলসহ পৃথিবীর সবখানেই। হয়তো কিছু উপাদান বাদ পড়বে, যুক্ত হবে নতুন কোনো উপাদান।

 

সূত্রনির্দেশ

১. Lee A. Jacobs (Editor). Introductions : Thinking About Drama, The Bedford Introduction to Drama, St. Martin’s Press, New York, 1989, p 1.

২.  Ibid, p 1101.

৩. Theodore W. Hatlen. Theater And Drama, Drama : Principles & Plays, Meredith Corporation, New York, 1967, p 9.

৪.  Oscar G. Brockett. The Theatre as a Form of Art, The Theatre : An Introduction, Third Edition, Holt, Rinehart And Winston, Inc., New York, 1974, p 4.

৫. T. S. Eliot. A Dialogue on Dramatic Poetry, Selected Essays, Fabar and Faber, London, 1963, p 46.

৬. শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়। রবীন্দ্র সৃষ্টিসমীক্ষা, ওরিয়েন্টাল বুক কোম্পানি, কলকাতা, ১৩৭২ বঙ্গাব্দ, পৃ ১১৭।

৭. শুদ্ধসত্ত্ব বসু। বাংলা সাহিত্যের নানারূপ, বিশ্বাস বুক স্টল, কলকাতা, ১৩৮৫ বঙ্গাব্দ, পৃ ১০৭।

৮. উত্তম দাশ। বাংলা কাব্যনাট্য, মহাদিগন্ত প্রকাশ সংস্থা, দক্ষিণ ২৪ পরগনা, ১৯৮৯, পৃ ৯।

৯. Op. cit., note no. 5, p 46.

১০. শান্তনু কায়সার। কাব্যনাটক, বাংলা একাডেমি, ঢাকা,

১৯৮৫, পৃ ৯।

১১. সুশীলকুমার গুপ্ত। রবীন্দ্রনাথ নাট্যপ্রসঙ্গ : কাব্যনাটক, স্ট্যান্ডার্ড পাবলিশার্স, কলকাতা, ১৩৬৮ বঙ্গাব্দ, পৃ ১৯।

১২. অনুপম হাসান। বাংলাদেশের কাব্যনাটক : বিষয় ও প্রকরণ, বাংলা একাডেমি, ঢাকা, ২০১০, পৃ ৪।

১৩. কাব্যনাটক, শান্তনু কায়সার। বাংলা একাডেমি, ঢাকা, ১৯৮৫, পৃ ২৪।

১৪. বেগম আকতার কামাল। ‘ফণিমনসা : প্রান্তজনের কাব্যনাটক’, কালি ও কলম, পঞ্চদশ বর্ষ, সপ্তম সংখ্যা, সম্পাদক : আবুল হাসনাত, বেঙ্গল পাবলিকেশন্স লিমিটেড, ২০১৮, পৃ ৯৪।

১৫. Saradindu Haldar, Historical sense in the poetry of T. S. Eliot, University of Calcutta, 2016. Retrieved from http://shodhganga.inflibnet.ac.in/jspui/handle/10603/157477.

১৬. Verse drama is any drama written as verse to be spoken; another possible general term is poetic drama. For a very long period verse drama was the dominant form of drama in Europe (and was also important in non-European cultures). Greek tragedy and Racine’s plays are written in verse, as is almost all of Shakespeare’s drama, and Goethe’s Faust. Verse drama is particularly associated with the seriousness of tragedy, providing an artistic reason to write in

this form, as well as the practical one that verse lines are easier for the actors to memorize exactly. In the second half of the twentieth century verse drama fell almost completely out of fashion with dramatists writing in English (the plays of Christopher Fry

and T. S. Eliot being possibly the end of a long tradition).

Ñ Verse drama and dramatic verse, Retrieved from https://en.wikipedia.org/wiki/verse_drama_and_ dramatic_verse.

১৭.  উলিস্নখিত বিষয়ে গবেষণার জন্য যে-কয়টি গ্রন্থ সহায়ক হতে পারে সেগুলো হচ্ছে ড. সেলিম আল দীন রচিত মধ্যযুগের বাঙলা নাট্য, ড. সৈয়দ জামিল আহমেদ রচিত অপযরহঢ়ধশযর

Infinity : Indigenous Theatre of Bangladesh এবং ড. সাইমন জাকারিয়া-রচিত বাংলাদেশের লোকনাটক : বিষয় ও আঙ্গিক-বৈচিত্র্য।

১৮. পূর্বোক্ত, পাদটীকা নং ১২, পৃ ৩৮।

১৯. পূর্বোক্ত, অনুপম হাসান। পৃ ৩৮৬। এ-বিষয়ে অনুপম হাসানের বিশদ বিবেচনাটি এরকম : ‘সেলিম আল দীন-এর (১৯৪৯-২০০৮) কিত্তনখোলা, কেরামতমঙ্গল, চাকা, হরগজ, হাত হদাই, বনপাংশুল প্রভৃতি নাট্যধর্মী আখ্যানমূলক রচনাগুলোকে অনেক নাট্য-সমালোচক কাব্যনাটকের অন্তর্ভুক্ত মনে করেন। কিন্তু আমাদের বিবেচনায় সেলিম আল দীনের নাট্যধর্মী এ-রচনাগুলো বাংলা সাহিত্যের নিজস্ব আঙ্গিকবৈশিষ্ট্যের সঙ্গে আধুনিক নাট্যবৈশিষ্ট্য আত্মস্থ করে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র সৃষ্টি। বাংলা সাহিত্যের মঙ্গলকাব্য, পাঁচালি, হাস্তর গান,

কথকতা, যাত্রাপালা প্রভৃতি আঙ্গিকের মধ্যে যে-নাট্যগুণ ছিল সেলিম আল দীন তার মধ্যে বাঙালির নিজস্ব নাট্যগুণ খুঁজেছেন। এসব রচনায় নৃত্য, সংগীত, বর্ণনা ও সংলাপের সহায়তায় বাঙালির কাব্য, কাহিনি ও নাটকের সামগ্রিক প্রতিফলন ঘটেছে। তিনি কবিতার মতো অজস্র বাক্প্রতিমা, অলংকার ব্যবহার করেছেন, ফলে এসব নাটকে কাব্যময়তার লক্ষণও সুস্পষ্ট। নাট্যকার নিজেও তাঁর চাকা, হরগজ, বনপাংশুল, হাত হদাই প্রভৃতি রচনাকে কাব্য অথবা গল্প হিসেবে বিবেচনা করা হলে তাঁর অনাপত্তির কথা জানিয়েছেন। এসব রচনায় আধুনিক জীবনবোধ আছে। তবে কাব্যনাটকের ক্ষেত্রে চরিত্রের অন্তর্লোকের যে রহস্যানুসন্ধান ও অস্তিত্বের সংকট, আনুভূতিক দ্বন্দ্ব-সংঘাত উপস্থাপন বিবেচ্য বিষয় মনে করা হয় তা পাওয়া যায় না। এই বিচারে সেলিম আল দীনের এ-রচনাগুলোকে কাব্যনাটক হিসেবে আখ্যায়িত না করাই শ্রেয়।’ অনুপম হাসানের বিবেচনা কতটা গ্রহণযোগ্য এ নিয়েও কেউ প্রশ্ন তুলতে পারেন, গবেষণা করতে পারেন। প্রস্তাবিত-প্রচলিত জ্ঞানকে প্রশ্নবিদ্ধ করেইতো নতুন জ্ঞানভাষ্যের জন্ম দিতে হয়।

– অনুপম হাসান। বাংলাদেশের কাব্যনাটক : বিষয় ও প্রকরণ, বাংলা একাডেমি, ঢাকা, ২০১০, পৃ ৩৮৬-৩৮৭।

২০. Poetic drama is not merely a drama which is written in verse, because prose may also be it’s effective medium. It is, in fact, a blending of the poetic and dramatic elements in a fruitful union. Here poetry is an integral part of the play, twined with plot, character and their interplay, not an element of isolated beauty or lyricism for its own sake. (…) the dramatic elements must be capable of sustaining the poetic grace and intensity. It means its themes and characters should be poetically convinced and should be larger than the average humanity and humdrum monotony of daily life, the passions and emotions permeating them should be naturally productive of the poetic expression, calculated to lift the mind of the spectator above the sphere of our ordinary joys and sorrows and send the penetrating gaze of his inner vision far down below the surface of life to the very springs of human action and human drives.

Ñ Dr Anupma Srivastava, Retrieved from https://hubpages.com/literature/poetic-drama.

  1. Eliot has been attracted towards poetic drama by his belief that poetic drama has something potentially to offer to the play-goer that prose-drama cannot. For I start with the assumption, says he, Ôthat if poetry is merely a decoration, an added embellishment if it merely gives people of literary taste the pleasure of listening to poetry at the same time that they are witnessing a play, than it is superfluous.Õ Poetry according to Eliot, must justify itself dramatically, and not merely be fine poetry shaped into a dramatic form. From this it follows that no play should be written in verse for which prose is dramatically adequate.

Ñ Saradindu Haldar, Historical sense in the poetry of T. S. Eliot, University of Calcutta, 2016. Retrieved from http://shodhganga.inflibnet.ac.in/jspui/handle/10603/157477

  1. T. S. Eliot is of the opinion that the function of a verse-play writer, i. e. a dramatist poet is entirely different from that of a Poet. The first thing, according to him is that a writer who has worked for years, and achieved some success, in writing other kinds of verse has to approach the writing of a verse-play or a dramatic poem, in an entirely different frame of mind from that’ to which he has been accustomed in his previous work.

Ñ Saradindu Haldar, Historical sense in the poetry of T. S. Eliot, University of Calcutta, 2016. Retrieved from http://shodhganga.inflibnet.ac.in/jspui/handle/10603/157477

 

[প্রবন্ধটি জাতীয় কবিতা পরিষদ-আয়োজিত ‘জাতীয় কবিতা উৎসব ২০১৯’-এর অনুষ্ঠানে ২০ মাঘ ১৪২৫/ ২ ফেব্রম্নয়ারি ২০১৯ তারিখে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় লাইব্রেরি চত্বরে পঠিত।]