ভূতজ্যোৎস্নায়

সুরেন হাঁটতে-হাঁটতে গ্রামের বাইরে চাঁদপুকুরের পাড়ে বিরাট ফণীমনসা গাছটার নিচে এসে দাঁড়াল। তারপর সন্ধ্যা নেমে গেল ঝুপ করে। চাঁদপুকুরের উঁচু পাড় ঘন জঙ্গলে ঢাকা। হিজল, তেঁতুল ছাড়াও অনেক বিচিত্র বুনোগাছ এখানে আছে। কাঁটাঝোপ আর উলুঘাসের ঘন আড়ালে রংবেরঙের জাতকুলহীন অজস্র ফুল ফুটে থাকতেও দেখেছে সে এখানে। এখন চারদিকে গাঢ় আলকাতরার প্রলেপ। গ্রামের লোক এখানে নিত্যকাজ সারতে আসে, ভোরে-সন্ধ্যায়। আজ বিশেষ তিথি তাই কাউকে সে দেখতে পেল না। দূরে গ্রামের ভেতরে জ্বলে-ওঠা আলোর দিকে তাকিয়ে রইল। এতক্ষণ অন্ধকারে দাঁড়িয়ে থাকার জন্য শরীরে কেমন একটা অস্বসিত্ম হতে শুরু হলো তার।

আজই সে গ্রামে ফিরেছে। প্রতিবছর সে এ-সময়ই বাড়িতে আসে। কালীপূজায় গ্রামে ধুমধাম হয়। দুর্গাপূজায় অতটা নেই। তাই সে এ-সময়েই ছুটি নেয়। হাওড়ায় একটা মিষ্টির দোকানে কাজ করে সুরেন। সামান্য জমি আর মা – এই নিয়ে তার সংসার। তার একটা ভাবুক মন আছে। সে পদ্য লেখে, গান গায়। যদিও তার অবকাশ বড় একটা নেই, তবু সে সুযোগ পেলেই সাধুসঙ্গ করে। সে অন্ধকারের ভেতর তন্ময় হয়ে যায়। তার মনে হয়, এই অন্ধকার বিরাট এক জিজ্ঞাসা, আর গ্রহ-তারা-নক্ষত্র সেই মহাজিজ্ঞাসার উত্তরের সামান্য প্রচেষ্টা মাত্র।

পেছনে সাইকেলের বেলের শব্দ শুনে চমকে ওঠে সুরেন। জোরহাসির শব্দে বুঝে ফেলে আর কেউ নয়, সে যার অপেক্ষায় ছিল সেই।

 

– ভাইপো তুমি সাইকেল চালাবে তো?

সুরেন ঘাড় নেড়ে সাইকেল হাতে নেয়, চড়ে বসে, প্যাডেলে চাপ দেয়। দুজনকে কাঁধে নিয়ে সাইকেল বর্ষায় ভেঙেচুরে এবড়োখেবড়ো হয়ে যাওয়া রাস্তা দিয়ে লাফিয়ে-লাফিয়ে এগিয়ে চলে।

– তুমি অনেকক্ষণ দাঁড়িয়েছিলে নাকি? আসলে তিনসন্ধেবেলা তো ঘরে একটু বাতি দিয়ে এলাম। তোমার কাকি গেছে বাপের ঘর।

আজ অনেকে আসবে বুইলে। হরেন বাউলের বুকের দোষ হয়েছিল, একন ভালো আচে, আসবে। নিতাই মাস্টার আসবে। শ্মশান আজ জমজমাট!

সাইকেল চালাতে-চালাতে সুরেন দেখছিল অন্ধকার আর কুয়াশা মাখামাখি হয়ে ঝুলে আছে দিকচিহ্নহীন ধানক্ষেতের ওপর। পৃথিবীর এখন কোনো রং নেই। কে যেন সমস্ত শুষে নিয়ে শুধু ছাইটুকু রেখে গেছে।

 

ঝিঁঝির একটানা ডাক কানের পর্দা ফুঁড়ে মাথার ভেতর ঢুকে যাচ্ছিল। সে স্তব্ধতা ভেঙে জিজ্ঞাসা করল, এবার পুজো কেমন গেল ষষ্টিকা?

– খুব খারাপ ভাইপো, কাজ পাইনি তেমন, লোকের হাতে পয়সা নেই, কেউ খচ্চা কচ্চে নাকো। মোটে দুটো কাজ পেয়েছিলাম, তাতেই কোনোমতে কাটালুম। তুমি গাঁয়ের লোকেদের দেখে বুঝতে পাচ্চ না?

একমাত্র অই চৌধুরীরা ভালো আচে। জমির পর জমি বাড়চে। অভাবী বন্ধকে গোটা মনিতলা গাঁ ওদের ধুতির খোঁটে বাঁধা!

মা দেখচে সব দেখে রাকচে! মা মাগো পাপীর যেন শাসিত্ম হয়!

সুরেন কিছু না বলে প্যাডেল করতে-করতে নতুন লেখা একখানা গান ধরে-

 

আমার জনম গেল বৃথাই রে মা

গোলায় ফসল উঠল না

সকল দিলি তাদের হাতেই

যেজন তোকে পূজল না!

 

– আহা কী লিকেচিস ভাইপো আমার, আহা রে! অচেনা গানে গলা মেলানোর ব্যর্থ চেষ্টা করে ষষ্ঠী।

 

ওরা মই নদীর পুলের ওপর উঠে আসে। এখানে নদীর ধারেই পাহাড়তলা শ্মশান। একটু দূরে পাহাড়তলা গ্রাম। আলো দেখা যায়। পুল পেরিয়ে বীজের দোকানের সামনে সাইকেল দাঁড় করাতে বলে ষষ্ঠী। বীজের দোকানটি আসলে একটি শুঁড়িখানাও বটে। সে ওখান থেকে একটা চুলস্নুর পাঁইট নেয়। আলুবীজের দরদাম করে। তারপর বাইরে চলে আসে। সুরেন বাইরে দাঁড়িয়ে আকাশ দেখছিল। ষষ্ঠী ইশারায় ওকে ডেকে নিয়ে যায় শ্মশানে।

শ্মশানকালীর থানে খুব মৃদু হয়ে এসেছে প্রদীপের আলো। কেউ সন্ধে দেখিয়ে গিয়েছিল হয়তো। তা এখন নিভন্ত। একটু দূরে পঞ্চমু–র আসন। বহুকাল আগে কোনো সাধক এখানে শবসাধনা করত শোনা যায়। তার নাম কেউ জানে না। সুরেন তেঁতুলগাছের তলায় বাঁধানো বেদির ওপরে এসে বসে।

সে এখানে প্রতিবছর আসে ষষ্ঠীসাধুর সঙ্গে। ওরা গাঁজা-মদ খায় আর আলোচনা করে ধর্ম নিয়ে, আলোচনা করে চাষের বিষয়ে, সেচের বিষয়ে, গ্রাম্য রাজনীতির বিষয়ে। সুরেন এখানে এলেই আকাশ দেখে নীরব শ্রোতার মতো। আকাশের নক্ষত্রম-ল তাকে কত কিছু বলে যায়, সে শোনে, লিখে রাখে মনের পাতায়, তারপর সেই লিখন থেকে বাঁধে গান।

আজকেও মাস্টার এসেছে, এসেছে শ্মশানের ডোম চয়ন, বাউল পদ ম-ল। পদ গত বছর আসতে পারেনি ব্যামোর যন্ত্রণায়।

ওরা চুকচুক করে দিশি খায় নুন দিয়ে। তারপর গাঁজা সাজে, হাতে-হাতে ফেরে। সুরেন কিছুই খায় না, তার নেশা নেই। সে পদ ম-লকে বলে, খুড়ো, যমের হাত থেকে তো ফিরে এসেছো, আবার গাঁজা ক্যানে? পদ লজ্জায় মাথা চুলকে বলে, না গো ভাইপো এই একবার নিলুম।

সবাই গল্পশেষে সুরেনকে চেপে ধরে গান গাইবার জন্য। সুরেনের গানে নিস্তব্ধ শ্মশান জেগে ওঠে।

– কী অপূর্ব গলা আহা, কী লিখেছো ভাইপো, মাস্টার উচ্ছ্বসিত হয়।

গান থামিয়ে সুরেন বলে, ষষ্টিকা, এবারে চলো রাত হচ্ছে যে।

ষষ্ঠী অমনি নড়ে ওঠে, হ্যাঁ-হ্যাঁ ভাইপো চলো-চলো। চলি গো সকল, রাত হলে এই পথটা বড্ড খারাপ হয়ে যায়। যা শেয়ালের উপদ্রব বেড়েছে! বাছুরের মতো বড়-বড় শেয়াল। ধরলে ছিঁড়ে খেয়ে ফেলবে। সঙ্গে আবার ভাইপো আছে।

সেবার বাউড়িদের একটা ছেলেকে তো ছিঁড়েই খেয়ে ফেললে। একা পেলে আর রক্ষে নেই। দলবেঁধে আসে সব। রক্তখোরের জাত কিনা!

 

ওরা রাস্তায় উঠে আসে। বীজের দোকানের মাটির দেয়ালের গায়ে হেলান দেওয়া সাইকেল তুলে আনে সুরেন। লক খুলেই সাইকেলে উঠে পড়ে। প্যাডেলে চাপ দেয়।

– ও ভাইপো ডাঁরাও গো। আমি যে নেশা করে আছি চলতি গাড়িতে কি উঠতে পারি, ষষ্ঠীর কথায় দাঁড়িয়ে পড়ে সুরেন। ও ওঠার পর আবার প্যাডেল শুরু করে!

ষষ্ঠী গান ধরে রামপ্রসাদী। নেশাগ্রস্ত গলায় সুর-তাল থাকে না। সুরেন আকাশের দিকে তাকায়, মাথার ওপর ভূতচতুর্দশীর আকাশে কোটি প্রেতের চোখ জ্বলছে। একটু ভয় লাগে তার। কেমন একটা ভয়, ঠিক বোঝানো যায় না। দিকচিহ্নহীন অন্ধকারে পথ বলে আলাদা কিছুই যেন নেই। শুধু অনুমানে চলে সাইকেল, সে চালায় গল্প করতে-করতে।

– ষষ্টিকা, থালে আলুতে লাভ আছে বলো!

– লাভ? লাভ কিছুতেই আর নেই ভাইপো। তুমি শহরে চাকরি করো, ওটেই ভালো। কম পাও যা পাও সেই ভালো। চাষা বীজ ছড়িয়ে, ক্ষেত পাহারা দিয়ে ফলন ভালোই করে, কিন্তু ফসল উঠলে তার আর দাম নেইকো! তার গলায় দড়ি। রামপদ মরল শোনোনি?

– তুমি যে নিলে?

– হা হা, আমি তো বুনব না গো, চাষিকে বেচব। পাঁচ টাকায় কিনে সাড়ে পাঁচে ছেড়ে দেবো। আমার জমি কোথায়। আমি তো শ্মশানবাসী!

– হ্যাঁ গো কা, চাষবাস যদি বন্ধ হয়ে যায় মানুষ খাবে কী? সব যে বাড়বে দামে! দেশের চাষি ফলায় বলেই না এট্টু সস্তায় মেলে সব!

– তা যা বলেছো ভাইপো!

সাইকেল ঝড়ের মতো চলে। নদী পেরিয়ে গড়ান, কষ্ট কম হয় সুরেনের। হেমন্তের হিমেল হাওয়া গায়ে এসে লাগে।

– খুড়ো তোমার প্রেতসাধনা কেমন হচ্ছে!

– হা হা হা হা, খুব মনে রেকেচ দেখছি ভাইপো। ভালোই চলছে। অনেকগুলোই এখন আমার বশ। গত বছর একটা সুলক্ষণা দেহ পেয়েছিলাম মই নদীর ধারে বুইলে। খুব সুন্দর একটি নারীদেহ। খুনের কেস বুইলে না!

চোরকাঁটার ঝোপে পড়ে ছিল। লুকিয়ে রেখেছিলাম। গাঁয়ের লোককে জানতে দিইনি সেই রাতে।

– সে কি?

– হ্যাঁ, সাধনা করে আমি প্রেতসিদ্ধ হবার পর, পরেরদিন যেখানকার লাশ সেখানে রেখে এসেছি। আমার শরীরে এখন সেই প্রেত খেলা করছে ভাইপো!

হা হা হা হা হা…

একটা প্রবল অট্টহাসি মাঠের ভেতর ছড়িয়ে পড়ে। আপাদমস্তক চমকে ওঠে সুরেন। তার সমস্ত রোমকূপ ফুঁড়ে যেন ঢুকে পড়ে মাঘের হাওয়া। সে স্তব্ধ হয়ে দেখে চারপাশ কৃষ্ণপক্ষের প্রবল জ্যোৎস্নায় ভেসে যাচ্ছে। ফণীমনসার পাতাগুলো সহস্র প্রেতের মুখ হয়ে ঝুলে আছে ওর দিকে। কোথাও সাইকেল নেই, ষষ্ঠীসাধু নেই!

 

সে গ্রামে এসেই তো শুনেছিল তিনমাস আগে ষষ্ঠী মারা গেছে। সে তাহলে এখানে এলো কেন? কে তাকে ডাকল? এতক্ষণ সে কোথায় ছিল তবে? এসব ভাবতে-ভাবতে জ্ঞান হারায় সুরেন। শিশিরে ভেজা ঘাসের ওপর পড়ে থাকে ওর দেহ। আর প্রেতের মতো ওর মাথার ওপর নেমে আসে ভূতজ্যোৎস্নার চাঁদ!