মধ্যরাতের নেমেসিস

বিরাট সংকটের মধ্যে পড়েছি – একদিন দুদিন তিনদিন, আজ পঞ্চমদিন, ঘড়ির কাঁটা ঠিক রাত দুটো বিশে পৌঁছামাত্রই ডেকে উঠবে মোরগটি। স্বভাবতই ঘুম ভেঙে যায়, আর ঘুম ফিরিয়ে আনার ব্যর্থ লড়াই চালিয়ে সকালে বিছানা ছেড়ে উঠতে হয়; অতঃপর দিন কাটে অবসাদ আর ক্লান্তির ভেতর দিয়ে, মাতালের মতো ঝুলে-দুলে। এ পর্যন্ত দেহইঞ্জিন ঠিকঠাকই সার্ভিস দিয়ে গেছে, চা-কফির পরিমাণ বাড়িয়ে দিয়েছি, কিন্তু পঞ্চমদিন শরীর চলনশক্তি হারিয়ে ফেলে, ব্যাটারির চার্জ ফুরিয়ে যাওয়া অটোবাইকের মতো দাঁড়িয়ে পড়ে প্রায় বিনানোটিশে – অথচ, গুরুত্বপূর্ণ ফাইল হাতে। এগারো কোটি নয় লাখ তিরাশি হাজার আটশো ঊনত্রিশ টাকার একটি ওয়ার্ক অর্ডারের ফাইল ছাড়তে হবে দুপুর দুটোর মধ্যে – আজ শেষদিন। কী করি – মাথা জ্যাম হয়ে আছে, দুই চোখের পাতা গুটিয়ে আসে মাছধরার জালের মতো, চেয়ারটাকে মনে হচ্ছে দোলনা, শরীর দুলছে। চোখে পানি ছিটিয়ে, চা-কফি কিছুতেই কিছু হচ্ছে না। ঘুমের খিদে পেটের খিদের চেয়েও ভয়ংকর।

সোহান, একটা সিগারেট দেবে।

টেবিল, চেয়ার, ফাইল, কলম সব নিয়ে চমকে ওঠে সোহানের প্রায় ছয় ফুট উচ্চতর শরীর, বিস্ময়ের ধাক্কা সামলে ওঠার জন্য চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়াতে হয়। এই বিস্ময়ের কারণ আছে – আমি ঘোরতর ধূমপানবিরোধী, অর্ধকিলোমিটার দূরে সিগারেট ধরালে নাকে গন্ধ আসে, এবং যেহেতু দ্বিতীয় কর্তাব্যক্তি, তাই, এক প্রকার চোখের শাসনে রাখি ধূমপায়ী সহকর্মীদের, অফিস ধূমপানমুক্ত এলাকা। এই পর্যন্ত মৃদু হুঁশ ছিল। এগারো কোটি নয় লাখ তিরাশি হাজার আটশো ঊনত্রিশ টাকার ওয়ার্ক অর্ডারের ফাইল মাথার নিচে নিয়ে দিব্যি ঘুমিয়ে পড়েছি, ঘড়ির কাঁটা ঠিক দুটোর ঘরে পৌঁছে টিক শব্দ করে উঠলে লাফিয়ে উঠি, সর্বনাশ! সর্বনাশই বটে – এমপি মহোদয় সশরীরে উপস্থিত, হাতে-হাতে ওয়ার্ক অর্ডার নেবেন।

ইট-কংক্রিটের শহর – চারদিকে পর্বতসম আধুনিক অ্যাপার্টমেন্ট, গাছপালা নেই, আকাশ দেখা দুর্লভ, এখানে কেউ মোরগ পুষতে পারে সোহান? এ কী রকম বিলাসিতা! আমি ভেবে পাই না।

বিলাসিতা না স্যার, বিদ্রোহ। কিন্তু মধ্যরাতে ডেকে উঠবে কেন? কালেভদ্রে ভুলে এক-দুদিন ডাকতে পারে, কিন্তু আপনি বলছেন নিয়মিত ডেকে ওঠে এবং নির্দিষ্ট একটি সময়ে – রাত দুটো বিশ মিনিটে। চার হাজার বছরের রেকর্ডে বোধহয় এই প্রথম কোনো মোরগ মধ্যরাতে ডেকে ওঠে নিয়মিত। মোরগটির ঘড়িতে গণ্ডগোল ঘটে গেল কি না।

মোরগের ঘড়ি!

হ্যাঁ স্যার, মোরগের শরীরে জৈবঘড়ি থাকে। এজন্যই ভোরের আলো ফোটার আগে ওরা টের পায়, আর ডেকে ওঠে। আর একটি ব্যাপার জানেন – মোরগ ঘুমায় খুব সামান্য। ২৪ ঘণ্টার মধ্যে পৌনে চব্বিশ ঘণ্টাই জেগে থাকে।

বাহ্! বড় সেয়ানার পাল্লায় পড়েছি।

বিকেলে বাসায় ফেরার সময় দারোয়ান বাবুল মিয়া এগিয়ে আসে, স্যার, দুই চোখের পাতা ফোলা, হাঁটছেন কেমন করে, দুই পা ঠক্কর খেয়ে পড়ে না যান আবার।

সমস্যা নেই, বাবুল, আশেপাশে কেউ মোরগ পোষে? অথবা মোরগের খামার আছে?

বাবুলের চোখে বিস্ময়, স্যার, এ কী বলেন!

যা হোক, তুমি তো রাত জাগো, মধ্যরাতে, ধরো, দুটোর পরে আড়াইটার মধ্যে একটি মোরগ ডেকে ওঠে, তুমি কি শুনতে পাও?

আপনি মোরগের ডাক শুনেন স্যার! আলহামদুলিল্লাহ। ফেরেশতা দেখলে মোরগ ডাকে, অবশ্য, আরেকটি কারণেও মোরগ ডেকে ওঠে, আমি বিশ^াস করি না; কিন্তু আমার দাদার মুখে শুনেছি – কেউ মিথ্যা বললে অথবা সত্য গোপন করলে মোরগ টের পায়, তখন প্রতিবাদস্বরূপ ডেকে ওঠে।

বাবুলের বয়স ষাটের ওপরে, ষাটের দশকের মাধ্যমিক পাশ, বিচিত্র ধরনের পড়াশোনা, ভারী ভারী বই পড়েছে, অনেকগুলির নামই শুনিনি। নোয়াখালীর হাতিয়ার কোনো একটি গ্রামে বাড়ি, স্ত্রী গত, মেয়ে দুটোই বিবাহিত, দারোয়ানের চাকরিটা করে মূলত একা থাকতে পারে না বলে। আর্মিতে চাকরিকালীন শান্তি মিশনে গিয়েছিল – কয়েকটি দেশে থাকার অভিজ্ঞতা আছে, বহু মানুষ ও বিচিত্র মানুষের সঙ্গে মেলামেশা করেছে যৌবনে। এসব অভিজ্ঞতার গল্প শোনানোর জন্য ব্যাকুল হয়ে ওঠে, কিন্তু কেউ শোনে না। আমার কাছে প্রশ্রয় পায়, তার গল্প শুনি ও উপভোগ করি। তার জীবনাভিজ্ঞতার কাছে নিজেকে নাদান মনে হয়। নোয়াখালীর মানুষ, কিন্তু শুদ্ধ ভাষায় কথা বলতে পারে, না বললে ধরা কঠিন। পরীক্ষা  করে দেখেছি, বানিয়ে-ফাঁপিয়ে গল্প বলে না, জীবনের অভিজ্ঞতার অনুবাদ তার গল্পগুলি।

বাবুল মিয়া বলে, মসজিদের ইমাম সাহেব সেদিন আফসোস করেছিলেন, মসজিদে মুসল্লি কমে গেছে। কেউ আর ফজরে ঘুম থেকে উঠতে পারে না। মোবাইল, ফেসবুক, ইউটিউব – এগুলি নাকি শয়তানের জুয়াখেলা; মদ-হেরোইনে আর কী নেশা, তার চেয়েও ভয়ংকর নেশা, নগরবধূর মতো সর্বনাশা।

নগরবধূ! এ কে?  বাবুল মিয়া মাঝেমধ্যেই এমন গুগলি দিয়ে থাকে।

নগরবধূ বুঝলেন না স্যার! শঙ্খিনী নারী, সর্বনাশা রূপিণী, যার রূপের ফাঁদ ঘুঘুর ফাঁদ – একবার ফাঁদে পড়লে মুক্তি নেই।

কিন্তু বাবুল মিয়া, রাত

দুটো-আড়াইটার সময় মোরগ ডেকে ওঠে, কোনোদিন শুনেছো?

কথা ঠিক – রাত দুটো মানে দুপুর রাত, এ-সময় মোরগ ডেকে উঠবে কেন? বাবুল মিয়া ভাবল দু-মিনিট। পেয়েছি – আপনার পাশের ফ্ল্যাটের জাবেদ স্যারের মোবাইলের রিংটোনে মোরগের ডাক, আমি শুনেছি। উনি রোজ সালাতুল তাহাজ্জুদ পড়েন।

আমি জ্যান্ত মোরগের ডাক শুনতে পাই – আর, রাত দুটোয় কেউ ঘুম থেকে ওঠে? তাহলে ঘুমায় কখন?

অবিকল এক স্যার। জ্যান্ত মোরগের ডাক আর মোবাইলের রিংটোনের পার্থক্য করতে পারবেন না।

বাবুল মিয়ার কথায় যুক্তি আছে, কারণ, ঠিক রাত দুটো বিশ মিনিটেই মোরগটি ডেকে ওঠে কেন, দু-পাঁচ মিনিট আগেপিছে হয় না কেন; কিন্তু মোবাইলের রিংটোন কি এত জোরে বাজে? দুই থেকে চারবার ডেকেই চুপ হয়ে যায়, এবং এই ডাকেই যেহেতু ঘুম ভাঙে, ফলে মোরগটি ঠিক কোন দিক থেকে ডেকে ওঠে, সঠিকভাবে ধরার সুযোগ থাকে না, এজন্য রাত জাগতে হবে। বাসায় প্রবেশ করে দেখি আমার স্ত্রী রণমূর্তি ধারণ করে আছে, আজ যোগ হয়েছে মেয়ে, এবং তারা পূর্বপ্রস্তুত। কিছু বুঝে ওঠার আগে আমার দিকে ছুড়ে মারে একটা কিছু – আমার কথা বিশ^াস হয় না, কারণ, আমার দুই পয়সার মূল্য নেই তোমার কাছে, তোমার সংসারে, আজ হাতেনাতে ধরেছি। এই দেখো, তোমার ওজিফা খাতুনের সুকীর্তি। আজই, এই মুহূর্তে, এই মাসের বেতন দিয়ে চোর বিদায় করো।

আমার পায়ের কাছে পড়েছে, হাতে তুলে নিয়ে দেখি, একটি ছোট্ট পলিথিনে চারটি পিঁয়াজ, দুটো পাকা টমেটো, দশ কি এগারোটি কাঁচামরিচ।

ওহ্! এই ঘটনা। এগারো কোটি নয় লাখ তিরাশি হাজার আটশো ঊনত্রিশ টাকার ওয়ার্ক অর্ডারের ফাইল ছেড়েছি আজ, এখানে দশ কোটি টাকাই তো পকেটে … আর যাই কোথায়? কারাগারের পাগলাঘণ্টা বেজে উঠলো যেন, আমার সৌভাগ্য, অতিরিক্ত ক্রোধে আমার স্ত্রীর শরীর কাঁপে থরথর করে, কিন্তু মুখের ভাষা বন্ধ হয়ে যায়। 

মা-মেয়ে আজ এক রুমে শুয়েছে। টানা কফি চলছে। ঘড়ির কাঁটা দুটোর ঘরে পৌঁছতেই আমি সতর্ক হই। দক্ষিণমুখী ফ্ল্যাট – দক্ষিণে, পূর্বে, পশ্চিমে তিনদিকে তিনটি বারান্দা;  কোনদিকে দাঁড়ালে মোরগের ডাকটির গতিবিধি স্পষ্ট ধরা যাবে, দ্বিধায় পড়ে গেলাম। পূর্বে দাঁড়ালে ভাবি দক্ষিণে, দক্ষিণে দাঁড়ালে ভাবি পশ্চিমে; দ্বিধা কাটিয়ে উঠতে পারছি না, নিজের ওপরে বিরক্তি চরমে ওঠে, স্থির হয়ে দাঁড়াতে পারছি না, ছোটাছুটি করছি। এই ছোটাছুটির মধ্যে বিশ মিনিট কেটে গেল কখন টের পাইনি, এবং মোরগটি ডেকে উঠল। বিধি বাম! ঠিক একই সময় চেঁচিয়ে ওঠে আমার স্ত্রী, কী হলো, আজ আর ঘুমাতে দেবে না তুমি।

পাগল-টাগল হয়ে গেলে নাকি, না ঘুমিয়ে দৌড়াদৌড়ি করছো! দুই ডাক দিয়েই মোরগ চুপ, কিন্তু আমার স্ত্রীর চেঁচানো থামেনি, এর মধ্যে জেগে ওঠে মেয়ে। জেগে থাকাটাই বিফলে গেল, অন্তত দুই ঘণ্টা ঘুম হতো। অবশ্য, একদম বিফল হয়নি, জ্যান্ত মোরগই ডেকে ওঠে, এবং আমার অ্যাপার্টমেন্ট থেকে ডেকে ওঠেনি, দক্ষিণ-পূর্ব-পশ্চিম এই তিনদিকের কোনো একটি অ্যাপার্টমেন্টের কোনো একটি ফ্ল্যাটে মোরগটির ঠিকানা।

তারপর গোলকধাঁধা – উত্তরের বারান্দায় দাঁড়ালে শুনি মোরগটি ডেকে উঠেছে দক্ষিণে, দক্ষিণে দাঁড়ালে পশ্চিমে, আর পশ্চিমে দাঁড়ালে উত্তরে মোরগের ডাক শুনি, আমি যাই কোনদিকে! তিনদিকে তিনটি মোরগ  অভিন্ন কণ্ঠে ডেকে ওঠে বলে মনে হয়; অথবা, আমার শোনার বিভ্রম হতে পারে, একটিই মোরগ ডেকে ওঠে, মধ্যরাতের নিস্তব্ধতার ভেতরে শব্দটি মুহূর্তের মধ্যে স্থান পাল্টে ফেলে। কী এক খেলুড়ে মোরগের ফাঁদে পা ফেললাম! মধ্যরাতের নীরবতার মধ্যে ডেকে ওঠে একটি মোরগ – শব্দের মাত্রা ন্যূনতম ৭০ ডেসিবেল হবে, এই  মাত্রার শব্দে আর কারো ঘুম ভাঙে না, পাশেই আমার স্ত্রী ঘুমায়, আমার একার ঘুম ভাঙে কেন?

দুই সপ্তাহ চলছে। শরীরে বকেয়া ঘুমের ঋণ চক্রবৃদ্ধি হারে বাড়ছে। যেখানে ছয়তলা আটতলা লাফিয়ে উঠি, একদমে উঠি, লিফট ব্যবহার করি কদাচিৎ, এখন তিনতলা উঠতে হাঁপিয়ে দাবড়িয়ে নাকাল। সার্বক্ষণিক ক্লান্তি আর অবসাদ শরীরে, মেজাজ খিটমিটে, চারপাশ অতিষ্ঠ করে তুলেছি। এর মধ্যে নতুন উপশম – হঠাৎ হঠাৎ শরীর কেঁপে ওঠে, চোখে ঝাপসা দেখি। গলির মোড়ে একটি ওষুধের দোকানে প্রেসার মেপে মাথায় হাত – সিস্টোলিক ১৫৫, ডায়াস্টলিক ১০৫। এদিনই ডাক্তারের কাছে যাই, ‘বয়স পঞ্চাশ ছুঁইছুঁই, আমি রিস্ক নিতে চাই না’- এই বলে ওষুধ ধরিয়ে দিলেন।

দিনে অন্তত এক ঘণ্টা হাঁটতেই হবে, আর ছয় ঘণ্টা ঘুম।

জীবননদীর উজানে হঠাৎ ভাটা! একদিনেই পাল্টে গেল এতোকালের জীবনছন্দ – ওষুধ, ঘুম, হাঁটা এখন বাঁচার শর্ত,  আর এসব শর্ত পালনার্থে যে-কোনো মূল্যে খুঁজে বের করতে হবে মোরগটিকে, মুখোমুখি হতে হবে, অন্য কোনো পথ নেই। দুদিনের সাপ্তাহিক ছুটি আর তিনদিনের নৈমিত্তিক ছুটি – এই পাঁচদিন ছুটি নিয়ে মাঠে নেমে পড়ি, চারপাশের সম্ভাব্য অ্যাপার্টমেন্টগুলির দারোয়ানদের সঙ্গে আলাপ করি, কেবল একজন দারোয়ান সমব্যথী হয়ে বিষয়টি গ্রহণ করে, এবং খোঁজখবর নিয়ে নিশ্চিত হয়, অন্যরা আমলেই নেয়নি, অবিশ^াস্য ও অবাস্তব বলে উড়িয়ে দেয়। চতুর প্রকৃতির দু-তিনজন মজা নেওয়ার জন্য ইনিয়ে-বিনিয়ে প্রশ্ন করে এবং  কৃত্রিম কৌতূহল দেখায়, রহস্য খোঁজে।

এযাবৎ সমস্যাটিকে সিরিয়াসলি নেয়নি মা-মেয়ে, কারণ – সবকিছুই ঠিকঠাক চলছে, নিয়মিত অফিস করছি, ঠিকসময় ঘুমিয়ে পড়ছি, হাটবাজার করছি, রাত দুটো বিশ মিনিটে অর্থাৎ মধ্যরাতে তারা যখন গভীর ঘুমে বিভোর তখন ডেকে ওঠে মোরগটি, আমি নিঃশব্দে বিছানা ছাড়ি, চলাফেরায় সতর্ক হই অর্থাৎ বড় ধরনের ব্যত্যয় তাদের চোখে পড়েনি। ডাক্তার প্রেসারের ওষুধ ধরিয়ে দিয়েছেন, অফিস থেকে ছুটি নিয়েছি, এই দুই দিনের দৃশ্যমান ছোটাছুটি এবং অস্থিরতা দেখে তৃতীয় দিন মেয়ে সহানুভূতি প্রকাশ করে –  বাবা, তুমি কি সত্যিই মধ্যরাতে মোরগের ডাক শুনতে পাও?

আমি মেয়ের মুখের দিকে তাকাই নির্বাক চোখে, কলেজপড়ুয়া মেয়ে, সংকোচে ঢেকুর গেলে – কিন্তু বাবা, আমি কেন শুনতে পাই না? মা কেন শুনতে পায় না? দুই রাত ধরে আমরা ঘুমাই না, ঘুমের ভান ধরে থাকি, তোমাকে বলিনি, টেনশন করবে তাই।

মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে আছি, দুই চোখ ভেসে যাচ্ছে জলে, আমার মেয়ে কাঁদছে!

দুই হাতে জড়িয়ে ধরি মেয়েকে, চোখে ঝাপসা দেখছি বলেই কি না, মেয়ের পেছনে দাঁড়িয়ে আছে মা, তার চোখে জল, তার মুখে ফুটে উঠেছে অজানা এক আতঙ্ক, ধেয়ে আসা ভয়, অপ্রতিরোধ্য ত্রাস।

অবিশ্বাস্য একটি শক্তি জেগে উঠল আমার মনে, দেহে এবং আমার বিশ্বাসে। মুহূর্তের মধ্যে উধাও আমার অপরাধবোধ, শরীরের ক্লান্তি, অবসাদ, ঘুমের ঘাটতি। দুই হাতে জড়িয়ে ধরি দুজনকে। এক বুক ভাগাভাগি করে নিল মা-মেয়ে। দুজনের মাথার ওপরে দুটি চুমু দিই, থ্যাঙ্কস গড।

এদিন যথারীতি ঘুমিয়ে পড়ি, এবং রাত দুটো বিশে ঘুম ভাঙে মোরগের ডাকে। বাবা! বলে চিৎকার দিয়ে ওঠে মেয়ে, দৌড়ে আসে, নিজেই লাইট জ্বালায়, বাবা, আজ আমি মোরগের ডাক শুনতে পেয়েছি, এই বলে ওপরে তাকিয়ে আল্লাহকে কৃতজ্ঞতা জানায়।

মেয়ের চিৎকারে বিছানায় লাফিয়ে ওঠে মা, হ্যাঁ রে, আমিও শুনতে পেয়েছি।

বাবা, এখন ঘুমিয়ে পড়ো লক্ষ্মী ছেলের মতো, এই বলে দৌড়ে এসে কপালে এক চুমু দিয়ে নিজেই লাইট বন্ধ করে ছুটে চলে গেল মেয়ে।

– সত্যিই তুমি মোরগের ডাক শুনেছো? আমি আর মুখ ফুটে বলি না যে, তুমি তো ঘুমিয়ে ছিলে, মেয়ের চিৎকার শুনে ঘুম থেকে লাফিয়ে উঠলে, এখনো শরীরের কাঁপুনি থিতু হয়নি।

শুনেছি – ছোট্ট করে বলে বুকের ওপরে নাক-মুখ ঠেসে চাপা শ^াস ফেলে আমার স্ত্রী, মোরগটা মাঝরাতে ডেকে ওঠে কেন?

কী করে বলি – ওর ভাষা তো বুঝি না।

মোরগটা তো পুরুষ, তাই না? এই বলে নিবিড় হয়ে আসে।

মেয়ে জেগে আছে।

থাকুক জেগে – শুয়ে পড়েছে। তোমার ঘুম প্রয়োজন।

শরীরজুড়ে পরম ক্লান্তি নেমে আসে, কিন্তু দু-চোখে ঘুম নেই।

কী কারণে সকালে নিচে গিয়েছিল মেয়ে, ফিরে আসে বাবুল মিয়ার মোরগের ডাক শোনার সংবাদ নিয়ে।

আমি বেরোনোর সময় দেখি বাবুল মিয়ার মুখে মুক্তির হাসি, স্যার, মোরগের ডাক শুনেছি, ঠিক রাত দুটো বিশে ডেকে ওঠে।

বাবুল মিয়ার চোখের দিকে তাকাতেই অপ্রতিভ হয়ে ওঠে, ফলগাছে ঢিল মেরে ধরা পড়া বালকের মতো লজ্জায় লাল হয়ে ওঠে চোখ-মুখ।

কী ভেবে হঠাৎ হাঁটতে শুরু করি, এবং থানায় পৌঁছার পূর্ব পর্যন্ত জানি না যাচ্ছি কোথায়। থানার ডিউটি অফিসার বয়সে তরুণ, অমায়িক মুখ, আচরণে যথেষ্ট ভদ্র ও পেশাদারি, আমার সংকটের বিস্তৃত-বিবরণ সাগ্রহে শুনেছেন, কিন্তু ঠিক ধরে উঠতে পারেননি, এক্ষেত্রে থানা-পুলিশের কী করণীয়, কার বিরুদ্ধে অভিযোগ, ডায়েরিতে কী লিখবেন। মধ্যরাতে একটি মোরগ ডেকে ওঠে, এবং এই শহরের একজন বিশিষ্ট নাগরিকের ঘুম ভেঙে যায়, সুতরাং, অভিযোগ প্রথমত মোরগটির বিরুদ্ধে; দ্বিতীয়ত, মোরগের মালিকের বিরুদ্ধে, কারণ, ইট-কংক্রিটের দালানে মোরগটি স্বেচ্ছায় প্রবেশ করেনি, বরং আটকে রেখেছে। মোরগের মালিকের বিরুদ্ধে অভিযোগ যৌক্তিক, প্রয়োজনে আইনের আশ্রয় নিতে পারি, কারণ, একটি নিরিবিলি অভিজাত আবাসিক এলাকার অধিবাসী আমি, আমি একা নই, বহুজনের মধ্যরাতে ঘুম ভেঙে যেতে পারে। এদেশে থানা-মামলা, আইন-আদালত, সাক্ষী-প্রমাণ, উকিল-বিচারক এসব অক্টোপাসের ফাঁদ – একবার জড়িয়ে পড়লে বেরোনোর পথ নেই, তাই এই সামান্য অত্যাচার হজম করে নিচ্ছে।

কিছুক্ষণ চুপ থেকে ডিউটি অফিসার বলেন, স্যার, মোরগটির মালিক কে?

– আমি চেষ্টা করেও জানতে পারিনি।

ওসির রুমে নিয়ে গেলেন। মধ্যবয়সী, বেজায় মোটা এবং সম্ভবত কনস্টেবল থেকে ওসি হয়েছেন – এক সত্তরোর্ধ্ব প্রবীণের সঙ্গে আলাপরত। প্রবীণের অভিযোগ খোদ তাঁর স্ত্রী-সন্তানদের বিরুদ্ধে – ব্যাংকের ম্যানেজার ছিলেন, তাঁর নিজের পেনশনের সম্পূর্ণ টাকা আত্মসাৎ করেছে, অধিকন্তু, তাঁর খাদ্য-খাবারে চলাফেরায় এত বেশি নিয়ন্ত্রণ আরোপ করেছে যে, তিনি অতিষ্ঠ; দুবার আত্মহত্যার চেষ্টা করে ব্যর্থ, তাঁর চোখেমুখে ফুটে উঠেছে করুণ অসহায়ত্ব, প্রায় কেঁদে ফেলেন – এভাবে বেঁচে থাকাটা দীর্ঘায়িত করে লাভ কী? ওসি আশ^স্ত করলেন, আচ্ছা, আমি দেখছি, আপনার স্ত্রী-সন্তানদের সঙ্গে একান্তে কথা বলব। প্রবীণ উঠে গেলেন চোখেমুখে একটি অস্বস্তির ছাপ নিয়ে, জীবনের প্রতি চরম বিতৃষ্ণার ছাপ। এবার কপাল-ভুরু কুঁচকিয়ে ডিউটি অফিসারের দিকে তাকালেন ওসি, মৃদু বিরক্তি-মেশানো একটি অভিব্যক্তি তাঁর মুখে, দুই শব্দের বিরক্তি প্রকাশ করেন উঠে যাওয়া প্রবীণের উদ্দেশে – সুখের অসুখ।

আমার সংকটের তিন লাইনের সারসংক্ষেপ ডিউটি অফিসার উত্থাপন করতেই ওসি লাফিয়ে ওঠেন, উত্তেজিত হয়ে ওঠেন, কাঠের চেয়ারের জয়েন্টগুলিতে মড়মড় শব্দ হয়, আর যেহেতু শরীরের তিনভাগই বিকাশমান ভুঁড়ি, তাই মূলত ভুঁড়ি কেঁপে ওঠে। কী! মোরগ! মোরগের ডাক! মধ্যরাতে মোরগ ডেকে ওঠে, মোরগের ডাকে ঘুম ভেঙে যায় – থানা কি সার্কাস! চোখ রাঙিয়ে তাকালেন ডিউটি অফিসারের দিকে, মুখে বিড়বিড় শব্দ, বিরক্তি এবং ক্রোধ দুটোই চরমে, এবং চূড়ান্ত বিরক্তি ও ক্রোধ প্রকাশের অংশ হিসেবে বিকাশমান ভুঁড়ি কেঁপে ওঠে দ্বিতীয় দফা। বিপরীতে ডিউটি অফিসারের মেজাজ শান্ত, মুখে মৃদু হাসি, মোটামুটি নির্বিকার এবং তার ছোট্ট একটি বাক্য ঘি-ঢালা কাঠে জ্বলে ওঠা আগুনে পানি ঢেলে দেওয়ার কাজ করে।

স্যার, এলজিইডির ইঞ্জিনিয়ার। 

এবার ওসির কণ্ঠে উল্টো ধমক, কেন প্রথমেই পরিচয় দেয়নি।

জি, ইঞ্জিনিয়ার স্যার, বলুন, আপনার কণ্ঠেই শুনি বিস্তৃত।

– বিস্তৃত আর কী, উনি যা বললেন তাই। টানা একুশ দিন চলছে, ঠিক রাত দুটো বিশ মিনিটে একটি মোরগ ডেকে ওঠে, এই ডাকে আমার ঘুম ভেঙে যায়।

– এই বয়সে ঘুম ভেঙে যাওয়া তো ভয়ানক বিপদ-সংকেত। ডায়াবেটিস, প্রেসার …

– কিছুই ছিল না – গত সপ্তাহ থেকে প্রেসারের ওষুধ চলছে।

– আমার তো দুটোই, সকাল-সন্ধ্যা ওষুধ চলে। ওসির চেহারায় বিমর্ষতা ফুটে ওঠে, এক মিনিট শান্ত থাকার সুযোগ নেই – চারদিকের প্রেসার, চাহিদা। আপনি রুমে ঢোকার সময় যাকে বেরিয়ে যেতে দেখলেন, একজন অসহায় পিতা, বাংলাদেশের কন্যার পিতা। এই শহরের এক বিজনেসম্যান কাম পলিটিশিয়ানের বখাটে ছেলের উৎপাতে কলেজে যেতে পারে না তাঁর মেয়ে। এই নিয়ে তিনবার নালিশ করে গেছেন, আমি এসপি স্যারকে জানিয়েছি, উনার সোজা জবাব, ম্যানেজ করুন। বিজনেসম্যানকে আপনি চেনেন, উনি আবার প্রথম শ্রেণির ঠিকাদার কি না, আপনি তো চিনবেনই। আমি কী করতে পারি? আমিও একজন পিতা, আমার দুটিই কন্যাসন্তান।

ভদ্রলোক সম্পর্কে আমার প্রাথমিক ধারণা সম্পূর্ণ পাল্টে গেল।

– যা হোক – স্যার, আপনি কি খোঁজ নিয়েছেন, মোরগটা ঠিক কোন অ্যাপার্টমেন্ট থেকে ডেকে ওঠে, মালিক কে?

– আবাসিকের সব অ্যাপার্টমেন্টে গিয়েছি, একজন দারোয়ানও বলতে পারেনি।

– দারোয়ানরা সেয়ানা আছে, জানে ঠিকই, বলবে না। আচ্ছা, কোনদিক থেকে মোরগটি ডেকে ওঠে এবং কতদূর থেকে ডেকে ওঠে, বলতে পারবেন? তাহলে আমাদের অনুসন্ধান সহজ হবে।

– আমি চেষ্টা করেছি, কিন্তু কিছুতেই ধরতে পারিনি, মোরগটি ঠিক কোনদিক থেকে ডেকে ওঠে।

– কতক্ষণ ডাকে বা কতবার ডাকে?

– দুই থেকে চারবার ডেকেই নীরব হয়ে যায়।

– ওকে। এই বলে দুই হাত মুষ্টিবদ্ধ করে দুই গালে ঠেকিয়ে জোরে শ^াস ফেললেন – ভাবছেন।

– একটি মোরগই ডেকে ওঠে, আপনি কি শতভাগ নিশ্চিত? কারণ, কোনদিক থেকে ডেকে ওঠে এবং কতদূর থেকে ডেকে ওঠে, আপনি ধরতে পারেন না। আমার ধারণা, একাধিক মোরগ  ডেকে ওঠে একই সময়ে। কারণ, মোরগ চরম আধিপত্যবাদী, কুকুর যেমন, সিংহ যেমন। এক এলাকার দাপুটে কুকুর অন্য এলাকায় লেজ গুটিয়ে হাঁটে। ভোরের  নৈঃশব্দ্য ভেঙে প্রথম যে মোরগটি ডেকে ওঠে, তা হলো হুঁশিয়ারি সংকেত অর্থাৎ এই তল্লাটের মালিক আমি। মোরগের ভয়ানক ‘ইগো’, খুব জেদি ও যুদ্ধবাজ – দুই মোরগের লড়াই দেখেছেন নিশ্চয়, পরাজয় মেনে নেয় না। মোরগ লড়াই – সেই ছেলেবেলার স্মৃতি, এখনো মনে পড়লে রক্ত হিম হয়ে আসে। মানুষ যে কত রকমের হয়! এখন বুঝেছি, জীবনের সব অভিজ্ঞতাই কাজের। একবার এক মোরগ লড়াইয়ে ভয়ানক এক ঘটনা ঘটে গেল। এক ধূর্ত তার মোরগের পায়ে ছোট্ট ধারালো একটি চাকু বেঁধে দিয়েছিল, কেউ খেয়াল করেনি। লড়াই শুরু হলে, চাকুবাঁধা মোরগটি ঝাঁপিয়ে পড়ে প্রতিপক্ষের ওপরে, আর, মুহূর্তের মধ্যে মরণ চিৎকার দিয়ে দাবড়িয়ে ওঠে প্রতিপক্ষের মোরগটি – গলাকাটা, রক্ত ঝরছে কলকলিয়ে। মোরগের মালিক হাউমাউ করে কেঁদে উঠল, সবাই হায় হায় করে উঠল এই পর্যন্ত বলে বুকের ভেতরে জমাট শ^াস ফেললেন।

– শেষে কী ঘটল? জানার কৌতূহলে নয়, গল্পের সমাপ্তি টানা জরুরি, তাই জিজ্ঞেস করলাম। ভদ্রলোক রীতিমতো মোরগবিষয়ক সেমিনার বসিয়ে দিয়েছেন। বাইরে কয়েকজন দর্শনার্থী অপেক্ষমাণ, এর মধ্যে কয়েকবার টেলিফোন বেজে ওঠে, দুইবার মোবাইল  ফোন – ধরেননি।

– ইউনিয়নের চেয়ারম্যন ছিলেন খেলা কমিটির প্রধান। বিজয়ীর মোরগের মালিকের বুদ্ধিমত্তার প্রশংসা করলেন, কেননা, খেলায় জেতাটাই বড় কথা, কীভাবে জিতলো সেটা বড় নয়।

ডিউটি অফিসার প্রশ্ন করে বসেন, দর্শকরা কিছুই বলেনি স্যার, এতো বড় অন্যায়!

– দর্শকরা কী বলবে? মুকুট যার রাজ্য তার। মুকুট কীভাবে মাথায় উঠল কে দেখে। পরাজিত মোরগটির আর্তচিৎকার এখনো কানে বাজে – কাটা গলা নিয়ে দর্শকবৃত্তে একচক্কর দিয়েছিল, নিজের রক্ত দিয়ে বৃত্ত তৈরি করে ফেলেছিল, অবশেষে রেফারির পায়ের কাছে আছড়ে পড়েছিল। সম্ভবত, মৃত্যুর আগে সুবিচার প্রার্থনা করে গেছে।

গল্প থেকে বেরিয়ে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন, মোরগের ডাক কী ধরনের অর্থাৎ বলছি, ডাকার ধরনটি কেমন?  হয় না – যেমন, দেমাকি ডাক, মুমূর্ষু ডাক, তেজি ডাক, খেলুড়ে ডাক ইত্যাদি। আবার মোরগের জাতভেদে কণ্ঠস্বরের তারতম্য হয়।

– এই মুহূর্তে বলতে পারছি না।

আমাকে তাজ্জব করে দিয়ে ভদ্রলোক নিজে আট-নয় প্রকারের মোরগের ডাক শোনালেন। শেষে অট্টহাসি দিয়ে ওঠেন, রীতিমতো প্রশিক্ষণ নিয়ে এইসব ডাক শিখেছি; আমার স্ত্রী ছিলেন আমার কাজিন, বুঝতেই পারছেন কখন শিখেছি। জীবনের কোন শিক্ষা কখন যে কাজে লাগে!

– তাহলে আমি আসি – এই বলে আমি উঠে দাঁড়ালে ওসি দাঁড়ালেন লাফিয়ে, চেয়ার ছেড়ে এগিয়ে আসেন দরজা পর্যন্ত – আপনি মোটেই ভাববেন না স্যার, আমি দেখছি, কীভাবে কী করা যায়, দুদিন সময় নিচ্ছি। আপনি শুধু একটি কাজ করুন, একপ্রকার অনুরোধই বলতে পারেন, এখনি এমপি স্যারের সঙ্গে দেখা করুন, উনি স্টেশনে আছেন, বিকেলে ঢাকা চলে যাবেন, তাকে অবহিত করুন, কারণ, তাঁর সহযোগিতা লাগবে, অন্তত, সম্মতি প্রয়োজন। ফ্ল্যাটে ফ্ল্যাটে তল্লাশি চালাতে হতে পারে।

এমপির বাড়িতে কয়েক স্তরের নিরাপত্তাবেষ্টনী, দর্শনার্থীদের বিশাল ভিড়। আমার ভিজিটিং কার্ড হাতে নিয়ে দোতলা থেকে নিচে নেমে এলেন এমপি – যুবক ও উঠতি যুবকের বাহিনী তাঁর পেছনে, প্রত্যেকেই সুঠামদেহী জোয়ান।

– আপনাকে কার্ড পাঠাতে হবে ইঞ্জিনিয়ার সাহেব! তাঁর চোখে-মুখে অপার বিস্ময়, সোজা ওপরে উঠে আসবেন। শুধু ওপরে বলছি কেন, সোজা আমার বেডরুমে ঢুকে পড়বেন, চলুন, আপনার ভাবির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিই।

আতিথেয়তার এলাহী কাণ্ড ঘটে গেল। কয়েক প্রকারের মিষ্টি,

দেশি-বিদেশি ফল ছয়-সাত প্রকার, পায়েশ, কোমল পানীয় – কী নেই?

– জানেন ইঞ্জিনিয়ার – আপনার ভাবি খান বংশের মেয়ে, অতিথিকে নিজের হাতে রান্না করে খাওয়াতে ভালোবাসে, আজ দুপুরে আপনি খেয়ে যাবেন অবশ্যই। 

– তাই তো দেখছি, আজ হাতে সময় নেই, একদিন এসে খেয়ে যাব। বিরাট এক সংকটের মধ্যে পড়েছি আমি।

– সংকট! চেয়ার থেকে প্রায় লাফিয়ে ওঠেন এমপি, আমাকে জানাননি কেন?

আমার সংকটের বিস্তারিত শুনে অট্টহাসি দিয়ে বলেন, ওহ্! এই ব্যাপার, আমি ভেবেছি বড় কিছু। এখনি, দশ মিনিটের মধ্যে আমার ছেলেরা মোরগটি বের করে আনতে পারে কিন্তু সমস্যা অন্যত্র – মিডিয়ায় নিউজ হয়ে যাবে। বরং, ওসি সাহেবকে ফোন করে দিচ্ছি  – দুদিন কেন, ১২ ঘণ্টার মধ্যে বের করবে মোরগটি। মেয়রকেও জানিয়ে রাখছি।

আবাসিকের গেটে পা ফেলে শুনতে পাই মসজিদে মাইকে ঘোষণা চলছে – মধ্যরাতে, আনুমানিক রাত দুটো থেকে আড়াইটার মধ্যে একটি মোরগ অথবা একাধিক মোরগ ডেকে ওঠে, আবাসিকের বিশিষ্ট ও সম্মানিত অধিবাসীগণের ঘুম ভেঙে যায়, অতএব, মোরগের মালিক অথবা মালিকগণকে দ্রুত সংশ্লিষ্ট অ্যাপার্টমেন্টের দারোয়ানকে বিষয়টি অবহিত করার জন্য অনুরোধ করেছেন থানার ওসি স্যার।

অ্যাপার্টমেন্টের ভেতরে প্রবেশ করে দেখি, বাবুল মিয়া বেরিয়ে যাচ্ছে শশব্যস্ত হয়ে। যৌবনে সৈনিক ছিলেন, শরীরে ও পোশাকে সেই দেমাকের রেশ আছে এখনো; তেলপানি দিয়েছে মাথায়, কপাল চুঁইয়ে পড়ছে। কোথায় যাচ্ছে এই প্রশ্নের জবাবে গালভরা হাসি দিয়ে জানায়, আবাসিকের সকল দারোয়ানকে জরুরি তলব পাঠিয়েছেন থানার ওসি।

 ঘণ্টা দুই পরে বাবুল মিয়া এসে সংবাদ দিয়ে গেল – এই আবাসিকের সকল দারোয়ান একবাক্যে স্বীকার করেছে, রাত দুটো বিশ মিনিটে মোরগ ডেকে ওঠে, তারা প্রত্যেকে নিয়মিত মোরগের ডাক শোনে এবং তাদের ঘুম ভেঙে যায়; কিন্তু  কয়টি মোরগ ডেকে ওঠে এই নিয়ে তুমুল বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে।