বেগম আকতার কামালের রবীন্দ্রচর্চা

সনৎকুমার সাহা

বইদুটো কদিন আগে-পিছে পড়ার সুযোগ পাই। লেখক বেগম আকতার কামাল। একেবারে অপরিচিত নন। আবার খুব বেশি যে জানি, তা নয়। অল্পই আমার পড়াশোনা। তাতেই আমি মুগ্ধ। এমন অভিজাত, নিরভিমান, কিন্তু সমর্থ-স্বাদু-মননপ্রভ-আতিশয্যহীন গদ্য খুব কম পড়েছি। ভাবনার প্রকাশ যথাযথ ও সম্পূর্ণ। অস্পষ্টতার আড়াল নেই কোথাও। ভাষার লাবণ্য ও গাম্ভীর্য অটুট থাকে সবটায়। এতটুকু তাল কাটে না। শৈলীর নিজস্বতা নিজেকে আলাদা করে চেনায়। আগ্রহ নিয়েই তাই বইদুটো পড়ি। উভয়েরই বিষয় রবীন্দ্রনাথ।

প্রথমটি, রবীন্দ্রনাথ : যেথায় যত আলো (২০১৪); প্রকাশনায় ঢাকার ‘অবসর’। দ্বিতীয় বইটি সবে বেরোল ২০১৭-র বইমেলায়। ছেপেছে ঢাকারই ‘কথাপ্রকাশ’। নাম রবীন্দ্রনাথের ব্রহ্মভাবনা। আগাম জানায় হতাশ হইনি। বাড়তি পেয়েছি অনেক। এই কথাটাই এখানে আর সবার সামনে খুলে বলি। মনে হয়েছে তা না করলে নিজের কাছেই জবাবদিহি করতে হবে। বইদুটো আর সবার নজরে আসা জরুরি। পড়লে তাদের মানসভুবনে আরো আলো ফুটবে, এ-আশায়। সেই সঙ্গে ভাবনা-জাগানো গদ্যের নির্মাণকলাও যে নৈরাত্মিক আকর্ষণ জাগিয়ে বিষয়নিষ্ঠ চেতনাকে ঊর্ধ্বমুখী করতে পারে, এমন অভিজ্ঞতার অংশীদার হওয়ার এক বিরল সুযোগও তারা পাবে।

আমি অবশ্য দ্বিতীয় বইটির বিষয়-আশয়ে আগে চোখ রাখি। কারণ, এ অগ্রসর হয় মনোজগতে একটি প্রত্যয়ের বিবর্তন ও রূপান্তরকে কেন্দ্র করে। প্রথম বইয়ে পাই রবীন্দ্রনাথের বহুমুখী চিমত্মার নান্দনিক প্রকাশের, অথবা তাদের উপলব্ধ তত্ত্বভূমির বিচার-বিশেস্নষণ। এ অনেকান্তিক। হয়তো আলাদা আলাদা বিবেচনার মুখাপেক্ষী। তাই এদের একসঙ্গে সামলানোর চেষ্টা। পরে অবশ্য আমি যেমন পারি, তেমন। অনেক আলোর শিখা আমার ক্ষীণদৃষ্টির কারণে চোখে না পড়াও সম্ভব। ‘দিনের আলোর গভীরে’ নয়, বিমুখ বা বিপন্ন অন্ধকারের প্রাচীরে প্রতিহত হয়ে তারার আলো না-ও ফুটতে পারে। ভুল দেখা বা খ–ত দেখা বিষয়-বিবেচনা বিপর্যস্তকরলে তার দায় পুরোটাই আমার। তার কালিমা যেন বইদুটোর ওপর কেউ না ছিটান। তারা অনেক নিবিষ্ট সাধনার ধন।

 

দুই

রবীন্দ্রনাথের ব্রহ্মভাবনা নিয়ে সুপরিকল্পিত, সুবিন্যস্তসমগ্রের ধারাবাহিকতায় ও পূর্ণতায় সচেতন, এবং সব নিয়ে সুসম্পন্ন একটি বই লেখায় অগ্রসর হওয়া যে কেউ বলবেন, অতিদুঃসাহসী কাজে হাত দেওয়া। ভাব ও ভাষার সমন্বয়ের দিকে ওই তীক্ষন অভিনিবেশ দাবি করে। ধারণার তাৎপর্যও গভীরভাবে অনুধাবনের চেষ্টা করতে হয়। ব্যক্তিমানসের নিজস্ব পছন্দ-অপছন্দকে দূরে সরিয়ে রাখা নিতান্তই জরুরি। পরিণাম যে প্রত্যাশা পূরণ করবে, এমনটি ঘটার সম্ভাবনা ক্ষীণ। সে-কারণেই বোধহয়, এ নিয়ে অনেকে বিক্ষিপ্ত সারবান কথা বললেও কেউ সবটা মিলিয়ে সমস্তটা একাঙ্গে সুস্পষ্ট ফুটিয়ে তুলবেন, এমনটি আগে আমার চোখে পড়েনি। আমার অজামেত্ম কেউ করতে পারেন; তাঁকে বা তাঁদের প্রণাম। কিন্তু তেমন থাকলে তারা যত বিশিষ্টই হোক, বেগম আকতার কামালের এই বই, আমার বিশ্বাস, তাঁদের পাশে এতটুকু মস্নান হবে না, বরং আপন অনন্যতায় নিজের উজ্জ্বলতা চেনাবে। অনপেক্ষ পাঠেই তার নিরাসক্ত বিচারের মহিমা ও নিরাবেগ সৌকর্যের বিভা আমাদের আকৃষ্ট করে।

প্রথমেই ব্রহ্ম ও ধর্মদর্শনের সংযোগ রেখাটি খুঁজেছেন বেগম আকতার কামাল। তবে এ-বিষয়ে কথা বাড়ানোর আগে একটি বিষয় স্পষ্ট করি – বিচারে তিনি কোনো পক্ষপাত দেখাননি। আজকের প্রেক্ষাপটে অনেক প্রশ্ন অবান্তর হয়ে পড়াও সম্ভব। তিনি কিন্তু তাঁর দৃষ্টি ঘটনার কালখ–ই সীমাবদ্ধ রেখেছেন, যদিও সাম্প্রতিক ধ্যান-ধারণাতেও নিজেকে শানিত করেছেন। আমি নিতান্তই হাটুরে লোক। বিদ্যাশৃঙ্খলার নিয়মকানুন কিছু জানি না। ফলে নানা জায়গায় পদস্খলন বা সীমানা লঙ্ঘন ঘটতে পারে। অভিজ্ঞ যাঁরা, তাঁরা এমন সম্ভাবনা মাথায় রেখে লেখাটি পড়বেন, এটুকু মিনতি।

উনিশ শতকের বঙ্গভূমিতে মানব বাস্তবতায় ব্রহ্মভাবনাকে কেন্দ্রভূমিতে প্রথম নিয়ে আসেন রাজা রামমোহন রায় (১৭৭২-১৮৩৩)। এদেশের ইতিহাসে এক ক্রান্তিলগ্নে তাঁর আবির্ভাব। মোগল সাম্রাজ্য তখন অস্তাচলে। বাংলায় নবাবি আমলের অবশেষটুকুও নির্বাপিত হয় ১৭৭৩-এ ব্রিটিশ পার্লামেন্টে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মাধ্যমে ভারত-নিয়ন্ত্রণ আইন পাশ হওয়ায়। পরের বছর ১৭৭৪-এ কোম্পানির শাসনে প্রথম গভর্নর জেনারেল হন ওয়ারেন হেস্টিংস। তার আগে আঠারো শতকের শুরু থেকেই বাংলায় চলে আসছে অস্থিতিশীলতার ধারাবাহিকতা। তা যুগান্তকারী অনিশ্চয়তার জন্ম দেয় ১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধের পরিণামে। প্রায় নৈরাজ্যিক দখলদারির সুযোগে কোম্পানি রাজস্ব-আদায়ের অধিকারকে চরম নির্মমতায় ব্যবহার করায় ভূস্বামী থেকে কৃষক, সকলেই ছারেখারে যেতে বসে। এরই অনিবার্য পরিণতি ছিয়াত্তরের মন্বন্তর (১১৭৬ বঙ্গাব্দ, খ্রিষ্টাব্দ ১৭৭০), যাতে বাংলার জনসমষ্টির এক-তৃতীয়াংশের প্রাণ যায়। অরাজক অবস্থাকে স্থিতিশীল করার লক্ষক্ষ্য এখানে ব্রিটিশ সরকারের পক্ষে গভর্নর জেনারেলের নিয়োগ দেওয়া। সঙ্গে সঙ্গে পরিস্থিতির উলেস্নখযোগ্য উন্নতি হয় না। জমির অধিকার রক্ষায়, সূর্যাস্তআইন, দশ-সালা বন্দোবস্তএসব পরীক্ষা-নিরীক্ষার ভেতর দিয়ে অবশেষে ১৭৯৩ খ্রিষ্টাব্দে – লর্ড কর্ন ওয়ালিস তখন গভর্নর জেনারেল – বাংলায় ভূমির অধিকারে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তচালু হয়। এতে জমিদারির অধিকারকেও করা হয় বাজারে অবাধ কেনাবেচার বিষয়। জমির খাজনা একবারে পাকাপোক্ত স্থির হয়ে যায়। একমাত্র সময়মতো রাজকোষাগারে খাজনা দিতে না পারলে তবেই কোনো জমিদারির নিলামে তোলার বিধান রাখা হয়। জমিদার যে-ই হোক, তার দেয় খাজনায় পরিবর্তন হয় না। তবে তার রোজগার বাড়ানোয় উৎপাদনের দিকে নজর না দিয়ে প্রকৃত চাষিদের ওপর যদি সে জোরজবরদসিত্ম করে, তবে তা ঠেকানোর কোনো ব্যবস্থা থাকে না। প্রত্যাশিত ছিল, সেও বাজারে সর্বোচ্চ উদ্বৃত্ত পাওয়ার আশায় জমির উৎপাদিকাশক্তি বাড়ানোর দিকে বিশেষ যত্ন নেবে। কৃষকদের কাজেও উৎসাহ বাড়ানোর চেষ্টা করবে। তা হয় না। তবে সমাজ আপেক্ষিক স্থিতিশীলতা পায়।

আরো একটা ব্যাপার অলক্ষে ঘটে চলে। প্রচলিত ধারণায় রাজা-বাদশা বাস্তব জীবনে সর্বেসর্বা – ঈশ্বরের প্রতিনিধি। তাঁর কৃপায় কারো এই ক্ষমতা লাভ। তাঁর বিরূপতা কারো ক্ষমতা নাশের কারণ। ফলে গণমানুষের এ নিয়ে কোনো মাথাব্যথা থাকে না। পলাশীর যুদ্ধের সময় পাশের জমিতে কৃষক নিশ্চিমেত্ম হালচাষ করে। যুদ্ধে জয়-পরাজয় তার কাছে অবান্তর। কিন্তু এমন এক পরিস্থিতি তৈরি হয়, যেখানে প্রত্যক্ষে কোনো রাজা নেই। যারা শাসক, তাদের সঙ্গে দৈনন্দিন কর্মকা– ব্যবসাপাতির সম্পর্ক। তারাও প্রত্যক্ষে। ঈশ্বরের আনুকূল্য যদি তারা পায়, তবে তা পেতে পারে যে-কেউ। ব্যক্তি ও ঈশ্বর সরলরেখায় যুক্ত হয়। আচার-অনুষ্ঠান ইত্যাদির প্রতীকী মূল্য আর থাকে না। ইহজাগতিক-মানবিক সম্পর্কে কৃত্রিম দূরত্ব অসার হয়ে পড়ে। সবাই যে একরকম ভাবে, তা নয়। তবে কোনো কোনো প্রখর চিমত্মাশীল মানুষের কাছে বিষয়টি এমন ধরা দেয়, রামমোহন রায় তাঁদের একজন।

আঠারো শতকের অনেকটা জুড়ে ঘটে চলে সব উথালপাথাল কা-। প্রাতিষ্ঠানিক শক্তির, শাসনের বা বাধ্যতার কোনো ধারাবাহিক সংগতি থাকে না। এই ভূখ– মানুষের চেতনায় এক ধরনের অনিশ্চয়তা নিজেদের অজামেত্মই বাসা বাঁধে। শেষ পর্যন্ত স্থিতিশীলতা আসে শাসনক্ষমতা পুরোপুরি কোম্পানির হাতে চলে গেলে। ওই পর্বেই রামমোহনের বেড়ে ওঠা। তীক্ষন ধীশক্তি ও বিপুল জীবন-জিজ্ঞাসা নিয়ে তিনি বাস্তবের অন্তর্নিহিত সত্য বোঝার চেষ্টা করতে থাকেন। পূর্বনির্ধারিত সব ছক তিনি খোলামনে পরীক্ষা করেন। কোম্পানির কর্তাব্যক্তিদের সঙ্গে যোগাযোগের সূত্র ধরে য়োরোপের বিকাশমান জ্ঞানকা–র বিশদ পরিচয় পান। ফরাসি বিপস্নব (১৭৮৯), রাষ্ট্রকাঠামোয় ব্যক্তিস্বাধীনতার আদর্শ, স্বাধীনতা, সাম্য, সৌভ্রাতৃত্বে সংকল্প, এগুলো তাঁকেও অনুপ্রাণিত করে। কোম্পানির শাসনকে তিনি নেতিবাচকভাবে দেখেন না। বরং একে আন্তর্জাতিকতাবোধের ও আত্মশক্তি জাগরণের সম্ভাবনা সৃষ্টির পথ বলেই মনে করেন। বাজারের ক্রিয়াশীলতায় তিনি দেখেন প্রত্যেকের সাধ্য অনুযায়ী স্বাধীন সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার। চিরস্থায়ী বন্দোবসেত্ম খোলাবাজারে জমির কেনাবেচা তাই তাঁর অনুমোদন পায়। নিজেও এই সুযোগে আপন বুদ্ধি-বিবেচনা খাটিয়ে বিপুল সম্পত্তির মালিক হন। তবে এটাও খেয়াল করার, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি স্বয়ং ছিল একচেটিয়া কারবারি। মুক্তবাণিজ্যে প্রশ্রয় দিতে সে প্রস্ত্তত ছিল না। কোম্পানির কর্মচারী, যারা খোলাবাজারে ব্যবসা করতে চায়, তারা কোনো প্রাতিষ্ঠানিক অনুমোদন পায় না। নতুন মুদ্রণশিল্পের উৎসাহী ব্যবহারের কল্যাণে ওই সময়ে অভিনব বাংলা ও ইংরেজি পত্রপত্রিকায় রামমোহন রায় তাঁদের হয়ে জোর সওয়াল করেন। তিনি মনে করেন, ব্যক্তিস্বাধীনতার সূত্র ধরে দুপক্ষের খোলামেলা বাণিজ্যিক যোগাযোগ উভয়েরই সম্পদ-বৃদ্ধিতে সহায়ক হবে। আমরা জানি, আধুনিক মুক্তবাজার অর্থনীতির প্রথম পূর্ণাঙ্গ শাস্ত্রগ্রন্থ অ্যাডাম স্মিথের An inquiry into the nature and causes of the wealth of natives প্রথম প্রকাশিত হয় ১৭৭৬ সালে। গোটা য়োরোপে তার প্রভাব পড়ে। প্রভাব পড়ে নতুন পরিস্থিতিতে বিশ্বচেতনায় উদ্বোধিত কলকাতাকেন্দ্রিক বাঙালি সমাজের ক্ষুদ্র প্রভাবশালী অংশেও। রামমোহন রায় সেখানে প্রাগ্রসর একজন।

পশ্চাদপটে এই পরস্পর-সংশিস্নষ্ট ভাবনাচিত্রটি সাজিয়ে বেগম আকতার কামালের শরণ নিই। তিনি জানাচ্ছেন, ‘ঔপনিবেশিক পরাধীনতায়ও মধ্যবিত্ত শিক্ষিত শ্রেণির মধ্যে যে বিত্তশালী একটি অংশ বিকশিত হচ্ছিল তারা আর সনাতন ধর্মপ্রাকারে আবদ্ধ থাকতে চাইল না আর্থিক স্বার্থেই। রাজনৈতিক পরাধীনতায় তারা বিকল্পায়নে গিয়ে নতুন একটি ধর্মমতের বিনির্মাণে অগ্রসর হয়, এবং সমাজকে ধর্মভিত্তিক প্রতর্কের মধ্যে নিয়ে যায়। তবে লক্ষণীয়, এই ধর্মপ্রতর্ক সমাজকেই দ্বান্দ্বিকতার মধ্য দিয়ে, ইতিনেতি তাৎপর্যের হাত ধরে নিয়ে যাচ্ছিল নতুন কালধর্মের সঙ্গে বোঝাপড়ার লক্ষক্ষ্যর দিকে।’

এই নতুন ভাবনা অঙ্কুরিত হয়েছিল রামমোহন রায়ের জীবনসাধনায়। তবে এটা আপতিক নয় যে, ঘটনার দৃশ্যায়ন রূপ পাচ্ছিল তখনকার কলকাতা নামে ভুঁইফোঁড় নামগোত্রহীন এক শহরে, যদিও সেখানেই চলছিল অনিশ্চিত ভবিষ্যতের নির্মাণে বহুমুখী তৎপরতা, অনেক ভাগ্যান্বেষীর অস্থির যাত্রা। কৌতূহলী সবারই এটা জানা, ১৬৯০ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির নিয়োগপ্রাপ্ত এক আধিকারিক জব চার্নক ব্যবসার পাকাপাকি বন্দোবস্তকরার লক্ষক্ষ্য সুতানুটি, গোবিন্দপুর ও কলকাতা, এই তিনটি অতি অস্বাস্থ্যকর জল-জঙ্গলে ভরা এঁদো গ্রাম সস্তায় ইজারা নিয়ে সেখানে এই শহরের পত্তন করেন। এ যে একশ বছর না পেরোতেই গোটা বাংলার ভাগ্য নির্ধারণের কেন্দ্র হয়ে উঠবে, তা কল্পনা করাও ছিল বাতুলতা। রাজমহল, ঢাকা, মুর্শিদাবাদের মতো কোনো বনেদি ঐতিহ্য এর ছিল না। নেহাতই শূন্যের ওপর ঘর তোলা। কোম্পানির শাসন শুরু হলে তা-ই হলো রাজধানী। কোনো শিকড় না থাকাই কিন্তু এই শহরে ধ্যান-ধারণা বিকাশে একটা ইতিবাচক ভূমিকা দেখা দিলো। যেহেতু শূন্য থেকে শুরু তাই অতীতের পিছুটান তেমন পা আঁকড়ে ধরে না। ভাগ্যান্বেষীরা, তাদের ভেতর থেকে নতুন ভাবনার নির্মাতারা এখানে বেশি সাহসী হওয়ার সুযোগ পায়। শাসক যারা, তারাও অজ্ঞাত-কুলশীল। প্রাচীন প্রথার দোহাই, তাদের কাছ থেকে প্রত্যাশিত নয়।

এসবই রামমোহনের অনুকূলে যায়। তাছাড়া তিনি ছিলেন প্রতিভাবানদের ভেতরেও ব্যতিক্রমী প্রতিভার অধিকারী। স্বভাবজাত মেধায় আয়ত্ত করেছিলেন প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের বেশ কটি ভাষা। সবগুলোর ব্যবহার তাঁর আকুল জিজ্ঞাসু মনের উত্তর অন্বেষণে। প্রচলিত সব শাস্ত্রের ও জীবনপ্রণালির মৌলিক বিষয়গুলো ঝাড়াই-বাছাই করে খোলামনে তিনি যুক্তিসংগত সমাধান-সূত্র খোঁজেন। সমকালীন য়োরোপের জ্ঞানচর্চার ধারাও বাদ যায় না। পরিণামে তিনি পৌঁছোন নিরাকার ব্রহ্মের ধারণায়। তবে সবটাই মননজাত। আবেগের আবেদন তাতে মেশান না। তাঁর মুক্তপ্রাণের ও স্বচ্ছদৃষ্টির শৃঙ্খলা অক্ষুণ্ণ থাকে। সত্য কথা, এই ব্রহ্মকে তিনি উপনিষদের প্রয়োগ থেকে আহরণ করেন। কিন্তু তাতে যুগমানুষের বাস্তব সামর্থ্যের আকাঙক্ষাও মেশান। তবে গণমানুষের জীবনযাপনে সুখ-দুঃখের প্রশ্ন তাতে মেশান না। তাঁর ব্রহ্ম একান্তই মননসিদ্ধ নিরাকার সমাধান।

তবে তিনি কোনো ধর্ম প্রতিষ্ঠা করেননি। সত্যার্থী সমমনাদের নিয়ে ব্রাহ্মসমাজ গড়েছিলেন মাত্র। নিয়মিত সমাবেশে তত্ত্ব আলোচনা ও ব্রহ্মসংগীত গাওয়া এবং প্রয়োজনে নিজেদের পত্রিকায় অথবা পুসিত্মকায় বিরোধী মত খ-ন, এসবের ভেতরেই তাঁদের কর্মকা- আবর্তিত হচ্ছিল। একে ধর্মের আকার দেন দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর। মনে রাখতে হবে, তাঁর পিতা দ্বারকানাথ ঠাকুর ছিলেন রামমোহনের একান্ত সুহৃদ। কিন্তু তিনি ব্রাহ্মধারণায় আকৃষ্ট হলেও নিজে ওই সমাজের সদস্য হননি। যদিও নতুন যুগে ব্যক্তির পার্থিব উন্নতির সম্ভাবনায় সাগ্রহ অনুমোদন তাঁকে উৎসাহিত করেছিল। তবে এর পরিণাম তাঁর জন্য ভালো হয়নি। উদ্যোগপতি হওয়ার কোনো অভিজ্ঞতা না থাকায় তাঁর সব প্রকল্প ব্যর্থ হয়। মারা যান ছেলে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের মাথায় বিপুল ঋণের বোঝা চাপিয়ে। দেবেন্দ্রনাথ শিল্পায়নের দিকে যান না। তাঁর ছেলে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ একটু-আধটু চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে পিছুটান দেন। বিশ শতকে আচার্য প্রফুলস্নচন্দ্র রায়ও কলকাতাকেন্দ্রিক বাঙালিকে উদ্যোগপতি হতে বারবার সনির্বন্ধ আহবান জানিয়েও কোনো সাড়া পান না। মাছে-ভাতে বাঙালি, বিশেষ করে যারা ভদ্রসমত্মান, এমন প্রয়াস সবিশেষ সন্দেহের চোখে দেখে। যদিও পশ্চিম ভারতে ধারাবাহিক ঐতিহ্য তাদের এদিকে টানে। ব্রাহ্মসমাজের আধুনিকায়নের একটি সম্ভাবনা বৃথা যায়।

রবীন্দ্রনাথ রামমোহন রায়কে মনে করতেন যুগশ্রেষ্ঠ মানব। একাধিক জায়গায় তিনি এই অভিমত প্রকাশ করেছেন। গান্ধীর সঙ্গে ঝগড়া করেছেন। নিজের অবস্থান থেকে একচুল নড়েননি। এই বইয়ে ‘রবীন্দ্রনাথের ব্রাহ্মসমাজদর্শন’ – অধ্যায়ে বেগম আকতার কামাল কালান্তর থেকে তাঁর কথার যে-উদ্ধৃতি দিয়েছেন, তাতে পড়ি, ‘… এই নবঈশ্বরের প্রবর্তক তাঁর ব্রাহ্মসংগীতে কোনো ‘তুমি’ বা তাঁর সমার্থক শব্দ প্রয়োগ করেননি। পেশ করেননি কোনো প্রার্থনীয় বা বাঞ্ছনীয় বিষয়।… যে-গানে ঈশ্বর উচ্চারিত হয়েছেন ‘যাঁর’, ‘যিনি’ প্রভৃতি সর্বনামে।… রামমোহন উপাসনার কথা বললেও তাঁর ঈশ্বরজ্ঞান ও কর্মে উপলব্ধ ঈশ্বর; যে-কর্মের কথা তাঁর গানেও রয়েছে – ‘পরহিতে মন দিবে সত্যকে চিনিবে।’

রবীন্দ্রনাথের এই মূল্যায়নে অতিশয়োক্তি আছে, যদিও রামমোহনের চিমত্মা ও কাজের ঝোঁকটা এতে ধরা পড়ে। তাঁর অতিবিখ্যাত একটি গান, ‘ভাব সেই একে’ -। এর অন্তিমে তিনি জুড়ে দেন রবীন্দ্রনাথেরও প্রিয় বৈদিক মন্ত্র ‘ত্বমীশ্বরাজাং পরমং মহেশ্বরং – ’ : তুমি সব ঈশ্বরের ভেতরে পরম মহেশ্বর।’ তাঁর রচিত বত্রিশটি গানের ভেতর শেষেরটি,

 

কি স্বদেশে কি বিদেশে যথায় যথায় থাকি।

তোমার রচনা মধ্যে তোমাকে দেখিয়া থাকি।

দেশভেদে কালভেদে রচনা অসীমা,

প্রতিক্ষণে সাক্ষ্য দেয় তোমার মহিমা।

তোমার প্রভাব দেখি না থাকি একাকি \

তবে অস্বীকার করা যায় না, তাঁর ব্রহ্ম যুক্তির নির্যাস। এবং এই যুক্তির সংগ্রামে রত তিনি নিরন্তর। মোটা দাগে একটি তুলনা দিয়ে বলা যায়, তাঁর ঈশ্বর ওল্ড টেস্টামেন্টে মোজেসের জেহোভা; আর রবীন্দ্রনাথের ঈশ্বর নিউ টেস্টামেন্টে যিশুখ্রিষ্টের পিতা। এই করুণাঘন ঈশ্বরের সার্বভৌমত্বের ধারণা রচনা করেন দেবেন্দ্রনাথ। ব্রাহ্মধর্ম প্রতিষ্ঠা করেন তিনিই। তাঁর আত্মজীবনী থেকে বেগম আকতার কামাল শোনাচ্ছেন – ‘যখন উপনিষদে দেখিলাম ‘সোহ্মস্মি’ তিনিই আমি’, ‘তত্ত্বমাস’ তিনিই তুমি, তখন আবার সেই উপনিষদের উপরেও নিরাশ হইয়া পড়িলাম। এই উপনিষদও আমাদের সকল অভাব দূর করিতে পারে না, হৃদয়কে পূর্ণ করিতে পারে না।… পবিত্র হৃদয়েই ব্রহ্মের অনুষ্ঠান। পবিত্র হৃদয়ই ব্রাহ্মধর্মের পত্তনভূমি। সেই হৃদয়ের সঙ্গে যেখানে উপনিষদের মিল, উপনিষদের সেই বাক্যই আমরা গ্রহণ করিতে পারি। হৃদয়ের সঙ্গে যাহার মিল নাই সে বাক্য আমরা গ্রহণ করিতে পারি না।’

এখানে কিন্তু মূল রামমোহন রায়ের যুক্তিসিদ্ধ অবস্থান থেকে কিছুটা সরে আসার ইঙ্গিত পাই। রামমোহনের যাত্রা ছিল মূলত মননের পথে। দেবেন্দ্রনাথ তাঁকে অনেকখানি ঘুরিয়ে দিলেন ‘আত্মপ্রত্যয়-সিদ্ধ-জ্ঞানোজ্জ্বলিত বিশুদ্ধ হৃদয়াভিমুখে। বোধহয় ধর্ম-সংস্থাপন করতে চাইলে এছাড়া পথ থাকে না। তবে এতে কর্মের যৌক্তিক বিকাশ ক্ষুণ্ণ হয় এবং ব্যক্তি আত্মমগ্নতায় উদ্ধার খোঁজে, এমনটির সম্ভাবনা যে বেড়ে যায়, তা অস্বীকার করা যায় না। এর প্রভাব রবীন্দ্রনাথের ওপরও পড়েছিল।

তবে উপনিষদে যেখানে দেবেন্দ্রনাথ আস্থা হারিয়েছিলেন, সেখানে কোনো অসংগতি আছে বলে আমার মনে হয় না; – যদিও অসংগতি থাকা খুবই স্বাভাবিক। এবং তা অন্য বহু জায়গায় আছে। উপনিষদের বাণীগুলো প্রায় তিনশো বছর ধরে ধারাবাহিক শ্রুতিতে সংকলিত হয়ে এসেছে। বাস্তবের প্রেক্ষাপট ক্রমাগত বদলেছে। সেই সঙ্গে প্রশ্ন মীমাংসার জায়গাটাও সরে সরে গেছে। এমনটিই স্বাভাবিক। মানুষের মনোজগতের ক্রিয়াও স্থান-কালে আপেক্ষিক। তবে ‘সোহ্মস্মি’ ও ‘তত্ত্বমসি’র ভেতর কোনো স্ববিরোধ নেই। ঈশোপনিষদে যে-শেস্নাকে ‘সোহ্মস্মি’ আছে তাতে বলা হচ্ছে, ‘হে সূর্য হে একাকি পথিক, তোমার জ্যোতিরশ্মি সংবরণ কর, যাতে তোমার কল্যাণতম রূপ আমি দেখতে পাই। তোমার ভেতরে যে পুরুষের নিত্য অবস্থান, আমিও সেই।’ আর ছান্দোগ্য উপনিষদে আরুণি-শ্বেতকেতু-কথাতে পিতা আরুণিপুত্র শ্বেতকেতুকে ব্রহ্মবিদ্যা শেখাচ্ছেন, – ‘ন্যগ্রোধ (বট) বৃক্ষের কোন ফলে তার বীজের ভেতরে যা অদৃশ্য হয়ে বিদ্যমান, লবণাক্ত জলে অদৃশ্য হয়েও যেমন লবণের অসিত্মত্ব থাকে, তেমন সর্বভূতান্তরাত্মা সবকিছুতে লীন হয়ে আছে। জলে-স্থলে-অন্তরীক্ষে, সবেতে তা অর্থাৎ সবই তা। তুমিও তাই।’ একই কথা দুভাবে ঘুরিয়ে বলা। এবং এখান থেকে সর্বাসিত্মবাদে অভিযাত্রা।

রবীন্দ্রনাথ কিন্তু এমন খটকায় পড়েননি। পূরবীর ‘সাবিত্রী’ কবিতায় পাই ঈশোপনিষদের ওই বাণীর টাকাসমেত প্রায় আক্ষরিক পুনরাবৃত্তি : – ‘তোমার হোমাগ্নি মাঝে আমার সত্যের আছে ছবি,/তারে নমো নম।/ তমিস্রসুপ্তির কূলে যে বংশী বাজাও, আদি কবি,/ধ্বংস করি তম/ সে বংশী আমারই চিত্ত – ’ ‘তত্ত্বমসি’ও এতে মিশে যায়। কারণ এই ‘আমি’ কোনো একক ‘আমি’ নয়, সমস্তকিছুতে, সমস্তকিছুর আত্মসত্তা।

অপ্রাসঙ্গিক হলেও এখানে অন্য একটি বিষয় টেনে আনি। পাবনার সিরাজগঞ্জে ঠাকুর-পরিবারের ছিল বিশাল এজমালি জমিদারি। দেবেন্দ্রনাথও তার এক বড় অংশীদার ছিলেন। প্রজাদের ওপর সুবিচার করায় ঠাকুর-এস্টেটের সুনাম ছিল না। ১৮৭২-৭৩ সালে সিরাজগঞ্জে এক কৃষক-বিদ্রোহ হয়। তা পরিচালিত হয় যে প্রধান পাঁচ জমিদারি মালিকানার বিরুদ্ধে, ঠাকুর-এস্টেটও তার একটি। সম্ভবত দেবেন্দ্রনাথ তখন তাঁর ‘হৃদয় মাঝে’ ব্রহ্মের ডাক শোনায় এত আত্মমগ্ন যে, প্রজাদের হাহাকার তাঁর কানে পৌঁছোয়নি। স্থানীয় নায়েব-গোমস্তা-পাইক-পেয়াদা-বরকন্দাজরা তাদের দুঃশাসন লাগামহীন চালিয়ে যায়। প্রতিক্রিয়ায় ওই কৃষক-বিদ্রোহ। এর সুফল যে কিছু ফলে না, তা নয়। এরই পরিণামে ১৮৮৫ সালে প্রজাস্বত্ব আইনের সংশোধনীতে জমিদারদের ইচ্ছামতো জমি থেকে প্রজা উৎখাত বন্ধ হয়। রবীন্দ্রনাথ সাজাদপুরে আসেন তার বছরপাঁচেক পরে। প্রজাদের সঙ্গে আচার-আচরণে বৈষম্য তিনি দূর করারই চেষ্টা করেছেন। হয়তো তিনি উপনিষদের ‘রূপং রূপং প্রতিরূপো বভূব। রূপং রূপং প্রতিরূপো বহিশ্চ \’ – এই বাণীর সারসত্য আপন চেতনায় তার ব্যবহারিক কল্যাণকরতায় একভাবে হৃদয়ঙ্গম করে তাকে বাস্তবের সঙ্গে মেলাতে চাইছিলেন।

আরো একটা ব্যাপার হয়তো তত অপ্রাসঙ্গিক নয়, কিন্তু এই বইয়ের চৌহদ্দিতে আসে না, একটু ছুঁয়ে যাই। এটি ওই কলকাতাতেই রামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের আবির্ভাব। তিনি ছিলেন দেবেন্দ্রনাথের সমসাময়িক কিন্তু মেজাজে, দেশনায় সম্পূর্ণ বিপরীত মেরুর। প্রায় অশিক্ষিত, তথাকথিত ভদ্রবেষ্টনীর বাইরে, এক অসাধারণ প্রতিভাবান কা-জ্ঞানসম্পন্ন চালচুলোহীন কালীসেবক, তিনি যুগচেতনাকে যেভাবে আত্মস্থ করেছিলেন এবং এক সরল, প্রায়-গ্রাম্য কিন্তু বুদ্ধিদীপ্ত ভাষায় প্রাসাদবাসী থেকে পর্ণকুটীরের অমানিত-জনদের সঙ্গে অবলীলায় যোগাযোগ গড়ে তুলেছিলেন, তা কোনো শিক্ষাভিমানী মার্জিত বাবুসম্প্রদায়ের কারো পক্ষে সম্ভব হয়নি। মহেন্দ্রনাথ গুপ্তের সম্পাদনায় তাঁর দৈনন্দিন কথকতার সংকলন, শ্রী শ্রী রামকৃষ্ণ কথামৃত মাটিঘেঁষা জীবন থেকে ছেনে নেওয়া উপমা, রূপক, উপকথায় মেশানো এক আশ্চর্য সম্পদ। তিনি কোনো নতুন দিক নির্দেশ করেন না। বলেন, যত মত, তত পথ। সবই মিলেছে এক জায়গায়। নিজে কালীসাধক। আপনমনে গেয়ে ওঠেন রামপ্রসাদী, ‘মন রে, কৃষিকাজ জানো না। এমন মানবজমিন রইল পতিত, আবাদ করলে ফলতো সোনা।’ অথবা, ‘সকলই তোমারি ইচ্ছা, ইচ্ছাময়ী তারা তুমি। তোমার কর্ম তুমি কর মা, লোকে বলে করি আমি\’ কিংবা অজস্র এরকম আর সব গান। এদের তত্ত্বকথা ব্রাহ্মতত্ত্বের সঙ্গে কোনো বিরোধ তৈরি করে না বরং একই কথা বলে। মাটিঘেঁষা মানুষের প্রাণের আর্তি তত্ত্বকথায় এসবে মেটে। অত মাটিঘেঁষা যারা নয়, তাদেরও। বাস্তবে ওই সময়ে রামকৃষ্ণদেবের আবির্ভাব ব্রাহ্ম-আন্দোলনের পালের হাওয়া অনেকটাই কেড়ে নেয়। তাঁর শিষ্য বিবেকানন্দ অবশ্য সম্ভবত না বুঝেই তাঁর ভাবমূর্তিকে খ্রিষ্টান যাজকদের অনুকরণে রামকৃষ্ণ মিশনের সংকীর্ণ গ–তে বাঁধেন। এর সুদূরপ্রসারী ফল ভালো হয়নি। বিবেকানন্দের সমসাময়িক রবীন্দ্রনাথও রামকৃষ্ণদেবকে যথোচিত মর্যাদাই দিয়েছেন। ১৩৪২ বঙ্গাব্দে রামকৃষ্ণ জন্মশতবার্ষিকীতে তিনি যে আন্তরিক শ্রদ্ধা নিবেদন করেন, তাতেই এ ফুটে ওঠে : ‘শত সাধকের বহু সাধনার ধারা/ ধেয়ানে তোমার মিলিত হয়েছে তারা।/ তোমার জীবনে অসীমের লীলাপথে/ নূতন তীর্থ রূপ নিল এ জগতে;/ দেশ-বিদেশের প্রণাম আনিল টানি/ সেথায় আমার প্রণতি দিলাম আনি।’

একদিক থেকে রবীন্দ্রনাথকে বোঝার জন্যও এ খুব তাৎপর্যপূর্ণ। বিশেষ করে তাঁর ব্রহ্মভাবনাকে। গীতাঞ্জলি পেরিয়ে তিনি গেয়ে ওঠেন ‘আমার সকল রসের ধারা/ তোমাতে আজ হোক-না হারা -’। বোঝা যায় তাঁর মনে নিরন্তর ব্রহ্মভাবনায় রূপান্তর ঘটে চলেছে। বেগম আকতার কামাল গভীর অভিনিবেশে সেই রূপান্তরের পথটি ছেঁকে তুলে এ-বইয়ে আমাদের সামনে মেলে ধরেছেন। আমরা কৃতজ্ঞ বোধ করি।

রামকৃষ্ণদেব আপনমনে প্রায়ই বলতেন, ‘মানুষ কি কম গা’, অথবা ‘আমাকে রসে-বশে রাখিস মা।’ রবীন্দ্রনাথ অবশ্যই তাঁর আসরে কখনো থাকেননি। যখন রামকৃষ্ণের দেহাবসান হয় – উনিশ শতকে আটের দশকের মাঝামাঝি – তখন রবীন্দ্রনাথ উঠতি যুবক। রামমোহন দেবেন্দ্রনাথের অনুসারীই শুধু নন, পিতৃ-আজ্ঞায় আদি ব্রাহ্মসমাজের সাংগঠনিক কর্মকা–ও জড়িত। তবু শুরু থেকেই তিনি অনেকখানি দলছুট। প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মপালনে নিরুদ্যম। তাঁর স্বীকারোক্তিতে এসব কথা বেগম আকতার কামাল জানিয়েছেন। আনুষ্ঠানিকতাকে অশ্রদ্ধা না করেও কবি নিজের মতো চলেছেন। একসময় আনুষ্ঠানিকতার আবরণ খসে পড়েছে। তখন আনুষ্ঠানিকতাই তাঁর পিছু পিছু ছুটেছে। তেপ্পান্ন বছর বয়সে আত্মস্থ রবীন্দ্রনাথ গেয়ে ওঠেন, ‘আমি হৃদয়েতে পথ কেটেছি, সেথায় চরণ পড়ে,/ তোমার   সেথায় চরণ পড়ে -।’ একই রকম ‘আপন হতে বাহির হয়ে বাইরে দাঁড়া,/ বুকের মধ্যে বিশ্বলোকের পাবি সাড়া \’ আরো গান, পঁয়ষট্টি বছর বয়সে, ‘চাহিয়া দেখো রসের স্রোতে রঙের খেলাখানি – ।’ এমন উদাহরণ মিলবে প্রচুর। খেয়াল করি, তাঁর বিবর্তিত ব্রহ্মভাবনা রামকৃষ্ণের শুভ কামনা, ‘তোমার চৈতন্য হোকে’র সঙ্গে একই জায়গায় এসে মেলে। তবে তিনি বেড়েছেন তাঁর নিজের মতো। রামকৃষ্ণকে ছাড়িয়েও গেছেন। জীবনের শেষপ্রামেত্ম এসে অকুণ্ঠে জানিয়েছেন, – বেগম আকতার কামালও পরম শ্রদ্ধায় উলেস্নখ করেছেন – ‘আমার গানের মধ্যে সঞ্চিত হয়েছে দিনে দিনে/ সৃষ্টির প্রথম রহস্য, আলোকের প্রকাশ,/ আর সৃষ্টির শেষ রহস্য, ভালোবাসার অমৃত।/ আমি ব্রাত্য, আমি মন্ত্রহীন,/ সকল মন্দিরের বাহিরে/ আমার পূজা আজ সমাপ্ত হল/ দেবলোক থেকে/ মানবলোকে,/ আকাশে জ্যোতির্ময় পুরুষে/ আর মনের মানুষে আমার অন্তরতম আনন্দে।’ বয়স তখন তাঁর পঁচাত্তর। তবে প্রথম জীবনে দীক্ষার রেশ এখানেও থেকে যায় – তা শেষ দুই চরণে, যেখানে তাঁর চেতনায়, ফুটে ওঠে ‘আকাশে জ্যোতির্ময় পুরুষ’ ও ‘মনের মানুষে অন্তরতম আনন্দ।’ ‘মনের মানুষে’ অবশ্য বাউল আকুতির রেশও মিশে যায়।

‘শিল্পদর্শন’ ও ‘প্রেমদর্শন’ নিয়ে বইটিতে যা পাই তাতে ঋদ্ধ হই। বিষয়গুলোর ওপর যে নতুন আলো পড়ে, তাতে আমাদের দেখারও বিস্তার ঘটে। এসব নিয়ে আলোচনা মুলতবি রেখে যাঁরা পড়বেন, তাঁদেরই বরং ওই পড়ার ভেতর দিয়ে নিজের নিজের মতো করে এই অভিজ্ঞতায় শরিক হওয়ার আহবান জানাই। আমি শুধু ভাবনাবিশ্ব থেকে বস্ত্তবিশ্বে তা মিলিয়ে নেওয়ার সম্ভাবনা একটু খতিয়ে দেখি। অবশ্য নির্মল হৃদয় না থাকলে বা দৃষ্টি আবিল হলে আমার কথার কদর্যও কেউ করতে পারেন। রবীন্দ্রনাথ নিজেই বলেছেন, ‘দেবতারে প্রিয় করি, প্রিয়েরে দেবতা।’ দেবতা বস্ত্তগ্রাহ্য নয়। তার বাস হতে পারে চৈতন্যলোকে। চৈতন্য অবশ্য বিশ্বাতিগ নয়। পঞ্চভূতের সমবেত অদৃশ্য ক্রিয়ার উদ্দেশ্যহীন পরিণাম প্রতিটি প্রাণে ব্যক্তিচৈতন্য। এই পরিণাম নিয়ে পঞ্চভূত নির্বিকার। মেধা কারো বেশি, কারো কম, এটা নিতান্তই আপতিক। রাশি-বিজ্ঞানে যাকে বলে র‌্যান্ডম ডিস্ট্রিবিউশন (Random distribution), এও তেমন। সম্ভাবনা-তত্ত্ব দিয়ে কেউ তার মানচিত্র আঁকার চেষ্টা করতে পারেন হয়তো। মানববিশ্বে পারস্পরিক প্রেমও, যদি স্বাধীন বৃত্তিতে পরিচালিত হয় অনুরূপ। অবশ্য স্থান-কাল-সমাজ-সংসার তার ক্ষেত্রকে সংকুচিত করে। তার পথকে নির্দিষ্ট করে। একে পুরোপুরি অতিক্রম করতে পারলে প্রেমের স্বয়ংসিদ্ধি। বৈষ্ণব পদাবলি সেদিকেই যায়। অল্প বয়সেই রবীন্দ্রনাথ তাতে মজেছিলেন, এ-কথা তিনি নিজে বলেছেন। বেগম আকতার কামালও সেদিকে আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। যদি তেমন ঘটে, তবে পার্থিব প্রেমেও ব্রহ্মস্বাদ সম্ভব।

রবীন্দ্রনাথের ব্রহ্মসংগীতে কোথাও কোথাও কি তেমন কিছু উঁকি দেয় না? তাঁর উনিশ বছরের রচনা ব্রহ্মসংগীত, ‘তোমারেই করিয়াছি জীবনের ধ্রম্নবতারা’ (১৮৮০ খ্রি.)। পরের বছর – গোনাগুনতি সাত মাস পর – আরো বিসত্মৃত করে, আট চরণের জায়গায় বাড়িয়ে তিরিশ চরণের কবিতায় রূপান্তরিত করে তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ (যতদূর মনে পড়ছে) ভগ্নহৃদয়ের উৎসর্গপত্রে উদ্দিষ্টাকে নিবেদন করেন। এই উদ্দিষ্টা নারী শ্রীমতী হে। আসলে এই হে-র আড়ালে যিনি ছিলেন, তাঁকে তিনি খেলাচ্ছলে ‘হেকেটি’ বলে ডাকতেন। অনেক পরে এই একই নারীর স্মরণে বলাকায় তাঁর অতিবিখ্যাত ‘ছবি’-কবিতা, জীবনের প্রান্তবেলায় আকাশ প্রদীপে ‘বধূ’, ‘শ্যামা’ ও ‘কাঁচা আম।’ অতিসহজেই শনাক্ত করা যায় বাস্তবের সেই নারীকে, যিনি গানে, কবিতায় হয়ে ওঠেন প্রতিমা। জীবনের ধ্রম্নবতারা করার সময় তিনি ছিলেন চোখের সামনে। পরে আর নেই। ‘বধূ’ কবিতার (১৯৩৮ খ্রি.) শুরুতে পড়ি :

ঠাকুরমা দ্রম্নত তালে ছড়া, যেত পড়ে;

ভাবখানা মনে আছে – বউ আসে চতুর্দোলা চ’ড়ে

আম-কাঁঠালের ছায়ে,

গলায় মোতির মালা, সোনার চরণচক্র পায়ে \

 

আর শেষটুকু :

 

অকস্মাৎ একদিন কাহার পরশ

রহস্যের তীব্রতায় দেহে মনে জাগালো হরষ;

তাহারে শুধায়েছিনু অভিভূত মুহূর্তেই,

‘তুমিই কি সেই,

আঁধারের কোন্ ঘাট হতে

এসেছ আলোতে!’

উত্তরে সে হেসেছিল চকিত বিদ্যুৎ,

ইঙ্গিতে জানায়েছিল, ‘আমি তারি দূত;

সে রয়েছে সব প্রত্যেক্ষের পিছে

নিত্যকাল সে শুধু আসিছে।’

নক্ষত্রলিপির পরে তোমার নামের কাছে

যার নাম লেখা রহিয়াছে,

অনাদি অজ্ঞাত যুগে সে চড়েছে তার চতুর্দোলা

ফিরিছে সে চিরপথভোলা

জ্যোতিষ্কের আলোছায়ে-

গলায় মোতির মালা, সোনার চরণচক্র পায়ে \’

 

এই কবিতার স্তম্ভিত-পবিত্র-বেদনা আমাদের হৃদয় ছুঁয়ে আকাশ স্পর্শ করে। কিন্তু আমরা যদি আরো একটু কৌতূহলী হয়ে ভেতরে  তাকানোর চেষ্টা করি, তাহলে কি দেখি না, ‘নক্ষত্রলিপির পরে’ কবির ‘নামের কাছে যার নাম লেখা রহিয়াছে’, যার ‘গলায় মোতির মালা, সোনার চরণচক্র পায়ে’, আর ‘প্রত্যেক্ষের পিছে নিত্যকাল (যে) শুধু আসিছে’, দুই-ই সমান পূর্ণ। রবীন্দ্রনাথের প্রিয় উপনিষদমন্ত্র ‘পূর্ণমদ : পূর্ণমিদং পূর্ণাৎ পূর্ণমুদচ্যতে – ’ ওটা পূর্ণ, এটাও পূর্ণ, পূর্ণ থেকেই পূর্ণের উদ্ভব – ’ এরই ভাব কি এখানে প্রসারিত হয় না? ব্রহ্মভাবনা অর্ধনারীশ্বর হওয়ার প্রয়োজন নেই। পূর্ণপুরুষ-পূর্ণনারী, উভয়ের ভেতরেই তা আলাদা-আলাদা পূর্ণরূপ পেতে পারে।

আমরা আরো অনেক অনেক ব্রহ্মসংগীতে এই একই নারীর ব্যাপ্তি আন্দাজ করতে পারি। উদাহরণ হিসেবে দুটো গানের দিকে নজর দিই। প্রথমটি ‘আমার  খেলা যখন ছিল তোমার সনে/ তখন  কে তুমি তা কে জানত।…’ এর শেষ দুটো চরণ, ‘তোমার চরণ-পানে নয়ন করি নত/ ভুবন  দাঁড়িয়ে আছে একান্ত \’ দ্বিতীয়টি ‘খেলার সাথি, বিদায় দ্বার খোলো – / এবার বিদায় দাও।/ গেল যে খেলার বেলা – ’। প্রথম গানটি লেখা রবীন্দ্রনাথের উনপঞ্চাশ বছর বয়সে, দ্বিতীয়টি লেখার সময় তাঁর বয়স একষট্টি। একটা কথা এখানে সবিনয়ে নিবেদন করি, যদিও কোনো স্বীকৃত অধিকার আমার নেই – ‘ব্রাত্য’ই বলা যায়।

রবীন্দ্রনাথের ব্রহ্মভাবনা ক্রমাগত বদলেছে। শুরম্নতে তাঁর সব নয়, তবে অধিকাংশ ব্রহ্মসংগীত ছিল প্রবলভাবে

রামমোহন-দেবেন্দ্রনাথের অনুসারী। এমনকি পরে শান্তিনিকেতন-প্রবন্ধমালাতেও তার রেশ থেকে গেছে। আদি ব্রাহ্মসমাজের দাপ্তরিক দায়িত্বও তাঁকে গোষ্ঠীভাবনার মুখপাত্র করে তুলেছে। ওই সময়ে, অর্থাৎ বিশেষভাবে উনিশ শতকের আশির দশকে ও পরে শামিত্মনিকেতন পর্বে গোষ্ঠীপতির ভূমিকায় তাঁর পুরোপুরি স্বাধীন কণ্ঠস্বর কি আমরা পাই? গীতবিতানে তাঁর তিরাশিটি গানের ভেতর বায়ান্নটিই ওই শতকের আশির দশক পার হওয়ার আগে লেখা। সব সময় তিনি নিজের মতো চলেছেন। কিন্তু নিজের মতো চলাটাও অনেক সময়ে সামাজিক ও পারিবারিক ঐতিহ্যের অসচেতন অনুসরণ হয়ে যায় না কি? তাই তিনি বলেছেন বা গেয়েছেন বলেই তা তাঁর মতো, এটা বোধহয় নির্বিচারে ধরে নেওয়া ঠিক নয়। আমরা জানি, এই বাংলার গ্রামে এসে সরাসরি অকৃত্রিম মানুষের সংযোগ তাঁর হৃদয়বৃত্তি ও চিমত্মাবৃত্তি দুয়েরই প্রসার ঘটায়। এ-কথা তিনি দেশে-বিদেশে অকুণ্ঠে বলে গেছেন বারবার। বাউল-সাহচর্য তাঁর ব্রহ্মভাবনাতেও ছাপ ফেলেছে। একইভাবে ছাপ ফেলেছে বিশ শতকের গোড়ায় বঙ্গভঙ্গ রদ আন্দোলন। গীতাঞ্জলির ‘জননী, তোমার করম্নণ চরণখানি/ হেরিনু, আজি এ অরম্নণ কিরণ রূপে\’ গানটি তাঁর সাতচলিস্নশ বছর বয়সে রচনা। রামমোহন, এমনকি, দেবেন্দ্রনাথের অনুসারী হয়েও তিনি কি ব্রাহ্মমাঘোৎসবে এ-গান গাইতে পারতেন? উলটো, একে কি স্বদেশ-পর্যায়েও ফেলা যায় না? গীতাঞ্জলি পর্বের পর তাঁর দৃষ্টি বিশ্বে প্রসারিত। ক্ষত-লাঞ্ছিত বিশ্ব কি তাঁর ব্রহ্মভাবনাকে সংশয়ের দোলাচলে ফেলেনি?

দুটো গান বেছে নিই। হাত-আন্দাজে নয়, বুঝে-সুঝে। প্রথমটি তাঁর বাহাত্তর বছর বয়সের। প্রেক্ষাপট আমত্মর্জাতিক অঙ্গনে অনিশ্চয়তা ও বিষণ্ণতা, সেই সঙ্গে নিজ বাসভূমে উৎকট সাম্প্রদায়িক পারস্পরিক হিংসা। তাঁর ধৈর্যচ্যুতি ঘটে, যখন তাঁর জোড়াসাঁকোর বাড়িতেই দাঙ্গায় উৎখাত হয়ে একদল অসহায় নর-নারী আশ্রয় নেয়। পরদিন শামিত্মনিকেতনে ফিরে প্রকাশ্য সভায় তিনি বলেন, সংকীর্ণ ধর্মান্ধতার চেয়ে বিশুদ্ধ নাসিত্মকতা অনেক ভালো। এই মানসিক আঘাতে দীর্ণ হয়ে তিনি লেখেন ‘পথের   শেষ কোথায়, শেষ কোথায়, কী আছে শেষে!/… আজ ভাবি মনে মনে   মরীচিকা অন্বেষণে   হায়/ বুঝি

তৃষ্ণার শেষ নেই। মনে ভয় লাগে সেই – / হাল-ভাঙা পাল-ছেঁড়া ব্যথা চলেছে নিরম্নদ্দেশে \’

আর দ্বিতীয়টি, লেখা তাঁর সাতাত্তর বছর বয়সে। গানের বাণী কিছুটা : ‘দিনামত্মবেলায় শেষের ফসল নিলেম তরী-’পরে,/ এপারে কৃষি হল সারা,/ যাব ওপারের ঘাটে\/… যা-কিছু নিয়ে চলি শেষ সঞ্চয়/ সুখ নয় সে, দুঃখ সে নয়, নয় সে কামনা -/ শুনি শুধু মাঝির গান আর দাঁড়ের ধ্বনি তাহার স্বরে \’ গীতবিতানে দেখি, এটি প্রেম পর্যায়ের গান। আর প্রথমটি পূজা-পর্বের। দুটোই মনে ধন্দ জাগায়। যা হোক, যে-প্রশ্ন মনে জাগে, তাহলো, এদের সঙ্গে কি কোনোরকম ব্রহ্মভাবনা মেলে?

আমরা জানি, অষ্টম শতকে কিংবদমিত্ম ব্রহ্মবাদী শংকরাচার্যের আবির্ভাব হয়। তিনি প্রচার করেছিলেন, ব্রহ্মসত্য, জগৎ মায়া (‘মোহমুদ্গরে’ তাঁর প্রবাদোপম উক্তি, ‘কা তব কামত্মা, কসেত্ম পুত্র;…’ ইত্যাদি। একে ঠাট্টা করে রবীন্দ্রনাথ গল্প লিখেছিলেন, ‘মুক্তির উপায়’)। আর রবীন্দ্রনাথ গাইলেন, ‘আমার সকল রসের ধারা তোমাতে আজ হোক না হারা… তোমার রূপে মরম্নক ডুবে আমার দুটি অাঁখি তারা \…’ তাঁর ব্রহ্ম এখন বিশ্বপ্রকৃতিতে ব্যাপ্ত। বেগম আকতার কামাল বিষয়টির চমৎকার প্রাজ্ঞ ব্যাখ্যা দিয়েছেন বইটিতে ‘ব্রক্ষের নিসর্গায়ন’ অধ্যায়ে।

একটা বিষয় বারবার আমাদের সচকিত করে। তাঁর সময়ে বিজ্ঞানের অগ্রগতি রবীন্দ্রনাথ অতিনিবিড়ভাবে অনুসরণ করে এসেছেন। রসের কারবারেও সতর্ক ছিলেন। যেন কোথাও তাঁর

ভাব-কল্পনা বিজ্ঞানের প্রাগ্রসর সীমা ছাড়িয়ে না যায়। অন্য বইটিতে বেগম আকতার কামাল সঠিক নির্দেশ করেছেন, শেষপর্যায়ে রবীন্দ্রনাথের কাছে ব্রহ্ম গুণাতীত-কল্পনাতীত মহাশূন্যে ধারণ করা একক সর্বাত্মক জ্যোতিষ্কপুঞ্জ। বলেছেন, উপনিষদের ভাষায় ‘ব্রহ্মতেজস্বরূপ’। জানিয়েছেন জীবনের শেষ প্রহরে এর নির্বিকার ভাবনা তাঁর

সৃষ্টিকলাতেও প্রতিফলিত হয়েছে। তবে তাঁর ‘হৃদয়ের গোপন বিজন ঘরে’ ‘তুমি’ও হারিয়ে যায় না। শেষ কবিতায় মৃত্যুর আটদিন আগে লেখা চৈতন্যের শেষ বিন্দুটুকু ঢেলে, সুখ নয়, দুঃখ নয়, কামনা নয়, নিরাসক্ত, নিরাবেগ কণ্ঠে যাপিত জীবনের চূড়ামত্ম উপলব্ধির কথা সেই ‘তুমি’কে শোনান। পরের কদিন কাটে গভীর অচেতনার ভাসমানতায়।

এখানে এই বইয়ের সম্পর্ক নেই, কিন্তু এরই ধারাবাহিকতায় অলস মসিত্মষ্কের প্রশ্ন একটা সসংকোচে তুলে ধরি। হয়তো অসার, খোলা আকাশে ঘুড়ি ওড়ানো। তবু। রবীন্দ্রনাথের বিশ্ব বা ব্রহ্ম-চেতনা মানবসাপেক্ষে। তিনি দ্ব্যর্থহীন ঘোষণা করেছেন আইনস্টাইনের সঙ্গে আলাপচারিতায়। পূরবীর ‘আমি’ কবিতাতেও তারই প্রতিফলন। প্রশ্নটা ওঠে কিন্তু এখানেই। পরম ব্রহ্ম বলে কি তা হলে কিছু থাকে? আজ বিশ্ব সৃষ্টি-রহস্যের বেশ কিছুটা জানা। তাতে শূন্য সত্তায় বিশাল বিস্ফোরণে বিশ্বব্রহ্মা–র উদ্ভব ও তারপর থেকে ক্রমান্বয়ে বিস্তার। তা এখনো অনিঃশেষ। যদি তা শেষ হয় ও প্রথম শূন্যের দিকে গুটিয়ে আসে – কখন, এ-প্রশ্ন অর্থহীন, কারণ ‘কাল’-ও ওই বিস্ফোরণপ্রসূত, – এবং এ সম্ভাবনার কথা অনেকে গুরম্নত্ব দিয়ে ভাবেন, তবে

মানববিশ্বের কী পরিণতি হবে, তা কল্পনা করা যায় না। আর, মানব-চেতনাপ্রসূত ব্রহ্ম বা অনুরূপ কোনো ধারণা-কল্পনাই বা থাকে

কোথায়? এটুকু আজ বিজ্ঞানে একরকম স্বীকৃত যে, প্রায় সাড়ে তেরো বিলিয়ন বছর আগে শক্তি ও পদার্থের উদয় হয়। সাড়ে চার বিলিয়ন বছর আগে এই পৃথিবী গ্রহটি আকার পায়। প্রাণের দেখা মেলে প্রায় চার বিলিয়ন বছর আগে। প্রথম দ্বিপদী প্রাণীর যখন দেখা মেলে আফ্রিকায়, তারপর কেটে গেছে আড়াই মিলিয়ন বছর। তখন থেকে মানব প্রজাতির বিবর্তন। তাহলে মানববিশ্ব বললে কোনো ‘পরম’ সত্য মেলে না। কল্পনায় আশ্রয় পাই হয়তো। এখানে ব্রহ্মভাবনাকে কোথায় পাই? কোথায় রাখি? মানবসাপেক্ষে নিজেদের বেঁচে থাকার অবলম্বনের জন্য আমরা কোনো ‘পরম’কে স্থানে-কালে প্রতিষ্ঠিত করতে পারি। কিন্তু সংজ্ঞার্থেই তা সীমিত এবং অবশ্যই আপেক্ষিক। ব্রহ্মা-ব্যাপী আছে অসংখ্য নীহারিকাপুঞ্জ। প্রত্যেকটিতেই থাকতে পারে সৌরজগৎ। মিলতে পারে সে-সবে বুদ্ধিমান প্রাণী।

দ্বিতীয় আর একটি প্রশ্ন সত্য-মিথ্যার প্রায়োগিক ব্যবহার নিয়ে। এ কি স্থানে-কালে বিবর্তায়িত ও বিবর্তমান নয়? সরল বিশ্বাসে দুইয়ের পরস্পর-বিচ্ছিন্ন বিপরীত যমকে আমরা অভ্যসত্ম থাকি। এটা অ্যারিস্টটলীয়। রবীন্দ্রনাথের বিচারের ভিত্তিও এইরকম। একে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে বঙ্কিমকে এক বিখ্যাত তর্কে তিনি বেকায়দায় ফেলেছিলেন। বঙ্কিমের যুক্তিক্রমও ভিন্ন ছিল না। তাই একরকম কোণঠাসাই হয়ে পড়েছিলেন। কিন্তু বাসত্মবের কোনো অবস্থান, পরিমাণগত বা গুণগত, তো সব সময়ে দ্বিমুখী (নরহধৎু) এটা

অথবা ওটা, এমন নয়। প্রত্যক্ষি বা অপ্রত্যক্ষে তা বহুমাত্রিক। তাতে প্রায়শই সবগুলো উপাদান একমুখো থাকে না। ফলে কোনো কোনো অসিত্মত্বে, এটাই সত্য, বা এটাই মিথ্যা, এমন শনাক্তকরণ

প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে। বঙ্কিম যে বলেছিলেন, কখনো কখনো মিথ্যাই সত্য হয়, তাকে এই বহুমাত্রিক তত্ত্ব-কাঠামোয় ফেলে তিনি তাঁর যুক্তি সাজাননি। তাই রবীন্দ্রনাথ চড়াও হওয়ার সুযোগ পান। আজ জানি, বাসত্মবে হ্যাঁ-নার অসংখ্য মিশ্রণ, মিশ্রণেরও মিশ্রণ। কোনোটির গ্রহণযোগ্যতা বা অযোগ্যতা শুধু তার অমত্মর্জাতবৃত্তির ওপর নির্ভর করে না। বিষয়ের কর্তা যে বা যা, তার পছন্দ-অপছন্দের ওপরও নির্ভর করে। এমন অবস্থায় শুদ্ধ পবিত্র একক ব্রক্ষার অনন্য চৈতন্যোদ্ভাসিত জ্যোতির্ময় বিভাব কোথায় পাই? যা পাই, তা-ও কি আপেক্ষিক নয়?

এসব কথা কিন্তু এই বইয়ের আলোচনায় প্রক্ষিপ্ত। এটি পড়ে আমি মুগ্ধ হয়েছি। আলোকিতও হয়েছি। আরো অনেক সুচিমিত্মত ও চিমত্মা উদ্রেককারী বিষয় এতে আছে। তাদের আবিষ্কারের আনন্দ যারা পড়বেন, তাঁদের জন্যই তোলা থাক।

 

তিন

অন্য বই, রবীন্দ্রনাথ : যেথায় যত আলো একই রকম উজ্জ্বল। গভীর অবিনিবেশ, মননের অনায়াস বিস্তার, বিষয় ঘিরে পরিপার্শ্বে সজাগ দৃষ্টি, এগুলো এখানেও ভাষার সুষম-সুশৃঙ্খল বন্ধনে ধরা পড়ে। ওই ভাষার সৌকর্যে ও লাবণ্যে বেগম আকতার কামালের নিজস্বতাও স্পষ্ট। এ শুধু প্রাগ্রসর, রম্নচিশীল যারা, তাঁদেরই নয়, যাঁরা তেমন হতে চান, অথচ ‘কুনাট্য রঙ্গে’ হারিয়ে যেতে বসেন, তাঁদেরও ভাবনার বিপুল পরিশীলিত ক্ষেত্রে এগিয়ে যাওয়ার আলোকিত এক পথ দেখায়। বিষয় অবশ্যই রবীন্দ্রনাথ। সেখান থেকে তিনি একচুল নড়েন না। কিন্তু তাঁকে ঘিরেই তিনি তাঁর বিশ্বরূপ রচনা করেন। নিরাবেগ, কিন্তু আনন্দময়। তাতে রবীন্দ্রনাথের বৈচিত্র্যেরও একঝলক উদ্ভাসিত হয়। দাবানলের মতো ছড়ায় না। যেন শীত-দুপুরের রোদ্দুর। কী আছে এতে, তা সূচিক্রমটা তুলে দিয়ে জানাই : ১. আত্মপরিচয় : স্বরূপ দর্শনের শিল্পকথা, ২. বিশ্বশামিত্মতত্ত্ব, ৩. সাহিত্যচিমত্মা, ৪.

সংস্কৃতি-ভাবনা, ৫. মিথ চেতনা, ৬. উত্তর উপনিবেশবাদের নিরিখে, ৭. রবীন্দ্র কবিতা : প্রকাশ ও সৃজনের দ্বৈতাদ্বৈত, ৮. গীতাঞ্জলির ভাবকল্পের ইশারা ও উত্তরণ, ৯. জন্মের স্মরণ-পূর্ণ বাণী, ১০. পলাতকা : মুক্তির পরিসর, ১১. শেষের কবিতা : আধুনিক কথাকাব্য, দুই বোন : নারীর ভাবমূর্তি, ১২. মালঞ্চ : অসিত্মত্বের শিকড়ায়ন, ১৩. নাট্যকবিতা ও কাব্যনাট্য প্রসঙ্গে, ১৪. রবীন্দ্রনাট্যে এঙপ্রেশনিজম, ১৫. মিথতত্ত্বের আলোকে মুক্তধারা। রবীন্দ্রনাথকে এক জায়গায় সামগ্রে্য দেখা অসম্ভবই। কত দিক থেকে দেখা যায়, কত রকম প্রশ্ন জাগে। এক জায়গায় সবকে মেলানো যায় না। আরো আছে যিনি দেখছেন, তাঁর দৃষ্টিভঙ্গিমা। বাতিঘরের মতো তাঁর আলোকরশ্মি সমুদ্রে একদিক আলোকিত করে। সবদিকে চোখ রাখতে হলে ওই আলোকরশ্মিকে ক্রমাগত সামনে একপাশ থেকে অন্যপাশ ঘোরাতে হয়। একজন নিজের ভাবনার ছক মনে মনে কষে নিয়ে সে-অনুযায়ী দেখতে চাইলে ওই ছকের বাইরে আর যেতে পারেন না। পারার চেষ্টা আত্মখ-নও বটে। তা দেখার বিষয়কেও অপমানিত করে। বেগম আকতার কামাল তাঁর মতো করে দেখেছেন। এতেই ওই দেখার বিশেষত্ব। তাতে ফাঁকি নেই। কাজে আমত্মরিক শ্রদ্ধা আছে। কোনো কিছু না হারিয়েও আমরা নতুন করে অনেক কিছু পাই। ঋদ্ধ হই। তবে তাঁর চেতনার আলো গতির স্বাভাবিক নিয়ম মেনে চলে। উলটে-পালটে ছড়ায় না। ভাবনার আলোক কিছু চোখে পড়ে না। এটা ত্রম্নটি নয়। বরং এমনটিই আমরা যা চাই – স্বর্গের কাছাকাছি – তাই। আমরাও চোখ মেলে তাকাতে পারি। তাকাই। একই সঙ্গে নিজেদের ভাবনা-চিমত্মাও ঝালাই করে নেওয়ার সুযোগ ঘটে। তাতে মাথার জংধরা স্ক্রুগুলোর মরচে কিছুটা হলেও খসে পড়ে।

বেগম আকতার কামাল রবীন্দ্রনাথের আত্মপরিচয়ের অনুসরণে তাঁর কবিসত্তা ও ধর্মসত্তার স্বরূপ অন্বেষণ করেছেন। স্বভাবতই জীবনদেবতার কথা এসে পড়ে, যা কবির অমত্মর্লোকে থেকে বহির্লোকে তাঁকে পরিচালিত করে। প্রসঙ্গক্রমে সাম্প্রতিককালে বহুল আলোচিত রলাঁ বের্তের লেখকের মৃত্যু-তত্ত্বটি এসেছে। রবীন্দ্র-ভাবনার সঙ্গে তিনি তাঁর মিল-অমিল দুই-ই লক্ষ করেছেন। তবে শ্রদ্ধার সঙ্গে রবীন্দ্রনাথে লগ্ন থেকেছেন। কোনো প্রাতিষ্ঠানিক-ধর্মে, বিশেষ কোনোকালে কবির আস্থা ছিল না। এখানে তাঁর কথার উদ্ধৃতি পাই, ‘সেই এককে জানো, সর্বব্যাপী আত্মাকে জানো, আত্মন্যেব, আপন আত্মাতেই, প্রথাগত আত্মার অনুষ্ঠানে নয়। মানবপ্রেমে, শুভকর্মে, বিষয়বুদ্ধিতে নয় – আত্মার প্রেরণায়।’ বেগম আকতার কামাল যোগ করছেন, ‘এটাই রবীন্দ্রনাথের আধ্যাত্মিকতা – মানবসম্বন্ধকে আত্মার জ্যোতিতে দীপ্তমান করা’ আমরা দেখি কবিসত্তা ও ধর্মসত্তা একবিন্দুতে এসে মেলে।

বিশ্বশামিত্মতত্ত্বে দেখি, পুঁজির আগ্রাসনে রবীন্দ্রনাথও বিচলিত। একদিকে তিনি এরই পরিণামে জাতিবাদের ভৎর্সনায় মুখর, অন্যদিকে রূপক নাটকে, বিশেষ করে রক্তকরবীতে, মুক্তধারায়, একাধিক গীতি ও নৃত্যনাট্যে তিনি তাঁর উদ্বেগ ও প্রতিবাদ মূর্ত করে তুলেছেন, কল্যাণ ও শামিত্মর দিক নির্দেশ করেছেন। আজো তাঁরা আমাদের প্রেরণার উৎস।

সাহিত্যচিমত্মায় রবীন্দ্রনাথের সত্য কল্যাণ ও সুন্দরের প্রকাশময়তার ধারণাকে, তাঁর দ্বন্দ্বের নয়, সমন্বয়ের ও সুষমার ধারণায় অবিচল থাকাতে – যদিও পরিবর্তমান বাসত্মবে ‘প্রতিদিনের পথের ধুলায়’ দৃশ্যলোকে ঢাকা পড়ে যেতে যেতে তাদের নিজেদেরও বহির্লোকে ক্রমাগত রূপ থেকে রূপামত্মরে, ভাব থেকে ভাবামত্মরে যাবার অনিবার্যতা মেনে নিয়ে, – এখানে সুনিপুণ উপস্থাপনায় দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে। আলোচনা সশ্রদ্ধ, তন্নিষ্ঠ ও যথাযথ। আমরা উপকৃত হই। উপলব্ধির পরিসীমা আমাদের বাড়ে’। ‘রবিবার’ গল্পে অভি যে সমাপ্তি রেখায় বিভাবরীর কাছে আবেদন করেছিল, ‘এতদিন পেতে চেয়েছিলাম তোমাকে বুদ্ধি দিয়ে, এবার পেতে চাই আমার সমসত্ম দিয়ে’ – এ যেন রবীন্দ্রনাথেরই আপন কণ্ঠস্বর। তবে বুদ্ধির তাগিদটা বেশি ধরা পড়ে তাঁর শেষ প্রহরের লেখায়। যদিও তাঁর সংজ্ঞার তাড়নাকে তিনি অমান্য করেন না। এতে অনেক লেখায় তাঁর হৃদয়ে রক্তক্ষরণ ধরা পড়ে। তিনি সংবিৎ হারান না।

‘সংস্কৃতি-ভাবনা’ অধ্যায়ে আমরা শুরম্নতেই বিষয়ের ক্ষত্রটি পেয়ে যাই। আমরা পড়ি : ‘ – সংস্কৃতি বলতে বুঝে নেব

গোষ্ঠী-কৌম-অঞ্চল-শ্রেণি-জাতি-দেশ ও বিশ্ববলয়ের মধ্যে ক্রিয়াশীল মানবজীবনযাত্রার নানাকৃত্য ও তার উপকরণসমূহকে, তার বিকিরণ ও উপযোগকে এবং ব্যক্তিক মুখশ্রীকেও। কেননা, ব্যক্তির মধ্য দিয়েই তার গোষ্ঠী ও দেশের সংস্কৃতি চর্চিত হয়, ব্যক্তি সংস্কৃতিবান হলেই সমাজ-সংস্কৃতি দৃশ্যবাসত্মবতা লাভ করে।…’

মুক্তকণ্ঠে জানাই, সংস্কৃতির বাহুল্যহীন, পরিপূর্ণ, সুসংহত ও সুচারম্ন এমন ধারণা পেয়ে আমি মুগ্ধ। আমাদের কৃতজ্ঞতা লেখক পেতেই পারেন। একটু পরে তিনি জানান, ‘রবীন্দ্রনাথের

সংস্কৃতি-ভাবনা একদিকে রাবীন্দ্রিক নৈতিকতা ও সৌন্দর্যবোধের সঙ্গে যেমন জড়িত, তেমনি তা তৎকালীন দেশ-সমাজের জনজীবনকৃতি এবং বৈশ্বিক সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য দ্বারা পরিস্রুত।’ এখানেও তিনি অব্যর্থ।

সংস্কৃতি বিষয়ে রবীন্দ্রনাথের স্বপ্ন ছিল দেওয়া-নেওয়ার। এবং তা পারস্পরিক শ্রদ্ধায় ও সক্ষমতায় বিশ্বাসে। জীবনের মধ্য-প্রহরে তিনি আসার পর ঔপনিবেশিক ঘেরাটোপের বাধা তাঁর ভাবনাকে প্রতিহত করেছে। কিন্তু তিনি তাতে আস্থা হারাননি। বরং আরো বহুমুখে, চিত্রকলাতেও সবার বিস্ময় জাগিয়ে আপন প্রতিভার আগ্রাসী প্রবলতায় এঙপ্রেশনিজমের সমামত্মরালে, নিজের আমৃত্যু প্রকাশ করে চলেছেন। এই বইয়ে আমরা তা ঠিক ঠিক চিনে নিতে পারি।

বইটির সবগুলো রচনাই সুলিখিত। যুক্তির রাশ কোথাও আলগা হয় না। উপলব্ধির তারেও ঠিক ঠিক ঝংকার তোলে। সবারই পড়া উচিত। মনের কালিমা কিছুটা হলেও তাদের ঘুচবে। তারপরও আমার কথা কিছু বলি। যা পেলাম, তা খ-ন করার জন্য নয়। তা যথার্থ। চিত্তে আনন্দ জাগায়। তবে আরো কিছু প্রশ্ন থেকে যায়। আমার সদুত্তর জানা নেই। সেই জন্যই তোলা।

উত্তর-উপনিবেশবাদ-বিষয়টি আগে বোঝার চেষ্টা করি। উত্তর-আধুনিকতাকে কেন্দ্র করে উত্তর-উপনিবেশবাদ, নিম্নবর্গচর্চা, ইত্যাদি গণমানুষের ভোজ্য (স্বাস্থ্যকর কিনা, সেটা ভিন্ন কথা।) নানা উত্তেজক বিদ্যানুশীলন অ্যাকাডেমিক মহলে সমীহ আদায় করতে থাকে। গত শতকের আশির দশকে এদের রমরমা অবস্থা। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে পড়ার পর থেকে এদের কাজকর্ম কিছুটা শিথিল। নিম্নবর্গচর্চার তন্ত্রধার রণজিৎ গুহও প্রকাশ্যে ঘোষণা দিয়েছেন, ওই কারবার মৃত। জীবনের শেষ বেলায়, গলবস্ত্র হয়ে রবীন্দ্রনাথে ফিরে এসে লেখেন ‘কবির নাম ও সর্বনাম।’ বলতেই হয়, এক অসামান্য কাজ। আরো লেখেন ‘রামমোহনের দয়া।’ নিম্নবর্গের হাল-চাষ যাঁরা করতেন, এখনো করেন কিনা জানি না, তাঁরা কিন্তু ওই আশির দশকে রবীন্দ্রনাথের মু-পাত কম করেননি। পার্থ চট্টোপাধ্যায় তো লেখেন, ‘দুর্বল নিম্নবর্গের প্রতিরোধের বিচিত্র কৌশল নিয়ে রবীন্দ্রনাথ খুব একটা কৌতূহলী ছিলেন বলে মনে হয় না।’ (২০০৬) উত্তর-উপনিবেশবাদ ও নিম্নবর্গচর্চা ছিল সমলয়ে। কখনো কখনো সব বিন্দুতে। যাকে বলি ‘পপুলিজম’ – তারই পরাকাষ্ঠা। তবে যাঁর রচনা সামনে রেখে উত্তর-উপনিবেশবাদের ঢক্কা নিনাদ, সেই ফ্রান্ত্স্ পানো ছিলেন অতিশ্রদ্ধেয় চিমত্মাবিদ। মাত্র ছত্রিশ বছর বয়সে

১৯৬১-তে ক্যানসারে তাঁর মৃত্যু হয়। তাঁর ঞঐঊ ডজঊঞঈঐঊউ ঙঋ ঞঐঊ ঊঅজঞঐ (১৯৬১) প্রকৃতই এক অসাধারণ বই। চোখ খুলে দেয় সবার। নিজে আফ্রিকার কৃষ্ণাঙ্গ। প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতায় দেখেন উপনিবেশোত্তর দেশগুলোতে শাসক বদলেছে। শ্বেতাঙ্গর জায়গায় কৃষ্ণাঙ্গ-শাসন চালু হয়েছে। কিন্তু বন্দোবসত্ম পালটায়নি। অমানিত মানুষ যেমন ছিল তেমনি আছে। কারণ নতুন শাসক আগের য়োরোপীয় প্রভুদের অনুকরণ করে চলেছে। তিনি চান গণমানুষের অভ্যুত্থান, যা য়োরোপীয় ধ্যান-ধারণা থেকে মুক্ত, যার জন্ম আফ্রিকার গর্ভে, যার সমগ্রতা স্থির করে দেবে সার্বিক কল্যাণ ও প্রগতির অগ্রাধিকার। তার মানে এ নয়, অতীতের আচার-অনুষ্ঠানে ফিরে যাওয়া। বরং সম্পূর্ণ মুক্তমন নিয়ে য়োরোপীয় ধ্যান-ধারণার বোঝা কাঁধ থেকে ঝেড়ে ফেলে আপন আফ্রিকি সত্তার ওপর দাঁড়িয়ে নিজস্ব চিমত্মাকে শানিত করা, লÿ্য স্থির করে সেই দিকে অগ্রসর হওয়া। এটা নির্দ্বান্দ্বিক হবে না। অনেক রক্ত ঝরবে। তবে এইটিই উদ্ধারের পথ।

উত্তর-উপনিবেশবাদী কোনো তত্ত্ব ফানো খাড়া করেননি। সেটি করেছেন এডোয়ার্ড সাঈদ। জন্মসূত্রে তিনি আরব।

আপন-পর বিভাজনের ছক কেটে তিনি বললেন, উপনিবেশের প্রভুরা নিজেদের জায়গায় দাঁড়িয়ে শাসিত জনদের ‘অপর’ বলে মনে করে। উলটো দিক থেকে কিপলিংয়ের কথায়ই তিনি পুনরাবৃত্তি করলেন, এদের মিলন অসম্ভব। এরই সূত্র ধরে তিনি তাঁর Culture and Impirialism-এ জেন অস্টেন, কনরাড, ক্যামু – সবাইকেই উপবিনেশবাদী বলে চিহ্নিত করলেন। এমনকি ওলে সোয়িঙ্কা যে নাইজেরিয়ায় আরব উৎপাতে বিরূপতা প্রকাশ করেন এবং

কৃষ্ণাঙ্গের কৃষ্ণত্ব জাহিরের প্রয়াসে (গোরার হিন্দুত্ব প্রদর্শনীর মতো) বিরক্ত হন (সোয়িঙ্কার বিখ্যাত উক্তি – A tiger does not pronounce its tigritude. It pounces. So also a Negro does not need to show his/her negritude.) তাতে তিনি সোয়িঙ্কাকেও উপনিবেশবাদীদের কাতারে ফেলেন। এদিকে কেন্দ্র-প্রামত্ম তত্ত্বে উপনিবেশোত্তর বাসত্মবতায় শিল্পোন্নত কেন্দ্রভূমি, অর্থাৎ যুক্তরাষ্ট্র, য়োরোপ যে ল্যাটিন আমেরিকা ও অনুন্নত সদ্য-স্বাধীন দেশগুলোর ওপর তাদের শোষণ অব্যাহত রাখছে এই অবস্থার নির্মম উন্মোচন ঘটতে থাকে। সব মিলিয়ে দ্বিখ–ত বিশ্ব ও তার দ্বান্দ্বিকতা উত্তর-উপনিবেশবাদে প্রকট হয়ে সামনে আসে। রবীন্দ্রনাথের নাইট খেতাব বর্জন, উগ্র জাতীয়তাবাদের বিরোধিতা বা ‘সভ্যতার সংকটে’ ব্যথিত প্রতিবাদ উত্তর-উপনিবেশবাদীদের সাগ্রহ অনুমোদন পায়, কিন্তু তাঁর সামগ্রে্যর সাধনা, বিন্দুমাত্র না।

প্রায় সম-সময়ে উত্তর-আধুনিকতারও উত্থান। পরিণামে তার আলোকেই উত্তর-উপনিবেশবাদের বা নিম্নবর্গচর্চার নিজেদের প্রতিফলিত করে আপন আপন গ্রহণযোগ্যতার ভিত পাকা করার চেষ্টা। এই উত্তর-আধুনিকতার তান্ত্রিক গুরম্ন মিশেল ফুকো। তিনি বাতলান, ক্ষমতার কেন্দ্রিকতা ও তার প্রয়োগই সব অনিষ্টের মূল। সবকিছুতে তিনি দেখতে থাকেন ক্ষমতার স্থাপত্য : জ্ঞানচর্চায়, চিকিৎসাকা–, পাগলাগারদে, কারাগারে, নর-নারীর সম্পর্কে এবং অবশ্যই রাষ্ট্রের কর্ম-কাঠামোয়। তবে ধর্ম ব্যতিক্রম। কারণ তার কর্তা মানুষ নয়, বিশ্বাতীত – ‘… the only spirit of a world without spirit’ (এ কি মার্কসের ধর্মকে অনিষ্টের মূল বলার জবাব?) আরো বলেন তিনি, ÔIt really has been the ceremonial, the timeless drama of a people.’ বিশ্বের মানবশক্তিকে নির্বীর্য করাই যেখানে উদ্ধারের পথ, সেখানে যে-কোনো মানব সংগঠন, রাষ্ট্রও, বিলুপ্ত করাই হলো মুক্তির উপায়। রলাঁ বার্তের লেখকের মৃত্যুর নিদান হাঁকাকে এর সঙ্গে মিলিয়ে নেওয়া যায়। তবে এখানে যা প্রাসঙ্গিক, তা হলো, রাষ্ট্রের অবলুপ্তি ঘটলে, ক্ষমতার কোনো কেন্দ্রিকতা না থাকলে, উৎপাদনকা- ফিরে যাবে আদিমতায়। ‘অরণ্যের অধিকার’ প্রতিষ্ঠিত হবে বনচরদের হাতে। গুহাবাসী হবে পাহাড়ি জনগণ। শ্রমবিভাজন ও পরস্পর নির্ভরতার কোনো বালাই থাকবে না। পাশ্চাত্যে বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রিক বিদ্যাচর্চায়, বিশেষ করে তৃতীয় বিশ্বের উচ্চাভিলাষীদের জন্য এই উত্তর-আধুনিকতা ও উত্তর-উপনিবেশবাদকে খুবই আকর্ষণীয় মোড়কে তুলে দেওয়া হতে থাকে। পেছনে কাজ করে প্রকৃতপক্ষে, গত শতকের সাতের দশকে যে নতুন প্রযুক্তি ও শিল্পবিপস্নব, যার পরিণামে উৎপাদনকা-কে গোটা বিশ্বে ছড়িয়ে দিয়ে এক জায়গায় অদৃশ্যে থেকে শুধু তাৎক্ষণিক তথ্য দেওয়া-নেওয়ার মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করা যায়। গ্রাহক দেশগুলোতে টুকরো টুকরো বরাত দিয়ে কম খরচে কার্যোদ্ধার অসম্ভব থাকে না, যদি রাষ্ট্র নগদমত্মহীন জড়-ভরতে পরিণত হয়। উন্নত আকারে নতুন প্রভাবশালী মুৎসুদ্দি শ্রেণি একটা গড়ে উঠতে পারে। তাদের যোগাযোগ আকাশপথে তথ্য চলাচলের মাধ্যমে মূল উদ্যোক্তার সঙ্গে। এনজিওকা-ও এখানে সহায়কের ভূমিকা পালন করে।

রবীন্দ্রনাথের নিজস্ব কোনো রাষ্ট্র ছিল না। জাতি-রাষ্ট্রসমূহের আগ্রাসী তৎপরতা তাঁকে পীড়িত করেছিল। দেশে-বিদেশে সবখানেই তিনি তাঁর বিরম্নদ্ধে উচ্চকণ্ঠ ছিলেন। কিন্তু ব্যক্তির উচ্চাভিলাষ বা একচেটিয়া কারবার – দেশি-বিদেশি দুইই – নিয়ন্ত্রণে রাষ্ট্রেরও একটা ভূমিকা থাকে। রাজস্ব আদায় সমেত্মাষজনক হলে তবেই সুষম বণ্টনের নীতি কাজে খাটানো যায়। এই বাসত্মব আবশ্যকতার সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের সামান্যই পরিচয় ছিল। তিনি তাই সমাজকে অগ্রাধিকার দিয়েছেন। কিন্তু কোন সমাজ? ‘চাতুর্বর্নংময়া সৃষ্টং গুণকর্মাবিভাগশঃ’ – সেই সমাজ? আজকের শিল্পায়ন-স্বপ্নের সঙ্গে তার কি কোনো সংগতি থাকে? অতিপ্রজ জনসংখ্যাবহুলতার সঙ্গেও কি তা খাপ খায়? রবীন্দ্রনাথ যে প্রকৃতি-সংলগ্নতায় জীবন কাটিয়েছেন, তা কি আর আছে? আজ এখানে তাঁর মতো কোনো প্রতিভাধরের আবির্ভাব ঘটলে তিনি কি তাঁর (রবীন্দ্রনাথের) দৃষ্টিভঙ্গি বজায় রেখে কোনো মুক্তির সাধনা করতে পারতেন? ‘তপোবন’ কি এখন এক মূর্তিমান কালাসংগতি নয়? আরো একটু যোগ করি, বিশ্বব্রহ্মা- নিয়ে মানুষের জানার সীমানা রবীন্দ্রনাথের কালে যা ছিল, তা আর নেই। প্রসারিত হয়েছে অনেক দূর। মানুষের জন্ম অনেকখানি তার নিয়ন্ত্রণসাধ্য। এমনকি কৃত্রিম উপায়ে প্রাণ-সৃজনও বাসত্মব। তবে মৃত্যু অনিবার্য। যদিও তাকে ঠেকিয়ে রাখার সম্ভাবনা বেড়েছে যথেষ্ট। আমাদের

এ-অঞ্চলে তাঁর সময়ে মানব-মানবীর প্রত্যাশিত গড় আয়ু যা ছিল, তার চেয়ে তা বেড়ে হয়েছে প্রায় দ্বিগুণ। মানুষের দেখার চোখ তখন আর এখন এক থাকার কথা নয়। থাকেও না। বিশ্বের সেরা বিজ্ঞানীদের একজন স্টিফেন হকিংকে সম্প্রতি তিনি ঈশ্বর নিয়ে কী ভাবেন, প্রশ্ন করা হয়েছিল। জবাবে তিনি বলেন, ডব ফড় হড়ঃ হববফ ঐরস.। মানুষের আত্মবিশ্বাস যদি এইখানে পৌঁছোয়, তবে ব্রহ্মকে স্থাপন করি কোথায়? বিশ্বাতিগ নয়, বিশ্বাভিগ-ই তাঁকে হতে হয়। মানবচৈতন্য যদি হয় পঞ্চভূতের সংশেস্নষণে সৃষ্ট বাসত্মবতার অন্যতম পরিণাম তবে ওই ব্রহ্মকেও খুঁজতে হয় ‘মানুষেরই সীমানায়’। বলাকা কাব্যে দেখি, কবি নিজেই আকুল প্রশ্নে জানতে চাইছেন : ‘স্বর্গ কি হবে না কেনা।… মানুষ চূর্ণিল যবে নিজ মর্ত্যসীমা/ তখন দিবে না দেখা দেবতার অমর মহিমা?’ এই প্রেক্ষিতেই রবীন্দ্রসংগীতে ‘প্রভু’, ‘নাথ’, ‘প্রিয়সখা’, অমত্মর্লোকে এসব কল্পরূপ আজ অর্থবহ হয়। ব্যক্তিকে অতিক্রম করে ব্যাপ্তি পায়। আমরা ওই সবখানে মগ্ন হতে পারি। হই।

শেষের কবিতা, দুই বোন, মালঞ্চ – এরা যে আমাদের চেতনায় গভীর গভীর দাগ কাটে, তা অস্বীকার করি না। কিন্তু মনে হয়, বড় বেশি সাজানো-গোছানো। কেউ নিজস্বতা পায় না। সবাই একই ধাঁচে কথা বলে। ‘নাচায় পুতুল যথা দক্ষ বাজিকরে’ – সেরকম। সব পুতুলের সব সুতো বাজিকরের শক্তমুঠিতে ধরা – তিনি স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ। এখানে অপ্রাসঙ্গিক। তবু বলি, তাঁর চতুরঙ্গ উপন্যাসটি নিয়ে খুব কম আলোচনা চোখে পড়ে। অথচ এটা, আমার মনে হয়, খুবই উলেস্নখযোগ্য কাজ। খেয়াল করি, এই উপন্যাস প্রথম ছাপা হয় সবুজপত্রে, যার অলিখিত বিধান ছিল, কথ্যভাষায় একনিষ্ঠ থাকা। এভাবে একটা প্রাচীনতার বোঝা থেকে তাঁরা মুক্ত হতে চেয়েছিলেন। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ লিখলেন চোখে আঙুল দিয়ে সাধু ভাষায়। শুধু তাই নয়, সংলাপও সাধু ভাষায়। এমনটি চোখের বালি পর্যমত্ম ছিল। গোরায় বর্ণনা সাধু ভাষায়, কিন্তু সংলাপে মুখের ভাষা। তার পরে চতুরঙ্গতে পেছনে ফিরলেন কেন, যেখানে পত্রিকা স্বয়ং তাকে খারিজ করতে চায়? এটা কি তাঁর দিক থেকে একটা পরীক্ষা, অথবা পালটা চ্যালেঞ্জ? মনোগত অভিপ্রায় তাঁর যাই হোক, আমরা কিন্তু পড়তে গিয়ে হতবাক হয়ে যাই। এ-ঝড়ের গতিতে এগোয়। আমরা খেয়ালই করি না, ভাষা প্রাচীনগন্ধী। বিপরীতে এমন এক বিষয়, পড়া শেষেও যার কূল-কিনারা মেলে না। বিস্তারিত আলোচনায় যাব না। শুধু বলি, আমার মনে হয়েছে, দামিনী তাঁর রচিত সবচেয়ে জীবমত্ম মানবী-প্রতিমার একটি। ব্যতিক্রমী, কিন্তু একশভাগ খাঁটি ও স্বাভাবিক। বিধবা বলে কোনো পিছুটান নেই। শচীশকে ভালোবেসেছে। এতে কোনো আড়াল নেই। শ্রীবিলাস তাকে সব জেনেও বিয়ে করেছে। তার দিক থেকে কোনো ছলনা নেই। জন্মামত্মরে শ্রীবিলাসকেই দামিনী আবার পেতে চেয়েছে। প্রথার ছাঁদ অক্ষুন্ন রেখেই রবীন্দ্রনাথ এখানে প্রথা ভেঙেছেন। তা জ্যাঠামশায়ের লেখচিত্র অংকনেও। এই মানের বিধ্বংসী কিন্তু নিরাসক্ত উপন্যাস পড়ে তাঁর কাছ থেকে আর পাইনি। সবুজপত্রের প্রথা ভাঙার ব্রতে এর চেয়ে বেশি কি কেউ এগোতে পেরেছেন? রবীন্দ্রনাথ অবশ্য এর পরে সাধু ভাষায় আর কোনো উপন্যাস লেখেননি।

এতক্ষণ অনেক আজেবাজে বকবক করলাম। যাঁদের শোনানো, তাঁদের তো ধৈর্যের একটা সীমা আছে। কেউ যদি লাঠ্যৌষধি বাতলান তবে তাঁকে দোষ দিতে পারি না। নিজের দিক থেকে শুধু এটুকু জানাই, সব বলা হলো না। বইদুটোয় আরো অনেক মণিমুক্তো আছে। ‘মুকং করোতি বাচালং’ – এমন তাগিদও দেয় কোথাও কোথাও। যাঁরা পড়বেন, তাঁরা নিজেরাই স্বতঃস্ফূর্ত সাড়া দেবেন। আমার থেমে যাওয়াই, নিশ্চিত, এখন সবার কাম্য। প্রতিবাদ করি না। মাথা পেতে মেনে নিই। তবে এই শেষ, বলার আগে বেগম আকতার কামালের ভাষাশৈলীতে আমার মুগ্ধতার কথা আর একবার জানাই। এটা না করলে সুবিচার হলো না বলে নিজেই নিজেকে দুষব। যদি পুনরাবৃত্তি হয়, তবু।

এখানে গদ্যের সংযম আগাগোড়া অটুট। মননের প্রভায় সবটা আলোকিত। যেন তারায় তারায় কথকতা। কোনোটার আলো বা কোমল, করম্নণাঘন। বিশেষ করে তিনটি উপন্যাসের আলোচনায়। উত্তাল আবেগ কোথাও গড়িয়ে পড়ে না। এতটুকু তাল কাটে না। ভাব ও ভাষার শৃঙ্খলা টানটান থাকে। সুরম্নচির শোভন প্রতিফলন সর্বত্র। বলিষ্ঠতা ও মাধুর্য, দুয়ের সামঞ্জস্য ও সুষমা অমত্মহীন কাছে টানে। রবীন্দ্রনাথের ভাবনালোক ফুটিয়ে তোলায় এমন সার্থক গদ্যকলা বিরল। পড়তে যে পেলাম ‘আমি আনন্দিত’।