বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরের সংগ্রহে বঙ্গবন্ধুবিষয়ক যে-কয়টি চিত্রকর্ম রয়েছে তার মধ্যে শিল্পী নাইমা হকের ‘স্মরণ’ সিরিজের দুটি চিত্রকর্ম ১৯৮৫ সালে আঁকা। চিত্রভাষায় বিশ্লেষিত হয়েছে রাজনৈতিক সময়, সংকট ও সত্যের কিছু বিষয়। বিমূর্ত ও আধা-বিমূর্ত অবয়বে শিল্পী যাদের ইঙ্গিত করেছেন তাদের চিনতে নিশ্চয়ই শিল্পরসিকদের অসুবিধা হয় না। সরাসরি ঘটনাবিন্যাস না করে শিল্পী রূপকের আশ্রয় নিয়েছেন। দেশ গড়ার কারিগরকে যারা চক্রান্ত করে হত্যা করেছে তাদের বিরুদ্ধে তখন কথা বলা সহজ ছিল না। কিন্তু শাসকের রক্তচক্ষু শিল্পীর তুলিকে বেঁধে রাখতে পারে না, তার প্রমাণ সেই প্রতিকূল সময়ে আঁকা ‘স্মরণ’ সিরিজের চিত্রকর্ম। রং ও ফর্মে জানান দেয় বঙ্গবন্ধুকে ঘিরে থাকা কিছু মানুষের আসল চরিত্র। দর্শক নিজের কাছে প্রশ্ন করলেই উত্তর পেয়ে যান – এঁরা বিশ্বাসঘাতক! ‘স্মরণ-৩’ চিত্রে বঙ্গবন্ধুর মাথা মাকড়সার জালে ঘেরা। ডান হাত (প্রতীকী অর্থে কাছের মানুষ) সাপ হয়ে মাথায় ছোবল মারছে। রং, ফর্ম, নকশা বিন্যাসে এই চিত্র মূলত অনেকটাই বর্ণনাধর্মী। যেন পুরো একটি উপন্যাস। সাংকেতিক সাদৃশ্যের ব্যাখ্যা ধরে বাস্তব ট্র্যাজেডি অনুধাবন করা যায়। ইঙ্গিতপ্রধান বক্তব্যে বোঝা যায়, সূক্ষ্ম অনুভূতির খেলা অনেকটাই মনস্তাত্ত্বিক।
ইঙ্গিতপ্রধান বক্তব্যধর্মী চিত্রকর্মের সুবিধা হচ্ছে দর্শক নিজের ভাবনালোকে অবগাহন করে রসাস্বাদন করতে পারেন। নাইমা হকের প্রতিটি চিত্রে সেই সুযোগ রয়েছে। সাধারণত বঙ্গবন্ধুর কোর্টের একাংশ এবং একটি হাত চিত্রজমিনের কোনো এক জায়গায় বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিত্বের প্রতীক হিসেবে কম্পোজিশনে দৃশ্যমান। খুব খেয়াল করে না দেখলে অচেনা ফর্ম বলেই মনে হয়। ১৯৯৩ সালে অঙ্কিত ‘ক্ষত’ শিরোনামের চিত্রে বঙ্গবন্ধুর চশমার ফর্ম একেবারে নিজস্ব শৈলীতে ব্যবহার করেছেন। বাস্তবানুগ দৃশ্যবর্ণিত না হলেও নকশার পরিভাষা দর্শককে কল্পিত ও স্বপ্নলোকের মধ্য দিয়ে বাস্তবতার জগতে ভ্রমণ করিয়ে নিয়ে আসে। আভাসে-ইঙ্গিতে আধা-বিমূর্ত থেকে মূর্ত হয় বিষয়ের সারসংক্ষেপ। এই চিত্রটিসহ বেশ কয়েকটি বঙ্গবন্ধুবিষয়ক চিত্রকর্ম গ্যালারি চিত্রকে ‘ছন্দে বর্ণে’ শিরোনামের একক শিল্পকর্ম প্রদর্শনীতে প্রদর্শিত হয়েছে। প্রদর্শনী শুরু (১৩ই জানুয়ারি ২০২৩) হওয়ার একদিন আগে শিল্পীর সঙ্গে কথা হচ্ছিল গ্যালারিতে পায়চারি করতে করতে। প্রদর্শনীটি অনেকটাই রেট্রোস্পেকটিভ ধরনের। ১৯৭৬ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে আঁকা বিভিন্ন সিরিজের চিত্রকর্ম দিয়ে সাজানো। আশ্চর্য হতে হয় তাঁর ক্যানভাস ও কাগজের ওপর পেনসিল মাধ্যমে করা চিত্রগুলি দেখে। রবীন্দ্রনাথের গান যেমন কানের ভেতর দিয়ে মর্মে এসে লাগে, তেমনি নাইমা হকের পেনসিলের রেখাগুলি হৃদয়ের ভাবতরঙ্গে দোলা দিয়ে মর্মে এসে প্রোথিত হয়। শিল্পকর্মের শিরোনামের অর্থ ধরে আলোচনা এগিয়ে নিতে একটু বিভ্রান্তিই হচ্ছিল। প্রতীক-সংকেতের ভাষা ব্যাখ্যায় শিল্পী যখন দু-একটি কথার হাওয়া লাগালেন, তখন এক একটা চিত্র এক একটা সময়ের ইতিহাস হয়ে হাজির হলো। বুঝতে পারলাম, প্রতিটি চিত্রে শিল্পী মানবিক মূল্যবোধের বয়ান তুলে ধরেছেন।
শিল্পী সারাজীবন সমাজ-সংস্কৃতির যে-অসংগতি দেখেছেন – রং-তুলিতে তা অনুসন্ধান ও বিশ্লেষণ করেছেন। ‘এফেক্টেড অব ফারাক্কা’ সিরিজ চিত্রে পদ্মা নদীর শুকিয়ে যাওয়ার দৃশ্য। কারণ ফারাক্কা বাঁধ। পদ্মার দিগন্তবিস্তৃত শুষ্ক বালুচর পরিদর্শন ও প্রাথমিক অনুশীলনী শেষে স্বকীয় শৈলীতে পুনর্বিন্যাস করেছেন। রেখা ও রঙের সহজ মিলন তাঁর চিত্রশৈলীর বিশেষ বৈশিষ্ট্য। অধিকাংশ চিত্রবয়ানে প্রকাশ করতে চেয়েছেন মানবিক গুণাবলির সত্য ও সুন্দর। পেনসিলের মোটা-চিকন রেখা, বায়বীয় আঁচড় ও ডটের সারল্যে বেঁধেছেন সংগীতময় প্রকৃতি। পাঠ্যের (টেক্সট) শারীরিক গঠন ব্যবহার করা তাঁর চিত্রাঙ্কনের আর একটি ঢং বইকি। টেক্সটগুলির মধ্যে ধর্ম, জীবন-জগৎ ও মানবীয় গুণাবলির কথা সাজিয়েছেন অক্ষর ও শব্দ বিন্যাসে। রেখার নির্যাসে প্রকৃতির ছন্দ, প্রকৃতির গান যেন নৈঃশব্দ্যের স্পন্দন। বড় কথা তাঁর চিত্র অনন্য। কারো সঙ্গে মিল নেই। সেফটিপিন, জেমস ক্লিপ, তীর-ধনুক একই জমিনে পাশাপাশি রেখে নারী-পুরুষের স্বভাব, শোষণ এবং শোষিতের চরিত্র-সত্য বোঝাতে চেয়েছেন। চিত্রজমিনে ব্যবহৃত প্রতিটি উপকরণ বক্তব্য তৈরি করে। সাদা-কালো, আলো-আঁধার, ভালো-মন্দের দ্বন্দ্বের একটা স্বাক্ষর পাওয়া যায়। এক একটি অবজেক্ট যেন বীজগণিতের মতো সূত্রবদ্ধ। কখনো নারীকে প্রতীকায়ন করেছেন পোড়া সিগারেটের দুমড়ানো অংশ দিয়ে; আবার কখনো পুরুষকে প্রতীকায়িত করেছেন জ্বলন্ত ম্যাচকাঠি দিয়ে। নারীশরীরের কিছু নান্দনিক রূপ এসেছে বিশেষ ভঙ্গিতে। কোনোটি পেনসিলের মোটা-চিকন রেখায়, কোনোটি রঙের পাতলা আস্তরণে। বাংলার চিরচেনা পুতুলের সাদৃশ্যে এঁকেছেন নারীর শরীর। কোনো কোনো নারী-পুরুষের শরীর আদিম চিত্রকলার মতো সরলীকরণ রেখায় গাঁথা। দু-একটি রেখার টানটোনেই এক একটি ফিগার বা শরীর। ব্যতিক্রম ‘যুদ্ধ শিকার=রাজনৈতিক পাশা’ চিত্রটি। চিত্রটি কংক্রিটে তৈরি কিছু ভাস্কর্যের আদলের আবক্ষ প্রতিকৃতি, যা রাজনৈতিক নিষ্ঠুর খেলার বয়ান। পেনসিলের কার্বনস্নাত মোহনীয়তা শিল্পীর বাস্তবানুগ চিত্রাঙ্কনের মুনশিয়ানা জানান দেয়।
শুরুতেই বঙ্গবন্ধুবিষয়ক চিত্রের কথা বলেছি। এই সিরিজ চিত্রের চশমা, কোট, ক্ষতচিহ্ন পরবর্তী সময়ে আঁকা তাঁর কিছু চিত্রে বিমূর্ত রূপ ধারণ করেছে। কালো, সাদা, ধূসর, হালকা বাদামি রঙের ক্রমবিন্যাস দৃষ্টিসুখকর। চিত্রজমিনে দৃষ্টি রাখলে ধ্যান ও প্রার্থনার মতো মনে প্রশান্তি জাগে।
অমানবিকতা, বর্ণবৈষম্য, লিঙ্গ লঙ্ঘনের প্রতিবাদে নাইমা হকের ক্যানভাস সবসময়ই উচ্চকিত। অক্ষর ও শব্দবিন্যাসে চিত্র হয়ে উঠেছে পাঠযোগ্য। চিত্রজমিনে ব্যঞ্জনবর্ণ ‘শ’-এর আদল হয়ে উঠেছে নারীশরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ। ‘বর্ণমালা’ সিরিজ চিত্রে ‘অ’, ‘ক’, চন্দ্রবিন্দু ( ঁ) হয়ে উঠেছে এক একটি নারীমুখের আদল। বর্ণমালা আর নারীশরীর যেন একে অপরের সমার্থক। চিত্রে উপস্থিত মানুষের শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ বর্ণমালার মতো ছন্দে বয়ে চলে। টোকাইয়ের শরীর ছন্দময় রেখায় বেঁধেছেন ‘ট্র্যাশ কালেক্টর’ চিত্রে। কোনো কোনো চিত্রে তিনি বাংলার পুতুলের ফর্ম ব্যবহার করেছেন। যেমন – ‘লেডি ইন ব্লু’ চিত্র।
দৃষ্টির প্রতীক চশমা, অবহেলিত নথির প্রতীক দুমড়ানো-মুচড়ানো কাগজ, বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের সারল্য ও পবিত্রতার প্রতীক শাপলা কিংবা সবুজ রঙের ভাঙা চুড়ি হয়েছে মুক্তিযুদ্ধে সর্বহারা বা নির্যাতিত নারীর চিহ্ন। অধিকাংশ চিত্রে শক্তি, সংশয়, অরাজকতার শিকার হিসেবে প্রকাশ করেছেন রেখায় চলনের বিশেষত্ব দিয়ে। সবমিলিয়ে সমাজের বিভাজন, দ্বন্দ্ব, অমঙ্গল, মিথ্যাচার ভাঙতে খোলা বা ভাঙা তালা দেখিয়েছেন ক্যানভাসে। এভাবে প্রতীক-সংকেতের হিসাব-নিকাশ ধরে মানবিক মূল্যবোধে যেমন উজ্জীবিত হওয়া যায়; তেমনি রং-রেখা-টেক্সচারের বিমূর্ত রূপানন্দের রসাস্বাদনে উপভোগ্য নাইমা হকের চিত্র। ১৩ই জানুয়ারি শুরু হওয়া প্রদর্শনীটি শেষ হয় ২৮শে জানুয়ারি।
Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.