মান-সম্মান

ফারুক মঈনউদ্দীন

 

লিফটের সামনে অনেক লম্বা সারি। একেকবার লিফট নেমে এলে পিলপিল করে লোক ঢুকে পড়ছে, ঠেলেঠুলে শেষ লোকটি ওঠার পর লিফটের দরজা বন্ধ হয়ে আবার নাট্যমঞ্চের পর্দার মতো দুপাশে খুলে যায়। তখন ভেতরে টুলে বসা লোকটা বিরক্তিতে উঠে দাঁড়ায়, এই যে লাস্টে কে উঠসেন, নাইমা যান, ওয়েট বেশি। সবশেষে ওঠা লোকটি তার আশপাশের লোকদের দিকে তাকিয়ে খোঁজার ভান করে কে উঠেছে তার পরে। কয়েকজন লোকটার দিকে তাকিয়ে বলে, এই যে ভাই আপনি লাস্টে উঠসেন, নাইমা যান। লোকটা বিকারহীন দাঁড়িয়ে থাকলে লিফটম্যান বলে, থাকেন তয়, লিফটও যাইব না। তখন ভেতরে দাঁড়ানো যাত্রীরা সমস্বরে, কী, কথা কানে যায় না? আজব মাল তো? এসব কথা বলে লোকটিকে প্রায় ঠেলে বের করে দিলে লিফটের দরজা যেন অনিচ্ছা সত্ত্বেও বন্ধ হয়। অপেক্ষমাণ

মানুষের সারির বাইরে দাঁড়িয়ে বেশ কিছুক্ষণ ধরে রেহানউদ্দীন আর নাজের আলী কয়েক দফা এরকম কায়-কারবার দেখে আপনমনে হাসে। দুজনই প্রায় একসঙ্গে মজা পেয়ে হাসে বলে কেউ কাউকে হাসির কারণ জিজ্ঞেস করে না।

এ মুহূর্তে ওদের হাতে করার মতো তেমন কোনো কাজ নেই। এই বিল্ডিংয়ের ছয় তলায় মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয়ে এসেছিল ওরা। ওদের গ্রামের ছেলে মনিরুল মন্ত্রণালয়ের সচিবের পিয়ন। ওর কাছেই আসা, সচিব সায়েবকে ধরে ওদের দুজনেরই ছেলের জন্য কিছু একটা চাকরির ব্যবস্থা করা যায় কি না, সে আশ্বাস দিয়েছিল মনিরুল। সরকারি অফিসের চাকরি পাওয়ার পর ছুটিছাটায় গ্রামে গেলে মনিরুল বেশ ভাব নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। গত ইলেকশনে সরকার পরিবর্তনের পর মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয়ে কাজ করে বলে মনিরুলের ভাব আরো বাড়ে। সেবার বেশ কদিন পরে গ্রামের বাড়িতে এসে বলে, মুক্তিযুদ্ধের সরকার আসিছে ক্ষমতায়, আমাগের মন্ত্রণালয়ের কাজকামও মেলা বাইড়ে গেছে। বারেকের চায়ের দোকানে বসে গ্রামের ছেলে-ছোকরাদের নিজের অফিসের গল্প শোনায়, এ্যাহন যে-সচিবসাব আইসে বুইছিস, খান সেনার সাতে যুদ্ধ করা মানুষ। একলা থাকলে আমারে ডাইকে নে যুদ্ধের গল্প শোনায়। বলে, যুদ্ধ কইরে দেশ স্বাধীন করলাম মনিরুল, এত বছর অয়ে গেল, এ্যাহনো অনেক কাজ বাকি। দেশের সোগ্গলে যদি সৎ থাহে, তাহলি আমরা আরো উন্নতি করতি পারতাম। আরেকদিন কলো, আমরা যদি যুদ্ধ না করতাম, আমি আর সচিব হতি

পারতাম না, তুমি মনিরুল সরকারি চাকরি পায়ে দুডো পয়সার মুখ দেখতি পাইরতে না, তোমারে গ্রামে বইসে লাঙ্গল ঠেলতি অতো।

কে একজন ফোড়ন কাটে, উরি বাবা, তোর সাতে সচিবসায়েব অত কতা কয়?

মনিরুল একথার সরাসরি জবাব দেয় না, বলে, শোন, সচিবসায়েব আমারে কিরাম ভালবাসে জানিস না তো!

– শুদু তোরে ভালবাসে ক্যান? আর কেউরে পছন্দ করে না?

– ফালতু কতা কচ্ছিস ক্যান? আমি বলিসি যে শুদু আমারে পছন্দ করে? ওরাম মাটির মানুষ সোগ্গলরেই পছোন্দ করে।

– ও আচ্ছা, আমি ভাবলাম শুদু তোরে পছোন্দ করে।

মনিরুলের কথাবার্তা শুনে নিজেদের দীর্ঘ লালিত অথচ প্রায়বিস্মৃত যুদ্ধকালীন ভূমিকার কথা স্মরণে এলে রেহানউদ্দীন আর নাজের আলী পরস্পরের মধ্যে স্বপ্নমাখা দৃষ্টিবিনিময় করে। গ্রামের ছেলে মনিরুলের বড়সায়েব মুক্তিযোদ্ধা জেনে অপরিচিত সফল মানুষটির সঙ্গে এক ধরনের একাত্মতা অনুভব করে দুজনই। মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয়ের সচিবের খাস লোক বলে ক্ষণেকের জন্য মনিরুলও যেন তাদের কাছে গ্রামের ছেলের অধিক আপন হয়ে ওঠে। মনিরুলের কথাগুলো কিংবা ওর বন্ধুদের ঠাট্টা-ইয়ার্কি ওদের কান পর্যন্ত পৌঁছয় না। উনিশ-বিশ বছরের যুবা বয়সে ওরা দুজন যখন যুদ্ধে যাওয়ার জন্য আরো কয়েকজনের সঙ্গে একরাতে বাড়ি ছাড়ে, তখন এমনকি তাদের চোখে দূরাগত কোনো স্বপ্নও ছিল না, কোনো হিসাব ছিল না চাওয়া-পাওয়ার। পাকসেনাদের নির্বিচার হত্যা আর নির্যাতনের বদলা নেওয়াই ছিল তাদের একমাত্র লক্ষ্য। আর সেটা করতে গিয়ে আস্ত এক বিশাল দেশের পরিচয় বদলে ফেলতে যাচ্ছে সেটুকুও বোধকরি তাদের কল্পনায় ছিল না।

এত বছর পর যুদ্ধের দিনগুলোর কথা যখন বহুদূর থেকে শুনতে পাওয়া ধ্বনির মতো হয়ে এসেছিল, তখন মনিরুলের বড়সায়েবের সফল জীবন কিংবা যুদ্ধপরবর্তী পরিস্থিতি নিয়ে আক্ষেপের কথা তাদের ভেতরের মলিন আবরণ সরিয়ে তুলে আনে যুদ্ধদিনের স্মৃতি।

মনিরুলের বন্ধুরা ওকে খুঁচিয়ে যখন প্রায় কোণঠাসা করে ফেলে তখন রেহানউদ্দীনের ডাকে যেন কূল পায় ছেলেটা, অ মনিরুল, কোন সেক্টরে যুদ্ধ করিসিল তোর সায়েব, জানিস?

এই দুই বয়স্ক মানুষের মনোযোগ পেয়ে মনিরুলের মিয়োনো ভাব আবার জেগে ওঠে। নিজের জায়গা ছেড়ে ওদের সামনের বেঞ্চে গিয়ে বসে বলে, তা তো জানিনে কাহা। ইবার যায়ে জিজ্ঞেস করবানে। বড় সায়েবরে অত কতা জিজ্ঞেস করা যায়, কনদি?

পেছন থেকে কে যেন ফোড়ন কাটে, তোরে অত ভালোবাসে গপ্পো দিলি, অত কতা জিজ্ঞেস করলি অসুবিধে কি?

মনিরুল খিঁচিয়ে ওঠে, শালা আঙুল দিচ্ছো না? আরে শালার বিটা, খামোখা জিজ্ঞেস করতি যাব কোন সেক্টরে যুদ্ধ করিছিল?

ছেলেগুলো হ্যা হ্যা করে হাসে।

রেহানউদ্দীন ওদের বলে, মিছেমিছি ওরে খ্যাপাচ্ছিস ক্যান? অ মনিরুল, তোর সায়েবরে কয়ে আমার ছাওয়ালডার একটা কিছু ব্যবস্থা কইরে দিতি পারিস বাপ?

মনিরুল এই নতুন আবদারে একটু থমকে যায় কিছুক্ষণের জন্য, তারপর সামলে নিয়ে বলে, সায়েবরে কবানে যায়ে। ইন্টার পাশ করিসে না আপনার ছাওয়াল?

– হ, বি কম তো ভর্তি অলো।

নাজের আলী এতক্ষণ চুপ করে ছিল, এরডা হলি পর আমারডার কিছু একটা করা যায় কি না দেহিস ক্যানে। গার্মেন্ট কারখানায় কাজের কোনো ভবিষ্যৎ আছে নিহি?

মনিরুল চেহারায় দু-দুটো তদবিরের গাম্ভীর্য, যেন চাকরি তো দেওয়াই যায়, কোথায় পোস্টিং দেবে সেটাই ভাবনার বিষয়। কিছুক্ষণ চিন্তা করে বলে, ও আপনাগের জন্যি তো মুক্তিযোদ্ধার কোটা আছে। আমি অফিসে যায়ে আলাপ কইরে জানাবানে। আমারে মাঝে-মাঝে মনে করায়ে দিতি অবে কলাম, ঢাকা গেলে কাজের ঠেলায় মনে নাও থাকতি পারে।

সেদিন মনিরুলের মোবাইল ফোন নম্বর নিয়ে রেখেছিল ওরা, যাতে মনে করিয়ে দিতে পারে।

এর পর মনিরুল ব্যস্ত ভঙ্গিতে উঠে যায়, বলে, যাই গো কাহা, মেলা কাম পইড়ে আছে।

সেদিনের পর কয়েক মাস কেটে গেলেও মনিরুলের কাছ থেকে কোনো নির্দিষ্ট খবর পাওয়া যায় না। ফোন করলে নানান ঝামেলা, সচিবসায়েবকে কায়দামতো ধরা যায়নি – এসব ছাড়া নতুন কোনো খবর দিতে পারে না ও। নাজের আলী রেহানউদ্দীনকে বলে, এ বিটা ঢপ দিচ্ছে নাতো?

– কিডা কবে? আমরা ওর ধারে টাহা-পয়সা দিয়ে ঠেইকে পড়িসি নিহি? হলি হবি, আমরা তো আর জোরাজুরি কত্তি কচ্ছিনে।

বারেকের দোকোনে বসে দুজন গুনগুন করে কথা বলে। মনিরুলের বন্ধুদের কেউ-কেউ ওদের দেখে বলে, ও কাহা, আপনার ছাওয়ালের কিছু অলো? মনিরুল যে খুব ভাব দেহায়ে গেল?

রেহানউদ্দীন নাকি নাজের আলী বলে, এহনো অয়নি, ও কিছু করতি পারবে মনে অয় না। গ্রামের ছাওয়াল, না পারলিও দোষের কিছু নেই। ও তো আমাগের কাছ থে টাহা-পয়সা নিচ্ছে না। আর পারলিও ইসব কি আর ওয়ান টুর মদ্যি অয়?

একথার জবাব হয় না বলে ওরা চুপ করে যায়।

রেহানউদ্দীন অনেকটা আপন মনেই বলে, অই যে মুক্তিযোদ্ধার কোটার কতা কচ্ছিল না মনিরুল? ওসব কতা ভাবিছি কহনো? কিছু পাওয়া যাবে ইসব চিন্তা কইরে যুদ্ধে যাইনি তো। এই যে নাজের আলী পাঞ্জাবিগের সাতে যুদ্ধে গুলি খায়ে পইড়ে গেল, ওরে বাঁচাতি যায়ে আমি মরতি পারতাম, নিজের জানের কতা ভাবিসি? ওরে উঠোয়ে নে ভাইগে আসিছি না?

নাজের আলী ওঁর রান্না করা নুডলসের মতো দাড়ির ফাঁকে হাসে কৃতজ্ঞতার সলজ্জ হাসি, চোখের নিচের বলিরেখাগুলো বর্ষার খালের মতো উপচে ওঠে। ও কেবল বলতে পারে, ও সেদিন আমারে উঠোয়ে না নিলে পইড়ে থাকতাম, ধইরে নে মাইরে ফেলাইতো পাঞ্জাবিরা।দোকানে খদ্দের ধরে রাখার জন্যই হোক কিংবা মুক্তিযুদ্ধের গল্প শোনার জন্যই হোক, কাউন্টারের পেছন থেকে বারেক গলা তুলে বলে, কী হয়েছিল কন-দি। মেলা আগে একবার শুনিছিলাম, অত মনে নেই। এহনকার ছাওয়াল-পাওয়াল ইসব কিছই জানে না।

রেহানউদ্দীন বলে, আগেও বলিছি বহুবার। একবার খবর পালাম হাই স্কুলের মাঠে বড় কইরে পাকিস্তানের স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠান করবে শামিত্ম কমিটি। স্কুলের মধ্যি আর্মি ক্যাম্প, মাঠে অবে অনুষ্ঠান। তাহলি মিলিটারির বড় অফিসার থাকবে, রাজাকার লিডার, জামায়াতে ইসলামী আর মুসলিম লীগের নেতারাও থাকবে। খবর পায়ে দফায়-দফায় মিটিং করল কমান্ডার আমাগের নিয়ে, ঠিক অলো এই অনুষ্ঠান বানচাল করতি অবে। অনুষ্ঠান করতি দেওয়া যাবে না নে।

এটুকু বলে রেহানউদ্দীন থামে। তার চোখ অতীতে ফিরে যায়। কিছুক্ষণ স্বপ্নাচ্ছন্নের মতো বসে থাকে চুপ করে। নিজের সঙ্গেই যেন কথা বলে ও, কী মারাত্মক বিপদ মাথার কইরে ইরহম একটা অপারেশন চালালাম আমরা, ভাবলি পর এহনো গায়ের পশম দাঁড়ায়ে যায়।

রেহানউদ্দীন বলে চলে, কীভাবে অন্য ক্যাম্প থেকে আরেক দলকে এনে বড় করা হয়েছিল আক্রমণকারী দল। দলের প্রত্যেককে কয়েকবার করে বুঝিয়ে দেওয়া হয়, কারা কোন দিক থেকে স্কুলের

কাছাকাছি পজিশন নেবে। তিন দিকে থাকবে মুক্তিবাহিনী, শুধু খালের দিকটা খোলা রাখা হবে, পালানোর জন্য কেউ নৌকায় উঠলে সহজ হবে টার্গেট। কমান্ডার বলে দিয়েছিল, শত্রম্নপক্ষের কাউকে ফেলে দেওয়া না গেলেও দুটো কথা মনে রাখতে হবে, নিজেদের কেউ যাতে জখম না হয়। মারতে পারলে তো ভালো, কিন্তু একটা ভারি আক্রমণ হলে আর যা-ই হোক অনুষ্ঠান করার সাহস পাবে না ওরা। তবে আচমকা আক্রমণে দু-চারটা লাশ তো পড়বেই। ঠিক হয় স্কুলের পাশের মসজিদ থেকে ফজরের আজান শেষ হওয়া মাত্রই একসঙ্গে আক্রমণ শুরু করতে হবে, এটাই হবে সংকেত। ওদের হাতে অঢেল গোলাবারুদ নেই, তাই সংক্ষেপ্ত অথচ তীব্র একটা হামলা শেষ করে নিরাপদে দূরে সরে পড়তে হবে তাড়াতাড়ি। হামলা শেষ হওয়ার সংকেত দেওয়ার জন্য কমান্ডার দারুণ এক বুদ্ধি বের করে। আজানের পর নামাজ শুরু হওয়ার আগে যে পনেরো মিনিট সময় থাকে তার মধ্যে হামলা শেষ করতে হবে। কমান্ডার নিজেই মসজিদের মাইকে যখন বলবে, ভাইসব ভারতীয় দালাল দুষ্কৃতকারীরা আমাদের ওপর হামলা করেছে, আপনারা ভয় পাবেন না, আলস্নাহু আকবর, ঠিক তখনই হামলা বন্ধ করে দ্রুত সরে পড়তে হবে। ব্যাপারটায় ঝুঁকি আছে, কিন্তু এটা এমনই নতুন কায়দা, ঘুম ভাঙা চোখে হঠাৎ হামলায় ওরা এতই দিশাহারা থাকবে যে, ওদের মাথায় আসবে না কিছু। গোলাগুলি শুরু হলে মসজিদে মুসলিস্নদের কেউই আসবে না। তারপর তিন দল তিন দিক থেকে হটে যাবে, খালের পাড় ধরে দুদিকে দুদল, আরেক দল যাবে বাজারের ঘন ঘরগুলোর ভেতরের অলিগলি ধরে। সবাই মাথায় টুপি পরে নেবে, যাতে কেউ দেখলে ভাবে মুসলিস্ন ফজরের নামাজে যাচ্ছে, অস্ত্র আড়াল করে রাখতে হবে যতদূর সম্ভব।

– সব ঠিকঠাক চলল, দূর থেইকে ক্রলিং কইরে গিয়ে আমরা পজিশন নিয়ে বইসে আছি, মশা কামড়ায়ে শরীর ছ্যাঁদা করে দিচ্ছে, চাপড় মারা যাবে না, শব্দ আর নড়াচড়া যত কম করা যায়। তারপর শুরু অলো আজান, আস সালাতো খায়রুম্মিনান্নণাউম, আলস্নাহু আকবরের পর লাইলা হা ইলস্নালস্না শেষ হওয়ার সাতে-সাতে শুরু অয়ে গেল, ব্রাশফায়ার আর গ্রেনেড। ইকটু পরে ওপাশ থেইকেও শুরু অলো গুলি। ভেতর থেইকে নানান রহমের চিৎকার শোনা যাচ্ছিল, কি হচ্ছিল কিছু বোঝা যায় না। পোরথমে মোনে অলো কেয়ামত শুরু হয়েসে। আমরা থাইমে-থাইমে গুলি করতিসি, আর ইকটু-ইকটু কইরে পেছুয়ে যাচ্ছি। পনরো মিনিট শেষ অয়না যেন। আমাগের গুলি শেষ অয়ে যাবে তাই ফায়ার কমায়ে দিলাম। আমার পাশে নাজের আলী, কলো, এহন কাইটে পড়া উচিত। শেষ গ্রেনেডটা মাইরে কাটা গাছের মতো মাটিতি পড়ার আগেই গুলি আইসে লাগল ওর কাঁধের মাংসে। ভয় পায়ে গেলাম। নাজের আলী তো কাঁইদে ফেলাইল, কয়, আমারে ফেলায়ে যাইসনে যেন। আমিও চিন্তা করলাম ওরে ফেলায়ে রাহা যাবে না নে। ধরা পড়লি সব শেষ, অত্যাচার কইরে কতা বাইর কইরে নেবে সব। ওর গামছা দে ভাল কইরে বাঁইধে দিলাম কাঁধের জখমি। তহন মাইকে কমান্ডারের গলা শোনা গেল। ওরে নিয়ি ক্রলিং কইরে খাল পাড়ের দিকে যায়ে পোরথমে হাতের অস্ত্র ঢুকোয়ে দিলাম কেয়াঝোপের মধ্যি, তারপর এক গড়ান দিয়ে পড়লাম পানিতে। ধল পহর শুরু অয়নি তহনো। আমাগের পক্ষের গোলাগুলি বন্ধ, কিন্তু ক্যাম্পের ভেতরত্থে আন্দাজের ওপর ভর কইরে ধুমায়ে গুলি চালায়ে যাচ্ছে পাগলের মতোন। আর আমরা ভাইগে যাচ্ছি। আমাগের গলা পর্যন্ত পানির নিচে, অন্ধকারে মাথা জাগায়ে এরে ধইরে হাঁটতি থাকি ভাটির দিকে। খেয়াল রাখতি হচ্ছিল পানি য্যান বেশি না নড়ে। আলস্নারে ডাকতিসি, ক্যাল মোনে হচ্ছিল পেছন থেইকে গুলি আইসে লাগবে মাথায়। কখন খাল পারোয়ে ওপারে উইঠে আসিছি মোনে নেই, তহন বুঝতি পারলাম য্যান বাঁইচে আছি।

নাজের আলী এতক্ষণ চুপ করে বসে ছিল, এবার গলা খাঁকারি দিয়ে বলে, এই সেদিন আমারে ফেলায়ে গেলি ধরা পইড়ে যাতাম ওগের হাতে। এরপর কী যে অতো আলস্না মালুম। হাজার শোকর গুলিডা মাংস ছিড়ে বারোয়ে গিইলো। ওর খালার বাড়িতে আমারে লুকোয়ে রাইখে ডাক্তারের ধারে গেল ও। রাতের বেলা ডাক্তার আইসে দেইখে কলো ভয়ের কিছু নেই গুলি বারোয়ে গেছে। তাবাদে পরিষ্কার কইরে ব্যান্ডেজ বাঁইদে দিলো।

রেহানউদ্দীন ওকে থামিয়ে দিয়ে বলে, আরে খালার বাড়ি মানে খালার শউর বাড়ি, তারা থাকে ঢাকায়। এরে পুহুরির পাড়ে জোঙ্গলের মদ্যি বসায়ে গেলাম বাড়ির ভেতর। বুড়ি দরজা খোলে না ভয়ে, জোরে কতা কওয়াও যাচ্ছে না, যত বলি, আমি রেহান গো নানী, সে ক্যাল বলে, কিডা। বহুত কষ্টে তারে বোজাই আমি কিডা। বুড়ির বুদ্ধি আছে, ওয়ান টুর মদ্যি বুইঝে ফেলাইসে। তারপরে এরে নিয়ে ঢুকোয়ে দিলাম বুড়ির ঘরে।

একজন জিজ্ঞেস করে, কেউ দ্যাহেনি তোমাগের?

– বরাতজোরে বাঁইচে গেছি। আর তহন তো ইরহম গায়ে গা লাগানো বাড়িঘর ওডেনি। আমরা যহন চাষের জমির ওপর দে হাঁইটে যাতাম ইদিক-ওদিক, মাইলের পর মাইল জনমনিষ্যির দ্যাহা মিলত না।

– সেদিন ইস্কুলের মাঠে অনুষ্ঠান হয়েছিল?

– মিলিটারি মরিসিল কয়ডা?

– আমরা তো কদিন আর ধারে-কাছে যাইনি, পরে শুনিসি ওরা লাশ আর জখমি মিলিটারি নে এমন দৌড়োদৌড়িতে ছিল, চোদ্দোই অগাস্ট চাঙ্গে উইঠেসিল। কতোজন মারা গিইলো কেউ ঠিকঠাক কতি পারেনি, কেউ বলিসে পাঁচজন, কেউ বলিসে আটজন।

বারেকের ইচ্ছে পূরণ করেই হয়তো দোকানে বহু খদ্দের জমে যায় সেদিন।

কয়েকদিন পর মনিরুলকে ফোন করে রেহানউদ্দীন, না, নতুন কোনো খবর দিতে পারে না ও। রেহানউদ্দীন তবু বলে, ইট্টু দ্যাহিস ক্যানে বাপ।

মনিরুল বলে, ইবার সায়েব দেশে ফিরলিই কবানে। আগামী মাসে ফোন দিয়েন দি একবার। সায়েব আসলে খুব ব্যস্ত, তারে মোডে একলা পাওয়াই যায় না।

পরের মাসে ফোন করলে মনিরুল বলে, কাহা এমন কইরে অবে নানে। আপনেরা চইলে আসেন দি, আপনাগের সাতে নিয়ি সায়েবরে ধরবানে।

ঢাকা যাওয়ার কথা শুনে রেহানউদ্দীন দোনোমোনো করে, ঢাকায় যায়ে থাকবানে কোয়ানে? নাজের আলী বলে, ছাওয়ালের ওহানে গেলি পর ব্যবস্থা অয়ে যাবেনে।

সেই ফোনের কথাতেই ওদের ঢাকা আসা। তা নাজের আলীর ছেলে ব্যবস্থা করেছিল। ওর শোয়ার জায়গায় বাপ আর রেহানউদ্দীনের থাকার ব্যবস্থা করে দিয়ে ও পাশের ঘরে আরেক জনের সঙ্গে থাকার ব্যবস্থা করে নিয়েছে কয়েকদিনের জন্য।

প্রথম দিন ঢাকা শহরের ভাব চক্কর বুঝতে, উত্তর দক্ষিণ ঠাওর করতেই কেটে যায় তাদের। পরদিন মিরপুর থেকে ছেলের বাতলানো পথে বাসে করে প্রেসক্লাবের সামনে নামতেই পিলপিল করে ছোটা অফিসযাত্রীদের মিছিলের মধ্যে পড়ে খেই হারিয়ে ফেলে নাজের আলী। রেহানউদ্দীন ওর পাঞ্জাবির খুঁট ধরে রাখায় হারিয়ে যায়নি কেউ। তারপর একে ওকে জিজ্ঞেস করে এসে পৌঁছে মনিরুলের অফিসে। ওর সঙ্গে আগেই কথা হয়েছিল বলে ও নিচে নেমে এসে ওদেরকে লিফটে তুলে ওপরে নিয়ে যায়। যাওয়ার পথে বেশ ভাব নিয়ে লিফটে উঠে কত তলায় এসে নামতে হবে, তারপর কোনটা

কোন সায়েবের রুম এসব দেখাতে থাকে। রেহানউদ্দীন অধৈর্য হয়ে বলে, তোর বড় সায়েবের সঙ্গে দ্যাহা করবানে কহন?

মনিরুল বলে, অত তাড়াহুড়ো করলি চলবে না নে। সায়েব আসেনি এহনো। আর আসলিও ওয়ান-টুর মদ্যি দেহা অয়ে যাবে মোনে করিছ? সায়েবের ম্যালা কাজ, ম্যালা মিটিং।

রেহানউদ্দীন নাকি নাজের আলী কে যেন বলে ওঠে, তাহলি আমাগের আসতি বললি যে? মনিরুল একটু গলা খাটো করে বলে, আরে সে জন্যিই তো আসতি বলিছি। এহানে দুয়েকদিন ঘোরাঘুরি করলি মওকা মিলে যাতি পারে। তোমাগের তো অ্যাপয়েন্টমেন্ট কইরে দেখা করানো যাবে না নে।

রেহানউদ্দীন উদ্ভ্রান্ত চোখে ওর দিকে তাকায়, তাহলি এহানে কদিন বইসে থাহা লাগবি আমাগের?

মনিরুল বলে, বইসে থাহা লাগবি ক্যান। এহানে ওহানে ঘুইরে ফিরে থাকবা। কাছে বায়তুল মোকাররম মসজিদ আছে, দেইখে আসতি পারো, নামাজ পড়তি পারো। স্টেডিয়াম, গুলিস্তান ঘুইরে দেখতি পারো। পাশে প্রেসক্লাব, খোদার তিনশ পঁয়ষট্টি দিন কিছু না কিছু একটা লাইগেই আছে, দেখতি-দেখতি সোমায় কাইটে যাবেনে, মোডে টেরই পাবানা।

পানের পিক দাগানো দেয়ালের কোণ ঘেঁষে সিড়ি বেয়ে নিচে নামতে নামতে ওরা বোঝার চেষ্টা করে, মনিরুল সত্যিই পারবে কি না ওদের দেখা করাতে। তবে কেউ কোনো কথা বলে না। নিচে নেমে নাজের আলী বলে, এ বিটা ঢপ দিচ্ছে না তো আমাগের? রেহানউদ্দীন সান্তনা দেওয়ার মতো বলে, আইসেই পড়িছি যহন দুই-চার দিন দেইখে যাই। কিছু না হলি পর চইলে যাবানে।

ওরা অলস অনিশ্চিত পায়ে প্রেসক্লাবের সামনে চলে আসে। ওখানে ফুটপাতে ব্যানার টানিয়ে কারা যেন হাতে হাত ধরে লাইন ধরে দাঁড়ানো। ওরা এসবের আগ-মাথা কিছু বোঝে না। ফুটপাতের দোকান থেকে চায়ের ভেতর বনরুটি ডুবিয়ে খেতে-খেতে ওরা বাসের তীব্র শব্দ, রিকশার অন্তহীন সারি আর দলা পাকানো মানুষের ভিড়ের ভেতর অনাহূত অসিত্মত্বহীন হয়ে যায়। এসময় মানববন্ধন করা মানুষের পেছন থেকে মাইকে সেস্নাগানের বিকট শব্দ হলে ওরা পরস্পরের দিকে তাকায়। নাজের আলী বলে, কি কচ্ছে কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। রেহানউদ্দীন মাইকের আওয়াজের ভেতর থেকে গলা তুলে বলে, কিডা কবে? মনিরুল কলো না, এহানে কিছু না কিছু একটা লাইগেই থাকে সারা বোচ্ছর?

এ মুহূর্তে কিছু করার নেই ওদের। মনিরুলের কাছে গিয়ে ওর বড় সায়েব এলেন কি না, এলে দেখা করা হবে কি না, এই খোঁজ নিতেও মন চায় না আর। তাই উদ্দেশ্যহীন ঘুরে বেড়ায়। হাইকোর্টের গেটের পাশে পাকুড় গাছটার নিচে কিছু সময় বসে। আবার রাস্তার ধার ঘেঁষে হেঁটে-হেঁটে বাতাসে এলোমেলো উড়ে যাওয়া কাগজের টুকরোর মতো এদিক-সেদিক যায়। ওসমানী উদ্যানের ভেতর পুকুর পাড়ে বসে থাকে চুপচাপ। পুকুরের নোংরা পানিতে হাড় জিরজিরে ঘোড়াদের গোসল করাতে দেখে নাজের আলীর নিজ বাড়ির কথা, বাড়ির পুকুরের পানিতে নামিয়ে গরুর গা ধুইয়ে দেবার কথা মনে পড়ে। হঠাৎ বলে ওঠে, এহানে পইড়ে থাহার দরকার আছে আর? চল রেহান ভাই, আইজ রাতের কোচে উইঠে পড়ি। রেহানউদ্দীন বলে, আরে আমি কি বলিছি এহানে থাইকে যাব। কলাম না? আইসি যহন দুডো দিন দেইখে যাই। এর মদ্যি কিছু না হলি চইলে যাবানে।

দুদিন ভাবলেও আরো তিনদিন ধরে এখানে সেখানে আনাগোনা করতে করতে  মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয়ের অফিস, বারান্দা আর গেটের স্থায়ী বাসিন্দা হয়ে যায় ওরা। ওদের ইতস্তত অনিশ্চিত ঘোরাফেরা দেখে সেদিন একজন এগিয়ে আসে কাছে, বলে, চাচা, সমস্যা আছে কোনো? মুক্তিযোদ্ধা সার্টিফিকেট লাগবনি? শস্তায় করাই দিমু। রেহানউদ্দীন লোকটার ধূর্ত চেহারা দেখে সাবধান হয়, না ভাইডি, আমাগের কোনো সমস্যা নেই, বলে এগিয়ে যেতে চায়। লোকটা পিছু ছাড়ে না, বলে, কিছু কাম থাকলে কন, আমার মানুষ আছে মন্ত্রণালয়ে। মুক্তিযোদ্ধা ভাতা করাইবেন? রেহানউদ্দীন লোকটাকে কাটানোর জন্য বলে, আমাগেরও মানুষ আছে। কিছু লাগবে না নে। তবুও এঁটুলির মতো কিছুক্ষণ ওদের পেছন-পেছন লেগে থাকে সে। লোকটার ভাবগতিক সুবিধার মনে হয় না ওদের, তাই দ্রুত হেঁটে রাস্তায় চলে আসে দুজন।

এভাবে এদিক সেদিক উদভ্রামেত্মর মতো ঘুরে মনিরুলের কাছে গেলেই বলে সায়েব তো মিটিং-এ, সায়েব পিএম অফিসে, কখনো বলে অর্থ মন্ত্রণালয়ে। অফিসে থাকলে বলে, অপেক্ষা কর দেহি, সায়েবরে ফ্রি পাই নাকি। কিন্তু মনিরুল কোনোভাবেই সায়েবের সঙ্গে দেখা করাতে পারে না।

সেদিন ফিরে যাওয়ার মনস্থির করে সকালে ছোট রোঁয়া-ওঠা ব্যাগট্যাগ নিয়ে ওরা মনিরুলের অফিসে চলে যায়, কিছু না হলে এখান থেকেই বাড়ির পথ ধরবে। উঁচু বিল্ডিংটার গেটের কাছে জটলা দেখে থমকে যায় ওরা। ক্যামেরা হাতে লোকজনের ভিড়ে গেট পর্যন্ত পৌঁছানো যায় না। কাউকে ঢুকতে দিচ্ছে না আনসার বাহিনী। ওরা বোঁচকা-কাঁধে ভিড় বাঁচিয়ে দূরে দাঁড়ায়, যদি মনিরুলের দেখা পাওয়া যায়। অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকেও বুঝে উঠতে পারে না কিছু। সাংবাদিকরা ভেতরে ঢুকতে চাইলে গেটের আনসারের গলা শোনা যায়, ওপরের অর্ডার।

এ সময় দেখা হয়ে যায় মনিরুলের পরিচিত আরেক জনের সঙ্গে। পর পর কয়েকদিন এই অফিসে যাওয়ার সুবাদে ওদের চেনে ছেলেটা, কী কারণে ঘোরাঘুরি করছে এই কদিন, তাও জানে। ওকে দেখে যেন হালে পানি পায় ওরা, বলে, এ বাবা, আমাগের ঢুকতে দিচ্ছে না ক্যান? ছেলেটা বলে, কাউরেই ঢুকতে দিতাসে না। নিষেধ আছে।

রেহানউদ্দীন বলে, ক্যান কতি পারো? ছেলেটা গলা নামিয়ে বলে, আপনারা চইলা যান। ঢুকতে পারলেও লাভ নাই। সচিব সায়েব ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা সার্টিফিকেট দিয়া চাকরি করতাছিল এতদিন, এতদিন পর ধরা খাইসে। উনার আরো বহুত কিছু বারাইয়া আইতাসে। স্যারেরে ওএসডি করা হবে। এটুকু বলে ছেলেটা ব্যস্ত হয়ে ভেতরের দিকে চলে যায়। নাজের আলী বোকার মতো বলে, কী করা অবে কলো? রেহানউদ্দীন সেখান থেকে সরে এসে বলে, কিডা কবে? রাস্তায় নেমে এসে হাঁটতে থাকে দুজন, কেউ কিছু বলে না। কড়া রোদের মধ্যে হাঁটতে-হাঁটতে বড় শিল কড়ই গাছটার ছায়ায় এসে দাঁড়ায়। নাজের আলী কিছু না বলে রেহানউদ্দীনের মুখের দিকে তাকায়। সেখানে ক্রোধ বা হতাশা কিছুই বোঝা যায় না। হঠাৎ করে রেহানউদ্দীন হাসতে শুরু করে, দ্রুত তপ্ত হয়ে ওঠা সকালের তেজি রোদের আলোর নিচে এলোমেলো হেঁটে যাওয়া ব্যস্ত জনারণ্যের মাঝে সে হাসি বেমক্কা মানে হয় নাজের আলীর কাছে, পাশ দিয়ে হেঁটে-যাওয়া কেউ-কেউ এমন হাসির শব্দে কৌতূহলে একঝলক তাকিয়ে পাশ কাটিয়ে চলে যায়। নাজের আলী অবাক চোখে ওর দিকে তাকিয়ে থাকলে রেহানউদ্দীন আচমকা হাসি থামিয়ে থম ধরা গলায় বলে, আলস্না যা করে ভালোর জন্যি করে, ঠিক না? আমরা দুই আসল মুক্তিযোদ্ধা আইছিলাম এক ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার কাছে তদবির করতি। মানীর মান আলস্নায় রাহে, কী কও নাজের মিয়া। ইরহম দুনম্বরী মানষির ধারে ভিক্ষা চাইতি আইছিলাম আমরা ছাওয়ালের চাকরির জন্যি? অলো না চাকরি, সম্মান বাঁচিসে, এডাই শামিত্ম। লাথি মারি ওরহম চাকরির মুহি। লও, বাড়ি যাই।

নাজের আলী কিছু বলে না, রেহানউদ্দীনের চেহারার দিকে তাকিয়ে কিছু বলার সাহস পায় না। তারপর উলটোদিকে গিয়ে বাস ধরার জন্য দাঁড়িয়ে থাকা কয়েকশ মানুষের তুচ্ছ একাংশ হয়ে ওরা অপেক্ষা করে পরবর্তী বাসের জন্য। r