ভাষাসংগ্রামী রফিকুল ইসলাম স্মরণে

রফিকুল ইসলাম। ভাষাসংগ্রামী রফিকুল ইসলাম। জাতীয় অধ্যাপক ডক্টর রফিকুল ইসলাম। দীর্ঘ ছয় দশক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের খ্যাতিমান শিক্ষক রফিকুল ইসলাম। আমাদের সংস্কৃতির, আমাদের সাহিত্যের, আমাদের জাতিসত্তার অনন্য এক ঠিকানা রফিকুল ইসলাম। আজ এই বিপন্ন মুহূর্তে স্যারকে নিয়ে কিছু লিখতে আমার কলম চলছে না। বিগত ১৯শে নভেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শতবর্ষপূর্তি উপলক্ষে প্রকাশিতব্য স্মারক সংকলনে ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নজরুল’ শিরোনামে একটা লেখা দেওয়ার জন্য স্যারকে অনুরোধ করেছিলাম। ফোনে স্যারের কণ্ঠস্বর খুব ক্ষীণ মনে হলো। বললেন – ‘শরীরটা ভালো না। একটা পুরোনো লেখা দেব। তুমি ইচ্ছেমতো ঠিক করে নিও।’ স্যারের বাসা থেকে সে-লেখা সংগ্রহ করে সংকলনে প্রকাশ করেছি; কিন্তু সে-সংকলন স্যার দেখে যেতে পারেননি। সংকলনটি যেদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে আসে, সেদিনই স্যারের নিথর দেহ আসে শহিদ মিনার চত্বরে। আমার শিক্ষক, আমাদের অভিভাবক রফিকুল ইসলামকে নিয়ে লিখতে বসে শিরোনামে ‘স্মরণে’ কথাটা লিখতে আমার কলম থেমে গিয়েছিল। তবু এটা তো অমোঘ সত্য, স্যার আর নেই আমাদের মাঝে – কিংবা আছেন আরো গভীরভাবে পরোক্ষ সত্তায় আমাদের প্রতিদিনের সংগ্রামে।

দুই

রফিকুল ইসলামের বহুমাত্রিক কৃতির মধ্যে প্রথমেই মনে আসে ১৯৫২ সালে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে তাঁর প্রত্যক্ষ সংশ্লিষ্টতার কথা। আন্দোলন সংগঠনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রনেতৃবৃন্দের সঙ্গে তিনিও যুক্ত ছিলেন। সারাদিন একটা ক্যামেরা হাতে তিনি বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় কাটিয়েছেন, সব সময় থাকতেন মিছিলের অগ্রভাগে। দুঃসাহসী এই মানুষটি সেদিন কোনো কিছুকেই ভয় পাননি। গুলি লেগে শহিদ রফিকের মাথা থেকে ঘিলু বেরিয়ে এসেছিল – এই ছবিটা সেদিন ঝুঁকি নিয়েই তুলেছিলেন রফিকুল ইসলাম। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের যেসব ছবি এখন দেখা যায়, তার অধিকাংশই রফিকুল ইসলাম ধারণ করেছিলেন তাঁর ক্যামেরায়। উত্তরকালেও সব গণতান্ত্রিক আন্দোলনে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন তিনি। এক সাক্ষাৎকারে এ প্রসঙ্গে তিনি লিখেছেন :

… আমি ১৯৫১ সাল থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। তাই ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ১৯৫৩ সালের ডেমোক্রেটিক ইউনাইটেড ফ্রন্ট, ১৯৫৪ সালে গঠিত যুক্তফ্রন্ট, ১৯৫৪ সালের সাহিত্য সম্মেলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলাম। বিশেষ করে ভাষা আন্দোলনের কিছু ছবি তুলেছিলাম। এছাড়া কালো পতাকা উত্তোলন, কালো ব্যাজ ধারণ, খালি পায়ে শহীদদের  কবরে গিয়ে ফুল দেওয়া – সব কিছুতেই অংশ নিতাম। তখন শহীদ মিনার ছিল না। ১৯৫২ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি ঢাকা মেডিকেল কলেজের ছাত্রছাত্রীরা যে শহীদ মিনার বানায় সেটা ২৬ তারিখ ভেঙে ফেলা হয়েছিল। ১৯৫৩ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকা কলেজে শহীদ মিনার তৈরি করা হয়। ১৯৫৩ সালে ব্রিটানিয়া সিনেমা হল ছিল পুরানা পল্টনে, সেখানে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজন করা হতো। সেখানেই প্রথম আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো’ গানটি পরিবেশন করা হয় আব্দুল লতিফের সুরে। এর প্রতিটির সঙ্গে যুক্ত থাকার কারণে আমার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জীবনটা ছিল তাৎপর্যপূর্ণ।

রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের অনেক ঘটনারই প্রত্যক্ষ সাক্ষী ছিলেন রফিকুল ইসলাম। আমতলার ছাত্রসভা, পুলিশের ব্যারিকেড উপেক্ষা করে ১৪৪ ধারা ভাঙা, পুলিশের গুলিবর্ষণ – সবকিছুই নিজ চোখে দেখেছেন তিনি। ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারির কথা বলতে গিয়ে তিনি লিখেছেন – ‘আমতলায় যে সভা, সেখানে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করা হয়। প্রথম শহীদ হয়েছিলেন রফিক। তাঁর মাথায় গুলি লাগে। তাঁকে স্ট্রেচারে করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। মাথার খুলি ফেটেছে, মাথা থেকে ধোঁয়া উড়ছে, মাথার ঘিলু বের হয়ে গেছে। এটা আমার জীবনের সবচেয়ে একটা বড় ট্র্যাজেডি। আরেকটা হলো, ২৩ ফেব্রুয়ারি যে শহীদ মিনারটি তৈরি করা হলো, ২৪ ফেব্রুয়ারি এটা বাঙালির তীর্থক্ষেত্রে পরিণত হলো। এই অনুভূতিটা আমি ভাষায় প্রকাশ করতে পারব না। আমি ঢাকা মেডিকেল কলেজের সেইসব ছাত্রকে ধন্যবাদ জানাই যে তাঁরা রাতারাতি শহীদ মিনার তৈরি করে ফেলেছে।’

বায়ান্নো-উত্তরকালে গণতান্ত্রিক সব আন্দোলনের সঙ্গেই রফিকুল ইসলাম ছিলেন প্রত্যক্ষভাবে সংশ্লিষ্ট। ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের সময় তিনি ছিলেন ছাত্রনেতৃবৃন্দের সাহসের  অন্যতম প্রেরণা। মুনীর চৌধুরী, নীলিমা ইব্রাহিম, মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান এবং রফিকুল ইসলাম মূল সংগঠকদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখতেন, প্রদান করতেন দিকনির্দেশনা। প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সঙ্গে প্রত্যক্ষ সংযুক্তির কারণে তিনি ছিলেন পাকিস্তানি স্বৈরশাসকদের সার্বক্ষণিক নজরদারিতে। একাত্তর সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি সেনারা তাঁকে গ্রেফতার করে কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে আটকে রেখে নির্মম নির্যাতন করে। ১৯৭১ সালের ১৩ই আগস্ট পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী তাঁকে গ্রেফতার করে, অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহে তিনি মুক্তিলাভ করেন।

রফিকুল ইসলাম মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় ছিলেন সদাজাগ্রত। মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধু, বাংলা ভাষা ও সাহিত্য – এসব ক্ষেত্রে তাঁর সদর্থক ইতিবাচক চেতনা নতুন প্রজন্মের জন্য সর্বদাই ছিল অনুপ্রেরণার অবিরল উৎস। রাজাকার-আলবদরদের বিরুদ্ধে তিনি ছিলেন সদা-সোচ্চার। স্বাধীনতাবিরোধী এই অপশক্তিই যে বাংলাদেশের সামূহিক মুক্তির পথে প্রধান বাধা – একথা সবসময় বলতেন তিনি। প্রসঙ্গত মনে পড়ে ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুর শহিদ হওয়া প্রসঙ্গে তাঁর এক অভিমতের কথা। ১৫ই আগস্ট জাতির পিতাকে হত্যা করার বিষয়টিকে আপনি কীভাবে দেখেন – এমন এক প্রশ্নের উত্তরে রফিকুল ইসলাম  জানিয়েছেন এই কথা : ‘এর পেছনে পাকিস্তান জড়িত আর যারা স্বাধীনতার বিরুদ্ধে ছিল তারা জড়িত। এর একটা কারণ হলো কী, ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ আত্মসমর্পণ করেছিল কারা? আত্মসমর্পণ করেছিল পাকিস্তান সেনাবাহিনী। রাজাকার বাহিনী আত্মসমর্পণ করেনি কিংবা আলবদর বাহিনীও আত্মসমর্পণ করেনি। এটা তাদের কাজ। না হলে একদিকে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হচ্ছে আর পাকিস্তান থেকে জুলফিকার আলী ভুট্টো রেডিওতে কী করে বলছেন, তিনি ইসলামিক রিপাবলিক অব বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিলেন। এটা কী করে হয়! একই সময়ে, সকাল বেলায়; তার মানে তিনি এটা জানতেন।’

রফিকুল ইসলাম ছিলেন অসাম্প্রদায়িক প্রগতিশীল মুক্তচিন্তার অধিকারী একজন বুদ্ধিজীবী। তাঁর সম্পর্কে কথা বলতে গিয়ে এক স্মরণলেখায় আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী জানাচ্ছেন এই কথা : ‘… এমন অসাম্প্রদায়িক, প্রগতিশীল রাজনীতিমনা পণ্ডিত আমি কম দেখেছি। আমরা সমবয়সী। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকাকালে ফজলুল হক হলের একই রুমে কিছুকাল থেকেছি। ভাষা আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী ছাত্রদের মধ্যে তিনি ছিলেন একজন। বিভিন্ন আন্দোলনে ক্যামেরা হাতে ছাত্র রফিকুল ইসলামকে দেখেননি, এমন প্রবীণ মানুষ কম আছেন। ১৯৫২ সালে ভাষামিছিলে গুলিবর্ষণের সময় আমি ও রফিকুল ইসলাম একসঙ্গে ছিলাম। শহীদ রফিকের মৃতদেহের ছবি তিনিই প্রথম তোলেন। এই ছবি তোলার সময় আমি তাঁর সঙ্গে ছিলাম।’

তিন

রফিকুল ইসলাম ১৯৫৬ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ থেকে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হয়ে এমএ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। ১৯৫৮ সালের জানুয়ারি মাসে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে লেকচারার পদে যোগদান করেন। ১৯৭৮ সালের অক্টোবর মাসে তিনি অধ্যাপক পদে উন্নীত হন। তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভাষাতত্ত্বে এমএ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নজরুলের জীবন ও কবিতা বিষয়ে গবেষণা করে পিএইচ.ডি ডিগ্রি অর্জন কেেরন। আমৃত্যু তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক বিভাগে শিক্ষকতার পেশায় যুক্ত ছিলেন – প্রথমে পূর্ণকালীন, অবসরগ্রহণের পর খণ্ডকালীন শিক্ষক। বাংলাদেশে ভাষাতত্ত্ব-বিষয়ক জ্ঞান শাখাটি প্রচলনে তিনি পথিকৃতের ভূমিকা পালন করেন। অন্যদিকে নজরুল-গবেষক হিসেবে তাঁর খ্যাতি বাংলাদেশের ভূগোল পেরিয়ে বহির্বিশ্বেও প্রসারিত।

ছাত্র হিসেবে রফিকুল ইসলাম যেমন গণতান্ত্রিক প্রগতিশীল আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, উত্তরকালে শিক্ষক হিসেবেও তাঁর সে-চেতনা প্রবহমান ছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রিক যে-কোনো সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে রফিকুল ইসলাম থাকতেন প্রথম সারিতে। বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো সাহিত্যসভা, সংগীতসন্ধ্যা বা নাট্য-উৎসবে রফিকুল ইসলাম ছিলেন অপরিহার্য এক নাম। কেবল বাংলা বিভাগ নয়, এক্ষেত্রে সকল বিভাগ বা আবাসিক হল থেকে তাঁর কাছে সহযোগিতার আহ্বান আসত। দেখা যেত, সহযোগিতা করতে গিয়ে ক্রমে তিনিই হয়ে উঠেছেন মূল সংগঠক। পঞ্চাশ-ষাটের দশকে মুনীর চৌধুরী, নীলিমা ইব্রাহিম, নুরুল মোমেন, রফিকুল ইসলামের নেতৃত্বে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যে নাট্য-পরিবেশ গড়ে উঠেছিল, তা আজ আমাদের সংস্কৃতিচর্চার ধারায় উজ্জ্বল এক অধ্যায় হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। প্রথমদিকে নাটকে অভিনয় করার জন্য কোনো নারী-শিক্ষার্থী পাওয়া যেত না। নারীর অভিনয় পুরুষ-শিক্ষার্থীরাই করতেন। এমন একাধিক নাটকে রফিকুল ইসলাম নারী-চরিত্রেও অভিনয় করেছেন। মুনীর চৌধুরীর অনেক নাটকে রফিকুল ইসলাম ছিলেন অনিবার্য এক অভিনয়শিল্পী। সংগীতের ক্ষেত্রে একই কথা সত্য। বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে কিংবা তার বাইরে, বেতারে এবং টেলিভিশনে, সংগীতবিষয়ক অনুষ্ঠানে রফিকুল ইসলাম আমৃত্যু ছিলেন ক্লান্তিহীন এক সাধক। নজরুল ইনস্টিটিউটের ট্রাস্টি বোর্ডের সভাপতি হিসেবে নজরুলসংগীতের শুদ্ধ চর্চায় তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন।

রফিকুল ইসলাম সাংগঠনিক কাজেও ছিলেন সুনিপুণ এবং দক্ষ একজন মানুষ। বাংলা বিভাগের সাহিত্য উৎসব (১৯৬৩), বিভাগের সেমিনার, বিভাগের বার্ষিক বনভোজন, বিভাগের পুনর্মিলনী – এসব কাজে তাঁর সাংগঠনিক দক্ষতা ছিল উত্তরসূরির কাছে শিক্ষণীয় এক বিষয়। অনুষ্ঠান উদ্যাপনে সময়ানুবর্তিতার দিকে তিনি বিশেষ নজর দিতেন। তিনি ছিলেন সূক্ষ্ম কূটনীতি বুদ্ধিসম্পন্ন এক মানুষ। সবকিছুকে তিনি উপস্থিতবুদ্ধি ও প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব দিয়ে উপলব্ধি করতে পারতেন। প্রসঙ্গত স্মরণ করা যায় আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর এই স্মৃতিকথা : ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের বার্ষিক বনভোজনে ছাত্রজীবনে, এমনকি শিক্ষকজীবনেও রফিকুল ইসলামই ছিলেন আমাদের সব কাজে হর্তাকর্তা। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্, অধ্যাপক মুহম্মদ আবদুল হাই, ড. দীন মুহম্মদ, অধ্যাপক জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতার মতো তখনকার জ্ঞানতাপস শিক্ষকদেরও বনভোজনে ডেকে এনে তিনি আনন্দে-উল্লাসে মাতিয়ে তুলতেন।

একবারের এক স্মৃতি মনে আছে। আমরা জয়দেবপুরের কাছাকাছি শ্রীপুরে বনভোজনে গেছি। ট্রেনে থাকাকালেই রফিকুল ইসলাম ধরে ফেলেন আমাদের সঙ্গে সরকারি গোয়েন্দা বিভাগের এক ব্যক্তি ছদ্মবেশে আছেন। বাংলা বিভাগের ছাত্র-ছাত্রীরা তাঁকে ধরে হয়রানির শিকার করতে চেয়েছিল। রফিকুল ইসলাম তাতে রাজি হননি। তিনি গোয়েন্দা অফিসারকে আমাদের সঙ্গে শ্রীপুরে নিয়ে যান, নাচ-গান ও ভোজনে অংশগ্রহণ করতে দেন এবং আমাদের সঙ্গে ঢাকায় ফিরিয়ে নিয়ে আসেন।’

রফিকুল ইসলামের সাংগঠনিক দক্ষতার সবচেয়ে উজ্জ্বল অধ্যায় রচিত হয়েছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবর্ষ উদ্যাপনের জাতীয় বাস্তবায়ন কমিটির সভাপতি হিসেবে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবর্ষ উদযাপনের বিভিন্ন দিক তিনি তত্ত্বাবধান করেছেন, মূল অনুষ্ঠানের পরিকল্পনা করেছেন, সকল কাজে দিয়েছেন যোগ্য নেতৃত্ব। মৃত্যুর পূর্বমুহূর্ত পর্যন্ত তিনি এ-কাজে ছিলেন সংযুক্ত।

চার

ব্যক্ত হয়েছে যে, নজরুল-গবেষক হিসেবে রফিকুল ইসলাম বাংলাভাষী মানুষের কাছে সমধিক পরিচিতি পেয়েছেন। কাজী নজরুল ইসলামের জীবন ও সাহিত্য বিষয়ে তিনি রচনা করেছেন একাধিক গ্রন্থ – যার মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য নজরুলজীবনী (১৯৭২) এবং কাজী নজরুল ইসলাম : জীবন ও সৃজন (২০১২)। নজরুল-গবেষণায় রফিকুল ইসলামের ভূমিকা তাঁর ভাষাতেই উপস্থাপন করা যায় : ‘কাজী নজরুল ইসলামের জীবন ও সৃষ্টিকর্ম নিয়ে আমি গত পাঁচ দশকের অধিককাল চর্চা করে আসছি। আমার নজরুল চর্চার প্রথম উদ্যম নজরুলের রচনাসমগ্রের কালানুক্রমিক ও বর্ণানুক্রমিক রচনাপঞ্জি ‘নজরুল নির্দেশিকা’। নজরুল গবেষণায় আমার দ্বিতীয় উদ্যোগ নজরুল-জীবনীর পুনর্গঠন, তারই ফলে প্রকাশিত হয়েছিল ‘নজরুল-জীবনী’। আমার নজরুল গবেষণার একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ নজরুলের জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত জীবনকথা এবং রচনা বা প্রকাশের ক্রম ধরে নজরুলের মৌলিক কবিতাবলীর সামগ্রিক মূল্যায়ন ‘কাজী নজরুল ইসলাম : জীবন ও সৃষ্টি’।’ এই শেষোক্ত বইটিই ঢাকার নজরুল ইনস্টিটিউট থেকে সম্পাদিত হয়ে কাজী নজরুল ইসলাম : জীবন ও সৃজন নামে ২০১২ সালে প্রকাশিত হয়, যেখানে পাওয়া যায় কাজী নজরুল ইসলাম সম্পর্কে রফিকুল ইসলামের সামূহিক মূল্যায়ন।

নজরুল ইসলাম ছাড়াও রফিকুল ইসলাম বাংলা ব্যাকরণ, ভাষাতত্ত্ব, ভাষা-আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের সাহিত্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও স্বাধীনতা আন্দোলন ইত্যাদি বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ বই লিখেছেন। সম্পাদক হিসেবেও তিনি রেখে গেছেন তাঁর দক্ষতার স্বাক্ষর। এ প্রসঙ্গে দু-খণ্ডে বিন্যস্ত বাংলা একাডেমি-প্রকাশিত বাংলা ব্যাকরণ বইটির কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করতে হয়। আধুনিক বাংলা কবিতার একটি সম্পাদিত গ্রন্থও এ-প্রসঙ্গে আমাদের স্মরণে আসে, যা তিনি প্রকাশ করেছিলেন ১৯৭১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে।

গবেষণায় অনন্যসাধারণ অবদানের জন্য রফিকুল ইসলাম পেয়েছেন ‘বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার’, ‘একুশে পদক’ এবং সর্বোচ্চ বেসামরিক পুরস্কার ‘স্বাধীনতা পদক’।

পাঁচ

রফিকুল ইসলাম ছিলেন, অনন্যসাধারণ হয়েও, একজন সাধারণ বাঙালি। পাণ্ডিত্যের অহংকার তাঁকে কখনো গ্রাস করেনি। নিজেকে কখনো রাখেননি ধরাছোঁয়ার বাইরে। সাবলীল সহজতায় তিনি মিশতে পারতেন সকলের সঙ্গে। বিভাগের শিক্ষার্থীকে তিনি সন্তানের মতো ভালোবাসতেন। বাংলা ভাষা, বাংলা সাহিত্য আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রতি তাঁর ভালোবাসা ছিল প্রবাদপ্রতিম। সহজ নিরাভরণ জীবন ছিল তাঁর বিশিষ্ট চারিত্র্যলক্ষণ। অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক প্রগতিশীল মানসিকতায় ঋদ্ধ ছিলেন রফিকুল ইসলাম – তাঁর প্রিয় শিক্ষার্থীদের তিনি সর্বদা নিজস্ব এই জীবনধারণা ও বিশ্ববীক্ষায় ঋদ্ধ করতে চেয়েছেন। অপশক্তির  বিরুদ্ধে তিনি সর্বদাই ছিলেন সোচ্চার। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তথা ঢাকা শহরকেন্দ্রিক একটি সুস্থ ও ঋদ্ধ সংস্কৃতিবলয় নির্মাণে রফিকুল ইসলামের অভাব আমরা দীর্ঘদীন অনুভব করব – তবু, তাঁকে স্মরণ করেই এ-পথে আজ আমাদের এগিয়ে যেতে হবে।

ছয়

আলোকিত মানুষ রফিকুল ইসলাম আজ আর আমাদের মাঝে নেই; কিন্তু আছে তাঁর কর্ম, তাঁর সংগ্রামী জীবনকথা, তাঁর অমূল্য গ্রন্থরাজি। রফিকুল ইসলামের জীবনদর্শন ও সংগ্রামের পথ ধরে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক মানবিক বাংলাদেশ গড়ার সংগ্রামে শামিল হওয়াই হবে তাঁর প্রতি সম্মান দেখানোর, তাঁকে স্মরণ করার শ্রেষ্ঠ উপায়।