বি. ওয়ার্ডসওয়ার্থ

অনুবাদ : মোজাফ্ফর হোসেন

প্রায় তিনজন করে ভিক্ষুক প্রতিদিনই নিয়ম করে আমাদের মিগুয়েল স্ট্রিটের বাড়িটায় আসত। দশটার দিকে ধুতি ও সাদা জ্যাকেট পরিহিত একজন ভারতীয় এলো, আমরা তাকে এক মগ চাল দিয়ে বিদায় করলাম। বারোটার দিকে একজন বয়স্ক মহিলা এলো, এক টাকা নিয়ে চলে গেল। দুটার দিকে একজন অন্ধ ভিখারি এক বালককে লাঠি বানিয়ে হাজির হলো, তাকেও এক টাকা দিয়ে বিদায় করলাম। মাঝেমধ্যে কিছু ধূর্ত প্রকৃতির ভিক্ষুক আসত। একদিন এক ভিখারি দরজায় বাড়ি দিয়ে বলল যে, তার খুব খিদে পেয়েছে। আমরা তাকে খেতে দিলাম। তারপর সে একটা সিগারেট চাইল, এবং আমি তার সিগারেটে আগুন না দেওয়া পর্যন্ত নড়ল না। তাকে আর কোনোদিন দেখা যায়নি। একদিন বিকেল চারটার দিকে আজব প্রকৃতির একজন দরজায় এসে দাঁড়াল। আমি সবে স্কুল থেকে ফিরেছি।

‘শোনো বাবা, আমি কি ভিতরে আসতে পারি?’ সে আমাকে বলল। লোকটি বেশ খাটো, পরনে সাদা শার্ট ও কালো ট্রাউজার। মাথায় টুপি।

‘আপনি কি চান?’ আমি জিজ্ঞেস করলাম।

‘তোমাদের মৌমাছিগুলো একবার দেখতে চাচ্ছিলাম।’ সে বলল।

আমাদের উঠোনে চারটি পামগাছ ছিল, সেখানে বেশ কয়েকটি মৌমাছির চাক ছিল। আমি ঘরের দিকে কয়েক পা এগিয়ে চেঁচিয়ে বললাম – ‘মা, দরজায় একজন লোক আছে, আমাদের মৌমাছিগুলো একবার দেখতে চায় বলছে!’

মা ঘর থেকে বেরিয়ে এসে লোকটির দিকে একবার তাকিয়ে নিয়ে কর্কশ গলায় বললেন – ‘কি চাওয়া হয়?’

‘আপনাদের মৌমাছিগুলো দেখতে চাচ্ছিলাম।’ লোকটি বলল।

তার ইংরেজি খুব গোছানো। বোঝাই যাচ্ছিল এটা তার মাতৃভাষা নয়। মাকে বেশ চিন্তিত মনে হলো। মা আমাকে বললেন – ‘যতক্ষণ উনি থাকেন, তুই এখান থেকে এক পাও নড়বি না।’

‘ধন্যবাদ ম্যাডাম! আপনার অশেষ মেহেরবানি।’ সে খুব ধীরে ধীরে গুছিয়ে কথাটা বলল, যেন প্রতিটি শব্দ তার টাকা দিয়ে কেনা! আমরা পামগাছের নিচে হাঁটুর ওপর ভর দিয়ে বসে প্রায় এক ঘণ্টা ধরে মৌমাছিগুলো দেখলাম।

‘মৌমাছি দেখতে আমার খুব ভালো লাগে। তোমার কেমন লাগে?’ লোকটি বলল।

‘আমার অত সময় নেই।’ বললাম আমি।

সে গম্ভীর হয়ে মাথা ঝাঁকালো। ‘আমি এ-কাজই করি। এটা-ওটা দেখতে আমার খুব ভালো লাগে। শুধু পিঁপড়ে দেখতে দেখতেই আমি দিনের পর দিন কাটিয়ে দিতে পারি। তুমি কি কখনো পিঁপড়েদের লক্ষ করে দেখেছ? কিংবা মাকড়সা, কেন্নোই – এদের ভালো করে দেখছ?’

আমি মাথা নাড়ালাম। ‘আপনি আসলে কী করেন, বলুন তো?’

সে উঠে দাঁড়াল – ‘আমি কবি’।

‘খুব ভালো কবি?’ আমি কোনোরকম ভণিতা না করেই জানতে চাইলাম।

‘পৃথিবীর সবচেয়ে বড় কবি।’ সে অকপটে বলল।

‘আপনার নামটা কি একবার বলবেন?’

‘বি. ওয়ার্ডসওয়ার্থ।’

‘বি মানে কি বিল?’

‘ব্ল্য­াক। ব্ল্য­াক ওয়ার্ডসওয়ার্থ। সাদা ওয়ার্ডসওয়ার্থ ছিলেন আমার ভাই। আমাদের আত্মা একটাই। আমি খুব ক্ষুদে একটা ফুলকেও সকালের মতোই শুভ্র ও মহৎ মনে করি; আর সেটা দেখে আমার কান্না পায়।’

‘কেন? এতে কান্না পাওয়ার কি আছে?’ আমি জিজ্ঞেস করলাম।

‘বুঝলে না বালক! তুমি যখন বড় হবে তখন বুঝবে। তুমিও যে একজন কবি, তুমি কি জানো সেটা? এবং একজন কবি যখন-তখন যে-কোনো কারণে কাঁদতে পারে!’

আমি না হেসে পারলাম না!

‘তুমি তোমার মাকে পছন্দ করো?’ সে জানতে চাইল।

‘করি, তবে আমাকে যখন মারে না, তখন।’

সে তখন তার পেছনের পকেট থেকে একটা ছাপা কাগজ বের করে বলল – ‘এই কাগজে মাকে নিয়ে লেখা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ কবিতাটি আছে। আমি এটা বিক্রি করব। কোনো দরদাম চলবে না, একদাম – চার টাকা।’

আমি ভেতরে গিয়ে মাকে বললাম – ‘মা, তুমি কি চার টাকা দিয়ে একটি কবিতা কিনবে?’

মা রেগে গিয়ে ভদ্রতার মাথা খেয়ে বলল – ‘ওই ফালতু লোকটাকে গিয়ে বল, ও যদি এখনই আমার সীমানা থেকে বেরিয়ে না যায়, আমি তার লেজ টেনে ছিঁড়ে ফেলব; কি, কানে যায় আমার কথা?’

‘মার কাছে এখন চার টাকা নেই।’ আমি বাইরে এসে বি. ওয়ার্ডসওয়ার্থকে বললাম।

‘এখানেই তো কবির ঐতিহাসিক পরাজয়!’ বি. ওয়ার্ডসওয়ার্থ বলল।

তারপর সে তার কাগজটি যথাস্থানে রেখে দিলো। মার কথায় কিছু মনে করেছে বলে মনে হলো না।

আমি বললাম – ‘এভাবে কবিতা বিক্রি করে বেড়ানো কি ভালো দেখায়? খুব বেশি কি বিক্রি হয়?’

‘এখন পর্যন্ত এক কপিও হয়নি।’

‘তাহলে আপনি এভাবে ঘুরেঘুরে কবিতা বেচে বেড়াচ্ছেন কেন?’

‘এর ফলে আমি অনেক কিছু দেখার সুযোগ পাই। আর আমি সবসময় কবিদের সাক্ষাৎ পেতে চাই।’

‘আপনি কি সত্যি সত্যিই আমাকে কবি মনে করেন?’

‘তুমি আমার চেয়ে কোনো অংশে কম নও।’ সে উত্তরে বলল।

বি. ওয়ার্ডসওয়ার্থ চলে যাওয়ার পর আমি মনে মনে প্রার্থনা করলাম যেন তার সঙ্গে ফের আমার দেখা হয়।

 

এক সপ্তাহ পর, আমি যখন স্কুল থেকে ফিরছিলাম তখন মিগুয়েল স্ট্রিটের এক বাঁকে তার সঙ্গে দেখা হয়ে গেল।

‘আমি অনেকক্ষণ থেকে তোমার জন্য এখানে অপেক্ষা করছি।’

‘এ কয়দিনে একটা কবিতাও কি বিক্রি করতে পারলেন?’ আমি জানতে চাইলাম।

সে মাথা নাড়াল। বলল – ‘আমার উঠোনে এই অঞ্চলের শ্রেষ্ঠ আমগাছটি আছে। এখন গাছে আম পেকে টসটস করছে। আমি তোমাকে আম খাওয়ার দাওয়াত দিতে এসেছি।’

সে আলবার্তো স্ট্রিটের এক মোড়ে এক কামরাবিশিষ্ট একটি বাসায় বসবাস করত। বাড়ির সামনেটা সবুজে ভরা। সেখানে বিশাল এক আমগাছ আছে, আর আছে নারিকেল ও তালগাছ। জায়গাটি জঙ্গল হয়ে আছে, দেখে মনে হয় শহরের বাইরে কোথাও এসেছি। এখান থেকে রাস্তার ওপারের বিশাল বিশাল দালানকোঠা দেখা যায় না।

সে একটুও বাড়িয়ে বলেনি, আমগুলো সত্যিই চমৎকার। আমি প্রায় আটটা সাবাড় করে ফেললাম। আমের হলুদ রস আমার কনুই চুইয়ে জামায় লেগে গেল। আমি যখন বাড়ি ফিরলাম, মা বললেন – ‘এতক্ষণ কোথায় ছিলি, হতচ্ছাড়া? ভেবেছিস খুব বড় হয়ে গেছিস, যেখানে খুশি যেতে পারবি, তাই না? যা, আমার জন্য একটা কঞ্চি কেটে আন।’

মা আমার কাটা কঞ্চি দিয়ে আমাকেই পেটালেন – আচ্ছা পিটুনি পেটালেন! আমি কাঁদতে কাঁদতে রেগেমেগে বাড়ি থেকে বের হয়ে এলাম। প্রতিজ্ঞা করলাম – আর কিছুতেই বাড়ি ফিরব না। বি. ওয়ার্ডসওয়ার্থের বাড়িতে গেলাম। আমার নাক রাগে লাল হয়ে গিয়েছিল।

বি. ওয়ার্ডসওয়ার্থ বলল – ‘কান্না এবার থামাও। চলো কোথাও ঘুরে আসি।’

আমার কান্না থেমে গেল। তখনো বেশ জোরে জোরে নিশ্বাস নিচ্ছিলাম। আমরা হাঁটতে বের হলাম। এসটি অ্যাভিনিউয়ের ভেতর দিয়ে সাভান্নাহ হয়ে রেসকোর্সে চলে গেলাম।

বি. ওয়ার্ডসওয়ার্থ বলল – ‘এসো, দুজনে ঘাসের ওপর চিৎ হয়ে শুয়ে আকাশ দেখি। আমি চাই তুমি এখন চিন্তা করে দেখবে ওই তারাগুলো আমাদের থেকে কত দূরে অবস্থান করছে।’

তার কথামতো আমি চিন্তা করা শুরু করলাম। তার উদ্দেশ্যটা একটু পরই পরিষ্কার হলো। নিজেকে খুব হালকা মনে হচ্ছিল। একই সঙ্গে খুব মহান আর বিশাল মনে হচ্ছিল, ঠিক ওই আকাশটার মতো; জীবনে আর কখনো কোনোদিন এই অনুভূতি হয়নি। আমি আমার সমস্ত ক্রোধ, অশ্রু ও আঘাতকে ভুলে গেলাম। যখন আমি বললাম যে, আমার খুব ভালো লাগছে, সে তখন এক-এক করে তারাদের নাম বলতে লাগল। তখনই একটা টর্চের আলো এসে আমাদের মুখের ওপর পড়ল। দেখলাম – পুলিশের লোক, ঘাস থেকে উঠে দাঁড়ালাম।

‘তোমরা এখানে কী করছ?’ পুলিশটি জিজ্ঞেস করল।

বি. ওয়ার্ডসওয়ার্থ উত্তরে বলল – ‘নিজেকে আমি চল্লিশ বছর ধরে এই একই প্রশ্ন জিজ্ঞেস করে ফিরছি।’

 

আমরা খুব দ্রুত বন্ধু হয়ে গেলাম। সে আমাকে বলল – ‘তুমি কাউকে কখনো আমার সম্পর্কে বলবে না। আমার ওই গাছগুলো সম্পর্কেও নয়। সমস্ত বিষয়টা গোপন রাখবে। কাউকে বললেই আমি কিন্তু ধরে ফেলব, কারণ আমি কবি।’

আমি তাকে কথা দিয়েছিলাম, এবং আজ অবধি আমি আমার কথা রেখেছিলাম। তার ছোট্ট বাড়িটি আমার ভালো লাগত। এত সুন্দর, গোছানো ও পরিষ্কার! তবে বেশ নিঃসঙ্গ দেখাত। একদিন আমি জিজ্ঞেস করলাম – ‘আপনি উঠানের আবর্জনাগুলো কেটে ফেলেন না কেন? জায়গাটা আরো স্যাঁতসেঁতে হয়ে গেছে।’

‘শোনো, তোমাকে তাহলে ঘটনাটা বলেই ফেলি – একদা একটা মেয়ে আর একটা ছেলের সাক্ষাৎ ঘটল এবং তারা পরস্পরের প্রেমে পড়ে গেল। ফলে তারা বিয়ে করে ফেলল। ছেলেটি শব্দ বুনতে ভালোবাসত, আর মেয়েটি ভালোবাসত ঘাস, ফুল আর গাছপালা। তারা একটি কক্ষে বেশ সুখেই দিনযাপন করছিল। তারপর একদিন মেয়েকবিটি ছেলেকবিকে বলল – আমরা পরিবারে আর একজন কবিকে পেতে চলেছি। কিন্তু সেই কবির আর জন্ম হয়নি; কারণ মেয়েটি মারা গেল। এবং শিশুকবিটি মায়ের সঙ্গে, মায়ের ভেতরে সমাধিস্থ হলো। ছেলেটি খুব কষ্ট পেল। সে প্রতিজ্ঞা করল যে বাগানের একটি জিনিসও সে আর কোনোদিন স্পর্শ করবে না। কাজেই বাগানটি রয়ে গেল, বেড়ে উঠল, তারপর একসময় জঙ্গলে পরিণত হলো।’ বি. ওয়ার্ডসওয়ার্থ গল্পটি এখানেই শেষ করল।

আমি মুগ্ধ হয়ে তার দিকে তাকালাম। তাকে আরো বয়স্ক দেখাচ্ছিল। আমি তার গল্পটি বুঝতে পারলাম। আমরা সেদিন দীর্ঘ পথ হেঁটেছিলাম। বোটানিক্যাল গার্ডেনে গেলাম, তারপর গেলাম রক গার্ডেনে। সন্ধের আগ দিয়ে চ্যান্সেলর হিলে উঠলাম, দেখলাম – সমস্ত জায়গাটাকে অন্ধকার কেমন করে গিলে ফেলল। তারপর আবার শহরের বাতিগুলো শহরটাকে অন্ধকারের হাত থেকে উদ্ধার করল।

সে প্রতিটি কাজ এমন মনোযোগ দিয়ে করত, মনে হতো যেন জীবনে প্রথম সেই কাজটি করছে। আর মনে হতো, যেন ঈশ্বরের উদ্দেশে সবকিছু করছে। সে আমাকে বলত – ‘এখন আইসক্রিম খেলে কেমন হয়?’ এবং আমি যখন বলতাম – ‘মন্দ হয় না’। সে খুব গম্ভীর হয়ে বলত – ‘এখন আমরা কোন দোকানের সেবা গ্রহণ করব?’ যেন এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয়। সে এটা নিয়ে কিছুক্ষণ চিন্তা করে বলত – ‘আমার মনে হয়, ওই দোকানের সঙ্গে এ-ব্যাপারে আলোচনায় বসা যেতে পারে!’ তখন পৃথিবীকে আমার খুব উপভোগ্য বলে মনে হতো।

 

একদিন, যখন আমি তার উঠানে দাঁড়িয়ে ছিলাম, আমাকে বলল – ‘আমার খুব গোপন একটা বিষয় আজ তোমাকে বলব।’

‘খুউব গোপন কিছু?’ – আমি জানতে চাইলাম।

‘এ মুহূর্তে তা তো বটেই।’

আমি তার দিকে তাকালাম। সেও আমার দিকে তাকাল। আমি ভেতরে ভেতরে বেশ শিহরিত হলাম। সে বলল – ‘মনে রেখো, এটা শুধু তোমার আর আমার ভিতরে। একটি কবিতা লিখছি।’

ওহ, সেই কথা! বেশ হতাশ হলাম শুনে। আমি আরো গুরুত্বপূর্ণ কিছু শোনার অপেক্ষায় ছিলাম।

‘কিন্তু এটা ভিন্ন ধাঁচের একটি কবিতা।’ সে বলল। ‘এটা পৃথিবীর সব থেকে মহৎ একটি কবিতা।’

আমি শিস দিলাম।

সে আরো বলে – ‘এটা নিয়ে আমি পাঁচ বছরেরও বেশি সময় ধরে কাজ করছি। আজ থেকে বাইশ বছর পরে কবিতাটি শেষ করব। তাও সেটা সম্ভব হবে আমি যে গতিতে এখন লিখছি সেটা ধরে রাখতে পারলে।’

‘তুমি তাহলে প্রচুর লেখ?’ আমি বললাম।

‘এখন আর না। এখন আমি প্রতিমাসে একটা করে লাইন লিখি। তবে নিশ্চিত করি যেন ওটাই শ্রেষ্ঠ লাইন হয়।’

‘গত মাসের শ্রেষ্ঠ লাইনটা কী?’ আমি জানতে চাইলাম।

সে আকাশের দিকে তাকাল, তারপর বলল – ‘অতীত বড় বিধুর, বিষণœময়।’

‘বেশ ভালো লাইন।’ আমি বললাম।

‘আমি আমার একটি মাসের সমস্ত অভিজ্ঞতাকে জ্বালিয়ে কবিতার একটি লাইনে ঘনীভূত করতে চাই। তাই বাইশ বছর পরে আমি যে-কবিতাটি লিখব সেটা বিশ্বমানবতার সংগীত হয়ে উঠবে।’

আমি খুব বিস্মিত হলাম।

আমাদের হাঁটা চলতেই থাকল। একদিন ডকসাইটে সি-ওয়ালের পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় আমি বললাম – ‘ওয়ার্ডসওয়ার্থ, যদি আমি এই পিনটি পানিতে ফেলে দিই, তোমার কি ধারণা এটি ভেসে থাকবে?’

‘পৃথিবীটা বড় আজব। ওটা ফেলে দাও, দেখি কী ঘটে!’ সে বলল।

পিনটি ডুবে গেল।

আমি বললাম – ‘এ-মাসের লাইনটি কতদূর?’

সে আর কোনো লাইন শোনায়নি। শুধু বলত – ‘এই তো চলে এসেছে … হয়ে যাবে …।’

আমরা তখন সি-ওয়ালের ওপরে বসে যাত্রীবাহী জাহাজগুলোকে বন্দরে ভিড়তে দেখতাম। পৃথিবীর সেই শ্রেষ্ঠ কবিতাটি আমার আর শোনা হয়নি।

আমার মনে হতো, সে একটু জলদিই বুড়ো হয়ে যাচ্ছে।

‘তুমি কীভাবে বেঁচে আছ?’ – একদিন জানতে চাইলাম।

‘মানে, তুমি বলতে চাইছ আমি কীভাবে আয়-রোজগার করি?’

আমাকে তোতলাতে দেখে সে মৃদু হেসে বলল – ‘আমি ক্যালিপসোর সময়ে ক্যালিপসো গেয়ে বেড়াই।’

‘তাতেই তোমার হয়ে যায়?’

‘খুব ভালোমতোই।’

‘কিন্তু তুমি যখন পৃথিবীর বিখ্যাত কবিতাটি লেখা শেষ করবে তখন তো তুমি বেশ ধনী হয়ে যাবে?’

সে কোনো উত্তর করল না।

 

একদিন তাকে আমি তার সেই ছোট্ট ঘরটিতে দেখতে গেলাম। সে শুয়ে ছিল। খুব বয়স্ক আর ক্লান্ত দেখাচ্ছিল। তার এই অবস্থা দেখে আমার কাঁদতে ইচ্ছে করছিল।

‘কবিতাটি আসতে আসতে কোথায় যেন থমকে গেছে।’ সে বলল।

সে তখন জানালা দিয়ে বাইরের নারিকেল গাছটির দিকে তাকিয়ে ছিল। এমনভাবে কথা বলছিল যেন আমার উপস্থিতি টের পায়নি। ‘যখন আমার বয়স বিশের কাছাকাছি ছিল, নিজের ভিতরে একটা শক্তি অনুভব করতাম।’ তারপর আমার চোখের সামনেই তাকে আরো বুড়িয়ে ও ক্ষয়ে যেতে দেখলাম। ‘কিন্তু, সেটা ছিল অনেক অনেক দিন আগে।’

তার কথা শুনে, সবকিছু এতটাই তীব্রভাবে আমার চেতনায় এসে ধরা দিলো যে, মনে হলো মা আমার গালে কষে একটা থাপ্পড় মারল। মৃত্যু তার সংকুচিত হয়ে আসা মৃতপ্রায় মুখম-লে জীবন্ত হয়ে উঠল – এটা যেন সবার জন্যই উপস্থিত হয়েছিল।

সে আমার দিকে তাকাল, আমার চোখে পানি দেখে উঠে বসল।

‘এদিকে এসো।’ বলল সে। আমি তার পায়ের কাছে হাঁটু গেড়ে বসলাম।

সে আমার চোখের দিকে তাকাল, বলল – ‘তুমিও তাহলে এটাকে দেখতে পাচ্ছ? আমি জানতাম, তোমার চোখদুটো কবির চোখ।’

তাকে একটুও চিন্তিত দেখাচ্ছিল না। তার বোকার মতো শান্ত চেহারা দেখে আমি চিৎকার করে কেঁদে উঠলাম।

সে তার শুকনো বুকে আমাকে টেনে নিল। ‘তুমি কি চাও আমি তোমাকে এখন একটা মজার গল্প বলি?’ তারপর আমার ভেতরে উৎসাহ জোগাতে হেসে উঠল। কিন্তু আমি কোনো উত্তর দিলাম না।

সে বলল – ‘যখন আমি গল্পটি বলা শেষ করব, আমি চাই তুমি আমাকে ছেড়ে চলে যাবে এবং আর কোনোদিন ফিরে আসবে না। তুমি এখন আমাকে প্রতিশ্রুতি দেবে।’

আমার কণ্ঠস্বর যেন রুদ্ধ হয়ে আসছিল!

সে বলল – ‘বেশ, তবে শোনো। আমি তোমাকে ওই ছেলে কবি ও মেয়ে কবিকে নিয়ে যে-গল্পটা বলেছিলাম, তোমার মনে পড়ে? ওটা সত্য ছিল না। গল্পটা আমি তোমাকে বানিয়ে বলেছিলাম। তোমাকে কবিতা এবং আমার বিখ্যাত কবিতাটি নিয়ে যে-সমস্ত কথা বলেছি তাও সত্য নয়। এটা তোমার জীবনে শোনা সব থেকে মজার বিষয় হলো না?’

কিন্তু তার কণ্ঠস্বর আস্তে আস্তে ক্ষয়ে যেতে লাগল।

আমি ঘর থেকে বেরিয়ে এলাম। একজন কবির মতো যা কিছু দেখলাম তাই দেখে কাঁদতে কাঁদতে বাড়ি ছুটে এলাম।

 

এক বছর পরে এলবার্তো স্ট্রিট ধরে একা হেঁটে যাচ্ছিলাম। ওই কবির বাড়ির কোনো চিহ্ন খুঁজে পেলাম না। এটা ঠিক অদৃশ্য হয়েও যায়নি, মনে হচ্ছে কে বা কারা যেন গুঁড়িয়ে ফেলেছে। বেশ বড় দোতলা একটি ভবন জায়গাটি দখল করে নিয়েছে। সেই বিশাল আমগাছটিসহ, নারিকেল ও তালগাছটিও কেটে ফেলা হয়েছে। এখন সেখানে শুধু ইট, পাথর আর লোহা দেখা যাচ্ছে – যেন বি. ওয়ার্ডসওয়ার্থ কোনোদিনই ছিল না এখানে।