নিরীক্ষাপ্রবণ শিল্পী সৈয়দ মোহাম্মদ জাকিরের একক
শিল্প-প্রদর্শনীর নাম ‘মায়া’। আমাদের জানাশোনা শব্দ ‘মায়া’র সঙ্গে এই প্রদর্শনীতে উপস্থাপিত শিল্পকর্মগুলির হয়তো আপাত দৃষ্টিতে কোনো মিল চোখে পড়ে না, কিন্তু তারপরও কোথায় যেন একটা নস্টালজিক সুর বেজে ওঠে। যদিও এই প্রদর্শনী সম্পর্কে শিল্পী বলেছেন, এটি আজ থেকে বহু বহু বছর পরের কোনো নগরীর দৃশ্যকল্প। প্রদর্শনীতে স্থান পেয়েছে ভাস্কর্য ও রেখাচিত্র। সংখ্যা বিচারে ভাস্কর্যই বেশি।
সৈয়দ মোহাম্মদ জাকিরের শিল্পসৃষ্টিতে প্রচলিত অর্থে কোনো পরিকল্পনা নেই, বরং হঠাৎ-পাওয়া উপকরণ বা ভাবনা তাঁকে উদ্দীপিত করে। নগরবাসীর চোখে ‘জঞ্জাল’ – এমন সব ফেলে দেওয়া, কুড়িয়ে পাওয়া বস্তুর সঙ্গে রেখাচিত্র ও ড্রইংয়ের সমন্বয়ে তিনি নির্মাণ করেন কল্পনা ও বাস্তবতার মিশেলে এক কাল্পনিক শহর – ‘বাঘরেব’ : যে শহরের অস্তিত্ব বর্তমান সময়ে নেই, আবার আছেও, কারণ এই শহর হয়তো বর্তমান কোনো শহরেরই দূর-ভবিষ্যতের অবয়ব।
প্রদর্শনকক্ষে প্রবেশ করলে এক ভিন্ন অভিজ্ঞতা হবে দর্শনার্থীদের। দেয়ালে, মেঝেতে, ছাদ থেকে তার দিয়ে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে শিল্পকর্ম। হরেক রকম বস্তুর সমন্বয়ে নির্মিত বিচিত্র গড়নের এসব শিল্পকর্ম সচরাচর চোখে পড়ে না, আবার অনেক ভাস্কর্যের উপাদান আমাদের প্রাত্যহিক জীবনে সব সময়ই চোখে পড়ে। আঁকা ছবিগুলো কালি-কলম বা ব্রাশের টানের রেখাচিত্র।
সৈয়দ মোহাম্মদ জাকির আধ্যাত্মিকতা এবং জৈবিক জীবনের ছন্দ মিলিয়ে দেখাতে চান যে, এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে প্রতিনিয়ত রূপান্তর ঘটে চলেছে, প্রতিটি বস্তুতে, অবস্তুতে। তবে সবকিছু ছাপিয়ে একধরনের অব্যক্ত আবেশে জড়িয়ে আছে সবকিছু।
প্রদর্শনীতে স্থান পাওয়া বেশ কিছু শিল্পকর্ম দর্শকদের কাছে খুবই চেনা। যেমন পথের পাশের চায়ের টং দোকান বা চাকা লাগানো চটপটির দোকান। পরিত্যক্ত দোকানগুলির মূল আকৃতি ঠিক রেখে শিল্পী রং, বার্নিশ প্রভৃতি প্রয়োগ ও সংযোগের মধ্য দিয়ে নির্মাণ করেন নতুন ভাবনার খোরাক। প্রতিদিনের দেখা এসব দোকান হয়তো আমাদের চোখে পড়ে, কিন্তু মনে বসে না। জাকির সেই দেখার জায়গাটিকে প্রসারিত করেছেন মনের ভাবনা মিশিয়ে। যেমন – চায়ের টং দোকানে রাখা টুলটি হয়তো কেউ সরিয়ে নিল। এটা হয়তো তেমন কোনো ঘটনাই নয়, কিন্তু এর ফলে যে স্থানান্তরের গল্প তৈরি হলো, তা সময়ের খাতায় লেখা থাকবে। আবারো হয়তো কেউ টুলটি সরিয়ে অন্য কোনো স্থানে নেবে। অর্থাৎ প্রতিনিয়ত স্থানান্তর ও রূপান্তর ঘটে চলেছে আমাদের চারপাশেই জানামতে, কিংবা অজ্ঞাতসারে।
প্রযুক্তি ও বিজ্ঞানের কল্যাণে পৃথিবী দ্রুত ধাবিত হচ্ছে ‘সুপার আর্থে’র দিকে। প্রতিনিয়ত আমাদের শহরগুলি বাড়ছে ওপরের দিকে, অর্থাৎ বড় বড় ভবন মাথা তুলে দাঁড়াচ্ছে, ছুঁতে চাইছে আকাশ। যানবাহনের চাপে পড়ে সড়কগুলির বেহাল দশা। শহুরে জীবনে ‘অত্যাবশ্যক’ এসব ভবন নির্মাণের জন্য কাটা হচ্ছে গাছ, হারিয়ে যাচ্ছে সবুজ মাঠ, ভরিয়ে ফেলা হচ্ছে জলাশয়। লোহা-কংক্রিটের কাঠামোয় গড়ে ওঠা ভবনগুলির বারান্দায় শোভা পাচ্ছে বনসাই। এ যেন ‘গরু মেরে জুতা দানে’র গল্প। সবুজ প্রকৃতিকে মুছে দিয়ে ড্রইং রুমে মিনিয়েচার করে রাখার বাসনা। এতে পরিবেশ বিপর্যয়ের অবশ্যম্ভাবী প্রভাব পড়ছে পৃথিবীতে।
সেই ধারণা থেকেই জাকির নির্মাণ করেছেন তাঁর দূর-ভবিষ্যতের শহর। সেখানে সবকিছুই ধ্বংসপ্রাপ্ত, রূপান্তরের কারণে বিপর্যস্ত। তিনি গাছের কাণ্ড, শিকড়, ডালপালা শুকিয়ে তাতে বার্নিশ বা ঢালাই করে উপস্থাপন করেছেন। ব্যবহার করেছেন প্রচুর লোহালক্কড়, ধাতব ফলক। কাঠের টেবিল ও চেয়ারের মতো বিভিন্ন আসবাবের হাতল, পা, নারকেলগাছের শাখা, কংক্রিট ফলকসহ নানা ধরনের দ্রব্য। এসব জিনিস পরস্পরের সঙ্গে জুড়ে দিয়ে, পাশাপাশি সাজিয়ে, ছড়িয়ে দিয়ে, একত্রে গুছিয়ে নানা দৃশ্যগোচর আকৃতি ও অবয়ব নির্মাণ করেছেন। শুকনা গাছপালা, শিকড়বাকড় পরিবেশ বিপর্যয়ের সুস্পষ্ট ইঙ্গিতবাহী। লোহালক্কড়ের ইনস্টলেশনগুলি বলে দিচ্ছে, কীভাবে আমরা এগিয়ে চলেছি জঞ্জালময় এক প্রাণহীন ভবিষ্যতের দিকে।
তিনি ভাস্কর্যের সঙ্গে রেখাচিত্রগুলি যুক্ত করেছেন সাযুজ্য রেখে। কোনো কোনো রেখাচিত্রে মূল স্থাপনাকর্মটির বিশেষ দিকটি আঁকা হয়েছে বড় করে। অন্যদিকে এসব বিধ্বস্ত, ভাঙাচোরা অবয়ব বস্তুজগতের অনিত্যতার দিকটির আভাস দিচ্ছে। সব মিলিয়েই ‘মায়া’ সবার চেনা পৃথিবী, দেশ, নগর, সমাজ, জগৎ-সংসার সম্পর্কে এক ভিন্নতর ভাবনার খোরাক জোগাবে।
সৈয়দ মোহাম্মদ জাকির উন্মুক্ত স্থানে কাজ করতে পছন্দ করেন। ল্যান্ড আর্ট, পারফরম্যান্স আর্ট, ইনস্টলেশনসহ দৃশ্যশিল্পের নানা মাধ্যমে তিনি কাজ করছেন। এশিয়ান আর্ট বিয়েনাল, জাতীয় চারুকলা প্রদর্শনী, ছবিমেলাসহ বিভিন্ন প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণ করেছেন। রাজধানীর বেঙ্গল শিল্পালয়ের লেভেল ৪-এ গত ২২শে জুলাই শুরু হওয়া এই প্রদর্শনী চলবে ১৬ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত।
Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.