ঊষর দিন ধূসর রাত

গোলাপি বাড়িটার ওপর দুপুরের রোদ আছড়ে পড়ছে। যদিও আশেপাশে বিস্তর দালান-কোঠা, তাদের উঁচা-উঁচা মাথায় বিচিত্র রঙের প্রলেপ – কিন্তু রোদ্দুরের মায়ার-খেলা আজ ওই বাড়িকেই ঘিরে। ধবধবে আলোর ঝরনাধারায় ব্যালকনির গ্রিল, আভা-আঁধারির আবছায়া জমে থাকা থাইগ্লাসের দরজা – এমনকি জানালার কার্নিশগুলিও উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। বেশ খানিকটা কৌতূহল নিয়ে শেফালি বাড়িটার দিকে তাকিয়ে থাকে। তাকিয়ে তাকিয়ে হয়তো রোদের রহস্য আন্দাজ করার চেষ্টা করে।

এই এলাকায় ঘিঞ্জি বসতি – একেবারে পেটের কাছে, পিঠের সঙ্গে সেঁটে থাকা বাড়িঘর। পেট-পিঠের ওই বাড়িগুলিকে কিছুমাত্র তোয়াক্কা না-করে একটা বাড়ির ওপরই নজর দিতে হয়? একেবারে সমস্ত ঢেলে দিতে হয়? হতে পারে ওই গোলাপি রঙের বাড়িটার মাথা সবচাইতে উঁচা – ওই রকম চড়তারং নিয়ে আর কোনো ঘরবাড়িও ধারেকাছে নেই – তাই বলে এমন বাড়াবাড়ি? নিত্যদিনের চেনা দৃশ্যেরও এমন করে রদবল ঘটিয়ে দিতে হবে? শেফালি ঠিক বুঝে উঠতেও পারে না।

এই যে এখন – শেষ বসন্তের খরতাপ – ব্যালকনিতে দাঁড়ানো মাত্রই দুদ্দাড়-হাওয়া এসে নাকে-ঠোঁটে হলকা বুলিয়ে দিচ্ছে! দালানের খাঁজভাঁজ থেকে প্রগাঢ়-উষ্ণতা ছড়িয়ে পড়ছে – এরকম ভাপতাপের মরশুমে – ওই গোলাপি রঙের ওপর মনোহর আলোর লুটোপুটি দেখে সত্যিই ধন্দে পড়তে হয়।

রোদের আচানক মোলায়েম হয়ে ওঠা – তাও এইরকম আগুনে-দুপুরে – লু হাওয়া বয়ে যাওয়া পিচ-গলানো-চৈত্রে।

দুই পায়ের বুড়ো আঙুলে ঢেউ দিয়ে – খানিকটা উঁচু হয়ে বাইরের প্রকৃত-অবস্থাটা দেখে নিতে চায় শেফালি। বিশেষ করে ঠিক এই মুহূর্তে আকাশের অবস্থা। ধুর! কোথায় আসমান তার কোথায়ই-বা কী? পেটের কাছে পিঠের সাথের বাড়িগুলির ওপর শেফালির দৃষ্টি চক্কর খায়। চক্কর খেয়েটেয়ে ফের গোলাপি রঙের ওপরই ন্যস্ত হয়। কিন্তু শেফালিও এত সহজে হাল ছেড়ে দেওয়ার পাত্র নয়। ফের সে চেষ্টা চালায় – দুই পায়ের বুড়ো আঙুলের ওপর দেহের ভার ছেড়ে দেয়। ব্যালকনির গ্রিল ঘেঁষে দাঁড়াতে দাঁড়াতে ভাবে – ইস্ রে। আসমানের কিয়দংশও যদি দেখতে পেতাম এখন – আলোর অদ্যকার ভেলকিবাজি হয়তো ধরে ফেলতে পারতাম।

গ্রিলের গায়ে গা লাগিয়ে কীভাবে দাঁড়াবে শেফালি? ইতোমধ্যেই দুই-চারটা মাটির টবের সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে তার পা-দুটো বাধাগ্রস্ত হয়েছে। কিন্তু শেফালি ফের চেষ্টা চালায় – সারিবদ্ধ টবের ফাঁক-ফোকরে আলগোছে নিজের দুই পা গলিয়ে দেয়। দুই হাতের দশ আঙুল দিয়ে গ্রিলের ওপরের অংশ আঁকড়ে ধরে। বানরের মতো ঝুলতে ঝুলতে মুখটা উঁচু করে বাইরে তাকায় – একটা বিলম্বি নাকি কামরাঙার পত্রশাখা কিংবা ঘনছায়া শেফালির দৃষ্টি থেকে সমস্তই আড়াল করে রেখেছে। সহসা অসহিষ্ণু হয়ে ওঠে সে – এই সুদীর্ঘ নগরবাস তাকে যত না বিরক্ত করেছে – আজ, এই মুহূর্তে – আসমানের কোনাকাঞ্চিও দেখতে না পেরে ততোধিক বিরক্ত হয়ে ওঠে শেফালি। একেবারে গায়েবি ঘটনা – ফ্ল্যাটটা ভাড়া নেওয়ার প্রাক্কালেও তো ওই গাছটা দেখতে পায় নাই কেউ! এইরকম পেটেপিঠে সেঁটে থাকা দালানকোঠার রাহুগ্রাস বাঁচিয়ে ওই বিলম্বি নাকি কামরাঙা এমন ডাঙর হয়ে উঠলো কবে? হতে পারে কোনো বাড়িওয়ালা কিংবা বৃক্ষপ্রেমী ভাড়াটিয়া শখের তোলা হাজার টাকায় কিনে এই গাছ লাগিয়েছে। বিলম্বি নাকি কামরাঙা কিংবা বাড়িওয়ালা নাকি ভাড়াটিয়া আপাতত চুলায় থাক – এক্ষণে যে করেই হোক আকাশের দশা শেফালিকে একবার দেখতেই হবে।

 সে যেহেতু দীর্ঘাঙ্গী নয়, সেহেতু দুই পায়ের গোড়ালি উঁচু করে, বুড়ো আঙুলে ঢেউ দিয়ে, গলাটা কাছিমের মতো লম্বা করে বাইরে তাকায় – আর তৎক্ষণাৎ আসমানের একচিলতে অংশ গোচরে আসে। এতক্ষণ ধরে মনে মনে যা ভাবছিল শেফালি সেটাই সত্য। চোতমাসের তীব্র-খরতাপ আর ঝাঁজের মাঝেও আলো মোলায়েম হয়ে ওঠার কারণ ওই আসমান!

না ঠিক আসমানও নয় – আসমানজুড়ে ভেসে থাকা ধূমল মেঘেদের চাঙারি। পুবদিকে কালোকেশরের মতো কুণ্ডলী পাকানো মেঘ – কেমন নিশ্চিন্ত আলোর-কণাদের পশ্চিমের প্রান্তে ঠেলে দিয়েছে! ফলত এই প্রখর-মধ্যাহ্নে – দাবদাহের মরশুমে – রোদ্দুর কোমল হয়ে ওঠা – এবং গোলাপি রঙের ওপর ঘোরতর-ঝরে-পড়া।

এতক্ষণ বাদে শেফালির খরখরে ঠোঁটের কোণে মøান হাসির আভাস ফুটে ওঠে। আজ ছুটির দিন বলেই না এই রোদ-রহস্য, পাশের বাড়ির ওপর আলোর বাড়াবাড়ি, আকাশের পুবদিকে ধূমাকার মেঘের অস্তিত্ব, বিলম্বি নাকি কামরাঙা গাছের ছায়াবিস্তারী হয়ে ওঠাও তাকে কেমন ব্যতিব্যস্ত করে তুললো? অথচ ওয়ার্কিং ডে হলে এই সময়ে শেফালির দম ফেলারও ফুরসত মেলে না। খাওয়া-দাওয়া ভুলে কাজের ভেতর ডুবে থাকতে হয়।

টেবিলের ওপর স্তূপকৃত ফাইলের আড়াল থেকে শেফালির গোলগাল মুখটাও তখন দেখা যায় কি যায় না।

সাপ্তাহিক ছুটির দিন হলেও এখন পর্যন্ত শেফালির স্নানাহার সম্পন্ন হয় নাই। আদতে এমন শুষ্ক ও তাপভাপের দিনগুলিতে একদমই খেতে ইচ্ছে করে না। শুধু কোনো গভীর পুকুরের তলায় বেলে মাছের মতো নিঃসাড় পড়ে থাকতে ইচ্ছে করে। হিম জলের স্পর্শে দেহমনের যত অবসাদ ধুয়েমুছে দিতে ইচ্ছে করে। কিন্তু শেফালি চাইলেই কি সবকিছু হবে? হওয়া সম্ভব? চাইলেই যদি সমস্ত কিছুই এসে ধরা দিত হাতের মুঠোয় – তাহলে শেফালি হয়তো অন্তত নিজের মনটাকে বশ মানাতে পারতো। মনকেও আর কতবার, কতভাবে দোষারোপ করা যায়? মানুষের মন তো আর কাগজের নৌকা নয় – ভাঁজে ভাঁজ মিলিয়ে বানাও – জলের ওপর ভাসিয়ে দাও – ফের দামাল হাওয়ার তোড়ে ডুবিয়েও দাও। আর কেউ তেমন করে নিজের মনকে চেনে কি না শেফালি তা জানে না। তবে শেফালি খুব ভালো করেই জানে, মানুষের মন হলো একেবারে সাক্ষাৎ দানব। যত মন্দ, অতীত, বঞ্চনা, বেদনা, যন্ত্রণা, হাহাকার, অপ্রাপ্তি, ক্ষোভ – যা কিছুই তুমি এড়াতে চাও, ভুলতে চাও – এই দানব-মন তা হতে দেবে না। বড় অদ্ভুত মানুষের এই মন!

ওই গোলাপি রঙের বাড়িটার মতো একপেশে আলোর ঝরনাতলায় স্নাত হয়ে, নয়নাভিরাম সৌন্দর্যে টইটুম্বর হয়ে থাকার অভিলাষ তোমারও হতে পারে – সে সবের অধিকাংশ অপূর্ণও থেকে যেতে পারে। অভিঘাত-জর্জর তুমি যাবতীয় কিছু বিস্মৃত হওয়ার চেষ্টাও করতে পারো – কিন্তু মন তোমাকে সহজে মুক্তি দেবে কেন? পরিত্রাণ পাবে না তুমি জগতের  এত্তসব ক্লেদ-জঞ্জাল থেকে।

এতটা জীবন অতিক্রম করে এসে শেফালি এখন জানে – মন চলে মনের ভাও বুঝে। মানুষের মন হইলো লাগামহীন এক পাগলাঘোড়া! এই পাগলাঘোড়াকে ছুটিয়ে চলার সাধ্য মানুষের কই? শেফালি অনুভব করে – রহস্যপূর্ণ আলোকরশ্মির এই দুপুর, ক্রমশ তাকে ক্লান্ত করে ফেলেছে। বিলম্বি নাকি কামরাঙা গাছের আড়াল ভেদ করে পুবের মেঘরাজি তাকে বিপন্ন করে তুলতে চাইছে। শেফালির চোখদুটি জলভারে নত হয়ে উঠেছে। মনের ওপর বিছিয়ে রাখা শুকনো-পাতার রাশি বাওকুড়ানির দাপটে উড়তে শুরু করেছে। কিন্তু এইসবের কিছুই শেফালি এখন ঘটতে দেবে না। উছলে-পড়া আলোকময় দিনটাকে নিñিদ্র-আঁধারের তলায় কিছুতেই চাপা পড়তে দেবে না। শেফালি ভালো করেই জানে – মানুষের জীবনের প্রায় সমস্তটা জুড়েই থাকে থকথকে-অন্ধকার।

ছুটির দিনের এই এলানো দুপুরে, সে বরং বিলম্বি নাকি কামরাঙা গাছের বিভ্রম নিয়ে ভাবতে চায়। দৃষ্টির আড়ালে থেকে একটা গাছের আচানক হুড়মুড়িয়ে বেড়ে ওঠা নিয়ে পড়ে থাকতে চায়। যদি এমন হয় যে – এখন, এই ক্ষণে – নিজের মনোভূমে মাছেদের বুরবুরির মতো উজিয়ে-ওঠা ভাবনারাজিকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার জন্য  ফুটন্ত গরমজলে ঝাঁপ দিয়ে পড়তে হবে – শেফালি তাতেও প্রস্তুত। সেটাই করবে এখন সে।

সন্তপর্ণে পা-দুটোকে টেনে বের করে এনে মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়ায়। বুক ভরে নিশ্বাস টেনে নিয়ে সজোরে ছেড়ে দেয়। ওর নিশ্বাসের স্পর্শে অদূরের নিমগাছের পাতারা দুলে ওঠে। ব্যালকনির পুরোটা জুড়েই শেফালির ছোট্ট-বাগিচা। ফুলফলের আশা কিছু নাই – ছায়ামায়ার আশাও নাই – শুধু বিস্তর সবুজ এনে ডাই করে রাখা।

নিশ্বাসের বৃত্তে নাতিদীর্ঘ নিমগাছ – যার পাতার

খাঁজে-খাঁজে সবুজ-রং ঘন হয়ে লেপ্টে আছে। বাদলার কাল এলে এই সবুজ ক্রমে ফিকে হয়ে উঠবে। যেন বনের টিয়াপক্ষীটি উড়ে এসে গায়ের পালক খসিয়ে পাতায় পাতায় বিন্যস্ত করে দিয়ে গেছে!

নিমগাছের পাশেই কাগজিলেবুর ঝাড়। কাঁটা-পত্র আর সবুজ – সেও কেমন উজাড় হয়ে আছে। লেবুগাছের কাঁটা-পত্রের মাঝ দিয়ে হেসে উঠেছে ফুলেদের সাদা-সাদা পাপড়ি। অজস্র কুঁড়ির পাশে ফুটন্ত ফুলেদের এক মিষ্টি সৌরভ – নিমের শাখাপত্রেও মাখামাখি হয়ে আছে।

কালো আর সাদা তুলসীর মাথায়-মাথায় চুড়ো হয়ে ফুল ফুটেছে।

রুবি নেকলেস, কারিপাতা আর টিয়ার্সলাভের মন মলিন করে নেতিয়ে থাকা – পাশেই অনন্তলতার উদ্দীপক-যাত্রা। আকর্ষি বাড়িয়ে গ্রিল ধরে ধরে উঠে গেছে অনেকখানি। অনন্তলতার তাম্বুলাকৃতি পাতারা যেন হাত বাড়িয়ে ছুঁতে চাইছে বিচ্ছুরিত রোদের-কণা। হৃদয় প্রস্ফুটনের মতো করে গোলাপি ফুলেরা ফুটে আছে এন্তার।

অনন্তলতার পাশে ক্ষুদ্রাকৃতির পাত্রগুলিতে বালি-মাটি-পাথর আর সার। এসব পাত্রেও বীজ বুনে দিয়েছে শেফালি। নিত্য ভোরেই একবার উঁকি দিয়ে দেখে যায় – নতুন কোনো অঙ্কুর গজালো কি না?

মাঝারি কিছু টবে ম্যাজেন্টা আর হলদেটে পর্তুলিকা নির্নিমেষে তাকিয়ে রয়েছে। পর্তুলিকার পাশে পড়ে থাকা প্লাস্টিকের ঝাড়িটা জলশূন্য। কোনোভাবেই স্মরণ করতে পারে না শেফালি – আজ সকালে গাছগুলিকে সে স্নান করিয়েছিল কি না।

উবু হয়ে টবের সারিতে তাকাতেই দেখে – ফ্যাকাসে সাদা হয়ে আছে মাটি। গর্ভবতী নারীর উদরের মতো সরু সরু রেখায় মাটি ফেটে চৌচির। পর্যাপ্ত জল না-পেলে এসব দাগ নিশ্চিহ্ন হওয়ার নয়।

আজ যে শেফালির কী হয়েছে? তাইরেনাইরে  করে ফুরিয়ে ফেললো সমস্ত দিন। অথচ ছুটির একটা দিন – কতই না মূল্যবান! সারা হপ্তার কাজের খসড়া তৈরি করে রাখা – নইলে প্রতিটা দিন লেজেগোবরে অবস্থার ভেতর দিয়ে দৌড়াতে হবে।

গোলাপি রঙের বাড়ির ওপর বিছিয়ে থাকা রোদ্দুর ক্রমশ উজ্জ্বলতা হারাচ্ছে। সমাসন্ন বিকেলের বাদামি আভাস বিলম্বি নাকি কামরাঙা গাছের শাখাপত্র ঘিরে। শেফালির তবুও নড়তে ইচ্ছে করে না। কী হবে ঘরে ফিরে? বুড়ো ঈগলের মতো একা-একা দীর্ঘ লড়াই করেও সে জয়ী হতে পারলো না। নতুন ডানায় ভর করে নতুনভাবে উড়তে শিখলো না আজ অবধি। কোনোদিন উড়াল শিখতে পারবে – এমনও মনে হয় না তার। নিজের সীমানা-প্রাচীর নিজেই নির্ধারণ করে নিয়েছে – দুই ছেলে তুহিন আর মাহিন। বড় ছেলে তুহিনের ছুটির দিনেও কাজের ডাক পড়ে। আর মাহিন বিছানায় পড়ে পড়ে ঘুমায়। ঘুম থেকে উঠে নিজের মতো করে খেয়ে নেয়। এক টেবিলে বসে একসঙ্গে খাওয়া – এ-বাসায় আর হয় না। যখন পূর্ণাঙ্গ পরিবার ছিল – তখনো কি হতো?

হাতে মাটির ছোট্ট একটা পাত্র – কালো মাটির অন্ধকার ভেদ করে কিছু একটা দেখার চেষ্টা করছে শেফালি। কিন্তু নিশ্চিন্ত হতে পারছে না – সত্যিই নতুন কোনো জীবন প্রস্ফুটিত হলো কি না? চোখ থেকে চশমা খুলে ওড়না দিয়ে ভালো করে মুছে নেয় – সাদা সাদা সরু সুতা মাটি ফুঁড়ে ওপরে উঠছে।

কাঁকর-বালি আর কালোমাটির ওপর আলগোছে মাথা উঁচিয়ে দেখছে এই পৃথিবীর আলো-হাওয়া!

সাকুলেন্ট!

শেফালির ইচ্ছে হয় চিৎকার করে বলতে –

সাকুলেন্ট! দেখো আমার এতদিনের পরিশ্রম সার্থক হলো।

ছোট্ট মাটির পাত্রটি পরিপূর্ণ করে দিয়ে সাকুলেন্টের অঙ্কুরোদ্গম হয়েছে। ভীতসন্ত্রস্ত নজরে নতুন শিশুরা তাকিয়ে দেখছে – এই পৃথিবী বাসোপযোগী কি না।

শেফালির মন প্রফুল্ল হয়ে ওঠে –

কোন মরুর দেশের অতিথি – আজ আমার ঘরের কোণে জীবন মেলে দিতে চাইছে!

২.

পুবদিকের আকাশে জমায়েত হওয়া মেঘদল এতক্ষণে ছিট্টিছান হয়ে ভেসে গেছে। টুকরো টুকরো মেঘেদের ফাঁকফোকর গলিয়ে স্বর্ণলতার মতো চিকন আলোর রেখা ঝলসে উঠেই মিলিয়ে যাচ্ছে। খানিক বাদেই ফের ঝলসে উঠছে। তারা আজ যেন কোনো লুকোচুরি খেলায় মেতেছে। অথচ ঘণ্টাখানেকের মাঝেই আলোর এই লুকোচুরি খেলা সাঙ্গ হয়ে যাবে। আর মেঘেদের রং যাবে পাল্টে। ছাইরঙা মেঘেদের স্তরে স্তরে জমাট বেঁধে যাবে লালরং। যেন-বা ইমাম হোসেইনের তাজা রক্তে রাঙা হয়ে উঠেছে সিমারের হাত – হোসেইনের কর্তিত মস্তক হাতে নিয়ে সিমার ছুটে চলেছে ইয়াজিদের দরবারে। সূর্য ডুব দেওয়ার প্রাক্কালে আকাশের লোহুবর্ণকে শেফালির কাছে ওরকমই মনে হয়। সূর্য জেগে ওঠার সময়ও আকাশের শরীর জুড়ে লালিমা দেখা যায়; কিন্তু তাতে এমনতরো ছোপ ছোপ বিষণ্নতা আঁচড় কাটতে পারে না। দিনবসানে সূর্য যখন ডুবে যায় – হয়তো ফিরে যায় নিজের বাড়িতে – পৃথিবীর সঙ্গে তার বিচ্ছেদের বার্তা রেখে যায় সংগোপনে। যেন সে এই ক্ষণিক-বিরহেও ব্যথাতুর – মর্মাহত। সে কোন নিরুদ্দেশের পানে যাত্রা করেছে – সে জানে না আগামীকাল ভোর হবে কি না? ভোর হলেও সে ফিরে আসতে পারবে কি না – অদ্যকার আলোকচ্ছটা ছড়াতে পারবে কি না?

বিকেলের আলো যতই নিষ্প্রভ হয়ে উঠবে – বিলম্বি নাকি কামরাঙা, নিম ও লেবুর ঝোপের সবুজ হয়ে উঠবে গাঢ় থেকে গাঢ়তর।

দিনের শেষে গাছেদের শাখাপত্রও ঘন-অন্ধকারে পর্যবসিত  হয়। পৃথিবীর আলো নিভে গেলে সবুজ আর কৃষ্ণবর্ণের মাঝে তফাৎ করা ভারি দুষ্কর। তখন অন্ধকার মানে কয়েক প্রস্থ সবুজ! গহিন তমসা নামলে মাটি আর বৃক্ষ একাকার হতেই ভালোবাসে।

শেফালি জানে, দিনের আলোর মাঝে উদ্ভাসিত হয়ে থাকা ওই গোলাপি বাড়িতেও রাত্রি নেমে আসবে প্রগাঢ় হয়ে। অন্যান্য বাড়ির মতো সেও হয়ে উঠবে ছায়ামায়া-রহস্যঘেরা। নিদারুণ অস্পষ্টতা নিয়ে সেও থাকবে স্থির দাঁড়িয়ে।

রাস্তার দুই পাশের ল্যাম্পপোস্ট সান্ধ্যবাতি জে¦লে না দেওয়া পর্যন্ত সমস্ত বাড়ির আদলই একই রকম মনে হয়। নিষ্প্রাণ স্ট্যাচুর মতো মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা কংক্রিট। মাথা নুইয়ে রাখা নিয়নের আলো ঝলমলিয়ে উঠলে যাবতীয় কিছুই একেবারে স্পষ্ট – দিনের আলোর মতোই তখন দৃষ্টির আয়ত্তে।

সাকুলেন্ট!

কত দূর মরুস্থলের বৃক্ষ!

হাজার রকমের সাকুলেন্ট – কোনোটা বাঁধাকপির আকৃতির। কোনোটা যেন হুবহু পদ্মফুল – শতদলে প্রস্ফুটিত! কোনোটার পাতা পুরু-খাঁজকাটা – একটা পাতা ছিঁড়ে মাটির ওপর রাখলেই তরতরিয়ে বেড়ে ওঠে গাছ!

নাওয়াখাওয়ার তাগিদ নাই – সামান্য জল দিলেই এরা বেঁচে থাকতে পারে। অচ্ছুত করে রাখলেও মরে যায় না – তীব্র প্রাণাবেগে বেঁচে থাকতে চায় – এরকম কোনো বৃক্ষ মাটির টবে জন্ম নিচ্ছে – শেফালির চোখের কোণে আনন্দাশ্রু জমে ওঠে।

ভেবেছিল – আজকের ছুটির দিনটাই বুঝি রসাতলে গেল। তাইরেনাইরে করে কেটে গেল দিন – পলকেই ব্যর্থতার ঝুড়িতে খসে পড়লো! শেফালি এরকম ভাবলেই কী – সাকুলেন্টের জন্ম সেটা হতে দিলো না। একদা শেফালির বেঁচে থাকাও কি ছিল না ওই সদ্য অঙ্কুরিত সাকুলেন্টের মতোই? সামান্য পরিচর্যা, অল্প খাদ্য, কিছু বস্ত্র আর স্বল্প মনোযোগ – শুধুমাত্র একটা জিনিস অঢেল ছিল – অযাচিত অপমান! আহ! কী ভয়ানক সেসব দিন! কী দীর্ঘ এক একটা দিন-রাত্রি! মনে পড়লে শেফালি আজো কেঁপে ওঠে ভয়ে। কীভাবে সে ওসব সহ্য করতো? কেন তার ছিল ওরকম মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা? এক পাষাণ্ড লোকের সঙ্গে বিবাহ নামক জুয়াখেলায় শরিক হয়েছিল। নিত্যদিন একই সিন, একই ডায়ালগ, একইরকম করে কাট এবং অ্যাকশন!

চশমার কোণ দিয়ে শেফালি দেখে, দরজায় লম্বা ছায়া পড়েছে – মাহিন! মাহিন এসে দাঁড়িয়েছে ঘরের দরজায় –

‘আম্মা, কী করতেছ এইখানে? আমি তোমারে খুঁজতেছি এতক্ষণ ধইরা।’

‘কিছু না। এমনিতেই দাঁড়িয়ে আছি।’

‘শোনো, ভাইয়া কিন্তু চইলা আসছে। এসে ভাতও খাইছে।’

‘তাই নাকি? তুমি ভাত খাইছ?’

‘হ্যাঁ। এখন একটু ঘুরতে বের হইতেছি।’

‘আচ্ছা যাও। কিন্তু কই যাইতেছ?’

বলেই থেমে যায় শেফালি। সংকোচে যেন একেবারে গুটিয়ে ফেলে নিজেকে। এরকম প্রশ্ন সাধারণত সে করে না, বা করতে চায় না। ‘কোথায় যাচ্ছ’ – জানতে চাইলেই ছেলেরা বিরক্ত হয়। শেফালি আশ্চর্য হয়ে দেখলো মাহিন আজ বিরক্ত হলো না। উল্টো হেসে দিয়ে বলল –

‘আম্মা – এখন বড় হইছি, আম্মা।’

শেফালির মুখে লজ্জার আভা ফুটে উঠল। সেও নিজেকে সামলে নিয়ে বলল –

‘হ্যাঁ – তা তো হইছই। কখন ফিরবা? রাতে এসে খাবে নাকি?’

‘না, খাব না। সজল-রাহাতদের ওইখানে যাচ্ছি। তুমিও তো খাও নাই মনে হইতেছে।’

‘খাব এখন। তুমি যাও।’

মাহিনের ছায়াটা দ্রুত সরে যায় দরজা থেকে।

শেফালি ডাইনিং স্পেসে এসে তুহিনকে কোথাও দেখতে পেল না। রুমের দরজা ভেতর থেকে বন্ধ করা। ছেলেরা যতক্ষণ বাসায় থাকে – নিজেদের রুমের দরজা ভেতর থেকে লক করে রাখে।

রান্নাঘরের সিঙ্কের ওপর দুইটা মাটির প্লেটে এঁটোকাঁটা জমে আছে। ভাতের হাঁড়ির ঢাকনা পাশেই লুটোপুটি খাচ্ছে – যেন ভাত ফুরিয়ে যাওয়ার ইঙ্গিত! এই অবেলায় শেফালির হঠাৎ খিদে পেয়ে যায় – কিচেন জুড়ে ভাত-তরকারির থইথই সুঘ্রাণ – মাটির জগ ভরে রাখা জল – কিংবা হতে পারে নিজের অস্তিত্বের ভেতর পুনরায় ফিরে আসার জন্য।

সেই সকাল দশটার দিকে শুধু দুধ-কর্নফ্লেক্স পেটে পড়েছিল – দিন গড়ালো প্রায়!

ছুটাবুয়া দুইজনের ভাত রান্না করে গিয়েছিল – এখন খাঁ খাঁ করছে হাঁড়ি। শুধু দুই-চারটা ভাতের-দানা ঢাকনার বুকে লেগে আছে! হাঁড়ির সব ভাত দুই ভাই খেয়ে নিয়েছে। ভাত খেতে চাইলে শেফালিকে রান্না করে খেতে হবে। অবশ্য ভাত রান্না করা তেমন কোনো পরিশ্রমের কাজ নয়। চাল ধুয়ে গ্যাসের চুলায় বসিয়ে দিলে মিনিট বিশেকের ভেতর গরম ভাত পাতে নেওয়া যাবে। ভাত না হয় রান্না করে নিল – তরকারির অবস্থা কী? কড়াইয়ের ঢাকনা তুললো শেফালি – এক পিস রুইমাছ অল্প ঝোলে মুখ বের করে আছে। পাশে মাংসের হাঁড়ি – ভাতের হাঁড়ির মতোই ঠনঠন করছে। সামান্য তেল আর ঝোলের মাঝে দুই-চারটা এলাচি আর দারুচিনি শক্ত হয়ে আছে। আচ্ছা – একটু বলেকয়ে বাইরে গেলে কী হয়? অথবা ফিরে আসার পূর্বে একটা মেসেজ দিয়ে জানানো – বা একটা কল করা? বাসায় এসে ভাত খাব – এই সামান্য কথাটাও মাকে জানানো যায় না?

চট করে মনে পড়ে – ফ্রিজে থানকুনি পাতা আর রসুনের ভর্তা রয়েছে। গতকালই বুয়া বেটে রেখে গেছে। এই বয়সে হার্বের ওপর নির্ভরতা বাড়াতে চায় শেফালি – থানকুনি, পুদিনা, ধনেপাতা, হিবিস্কাস-টি, চিয়াসিড, এপ্রিকোট, মধু, গ্রিনটি – রান্নায় লেবুপাতা, কারিপাতা, তেজপাতা, কালিজিরা, তিল, তিসি, পোস্তদানা। এইসবের ওপর নির্ভরশীল বলে সুস্থও আছে সে। ষাট ছুঁইছুঁই শরীর – হাই ব্লাডপ্রেসার, ডায়াবেটিস কিছু নেই। এই বয়সে ওসব রোগের বাইরে থাকা চ্যালেঞ্জিংও বটে!

নিচু হয়ে বসে ক্যাবিনেটের পাল্লা দুটো ধীরেসুস্থে খোলে শেফালি। চাল রাখার হাঁড়িটা এখানেই রাখে সে। বছর দুয়েক হবে একটা বড়সড়ো মাটির হাঁড়িতে চাল রাখছে – এতে করে পোকামাকড় ধরে না, চাল নষ্ট হয়ে যাওয়ার আশঙ্কাও থাকে না। মাটির হাঁড়িটা মাটির সরাতেই ঢেকে রাখে – প্লাস্টিক ব্যবহার না করার চেষ্টা। প্লাস্টিকের কুফল এখন ওপেন-সিক্রেটের মতো। একদিন এই পৃথিবীই হয়তো ধ্বংস হয়ে যাবে প্লাস্টিক-পলিথিনের কারণে।

টিভির কোন চ্যানেল দিন কয়েক আগেও দেখালো – কক্সবাজার হিমছড়ির সমুদ্র সৈকতে অতিকায় এক তিমির মৃতদেহ ভেসে এসেছে। সেই তিমির পেট কেটে কেজি কে কেজি পলিথিন বের করেছে সমুদ্রের জেলেরা।

দক্ষিণ আটলান্টিকের সৈকতে ভেসে আসা মৃত তিমিটার ওজন ছিল কয়েকশো টান। ওই তিমির মাথা কাটার জন্য জেলেদের মই বেয়ে উঠতে হয়েছিল।

গাছকাটার করাত এনে কাটতে হয়েছিল ধড়-মাথা-লেজ। দড়ির মতো পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে টন কে টন পলিথিন ছিল তিমির পেটের ভেতর।

ছোট ছোট হাত দুটি দিয়ে মাটির হাঁড়ির ঢাকনা খোলে শেফালি – এক কৌটা চাল মেপে নেয়। বড় যত্ন করে মাটির সরা দিয়ে ফের ঢেকে রাখে হাঁড়ির মুখ। থাকুক – মা-লক্ষ্মীর ভাণ্ডার যতনে থাকুক। মা-লক্ষ্মীর ভাণ্ডারকে যত্নে আগলে রাখতে হয়। শেফালি বরাবরই তাই করে।

শেফালি জানে – এ ভাণ্ডার আদতে ওর। একান্তই ওর-ই। এই ভাণ্ডারের ভাগ ও কাউকে দিতে চায় না। দেবেও না।

ভাত খেয়ে উঠতে উঠতে সন্ধ্যা গড়িয়ে যায়। চারপাশের মসজিদ থেকে একযোগে আজান ধ্বনিত হয়। নামাজটা কি পড়ে নেবে? আলস্যপূর্ণ, উদাস – অথচ রহস্যময় একটা দিন সে পার করেছে। সারাদিনের স্বেদ-ধূলি-ময়লা শরীরে মেখে আছে – এরকম অবস্থায় নামাজ পড়ার ইচ্ছা হয় না তার।

মাহিনের শূন্য ঘরে আলো জে¦লে দেওয়া দরকার। এরকম ভরসন্ধ্যায় ঘর অন্ধকার করে রাখতে নাই। তুহিনের বদ্ধ-দরজার ফাঁক গলিয়ে সামান্য সোনালি আলোর সরু-রেখা – হয়তো দরজার পাল্লাতেই সমস্ত আলো সেঁটে ধরেছে।

ডাইনিংয়ে একটা ছোট বাল্ব জে¦লে দিলো শেফালি – নিজের ঘরে জে¦লে দিলো টিউবলাইট। ধবধবে সাদা আলোর তোড়ে চোখের পাতা দুটো কুঁচকে ফেললো – ধুর! সন্ধ্যার সদ্য জন্মলগ্নে এত উজ্জ্বল-আলো অস্বস্তিকর লাগে ওর। এখনো আঁধার ঘনায়নি – ভোরের মতো নরম আলোয় ডুবে আছে এই শহর। সুইচটা অফ করে ফের ব্যালকনিতে দাঁড়ালো – আলকাতরা গোলানো ঘন-অন্ধকার থইথই করছে শেফালির ছোট্ট-বাগিচার শাখাপত্রে।

কিরির কিরির শব্দে কানে তালা ধরে যাচ্ছে – ঝিঁঝি পোকাদের একটানা কোরাস। এত ঝিঁঝি পোকা এলো কোত্থেকে? বিলম্বি নাকি কামরাঙার ছড়ানোবিছানো ডালপালা থেকে ভেসে আসছে এই গান – ঝিঁঝিদের সম্মিলিত আহ্বান!

ব্যালকনির বাইরেও জমাট বেঁধে আছে আঁধার। ওই ঐক্যতান ভেসে আসছে কোত্থেকে – শেফালি কিছুতেই ধরতে পারছে না। একবার মনে হয়, বিলম্বি নাকি কামরাঙা, ওইরকম কোনো গাছ থেকে উঠে আসা কর্কশ-সুর সন্ধ্যার মোহময়ী আলোকেও নিরুদ্দেশ করে দিয়েছে।

ক্রমশ জোরে বাজতে থাকে ওই সুর – একঘেয়ে – বিরক্তির। নিমগাছ নাকি অনন্তলতা? লেবুর ঝোপ নাকি কলাবতীর নরম ডাল – শেফালি ধরতে পারে না। কোত্থেকে উঠে আসছে এত তীব্র শব্দ?

একবার ভাবে, তুহিনকে ডেকে বলে – বাবা, এত ঝিঁঝি পোকা কবে এলো এই শহরে? এসেছে ভালো কথা – এরকম কর্কশ স্বরে ডাকতে শিখলো ওরা কবে?

তুহিনের বদ্ধ-দরজার এপাশে নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে থাকে শেফালি – কী এক সংকোচে গলা বুজে রয়েছে! ছেলেকে কিছুতেই ডাকতে পারে না। বদ্ধ দরজায় উপচে পড়ছে টুংটাং মিষ্টি-সুর। গিটার বাজাচ্ছে তুহিন।

ঝিঁঝিদের অবিশ্রাম ডেকে যাওয়া আর গিটারের মিষ্টি ঝংকারের মাঝখানে দাঁড়িয়ে শেফালি কী শুনছে – উপলব্ধি করতে পারে না।

৩.

ডোরবেল বেজে উঠলো না – দরজায় কোনো করাঘাতও নয় – শুধু ‘খুট’ করে সামান্য আওয়াজ হলো। যেন কোনো বনস্পতি অশ্বত্থ কিংবা পাকুড়ের ছায়া হেঁটে গেল অলক্ষে। অথবা একটা বরফের কিউব হাত ফসকে পড়ে গেল নিচে – মোজাইক করা  মেঝের ওপর। মেঝের ওপর পড়তেই ভেঙে চৌচির। বরফের ক্ষুদ্র-ক্ষুদ্র ভগ্নাংশ মিলিয়ে গেল কালো-সাদা-ঘিয়ে-লালচে রঙের অজস্র পাথরের ভিড়ে। এরকম রাত-নিশুতিতে ওই ‘খুট’ শব্দ কারো শোনার কথা নয়। মৃদু শব্দের জন্মই হয় মুহূর্তেই মরে যাওয়ার জন্য। রাত্রির কাক্সিক্ষত নির্জনতায় ঢুকে পড়ে ওই শব্দ – ত্বরিত গতিতে ফের হারিয়েও যায়। এমন অস্ফুট-আওয়াজ কেউ শুনবে না – শুনলো না – শুনলো শুধু শেফালি। স্পষ্ট শুনলো সে ওই আওয়াজ!

এ-কথা সত্য – এই শব্দ শুধু শেফালিই শোনে। হররোজ না হলেও হপ্তায় তিন-চারবার তো বটেই। মাঝরাতে মাহিন ঘরে ফিরলে এই শব্দ শোনে সে। তুহিন ফিরে এলেও শোনে। নিশিরাতে বিব্রত মুখ করে পায়ের তলায় ওই শব্দকে চাপা দিয়ে নিজের রুমে ঢুকে পড়ে। প্রায় নিঃশব্দে দরজা বন্ধ হয়ে যায়।  দরজা বন্ধ হওয়ার পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত ওই শব্দ সারা ফ্ল্যাটে ঘুরপাক খায় – লিভিং, ড্রয়িং, ডাইনিং, কিচেন, বাথরুম, ব্যালকনি। বরফের কিউব ভেঙে চুরমার হয় – সারা বাড়ি জেগে ওঠে, পরমুহূর্তে ঘুমিয়েও পড়ে।

মাহিন আজ ফিরলো রাত্রি একটার পর। ‘খুট’ – মৃদু শব্দে জেগে উঠলো সব – অশ্বত্থ নাকি পাকুড়ের ছায়া হেঁটে গেল অলক্ষে। সন্তর্পণে চাবি ঢুকে খুলে ফেলল বদ্ধ-কপাট। দরজার পাল্লায় লেগে আছে রাত্রির নৈঃশব্দ্য! নিজের বিছানায় শুয়েছিল শেফালি – পুত্র এত রাতে ফিরে এলো? মাহিন বেড়ালের মতো নরম পায়ে ঢুকে পড়লো নিজের রুমে। আলগোছে ভেতর থেকে বন্ধ হয়ে গেল দরজা। অতি পুরাতন ও একঘেয়ে দৃশ্য – বন্ধ কপাটের তলায় শুয়ে থাকা ক্ষীণ আলোর রেখা – সাদাটে সোনালি। বের হয়ে যাওয়ার গতিপথ খুঁজে না পেয়ে ফিরে গেছে ঘরের ভেতর – যেন-বা উজ্জ্বল অথচ সরু সরীসৃপ।

অথবা এমনও হতে পারে যে, দরজার পাল্লার সঙ্গে ভাব জমিয়ে লেপ্টে গেছে। আলোর স্বভাবই অমন – অন্যের ওপর প্রতিফলিত হওয়া। একটা কিছু আঁকড়ে ধরে নিজেকে প্রকাশ করা – যেন লাউগাছের আকর্ষি! কিছুকে অবলম্বন না-করে যে জীবন বিস্তার করতে অপারগ। ফলে বদ্ধ-ঘরের বার্নিশ মলিন হয়ে পড়া দরজাকে আলোকিত করে তোলা আলোর জন্য সহজতর।

‘তরুলতা’ নামক এই বাড়ির গেট ভেতর থেকে লক হয়ে যায় রাত এগারোটায়। ঢং ঢং শব্দে দেয়ালঘড়ির পেন্ডুলামটি এগারোবার বেজে যায়। এর সামান্য পরেই দারোয়ান আসলাম প্রামাণিক জেলখানার প্রহরীদের মতো ধামাধাম ঝুলিয়ে দেয় তালা। তিন-চারটা তালা চাবি ঘুরিয়ে লক করে দিয়ে গেটের ফাঁক দিয়ে উঁকিঝুঁকি মারে – আর কেউ বাইরে রয়ে গেল কি না? অথবা অপরিচিত মানুষজন দাঁড়িয়ে আছে কি না ‘তরুলতার’ চৌহদ্দির ভেতর? দেখেশুনে নিশ্চিন্ত হয়ে অলস ভঙ্গিতে হাঁটতে শুরু করে সে। দিনান্তে রাজ্যির আলস্য এসে অচল করে তুলতে চায় ওকে। প্রামাণিকের কোমরের কালো তাগায় বাঁধা চাবির গোছা দুলতে শুরু করেছে এতক্ষণে। ঝুমুত ঝুমুত শব্দে বেজে উঠছে – প্রামাণিক ফিরে যাচ্ছে নিজের ঘরে। ঘর বলতে তিনখানা মানুষ কোনোরকমে  এপাশ-ওপাশ করতে পারে সেরকম একটা ডেরা। এই ডেরার পাশেই ছয় হাত বাই দশ হাত আরেকটা পকেট-রুম। জুলেখার পুরো সংসার এই পকেট রুমে।

হাঁড়িকুড়ি-থালাবাসন-পেঁয়াজ-রসুন-তেল-লবণ-আদা-হলুদ-মরিচ-সবজি নিয়ে ভাঁড়ার ঘর। এই ঘরেই তাদের রান্নাবান্না হয়। বাড়িওয়ালা একটা পুরাতন গ্যাসের চুলা লাগিয়ে দিয়েছে। চুলার আগুন বাড়িয়ে জুলেখা হাত-পা সেঁকে নেয় শীতের মরশুম এলে। আর প্রামাণিকের সঙ্গে কলহের রাতগুলিতে চুলার ধার  ঘেঁষে শুয়ে থাকে। ঘামের কুট-গন্ধ লেগে থাকা শাড়ির আঁচলে মুখ ঢেকে হাপুস নয়নে কাঁদে।

লক হয়ে যাওয়া গেট খুলে মাহিন তরুলতায় ঢুকলো কীভাবে? এত রাত অবধি সে ছিলই বা কোথায়? এসব প্রশ্ন মাহিনকে জিজ্ঞাসা করা যাবে না। শেফালি জিজ্ঞেসও করবে না। যুবক হয়ে ওঠা দুই ছেলের কাছে মায়ের কোনো জিজ্ঞাসা থাকতে নাই – হাজার জিজ্ঞাসা থাকলেও সেসব কণ্ঠনালির ওপরে উঠতে দেয় না শেফালি। বেমালুম হজম করে ফেলে। কারণ ছেলেদের কিছু জিজ্ঞাসা করা মানেই বিপদে পড়া। কারো কাছ থেকেই সদুত্তর মেলে না, মিলবেও না। বরং উল্টা আজগুবি কথার মারপ্যাঁচে নিজেকে বিপন্ন করে ফেলা। শেফালি বহুবার খেয়াল করেছে – কোনো কিছু জানতে চাওয়া মাত্রই দুই ছেলেই বিরক্ত হয়, বিরক্ত হয়েছে – এ নিয়ে ওদের কোনো রাখঢাক নাই। লজ্জিত হওয়া তো বহুদূর!

কিছু জানতে চাইলেই দুইজনেরই মুখের রং রাঙা হয়ে ওঠে – ভ্রু-যুগল কপালে তুলে, চোখ দুটো কুঁচকে বলে –

‘আম্মা, সব বিষয়ে তুমি নাক গলাইতে আসো ক্যান?’

‘আম্মা, এতকিছু জেনে তোমার ফায়দা কী?’

‘আম্মা, এত ঘ্যানঘ্যান কইরো না তো!’

এই পৃথিবীতে মুশকিল যত আছে আসান ততোটা নাই। মুশকিলের ঘূর্ণিপাকেই ঘুরছে সবকিছু।

‘আম্মা যাও তো নিজের কাজবাজ করো। অফিসের কাজকর্ম কি তোমার বন্ধ হয়ে গেছে?’

আদতে জেগেই ছিল শেফালি। দুই ছেলের যে কেউ একজন ঘরে না-ফেরা পর্যন্ত তার চোখে ঘুম নামে না। ঘুমের মাসিপিসিরা তখন হয়তো অন্য এলাকায় বেড়াতে যায়। বেড়াতে বেড়াতে ঘুম বিতরণ করে চলে। এই শহরে হাজারেবিজারে মানুষ – নিযুত-কোটি মানুষ – এত লোককে ঘুম বিলাতে বিলাতে তারা কি ক্লান্ত হয়ে পড়ে?

শেফালি জেগে থাকে, দুই ছেলের কেউ কখনো বলে নাই – ‘আম্মা – তুমি জেগে থাইকো – আমরা ঘরে না-আসা পর্যন্ত জেগে থাইকো তুমি।’

ছেলেরা এমন না বললেও শেফালি জেগে থাকে। এই জেগে থাকা ওর দীর্ঘদিনের অভ্যাস। ঘুম আসে না – ল্যাপটপ খুলে অফিসের কিছু কাজ সেরে রাখে। বিছানা ছেড়ে উঠে গিয়ে ব্যালকনিতে পায়চারি করে – বাইরে ঘুটঘুটে – অথচ আকাশ আবছা-আলোয় ভরে আছে। গাছেদের-পাতাদের নাকি অন্ধকারের ঘ্রাণ শুঁকে রাত্রি কত প্রহর – আন্দাজ করার চেষ্টা করে শেফালি।

‘তরুলতার’ প্রতিটা ফ্ল্যাটের তিনটা করে চাবি। তিনটা চাবি তিনজনের কাছে রাখা – ফলে এই ফ্ল্যাটের বাসিন্দারা সকলেই স্বাধীন। কেউ কারো জন্য অপেক্ষা করে না – কেউ কাউকে বদারও করে না। যখন যেমন ইচ্ছে ফ্ল্যাটে প্রবেশের ও বের হয়ে যাওয়ার এখতিয়ার তিনজনেরই আছে। শেফালি তবু অপেক্ষা করে। ছেলেরা না ফেরা পর্যন্ত ঘুমাতে পারে না সে!

বাদলের সঙ্গে যখন পরিপূর্ণ সংসার ছিল – তখনো জেগে থাকতো শেফালি। উৎকর্ণ হয়ে অপেক্ষায় থাকতো ছোট্ট একটা শব্দ শোনার জন্য –

‘খুট’!

অশ^ত্থ নাকি পাকুড় গাছের ঘন ছায়ারা অলক্ষে হেঁটে গেল। সাদা-লোমে-ভরা চতুর এক বিড়ালের নিঃশব্দ-যাত্রা – হোঁচট খেল। আর বরফের কিউবটা হাত ফসকে পড়ে গেল নিচে। বহুবর্ণা পাথরের মোজাইক মেঝের ওপর চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে গেল সাদা এক টুকরো বরফ! আহ্! জীবন! অনবধানে হাত ফসকে পড়ে যাওয়া হিমখণ্ড! অতঃপর ভগ্নাংশ খুঁজতে খুঁজতে খরচ করে ফেলা জীবনের বাদবাকি দিনগুলি!

রাত গহিন করে ছেলেরা যেদিন বাড়ি ফেরে – অ্যালকোহালের চেনা গন্ধ ফ্যানের হাওয়ায় উড়ে বেড়ায়। উড়তে উড়তে শেফালির বারো বাই চোদ্দো ফুটের রুমটাতেও ঢুকে পড়ে। কত জনমের পরিচিত ওই গন্ধ – স্পিরিটের বোতলের কর্ক হঠাৎ খুলে ফেললে ভক করে নাকে এসে লাগে। মিষ্টি অথচ ঝাঁজালো গন্ধ!

বাদলের সঙ্গে সংসার যাপনের দিনগুলিতে এই গন্ধের সাথে শেফালি পরিচিত হয়েছিল। দিনের প্রান্তে নেমে আসা অন্ধকার – এই পৃথিবীকে ঘুমিয়ে পড়ার অবকাশ দেওয়া রাত্তির – যেন ছোট্ট একটা ঘোমটা টেনে বসে থাকা কলাবউটি! আঁধারের মোহনীয় হাতছানিতে প্রায় প্রতি রাতেই টলতে টলতে বাসায় ফিরতো বাদল। কোনোদিন সন্ধে নামার মুখে ফিরে এলে কাঁধের ব্যাগের ভেতর দুলতে দুলতে আসতো – ভদকা, জিন নয়তো  স্কচ হইস্কি। কোনো কোনোদিন ‘খাঁটি বোতল’।

রাত্রি যেন মুঝরা করতে আসা  কোনো অপরূপ নর্তকী – যার নাচের তালে বেজে উঠছে পায়ের ঘুঙুর – আর মৌতাতে ভরে দিচ্ছে যামিনীর তৃতীয় প্রহর। গহিন-গহন-বিভাবরীতে বাদলের কণ্ঠস্বর যেত বদলে। প্রথম প্রণয়ের দিনগুলির মতো আবেগে ভেসে যেতে চাইতো সে। ফ্লোর ম্যাটের ওপর পদ্মাসনে বসা বাদল – যেন সাক্ষাৎ শিবঠাকুর! শুধু মাথায় জটাতে এক ফালি চাঁদের অনুপস্থিতি!

রজনীর কালো মুখোশ পরে বাদল তখন একেবারে অন্য মানুষ। কথা বলতো ধীর লয়ে – যেন পৌষের কুয়াশা ঝরে পড়ছে ঝাঁকড়া-বকুলের শাখাপত্রে। অসময়ে ফুটে ওঠা কিছু ফুলের সুবাস মাখামাখি হয়ে যাচ্ছে ওই বিন্দু বিন্দু জলকণাতে।

‘শেফু আইজ কি ফ্রিজে বরফ জমাইছিলা?’

‘শেফু’ – বাদলের কাছে শেফালির সংক্ষিপ্ত নাম। বাসনা জাগ্রত হলে এই নাম ধ্বনিত হয়!

কোড়াপাখির চোখের মতো বাদলের চোখের কোণে

লালচে-আভা – সেদিকে তাকিয়ে শেফালির জবাব দেওয়ার ইচ্ছে মরে যেতো। নিঃশব্দে উঠে চলে যেত কিচেনে। ডিপফ্রিজের ড্রয়ার থেকে বের হতো আইসকেইস। কেইসটা উল্টা করে ধরে খুলে দিত জলের কল। রাতের কালো শরীরে জল পড়ছে অবিরল – যেন অর্বাচীন কোনো জলঘুঙুর!

ততক্ষণে উধাও আবেগ! মদিরাবৃত কণ্ঠে উত্তাপ –

‘কই গেলা শেফালি? কতক্ষণ ধইরা বইসা রইছি। আইসবক্সটাও নিয়া আইসো।’

এখন ‘শেফু’ থেকে ‘শেফালি’ – বাদল কখন ও কেন ডাকে এমন – জানে সে।

‘শেফালি’ ডাক শুনেই আপাদমস্তক থরথর করে ভয়ে কেঁপে ওঠে – আইসকেইস থেকে দুই-চারটা কিউব হাত ফসতে মেঝেতে গড়িয়ে পড়ে। ‘খুট’-ভেঙে চৌচির বরফখণ্ড!

কালো-সাদা-ঘিয়ে-লালচে রঙে বিছিয়ে থাকা অজস্র পাথর – শক্ত চোখে তাকিয়ে রয়েছে। ওই বিচিত্র রঙের পাথরের মাঝে বরফের ভগ্নাংশ খুঁজে পাওয়া – একেবারেই অসম্ভব!

পলকেই গলে গলে জল হয়ে যাবে বরফচূর্ণ, মিশে যাবে মোজাইকখচিত মেঝের সঙ্গে। শেফালি জানে, চার-পাঁচ পেগের পর গলতে শুরু করবে বাদলও। কোড়াপাখির মতো লালচে হয়ে থাকা চোখজোড়াতে গাঢ় হয়ে জমবে লালরং।

সেই টুকটুকে-লাল, ঘোরগ্রস্ত-নয়ন খুঁজে ফিরবে শেফালিকে। বাদলের চোখের রংই বলে দেবে – কোড়াপাখির শিকার ধরার সময় আসন্ন। কাচের বোতলের মুখ থেকে প্লাস্টিকের কর্ক খুলে নেওয়ার শব্দের মতো করে কোড়াপাখি ডাকছে –

ঢব-ঢব-ঢব-আছ! ঢপ-ঢপ-ঢপ-আহ্!

একতারা থেকে ক্রমশ বোল উঠছে – ঢকা-ঢকা-ঢকা –

বাদলের তর্জনী দ্রুত নড়ে উঠছে একতারাটির কোমরের ওপর। রক্তবর্ণ দুই-চক্ষের মাঝখানে কোড়াপাখির আলতা রঙের ঝুঁটিটা নড়ে উঠছে ঘনঘন! ধূসর-হলদেটে পা দুটো ডুবিয়ে দিয়েছে ক্ষেতের কাদাজলে। ধান কেটে নিয়ে গেছে কিষানের দল। প্যাচপ্যাচে জল জমে আছে শূন্য মাঠে। সেই জলে সন্তর্পণে পা ফেলে হেঁটে চলেছে পাখি – শিকারের সন্ধানে।

৪.

বহুদূর থেকে কোনো শব্দ ভেসে এসে ঘুমের ভেতর ঢুকে পড়ছে। এপাশ-ওপাশ করে মুমু তাড়াতে চেয়েছে ওই অনাকাক্সিক্ষত শব্দ – কিন্তু পেরে ওঠে নাই। মাথার নিচ থেকে শিমুল তুলার বালিশটা টেনে এনে কানের ওপর চেপে ধরেছে, কিন্তু কাজের কাজ কিছু হয় নাই। উপায়ন্তহীন ওই শব্দকে সঙ্গ করেই শুয়ে থাকতে হচ্ছে – চিৎপাত পড়ে থাকা আরশোলার মতো। যেন সে অতি দ্রুত পথ চলতে চলতে কোনোভাবে উল্টে গেছে। উল্টে গিয়ে নড়াচড়ার শক্তিও হারিয়ে ফেলেছে। এখন নিষ্ফল আক্রোশে হাত-পা ওপরের দিকে ছোড়াছুড়ি করা ছাড়া তার আর কোনো গত্যন্তর নাই। চিৎ হয়ে পড়ে থাকা মৃতবৎ মুমুর বুকে কে যেন একটা ভারী পাথর চাপা দিয়ে গেছে। ওই ভারী পাথরের নিচ থেকে উদ্ধারের সম্ভাবনাও ক্ষীণ। পাথরের তলায় চাপা পড়ে থেকে ফ্যাকাশে-সাদা – এরকম কোনো অবয়ব ধারণ করেছে। যেন সে কোনো ঘাস – অন্ধকার স্যাঁতসেঁতে পাথরের তলায় চাপা পড়া – ক্রমশ ক্ষয় করে ফেলছে জীবনীশক্তি। এমনকি নড়াচড়া করার মতো সামান্য শক্তিও আর অবশিষ্ট নাই!

মুমুর পরনে ঘিয়ে-রঙা-নাইটি – চিৎ হয়ে শুয়ে আছে বলে স্তনযুগল স্পষ্ট – পরিপক্ব ডালিমের আকৃতি নিয়ে ঊর্ধ্বমুখী। কালো গোলাকার অংশে কুঁচফলের মতো ছোট স্তনবৃন্ত শক্ত হয়ে ফুটে আছে। ঘরের ভারী-পর্দা ভেদ করে অস্ফুট-আলো এসে পড়েছে মুমুর অনাবৃত হাত-কাঁধে – বর্ষার জলমগ্ন পুকুরে ডুবন্ত শাপলার ন্যায় সতেজ-সুডৌল বাহুদুটি।

আধোঘুম কিংবা আধোজাগরণের মাঝে অবস্থান করে মুমু বোঝার চেষ্টা করছে – কীসের শব্দ? কোথা থেকে ভেসে আসছে ওই শব্দ?

সকাল এত শিগগির জেগে ওঠার কথা নয়। এই শহরের ঘুম পুরোপুরি ভাঙতে আরো ঘণ্টা-দেড়েক সময় অতিক্রান্ত হওয়ার কথা। তাহলে এই শব্দের উৎস কী? কোথা থেকে ভেসে আসছে এমন শব্দ?

একমাথা মিশমিশে কালো চুল বিছানা-বালিশে

ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে আছে। গুচ্ছ-গুচ্ছ-চুল কান দুটোকেও ঢেকে ফেলেছে।

রাতের ঘুমের পূর্বে মুমু একেবারে নিরাভরণ হয়ে বিছানায় যেতে পছন্দ করে। সারাদিন ঘাম কামড়ে থাকা ব্রা-প্যান্টি দ্বিধাহীন ছুড়ে ফেলে – চুলগুলিকেও বন্ধনমুক্ত করে ঘুমুবার আনজাম করে। মুমুর কাছে রাত মানেই নিজের নগ্নতায় নিজেকে দেখা। অন্তহীন নৈঃশব্দ্যের মাঝে নিজেকে নির্ভার উপুড় করে দেওয়া। এরকম সময়ে পোশাকের বাহুল্য বড় অস্বস্তির। অন্ধকার নির্জন হলে মুমুর পরনে থাকে ফিনফিনে-রাত্রিবাস – ফড়িংয়ের ডানা দিয়ে ঢেকে রাখা শরীর! যেন কোনো দক্ষ কারিগর রংধনু রঙের ডানাটি কেটেছেঁটে পরম যত্নে তৈরি করেছে মুমুর রাতপোশাক। পুরুষ্টু স্তনযুগলের ওপর ও পলকা-ডানা আলগোছে লুটিয়ে পড়ে ইঙ্গিতপূর্ণ করে তুলেছে দেহের চড়াই-উতরাইকে। ঘরের এককোণে ল্যাম্পের মৃদু-আলো – ওই আলোর রহস্যে কেমন অচেনা হয়ে ওঠে মুমু! যেন কোনো সুদূর পাহাড় থেকে অক্লান্ত উড়ে এসেছে – উড়ালের সঙ্গে নিয়ে এসেছে পাহাড়ি বুনোফুলের ঝাঁজ। ফিনফিনে পোশাকে মুমু যেন নিজেই একটা ফড়িং – ওর অনাবৃত বাহুদুটিকে দেখায় চওড়া পাখনার মতো।

পলকা-চওড়া পাখনা মেলে দিয়ে ফর্রফর ফর্রর্ফ শব্দে উড়ে বেড়ায় ঘরময়।

অবিশ্রাম শব্দের নিনাদে চাপা পড়া মুমু উৎকর্ণ হয় – জল পতনের শব্দ! ফোঁটায় ফোঁটায় জল ঝরে পড়ছে কোথাও। মুষল ঝড়-বাদলা থেমে যাওয়ার দীর্ঘক্ষণ পরেও বাঁশের বনে যেভাবে ঝরে পড়ে জল। খসখসে বাঁশপাতার ওপর জমে থাকা জলকণা গড়িয়ে গড়িয়ে অধোমুখী – পাতাদের সূচ্যগ্র মাথায় এসে জমে। অতঃপর ঝরে পড়ে টুপ করে।

বনের মাঝে বিছিয়ে থাকা মরাধরা-শুকনা, আধশুকনা পাতার স্তূপে সেই জলপতন আশ্চর্য মধুর এক ধ্বনি তোলে।

বাঁশবনের ভেতর মুমু কেন? কখন বা কীভাবে এলো সে? রহস্য যা-ই থাকুক না কেন মুমু হেঁটে চলেছে – ধীরলয়ে হেঁটে চলেছে – পায়ের তলায় মর্মর শুকনো পাতার নূপুর বেজে চলেছে – নূপুর ধ্বনিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ভিজে উঠছে পায়ের পাতা দুটি! মাথার ওপর ওড়াউড়ি করছে অগণন পাখি – ক্রমাগত চিরিক চিরিক ডাক আর পাখসাট! পাখা ঝাপটানোর অবিরাম শব্দের মাঝেও স্পষ্ট হয়ে উঠছে অচেনা কোনো পাখির ডাক।

কোন পাখি ডাকছে অমন করে? চড়াই নাকি শালিক? ঘুঘু নাকি দোয়েল? চড়াই, শালিক, ঘুঘু, দোয়েলের ঝাঁক একযোগে ডেকে চলেছে – জঙ্গলের মাদকতাময় গন্ধে মুমুর সবই তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে। কোনো এক বড়সড়ো ভুলভুলাইয়ায় ক্রমাগত ওঠানামা করছে মুমু।

অথচ এই সদ্য প্রস্ফুটিত সকাল – গাঢ় ঘুমের অস্পষ্টতার মাঝে থেকেও এটুকু স্মরণ হয় – গতরাতে সে নিজের ফ্ল্যাটেই ঘুমিয়েছিল। উত্তরা দুই নাম্বার সেক্টরের চৌদ্দ নাম্বার বাড়ি। সাততলা বাড়ির ছয়তলার ফ্ল্যাটটা মুমুর। নিজের ফ্ল্যাটের নিজের বিছানায় আয়েশ করে শুয়েছিল সে – যথারীতি ব্রা-প্যান্টির ফাঁস থেকে নিজেকে মুক্ত করে। একটানা নিরুপদ্রব ঘুমের অন্তে এক্ষণে কি না এই দশা!

অনবরত জল পতন! ফোঁটায় ফোঁটায় ঝরে পড়া জলের শব্দতরঙ্গ তাকে জাগিয়ে তুললো!

গাঢ় ঘুমে দুই চোখের পাতা সেঁটে আছে – প্রায় জোর করেই ঘুম তাড়ায় মুমু। ঘুম ভেঙে কীরকম এক বেকায়দায় পড়ে – এটা কোন জায়গা? এতক্ষণ সে কোথায় ঘুমিয়েছিল? অচেনা অনুভবের মাঝ দিয়ে যেতে যেতে চারপাশে তাকাতাকি করে – সবই চেনা চেনা লাগছে।

ডানপাশে ছয় ফুটের জানালা – ভারী পর্দার মাঝখানে ঝুলন্ত চাইমের সুদৃশ্য রশি। হাওয়ার বেগ বাড়লেই বেজে উঠছে রশির আগায় ঝোলানো ধাতবদণ্ড।

রিনির-রিন রিনির-রিন শব্দে একযোগে বেজে উঠছে। জানালার রেলে ঝুলন্ত চাইম দুলে দুলে জন্ম দিচ্ছে এই মনোহর জলতরঙ্গ!

চোখের পাতা-পল্লবে আঁকড়ে ধরা ঘুম – মুমু তবুও উঠে বসে। বড় বড় হাই তুলে ঘুমের আড়মোড়া ভাঙে। আড়মোড়া ভাঙতে ভাঙতেই বাইরে তাকায় – ঢাকা শহর ব্যস্ততার কোলাহলে এখনো মুখর হয়ে ওঠে নাই। আর ঘণ্টা দুয়েকের মাঝে শহরের প্রায় প্রতিটি রাস্তা হয়ে উঠবে যানবাহনের সমুদ্দুর। ঢেউয়ের পিঠে ঢেউ লাগিয়ে নিশ্চল হয়ে থাকবে গাড়ির বহর। যানবাহনের নিশ্চল হয়ে থাকাকে সমুদ্দুরও ঠিক বলা যাবে না – আগ্নেয়গিরির উদ্গত লাভা নেমে পাথর করে দিয়েছে এক নগরকে।

জানালায় ঝুলন্ত চাইম বেজে উঠলে ফের ধন্দে পড়ে মুমু – এইমাত্র বেজে যাওয়া সংগীত জলপতনের নয়। রাশি-রাশি শুকনা-পাতা দমকা বাতাসে উড়ে গেলে যেমন ধ্বনি ওঠে, ঠিক তেমন ধ্বনি বাজিয়ে চলছে ধাতব দণ্ডগুলি। ঘুম ভাঙলো তবে কীসের শব্দে?

মুমুর শোবার ঘরে তখনো সুরের মায়াজাল – একটানা বেজে চলেছে অপার্থিব কোনো সংগীত। একটা জলের ফোঁটার ওপর টুপ করে ঝরছে আরেকটা ফোঁটা। সেলফোনটা কোথায়? মাথার বালিশটা সরালে শব্দ-উৎস পেয়ে যায় – ‘রিলাক্সিং মিউজিক ওয়াটার’!

ঘুমপাড়ানিয়া জলতরঙ্গ। গতরাতে বলতে গেল নির্ঘুমই ছিল – পিয়ানো আর জলের মৃদু-সংগীত কত দ্রুতই না তাকে ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছিল। সারারাত ধরে বেজে চলেছে এই জলপতন। এই তাল-ছন্দ তাকে ঘুম পাড়িয়ে দিয়ে ফের জাগিয়েও তুলেছে।

বিছানা ছেড়ে উঠতে হলো। বেসিনের আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের মুখটা ভালো করে দেখে মুমু। ঘন-কালো সিল্কি-চুল মুখ-কাঁধ-হাতের ওপর এলিয়ে রয়েছে। বড় বড় চোখ দুটিতে কালোহাতা – তাতে রাজ্যের কৌতূহল জমে রয়েছে। ঈষৎ বোঁচা নাকের নিচে পুরু-ঠোঁট। গলার ঠিক মধ্যিখানে কালো তিল। ঝকঝকে উজ্জ্বল ত্বকে কচুপাতার মতো সবুজ আভা – মা বলে কালো! বোনেরাও তেমনই বলে। শুধু বাবা বলতো অন্যরকম – কী তোমরা কালো কালো করে মাথা খারাপ করছ? ও কি সত্যি কালো? কিছুতেই কালো না ও। ও হলো শ্যামল – শ্যামলা। ও হলো সবুজ-শ্যাওলা – কচুপাতা।

রাতভর পিয়ানো আর জলের ঘোরে থেকে এই সাতসকালে কে-ইবা দুঃখী হয়ে উঠতে চায়? কে-ইবা স্মরণে আনতে চায় দুম করে চলে যাওয়া মানুষটির কথা? বছর দুয়েক আগে কোভিড-১৯ তাকে নিয়ে গেল। মাত্র চারদিনের জ¦রে মরে গেল মুমুকে সবুজ-শ্যাওলা বলা লোকটা। সেই থেকে মুমুর একলা জীবন আরো একলা হলো। যেন সাহারা মরুভূমিতে একলা দাঁড়িয়ে থাকা খেজুরবৃক্ষ – চৌহদ্দিতে আর কারো ছায়া নাই – এমনকি সে নিজেও কারো জন্য ছায়া হয়ে দাঁড়াতে পারে না।

জ¦র, খুশখুশে কাশি, গলা-ব্যথা ছিল কি না বলে নাই  – মানুষটাকে হাসপাতালে নিতে নিতেই মরে গেল। মা তখন কানাডায় – ঝুমু আর রুমু আপার কাছে।

চারদিনের জ¦রে মারা যাওয়া লোকটা মুমুর জীবনের বারোটা বাজিয়ে দিয়ে গেছে – মুমুর স্বভাবের গরল-অমৃত – যা কিছু সবই সে ‘ইয়েস’ বলেছে। মুমু ভাবতে বসে – ওর সবকিছুতেই ‘ইয়েস’ বলার মতো মানুষ আর কে কে?

সজল আহমদ – কবি, এনজিও কমকর্তা। লম্বা-ঢ্যাঙা, কাঁধের ওপর স্ট্রেইট চুল। ঘন-পল্লবে ছাওয়া নয়ন দুটিতে শিশুর সারল্য উপচে পড়ছে। শিশুর মতো অবুঝ-দৃষ্টি নিয়ে এই পৃথিবী দেখে চলেছে। হাঁটার ছন্দে কাঁধের ওপর খোলা চুলে ঢেউ জেগে ওঠে। কথা বলে গুছিয়ে – মৃদু-স্বরে।

বছর পাঁচেক আগে মুমুর সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল সিনেম্যাটিক কায়দায়। উত্তম-সুচিত্রা জুটিকেও হার মানানো কায়দায় ছিল সে-পরিচয়।

বেঙ্গল গ্যালারিতে এস.এম. সুলতানের একক চিত্র-প্রদর্শনী চলছিল। প্রদর্শনী দেখতে আসা মানুষের ঢল – মুমু লম্বা-ঢ্যাঙ্গা সজলকে একপলক দেখেছিল।

সুলতানের ‘হত্যাযজ্ঞ’ ছবির সামনে বেশ ভিড়। মুমু চেষ্টা করলো ছবিটা দেখার – অগণন মানুষের মৃতদেহ পড়ে আছে ধানক্ষেতে। স্বাস্থ্যবতী মায়ের পাশে বলিষ্ঠ শিশু – হয়তো সংসারের কর্তাব্যক্তিটি – মাঠের-রাখাল, যুবতী-বধূ, দিনমজুর – সবুজ রঙের আধিক্যের পাশে লাল, হলুদ, কমলা, ধূসর, নীলের মিশেলে মৃত্যুর মিছিল দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়েছে।

আর তাকাতে ইচ্ছে করে না মুমুর। সরে পড়তে হবে এ-ছবির সামনে থেকে এই মুহূর্তে, এক্ষুনি। গলা শুকিয়ে কাঠ – জল ও চায়ের তেষ্টা মুমুকে কাতর করে তুলেছে। প্রায় পনেরো-বিশজনের পর চায়ের ট্রে হাতে পেল – হাফ লিটার পানির বোতল, ঘন দুধের চা আর এক প্লেট পাকোড়া। ট্রে হাতে এলেও মুমু বিপাকে – কোথায় বসে শান্তি করে চা খাবে? সব টেবিলে কালো কালো মাথা – মাথাগুলি নড়ছে – হাসছে – কলকল করছে।

মুমুর অনুসন্ধানী চোখ খালি-চেয়ার খুঁজে ফেরে – কেয়াগাছের ঝোপের পাশের টেবিল ছেড়ে মাত্রই উঠে গেল এক কাপল। পড়ি কি মরি করে মুমু দৌড়ালো সেদিকে – একহাতে শাড়ি আর অন্য হাতে ট্রে সামলাতে সামলাতে। কাপ থেকে চা চলকে পড়ছে – মুমু টেবিলে ট্রে রাখার ঠিক আগ মুহূর্তে আরেকজন ঠেলে দিলো নিজের ট্রে। কিংকর্তব্যবিমূঢ় মুমু কী করবে এখন? পূর্বের ট্রে ধাক্কা মেরে একপাশে সরিয়ে রেখে চেয়ারে বসে পড়লো ধপ করে। অন্য পক্ষের অবাক দৃষ্টি – বিব্রত হলেও পাত্তা দিলো না মুমু।

জোয়ার আসার মতো ফুলে ওঠা মানুষজনকে জোরজবরদস্তি করেই অন্যদিকে সরাতে হয়।

পাশের ট্রের ওপরও বেশ কিছুটা চা চলকে পড়েছে। একটা হাফ  প্লেটে দুটো শিঙাড়া – মুমুর চোখকে লোভী করে তুলছে।

অপজিটের প্লাস্টিকের চেয়ারটা টেনে বসে পড়লো ঢ্যাঙা লোকটা। মুমুর দিকে শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে হেসে ফেললো।

সেলফোনের আলো জ¦লে উঠলো। টুং-টুং করে বেশ কয়েকবার মৃদু শব্দ হলো – ভোরের চড়াই পাখি ডাকছে – ফেসবুকের ইনবক্সে মেসেজ জমা হচ্ছে। এরকম সকাল সকাল মেসেজ সেন্ড করছে কে? সজল আহমদ ছাড়া আর কে? রাতে লেখা কবিতা তরতাজা থাকতে থাকতেই মুমুর ইনবক্সে জমা হয়। মুমু ইনবক্স খুলল – সজল আহমদ ছাড়াও টুলকি মেসেজ দিয়েছে।

ইনবক্সে লালরং মুছে দিয়ে মুমু খুললো সজলের টেক্সট –

আমাকে ফেলে কোথায় তুমি যাবে?/ যেখানে যাও অন্ধ-বন/ লক্ষ তারার রাত,/ ব্যথার মতো বাতাস বয়ে যাবে/ আমাকে তুমি এড়িয়ে বলো কেমন করে রবে?/ যতই তুমি সরাতে চাও আমার অনুভব,/ তোমার চোখে গভীরতর স্বপ্ন হয় শিখা -/ জে¦লেছি আমি তোমাকে পেয়ে অন্ধকার রাতে/ ছড়িয়ে পড়ে আমার ছায়া তোমার চেতনায়/  তোমাকে বলি বৃথাই তুমি বিরান বুকে রাখো/ আমাকে আজ ফেরাবে কিসে, কেমন করে বলো?/ যেখানে যাও আমার প্রেম দুঃখ দিনের মতো/ আমাকে ফেলে কোথায় তুমি যাবে?

৫.

ঢব-ঢব-আহ! ঢব-ঢব-ঢব-আহ!

দাদাবাড়ির আমবাগানের একটা কোড়াপাখি অনবরত ডেকে চলেছে।

রোদ্দুরের প্রচণ্ড তাপে যখন কোনো কোনো দুপুর পুড়ে খাক – তামাটে বরণ হয়ে উঠেছে দিনের রং – বাতাস থম ধরা – শেফালি স্পঞ্জের স্যান্ডেল পায়ে হেঁটে বেড়াচ্ছে বাগানের ভেতর। বালিকার উদলা শরীরে হাজারেবিজারে ঘামাচি চাকা বেঁধে লাল হয়ে আছে। ফকফকা সাদা ত্বকে যেন কোনো লাল-ডেউয়া মরণ কামড় বসিয়ে দিয়েছে। সূর্যের গনগনে আঁচে হাঁসফাঁস করতে করতে শেফালি ছুটছে এগাছ থেকে ওগাছের তলায়। যদি কোথাও অধিক শীতলতা পাওয়া যায় – সন্নিবেশিত শাখাপত্রের ঘন ছায়ার নিচে দাঁড়ানো যায়। গরমের তীব্রতায় অতিকায় বৃক্ষরাজির শেকড়বাকড়ও যেন মাটির ওপরে উঠে আসতে চাইছে – ডালপালাও কুঁকড়িয়েমুকড়িয়ে একাকার। এইরকম অসহ্য তাপভাঁপের মাঝেও কি না ঝেঁপে ধরেছে আমের বোল। বৃক্ষরাজির চূড়ায় চূড়ায় মুকুলের হলুদ-সবুজের নিখুঁত  মিশ্রণ নয়নাভিরাম সৌন্দর্যের জন্ম দিয়েছে। উজ্জ্বল-রোদ খাড়া হয়ে নেমেছে ওই হলুদ-সবুজের মিশ্রণের ওপর। ফলে সরাসরি আসমানের দিকেই তাকিয়ে রয়েছে ওরা। আর কিছু ক্ষণজন্মা ফুলদল ঝরে পড়েছে গাছেদের তলায় – যেন জমিনের তপ্ত রোষ ঢেকে রাখার আপ্রাণ চেষ্টায় রত।

আমবাগান পেছন ফেলে কয়েক কদম আগে বাড়লে বিশাল দিঘি; কিন্তু বৃক্ষদের ছায়া ওই দিঘির নাগাল পায় না। গহিন কালো-ধূসর জল বুকে ধরে প্রাচীন ও গম্ভীর এক জলাধার – সূর্যের বুভুক্ষু উত্তাপ দিঘির তলদেশ পর্যন্ত পৌঁছে গেছে। ফলে জল কিছুটা অচঞ্চল ও উষ্ণ। অস্থির মাছের ঝাঁক ঈষদুষ্ণ জলে ক্রমাগত ঘাই মেরে চলেছে – এতে করে সামান্য দুলে উঠছে দিঘি। পরক্ষণেই ফিরে যাচ্ছে পূর্বের অবস্থায়। এই দিঘি যেন কতকালের বোবা-কালা-জন্মান্ধ।

উইন্যার মরশুম চলছে বলে এমন করুণ দশাপ্রাপ্ত – বাইস্যা এলেই টলটলা জল খলবলিয়ে উঠবে। করুণ-দিঘির পেটের কাছ ঘেঁষে চলে গেছে বিস্তৃত ধানক্ষেত – সরলরেখায় পৌঁছেছে দিগন্তের কাছাকাছি। কিষানের দল রবিশস্য তুলে নিয়ে গেছে ঘরে। মাঠ খাঁ খাঁ শূন্য। ফসলহীন ক্ষেতের সর্বত্র রিক্ত-নিঃস্ব-ভূলুণ্ঠিত অবস্থা। সব হারানোর গোপন হাহাকার। মাটি ফেটে চৌচির।

বাদলা নামলেই বদলে যাবে এ-দৃশ্য। বদলাতে শুরু করবে চারপাশ – সোমত্ত চেহারা ফিরে পাবে এই শূন্য-মাঠ। আউশ ধানের সতেজ গোছার ফাঁকে-ফাঁকে ছন্দ তুলে হেঁটে বেড়াবে বক আর পানকৌড়ি, ডাহুক আর কোড়াপাখির দল। মাছ শিকারের আশায় ঘন ঘন ঠোঁট ডুবিয়ে দেবে হাঁটুজলের ভেতর। চতুর দৃষ্টিতে তাকাতাকি করবে – ডানকানা কিংবা চাপিলার পোনা হাতছাড়া হয়ে গেল কি না?

শেফালির অনুসন্ধানী চোখ খুঁজে খুঁজে পাখিটাকে পেয়ে যায় – দেলদুয়ার আমগাছের মস্ত ডালে বসে আছে। এখন খরার কাল, ধানের ক্ষেত জনশূন্য – পোকামাকড় ছাড়া পেট ভরাবে কী দিয়ে পাখি?

মুকুলের মিষ্টি সৌরভে বাগানে উড়ে এসেছে ঝাঁকে-ঝাঁক কীটপতঙ্গ। কোড়াপাখির লোভী চোখের সামনে ওড়াউড়ি করছে মাছি, মৌমাছি, প্রজাপতি আর কাঠকিরার দঙ্গল।

কালো কুচকুচে কোড়ার মাথায় আলতা মাখানো ঝুঁটি – ধূসর-কমলা দুই ঠ্যাং দিয়ে আঁকড়ে ধরে আছে দেলদুয়ার আমগাছের ডাল।

দিন কয়েক পূর্বে কি এই পাখিটাকেই দেখেছিল শেফালি? তখনো এমন কুচকুচে কালো হয়ে ওঠে নাই, সে ছিল মাটির সঙ্গে মিশে থাকার মতন – গাঢ়-বাদামি। অথচ এখন আর সেই বাদামি বরণ নাই – এমনকি সত্যিই সে কোড়াপাখি কি না তাও বোঝার উপায় নাই। যেন এইমাত্রই সে কোনো আলকাতরার সমুদ্দুরে ডুব দিয়ে এসেছে – কালো রং গায়ে মেখে কী ভীষণ চকচক করছে!

শেফালির উদলা-শরীর ফ্রকের তলায় ঢাকা পড়লো। বালিকার বুকের ওপর ফ্রিল দেওয়া ফ্রক – ফ্রকের পর পা ঢাকার জন্য সালোয়ার। সালোয়ারকে ঢেকে রাখার জন্য কামিজ। অতঃপর কুঁড়ির মতো স্তনটিকে ঢেকে রাখার জন্য ওড়না।

গায়ে ওড়না জড়ানোর বহুদিন বাদে শেফালি জেনেছিল – কোড়াপাখি কখন নিজের পালকের রং বদলে ফেলে? জেনেছিল কেন সে মাটিরং ঝেড়ে ফেলে কালো-মোরগের মতো হয়ে ওঠে? তখন সে যেন কোনো কোড়াপাখি নয় – সোমত্ত একটা বনমোরগ। দেহের রং পাল্টে ফেলা মাত্রই যার স্বভাবও পাল্টে যায় – রকে-বসে-থাকা বখাটের মতো তখন পাখির রকমসকম। ভাবেসাবে বখাটেপনা – যেন সে শার্টের কলার তুলে, বোতাম খুলে নিজের জোয়ানকি প্রদর্শন করছে। টগবগে যুবক হয়ে ওঠা কোড়াপাখিটা তখন অচেনা, একেবারে অকুতোভয়। জোয়ান পাখি গলা উঁচু করে, বুক ফুলিয়ে ঘনঘন প্রণয়বার্তা নিবেদন করে যায়। অদেখা প্রেয়সীর কাছে পৌঁছে দিতে চায় প্রেমার্ত-সংগীত। আঁই-আঁই-আঁই শব্দে ডেকে ডেকে ক্লান্ত হয়ে পড়ে, কিন্তু  প্রেয়সীর দেখা মেলে না। দেহমনের সমস্ত শক্তি উজাড় করে বারংবার ডেকে চলে – ক্রমে বিষাদ তাকে পরাস্ত করে ফেলে। কই সে? কই গো তুমি? কতদূর তোমার বাস? কোথায় রয়েছ তুমি অদৃশ্য-প্রেয়সী আমার? অতঃপর দুঃখী হয়ে ওঠে পাখি দেহের রঙের মতো গলায় স্বরও বদলে ফেলে। যেন কতশত জনম ধরে অদৃশ্য এক প্রণয়িনীর জন্য সে কেঁদে ফিরছে –

ঢব-ঢব-ঢব-আহ্! ঢব-ঢব-ঢব-আহ্!

জলে, স্থলে, হাওয়ায়, গাছের পাতায় পাতায় ধ্বনিত হয় কোড়ার কান্না – করুণ এক আর্তি – ঢব-ঢব-ঢব-আহ্।

অ্যালকোহলের ঝাঁজালো নাকি ঝিমঝিমানো কী রকম

মৃদু-গন্ধে বাতাস ক্রমান্বয়ে ভারী হয়ে উঠলো – এক্ষুনি বুঝিবা থেমে যাবে, স্তব্ধ হয়ে পড়বে বাতাসের চলাচল। যেন এই শোবার ঘরের ভেতরই বৃত্তাকারে ঘুরবে-ফিরবে – কোথাও যাওয়ার তাড়া তার নাই। বাইরের বিশুদ্ধ বাতাসও শেফালির রুমে ঢুকতে পারবে না – এতটাই নিñিদ্র  নিরাপত্তা বাদল নিশ্চিত করে রেখেছে। এ যেন বেহুলার সেই লোহার-বাসর; কিন্তু এ-বাসরের পাহারাদার স্বয়ং লখিন্দর! দেবী মনসার সাধ্য কী এ ঘরে প্রবেশ করার?

সত্যিই তাই – রাত্রির বিমূর্ত প্রহরগুলিতে বাদল নিজেই দ্বাররক্ষকের মতো দাঁড়িয়ে থাকতো – তখন তুহিন-মাহিন কারোরই প্রবেশাধিকার নাই। তিন বা চার পেগ ঢালার পরপরই আবেগে ভারী হয়ে উঠতো বাদলের কণ্ঠ। জলপাত্রের ওপর জলতরঙ্গ বাজানোর মতো করে ধ্বনিত হতো শেফু-শেফু-শেফালিকা-শেফালি -।

ঢব-ঢব-ঢব-আহ্! ঢব-ঢব-ঢব-আহ্! শিকার ধরার আহ্বান। অথচ শিকার স্বেচ্ছায় এসে ধরা দিত বাদলের পেতে রাখা ফাঁদে। দুই বাহুর বেষ্টনীতে বন্দি পাখি চঞ্চুতে চঞ্চু ডুবিয়ে দিত। কোড়াপাখির প্রণয় সম্ভাষণ ততক্ষণে থেমে গেছে।

বাদলের কাছে ধরা দিয়ে শেফালি সুখী ছিল – যেন কানায় কানায় পূর্ণ হওয়া দাদাবাড়ির সেই প্রাচীন জলাধার – আম্রকাননের ছায়া যাকে আচ্ছাদিত করতে পারে না। মাছেদের আনন্দিত বিচরণে যার জলে ঢেউ ওঠে – গহিন জলে পুচ্ছ নাচিয়ে বাদল সন্তরণপটু হয়ে উঠতো – ক্ষণে ক্ষণে কেঁপে উঠে একেবারে শান্ত হয়ে যেত শেফালি। দেহের প্রতিটি লোমকূপের  শিহরণ জানান দিত – সে সুখী – সে সুখী – শেফালি সত্যি সুখী! শেষ জলবিন্দু নিংড়ে না-নেওয়িা পর্যন্ত বাদল ক্ষান্ত হতো না। ক্লান্তিও বোধ করতো না কোনোদিন!

একদিন ভোররাতের দিকে বাদলের চরম দুর্ব্যবহারে স্তম্ভিত শেফালি নিজের মুখোমুখি দাঁড়ালো। অন্ধকারের দিকে ক্রমাগত পতন থেকে ফিরতে ফিরতে ভয়ালভাবে চমকে উঠলো। শুধুমাত্র শরীরী আদিমতায় পরিপূর্ণ রাতগুলিই  কি জীবনের জন্য জরুরি? আর কোনো কিছুর প্রয়োজন নাই? আত্মসম্মা – – চাওয়া-পাওয়া – সামান্য স্বাধীনতা – এসবের প্রয়োজন নাই? দেহের বাইরে আর কিছুই কি ঠিক মূল্যবান নয়? যৌনতায় তুরীয় আনন্দলাভের ইচ্ছে থেকে নিজেকে সরিয়ে নিল শেফালি।

হাত ফসকে বরফখণ্ড গড়িয়ে পড়লো মোজাইকের মেঝেতে। বরফ চূর্ণবিচূর্ণ রাত্রির বাইরে বাদল ভিন্ন মানুষ। একেবারেই অচেনা এক চেহারা – তীব্র ক্রোধ নাকি ঘৃণায় রক্তবর্ণ হয়ে থাকা মুখ। শক্তভাবে চোয়াল এঁটে রাখা –

যেখানে স্নেহ-মায়া-মমতা-ত্যাগ-তিতিক্ষা-বাৎসল্য-দায়িত্ব-কর্তব্য – এমনকি সামান্য ভালোবাসার ছিটেফোঁটাও নাই। উগ্র ও বর্বর প্রকৃতির এক পুরুষ – যে রাতের বিষয়-আশয়ের বাইরে আর কোনো কিছুতেই কোমল হয়ে উঠতে জানে না।

বাদলকে ভয় পেতে শুরু করলো শেফালি। ঝড়ের কবলে পড়া পাখির ছানার মতো কেঁপে উঠতো ভয়ে।

কতদিন এমন হয়েছে – বেড়াতে যাবে বলে শাড়ি পরে, সাজগোজ করেছে – খুলে ফেলতে হয়েছে শাড়ি। আর সমস্ত প্রসাধন অশ্রুজলে ধুয়ে দিতে হয়েছে। ঠিক বেরোবার মুখে তালার চাবিটা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না – অথবা তুহিনের জামাটা বদলে দিতে বিলম্ব হচ্ছে – বাদল গালিগালাজের তুফান তুলেছে। কাচের তৈজপত্র ভেঙে চুরমার করেছে – ভাংচুরের শব্দে প্রতিবেশীরা দৌড়ে এসেছে। কলিংবেলের উপর্যুপরি ডিংডংয়ের সঙ্গে কাচ ভাঙার শব্দ মিশে একাকার হয়েছে।

মায়ের জরায়ুতে জন্ম নেওয়া এই দেহ – মানবী অবয়বে এই পৃথিবী পেয়েছে শেফালিকে – বেঁচে থাকা মানে শুধুই যৌবন? পরিতৃপ্ত যৌনতার মিশকালো-রাত্তির? না, এভাবে হয় না। এভাবে কাটানো যায় না জীবন – শেফালি জেনেছে। নিজের জীবন তিল-তিল-করে ক্ষয় করে জেনেছে।

আত্মমর্যাদার প্রশ্নে শুধুমাত্র শরীর মন্থনের কানাকড়ি মূল্যও ওর কাছে নাই – দেড়-দুই ঘণ্টার পরিপূর্ণ ও উদ্দাম-যৌনতার জন্য সমস্ত পৃথিবী আঁধারে ঢেকে দেওয়া যায় না। উন্মুক্ত আকাশে অবিশ্রাম উড়ে চলার অভিলাষী পাখির ডানা দুটি কেটে দেওয়া ভারি অন্যায়। শুধু জান্তব দেহমিলনের জন্য যাবতীয় অপমান সহ্য করে যাওয়াও ভয়ংকর অন্যায়।

জান্তব -? নয়তো কী? শুধুমাত্র আদিমতা, শুধুই তাড়নায় একে অপরের কাছে আসা – পোণ, মর্দন, উপগত, অধগত – এসবই বুঝি জীবন? শুধুমাত্র যৌনতৃপ্তির জন্য নিরন্তর অপমান-অবজ্ঞা-গালিগালাজ মেনে নেওয়ার নামই দাম্পত্য? অন্ধকার দিন আর রাত। রাত আর দিনের মাঝে বসে শেফালি দাম্পত্যের সংজ্ঞা খুঁজে ফেরে।

সংসারের শুরুতে বাদলের সঙ্গে শেফালির এরকম হিসাবনিকাশের সম্পর্ক ছিল না। অন্য পাঁচটা-দশটা নারীর মতোই স্বামীকে, সন্তানকে, নিজের ঘরটিকেই সর্বান্তঃকরণে ভালোবেসেছিল সে-ও। দুজনের পছন্দের বিয়ে – সুদর্শন বাদলের প্রেমে মজে ছিল শেফালি। সেই অন্ধত্ব ফিকে হয়ে উঠলো! গৌরবর্ণ-ছয় ফুট লম্বা-নির্মেদ শরীরের অধিকারী বাদল প্রেমিক নয়, বন্ধু নয়, স্বজন নয় – প্রভু। স্রেফ প্রভু! যে প্রভু কর্তৃত্ব ছাড়া আর কোনোভাবেই নিজেকে উপস্থাপন করতে জানে না।

শেফালি মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেছিল। দাঁতে দাঁত চেপে সব সহ্য করতে শিখে গিয়েছিল – প্রথম সন্তান তুহিন জন্মালো। শেফালির মনে ক্ষীণ আশা – বাদল এবার নিজের ভুল বুঝতে পারবে। হয়তো শুধরে নেবে নিজেকে।

বাদলের গতিবিধি লক্ষ করা বা সন্দেহ করে চোখে চোখে রাখার মতো মনোভাব শেফালির ছিল না। সে তখন মাস্টার্স শেষ বর্ষের ছাত্রী – নিজের পড়াশোনা আর ছোট্ট তুহিনকে নিয়ে ছকে-বাঁধা-জীবন। ছকে বাঁধা হলেই জীবন সহজ হয়, এমন নয়। দ্বিতীয় সন্তান মাহিন গর্ভে – শেফালি আর একা একা পেরে উঠছিল না। বড়ভাই জুবায়েরের মেয়ে চম্পাকে নিয়ে এলো নিজের কাছে। চম্পা – যার পড়াশোনায় একেবারে মতি নাই – ছোট চামেলির তখনো জন্ম হয় নাই।

নিজের সঙ্গে নিজের বোঝাপড়াটাও শেফালি তখনই করতে পেরেছিল – চম্পাকে ঢাকায় নিয়ে আসার পর। দাম্পত্যের প্রতিটা দিনরাত্রির পরতে পরতে অপমান আর বেদনা লুক্কায়িত থাকে – কত শত অনাহূত ঘটনা-দৃশ্য – হাত ফসকে মেঝেতে পড়ে যাওয়া বরফখণ্ডের মতো চূর্ণবিচূর্ণ করে দেয় জীবনকে।

৬.

কবিতা পড়তে পড়তে শব্দ-বিভ্রম উধাও হয়ে যায়। সত্যি সত্যিই গতরাতের সমস্ত কিছুই বিস্মৃত হয় মুমু। কবিতা তো দেখছি মারাত্মক অস্ত্র – মুহূর্তে অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যৎ সবই একাকার করে দিতে পারে। হয়তো এরকম ভাবে সে – কিংবা ভাবে না। ক্রমাগত জল পতনের শব্দ – শব্দ-উৎস – ঝুলন্ত চাইমের বাজনা – রিলাক্সেশন-মিউজিক – আশ্চর্য! এখন কোনো কিছুরই অস্তিত্ব নাই। আছে শুধুমাত্র থই-থই নীরবতা। সমস্ত নীরবতা জড়ো হয়ে ঢুকে পড়ছে মোবাইলের স্ক্রিনে। মুমুর ডান হাত আলগোছে ধরে রেখেছে সজল আহমদের কবিতা –

তোমাকে বলি বৃথাই তুমি বিরাগ বুকে রাখো/ আমাকে আজ ফেরাবে কিসে, কেমন করে বলো?/ যেখানে যাও আমার প্রেম দুঃখ দিনের মতো/ আমাকে ফেলে কোথায় তুমি যাবে?/

সজলের কবিতার প্রতিটা শব্দ উজ্জ্বল আলোর মাঝে গতিশীল হয়ে আছে। যেন কোন দূর-সুদূর মহাসমুদ্র থেকে ভেসে ভেসে আসছে –

আমাকে আজ ফেরাবে কিসে, কেমন করে বলো?/ যেখানে যাও আমার প্রেম দুঃখ দিনের মতো/

মুমু খানিক থমকায় – এই যে কবিতার ঢেউ, দূর কোনো সমুদ্দুর থেকে ভেসে আসা পঙ্ক্তিমালার জন্য মুমুর দুর্মর আকুতি। এসবের জন্যই কি সে ওর সঙ্গে এভাবে আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা? কে জানে।

ঢ্যাঙা, একহারা গড়নের সজল আহমদ – বড় বড় আঁখিদ্বয়ের অধিকারী সজল আহমদ – কবিতা-পাগল – মুমুর ওকে ভালো লাগে। হয়তো সে ভালোও বাসে সজলকে। ভালোবাসা মানে যদি হয় যত্ন-নিবেদন – এসব ওদের আছে। না-ই যদি থাকবে তাহলে দীর্ঘ পাঁচ-বছর একটা সম্পর্ককে গড়িয়ে নেওয়া যায় না। গড়িয়ে নেওয়া প্রায় অসম্ভবও বটে। এ-কথা তো সত্য – এই দীর্ঘ সময়ে দুইজনের কোনোকিছুই  একে অন্যের কাছে ক্লান্তিকর হয়ে ওঠে নাই। লম্বা সময় ধরে যৌথযাপনে একে অন্যের কাছে আজ আর কোনো আড়াল-আবডাল নাই। ওরা দুইজন তা রাখতেও চায় নাই। যে যার মতো স্বাধীন ও পৃথকভাবে বসবাস করেও কোথায় যেন একটা একাত্মতা অনুভব করে। অদৃশ্য এক সুতোতে যেন গাঁথা রয়েছে দুজন। সামান্য হেলদোল হলেই সেই সুতোর কোথায় যেন তীব্র টান পড়ে – টান রয়ে যায়। এইরকম ‘ওপেন-রিলেশনশিপের’ ভেতরে থেকেও ওই ‘টান’ দুইজনই দেখতে পায়। অবশ্য এই ‘টান’ কাঁটার মতো খচখচ করে বিঁধে কি না – এ নিয়ে কেউ-ই কোনোদিন কথা বলে নাই। কোনো কথা না বলেও একটা সম্পর্কে নিবিড় থাকতে হয় – হয়তো দুজনই তা মেনে চলে।

মুমুর এই ফ্ল্যাটে সজল আহমদের অনায়াস যাতায়াত। সপ্তাহের পাঁচদিনই দুইজন দৌড়ায় রুটি-রুজির তাগিদে। অফিস ছুটির দিনগুলিতে দুইজন বসে থাকে মুখামুখি। তখন ফ্ল্যাটের বিছানা-বালিশ-চাদর-সোফা-শতরঞ্জি প্রগাঢ় প্রেম নাকি কাম ও ঘাম কিংবা আলস্যে মাখামাখি হয়ে ওঠে।

ভোরের তরতাজা কবিতার ঠিক ওপরেই টুলকির টেক্সট –

‘কখন যাবি?’

এরকম উদ্ভট জিজ্ঞাসার মানে কী? সদ্য ঘুম ভেঙে জেগে ওঠা মুমুর দৃষ্টি ঘোরগ্রস্ত হয়ে আছে কবিতার লাইনে – ঘোর অতিক্রম করে সে ঠিক বুঝতে পারে না – আজ তার কোথায় যাওয়ার কথা? কোথায় এবং কেনই-বা যাবে সে? টুলকি কোথায় যেতে বলছে তাকে? মেয়েটার কি এই সাতসকালেই মাথাটাথা আউলা হয়ে গেল? নইলে এরকম তাগিদ কেন –

‘কখন যাবি?’

টুলকির ‘কখন যাবি’ টেক্সটের ওপর একবিন্দু সবুজ-আলো – দূরতর কোনো দ্বীপের মতো জেগে আছে – অর্থাৎ টুলকি এখন অনলাইনে। কিন্তু টুলকির দূরতর-দ্বীপ হয়ে থাকাতে সমাধান কিছু হয় না। মুমুর স্মৃতি ‘কখন যাবির’ আগাপাশতলা কোনোকিছুই খুঁজে পায় না। অনেকটা আন্দাজে ঢিল ছুড়ে দেওয়ার মতো করে সে রিপ্লাই সেন্ড করে –

‘কই যেতে চাস?’

প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই টুলকির টেক্সট আসে –

‘আজব! ভুলে গেছিস?’

মুমু লেখে –

‘হুম, মনে হয়।’

এরপর সে একটা গালে হাত দেওয়া ভাবনাগ্রস্ত মুখের ইমোজি সেন্ড করে।

‘তোর মাথাটা ওই কবির পাল্লায় পড়ে একেবারেই গেছে? ভুললি কীভাবে? আজ না বাবুর হাটে যাবি?’

এতক্ষণ পর মুমু যেন ঘুমের রেশ কাটাতে পারে। টুলকিকে নিয়ে ওর আজ টাঙ্গাইল যাওয়ার কথা। করটিয়ার বাবুর হাট থেকে টাঙ্গাইল শাড়ি কিনে আনার কথা।

মাথাটা সত্যিই গেছে – বেমালুম সবই ভুলে বসে আছে মুমু!

কোভিড-১৯-এর মহামারি শুরু হওয়ার পরপরই সব জায়গায় বিধিনিষেধ শুরু হলো। অফিস-আদালত-স্কুল-কলেজ-ভার্সিটি – সবখানেই কঠোর স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার নির্দেশ। বাংলাদেশ সরকার কড়া নজরদারি শুরু করলো মহামারি ঠেকাতে। সে এক ভয়াবহ অবস্থা। ওই বিধিনিষেধ জারির পরপরই সাইকোথেরাপিস্ট হিসেবে অনলাইনে ক্লাস নিতে শুরু করেছিল মুমু। প্রথম দুই-তিনটা সেশন ও ফ্রি করিয়েছে। পরে আর কুলাতে না-পেরে নামমাত্র টাকায় সেশনগুলি করাতো। কিন্তু এতে করে চলা দুষ্কর হয়ে উঠলে অনলাইনে শাড়ির বিজনেস শুরু করলো। নানারকম দেশি শাড়ির সম্ভার নিয়ে মুমুর ‘ধরিত্রী’। পাথরাইল বা বাবুর হাট থেকে শাড়ি কিনে এনে অনলাইনে ক্রেতাদের কাছে বিক্রি করা। পরে নিজেই হয়ে উঠলো ডিজাইনার। কোন রঙের সঙ্গে কোন রঙের বনিবনা বেশি হবে, কোন পাড়ে নতুন করে কী কী সুতার বুনন দেওয়া যায় – সারাদিন এসব ভাবনায় মশগুল। টুলকির আগ্রহ থাকাতে ওকেও পার্টনার করে নেয় সে।

মুমুর আজ টুলকিকে নিয়ে শাড়ি কিনতে যাওয়ার কথা।

প্রায় দুশো বছরের পুরনো ও বৃহৎ এই করটিয়ার হাট। সারাদেশ থেকেই ব্যবসায়ী ও পাইকাররা কাপড় বেচাকেনার উদ্দেশ্যে এই হাটে আসে।

মঙ্গল ও বুধবার – সপ্তাহের এই দুইদিন হাট বসে। মঙ্গলবার বিকেল থেকে শুরু হওয়া হাটে বুধবার বিকেল পর্যন্ত চলে পাইকারদের বিক্রিবাট্টা। আর খুচরা বেচাকেনা হয় শুধুমাত্র বৃহস্পতিবার।

মুমু বাবুর হাটে যায় বুধবার। দিনে গিয়ে দিনেই ফিরে আসে। আজ কী বার? আজকেই যাবে এমন কিছু কি সে টুলকিকে বলেছিল?

মোবাইলের স্ক্রিন স্ক্রল করে ক্যালেন্ডার দেখে মুমু – আজ মঙ্গলবার। ধুর – মঙ্গলবারে তো সে যাবে না। হাট বসেই মঙ্গলবার বিকেল থেকে। ফিরে আসাটা ঝক্কির হয়ে যাবে।

মঙ্গলবার সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসার আগেভাগেই শাড়ির স্তূপ নিয়ে বসে পড়ে ব্যবসায়ীরা। কিন্তু বসলেই কী? প্রকৃত হাট জমে উঠতে মাঝরাত্তির গড়ায়। অত রাতে ফিরে আসার কায়দা

থাকলেও মুমুর অস্বস্তি হয়। অন্ধকারকে বড় ভয় পায় মুমু। দিনের আলো নিভে গেলেই ও অকারণেই কুঁকড়ে ওঠে। মুমুর মনে হয়, রাতের অন্ধকারে ভাঁজে ভাঁজে হিংস্র জন্তুরা ফাঁদ পেতে বসে থাকে। শিকারকে মওকা মতো পেয়ে গেলে শুরু হয়ে যায় কালো আঁধারের মচ্ছব।

রাত্রি যেন লুকিয়ে থাকা বিরাটকায় কোনো ডাইনোসর – বিশাল হাঁ করে বড়সড়ো দাঁতগুলি বের করে রাখে – যা ওর ভুখা অবস্থার কথা জানান দিতে থাকে। নাগালের ভেতর কাউকে পেলে ঝাঁপিয়ে পড়ে তার ওপর। রাত্রির অন্ধকার মানেই মুমুর কাছে কড়মড়িয়ে হাড়গোড় খাওয়ার শব্দ। ফলত রাতের অন্ধকারের কাছে নিজেকে সমর্পণ করতে চায় না সে।

কিন্তু কবি সজল আহমদ অন্ধকারের যাত্রী। অন্ধকার ছেনেছুনে মন্থন করতে সে আসে মুমুর কাছে। ঘোরঘুট্টি আঁধারে  হামাগুড়ি দিয়ে আসে। যেন সে কোনো লোমশ-জন্তু। রাতের যত কালো আর নিজর্নতা শরীরে মেখে গুহা থেকে বের হয়ে ক্ষিপ্রগতিতে।

অথচ মুমু রাতকে ভয় পায়। অন্ধকারের বিশাল পারাবারে হাবুডুবু খায় সে। কূল নাই, কিনার নাই – এরকম দশা হয় মুমুর। অথচ সজল আহমদ একেবারে ভাবলেশহীন। ঠোঁটের সিগারেটে আগুন জ¦ালিয়ে ডায়েরি খুলে কবিতা পড়তে শুরু করে।

এরকম সঘন কালো-রাত্তির আসার পূর্বে বিকেল থেকেই ছুটি পেয়ে যায় কাজের বুয়া। বেজে ওঠা কবিতার জলতরঙ্গের মাঝে হতবিহ্বল মুমু। সিকি-আধুলির মতো বিছিয়ে থাকা অন্ধকার সঙ্গী করে ফুটন্ত গরম জলে গ্রিনটির লিফ ফেলে দেয়। উতরানো জল পলকেই হলুদাভ বর্ণ ধারণ করে।

টুলকি একটা হালকা হলুদ রঙের হার্টের ইমোজি সেন্ড করেছে। অর্থাৎ মুমুর জবাবের প্রতীক্ষায় আছে সে।

মঙ্গলবার – উঁহু কিছুতেই  নয়।

হয়তো ক্যালেন্ডারের বার-তারিখ না-দেখেই টুলকিকে শিডিউল দিয়েছিল মুমু।

ঢাকা থেকে টাঙ্গাইল – দুই-তিন ঘণ্টার জার্নি; কিন্তু গিয়ে কী হবে? দিনের আলো বিপন্ন না হওয়া পর্যন্ত বাবুর হাট বসবে না। সাঁঝবাতি না জে¦লে ওই হাট কখনো জমে ওঠে না।

এই সাতসকালে এতসব পঁ্যাঁচালে যাওয়ার আগ্রহ পায় না মুমু। টুলকিকে শর্টকাট উত্তর পাঠায় –

‘আজ না, আগামীকাল।’

‘আগামীকাল? কেন?’

মুমু মনে মনে বলে –

‘তুই কি জানিস না বাবুর হাটের নিয়মকানুন?’

কিন্তু লিখে পাঠায় –

‘আগামীকাল সকাল আটটায়।’

‘আচ্ছা আমি বাসস্ট্যান্ডে, পৌঁছায়া যাব।’

‘ওকে। দেখা হচ্ছে তবে।’

‘ওকে।’

মুমু একটা সবুজরঙা হার্টের ইমোজি পাঠায় টুলকিকে। সজলের পছন্দের রং সবুজ।

এ-বাসায় ওয়াশরুমের দরোজা বন্ধ করার দরকার হয় না – ধু ধু ফ্ল্যাটে মুমু ছাড়া কোনো মানুষ নাই। ছুটাবুয়া ডোরবেল বাজাবে আরো ঘণ্টা দেড়েক পর।

ঘরের দেয়ালে ঠেস দিয়ে রাখা ইয়োগা ম্যাটটা ফ্লোরের ওপর বিছিয়ে দেয় মুমু। পরনের নাইটিটা খুলে ফেলবে সে এখন। স্পোর্টস-ব্রা পরে পদ্মাসনে বসবে। ডিপ-ব্রিফিং এক্সারসাইজ দিয়ে শুরু করবে নতুন একটা দিন।

৭.

বড় কোনো মাঠ পার হতে গিয়ে পথ হারানো বালিকার মতো উ™£ান্ত দৃষ্টি বকুলের। মাঠে যেন কোনো গাছ নাই, ঘাস নাই, ছায়া নাই – সামান্যতম সবুজের চিহ্নমাত্র নাই। খরখরে বাদামি মাটি – সমতল হতে হতে কোথায় যেন মিলিয়ে গেছে। যে-মাঠে জলের স্পর্শও নাই বহুকাল ধরে। মাটি ক্রমে ধুলা থেকে ধুলাকার হয়ে উঠেছে।

এরই মাঝে ঘনিয়ে এসেছে বাতাস আর এলোপাতাড়ি ছুটতে শুরু করেছে। বাতাসের দুরন্ত-ঘূর্ণি উড়িয়ে আনছে শুকনো-পাতার-দল। বাওকুড়ানির খপ্পরে পড়ে বিভ্রান্ত বকুল। মাঠের এই প্রান্ত থেকে ওই প্রান্ত পর্যন্ত ওর ছুটে যাওয়া সারা; কিন্তু কিছুতেই খুঁজে পাচ্ছে না পথের হদিস। ঘূর্ণি হাওয়া আর পথবিভ্রাটের গোলকধাঁধায় পড়ে করুণ দশাপ্রান্ত বালিকা – ততোধিক করুণ চেহারা করে বসে আছে। তাও ঘণ্টা দেড়েক তো হবেই। মিরপুর দশ নাম্বারের গোলচক্করের জ্যামে একবার যারা পড়েছে তারা জানে অবস্থাটা এরকম। ঠিক এরকমই। এইখানে যানজট লেগে যাওয়ার কোনো সময়-অসময় নাই। উত্তর থেকে দক্ষিণ – পশ্চিম থেকে পুবের  দিকে অগণন যানবাহন। ফের উল্টা রুটেও একইভাবে গতিশীল হয়ে ওঠে ওরা। হাজারেবিজারে বাস, কার, টেম্পো, রিকশা, ভ্যান, মোটর সাইকেল – সবই এখন স্থির। স্থির রিকশায় হুড তুলে বসে আছে বকুল। আর খানিক বাদে বাদে কচ্ছপের মতো গলা বের করছে। দেখার চেষ্টা করছে কোনো রাস্তা নড়ে উঠলো কি না? নাহ – গলা বাড়িয়ে বা কমিয়ে কোনো কিছু করেই লাভ নাই। ডান-বাঁ-সম্মুখ-পেছন সমস্ত কিছুই অচল। যেন বিশাল কোনো ক্যানভাসে অতি যত্নে তেলরঙে কেউ এঁকে রেখেছে যানবাহনের ছবি। রংবেরঙের গাড়ি – কত রকমের আকার আকৃতি ওদের – কিন্তু নড়াচড়া নাই। এমনকি পিঁপড়ার সারির মতো ক্ষীণ গতিতেও চলাচল করতে পারছে না। অথচ ভোর-ভোর ঘুম থেকে উঠে কীরকম রুদ্ধশ^াস দৌড়টাই না দিয়েছিল বকুল। হুড়াহুড়ি করে গোছলআছল সেরে কোনোমতে শাড়িটা পরেছিল। অবশ্য বেছে বেছে নিজের সবচাইতে পছন্দের শাড়িটাই পরেছে। কোরা রঙের মাঝে সরু লালপেড়ে তাঁতের শাড়ি। পাড়ের কিনার ঘেঁষে সোনালি জরির বর্ডার। জমিন জুড়ে তারার মতো ছোট ছোট বুটি। বুটিগুলিও সোনালি জরিতে উদ্ভাসিত। যেন দিনের আলোর মাঝে তারকারাজি নিজেদের অস্তিত্ব ঘোষণার জন্য লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে প্রাণপণ।

বকুলের আজ চাকরির ইন্টারভিউ। ‘দৈনিক বিভাবসু’ পত্রিকায় ইন্টারভিউ দিতে গেলে অরুচিকর জামাকাপড় পরলে হয় নাকি? প্রচারের শীর্ষে থাকা একটা পত্রিকা, যার সার্কুলেশন প্রায় পাঁচ লাখের ওপরে – এরকম বড় হাউজে কাজ পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। যদিও পোস্টটা সাব-এডিটরের। তা হোক – বেতনের অঙ্কটা তো রীতিমতো লোভনীয়। সাড়ে বারোটা বাজতে চলল নাকি? বকুলের এখন সময় দেখতেও ভয় করছে। ‘দৈনিক বিভাবসু’তে পৌঁছানোর পূর্ব পর্যন্ত কিছুতেই ঘড়ি দেখবে না ও।

নির্দিষ্ট সময়ের পূর্বে পৌঁছানোর জন্য আপ্রাণ চেষ্টা ছিল  বকুলের; কিন্তু বিধি বাম!

‘নিবেদিকা কর্মজীবী মহিলা হোস্টেল’ থেকে বেরোবার মুখে দুই-দুইবার শাড়ি পেঁচিয়ে গিয়েছিল পায়ে – তখুনি মন

কু-ডাক ডেকেছে। আজ অঘটন কিছু না হয়েই যায় না। পড়তে পড়তে নিজেকে সামলে ছুট লাগিয়েছে বকুল। গেটকিপার সাদ্দাম দুই চোখ কপালে তুলে অবাক হয়ে প্রশ্ন করেছে –

‘আফা, আইজ এমুন হুড়াতাড়া কইরা কই যাইতাছুন?’

সাদ্দামের গায়ে-পড়া আচরণে বিরক্ত বকুল – কিন্তু মুখে সেটা প্রকাশ করে নাই। কিন্তু মনে মনে গালাগাল করেছে –

‘বেয়াদব বেটা – তোর কীসের দরকার আমি কই যাই, বা না যাই?’

মনে মনে দেওয়া গালি সাদ্দামের কানে যাবে না – সে তো বলাই বাহুল্য। ফলত সে আরেকটু আগ্রহ দেখিয়েছে। কেয়ারিং অভিভাবকের ভূমিকা পালন করতে চেয়েছে –

‘আফা, রিসকা ডাইকা আনমু?’

বকুল রাগে জ¦লে উঠেছে –

‘তগো সবখানেই গার্ডিয়ান সাজতে মন চায়?’

এসব কথা বলার মতো টাইম বকুলের নাই। থাকলেও ছোটলোকদের আশকারা দেবে না ও কিছুতেই। মুখে ভোলাভালা হাসি ফুটিয়ে বলেছে

‘না, না, সাদ্দামভাই – আমি নিয়ে নেব রিকশা।’

তারপর থেকেই ও রিকশায়। যুবক রিকশাওয়ালার গতি ছিল পঙ্খিরাজ ঘোড়ার মতোই। কিন্তু সেই পঙ্খিরাজের অবস্থা এখন কেরোসিন। পা ভেঙে, ডানা দুটিও কাটা পড়ে গেছে। এক্ষণে পঙ্খিরাজ কি না শোচনীয় দশাপ্রাপ্ত হয়ে মুখ থুবড়ে পড়ে আছে উত্তর দিকের রাস্তায়।

স্টিল, টিন, লোহালক্কড় আর খোলসে যন্ত্রপাতি নিয়ে অনড় গাড়িবহর – সূর্যের সমস্ত উত্তাপ শুষে নিয়ে ফের যেন উগড়ে দিচ্ছে। ফলে বাতাস উষ্ণ ও অসহিষ্ণু। কিছুক্ষণ বাদে বাদে বাতাস দুলে উঠলে প্রকট হয়ে উঠছে গরম। রিকশার হুডের আচ্ছাদনে থেকেও উসখুস করছে বকুল – এত গরমে ওর প্রসাধনচর্চিত মুখখানি খানিক বাদেই কিম্ভুতকিমাকার হয়ে উঠবে। আর ফিরে যেতে চাইবে আদিরূপে।

ব্যাগ থেকে মোবাইল ফোনটা বের করে সময় এখন সত্যিই কত – সেটা জানা বা দেখারও সাহস হয় না ওর। যদি দেখে এগারোটা বেজে গেছে r শুরু হয়ে যাবে অস্থিরতা – বুক ধড়ফড়ানি। বহুকিছুতেই অন্ধ সেজে থাকা উত্তম – বকুল এমন ভাবে। ফলে সে ঘড়ি দেখে না – দেখার ইচ্ছাও ওর জাগে না। বকুল ভাবে – ‘ঘড়ি’ নামক কোনো সময় নিরূপণ যন্ত্র এই পৃথিবীতে নাই।

‘সময়’ নামক বিরাটকায় কোনো রাক্ষস এই পৃথিবীকে কখনোই গিলে খেতে পারবে না। বরং বকুল এতক্ষণে নিজের চারপাশটা ভালো করে দেখে নিক।

ওর রিকশার সম্মুখেই একটা লেগুনা – খাঁচায় পুরে রাখা মুরগির মতো যাত্রী বোঝাই হয়ে থেমে আছে। লেগুনার হেলপার ছোকরা ধরনের। এক পা শূন্যে তুলে অন্য পায়ে পাদানিতে ভর করে দাঁড়িয়ে রয়েছে। যাত্রী ঠাসা প্রায়ান্ধকার লেগুনার ভেতরের কারো মুখাবয়ব বোঝার উপায় নাই। কিন্তু বিশ-জোড়া চক্ষু যে বকুলকেই দেখছে – তা ওই না-আলো, না-অন্ধকারের পর্দা না উঠিয়েও অনুমান করা যায়। চ্যাংড়া হেলপার প্রায়ই লেগুনার ছাদের ওপর দিয়ে উঁকিঝুঁকি মেরে সামনে দেখার চেষ্টা চালাচ্ছে – কোনদিকে হেলে পড়েছে ট্রাফিক পুলিশের হাতের লাঠি? অথবা কোনো লেনের গাড়ি নড়ে উঠলো কি না?

বকুল হয়তো দেখছে সবই – কিন্তু কিছুই ওর মনে ছাপ ফেলতে পারছে না – যেন সে কোনো কাগজের নৌকা! ভাবলেশহীন জলের ওপর ভেসে যেতে চাইছে – দাড়ি নাই – হাল নাই – মাঝিমাল্লা কিচ্ছু নাই। বরং ডুবে যাওয়ার শতভাগ সম্ভাবনা নিয়েও যে ভাসার কথাই ভেবে চলেছে। ভেসে যাওয়ার কথা না ভেবে  উপায়ই-বা কী? আজকের ইন্টারভিউ মিস হয়ে গেলে চাকরিটা হবে না। এখন যে পত্রিকায় কাজ করছে – নামমাত্র বেতন – কোনোমতে নিজে চলা যায়।

‘দৈনিক বিভাবসু’র চাকরিটা বকুলের দরকার। পত্রিকার সহকারী সম্পাদক আল মোসাদ্দেক পইপই করে বলে দিয়েছে –

‘এই যে বকুল – ঠিক সময়ে উপস্থিত থেকো। টাইমটা কিন্তু বড় ফ্যাক্টর।’

‘আচ্ছা, আচ্ছা – মোসাদ্দেক ভাই – আমি টাইমের আগেই হাজির হয়ে যাব।’

‘বোর্ডকে আমি বলে রেখেছি – সো নার্ভাস হওয়ার কিছু নাই।’

‘থ্যাঙ্ক ইউ মোসাদ্দেক ভাই।’

কিন্তু এখন? এই বিশ্রী জ্যামে ধরা খাওয়া বকুল এখন কী করবে? রাগে-দুঃখে নিজের মাথার চুল উপড়াতে ইচ্ছে করছে। বড়ই আজব এই ঢাকা শহর! নামে রাজধানী – ঝকমকে আলো – মসৃণ রাস্তাঘাট – দালানকোঠার ওজনে মাটি দেবে যাওয়ার উপক্রম। আর জ্যামে আটকে থাকা ঘণ্টার পর ঘণ্টা।

এই শহরটা আদতে বিষে বিষে পূর্ণ হয়ে গেছে প্রতিদিন রাস্তায় নামছে হাজারেবিজারে নতুন গাড়ি। আর চলছে প্রতিযোগিতা – কে কার চাইতে কত ওপরে উঠবে।

উপায় থাকলে এই শহর ছেড়ে পালিয়ে যেতো বকুল। এখনো পালাতে পারে – কিন্তু পালিয়ে যাবে কই সে? যদি যায়ও কোথাও – বকুল খাবে কী? থাকবে কোথায়?

দিগন্তরেখার মতো সোজা হয়ে থাকা চারদিকের রাস্তাগুলি দেড় ঘণ্টা যাবত অচল। কিন্তু সবাই কেমন নির্বিকার। প্রতিদিনের এসব ভোগান্তি সকলেরই সহনীয় হয়ে গেছে। আর যেদিন ভিআইপি মুভমেন্ট হয়, সেদিন তো কথাই নাই। পাহাড়ের মতো স্থির হয়ে থাকা যানজটে পড়ে শখানেক লোক মারা গেলেও কোনো রাস্তাই নড়ে উঠবে না।

বকুলের রিকশার পেছনে একটা অ্যাম্বুলেন্স খানিক বাদে বাদেই ভোঁ ভোঁ করে  কেঁদে যাচ্ছে – কেউ গ্রাহ্যই করছে না। ভেতরের রোগী বেঁচে আছে না মরে গেছে, তা সৃষ্টিকর্তাই জানেন।

আচ্ছা, এই দেশে কি কোনোদিন সিরিয়াস রোগী নিয়ে যাওয়ার জন্য আলাদা রাস্তা হবে?

এরকম শত-সহস্র ভাবনায় বকুলের মুখে বিন্দু-বিন্দু-ঘাম জমে উঠেছে। হ্যান্ডব্যাগ থেকে টিস্যু পেপার বের করে চেপে চেপে ঘাম মুছতে শুরু করে ও।

কী অসহনীয় অবস্থা – বোর্ড ফেস করার পূর্বে নিজেকে সামান্য গুছিয়ে নেওয়ারও সময় পাবে না হয়তো।

আল মোসাদ্দেক – বয়স ষাট পেরিয়েছে। কিন্তু বয়সের তুলনায় তরুণ দেখায় তাকে। টকটকে গৌরবর্ণ। কপালের দুই পাশের চুলগুলি কালো আর রুপালিতে আভিজাত্য বাড়িয়েছে। কালো মোটা ফ্রেমের চশমাতে ঢাকা আঁখিযুগল। ফলত বোঝার উপায় নাই – কেমন মানুষ সে? পাঞ্জাবির আড়াল ভেদ করে শক্তপোক্ত শরীর তারুণ্যের ইঙ্গিত দেয়।

গত পাঁচ-ছয় বছরে কমসে কম দুই-তিনটা চাকরি বদল করেছে বকুল। ‘দৈনিক রূপসা’র রিপোর্টার থেকে আজ যাচ্ছে  ‘দৈনিক বিভাবসু’তে ইন্টারভিউ দিতে।

সহসা রাস্তাটা যেন দুলে ওঠে – মৃদু ভূমিকম্প হলে যেমন – ঠিক তেমনিভাবে দুলে ওঠা। ইন্টারভিউয়ের চিন্তায় প্রায় আধমরা হয়ে থাকা বকুল হঠাৎ হকচকিয়ে যায় – অসময়ে ভূমিকম্প! থেমে থাকা গাড়ির বহর পিঁপড়ার সারির মতো চলতে শুরু করেছে। বকুল দেখে – বহু দূরে বিন্দুর মতো একটা সবুজ আলো জ¦লছে। দিবসের ঝলমলে আলোর তীব্রতায় ওই একবিন্দু সবুজকে দেখায় কোনো কুহকিনীর মতো। আছে কিংবা নেই-এর বিভ্রমে জ¦লছে। অথচ অগণন যানবাহন ছুটে চলছে ওই কুহকিনীর অদৃশ্য হাতছানিতে।

৮.

ভেজাবালি জড়ো করে দুরন্ত কোনো বালক বেলাভূমিতে একটা ঢিবি বানিয়েছে। ঢিবিটা বানিয়ে রেখেই কোথায় যেন চম্পট দিয়েছে সে। দুই চোখে রাজ্যের বিস্ময় নিয়ে সেই ঢিবির দিকে তাকিয়ে থাকে শেফালি। একদার সমতল পেট স্ফীত হয়ে এখন ঢালের দিকে গড়িয়ে গেছে অনায়াসে। ফুলে ওঠা পেটের ওপর আলগোছে হাত বুলায় – ত্বক কী রকম আর্দ্র! স্যাঁতসেঁতে। – যেন বহুকাল ধরে শ্যাওলা জমে আছে এখানে।

কালচে-শ্যাওলার ওপর নানান রঙের আঁকিবুঁকি। রঙের চৌবাচ্চায় সরু তুলি চুবিয়ে কোনো অন্ধ ছবিকর একের পর এক পোচ দিয়ে গেছে। এতে করে সৃষ্টি হয়েছে বিমূর্ত শিল্প। আদতে লাল-কালো-সাদার মিশেলে হিবিজিবি বিদ্ঘুটে রেখা।

তুহিন জন্মানোর আগে কী অপরূপ শ্রী-ই না ছিল শেফালির পেটের। ঘিয়েরঙা মাখনের মতো মোলায়েম ছিল ত্বক। কনকচাঁপার পাপড়ির মতো নাজুক ও উজ্জ্বল শোভায় পরিবৃত। শাড়ির দুই-পাল্লা ভেদ করে ওই স্বর্ণাভা ঠিকরে বেরোতো।

তুহিন গর্ভে আসার পাঁচ-ছয় মাসের মাথায় দাগগুলি পড়তে শুরু করলো। অন্ধ-শিল্পীর ক্ষিপ্র হাতে তুলির আঁচড়! করুণ নয়নে তাকিয়ে দেখলো শেফালি – সাদা-লাল-কালোর বিস্তর রেখা মুছে ফেলা ছিল ওর আয়ত্তের বাইরে।

শ্রীহীন, ভয়ানক কুৎসিত উদরের দিকে তাকিয়ে বিপন্ন শেফালি। আতঙ্কগ্রস্ত হবু মায়ের মর্মবেদনার সহচর কে হতে যাবে? শুধু শেফালির দেহের সঙ্গে লেপ্টে আছে শিশুটির প্রাণস্পন্দন। সেই প্রাণের উত্তাপ অনুভব করে সারাদিন ভেবে মরতো ও – মায়ের দেহের সমস্ত লালিত্য ধীরে ধীরে গ্রাস করে এভাবেই বুঝি জন্ম হয় কোনো মানবশিশুর?

শেফালি তৎপর হলো – এরকম ভয়াবহ শিল্পের বিস্তার ঠেকাতে হবে। অলিভ-অয়েলের টিন উপুড় করে ঢালতে শুরু করলো। বোতলকে বোতল ক্যালামাইন লোশন – কিন্তু পেটের  ত্বকে অন্ধ-শিল্পীর চিত্রকর্ম নিশ্চিহ্ন করা গেল না। শেফালি হাল ছেড়ে দিলো – যেদিকে খুশি চলে যাক হাল-পাল ছাড়া নৌকা। ভয়ানক এক সত্যের সম্মুখে বিমূঢ় এক মা – নারীদেহের চিরবসন্তকে কীভাবে ধীরে ধীরে মরুভূমি বানিয়ে তোলে এক দেবশিশু!

সাকুলেন্ট!

মরুর বুকে জন্ম নেওয়া একফোঁটা-সবুজ। আহা! কত যত্নআত্তির পরই না জন্ম নেয় এই বিরিক্ষ!

তুহিনের বয়স তিন – আর ভেজাবালি দিয়ে বানানো আরেকটি ছোট্ট-ঢিবি শেফালির উদরে। আরেকটা নতুন প্রাণ – প্রাণের স্পন্দন। যে স্পন্দনে শেফালির আপাদমস্তক কেঁপে ওঠে। পূর্বের মতোই বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে বসে থাকে। কিছুতেই যেন ঘোর কাটে না ওর। নিজের সৌন্দর্যের মøানিমা দেখতে দেখতে অশ্রু জমে ওঠে আঁখির কোণে।

পেটের ওপর হাত রাখতেও কেমন যেন ভয় ভয় লাগে। অথচ তুহিন জন্মানোর পূর্ব অভিজ্ঞতায় ওর তো এমন হওয়ার কথা নয়। পেটের ওপর হাত রাখলেই শেফালির মনে হয় – রাবারের হটওয়াটার ব্যাগের ভেতর হিম হয়ে যাওয়া জল! সেই হিমজল থেকে কলধ্বনি উঠছে।

অবুঝ তুহিন হঠাৎ দৌড়ে এসে ঝাঁপিয়ে পড়ে ওই কলধ্বনির ওপর। গভীর মমতায় ছেলেকে বুকে টেনে নেয় শেফালি। দেবশিশু – ধবধবে ফর্সা গায়ের রং। পক্ব কমলার মতো গোলগাল মুখমণ্ডল। ওই মুখের ওপর কালো আঙুরের মতো থোকায় থোকায় ঝুলে আছে কোঁকড়ানো চুলের গুচ্ছ। শিশুর বড় বড় চোখের কুচকুচে কালো তারায় এক পৃথিবী বিস্ময়।

নরম আঙুলে ছেলের মাথায় বিলি কেটে চলে মা। হটওয়াটার ব্যাগের হিমজল থেকে তখুনি ছোট ছোট ঢেউ ওঠে – কে অমন করে? কে এমন করে জলতরঙ্গ বাজিয়ে চলে অহর্নিশ। কে হে তুমি? বালক, না বালিকা? বালিকা, নাকি বালক?

যে-ই বাজায় এই বাজনা – সে বড়ই দস্যি। ভারি ছটফটে। নরম ব্যাগের ভেতর আবদ্ধ থেকে হয়তো অস্থির হয়ে ওঠে – এদিক থেকে ওদিকে যায়। ওদিক থেকে এদিকে।

তুহিনকে বুকের ভেতর গভীর করে জড়িয়ে ধরে শেফালি। বলে –

‘বুঝলে সোনা – এই পেটের ভেতর কিন্তু তোমার মতো আরেকটা বাবু আছে।’

তুহিন বড় চোখ দুটি আরো বড় করে আধো আধো বোলে বলে –

‘বাবু? আতে? আরেকতা? বাবু ভাইয়া আতে।’

শেফালি চমকে ওঠে। ‘ভাইয়া’ কেন বলছে তুহিন? কেন ও বললো না –

‘আতে? বাবু আতে? বাবুবোনু আতে।’

দাগের ওপর দাগ। অসংখ্য কুৎসিত দাগে পূর্ণ শেফালির বেবিবাম্প। তুহিন জন্মের প্রাক্কালে গাঢ় দাগগুলির ওপর ফের নতুন দাগ পড়ছে। অন্ধ-শিল্পীর এঁকে যাওয়া চিত্র। এই ছবিগুলি কোনোদিন আর কাউকেই দেখাতে পারবে না শেফালি।

নিজের পেটের দিকে তাকাতে ঘেন্না হয়। কী বিশ্রী! কী বিশ্রী! দেহের এই কুৎসিত পরিবর্তন নিয়ে অস্বস্তি হয়। তীব্র অস্বস্তি। বাদল – তার এসব দেখার সময় কোথায়? তবু শেফালি মরমে মরে যায়। বাদলের সম্মুখে নিজেকে নগ্ন করতে গিয়ে মরমে মরে যায় ও। বাথরুমের ঝরনাতলায় অস্বস্তি। ডাক্তারের চেক আপের সময় পেটের আবরণ সরাতে অস্বস্তি। কিন্তু এই যে পাহাড় সমান অস্বস্তি – কাকে বলবে এই অস্বস্তির  কথা? কে বুঝবে?

শেফালির ইচ্ছে বা অনিচ্ছে, স্বস্তি-অস্বস্তি, ভয়-সংকোচ – দেখা বা বোঝার মতো অবকাশ বাদলের কই? রাত নামলেই জান্তব আগ্রাসন। উন্মাতাল রিপুর বাসনা। আদিমতার তীব্র তাড়না। ভয় পেতো শেফালি। ভয়ে একেবারে কুঁকড়েমুকড়ে থাকতো। ভয়ার্ত চোখে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখতো – কীভাবে,  কত দ্রুততায় ভদ্রবেশী কেউ আদিম পুরুষে রূপান্তরিত হয়। আর ওর ইচ্ছা-অনিচ্ছার তোয়াক্কা না করে টেনে-হিঁচড়ে গুহার ভেতর নিয়ে যায়। থই-থই অন্ধকারে ভরে থাকা এক প্রাচীন-গুহা। যেখানে অন্ধকার এতোটাই গাঢ় যে, একহাত অদূরের মানুষটিকেও ভালো করে দেখা যায় না। ওইরকম থই-থই অন্ধকারের ভেতর একদিন রক্তে ভিজে উঠলো শেফালি। নিকষ-কালো-আঁধার ছিন্নভিন্ন করে দিয়ে রক্তের ধারা গড়িয়ে পড়লো মাটির ওপর।

রাবারের হটওয়াটার ব্যাগের ভেতরের হিমজলের কলধ্বনি স্তিমিত হয়ে উঠলো। আর চলকে পড়লো খানিকটা জল। চলকে-পড়া জলের রং লালচে। যেন সদ্য ঝরে পড়া হিজলফুল। হাওয়ায় ভাও লেগে আলগোছে খসে পড়েছে সবুজ ঘাসের ওপর।

হিজলের হালকা-লাল রং ক্রমে হয়ে উঠলো গাঢ় থেকে গাঢ়তর। যেন সে এখন শিমুল! টুকটুকে লাল জল! রক্ত দেখে শিউরে উঠলো অনাগত শিশুর মা। দৃষ্টির সমুখে আর কিছুই নাই শেফালির – বিশাল শিমুল-বৃক্ষে বড় অসময়ে ঝেঁপে ফুটেছে অজস্র-পুষ্প!

চিৎকার দিয়ে ওই প্রাচীন গুহার অন্ধকার থেকে বের হতে চাইলো ও। চারপায়ে হামাগুড়ি দিয়ে ধূর্ত জন্তুর মতো কাছে এলো বাদল। কণ্ঠে প্রচণ্ড বিরক্তি ও উষ্মা ঢেলে বলল –

‘কী হইছে অ্যাঁ? এত জোরেজোরে কানতেছ ক্যান?’

এই জিজ্ঞাসার উত্তর জানা নাই শেফালির। জানা থাকলেও বলার মতো অবস্থা নাই ওর। পরনের ম্যাক্সি জুড়ে অবিশ্রাম ফুটে চলছে শিমুলফুল। যোনি থেকে রক্তধারা চুইয়ে নামছে। আর ভিজিয়ে দিচ্ছে শেফালির পায়ের পেলব-পাতা।

পৃথিবীর আলো না দেখা এক শিশুর মায়ের সামনে উড়ছে গুচ্ছ-গুচ্ছ শিমুল-তুলা। সাদা-সাদা-তুলাফুল ঢেকে দিচ্ছে গুহার অন্ধকার। আহ! কী শুভ্র! আর কতই না পবিত্র ওই ফুল। উড়ন্ত-ফুল দেখতে দেখতে ঘুম নেমে আসছে শেফালির দুই-চক্ষু জুড়ে।

হাসপাতাল!

লেডি ডাক্তার দুই হাতে পরে নিল গ্লাভস। ভ্যাজাইনাতে ফিংগার পুশ করে বলল –

‘কমপ্লিটলি বেড রেস্ট। নো মুভমেন্ট। একদম নড়াচড়া করা যাবে না কিন্তু।’

ফের বললো –

‘ব্লিডিং হচ্ছে। যেকোনো মুহূর্তে বাচ্চার হাত-পা বের হয়ে যেতে পারে।’

হাসপাতাল! লোহার খাটে পেতে রাখা ধবধবে বিছানা। যেন তুলাফুল উড়ে এসে বিশ্রাম নিচ্ছে। খাটের পায়ের দিকটা উঁচু করে শুইয়ে দেওয়া হলো শেফালিকে।

আহ! কতদিন পর শান্তি! কতদিন পর বিশ্রাম! ঘর-সংসার-স্বামী-সন্তান-অতিথি করে করে বড় ক্লান্ত ও। রক্ত-মাংস-হাড়-মজ্জায় ক্লান্তি ঢুকে পড়েছে শেফালির।

কতদিন বাদে অন্য এক পৃথিবী? যে-পৃথিবীর হাওয়ায় ভাসে ওষুধের গন্ধ। লোকজন চলাচল করে বিড়ালের মতো নিঃশব্দ পায়ে। আর সাদা রঙের তোড়ে ডুবে যায় এখানকার

ঘর-দোর-জানালা। রাত্রি নামলেই এইখানে কোড়াপাখির ডাক শোনা যায় না।

ঢব-ঢব-ঢব-আহ!

লাল-চক্ষু-কোড়াপাখি শিকার ধরার ফাঁদ পেতে রাখতে পারে না এইখানে।

প্রচণ্ড ক্লান্ত শেফালির এতদিনে বিশ্রাম মিলল।

তুহিন?

আহা! অবুঝ শিশু! তুহিনের মুখটা মনে করে অশ্রুতে ভেসে গেল শেফালি।

মৃত্যু এসে বসে আছে মাথার কাছে। যেন কতদিনের জানাশোনা দুজনের। কিন্তু শেফালির ভয় লাগছে না। কোনো পিছুটানই অনুভব করছে না। বাবা-মায়ের কাছে তুহিনকে রেখে এসেছে শেফালি।

একটানা দশদিন দুই-পা উঁচু করে রাখা হলো। আর মাথার দিকটা নিচের দিকে। ফুটন্ত শিমুলের গাঢ়-লালরং ফিকে হয়ে উঠতে লাগল। লাল থেকে গোলাপি। গোলাপি থেকে ক্রমশ সাদা।

রাবারের ব্যাগের ভেতর ফের জলতরঙ্গ। জলঘূর্ণি। এদিক থেকে ওদিকে জল গড়িয়ে পড়ার শব্দ। সন্তর্পণে পেটের ওপর হাত রাখল শেফালি –

বেঁচে আছে আহা! বেঁচে আছে ও। ধীরে ধীরে নড়ছে।

বেঁচে আছে! শেফালির গর্ভের শিশু!

রক্ত-নদীতে হাবুডুবু খাওয়া শেফালির চোখে অশ্রুবিন্দু জমে উঠছে।

৯.

ঢাকা-টাঙ্গাইল রুটে এইরকম প্রচণ্ড জ্যাম লেগে যেতে পারে – ঘুণাক্ষরেও মনে ঠাঁই দেয় নাই ওরা। অবশ্য এই রুটে কখনো জ্যাম লাগে না, তেমনও তো নয়। অন্যান্য দিনের তুলনায় বৃহস্পতিবার বিকেল থেকেই গাড়িঘোড়ার লটবহর অচল  হতে শুরু করে। হপ্তা অন্তে রাজধানী থেকে যাদের ঘরে ফেরার তাড়া থাকে, তাদের খুশিকে মøান করে দেওয়ার জন্যই যেন রাস্তার এই ষড়যন্ত্র। শুধু ঘরমুখো ক্লান্ত মানুষদের বিড়ম্বনায় ফেলা নয় – ট্রাক বা কাভার্ড ভ্যানগুলির মালসামান আনা-নেওয়ায় বিঘ্ন ঘটানোও যেন উদ্দেশ্য।

আজ বুধবার – সকাল সকালই পুরো রাস্তার কোনো গাড়িরই নড়াচড়ার নাম নাই – মুমু বিস্মিত হয়। কপালের ওপর শনি এরকম করে ভর করবে কে জানতো?

পাবলিক-ট্রান্সপোর্ট ছাড়াও রেন্ট-এ-কার বা প্রাইভেট-কার নিয়েও এখানে আসে মুমু। অচল গাড়ির মিছিলে সয়লাব

সমস্ত-রাস্তা – আর আজই কি না বাসে চড়তে হলো ওকে?

পেটমোটা-ননএসি বাসের ভেতর ঘাম আর গরমে, হাঁসফাঁস করছে মুমু আর টুলকি। পাশাপাশি সিটেই বসে আছে দুইজন। মুমু বসেছে জানালার ধারের সিটে। বিষয়টি নিয়ে টুলকি বিরক্ত হলেও মুখে কিছু বলে নাই। জানালার পাশে বসার মতো সামান্য বিষয় নিয়ে বাহাস করবে নাকি ও? তাও বাসবোঝাই যাত্রীদের মাঝে? এমনিতেই কম কথা বলার স্বভাব – পাবলিক বাসের ভেতর একটা বাড়তি কথাও উচ্চারণ করবে না টুলকি।

নির্বিকার থাকার চেষ্টা করে সদাই ফল লাভ ঘটে – এমনও তো নয়। বাস যখন মৃদু পায়ে গাছলতার ঘন বনানীর মাঝ দিয়ে চলে – টুলকির মনে ঈর্ষা ঘনায়। চোখ দুটো বন্ধ করে নিজেকে সামলে নিলেও ভাবনাকে প্রতিহত করতে পারে না সে। নিজেকে প্রবোধ দেওয়ার জন্যই হয়তো বিড়বিড় করে বলে –

‘আল্লায় যারে দেয় – একেবারে ছাপ্পড় ফাইড়াই দেয়। নইলে দুনিয়ার যাবতীয় ভালো কেন মুমুর জন্য বরাদ্দ? পৈতৃক সূত্রে পাওয়া ওইরকম আলিশান ফ্ল্যাটে নিশ্চিত-নির্ভাবনার জীবন। আবার সেইরকম একজন প্রেমিকও ওর রয়েছে। মাখো-মাখো-প্রেম নিয়ে কত সুখেই না আছে মুমু।’

‘প্রেম’ – এই শব্দটা ভাবলেই টুলকি আরো বেশি নিশ্চুপ হয়ে পড়ে। হয়তো ঈর্ষার ধারালো-শিং আহত করে ফেলে ওকে।

ওরকম ‘তুমুল প্রেম’ টুলকির বরাতে জোটে নাই।

দুই-চারজন যাও এগিয়ে এসেছে – ওরাও বেশিদিন টেকসই হয় নাই। কেন টেকসই হয় নাই বা হয় না – এতসবের কারণ খুঁজতে যায় নাই টুলকি।

সজল আহমদের সঙ্গে প্রেমের বিষয়টি মুমুই বলেছে ওকে। বিভিন্ন আড্ডাতে দুই-চারবার দেখা-সাক্ষাৎও হয়েছে ওর সজলের সঙ্গে।

মুমুর শুরু করা অনলাইন শাড়ির বিজনেস ‘ধরিত্রীর’ সঙ্গে নিজের আগ্রহেই যুক্ত হয়েছে। তাও তো কম ঠ্যালায় পড়ে নয়। কোভিড-১৯-এর মহামারিতে দুম করে চাকরিটাও হারিয়েছিল টুলকি। সেই থেকে কত জায়গাতেই না সিভি ড্রপ করে চলেছে; কিন্তু ব্যাটে-বলে মিলছে না কিছুতেই।

মাথাভর্তি কালো চুল এলিয়ে বসে আছে মুমু। সানগ্লাস পরা চোখ কোনদিকে তাকিয়ে আছে ধরা মুশকিল। খোলা চুল থেকে কাঁচা-মেহেদি আর মেথির সুঘ্রাণ টুলকির নাকে ঢুকে পড়ছে। কী মাখে চুলে ও? কোনো বিশেষ তেল, নাকি শ্যাম্পু? সুযোগ বুঝে একদিন জেনে নেবে টুলকি। অবশ্য জেনে নিলেই বা কী?

টুলকির চুল মুমুর চুলের মতো সিল্কি ও স্ট্রেইট নয়। কোঁকড়ানো চুলের গোছা পাঞ্চ ক্লিপে ভালোমতো আটকে রাখে। চুল খুলে দিলেই সাপের ফণার মতো উঁচু হয়ে থাকা কেশরাজি কিম্ভুতকিমাকার চেহারা বানিয়ে তুলবে টুলকির।

মুমু ওর বন্ধু, বিজনেস পার্টনার – এই মুহূর্তে ঈর্ষা করা কি উচিত হচ্ছে? অন্য সময় হলে এইরকম নিচু চিন্তায় আহত হতো না টুলকি। কিন্তু লম্বা সময় ধরে অনড় বাসের ভেতর বসে বসে বিরক্তির চরমে পৌঁছেছে ও। ঘাম-গরম-লোকজনের কোলাহল-অস্বস্তি সবই যেন টুলকির দেহে বিঁধে আছে। ধুত্তরি! কতক্ষণে এই জ্যাম ছুটবে? ভালোরকম গ্যাঁড়াকলেই আজ পড়া গেল দেখছি!

মুমুও বুঝতে পারছিল – অদৃশ্য শনির খপ্পরে পড়া আজকের দিনটা মাটি হতে চলেছে। কাজের কাজ আজ আর কিছু হবে না। এতো দূর থেকে এসে কিছু শাড়ি কিনে ফিরতে না পারলে বিজনেসেও লালবাত্তি জ¦ললো বলে। নিত্যই কি আর ঢাকা-টাঙ্গাইল করা যায়? বেশির ভাগ কাজ ফোন করেই সেরে নেয়। তবুও মাসে দুই-একবার আসতে হয়। না এলে শাড়ির নতুন ডিজাইনগুলির ভাও ভালো করে বোঝা যায় না। সুতার কোয়ালিটি ও বুননকায়দা যাচাই করার জন্যও আড়ংগুলিতে ঢুঁ মারতে হয়।

জ্যাম লাগার পর থেকেই টুলকি একেবারে চুপ মেরে আছে। যেন সে জন্মের বোবা-কালা। সানগ্লাসের ওপর দিয়ে টুলকির দিকে তাকায় মুমু – ওর দৃষ্টি ফোনের স্ক্রিনে। এই মুহূর্তে ওর হাতের স্মার্টফোনটাই যেন সবচাইতে দরকারি। ওই ফোনের ভেতরই টুলকি পুরে রেখেছে সমস্ত পৃথিবীকে। কিংবা কোনো থ্রিলার মুভিতে ডুবে রয়েছে। হেডফোন কানে লাগিয়ে চারপাশে যা কিছু ঘটছে সব থেকেই বিচ্ছিন্ন হয়ে আছে ও।

হঠাৎ বিষণ্নতা আচ্ছন্ন করে ফেলে মুমুকে। ওরই সমবয়সী একটা মেয়ে – কী দিব্যিই না নিজের জগৎ নিয়ে নিমগ্ন হয়ে আছে। অথচ মুমুর মাথাভর্তি টেনশন – একটা নির্দিষ্ট সময়ের ভেতর শাড়িগুলি কিনতে হবে – কিনে ফিরেও আসতে হবে ওদের। দুইজনই সমপরিমাণ টাকা ইনভেস্ট করেছে ‘ধরিত্রী’তে, অথচ সব যন্ত্রণা এখন মুমুর একার? অদৃশ্য একটা কাঁটা খচখচ করতে থাকে মনের ভেতর।

শেষ বসন্তের শুষ্ক ও উত্তপ্ত হাওয়ার ঝাপটায় ত্বকে চিড়বিড়ে অনুভূতি – বাসবোঝাই লোকজন অসহিষ্ণু হয়ে উঠছে ক্রমশ। দুই-চারজন শিশু ভ্যাঁ ভ্যাঁ কান্না জুড়ে দিয়েছে। সিগারেটখেকো পুরুষেরা নেমে গেছে বাস থেকে। পাঁচ-পাঁচ-সাতটা সুখটান দিতে পারলেই মেজাজ শরিফ হয়ে উঠবে ওদের। মুমুরও সিগারেট খাওয়ার ইচ্ছে জাগে। একটা প্যাকেট ব্যাগে ভরে নিয়ে এলে ভালো হতো। সেও নেমে গিয়ে কয়েকটা সুখটান দিয়ে টেনশন ঝেড়ে ফেলতে পারতো। কিন্তু মুমু যেরকম ভাবছে – সেরকম ঘটানো যেতো না। এখনো নারীর ওপেন স্মোকিং সুনজরে দেখে না অনেকেই।

বৃক্ষের মতো প্রধান-শেকড় মাটিতে প্রোথিত করেও বাসটা মাঝেমধ্যে হাঁটছে। এই শ্লথগতিতে হাঁটাহাঁটির ফাঁকে টাটকা বাতাসের স্পর্শ পাওয়া যায়। কিন্তু বাতাসের সঙ্গে উড়ে আসছে অজস্র ধূলিকণা – টিস্যু দিয়ে সানগ্লাসটা বারকয়েক মুছেও ধুলার স্তর সরাতে পারছে না মুমু। অগত্যা ধুলার উড়ে আসার মাঝেই চুপ করে বসে রইলো।

দুপুর প্রায় ফুরিয়ে বাস ওদের নামিয়ে দিলো করটিয়ায়। কী লাভ হবে এখন আর হাটে গিয়ে? অধিকাংশ দোকানদার ভাতের থালা সামনে নিয়ে বসে গেছে। উদরপূর্তি না-হওয়া পর্যন্ত সমস্ত বিক্রিবাট্টা স্থগিত।

টুলকি রেগে আছে নাকি নির্বিকার বুঝতে পারছে না মুমু। আসল অবস্থাটা বোঝার জন্যই বলে –

‘আজ আর হাটে না ঢুকি?’

সঙ্গে সঙ্গেই টুলকি প্রায় ঝাঁজিয়ে ওঠে –

‘তাইলে আসলি ক্যান? হাটে যাবি না কী করবি?’

এতক্ষণ বাদে নিজেকে হালকা লাগে মুমুর। জ্যামে পড়ে-মাটি-হয়ে যাওয়া দিনটির দুঃখ তাহলে ওর একার নয়? ওর সহযাত্রী টুলকিও ওই বিদঘুটে জ্যামের প্যারার ভেতরই রয়েছে।

চোখ থেকে সানগ্লাস খুলে ফেলে সরাসরি তাকায় টুলকির দিকে –

‘ভাঙা হাটে গিয়ে লাভ কী বল? তার চাইতে এক কাজ করি চল – পাথরাইলের আড়ংগুলিতে ঢুঁ মেরে আসি।’

পলকে নিজেকে পূর্বের গাম্ভীর্যে মুড়ে ফেলে টুলকি। আচ্ছা  – ভারি আজব তো ওই মেয়ে মুমু। খিদাটিদা লাগে না নাকি ওর? ঘণ্টা দুয়েকের পথ ছয় ঘণ্টা লাগিয়ে এসে এক্ষুনি কি না ছুটতে চাইছে পাথরাইলের দিকে?

রাগে মাথা ঝাঁ ঝাঁ করে উঠতে চাইলেও সামালে নেয় নিজেকে। শান্ত গলায় বলে –

‘কিছু খেয়ে নিই। তারপর যাই যেদিকে নিয়ে যাস।’

এক্ষণে মুমুও যেন খিদা টের পায়। শুধু খিদা না, পানির অভাবে গলাও শুকিয়ে কাঠ-কাঠ। দ্রুত চিন্তা করে নেয় – ভাত খাবে নাকি দই-মিষ্টি? ফণীন্দ্রর দোকানের দই-মিষ্টির নামডাক আছে। নাকি বনরুটি-কলা? বাইরে এলে শুকনা খাবার খায় ওরা।

‘কী খাবি – ভাত নাকি অন্য কিছু?’

‘সকাল থেকে না খেয়ে আছি – অন্য কিছু কী খাব?’

‘ওহো, তাই তো। বল কী খাবি?’

‘ভাত খেতে পারলে ভালো লাগবে।’

মুমু রেগে উঠতে গিয়েও হেসে ফেলে।

‘আচ্ছা চল চল, ভাত খাই আজ।’

টুলকি যে ভাত ছাড়া আর কিছু বোঝে না, কেন ভুলে গিয়েছিল মুমু?

সকাল-সন্ধ্যা-রাত-ভোর যখনই হোক না ভাত ও খাবেই।

ভাত খেয়ে খেয়ে দেহটা যে ফুটবলের আকৃতি পাচ্ছে – সেদিকে নজর নাই এই মেয়ের!

মুমু আর কিছু না বলে ‘আল আমিন’ রেস্টুরেন্টে ঢুকে পড়ে।

এই হোটেলে বহুবার খেয়েছে। ভাত, মাছ, সবজি, ভর্তা যা-ই দেবে – বাসি কোনো খাবার দেয় না এরা। মাঝারি ধরনের একতলা রেস্টুরেন্ট – কিন্তু যথেষ্ট পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। ভিড় সামলাতে সামলাতে ওয়েটাররাও দক্ষ হয়ে উঠেছে।

বেসিনের কলে ভালো করে হাতমুখ ধুয়ে নিয়ে টেবিলে বসে দুইজন। টেপা বোরোর লালচে ভাত থেকে গরম-ধোঁয়া উঠছে। পাশের হাফপ্লেটে টাকি মাছের ভর্তা। লালশাক। ভাতের সঙ্গে ভর্তা মাখতে মাখতে চমকে ওঠে মুমু। টুলকি ভাতের প্লেট সামনে রেখে বসে আছে – আনমনা। মুখোমুখি বসে ভাত মাখছে মুমু – টুলকি তা দেখছে বলে মনে হয় না।

কী হয়েছে ওর? শরীর খারাপ নাকি?

জানতে চেয়েও চুপ করে যায় মুমু। ভাতের লোকমা মুখে দিয়ে অনুভব করে –

‘সত্যি। আমারও খিদা পেয়েছে এত? অথচ দিব্যি ভুলে ছিলাম!’

সামনাসামনি বসে অন্যের আনমনা মুখ পড়তে বড় ভালো লাগে ওর। মুখের প্রতিটা ভঙ্গি, রেখা, চোখের পলক ফেলা থেকে নতুন গল্প আবিষ্কার করা যায়।

চেনা মানুষকেও ফের চেনা যায় নতুনভাবে। নতুন করে। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে না দেখলে অন্যের মনোজগতের সন্ধান পাওয়া যায় না।

পাথরাইল যেতে হলে অটোতে চেপে যেতে হবে। লোকজনের চাপাচাপিতে চিড়েচ্যাপ্টা হয়ে। নতুবা আলাদা করে অটো ভাড়া নিতে হবে। কিন্তু সুবিধামতো ভাড়ায় পাওয়া যাবে কি না কে জানে? এইরকম রোদ-জ¦লা বিবর্ণ-দুপুরে অটোওয়ালারাও অলস হয়ে ঝিমাতে থাকে। ভাড়া বাড়িয়ে বললেও যেতে চায় না।

১০.

‘দৈনিক বিভাবসু’তে চাকরি হয়ে গেল বকুলের। কারওয়ান বাজারে অফিস। একটা হাইরাইজ বিল্ডিংয়ের আটতলাটা নীল কাচে ঘিরে রাখা। যেখানে সূর্যের রুপালি-আলো ঢুকে ফিকে-রং ধরে। কোথাও কড়া-আলোর খবরদারি নাই।

দৃষ্টি-সহনীয় আলোতে সাজানো-গোছানো। যেন বিন্দুমাত্র উজ্জ্বলতার বাড়াবাড়ি হলেই মøান হয়ে উঠবে আভিজাত্য। তার মানে এই যে – অন্ধের মতো হাতড়ে-পাতড়ে দিক-দিশা খুঁজে নিতে হয় এই অফিসে। আলোর-বাহার ঠিকই আছে, কিন্তু সেসব রয়েছে চোরাগোপ্তা পথে। আসলি হীরার দ্যুতি যেমন ঠিকরানো জৌলুসে পরিপূর্ণ থাকে।

পৃথিবীর তাবৎ ঘটন-অঘটনের সংবাদ ছাপা হয় এই পত্রিকায়। পাঠক কোন খবর গোগ্রাসে খাবে, আর কোন খবরটা চেখেও দেখবে না – প্রতিটা বিভাগীয় প্রধান তা জানে। কোন খবরের বল জালে আটকে পরিপক্ব বাতাবিলেবুর মতো দুলতে থাকবে – সেইরকম হাওয়া দিতে পারে এই পত্রিকার মালিকপক্ষ। এতসব কায়দাকানুন জানা, কৌশলী মালিকপক্ষের পত্রিকা ‘দৈনিক বিভাসু’কে টেক্কা দিতে অপারগ অন্য পত্রিকাওয়ালারা।

‘দৈনিক বিভাবসু’ জানে কীভাবে খবর বিশ^াসযোগ্য করে পরিবেশন করতে হয়। অফিসের ঝাঁ-চকচকে রূপ-রোশনাইয়ে হতবিহ্বল  করে দিতে হয়। কী খবর দিয়ে, কী অফিসের রূপ-রোশনাই দিয়ে – অন্যদের চক্ষে-মুখে ভেলকি লাগানোই আসল কথা। ফলে বেড়েছে অফিসের আধুনিক-আভিজাত্য। সেই সঙ্গে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা-বোনাস।

এইরকম দূরবর্তী কোনো স্বপ্নের নাগাল পাওয়া, ‘দৈনিক বিভাবসু’র বিগ-হাউজে পারমান্যান্ট চাকরি – সত্যি, বকুল কিন্তু কস্মিনকালেও ভাবতে পারে নাই। শুধু ভাবতে পারে নাই, তা নয় – বদখোয়াবেও দেখে নাই। এই যে দিন পনেরো হবে – রেগুলার অফিস করছে – তবুও সবই কেমন অবিশ^াস্য লাগে ওর। যেন কোন প্রাচীন ভুলভুলাইয়ার ভেতর চক্কর খাচ্ছে ও। ঘোরানো-প্যাঁচানো সিঁড়ির আলো-আঁধারি সঙ্গে করে ক্রমাগত উঠছে-নামছে; কিন্তু পথ যেন অধরা। সঠিক পথের হদিস ও যেন এখনো খুঁজে পায় নাই। সত্যি, বকুলের এরকম অনুভূতি হয়। এরকম অনুভূতি হলে ও  কী করবে? কী করতে পারে ও? নিজের মনের ভেতরে জেগে-ওঠা অনুভূতিকে অন্য কোনো দিকে প্রবাহিত করে দেওয়ার মতো কৌশলী ও হয়ে উঠতে পারে নাই। এরকম বিভ্রমের ভেতর থেকেই বকুল জয়েন করেছে। কনফারমেশন-লেটার পাওয়ার দিন-তিনেকের মাথায় জয়েন করেছে। সামান্যতম গড়িমসি করে নাই।

পত্রিকার পৃষ্ঠা হিসাব করে এক-একটা বিভাগ – আর বিভাগ হিসাব করে রুম ভাগ করে দেওয়া। ‘কন্যা-জায়া-জননী’ – এই বিভাগ বকুলের। ‘কন্যা-জায়া-জননী’র রুম আলাদা। দশ-বারো জন বসার মতো করে রুমের ডেস্ক-চেয়ার সাজানো। পার্টিশন দিয়ে সকলকেই কাজ করার প্রাইভেসি দিয়েছে এই পত্রিকা। রুমের দেয়ালজুড়ে কাবার্ড। আলাদা আলাদা চেম্বারে একেক জনের নাম আর পদবি সেঁটে দেওয়া। নাম-পদবি সেঁটে দিয়ে হয়তো মালিকানাও নির্দেশ করে দেওয়া হয়েছে।

নাম-পরিচয় না-দিয়ে বাইরের লোকজন যেমন ‘দৈনিক বিভাবসু’তে ঢুকতে পারে না তেমনি বাইরের আলো-হাওয়াও হুড়মুড়িয়ে ঢুকতে পারে না। বাইরের আলো-হাওয়ার নিয়ন্ত্রিত যাতায়াতে ধুলাবালির কণামাত্রও কারো চক্ষে ভাসে না। এই অফিসে সেন্ট্রাল-এসি চলে মৃদু-শব্দে। যেন-বা বহুদূরের কোনো মৌচাক ঘিরে মৌমাছিরা নিজেদের সুরে গান গাইছে। মৌমাছির ওই নিজস্ব-সুর খুব কাছ থেকে শুনলে দুইকানে তালা লেগে যেতে পারে।

অত্যন্ত আনন্দিত বকুল – জনগণের যাতায়াত-আনাগোনা নাই, আলো-হাওয়ার অবাধ চলাচল নাই – ঝকঝকে-তকতকে অফিস-কক্ষ। এই রকম সূচিশুভ্রতায় ঢুকে পড়লে  আপনাআপনিই দৃষ্টি নরম হয়ে আসে। সিলিংয়ের ছোট ছোট খুপড়িজুড়ে  আলোর-গোলক – যা থেকে বিচ্ছুরিত আলো সাদা-পায়রার ডানার মতো ছড়িয়ে নামছে।

কাজের চাপে বা বিনা-কাজেও ক্লান্তি ভর করলে চাহিবামাত্রই পাওয়া যায় গরম-গরম চা-কফি। সঙ্গে নোনতা, ঝাল বা মিষ্টি বিস্কুট। গরম-কফির-মগে চুমুক দিয়ে চাঙা হয়ে ওঠা-যায়, বকুলও চাঙা বোধ করে। গুচ্ছের-চুল আটকে রাখা পাঞ্চ-ক্লিপটা তিন-আঙুলে খুলে ফেলে। মাথাটা এলিয়ে দেয়

রিভলভিং-চেয়ারের পেছনের দিকে। আহ, শান্তি! শুধু শান্তি নয়, একেই বুঝি বলে – পরম-শান্তি। এই অফিসে আর যা-ই থাকুক না কেন ভাপ-ওঠা অসহনীয়-গরম নাই। ধুলাবালির আক্রমণ নাই, এমনকী, যানবাহন নামক সারি-সারি-দানোগুলির হর্ন, বেল, ঘ্যাসঘ্যাস, প্যাঁ-পুঁ কিছুই নাই।

এতদিন বাদে বকুল এতটাই উঁচুতে উঠে এসেছে যে, চাইলেই যেন পাখির মতো উড়তে পারে। খুব ইচ্ছে হলে খানিকটা মেঘ,  মেঘের খানিকটা আঁবও ছুঁয়েছেনে আসতে পারে। ইচ্ছেটা প্রলম্বিত করে ওইসব মেঘরাজির ওপর চড়ে বসে ভেসে বেড়াতেও পারে। এসব ভাবনায় ডুবতে ডুবতে ফিক করে হেসে ফেলে বকুল। বকুলের হাসি আকর্ণ বিস্তৃত হলে বাজতে শুরু করে ‘আলিফ-লায়লার’ থিমসং। বকুল যেন এক্ষণে শেহেরজাদ। শেহেরজাদ জাদুর কার্পেটে দাঁড়িয়ে জগৎ চষে বেড়াচ্ছে। যদিও বাস্তবে ‘দৈনিক বিভাবসু’র অফিসে বসে আছে। কিন্তু এই মুহূর্তে ও শেহেরজাদ। গরম-কফির-মগে দ্বিতীয়বার চুমুক দিয়ে সাঁই-সাঁই করে উড়ে চলছে বকুল।

নতুন অফিস – কাজের ধরনও নতুন। সময় লাগবে বকুলের। তা লাগুক – ধীরে ধীরে সবই গুছিয়ে নেবে সে। চেনা-পরিবেশ থেকে অচেনা-পরিবেশে এসে মানিয়ে নিতে সময় লাগে। সময়  লাগবে।

চুল খুলে, মাথা এলিয়ে চোখ বুজে আছে বকুল। আপাত দৃষ্টিতে ওর চোখের সম্মুখে কোনো দৃশ্য নাই। নতুন কোনো দৃশ্যের জন্মও হয় নাই বা দৃশ্যান্তরও ঘটে নাই। ডেস্কে রাখা কফির মগ থেকে এখনো মৃদু-ধোঁয়া উঠছে। কুয়াশার মতো উঠে আসা হালকা-ধোঁয়া সর্পিলাকারে ঘুরে ঘুরে কোথায় যেন মিলিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু বকুল এসবের কিছুই দেখছে না। ওর মগজে তখন অন্য চিন্তা, অন্য কিছু প্যাঁচ-খেয়ে আছে। প্যাঁচ-খেয়ে-খেয়ে ধোঁয়ায় ওড়াউড়ি করছে।

কাউন্দিয়া বাড়ির উঠান – শীতের সকালের রোদ্দুর তেরছা-ভঙ্গিতে শুয়ে পড়েছে। যেন রাতভর জমে-থাকা দইয়ের ওপর-ঘন-হয়ে জমা-সর। বড়ভাই জাফর মিয়া লুঙ্গির একটা কোনা পেছনের দিকে তুলে ধরে সেই সর ভেঙে ভেঙে হাঁটছে। হাঁটছে ঠিক নয়, এলোপাতাড়ি পায়চারি করছে। প্রচণ্ড ক্রোধ জমে আছে দুই-চোয়ালে। আর চক্ষু দুইটা টুকটুকে-লাল জবাফুলের মতো।

উঠানের কোমর ঘেঁষা ঘরের বারান্দায় বার্নিশ-ঘোলা-হয়ে-ওঠা হলুদাভ-কালো চেয়ার – একটা চেয়ারে বসা আব্বা জুবায়ের মিয়া। আব্বার পাশের চেয়ারে আম্মা মালিহা খাতুন। দুইজনই নির্বাক। দৃষ্টি যেন কোন সুদূরের দিকে। জাফর মিয়ার জান্তব চিৎকারে কেঁপে উঠল দুইজনই –

কীয়ের কলেজে যাওন? কীয়ের কলেজে যাইব ও? কীয়ের এত পড়ালেখা? পড়ালেখার নাম কইরা প্রেমপিরিতি চালাইব?

ঘরের ভেতরে খাটের ওপর বসে বকুল শুনছে জাফরের চিৎকার।

‘বড়ডারে পড়াইতে গিয়ো শিক্ষা হয় নাই তুমাগো? পড়ার লাইগ্যাই না ঢাকায় পাঠাইছিলা?’

জুবায়ের মিয়ার মুখে কোনো শব্দ নাই। শব্দ নাই মালিহা খাতুনের মুখেও। জাফর অনর্গল চিৎকার করে চলেছে তবুও।

চম্পা! বকুলের বড়বোন। বয়সে চৌদ্দ-পনেরো বছরের বড় বকুলের চাইতে। এত বছর বাদে চম্পার-মমিকে কেন যেন আনছে আবার? বিয়ে-থা হয়ে কোন দূর গ্রামে চলে গেছে চম্পা।

কাউন্দিয়া থেকে ভাটগাঁও – ম্যালাই দূরের পথ। ম্যালাই ঘুরপথ। চম্পা ওই দূর পথ ধরে, ঘুরপথে কালেভদ্রে আসে কি আসে না।

শেহেরজাদ উড়ন্ত-কার্পেট থেকে ধপ করে পড়ে যায় নিচে।

‘কন্যা-জায়া-জননী’ পেইজের মেকআপ দিতে হবে আজ। আগামী পরশু বাজারে যাবে পত্রিকা। কফির মগে ঠোঁট ডুবালে তিতকুটে স্বাদে মুখ ভরে যায় বকুলের। অথচ যখন খেতে শুরু করেছিল – কী চমৎকার স্বাদই না ছিল এই কফির।

ধীরেসুস্থে কম্পিউটারের স্টার্ট বাটনে চাপ দেয় বকুল। কিছুক্ষণ বাদে একটা ছবি ভেসে ওঠে – একজোড়া বনহংস, বনহংসী কোনো নিরালা চরে বসে আছে। ওদের চারপাশে  কল্লোলিনী-স্রোতস্বিনী। জলের তোড়ে ভেসে আসা এক টুকরো কাঠের ওপর বসে রয়েছে দুইজন। হংসীটি পেট চেপে – পালক ফুলিয়ে বসে আছে। হলদে-ঠোঁটজোড়া গুঁজে রেখেছে নিজের ঘাড়ের ওমে। আরামে বুজে আছে চক্ষুদ্বয় – যেন-বা এক্ষুনি গড়িয়ে পড়বে চরের ধু-ধু বালিতে।

আর পাশে বসা পুরুষটি একটা ডানা মেলে দিয়েছে। ডানা মেলে দিয়ে ছাতার মতো ছায়া দিয়ে রেখেছে নিজের প্রিয়তমাকে। খুব সন্তর্পণে মেলেছে সে তার ডানাটিও – যাতে রোদ্দুরের কড়া-আঁচ বনহংসীর ঘুম ভাঙাতে না পারে।

১১.

অফিস-ডে’তে তাড়াহুড়ার আদিঅন্ত নাই। একটা গোছালে আরেকটা অগোছালো হয়ে যায়। কিছু কিছু জিনিসের কথা ইয়াদও থাকে না। দুই-একটা অতি প্রয়োজনীয় জিনিস ব্যাগে নেওয়ার কথাও বিস্মৃত হয় শেফালি। কী যে ব্যারাছ্যারায় সময় ফুরিয়ে যায়-যেন কোনো বড়সড়ো চৌবাচ্চা থেকে অবিশ্রাম উপচে পড়ছে সাবান-গোলানো-জল। ফেনায়িত-জলধারা সাপের মতো এঁকেবেঁকে গিয়ে সমস্ত দিনটাকেই পিচ্ছিল করে তুলেছে।

জাহানারা-বুয়া ডোরবেল বাজায় ঠিক ভোর ছয়টায়। অবিরাম বেজে গেলেও বেলের শব্দ এ-বাসার কারো কানেই ঢুকবে না। অথবা কানে গেলেও সকালের ঘুমের আলসেমি ছেড়ে কেউ-ই ওঠে না। আসমান থেকে বজ্র নেমে এলেও তুহিন বা মাহিন কিছুতেই আসবে না দরজা খুলে দিতে। অফিস কিংবা সংসারের তাড়নায় শেফালিকেই শুনতে হয় বেল বেজে ওঠার শব্দ। আর দরজাও খুলে দিতে হয় ওকেই। দরজা খুলতেই জাহানারা-বুয়ার পানখাওয়া লালচে দাঁতের হাসি।

ভোরের শান্ত-স্নিগ্ধ-সমাহিত রূপে ফাটল ধরে জাহানারার উপস্থিতিতে। কেমন একটা উৎকট গন্ধে ভরে যায় চারপাশ। পান-জর্দা-খয়ের নাকি গুলের-গন্ধ গোত্তা থেকে থাকে সকালের নির্মল-বাতাসে। বিরক্তিতে শেফালির নাক-চোখ কুঁচকে ওঠে। কিন্তু মুখে মৃদু হাসি খেলিয়ে বলে –

‘জাহানারা আসছ? আসো, আসো। আমি তো তোমার জন্যই অপেক্ষা করতেছি।’

জাহানারা কিচেনের দিকে এগোতে থাকলে ওই গন্ধ আরো প্রকট হয়। ওর আধ-ময়লা শাড়ির ভাঁজ থেকে আরো কিছু পান-জর্দা-খয়ের নাকি গুলের-গন্ধ ভুরভুর করে বেরোতে শুরু করে। শেফালির বাসিপেট মুচড়ে বমির ভাব উঠে আসে। কী জানি কী কারণে যেন বমির-ভাব কণ্ঠনালিতে এসে থেমে যায়। অবশ্য বমি করলেও এই মুহূর্তে একবিন্দু জলও ও উগড়ে দিতে পারবে না অন্ত্র থেকে।  এই পান-জর্দা-খয়ের নাকি গুল খাওয়া নিয়ে জাহানারাকে বহুদিন লেকচার ঝেড়েছে শেফালি। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয় নাই। জাহানারা মুহূর্তে মুহূর্তে পল্টি খেয়েছে। নির্বিকারভাবে ডাহা মিথ্যা কথা বলেছে –

‘আফা কী যে কইন? গুল খামু ক্যান? আমি কি পাগলছাগল নাহি?’ 

‘দেখো জাহানারা, পান-জর্দা খাও – এই নেশা তুমার থাকতেই পারে। কিন্তু গুলডা খাও কিয়েরে?’

‘তওবা তওবা আফা। আস্তাগফিরুল্লা – কী যে কইন আফা! গুল কি কুনু খাওনের জিনিস?’

‘কিন্তু গুলের ডিব্বা তো তোমার কোমরে  গুঁজেই রাখো। অথচ ঝোড়মুছে এখন বলতেছ – গুল খাও না তুমি!’

‘খুদার কছম আপা। গুল মাইনষে কেমতে খায়? গুল তো আমি খাই না আফা – দাঁতের উপুর খালি ল্যাপ দিয়া থুই।’

‘দাঁতের ওপর লেপে রাখো? ক্যান? গুল তুমি দাঁতের ওপর দিয়ো রাখো ক্যান?’

‘আফা, বিশ^াস করেন, গুল আমি খাই না। দাঁতের উপুর লাগাইয়া থুই খালি। নাইলে হারাদিন দাঁত শিরশিরায়। গুল না দিলে শিরশিরানি কমে না। অহনে কন, দাঁতের শিরশিরানি নিয়া কি কামকাইজ করণ যায়?’

গুল দিলে দাঁতের শিরশিরানি কমে যায় – এরকম আজগুবি কথা শুনে শেফালি রাগে ফেটে পড়তে চায়। কিন্তু সমস্ত রাগ গিলে ফেলে মুখটা স্বাভাবিক করে রাখে সে।

জাহানারার সঙ্গে তর্কে জড়িয়ে কী লাভ? শেফালি ভালো করেই জানে – এই ‘গুলের নেশা’ আফিমের চাইতেও তীব্র। এই নেশা জাহানারা ছাড়তে পারবে না। আর সে-ও তা ছাড়াতে পারবে না। জাহানারার মতো বিশ^াসী-বুয়া সহসা পাওয়া যাবে না। কাবার্ড-ক্যাবিনেট-এমনকি সমস্ত ফ্ল্যাট খুলে রেখে গেলেও দুশ্চিন্তার কিছুই নাই। জাহানারা কোনোকিছুতেই হাতসাফাই করবে না। শেফালিকে না বলে এককোয়া রসুনও নেবে না ও।

বছর-শুরুর মাসগুলিতে অফিসে কাজের-চাপ থাকে অত্যধিক। জাহানারা না থাকলে সংসারের যাবতীয় কিছু গোছগাছ করে যাওয়া প্রায় অসম্ভব। এত সকাল সকাল কিচেনে ঢুকতে ইচ্ছে করে না শেফালির। জাহানারার উপস্থিতি ভোরের শান্ত-স্নিগ্ধরূপ যতই টলিয়ে দিক – কাজে বড়  দক্ষ সে। যদিও কিচেনে ঢুকেই আপনমনে একচোট গজগজ করে নেয়। শুনেও সেসব না-শোনারই ভান করে শেফালি। সিঙ্কের ওপর ডাঁই করে রাখা বাসি-বাসনকোসন দেখে কার না মেজাজ বিল্লা হবে? ধুড়ুমধাড়াম শব্দে সেসব মাজতে মাজতে কল ঘুরিয়ে জল পতনের শব্দ বাড়িয়ে দেয় ও। আর চাপা স্বরে একটানা গজগজ করতেই থাকে। শেফালি ততক্ষণে ব্যালকনি-গার্ডেনে। সকালের

কোমল-আলো ছড়িয়ে রয়েছে গাছলতার শাখায়-পাতায়। ভাতের-হাঁড়ি চুলায় বসিয়ে দিয়ে দুই-চারটা পরোটাও বেলে ফেলেছে জাহানারা। ডিম ওমলেট, সবজি, মাছের-ঝোল – ঝোলে দুই-টুকরা করে টমেটোও ফেলে দিয়েছে হয়তো।

হারভেস্ট তদারকিতে ব্যস্ত শেফালি কিছুতেই এখন কিচেনের দিকে উদগ্রীব হয়ে উঠবে না। বরং সে এখন টবের প্রতিটা গাছ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখবে। বাদামি – আধ-বাদামি-হয়ে-যাওয়া পাতাগুলি কেটে ফেলবে। শুকনা-মরাডাল যত্নের হাতে বিচ্ছিন্ন করে ফেলবে গাছ থেকে। ঝারির জলে ভিজিয়ে দেবে জলকষ্টে মিইয়ে থাকা গাছেদের কাণ্ড। গাছপালার তদারকি শেষ হলে স্নানের সময় সমাসন্ন।

স্নানঘর – বড় বিপজ্জনক স্থান!

একান্ত, নিবিড়, নির্জন, অপ্রাপ্তি, বেদনা, আনন্দ, সুখ বা দুঃখ – বুকের ভেতর লুকিয়ে রাখা জলভার উপুড় করে দেওয়ার মোক্ষম জায়গা।

অনন্ত-সময়ের মাঝখান দিয়ে অলক্ষে বয়ে যাওয়া

ভাবনা-নদী – কিন্তু সময়কে আটকে ফেলার একটা বন্দোবস্ত করেছে শেফালি।

বাথরুমের কাচের র‌্যাকগুলিতে সাজিয়ে রাখা শোপিসগুলির মাঝখানে একটা টেবিলঘড়ি বসিয়ে দিয়েছে। ঘড়ি ঠিকই কিন্তু ঘড়ির মতো দেখতে নয়। একটা থ্যাবড়ানো মুখাবয়বের নাকের ওপর দুটো-কাঁটা টিকটিক শব্দ করে ঘুরে চলেছে।

ওই থ্যাবড়ানো মুখের দিকে তাকিয়ে শেফালি সময়ের নির্ভুল হিসাব রাখতে পারে।

ক্ষতবিক্ষত-রক্তাক্ত মন, অঝোর-অশ্রুজলে ধুয়ে যাওয়া আঁখিপল্লব মেলে শেফালি দেখতে পারে – কয়টা বেজেছে এখন?

বিপজ্জনক-স্নানঘর – মনের চোরাগোপ্তা পথে ঘুরে এসে নিজের দেহটাকেও কি একেবারে নিজের মতো করে দেখতে পায় না সে? দেহের-খাঁজভাঁজ থেকে বয়স রূঢ়-হাতে তুলে নিয়েছে পেলবতা। বাথরুমের নীলরঙের টাইলসে গেঁথে থাকা আয়না নামক লম্বাটে-রাক্ষস – সে-ও তো কম দিগদারিতে ফেলে না ওকে?

আয়নার সম্মুখে একদম-নগ্ন শেফালি – মাথার ওপর

কৃত্রিম ঝরনাজলের হীরককণা ছিটকে পড়ছে। কানে বাজছে জলকল্লোল – যেন-বা পাশেই কোনো খরস্রোতা-নদী! কিন্তু আতঙ্কে দুই-চক্ষু বুজে আছে শেফালি – যেন-বা চক্ষু মেললেই একটা ধারালো ছুরি ধাই করে বিঁধবে ওর বামস্তনে। শেফালি সত্যিই ভয় পায়। আয়নায় নিজেকে দেখতে কী অসম্ভব ভয়-ই না লাগে ওর। ছি, কী বিশ্রী একটা শরীর! কী বেঢপ!

অন্তর্বাসের বেড়াজালের বাইরে হেলেপড়া-স্তনযুগল।

হালকা-কফিরঙা-বৃত্ত ঘিরে গাঢ় হয়ে থাকা বৃন্তকুঁড়ি। আহ্! সবই কেমন আভূমি নত হতে চাইছে।

যখন তুহিন জন্মায়নি, মাহিন জন্মায়নি – এই স্তনের

গড়ন-সৌন্দর্য আর দীপ্তির অপরূপ-রূপচ্ছটা কি বিস্মৃত হয়েছে শেফালি? আর ওই অপরূপ-রূপ শুধু কি শেফালিই দেখেছিল? বাদল? বাদল নয়? বাদলও দেখেছিল মাটির প্রতিমার মতো নিখুঁত এক শরীর। বাদল দেখেছিল – কনকচাঁপার-কুঁড়ি ভোর-ফুটে-ওঠার পূর্বে কীভাবে মেলে দেয় দল? মেলে দেয় তার ঘিয়েরঙা পাপড়ির সুবিন্যস্ত-সৌন্দর্য।

বাদলের পরেও দেখেছিল আরও দুই-একজন। কিন্তু ভোরে-ফুটে-ওঠা কনকচাঁপার চোখ-ধাঁধানো সৌন্দর্য উপভোগের সৌভাগ্য ওদের হয় নাই।

আয়না নামক লম্বাটে চেহারার রাক্ষস – ধারালো ও বিকট দাঁতগুলি বের করে অবিরাম হেসেই চলেছে। গত কয়েকদিন ধরে ছেলে দুটো মাঝ-রাত্তিরে ঘরে ফিরছে। মাথার ভেতর এক অদৃশ্য-যন্ত্রণায় কাবু এখন শেফালি। কাচের র‌্যাকে সাজানো শোপিসের দিকে হাত বাড়ায় – নীলরঙা বল হাতে

নীল-ডানায়-উড়ন্ত পরিটাকে তুলে আনে। আর ছুড়ে মারে আয়না বরাবর। পলকেই উড়ন্ত-পরি দিকভ্রষ্ট হয়ে মুখ-থুবড়ে পড়ে স্নানঘরের মেঝেতে। হাতের-বল ভেঙে চৌচির। পরির উড়ন্ত-ডানা-পাখনা শত টুকরো হয়ে ছড়িয়ে পড়ে সর্বত্র।

লম্বাটে-আয়নার ভেতর শেফালির দেহ স্পষ্ট হয়ে ফুটে আছে। আর ওই আয়না-রাক্ষস ঠা ঠা করে হেসেই চলেছে। একটা তোয়ালে দরকার – আপাদমস্তক ঢেকে ফেলার জন্য একটা তোয়ালে দরকার। কোথায় রেখেছে তোয়ালে শেফালি?

চর্বি-জমে-যাওয়া ঈষৎ-উঁচু তলপেট ঝুলে পড়েছে যোনির ওপর। চৈত্রমাসের বাঙ্গি-ক্ষেতের মাটির মতো বাদামি, রুক্ষ আর অজস্র ফুটিফাটা দাগে পরিপূর্ণ। অথচ একদা এই পেটই ছিল শীতকালে সর-জমে-থাকা দিঘির জলের মতো। তেমনই নিস্তরঙ্গ – টানটান। ওই সর-পড়া-জলে মৃদু-ঢেউ তোলাও তখন অসাধ্যই ছিল।

ড্রেসিং গাউনটা দ্রুত পরে নিল শেফালি। চুরমার হয়ে যাওয়া নিহত-পরির দিকে তাকানোর ফুরসত এখন নাই। অফিসে লেট হয়ে যাবে। একটা নি®প্রাণ কাঁচের-পরি খণ্ডবিখণ্ড হয়ে আছে – তাতে কার কী এসে যায়? এসে যাবে? মানুষই কি মানুষকে শত টুকরায় খণ্ডবিখণ্ড করে দেয় না? দেয় তো।

শেফালি কি জানে না – অন্যের তুচ্ছতাচ্ছিল্য, অপমান, অবহেলা আর মিসবিহেভের চাইতে অধিক ক্ষমতাধর নয় কোনোকিছুই। এমনকি এই পৃথিবীর কোনো মারণাস্ত্রও।

এই শেফালিকে কতশতবার নিহত হতে হয়েছে? ভেঙে টুকরো টুকরো হতে হয়েছে? নিজেকে কতবার শুইয়ে দিতে হয়েছে চলন্ত-রেলগাড়ির তলায়?

কিচেনে ঢুকে দ্রুত হাতে দুপুরের লাঞ্চ বক্সে ভরে নিল শেফালি। ওয়ালেট বের করে গুণে দেখলো কত টাকা আছে – এখন ঘড়িতে আটটা ত্রিশ বাজে।

আধঘণ্টায় আজ অফিসে পৌঁছানো যাবে তো? ফ্ল্যাটের চাবি জাহানারার হাতে-দিতে দিতে বলল –

‘কাজ শেষ হলে আসলামের হাতে দিয়ে যেও।’

‘আফা নাস্তা তো রেডি। খাইয়া যান একডা পরোটা।’

শেফালি এ-প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে বলে –

‘জাহানারা – যাওয়ার আগে আমার বাথরুমটা ক্লিন করে যেও।’

মুহূর্তে জাহানারার দুই চক্ষু কপালে উঠে যায় –

‘কী কইন আফা? গত পোরকাই না ধুইলাম?’

‘সাবধানে ঢুকো। স্যান্ডেল পরে নিও। ভেতরে কাচ ভাঙা আছে।’

‘কাচ? কীয়ের কাচ আফা? কাচ আইলো কইথন?’

শত প্রশ্নে হা-হয়ে-যাওয়া জাহানারার মুখ। ওই মুখ থেকে এখন তীব্রবেগে পান-জর্দা-খয়ের নাকি গুলের গন্ধ বেরোচ্ছে।

ঠিক ভোরের মতোই শেফালির অন্ত্র গুলিয়ে ওঠে। দ্রুত লিফটের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। আর নিচে নামার অ্যারো-চিহ্ন দেওয়া বাটনটিতে আঙুল চেপে ধরে।

১২.

পাকা রাস্তার-দুই-পাশে মেঘশিরীষের সারি – সুদীর্ঘ-ছায়া ফেলে চলে গেছে অনন্তের উদ্দেশে। গাছগুলি বট নয়, পাকুড় নয়, অশ^ত্থ নয় – কিন্তু সুবিশাল। বট-পাকুড়ের মতো মেঘশিরীষও ছায়াময়-মায়াময়। চওড়া-রাস্তার ওপরে ঝেঁপে নেমেছে

বৃক্ষদের-ছায়া। দুই-সারিতে বিন্যস্ত থেকেও একে অপরকে গভীরভাবে আলিঙ্গনাবদ্ধ করে রেখেছে।    

এই পথ দিয়ে যেতে যেতে গান গাইতে ইচ্ছে করে মুমুর। গলা ছেড়ে গেয়ে উঠতে চায় –

কী শোভা কী ছায়া গো

কী স্নেহ কী মায়া গো

কী আঁচল বিছায়েছ বটের মূলে

নদীর কূলে কূলে …

ভাড়া-করা-গাড়ি না হয়ে প্রাইভেট-গাড়ি হলে এতক্ষণে মুমু গেয়ে উঠতো গান। ওর সেই গান হাওয়ার-টানে-টানে ভেসে যেত বহুদূর।

পাঁচ-ছয়জনের সঙ্গে শেয়ারে না এসে ওরা দুইজন আজ আলাদা একটা অটো ভাড়া করেছে। অটোওয়ালা বয়সে তরুণ – তরুণ গাড়িয়াল শক্ত হাতে লাগাম টেনে ধরে রেখেছে। ফলে ভেসেই যাচ্ছে ওরা – নাকি পঙ্খিরাজে চেপে উড়ে যাচ্ছে?

মুমু ভাবে, অটোড্রাইভারটাকে একটু ধমকে দেওয়া দরকার। এত স্পিডে চালালে অঘটন ঘটতে কতক্ষণ? টুলকিও অস্বস্তি নিয়ে বসে আছে। ভাবছে বলবে –

‘ও মামা, এমুন হুড়াতাড়া করতাছেন ক্যান?’

টুলকি এরকম ভাবে, কিন্তু কিছুই বলে না সে। বরং মুমুই সামনের দিকে ঝুঁকে পড়ে বলে –

‘ধীরেসুস্থে সামলাইয়াসুমলাইয়া যান, মামা। উল্টাইয়া গেল তো এক্করে জন্মের মতো থাইমা যাইবেন।’

তরুণ গাড়িয়াল পেছনের দিকে মুখ ফিরিয়ে জবাব দেয় –

‘ভাইবেন না – ঠিকঠাক জায়গায় লইয়া যামু। উল্টাইয়া যামু কিয়েরে?’

কড়কড়ে রোদের দুপুর – ধীরে ধীরে গড়িয়ে নেমে যাচ্ছে বিকেলের ঢালু পিঠের দিকে। খানিক বাদেই আরেকটু গভীর খাদে পা দেবে। আর তক্ষুনি কি না ঝপাৎ করে নেমে আসবে অন্ধকার। অন্ধকার-কালোচিতা লাফিয়ে লাফিয়ে চষে বেড়াবে সারা এলাকা।

তুমুল গতির অটো-পঙ্খিরাজে চড়ে যেতে ভালো লাগছে মুমুর। গতি ভালোবাসে ও। ভালোবাসে দুরন্ত বেগে ছুটে চলা। মুমুর কথা হলো, যতক্ষণ দেহে আছে প্রাণ – ততক্ষণ তুমি দৌড়াও। দৌড়াবে। দৌড়াও মুমু – রান, রান, রান – টিল ডেথ। মুমু তো জানে ছুটে চলার আরেক নামই জীবন।

সত্যি সত্যিই দৌড়ায় ও। তেজি ঘোড়ার মতো দৌড়ায় – কেশর ফুলিয়ে, টগবগিয়ে দৌড়ায়। অলসতা মুমুর ধাতে নাই। দেহে নাই। মনে-প্রাণেও নাই। ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কতকিছুই নিয়েই না মেতে উঠতে পারে ও। মেতে উঠে জীবনের প্রতিটা পল-অণুপলকে উপভোগ্য করে তুলতে পারে।

যেমন এই মুহূর্তে মেতে আছে মেঘশিরীষের সারি নিয়ে। কে বুনে দিয়েছিল ওদের অমন সারিবদ্ধভাবে? কী বিরাটকায় দেহ ওদের! কী উদাত্ত-ছায়া! ওদের মেলে দেওয়া ছায়ার ভেতর দিয়ে গড়িয়ে গড়িয়ে যাচ্ছে অটো। ছায়াসঙ্গী গাছেদের শাখাপত্রও দেখা যায় না। ওদের দেখতে হলে অটোর বাইরে মুখ বের করে তাকাতে হবে। কিন্তু মুমু তা করতে চায় না। কোনোরকম  রিস্ক নিতে চায় না। অন্য কোনো গাড়ি ওভারটেকের মতলব আঁটলে ধাম করে মেরে দিতে পারে। ফলত সংযত থাকতে হয় মুমুকে। ডানাহীন-পঙ্খিরাজে চড়ে উড়তে উড়তে পিচঢালা রাস্তাটাই দেখতে থাকে। মুমু দ্যাখে – কীভাবে এক নিমিষে রাস্তা হারিয়ে যায়! আহা! কত দ্রুতই না ওরা পেছনে ফেলে যাচ্ছে পরিচিত পথ! হারিয়ে যাওয়া পথের রহস্যের ওপর অবলীলায় ঝরে আছে মেঘশিরীষের ফুলদল। রাস্তার মাঝখানে ঝরে পড়া ফুলেদের পাপড়ির রঙ মরাটে, কালচে। যানবাহনের চাকার অবিরাম নিষ্পেষণে ওদের রং পরিবর্তিত হয়েছে। অথচ গোলাপি-আভায় ঢাকা পড়ে আছে কালো-রাস্তার দুইধার। মুমু জানে – ঈদের সেমাইয়ের মতো সরু-সরু এসব ফুলের পাপড়ি। ফুল থেকে বিস্তর পাপড়ি ঝরে ঝরে পথকে গোলাপি রঙে উজ্জ্বল করে তুলেছে। মুমুর খুব ইচ্ছে করে গাছে ফুটন্ত ফুলগুলিকে একটিবার দেখে নেওয়ার, কিন্তু তা কোনোভাবেই পূর্ণ হওয়ার নয়। ডালপালার বেড়াজাল পেরিয়ে অত উঁচুতে ফুটে-থাকা ফুলেদের সন্ধান পাওয়া একেবারেই অসম্ভব ব্যাপার।

কোনো হেলদোল নাই টুলকির। সে আগের মতোই মৌন। অপস্রিয়মাণ পথের কথা ভেবে ও-ও খানিকটা বিষণ্ন কি না ধরতে পারছে না মুমু। হারিয়ে যাওয়া পথের জন্য হয়তো সকলেরই মন খারাপ হয়ে ওঠে।

কোনো সকালে বা দুপুরে বা নিবু-নিবু বিকেলে যখনই এই পথ পেরিয়ে গিয়েছে সবুজরঙা অলৌকিক আলো এসে চোখে ধাক্কা লাগিয়ে দিয়েছে। মুমু ভেবেছে – কেমন অবাক করা বিষয় – বৃক্ষদের ঘিরে ফুটে-থাকা আলোর রং – সবুজ।

‘যজ্ঞেশ^র অ্যান্ড কোম্পানি’র বড়সড়ো দোকানটার সামনে এসে অটোওয়ালা থেমে গেল। অবশ্য ও এমনিএমনিই থামে নাই – মুমু আগেভাগেই গন্তব্য বলে দিয়েছিল। ‘যজ্ঞেশ^র অ্যান্ড কোম্পানির’ পাশেই ‘নিউ যজ্ঞেশ^র অ্যান্ড কোম্পানির’ আরেকটা মাঝারি সাইজের দোকান উঠেছে। কিছুদিন আগেও একটা দোকানই ছিল। পিতার আমলের ‘যজ্ঞেশ^র অ্যান্ড কোম্পানি’ হয়তো ভাইয়ে ভাইয়ে অবনিবনার কারণে দুই ভাগে বিভক্ত হয়েছে। আগের ‘যজ্ঞেশ^রে’র সঙ্গে ‘নিউ যজ্ঞেশ^রে’র কোনো তফাৎ হয়েছে কি না মুমুর জানা হয় নাই। কারণ ও আর ‘যজ্ঞেশ্বরে’র শাড়িই কিনে নাই। দুই দোকানের একটিতেও যায় নাই কোনোদিন।

‘নিউ যজ্ঞেশ্বর’ থেকে সামান্য হেঁটে বাঁদিকে গেলে ‘রাধাবল্লভ অ্যান্ড কোং’। পাথরাইলের তাঁতের শাড়ির দোকানগুলিতে নামের বাহার আছে – মুমুর এইসব ভালো লাগে।

আট-দশটা দোকান পেরিয়ে একদম ভেতরে ঢুকে পড়লে ‘নীলকমলের শাড়ি’। এই ‘নীলকমলের শাড়ি’ কালেভদ্রে কিনতে পেরেছে মুমু। নীলকমলের হাতের কাজ খুব সূক্ষ্ম। আর দৃষ্টিনন্দন। এসব কারণেই নীলকমলের কাছে ফরমায়েশ আসে প্রচুর। নিত্যনতুন ডিজাইনে ফরমায়েশের শাড়ি বুনে দেয়  তাঁতি নীলকমল। খুচরা ক্রেতার কাছে ওর শাড়ি বিক্রিবাট্টা হয় না। পাইকারি ক্রেতারাও ফিরে যায়। নীলকমল ফরমায়েশের শাড়ি বুনেই দম ফেলতে পারে না। ফলে ওর কাছে খুচরা বা পাইকারি কোনো ক্রেতার আনাগোনা তেমন নাই। নীলকমলের শাড়ি চলে যায় রাজধানীর বড় বড় ফ্যাশন হাউজে।

কে-ক্র্যাফট, বাংলার মেলা, টাঙ্গাইল শাড়ি কুটির, অঞ্জনসকে শাড়ির জোগান দেওয়ার পর টুকটাক দুই-একটা শাড়ি থেকে যায়। তখন মুমুর মতো অনলাইন ব্যবসায়ীদের বরাতে সেসব জুটলেও জুটতে পারে। ফলত ‘ধরিত্রী’তে নীলকমল তাঁতির শাড়ি পাওয়াই যায় না।

‘নীলকমলের শাড়ি’ নাগালের বাইরে চলে গেলেও মুমু একটুও ভড়কে যায় না। ‘নীলকমলের শাড়ি’র কোয়ালিটি নিয়ে আরেকটা দোকানে শাড়ি মজুদ থাকে – ‘সীতানাথ রঞ্জিত শাড়ি হাউজ’। সীতানাথ রঞ্জিত সব ধরনের ক্রেতার কথা মাথায় রেখেই শাড়ি বোনায়।

‘সীতানাথ রঞ্জিতে’র পাশের দোকানটা আনন্দ ঘোষের। আনন্দ নিজের নামেই দোকানের নামকরণ করেছে – ‘আনন্দর তাঁতের শাড়ি’।

আনন্দর দোকানে এসে হাত-পা ছড়িয়ে বসে মুমু আর টুলকি। আনন্দ হাসি-খুশি-দিলদার মানুষ। দিদিমণিদের জলখাবারের আয়োজনও সে রাখে। আনন্দর দোকানে রয়েছে সব ধরনের সিল্ক, হাফসিল্ক, এন্ডি কটন, এন্ডি সিল্ক, সুতি, জামদানিসহ সবই।

আনন্দর কাছে আরো আছে ১০০ কাউন্টে বোনা খাদি। মাসলাইন কটনে বোনা তুলতুলে নরম শাড়ি। মুমু মাঝেসাঝে নিজের ডিজাইনেও শাড়ি করতে বলে আনন্দকে। বিশেষ করে ভেজিটেবল-ডাই বা ন্যাচারাল ডাইয়ের শাড়িগুলি।

আনন্দর দোকানে এলে মুমু যেন প্রকৃত-শিল্পী হয়ে ওঠে।

শাড়ির জমিনের রং পালটে দেয়। পাড়ের নকশার কারুকাজে দিয়ে বসে জ্যামিতিক ডিজাইন। অথবা মিলিয়ে দেয় ৮০-এর সঙ্গে ২০। অথবা ৬০-এর সঙ্গে ৪০ কাউন্ট।

গঙ্গা-যমুনা পাড়ে হাতি বা ঘোড়ার ছবিও বসিয়ে দিতে বলে। অথবা শুধুই ন্যাচারাল-ডাই দিয়ে লতাপাতা আঁকতে বলে দেয় তিন রঙে।

‘ধরিত্রী’র ঘরে পৌঁছালেই মুমু শাড়িগুলির নামও দেয় পাল্টে।

যেমন তরুলতা, সরলা, অলকানন্দা, সুরঞ্জনা বা কবি জীবনানন্দ দাশের কবিতা থেকে ধার করে মুমু শাড়ির নাম রাখে – ‘একটি ধূসর কবিতা’।

১৩.

রোজ-ই দুইটা করে মিল লিখে রাখা হয় বকুলের নামে। চৌকোনা ঘর-কাটা-রেজিস্টার্ড খাতায় মোছাম্মত বকুল বানুর পাশে লেখা থাকে ১, ২, ৩। ২ সংখ্যাটির ওপর টিক চিহ্ন দিয়ে রাখে হোস্টেল-সুপার নিগার সুলতানা। অবশ্য এই টিক চিহ্ন এমনিএমনি মেলে না। রাতের খাওয়া হয়ে গেলে পরদিনের মিলের জন্য সিøপ পাঠাতে হয় কিচেনের খালাম্মা সুফিয়া আক্তারের কাছে। ওই সিøপেই লিখে দিতে হয় কোন বোর্ডার আগামীকাল কয় বেলা খাবে কিংবা খাবে না। এভাবেই মাথা গণনা করে খাবার রান্না হয় নিবেদিকার ডাইনিংয়ে। কারো ভুলোমন কোনোদিন সিøপ পাঠাতে ভুলে গেলে সাড়ে সব্বোনাশ! সেদিন তার উপোস অনিবার্য হয়ে পড়ে। শুকনো খাবারে দিন চলে যায় – পাউরুটি-কলা, দুধ-বিস্কুট, খেজুর-আপেল ইত্যাদিতে। যেসব বোর্ডারের আয় উঠতির দিকে – তাদের জন্য চলে আসে ফুডপান্ডার ডেলিভারম্যান।

ভুলোমন-বকুল সিøপ পাঠাতে ভুলে গেলে সে নির্জলা-উপোস কাটায়। ওর ভালো লাগে না অফিস থেকে ফিরে ওইসব শুকনো খাবার। পাউরুটি-কলা-দুধ-আপেল-খেজুর – এসবই রোগীদের পথ্য। ফলে দানাপানিহীন রাত কাটে বকুলের।  খাওয়া আর না-খাওয়া সমান ওর কাছে। কিন্তু বেঁচে থাকার তাগিদ আছে বলে খেতেই হয় – আর না খেলে মরে যেতে হয় – এই তো জীবনচক্র!

ছয়টা ঋতু যেভাবে ঘুরেফিরে আসে – তেমনই চক্রে জীবন বন্ধক পড়ে আছে। সকাল-দুপুর-রাত। রাত-সকাল-দুপুর। ফের দুপুর-রাত-সকাল। নির্দিষ্ট সাইকেলে ঘুম। নির্দিষ্ট সাইকেলে জেগে ওঠা। খাওয়া-দাওয়া – ঘুরে-ফিরে একই নিয়ম আর কানুন। কানুন আর নিয়ম। মাসের যে কয়টা দিন যোনিপথে রক্তারক্তির অস্বস্তি – তাও তো চক্র মেনেই হয়। নির্দিষ্ট একটা চক্র মেনেই চলে। হয়তো দুই-চারদিন এদিক-ওদিক হতে পারে, হয়-ও। কিন্তু চক্রটা তো নির্দিষ্ট। মাঝেমধ্যে দমবদ্ধ হয়ে আসতে চায় বকুলের। কেন এত নিয়মের নিগড়? নিয়ম করে সূর্য আর চন্দ্র। দিবস আর রজনী। আলো-অন্ধকার। এমনকি জীবনযাপনও। নিয়ম করে নিত্য অফিস। নিয়ম করে হপ্তার ছুটি। স্নানাহার – সবই নিয়মের নিগড়ে কঠিনভাবে বন্দি!

ধুস্! এত্তসব নিয়মকানুন বকুলের ভালো লাগে না। ওর মনে হয় গলা জুড়ে ফাঁসির রজ্জু পেঁচিয়ে রয়েছে। এক্ষুনি কেউ এসে, কোনো হন্তারক – রজ্জুর দুইদিক থেকে কষে দেবে টানে। নিয়মের বেড়াজাল অসহ্য লাগে বলেই কাউন্দিয়া থেকে পালিয়ে এসেছিল। অবশ্য পালানোর পূর্বে মালিহা খাতুনের দুই-একপদ গহনা সরাতে ভুলে নাই।

আম্মার গহনা সরানোর দরকার ছিল না – বকুল চাইলে এমনিতেই দিয়ে দিতো। পালানোর পর যেমন দিয়েছিল জমিয়ে রাখা এক-থোক-টাকা।

কাউন্দিয়া গ্রামে তখন ভোরের-আলো ফুটি-ফুটি করছে। বকুলের হাতে একেবারে সময় ছিল না। থাকলে হয়তো আম্মার গোলাপবালা আর গলার হাঁসুলিটা ফেরত দিয়ে আসতো। এত তাড়াহুড়া – বাসের ফার্স্ট-ট্রিপ ধরতে হবে ওকে। কাউন্দিয়া থেকে সরাসরি বাস যায় রাজধানী ঢাকা শহরে। সত্যিই বড় তাড়া ছিল বকুলের। পলায়নপর বকুলের হাতে সম্বল বলতে চুরি করা মায়ের গহনা আর বিএ পাশের সার্টিফিকেট। এসব নিয়েই ও ছুটেছিল কাদেরাবাদ হাউজিং সোসাইটির একটা ফ্ল্যাটের উদ্দেশে। যে ফ্ল্যাটে থাকে বকুলের সৎ-ফুপু শেফালি।

ছুটির দিন বলে বাসাতেই ছিল ও। বকুলকে দেখামাত্রই সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছিল শেফালির চোখেমুখে। কিংবা ঘোর-আষাঢ়ের কাজলরঙা-মেঘ। ফুপুর এরকম চেহারা – বিপন্ন বোধ করেছিল বকুল। বড় অসময়ে অস্থানে এসে পড়লাম নাকি?

চেহারা থেকে মেঘের আস্তর বিন্দুমাত্র না সরিয়েই শেফালি বলেছিল –

‘এরকম হুট করে চলে এসেছিস কেন? আসার আগে জানিয়ে আসতে হয় না?’

বকুলের মনে-মুখে অজস্র কথার-খই; কিন্তু সে কি না একটা শব্দও উচ্চারণ করতে পারলো না!

ফের সেই গম্ভীর স্বর –

‘জরুরি কোনো কাজে এসেছিস? কাজ থাকলে থাকতে পারিস দুই-একদিন। জানিস তো আমার একলার সংসার। ছেলেরাও বড় হয়ে উঠেছে। আর আমাকেও তো অফিস করতে হয়।’

বকুল প্রাণপণ চেষ্টাতে বলতে পেরেছিল –

‘ফুপু – আমি একটা কাজ পেলেই চলে যাব।’

শেফালি তাচ্ছিল্যের দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলেছিল –

‘কাজ? ঢাকা শহরে কাজ আর টাকা দুইটাই হাওয়ায় ওড়ে – এরকমই ভাবিস নাকি তোরা?’

বেলেমাছের মতো সাদাটে চেহারার বকুল। হাতের ব্যাগটা যদি কোথাও লুকানো যেত? এরকম ঝোঁকের বশে কেন পালিয়েছে ও? আর পালিয়ে এই বাসায় এসে উঠেছে কেন?

শেফালি তো ওর আপন ফুপু নয়। আব্বা জুবায়েরকে সঙ্গে নিয়ে দাদি সামসুন্নাহার নিকে বসেছিল আব্দুল খালেকের কাছে। সামসুন্নাহার আর আব্দুল খালেকের কন্যা শেফালি – বকুলের শেফালি ফুপু।

বকুলের জন্মের আগে নাকি আব্বা চম্পাকে পাঠিয়েছিল এই শেফালিফুপুর কাছে। আব্বার ইচ্ছে – ফুপুর কাছে থেকেই পড়াশোনা করুক চম্পা। কিন্তু শেফালিফুপু ফেরত পাঠিয়ে দিয়েছিল চম্পাকে। ফলে চম্পাকে কাউন্দিয়ার স্কুল-কলেজেই পড়তে হয়েছে। এতটুকুই বলেছিল আম্মা মালিহা খাতুন। কেন বা কী জন্য চম্পার ঠাঁই হয় নাই শেফালির বাসায় – এ নিয়ে বকুলেরও আগ্রহ ছিল না। বকুলও আম্মার কাছ থেকে এসব কথা জানতে চায় নাই। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে – সবকিছু জেনে আসা  উচিত ছিল। না-জেনে ভুল করেছে ও।

আদতে বকুলের আগ্রহ কম। কমই। এত নিয়মের-নিগড় ওর ভালো লাগে না। ভালো লাগে না বলেই তো কাউন্দিয়া থেকে পালিয়েছিল। বড় দুইভাই জাফর আর আসগরের না-হক খবরদারি থেকে বকুল পালিয়েছিল।

এমনকি যৌবনের প্রথম প্রেমিক রাহাতের কাছ থেকেও নিগড় ভালো লাগে না, ভালো লাগে না। বকুলের কাছে সমস্তকিছুই অসহ্য ঠেকে। নিয়মের নিগড় বড় ওজনদার। নড়ানোচড়ানো যায় না। ওই নিগড় নড়াতে গেলে, সরাতে গেলে ঝনঝন শব্দে বেজে ওঠে। ঠিক ঝনঝন শব্দে বেজেও ওঠে না – আদতে ঝনঝন করে ভেঙে পড়ে। পুরাতন যতকিছু – বদলাতে গেলেই মুসিবত। ভাঙতে গেলে আরো মুসিবত। তুমি ভাঙো – ভাঙতে তুমি পারোই – সে অধিকারও তোমার আছে – কিন্তু ভেঙে দেখো – একপাল শেয়াল-কুকুর তোমাকে ক্রমাগত তাড়া করে ফিরবে।

ভেঙেচুরে নতুন পথের দিকে কে তোমাকে যেতে দেবে? কেউ দেবে না। কেউ-ই নয়। এই সব কি বকুল জানে না? খুব ভালো করেই জানে ও এখন।

‘নিবেদিকা কর্মজীবী মহিলা হোস্টেলে’র গেটকিপার সাদ্দামও হয়ে ওঠে রক্ষক। রাত নয়টা বাজলো কি বাজলো না – হোস্টেলের গেট সশব্দে বন্ধ হয়ে যায়। অতঃপর ওতে ঝুলতে থাকে মস্ত এক তালা। রাত্রি নয়টা – যেন শেষ বিচারের শেষক্ষণ। নয়টাকে সামান্য এদিকওদিক করে কেউ ঢুকতে চাইলে সাদ্দাম হোসেনের মুখ অন্ধকার। যেন মাত্রই আসমানের আলোকিত চাঁদ পড়লো গ্রহণের কবলে। এই হোস্টেলের বোর্ডারদের সে-ই তখন অভিভাবক। নকিদারি-খবরদারি করার একমাত্র মালিক।

নতুন চাকরিতে জয়েনিংয়ের পর বকুলের রাত্রি শুধু গড়বড় হয়। নয়টা হয়ে যায় দশটা। সাদ্দাম হোসেন বদ্ধ হয়ে যাওয়া দরোজার কপাট খোলে ঠিকই; কিন্তু উঠে আসা হুংকার গিলে ফেলে।

এ-কথাও তো সত্য যে, নতুন চাকরিতে ঢোকার ছয়মাসের মাথায় বকুল বড়ই অস্থির। বড়ই টালমাটাল। বকুলের মনে কত কী – দিবারাত্রির প্রতি ক্ষণে ও ভেবে মরছে। ভেবে সারা হচ্ছে ওর চাইতে দ্বিগুণ বয়সী এক লোককে নিয়ে।

‘দৈনিক বিভাবসু’র সহকারী সম্পাদক আল মোসাদ্দেক। কী তুখোড় তার ব্যক্তিত্ব! কঠিন-গাম্ভীর্যের বাহুল্য যেন তাকে করে তুলেছে অনেক বেশি মর্যাদাবান।

আল মোসাদ্দেকের হাত লম্বা না হলে এরকম বড় পত্রিকায় কিছুতেই কাজ জোটাতে পারতো না বকুল। ‘দৈনিক রূপসা’র মতো তৃতীয় শ্রেণির পত্রিকায় আরো বহুকাল ওকে পড়ে থাকতে হতো। ভালো একটা চাকরির জন্য ফ্যা ফ্যা করে ঘুরতে হতো এই রাজপথের কানাগলিতে। আর মাড়াতে হতো আরো কত পঙ্কিলপথ – কে জানে?

এক পায়ের ওপর ভর করে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলতে হতো। আর এইভাবে জীবনকে টেনে নেওয়া – কী যে ভয়াবহ! শুধু ভয়াবহ নয়, বিপজ্জনকও বটে! যে টেনে নেয় – সে-ই শুধু তা জানে। বকুলও কি কম জানে? নিজের দুইপায়ের ওপর ভর করে চলতে না পারলে কতকিছুই না অপূর্ণ থেকে যায় একজীবনে। এই পৃথিবীর কতকিছুই না থেকে যায় অধরা।

একটা ভালো চাকরি, মোটা অঙ্কের বেতন – তিনবেলার স্বাদু-খাদ্য – কত দ্রুতই না বদলে দিতে পারে কতকিছুই। এমনকি অতিচেনা, অতিঘরোয়া জীবনও আমূল বদলে যায় টাকাপয়সার টঙ্কারে।

১৪.

দেয়ালঘড়ির ছোট্ট কাঁটা ঠিক নয়ের ঘরে স্থির হয়ে আছে। যেন কোনো কালো রঙের ফড়িং স্থির হয়ে বসে আছে কচুরিপানার ফুলের ওপর। ফড়িংয়ের কালো ডানাটি সামান্য বেঁকে গিয়ে স্পর্শ করেছে বারোর ঘর। সকাল নয়টা। খানিক বাদেই সময় নামক ঢেউয়ের তোড়ে ভেসে যাবে কচুরির ল্যাভেন্ডার-রঙের-ফুল। ভেসে যাবে কালো ফড়িংটিও। আর ওর একটা ডানা বারোর ঘর ফেলে ডান দিকে ঘুরতে শুরু করবে দ্রুত।

বেশ জোরে শব্দ করে দীর্ঘশ^াস ফেলে শেফালি। একেবারে ঘড়ির কাঁটায় কাঁটায় অফিসে পৌঁছেছে সে। নিজের ডেস্কের দিকে এগোতে এগোতে দেখে অফিসের প্রায় সবাই ইতোমধ্যে এসে পড়েছে। এখন নিজের ওপরই রাগ জমে ওঠে শেফালির –

ইস! আমি কেন এরকম? কেন আমি একদিনও ওদের আগে এসে ঢুকতে পারি না অফিসে? কেন?

স্নানঘরে নিহত-পরির কথা মনের ভেতর লাফঝাঁপ দিয়ে উঠলেও শেফালি নির্বিকার। অফিসে ঢোকার পর একেবারে অচেনা এক শেফালি। রাগ-ক্ষোভ-দুঃখ-বেদনা আর অপ্রাপ্তির বুঁদবুঁদ যতই মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে চাক না কেন – কেউ ধরতেও পারবে না শেফালির মনের অবস্থা। আদতে সে-ই বুঝতে দেবে না কাউকে। বরং চোয়াল শক্ত করে নিজের চেয়ারে জুত হয়ে বসবে। সাব-অর্ডিনেটকে বলে দেবে এক কাপ গ্রিনটি এনে দেওয়ার কথা। কফি কালারের লিপস্টিক লাগানো ঠোঁট-জোড়াতে রহস্যময়-হাসি খেলিয়ে ল্যাপটপ ওপেন করবে।

বছরের শুরুতে কেরোসিন-অবস্থা শেফালির। অত্যধিক কাজের চাপ। আমেরিকার একটা ভলান্টারি অ্যাসোসিয়েশন ওল্ড এইজ পিপলের জন্য কিছু ডলার ডোনেট করতে চাইছে। কিন্তু ওরা তো যাচাইবাছাই না-করে, সরেজমিনে না-দেখে কিচ্ছু দেবে না। ওই অ্যাসোসিয়েশনের লোকজন এসে দেখতে চাইছে শেফালির অফিস প্রকৃত পক্ষেই ওল্ড এজদের জন্য কোনো কাজ করছে কি না? বা অফিস ওদের প্রতি আন্তরিক কি না?

না-দেখে না-জেনে এক ডলারও দেবে না ওরা। সেসব নিয়েই মেইল চালাচালি করতে হচ্ছে। আর এই মেইল চালাচালির দায়িত্ব এসে বর্তেছে শেফালির ঘাড়ে। সিনিয়র কর্মকর্তা হিসেবে অফিসের গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলি ওকেই দেওয়া হয়। শেফালি জানে – কত কাগজপত্র চালাচালির পর কিছু বিদেশি-মুদ্রা

অফিস-ট্রেজারিতে জমা হয়। এজন্য কাঠখড় যা কিছু সেসবের বেশির ভাগই জোগাড় করতে হয় শেফালিকেই। দুই-একটা ইমেইলের জবাব পাঠিয়ে শেফালি উঠে পড়ে। একবার ওয়াশরুমে যাওয়া দরকার। সকালের ঘটনাটা এখনো মাথার ভেতর পেরেকের মতো বিঁধে আছে। ধুর – এখন কাজের সময় – ব্যক্তিগত টানাপড়েনের আবর্জনা থেকে দূরে থাকতে চায় ও। দূরে থাকেও শেফালি। ল্যাপটপ ওপেন করলেই সে একেবারে অন্য মানুষ। কাজের ব্যস্ততায় নিজের দিকে দৃষ্টি দেওয়ার অবকাশ আর নাই।

ওয়াশরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে ফিরতেই পাশেল ডেস্কের রুলি রহমান জোরে চিৎকার করে ওঠে –

‘আপা – এত রক্ত!’

‘রক্ত’ শুনে শেফালিও প্রচণ্ড চমকে ওঠে। রক্ত – কীসের রক্ত? রক্তের ঢল-নামা মাসগুলি অতিক্রান্ত হয়েছে সেই কবে। তা বছর পাঁচেক তো হবেই। তাহলে হঠাৎ রক্ত এলো কোথা থেকে?

ভ্যাবাচ্যাকা অবস্থার ভেতর শেফালি – কোথায় রক্ত? সে তো সদ্যই ওয়াশরুম ঘুরে এলো। রক্ত তো কোথাও দেখতে পেল না।

ইতোমধ্যে রুলি কাছে এসে দাঁড়িয়েছে। রুলির পাশে অফিস কলিগ আনিস। তপন এবং ইদ্রিসও। বেশ ভালোরকম বিব্রত শেফালি। এত লোকজন জড়ো হয়ে গেল এক লহমায়? কিন্তু কোথায় রক্ত? শেফালি কি জানে না – পুষ্পহীনারা আর কোনোদিনই রক্তপলাশ ফোটাতে পারে না। মাথা কুটে মরে গেলেও শেফালিও পারবে না। শেফালির যোনিদ্বার দিয়ে আর কোনোদিন একফোঁটাও রক্তও চুইয়ে পড়বে না। এবং একফোঁটা রক্তের জন্য যদি সে ফাঁসির রজ্জুতেও ঝুলে পড়ে – তবু ফুটবে না একটাও পলাশফুল। কিংবা ফোটাতে পারবে না শিমুলের একটা গাঢ়-লাল মখমলি-পাপড়ি।

ভয়ে, সংকোচে শেফালি নিজের পেছন দিকেও তাকাতে পারছে না। কিন্তু তবুও সে আড়েঠাড়ে তাকায় – দেখার চেষ্টা – করে রক্তধারা নামছে কোথা থেকে? পাংশুটে চেহারা করে রুলি পাশে দাঁড়িয়ে। আনিস বলে ওঠে –

‘সাতসকালেই এরকম কাটাকাটি কীভাবে করে আসলেন, আপা?’

‘কী বলেন? কীসের কাটাকাটি?’

রুলি বলে –

‘আপা – আপনর সালোয়ার তো রক্তে ভিজে গেছে।’

ফের বিব্রত শেফালি। ভারি এক মুসিবতে পড়া গেল দেখছি – সালোয়ারে রক্ত!

রুলি বলে –

‘দেখি আপা কতটা কেটেছে?’

বলেই নিচু হয়ে শেফালির ডান পায়ের সালোয়ার উঁচু করে তুলে ধরে।

উফ! এতক্ষণ বাদে যেন দম ফিরে পায় শেফালি। পায়ের দিকে তাকিয়ে দেখে সালোয়ারের নিচের অংশ রক্তে প্রায় ভিজে গেছে।

‘আয়-হায়। আপা – এতখানি কেমনে কাটলো?’

‘আমি তো বুঝতেই পারি নাই।’

‘কী বলেন? ধারালো কিছুতে পা দিছিলেন নাকি? এত কাটছে – অথচ বলতেছেন আপনে কিচ্ছু জানেন না।’

‘সত্যি রুলি – কেটেছে যে আমি একদম টের পাই নাই।’

শেফালির ডান পায়ের গোড়ালির ওপরের অংশ ভালোরকম কেটে আছে। ঝট করে মনে পড়ে – এইটা তো ওই কাচের পরির কাণ্ড! উড়ে এসে কোন সময় যে সে তার ভাঙাডানা দিয়ে হ্যাঁচকা টান মেরে গেছে?

নি®প্রাণ-পরিরাও তাহলে হিংস্র হয়? নিহত হলেও বদলা নেওয়ার কথা ভোলে না? শেফালি নিজেও কী কিছুটা তেমন নয়?

আচ্ছা, জাহানারা কাচগুলি ভালো করে তুলতে পারছে তো? নাকি বাসায় ফেরা মাত্রই শেফালি পুনরায় পড়বে ওই পরির খপ্পরে! কীসব কাণ্ড!

অফিস শোরগোলে ভরে আছে – শেফালি আপার পা কাইটা রক্ত পড়তাছে – উনার খবর নাই।

‘তুলা নাই? ডেটল নাই? স্যাভলন ক্রিম?’

‘সময়মতো হাতের কাছে কিচ্ছু পাওয়া যায় না।’

ম্যানেজার এলে শোরগোল আরো বেড়ে যায় –

‘তোমাদের কতবার বলছি – ফার্স্ট-এইড-বক্সটা হাতের নাগালে রাখতে – কথাই শোনো না কেউ তোমরা।’

‘ডাক্তারকে কল করো। ডাক্তার ফরহাদ কি আজ একবারও অফিসে আসে নাই?’

রুলি ফ্লাস্ক থেকে গরমজল এনে শেফালির ডান পা-টা ভালো করে ধুয়ে দেয়। ডাক্তার ফরহাদও চলে এসেছে।

শেফালির পা ভালো করে দেখেটেখে বলে –

‘আরে নাহ্ অত গভীরভাবে কাটে নাই। আঁচড়টা ডিপ – তাই চুঁইয়ে চুঁইয়ে ঝরছে।’

আয়োডিনের বোতল ঝাঁকিয়ে তুলার বল ভিজিয়ে নেয়। হলুদাভ-কালচে রঙে ডুবে যায় তুলার শুভ্র বরণ। তুলার ওপর এখন ব্যান্ডেজ হবে। ফরহাদ যত্ন করে শেফালির পা পেঁচিয়ে দেয় গজ দিয়ে।

অফিসের সবাই গোল হয়ে দাঁড়িয়ে ডাক্তারের ব্যান্ডেজ বাঁধা দেখে।

সহসা রুলি বলে ওঠে –

‘ইয়াল্লা – শেফালি আপার পা এত ছোট? একদম বালিকার মতো।’

ফরহাদ হেসে ফেলে। ব্যান্ডেজ বাঁধা শেষ করে বলে –

‘ঠিক বলছো – আপার পা বালিকার মতোই।’

শেফালি বজ্রাহত হয়ে বসে থাকে। ওর শারীরিক ত্রুটি নিয়ে আজো কথা ওঠে? বাদলও তো কম বলতো না – কম উচ্চতা, ছোট ছোট হাত-পা নিয়ে কম কটাক্ষ করতো  না।

‘আল্লা শেফালি – কীরকম ছোট ছোট হাত-পা তুমার? চীনদেশের মাইয়াগো মতো।’

শেফালি বলতে চাইতো –

‘হাত-পা ছোট হলে বা অসুন্দর হলে বুঝি চীনদেশ পাঠিয়ে দিতে হয়?’

কিন্তু শেফালি চুপ করেই থাকতো। জবাব দিলেই শুরু হয়ে যাবে গালিগালাজ।

শেফালি তাই উল্টা করে বলতো – ‘চীন দেশের মাইয়ারা কিন্তু খুব সুন্দর। ব্যালে ড্যান্স করতে পারে।  ওরা খুব গোছানোও হয়।’

‘হ। সেইটা ঠিক বলছো।’

‘কী ঠিক?’

‘ক্যান চীন দেশের মাইয়ারা। তবে ওগো কিন্তু বুক নাই। দুল্লা দুল্লা বুক।’   

স্তব্ধ হয়ে বসে থাকতো শেফালি। এই লোকটা কতটা স্থূল? যৌনতার বাইরে যে চীনা নারীদের দেখতেই শেখে নাই!

বাদল ফের বলতো –

‘তুমারও হাত-পাও ছোট; কিন্তু বুক দুইটা তো সেইরকম। চীনাদের মতন না। চীনাগো মতন দুল্লা-দুল্লা-বুক তুমার হইলে আমি রাইতে বাসায়ই আসতাম না।’

ডাক্তার ফরহাদ খসখস করে প্রেসক্রিপশন লিখছে –

‘আপা – দুই-তিনদিন ছুটি নেন। পা-টাকে রেস্ট দিতে হবে। আর কোনো ফার্মেসিতে গিয়া ড্রেসিং চেঞ্জ কইরেন। ধুলাবালি একদম লাগানো যাবে না।’

নিহত পরির এত ক্ষমতা? আগে জানলে পরিটাকে কিছুতেই আছড়ে ফেলতো না শেফালি।