বাংলাদেশের লোকশিল্প : চিত্রিত মৃৎপাত্রের প্রদর্শনী

ঢাকার বেঙ্গল শিল্পালয়ের আয়োজনে ‘বাংলাদেশের  লোকশিল্প – চিত্রিত মৃৎপাত্র’ শিরোনামে বিশেষ একটি প্রদর্শনী এখন চলছে তাদের প্রদর্শনশালায়। প্রদর্শনীটি শেষ হবে ২৩ সেপ্টেম্বর।  শিল্পী অধ্যাপক নিসার হোসেনের গবেষণা ও নির্দেশনায় এই প্রদর্শনীর আয়োজন। ২৭শে জুলাই, ২০২৩ শনিবার সন্ধ্যায় প্রদর্শনীর আনুষ্ঠানিক সূচনা হয়েছে। প্রদর্শনীতে রয়েছে শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের সংগ্রহকৃত মৃৎশিল্প থেকে শুরু করে তাঁর কনিষ্ঠ পুত্র প্রকৌশলী ময়নুল আবেদিন, শিল্পী তরুণ ঘোষ, সাইদুল হক, নিসার হোসেন, শিশির ভট্টাচার্য্য, সুশান্ত ঘোষ, ইমরান উজ জামান, নবরাজ রায়, টিটু সাহা ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদভুক্ত কারুকলা বিভাগের সংগ্রহ। মাঠপর্যায়ে উপাদান ও তথ্য সংগ্রহ করেছেন শেষোক্ত তিনজন।

লোকশিল্প বলতে আমরা সাধারণ অর্থে যা বুঝি তা হলো, গ্রামীণ শিল্পীদের আঁকা ও গড়া শিল্প, বংশপরম্পরায় যার চর্চা হয়। নদীমাতৃক জলকাদার এই দেশে মানুষের প্রয়োজনেই মৃৎশিল্পের প্রচলন। দৈনন্দিন ব্যবহার্য মৃৎপাত্র গড়ার পর মৃৎশিল্পীর ভালোলাগা থেকেই হয়তো তাতে নকশা করা, একটু আঁকার চেষ্টা থেকে লোকশিল্পের সূত্রপাত।

বাংলার লোকশিল্প প্রসঙ্গে বরেণ্য বাঙালি সমাজবিদ-শিল্পী-কবি ও সংস্কৃতিসেবীরা নানা সময়ে জনসমক্ষে উচ্চ মূল্যায়ন উপস্থাপন করেছেন। পাঠকদের সুবিধার্থে আমি সেগুলি একে একে তুলে ধরছি।

‘ঠাকুরবাড়ির আঙিনায়’ কবি জসীমউদ্দীনের লেখা প্রণিধানযোগ্য। তাঁর লেখায় লোকশিল্প সম্পর্কে আমরা শিল্পাচার্য নন্দলাল বসুর মুগ্ধতার পরিচয় পাই। শিল্পী নন্দলাল বসু তাঁর এক ছাত্রকে বলেছিলেন –  ‘তুমি গ্রামে গিয়ে দেখতে পাবে এক রাখাল বালক হাতে ছুরি নিয়ে তার লাঠির উপরে ফুলের নকশা করছে। তার গরু হয়ত পরের ক্ষেতের ধান খাচ্ছে, এজন্য তাকে কতো বকুনি শুনতে হবে। কিন্তু সেদিকে তার কোন খেয়াল নেই। সে একান্ত মনে তার লাঠিতে ফুল তুলছে। আরও দেখবে, কোন এক গাঁয়ের মেয়ে হয়তো কাঁথা সেলাই করছে কিংবা রংবেরঙের সুতা নিয়ে সিকা বুনছে। তার উনুনের উপর তরকারি পুড়ে যাচ্ছে, কিংবা কোলের ছেলেটি মাটিতে পড়ে আছাড়ি-পিছাড়ি কান্না করছে। কোনদিকে তার খেয়াল নেই। সে সুতার পর সুতা লাগিয়ে কাঁথার ওপর নতুন নকশা বুনট করছে – সেই রাখাল ছেলে, সেই গ্রামের মেয়েটি, এরাই হবে তোমার সত্যিকার শিল্পীবন্ধু। এদের সঙ্গে যদি মিতালি করতে পার তবে তোমার গ্রামজীবন একঘেয়ে লাগবে না। চাই কী, তাদের সৃজন-প্রণালী যদি তোমার ছবিতে প্রভাব বিস্তার করে, তুমি শিক্ষিত সমাজের শিল্পে নতুন কিছু দান করতে পারবে।’

গুরুসদয় দত্ত (১৯৮২-৪১) সরকারি কাজে যেখানেই যেতেন, সে-অঞ্চলের লোকশিল্পজাত পণ্য যেমন – নকশিকাঁথা, পটচিত্র,

মাটি-কাঠ-পাথরের তৈরি মূর্তি, পোড়ামাটির ফলক, পাটের শিকা, আমসত্ত্বের ছাঁচ ইত্যাদির সমন্বয়ে লোকশিল্পের বৈচিত্র্যময় সংগ্রহ গড়ে তোলেন। এসব উপাদান সংগ্রহের ইতিকথাও তিনি লিখে গেছেন। তাঁর মতে – ‘বাংলাদেশের শিল্পকলার সমস্ত ক্ষেত্রের মধ্যেই এই মৌলিক পুতুল ও খেলনা শিল্পের মা ও শিশুর আকৃতিটি সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য। এগুলো অনন্যসাধারণভাবে মৌলিক। শক্তি, আত্মনির্ভরশীলতা, সাহসিকতার মধ্যেও সারল্য এবং মাতৃত্বের নমনীয়তাকে তুলে ধরেছে – যা বর্ণনা করা কঠিন।’

প্রদর্শনীর উদ্বোধনী বক্তৃতায় শিল্পী নিসার হোসেনের কাছ থেকে জানা গেল – তোফায়েল আহমেদ (১৯১৯-২০০২)  ফোর্ড ফাউন্ডেশন ও কারিকার উদ্যোগে গৃহীত  ‘ফোক  ক্রাফটস সার্ভে অ্যান্ড ডিজাইন ডকুমেন্টেশন’ প্রকল্পে ড. হামিদা হোসেনের পরিচালনায় রিসার্চ স্কলার হিসেবে ১৯৮৪ থেকে ১৯৮৭ সাল পর্যন্ত প্রায় দেড় হাজার গ্রাম পরিভ্রমণ করে লোকশিল্পের নানা উপাদান সংগ্রহ করেন। এছাড়াও তিনি বিভিন্ন সময়ে নিজ উদ্যোগে কয়েকশো গ্রাম ঘুরে দেখেন। এই পরিক্রমায় তিনি লোকশিল্পের নানা দুর্লভ নিদর্শন আবিষ্কার করেন। লোকশিল্প বিষয়ে তাঁর কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রকাশনা রয়েছে। ঢাকার লালমাটিয়ায় নিজের বাড়ির নাম রেখেছিলেন ‘বাংলা ঘর’, সেখানে গড়ে তুলেছিলেন লোকশিল্পের প্রাচীন নিদর্শনে সমৃদ্ধ এক সংগ্রহশালা। সংগ্রহটি এখন বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটির লোকশিল্প জাদুঘরের তত্ত্বাবধানে রয়েছে। শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের অনুরোধে তিনি সোনারগাঁ লোকশিল্প জাদুঘরের মূল পরিকল্পনা প্রণয়ন করেন। উল্লেখ্য, এ-প্রদর্শনী উদ্বোধন করেন এদেশের লোকশিল্পের অন্যতম পৃষ্ঠপোষক ড. হামিদা হোসেন।

জয়নুল আবেদিন শৈশবে ময়মনসিংহে গুরুসদয় দত্তের বক্তৃতায় লোকশিল্পের গুরুত্ব সম্পর্কে শুনে উৎসাহিত হয়েছিলেন। ১৯৫১-৫২ সালে তিনি ইউরোপ ভ্রমণ করেন। লন্ডনের মিউজিয়ামসমূহ পরিদর্শন করে যখন তিনি দেখলেন – ওখানে বাংলার লোকশিল্প সংগ্রহকে অত্যন্ত  গুরুত্বের সঙ্গে তুলে ধরা হয়েছে, তখন তিনি দেশে ফিরে আমাদের শিল্পের গতিমুখ লোকঐতিহ্যের দিকে ফেরানোর এবং এই সমৃদ্ধ ভাণ্ডার থেকে উপাদান সংগ্রহ করে তার সঙ্গে আধুনিক শিল্পের সমন্বয় সাধনের কথা বলেন।

১৯৫৫ সালে তাঁর উদ্যোগে আর্ট ইনস্টিটিউটে একটি লোকশিল্প প্রদর্শনী আয়োজিত হয়। তখন তাঁর মনে একটি ব্যক্তিগত সংগ্রহ গড়ে তোলার আকাক্সক্ষা জাগে। তিনি দেশের নানা প্রান্ত থেকে নকশিকাঁথা, মাটির পুতুল, টেপা পুতুল প্রভৃতি সংগ্রহ করেন। ১৯৫৮ সালে চারুকলায় তিনি লোকশিল্পের আরেকটি প্রদর্শনীর আয়োজন করেন। এতে তিনি অনেক বিদেশি কূটনীতিককে আমন্ত্রণ জানান ও কিশোরগঞ্জ থেকে নকশি পিঠা এনে তাঁদের আপ্যায়নের ব্যবস্থা করেন। বাংলার লোকায়ত সংস্কৃতির ঐশ্বর্য দেখে তাঁরা অভিভূত হয়েছেন।

কিশোর বয়সে আমি প্রত্যক্ষ করেছি – ১৯৭৪ সালের ডিসেম্বরে শিল্পাচার্য জয়নুল কচি-কাঁচার মেলার জেলা সম্মেলনে টাঙ্গাইলে গিয়েও সেখান থেকে লোকশিল্প সামগ্রী সংগ্রহ করেছেন। তিনি এবং আরেক গুণী শিল্পী কামরুল হাসান তাঁর চিত্রকলায় লোকশিল্পের অনেক উপাদান ব্যবহার করেছেন। এসব নিয়ে পরে বিস্তৃত আলোচনার অবকাশ আছে।

প্রদর্শনী প্রসঙ্গে

বেঙ্গল শিল্পালয়ের প্রদর্শনী হলে ঢুকতেই চোখে পড়ে দুটি লেখা। এর একটিতে প্রদর্শনীর আয়োজন নিয়ে বেঙ্গল শিল্পালয়ের বক্তব্য, অন্যটিতে প্রদর্শনীর কিউরেটর শিল্পী অধ্যাপক নিসার হোসেনের কথা। বেঙ্গলের ভূমিকায় লেখা হয়েছে – এ-প্রদর্শনীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ ঐতিহাসিক মৃৎপাত্র, যা বিভিন্ন ব্যক্তিগত সংগ্রাহকের আনুকূল্যে উপস্থাপন করা সম্ভব হয়েছে। আমরা আশা করছি, এই প্রদর্শনীর মধ্য দিয়ে নানা বর্ণ, আকৃতি ও অলংকরণে উজ্জ্বল মৃৎশিল্পের বিপুল বৈচিত্র্য ও শৈল্পিক ব্যঞ্জনা দর্শকের সামনে তুলে ধরা যাবে।

নিসার হোসেন লোকশিল্প বিষয়ে আমাদের চর্চা ও গবেষণার অপ্রতুলতার বিষয়ে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করে লিখেছেন – অবিভক্ত বাংলায় ময়মনসিংহের লোককাব্য, পালাগান আর লোককবিদের জীবনী কেদারনাথ মজুমদারের উৎসাহে সৌরভ পত্রিকায় প্রকাশের জন্য চন্দ্রকুমার দে যখন সংগ্রহ ও লিপিবদ্ধ করে প্রকাশ করতে শুরু করেন, তখন এসবের প্রতি দীনেশচন্দ্র সেন, গুরুসদয় দত্ত, জসীমউদ্দীন প্রমুখ বিদ্বজ্জন যে একই কারণে আকৃষ্ট হয়েছিলেন, সে-সম্বন্ধে নিশ্চিত হওয়া যায়। গুরুসদয় দত্ত ও জসীমউদ্দীনের আগে লোকশিল্পের বস্তুগত নিদর্শনগুলো গুরুত্বসহকারে সংগ্রহ, সংরক্ষণ এবং
এ-সম্পর্কে জনসচেতনতা বিকাশে তেমন কেউ উদ্যোগী হননি।

শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের সংগ্রহকৃত লোকশিল্পে আমরা দেখতে পাই ফরিদপুরের লক্ষ্মীসরা, নবাবগঞ্জ দোহারের বিজয়সরা, টাঙ্গাইলের অপ্রচলিত রীতির সরা, ছাঁচের পুতুল, ছাঁচের হাতি, ময়মনসিংহের টেপা পুতুল, কিশোরগঞ্জের ষাঁড়, মুন্সীগঞ্জের পাখি আকৃতির পাত্র, রাজশাহীর শখের হাঁড়ি, দিনাজপুরের চিত্রিত মেয়ে পুতুল, উত্তরবঙ্গের হাতির পিঠে সওয়ারি প্রভৃতি।

বাংলাদেশ থেকে পশ্চিমবঙ্গে পাড়ি জমানো লোকশিল্পী প্রজন্মের হাতে আঁকা ও গড়া ফরিদপুররীতির লক্ষ্মীসরা, শরীয়তপুরের সুরেশ্বরী সরা, ঢাকার রায়ের বাজারের রিলিফকৃত লক্ষ্মীসরা, ফরিদপুরের লক্ষ্মীনারায়ণ সরা এ-প্রদর্শনীকে ঋদ্ধ করেছে। শিল্পাচার্য-পুত্র ময়নুল আবেদিনের সংগ্রহকৃত লোকপুতুলগুলির মধ্যে আছে দুই সওয়ারিসহ শুঁড়-তোলা হাতি, বসে থাকা বাঘ, গর্জনরত সিংহ, চাকাওয়ালা নৌকা, চাকাওয়ালা ঘোড়া, ষাঁড়, পেখমমেলা ময়ূর, পাখি প্রভৃতি।

শিল্পী তরুণ ঘোষের সংগ্রহকৃত লোকপুতুলের মধ্যে দেখতে পেলাম – ঘোড়সওয়ার, নৃত্যভঙ্গিতে নারী, উট, বাঘ, নৌকা প্রভৃতি।

শিল্পী নিসার হোসেনের সংগ্রহকৃত নানা আকৃতির চিত্রিত শখের হাঁড়ি, নানারকম সরা, মঙ্গলঘট প্রদর্শনীকে সমৃদ্ধ করেছে। শিল্পী তাঁর ও অন্যদের সংগ্রহগুলি সম্পর্কে কিছু বিবরণও দিয়েছেন দর্শকদের বোঝার জন্য। এগুলির সিংহভাগ প্রধানত সমকালীন।

ঠাকুরগাঁও থেকে শিল্পী শিশির ভট্টাচার্য্যরে সংগ্রহ করা বাঘ, বাচ্চাসহ গরু, লম্বা গ্রীবার ঘোড়া, ব্যাঙ, ষাঁড়, নারী ও পুরুষ – এসব লোকপুতুল অন্য এলাকা থেকে বেশ আলাদাই মনে হলো। এসবের কিছু বৃহদাকৃতি করে মঙ্গল শোভাযাত্রায় ব্যবহার করা হয়েছে বলে তিনি জানালেন।

শিল্পী তরুণ ঘোষ, সাইদুল হক, নিসার হোসেন, কারুশিল্প বিভাগ, চারুকলা অনুষদ, সুশান্ত ঘোষ, ইমরান উজ জামান, নবরাজ রায় সংগ্রহকৃত চিত্রিত পট, মনসাঘট, নাগঘট, মনসার চালি ও মনসার ঝাড় মনসা দেবীকে কেন্দ্র করে বাংলার প্রচলিত লোককাহিনির কথা আমাদের মনে করিয়ে দেয়।

ইমরান উজ জামানকৃত লোকশিল্প সামগ্রীও সাম্প্রতিক লোকশিল্পের সংগ্রহ।  তাতে দেখা গেল – নানারকম ফলমূল-সবজি – আম, কাঁঠাল, আতা, ডালিম, পেঁপে, জামরুল, টমেটো, মরিচ ইত্যাদি।

টিটু সাহার সংগ্রহে দেখতে পাওয়া গেল মূলত সমকালীন লোকশিল্পের নিদর্শন গরু, উঁচু পায়ের ঘোড়া, হাতির পিঠে সওয়ারি, নানারকম পাখি, ময়ূর, ব্যাঙ, ঘর, চাকাওয়ালা নৌকা, এমনকি সিএনজিচালিত অটোরিকশা, পিকআপ প্রভৃতি। এগুলি তিনি সংগ্রহ করেছেন ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা, রাজবাড়ী, সুনামগঞ্জ থেকে।

এ-প্রসঙ্গে নন্দলাল বসুর একটি উদ্ধৃতি উল্লেখ করা যায়, তিনি বলেছিলেন – ‘কৃষ্ণনগরের পুতুল রিয়ালিস্টিক। এর একাংশ ভেঙে গেলে সেগুলো দিয়ে আর খেলা করা যায় না। আমাদের গ্রামের পুতুলগুলি আইডিয়ালিস্টিক, তার এক অংশ ভেঙে গেলেও তা দিয়ে খেলা করা যায়।’