ওজান এসেছিল। নিঝুমপুর স্টেশনে ট্রেনটা যখন দাঁড়াল, একে একে সবাই নেমে যাওয়ার পরে আমি নামতে গিয়ে দেখি সামনেই এক যুবক দাঁড়িয়ে আছে। মুখে মৃদু হাসি। ডেনিম জিন্স আর নীল রঙের পাঞ্জাবি গায়ে।

ওজান আমার দিকে হাত বাড়িয়ে আছে।

আমি ওর হাতের ওপর হাত রাখি। ওজান আস্তে আস্তে আমায় নিচে নামিয়ে আনল।

প্ল্যাটফর্মে পা রাখলাম।

নিঝুমপুর স্টেশন। আমার স্বপ্নের শহর। যেদিন থেকে ওজানের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছে সেদিন থেকে এই শহরে পা রাখার একটা বাসনা মনের ভেতরে জায়গা করে নিল। ওজান ওর শহরের সুন্দর সুন্দর সব ছবি পোস্ট করত। যে-ছবি অনেক কথা বলত, তাই আর আলাদা করে ওজানকে নিজে থেকে কিছুই বলতে হতো না। আমি তো বহুদিন ধরে এমন একটা জায়গার কথাই ভাবছিলাম। নাম শুনেই বেড়াতে যাওয়ার বাসনা হলো। আমার একাকী নিঃসঙ্গ জীবনে ওজানের ছবিগুলি আমার স্থবিরতাকে একটু একটু করে প্রাণের পরশ বুলিয়ে দিতে লাগল। আমি মনে মনে নিঝুমপুরকে ঘিরে স্বপ্ন দেখা শুরু করলাম। আমার মানসচোখে ভেসে উঠল সবুজ ছায়াময় এক জনপদ। চা-বাগানকে ঘিরে যে শহরটা গড়ে উঠবে। সবুজ চা-বাগিচার ভেতরে একটা কাঠের বাংলো টাইপের বাড়ি থাকবে। ছোট্ট একটা ব্যালকনি থাকবে। তার পাশ দিয়ে বয়ে যাবে সুন্দর একটা নদী। তার নাম থাকতেই হবে এমন কোনো মানে নেই। বরঞ্চ নাম না থাকলেই ভালো। যে-নামটা আমার প্রথম মনে আসে তাকে সেই নামে ডাকবো। সেই নদীর ওপারে দূরে আবছা ঢেউ খেলানো পাহাড় থাকবে। সেই পাহাড়ের বুক ছুঁয়ে ছুঁয়ে যাবে মেঘের দল। ধোঁয়ার মতো ধূসর চাদরে মোড়া থাকবে শহরটা। মন খারাপের মেঘ জমবে আকাশে। সেই মন-কেমন-করা মেঘ উড়ে এসে জমতে থাকবে আমার মনে। কষ্ট কষ্ট সুখের এক অনির্বচনীয় অনুভূতি। মাঝে মাঝে হালকা মন খারাপ এসে গ্রাস করবে আমাকে। একটু একটু করে আমাকে ক্ষয় করবে আর আমি সেই ক্ষয়িষ্ণু মন নিয়ে ঘরের সামনে এক চিলতে ব্যালকনিতে কাঠের চেয়ার-টেবিলে বসে লিখতে থাকবো আমার কষ্টের কথাগুলি।

আমার চারদিনের ছুটি ছিল কলেজে। এমন একটা সুযোগের অপেক্ষাতেই ছিলাম আমি। ওজানকে বলায় সে সাগ্রহে জানাল ওর ওখানে চলে আসতে। অনলাইনে ট্রেনের টিকিট কেটে আমায় মেইল করে দিলো। বলল, ও প্ল্যাটফর্মে অপেক্ষা করবে। আমি নিশ্চিন্ত বোধ করলাম।

আমি আর ওজান প্ল্যাটফর্মের বাইরে এসে দাঁড়ালাম। প্রৌঢ় দুপুর তখন পা রেখেছে অপরাহ্ণে। আমি ওজানের দিকে পূর্ণদৃষ্টিতে তাকালাম। নীল রঙের পাঞ্জাবিতে চমৎকার মানিয়েছে ওজানকে। খুব হ্যান্ডসাম লাগছে তাকে। মেদহীন, ফর্সা সুদর্শন চেহারা ওজানের। মুখে ট্রিম করা দাড়ি। ঘন কালো চোখ দুটিতে অপূর্ব এক মায়া।

নিঝুমপুর খুব নিরিবিলি শান্ত একটা আধা শহর। ওজান যা বলেছিল তার চাইতেও শান্ত। রাস্তা ফাঁকাই বলা চলে। মাঝে মাঝে দু-একজন সাইকেল আরোহী পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে গেল। যতটা পথ পেরিয়ে এলাম এই সময়ের ভেতরে শব্দ সৃষ্টিকারী কোনো যানবাহন নজরে পড়ল না।

কয়েকজন কুলিমজুরকে দেখলাম চা-পাতা তোলার ঝুড়ি মাথায় চাপিয়ে বাগান থেকে বেরিয়ে তাদের গন্তব্যপথ ধরে চলে যেতে।

ওজানের মুখে শুনলাম, ওদের এই মফস্বল শহরে তেমন কোনো দূষণ সৃষ্টিকারী যানবাহন নেই, এক অ্যাম্বুলেন্স ছাড়া। কেউ অসুস্থ হলে ফোন করলেই অ্যাম্বুলেন্স চলে আসে। গুরুতর কিছু না হলে সাইকেলে চাপিয়ে নিয়ে যাই।

বলতে বলতে একটা সাইকেলের দিকে আঙুল তুলে বলল, এই যে এটাই আমাদের এখানকার যানবাহন। দেখি সাইকেলের পেছনে চওড়া তক্তা বেঁধে দুপাশে দুজনকে বসিয়ে চালক গান গাইতে গাইতে চলেছে।

আমি অবাক হয়ে দেখলাম।

আজকাল কিছু ব্যাটারিচালিত গাড়ি চলছে। 

চা-বলয়কে ঘিরে গড়ে উঠেছে জনবসতি। চা-বাগিচার ভেতর দিয়ে চলে গেছে সোজা পিচঢালা রাস্তা। হাঁটতে হাঁটতে ওজান এই শহরের ইতিহাস শোনাতে লাগল। আমি হাঁটছি আর মাঝে মাঝে ওজানের মুখের দিকে তাকিয়ে সেই রূপকথার গল্প শুনছি। একসময় ওজান গল্প থামিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, কী দেখছো ওই ভাবে?

– তোমায় দেখছি।

– কী এতো দেখার আছে বলো তো?

– নাহ, ভাবছি তোমার কি নাম দেবো – আকাশ, নাকি সমুদ্র?

– ধরো যদি আকাশ হই?

– তাহলে আমি পাখি হবো। তোমার বুকে ডানা মেলে ভাসতে ভাসতে তারাদের জন্মকথা শুনবো, শিশু  নক্ষত্র, নীহারিকা আর নেবুলার গল্প শুনবো।

– আর যদি সাগর হই?

– আমি হবো ময়ূরপঙ্খি ইয়ট। সাগরের ঢেউয়ে ভাসতে ভাসতে দুঃসাহসী নাবিকদের ভয়ংকর সব অভিজ্ঞতার গল্প শুনব। নাম-না-জানা দ্বীপের গল্প শুনব। দারুচিনি দ্বীপ, মশলা দ্বীপ, আইল অব পাইন, সুবর্ণদ্বীপের গল্প। টাং অব ওশান, বারমুডা ট্রায়াঙ্গেলের গোটা জাহাজ গিলে ফেলার গল্প শুনব। পাড়ি দেবো অজানা কোনো এক দ্বীপে। তারপরে সন্ধ্যা নামার মুখে নোঙর ফেলব সেই দ্বীপে। বেলাভূমিতে বসে সারাটা রাত তোমার সঙ্গে গল্প করবো। তুমি ঢেউ হয়ে ছুটে আসবে আমার কাছে আর আমার সর্বাঙ্গ ভিজিয়ে দেবে। আমি সিক্ত হবো  সম্পৃক্ত হবো। ‘আসি’ বলে চলে গিয়েও আবার ফিরে আসবে। এক দুই তিন চার … করে আমি পাড়ে বসে গুনতে থাকবো তোমার ভালোবাসার স্পন্দন।

পাইন বনের ভেতর দিয়ে এঁকেবেঁকে চলে গেছে বনপথ। জঙ্গলের ভেতর থেকে পাখির ডাক শুনতে পাচ্ছি। একটা লাফিং থ্রাশ একনাগাড়ে তার সঙ্গিনীকে ডেকে চলেছে।

আরো যে কত পাখির ডাক শুনতে পেলাম। ওজানকে বললাম, নিঝুমপুরকে তো পাখির শহর বলতে পারি।

তা পারো। এই পাখিদের জন্যেই দূষণহীন পরিবেশ গড়ে তোলা হয়েছে। তাছাড়া আমাদের এই ছোট শহরে যানবাহনের কী প্রয়োজন বলো?

স্কুল, কলেজ, হাসপাতাল, অফিস, কাছারি, বাজারঘাট যা-ই বলো না কেন সবই প্রায় চার-পাঁচ কিলোমিটারের ভেতরে রয়েছে। আর দূরে যেতে হলে ট্রেন আছে। শহরের বাইরে জাতীয় সড়কে দূরপাল্লার বাস চলে। পাশের শহরে যেতে গেলে লোকাল বাস বা ট্রেনে উঠলেই হলো। তার জন্যে তো গাড়ির দরকার নেই।  জানো, আমাদের শহরের প্রত্যেকটা মানুষ খুবই শান্তিপ্রিয়।

– আমরা এখন জারুল লেন দিয়ে হাঁটছি। ওজান বলল, এরপরে গুলমোহর লেন, পাইন লেন, দেবদারু, আমলকী লেন – এমনসব গাছেদের নামে রাস্তার নাম এখানে। ছায়ায় ঘেরা শহর। পাখির কলকাকলিতে মুখর।

আমি ওজানকে বললাম, তোমার শহরে নদী আছে?

ওজান আমার মুখের দিকে তাকাল, যেন এই প্রশ্ন করাটা নিতান্তই বোকামির পরিচয়।

বলল, তুমি কটা নদী দেখতে চাও?

আমি বললাম, নিদেনপক্ষে একটা নদী দেখাতে পারলেই আমি খুশি  হবো।

ওজান বলল, আজ রাতটা কটেজে কাটাও। কাল সকালে তোমায় নদী দেখাতে নিয়ে যাবো।

জঙ্গলের ভেতর দিয়ে ঝরঝর জল পড়ার শব্দ কানে আসছিল।

ওজানকে বললাম, ও কিসের শব্দ?

ওজান মিষ্টি করে হেসে বলল, পাহাড়ি ঝোরার জলের শব্দ।

– ঝোরা!

বাচ্চা মেয়ের মতো আমার দুই চোখে তখন খুশির ঝিলিক খেলছে।

বললাম, আমায় দেখাবে? চলো না দেখে আসি কেমন সুন্দর ঝোরাটা?

ওজান আমার হাতে আলতো চাপ দিয়ে বলল, ঝোরা আবার দেখার কী আছে?

– বাহ, দেখার নয় বলছো? আমি তো নদী পাহাড় ঝরনা এসব দেখতেই এখানে এসেছি।

– তুমি না নিরিবিলিতে লেখার জন্যে আসছো বলেছিলে?

– হ্যাঁ, বলেছিলাম। আর নদী দেখার কথাও তো বলেছিলাম। মনে নেই তোমার? 

আমি ছদ্ম অভিমানের সুরে বলি।

ওজান আমায় বলল, কাল সকালে ঘুম থেকে উঠেই তোমায় নিয়ে যাবো নতুন এক জায়গায়।

সে-রাতে আমার কিছুতেই ঘুম এলো না। তখন মধ্যরাত। আমি কটেজের ব্যালকনিতে এসে দাঁড়ালাম। চারিদিকে অপূর্ব এক মায়াবী আলো ছড়িয়ে পড়েছে। আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখি পূর্ণিমার চাঁদ তার মহিমা ছড়াচ্ছে। দিগন্তবিস্তৃত চা-বাগিচা নীলাভ জ্যোৎস্না মাখছে। দূরে আবছায়া পাহাড়ের সারি, মনে হচ্ছে বুনো হাতির দল পিঠে পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

এমন নিঃসীম উদার উন্মুক্ত আকাশ, দিগন্তবিস্তৃত চা-বাগিচা, এমন মায়াময় জ্যোৎস্নাপ্লাবিত রাত্রি আমি এর আগে কখনো দেখিনি।

রাতের কী অপূর্ব রূপ – যে এক রাত এমন পরিবেশে না কাটিয়েছে তাকে বলে বোঝানো যাবে না। চরাচর জুড়ে এক অপার্থিব নীরবতা, এক মনোমুগ্ধকর শান্তি বিরাজ করছে।

আমি বেশ কিছুটা সময় ধরে সেই নৈঃশব্দ্যের অপূর্ব রূপমাধুর্য হৃদয়ঙ্গম করলাম। দূর বহুদূর থেকে  অস্পষ্ট শব্দ কানে আসছে। শুনতে পাচ্ছি নৃত্যের ছন্দের মতো অপূর্ব এক ছন্দোবদ্ধ ধ্বনি। সেই সুরমাধুর্য আমায় মোহিত করে তুললো।

ভাবলাম, কাল সকালে হলে ওজানের কাছে জেনে নেবো এমন ছন্দময় শব্দ কীসের।

ওজান পাশের ঘরে ঘুমাচ্ছে। ও জানে না যে, আমি এতো রাত পর্যন্ত জেগে বাইরে বসে আছি। 

একটা রাতচরা পাখি হঠাৎ ডানা ঝাপটিয়ে বিচিত্র সুরে ডেকে উঠল। তাকিয়ে দেখি রিসোর্টের ঠিক সামনে ডালবর্জিয়া গাছের ডালে বসে আছে পাখিটা। মনে হলো আমার দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে একবার দেখে নিল। 

পাহারাদার এগিয়ে এসে বলল, কোনো সমস্যা ম্যাডাম?

আমি মাথা নেড়ে বললাম, নাহ, কিছু না।

– শুতে যান ম্যাডাম। এতো রাতে বাইরে থাকা ঠিক না।

– কেন বলো তো?

– কত রকমের হিংস্র জীবজন্তু বের হয়। যান, ঘরে যান। আর রাতে শব্দ হলেও দরজা খুলবেন না।

আমাদের কটেজটা মাটি থেকে প্রায় একতলা সমান উঁচু পিলারের ওপরে বানানো হয়েছে। বন্যজন্তুদের হাত থেকে বাঁচতে এই অভিনব প্রক্রিয়া। জানালাগুলিও বেশ খানিকটা ওপরে।

রাত পাহারাদারের অনুরোধ রাখতে অগত্যা আমাকে ঘরে চলে আসতে হলো।

কাচের জানালার পর্দা সরাতেই দেখি পূর্ণচন্দ্র আমার বিছানার ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়েছে।

লুটোপুটি খাচ্ছে ধবল জ্যোৎস্না। আমার বালিশে নরম গদিতে মাখামাখি।

বালিশে মাথা রেখে তাকিয়ে রইলাম সোমাভার দিকে।

ঘুম ভাঙল ওজানের ডাকে।

ওজানের সঙ্গে চলেছি।

দিগন্তবিস্তৃত বালির চর। ওজান বলল, এখানে মোট পাঁচটা নদী আছে। এখন কিছুই বুঝতে পারবে না। বর্ষায় কত ভয়ংকরী। তাকিয়ে দেখি ধুধু বালুচর দিগন্ত ছুঁয়েছে।

বাঁদিকের পাহাড়ের গায়ে বেশ কিছুটা অঞ্চল ধুধু করছে। কোনো গাছপালা, নিদেনপক্ষে ঘাস পর্যন্ত নেই। মনে হচ্ছে, কেউ পাহাড়ের গায়ের চামড়া তুলে নিয়েছে। দগদগ করছে ক্ষত। বললাম, এই জায়গাটা এরকম কেন?

ওজান বলল, এই পাহাড়ের ওপাশে একটা ঝোরা আছে। এখন তার অস্তিত্ব না থাকলেও বর্ষায় সে প্রলয়ংকরী হয়ে ওঠে। অনেক ওপর থেকে প্রবল জলরাশি নিয়ে সে নেমে আসে। কী উদ্যম তার গতি। চোখে না দেখলে বোঝানো কঠিন। গতবার দুটো গ্রাম নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। জলের তোড়ে ভাসিয়ে নিয়ে গেছে গোটা দুটো পাহাড়ি জনপদ। এটা তারই চিহ্ন। লোকে একে নাম দিয়েছে পাগলা ঝোরা।

হ্যাঁ, বর্ষায় এলে দেখতে কূলহারা জলরাশি উদ্দাম গতিতে ছুটে চলেছে। তখন পাহাড়ের ওপরে ওই যে গ্রাম দেখতে পাচ্ছো না – ওই জনপদ মূল শহর থেকে একেবারে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। তিন মাস তারা কার্যত বন্দি থাকে ওই পাহাড়চূড়ায়।

আমি আতঙ্কিত হই ওজানের কথা শুনে। ধরো, কারো যদি অসুখ করে? করতেই তো পারে। তিন মাসের ভেতরে কেউ অসুস্থ হবে না, তাই বা কী করে হয়?

– কিচ্ছু করার নেই। ওই ওঝা-বদ্যি তুকতাক ঝাঁড়ফুক জড়িবুটি – এসব দিয়ে টিকিয়ে রাখে।

– আর প্রেগন্যান্ট মায়েরা?

– তারা বর্ষার শুরুতেই অন্য জায়গায় সরে যায়।

মশলা বনের ভেতর দিয়ে এঁকেবেঁকে চলে গেছে পথ। বেশ খাড়া পথ ধরে আমরা অনেকটা উঁচুতে উঠে এসেছি। জঙ্গলের ভেতর দিয়ে পাথুরে রাস্তা। দুপাশে দেবদারু, খয়ের, আমলকী, হরীতকী আর সুপারি গাছের সারি। ভেতরে নানা গুল্মজাতীয় উদ্ভিদ। এলাচ এবং দারুচিনি গাছ দেখাল ওজান। লবঙ্গ লতিকায় ফুল এসেছে। লতানো গোলমরিচ গাছ দেখালো। এতোটা ওপরে উঠে খুব ক্লান্ত বোধ করছিলাম। ওজান আমাকে একট হরীতকী গাছের ছায়াতলে এনে বসালো।

সবুজ পাতায় ঢাকা হরীতকী গাছের শীতল ছায়ায় বড়োসড়ো একটা সমতল পাথরের ওপরে বসে ওজান শোনাতে লাগল এই পাহাড়ি গ্রামের কথা। বহু প্রাচীন এই জনপদ। এখানে বাস করছে লুপ্তপ্রায় এক জনজাতি। পৃথিবীর আর কোথাও তাদের অস্তিত্ব নেই। জঙ্গলের ভেতরে তাদের বসতি নজরে পড়ল। মাটি থেকে কয়েক মিটার উঁচুতে বাঁশের পাটাতনের ওপরে বানিয়ে নিয়েছে কাঠের ঘর। আকারে খুবই ছোট ছোট ঘরে ছেলেমেয়ে নিয়ে থাকে।

ঘরের সামনে শূকর আর ছাগল ঘুরে বেড়াতে দেখলাম। কয়েকজন মহিলা মাথায় করে বন থেকে শুকনো কাঠ আর
ছাগল-গরুর খাবার আঁটি বেঁধে নিয়ে আসছে। বয়স আর বোঝার ভারে ন্যুব্জ হয়ে হাঁটছে।

কিছুটা পথ চলার পরে শুনতে পেলাম অপূর্ব ছন্দময় ধ্বনি। ঠিক কাল রাতে এই শব্দই কানে এসেছিল মনে হলো।

যত ওপরের দিকে উঠছি তত প্রবল শোনাতে লাগল।

মনে হচ্ছে আশেপাশে  মুষলধারায় বৃষ্টি নেমেছে।

আমি ওজানকে বললাম, শুনতে পাচ্ছো ওজান? কীসের শব্দ বলো তো? পাহাড়ের ওদিকে কি বৃষ্টি হচ্ছে? কাল রাতেও শুনেছি তখন তুমি ঘুমাচ্ছিলে। ভাবলাম তোমায় ডেকে শোনাই। রাতে ফুটফুট করছে জ্যোৎস্না অথচ বৃষ্টির শব্দ। কী ছন্দময় তার ধ্বনি। আমি মেলাতে পারছিলাম না।

ওজান আমাকে জঙ্গলের ভেতর দিয়ে শুঁড়িপথ ধরে পাহাড়ের অনেকটা উঁচুতে নিয়ে এলো।

আমি মুগ্ধ হয়ে শুনছি সেই শব্দ। কী হতে পারে ভাবছি।

ওজান হঠাৎ এক জায়গায় দাঁড়িয়ে পড়ল।

– কী ব্যাপার দাঁড়িয়ে পড়লে কেন?

ওজান ওপরের দিকে তাকাল।

আমিও ঘাড় উঁচু করে দেখি পাহাড়ের অনেকটা ওপর থেকে গড়িয়ে আসছে দুধসাদা জলরাশি। প্রচণ্ড গর্জনে নেমে আসছে নিচের দিকে।

অপূর্ব এক ঝরনা পাহাড়ের গা বেয়ে নিচে যেখানে এসে পড়ছে সেখানে একটা ছোটখাটো হ্রদের সৃষ্টি হয়েছে। ঘন বনের ভেতরে হ্রদটা। বেশ ছায়াচ্ছন্ন পরিবেশ। এগিয়ে যাই প্রাকৃতিক সেই হ্রদের দিকে। কী স্বচ্ছ জল! নিচের পাথরগুলির রং পর্যন্ত আলাদা করা যাচ্ছে।

গাছের পাতা ভেদ করে সামান্য সূর্যালোক এসে পড়েছে।

জলরাশি সহস্র কণায় বিশ্লিষ্ট হয়ে চতুর্দিকে মেঘ-কুয়াশার সৃষ্টি করেছে।

 অপূর্ব এক রামধনু সৃষ্টি হয়েছে। সে এক নৈসর্গিক দৃশ্য। আমি মুগ্ধ হয়ে মেঘ-কুয়াশা আর রামধনুর শোভা দেখতে লাগলাম।

প্রচুর বুনোফুল ফুটে ছিল বনে। কয়েকটা পাখি দেখলাম জলের কিনারায় এসে খেলা করছে। ওজানই চেনালো, বলল, এগুলি হলো ধোবি পাখি। এরা সারাটা দিন এই জলের ধারে ঘুরে বেরায়। তাই এদের এমন নাম।

কথাগুলি বলে ওজান এগিয়ে গেল।

আমায় বলল, তুমি আসতে পারো।

– কোথায় চললে?

– এই তো –

ওজান ক্রমশ নিচের দিকে নামতে লাগল। হ্রদ ছাপিয়ে যেদিকে জলধারা নদী হয়ে বয়ে চলেছে সেইদিকে হাঁটতে লাগল। আমিও ওজানের সঙ্গে সঙ্গে চলেছি। হাঁটতে হাঁটতে একসময় বললাম, তুমি তো আমার কথা কিছুই জানতে চাইলে না?

– কোন কথা?

– আমার অতীত জীবনের কথা, কিছুই কি তোমার জানার নেই? 

ওজান বলল, অতীত খুঁড়তে নেই, কষ্ট পাবে।

– তবু তোমার জানা দরকার।

– আমি কিছুই জানতে চাই না। আমি শুধু বর্তমানকে নিয়েই বেঁচে থাকতে চাই।

– আমার ভাগ্যে কী লেখা আছে জানো?

– না, যা জানি না তাকে আগে থেকে ভেবে নিয়ে অকারণ কষ্ট পেতে রাজি নই।

– আমি ভীষণ একা ওজান।

কথাটা বলতে গিয়ে আমার ঠোঁট কেঁপে উঠল।

ওজান ঘাড় ঘুরিয়ে আমার দিকে একপলক তাকাল। তারপরে বলল, তুমি নদীটাকে দেখে শেখো। এই ছন্দময় চলাটাই হলো জীবন। এই বহমানতাই বর্তমান। তুমি শাখা ছড়াও, অববাহিকার পরিধি বাড়াও। ব্যাপ্ত করো চারিদিকে নিজেকে। নিজের ক্ষেত্র নিজেকেই গড়ে নিতে হয়। অতিথি উপনদীদের ডাক দাও। তারাও মিলিত হোক। বন্ধন সূত্র রচনা করো। সবাইকে নিয়েই তো এই গোটা আমি। শুধু ‘আমি’ তো অর্থহীন।

এই নদীটার গতিপথ ধরে আমি আর ওজান চলেছি। কত গ্রাম শহর বন জঙ্গল কত জনপদ কত শস্যক্ষেত কত ঊষর প্রান্তর পার হয়ে চলেছি। কত মানুষ দেখলাম, কত বিচিত্র তাদের জীবনধারা। কত যন্ত্রণাময় মানুষ যেমন দেখেছি, তেমনি আনন্দমুখর কর্মচঞ্চল মানুষ দেখলাম।

আমি সারাটা জীবন ধরে একজন মানুষের খোঁজ করেছি। স্বচ্ছ নদীর জলের মতো যার হৃদয়। সরলতা যার বৈভব।

ওজানের দেখানো পথ ধরে আমি নদীটার তীর ধরে হেঁটে চলেছি দিন মাস বছর …।

পিপাসার্ত হলে আঁজলা ভরে সেই নদীটার জল পান করে তৃষ্ণা মিটিয়েছি। পথ হয়েছে বন্ধু। পথ চলছি, মানুষের দাওয়ায় বসে যে যা দিয়েছে আগ্রহসহ সেই খাদ্য-পানীয় গ্রহণ করে আবার চলা শুরু করেছি। একলা পথিক হয়ে ঘর থেকে বেরিয়েছিলাম – এখন দেখছি আমি আর একলা নই। আমার চিন্তায় মননে এখন শত-সহস্র মানুষের ভিড়। মন সারাটা দিন তাদের সঙ্গে কথা বলে চলেছে অহরহ।

ক্লান্ত হয়ে আমি এক সুশীতল ছায়াবৃক্ষের তলে এসে বসি। ওজান আমাকে ছেড়ে চলে গেছে বহুদিন। বলেছে তাকে আর আমার দরকার নেই। যতটুকু সময় দরকার ছিল সে আমাকে সঙ্গ দিয়েছে।

এবারে ও আবার একজনকে খুঁজে নেবে যে আমার মতোই নিঃসঙ্গ। বিষাদ রাক্ষস যাকে আস্তে আস্তে গ্রাস করতে চলেছিল। অবসাদে ভঙ্গুর হয়ে যেমন পড়েছিলাম এই আমি।

দিনের পর দিন নিদ্রাহীন রাত কাটিয়েছি। জেগে বসে শুধু অতীত খুঁড়ে যেতাম। কী চেয়েছিলাম আর কী পেলাম এই
হিসাব-নিকাশ করতে করতে দিন কেটে যেতো।

কখনো ভাবিনি আমার বাইরে এই যে বিশাল এক ক্ষেত্র ছড়িয়ে আছে। এই যে লাখ লাখ কোটি কোটি মানুষ একবারের জন্যে তাদের কথা যদি ভাবি তখন এই ক্ষুদ্র ‘আমি’র কষ্ট কর্পূরের মতো এক নিমেষে উবে যাবে।

ওজান আমাকে সেই কথাই বলে গেল। এই অন্তর্মুখী মানুষটাকে ওজান বহির্মুখী করে তুলল।

আমি একসময়ে মুঠো মুঠো ওষুধ খেতাম। এখন আর আমার কিছুই দরকার পড়ে না। একসময় ভাবতাম, বড়ো বাড়ি দামি গাড়ি এসি ছাড়া আমার এক বিন্দু চলবে না। এতোটাই বিলাসী ছিলাম। এখন পথই আমার ঘর, পথচলতি মানুষ আমার বন্ধু। গাছের তলা আমার গৃহ।

বহুদিন বাদে আমার চিকিৎসকের কথা মনে পড়ল। মানসিক অবসাদে আমি যখন ভঙ্গুর হয়ে যাচ্ছিলাম তখন তিনি আমায় সুস্থ করে তোলার চেষ্টা করছেন।

সেই সাইকিয়াট্রিস্ট একদিন একটা ঠিকানা দিয়ে বলেছিলেন, আপনি এনার সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেন। পরোপকারী। অনেকের অনেক রকমের উপকার করেছেন। শুধু ওষুধ খেলে হবে না। আপনার একটু বাইরে যাওয়া দরকার। এই যে সর্বক্ষণ ঘরের ভেতরে থাকেন – এভাবে রোগ সারবে না।

সেই চিকিৎসকই আমাকে ওজানের নাম্বার দিলেন। বললেন, ফেসবুকে যোগাযোগ করতে পারেন।

আমি বললাম, মানুষটাকে কী করে চিনব? আমি তো তার কোনো ফটো দেখিনি। তার নাম থাকবে তো?

চিকিৎসক বললেন, নাম থাকবে না, তবে ছবিতে একটা পেয়ালার ফটো দেখতে পাবেন। নাম অবশ্য থাকতে পারে। 

– কী নাম তার?

– ওজান।

– ওজান!

আমি নামটা মনের খাতায় লিখে নিলাম।

তারপরে ঘরে এসে মোবাইল অন করে ফেসবুকে গিয়ে দেখতে পেলাম একজন আমাকে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠিয়েছে। একটা রুপোর পেয়ালার ছবি। নিচে লেখা, ওজান। ব্যস এটুকুই।

ডাক্তারবাবু না বললে এমন একজনের ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট আমি কিছুতেই অ্যাকসেপ্ট করতাম না।

এরপরে কেটে গেছে বহুকাল। আমার এখন আর নিশ্বাস ফেলার সময় নেই। এতো লেখার প্লট মাথায় গিজগিজ করে। এতো এতো মানুষের সঙ্গে কথা বলতে হয়। সর্বক্ষণ যেন মানুষের ভেতরে আছি মনে হয়।

আগে সময় কাটতো না আর এখন সময় বের করতে পারি না।

বহুদিন বাদে সেবার পূজার লেখাজোখাগুলি দপ্তরে পৌঁছে দিয়ে ক্ষণিকের অবসর মিলল। তো ভাবলাম বহুদিন তো নিঝুমপুরে যাওয়া হয়নি। যাই একবার। ওজানকে এরপরে আর কখনো ফেসবুকে দেখতে পাইনি। ওর নাম্বারে ফোন করেও যোগাযোগ করতে পারলাম না। খুব অপরাধী মনে হতো। কতদিন ওর সঙ্গে কথা বলা হয়নি। যে আমায় নতুন জীবন দিলো, বেঁচে থাকার প্রকৃত অর্থ কী শিখলাম তার কাছ থেকে, তাকে এতোদিন ভুলে ছিলাম কেমন করে। আমার আত্মগ্লানি হচ্ছে ভীষণ। ওজান কি আমায় ভুল বুঝল? কোথায় গেল ছেলেটা?

একদিন ওজান যে ট্রেনের টিকিট কেটে দিয়েছিল আমি নিজেই টিকিট কেটে সেই ট্রেনে উঠে বসলাম। জানালায় মাথা দিতেই হাজার চিন্তার ভিড়ে আচ্ছন্ন হলাম।

প্রচুর লোক উঠেছে ট্রেনে। সবাই কি আমার মতো এই দিকেই ঘুরতে যাচ্ছে?

এতো লোক ট্রেনে উঠেছে দেখে খুব অবাক হলাম। সিট তো মাত্র এই কটা। এতো লোক থাকবে কোথায়?

যাই হোক আমার চিন্তার নিরসন ঘটাল টিটি এসে।

নির্ধারিত সময়ে নিঝুমপুরে নেমে গেলাম।

আজ আর আমার জন্যে কেউ অপেক্ষায় ছিল না। ওজানের জানার কথা নয় যে আমি আসছি।

আমি সেদিনের সেই পথ ধরেই হাঁটছি। মনে হচ্ছে প্রায় সবই চেনা। সেই প্রথম দিনের যে অদেখা অজানা অনাস্বাদিত পুলক অনুভব করেছিলাম তার কিছুমাত্র অনুভূতি আমার ভেতরে জাগল না। তবু আমি হেঁটে গেলাম সেই চা-বাগিচার ভেতরে রিসোর্টের দিকে। দেখি বাংলোটা আরো সুন্দর সেজে উঠেছে। সবুজ চা-বাগিচা আরো সবুজতর হয়েছে। বাংলোর পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া নদীটা তেমনি কুল কুল ছন্দে বয়ে চলেছে। দূরে ঢেউ খেলানো পাহাড়ের সারি। বড্ড মায়াবী বলে মনে হলো।

আমি আনন্দে উল্লসিত হলাম। জারুল গুলমোহর পাইন গাছের ছায়া শীতল পথ ধরে হাঁটতে লাগলাম। বিভিন্ন জনের কাছে ওজান নামে এখানে কেউ আছে কি না জিজ্ঞাসা করলাম। আসলে সেদিন আমার একটা ভুল হয়ে গিয়েছিল। আমি এতোটা সময় ওজানের সঙ্গে কাটালাম অথচ একবারের জন্যেও ওজানের বাড়িটা কোথায় জানা হয়নি। সঠিক ঠিকানা না জানায় এখন সত্যি হাত কামড়াতে হচ্ছে।

কী ভুল করেছিলাম। যার সঙ্গে এতোটা সময় কাটালাম, এতো পথ যে আমার সঙ্গী ছিল তার নিজের কথা একবারের জন্যও কিন্তু শোনা হয়নি। আসলে আমি তখন আমার সমস্যা নিয়েই বেশি ব্যস্ত ছিলাম।

এখন কোথায় পাবো ওজানকে আমি?

নাহ, কেউই বলতে পারল না। ওজানের কোনো ছবি আমার কাছে নেই। যে ছবি দেখিয়ে মানুষজনকে বলতে পারি এমন চেহারার কোনো যুবককে কি দেখেছেন? এখানেই সে থাকতো।

সারাটা দিন ঘুরে হতাশ হয়ে ফিরে এলাম স্টেশনে।

মনটা বিষাদে ভারাক্রান্ত হয়ে এলো।

মনে হলো, কেন এলাম? না এলেই ভালো হতো। নিঝুমপুর আমার স্বপ্নের জায়গা। ওজানের সঙ্গে কাটানো দিনগুলি আমার জীবনের সেরা উপহার। সেটাই আমি যত্ন করে রেখে দিতে পারতাম। এই নিঝুমপুর তো আমি চাইনি?

রাতের ট্রেন ঠিক সময়ে এসে দাঁড়ালো নিঝুমপুরে।

আমি ট্রেনে চেপে বসলাম। জানালার ধারে আমার সিট।

জানালা দিয়ে স্টেশনটা আর একবার দেখে নিলাম। একটু একটু সরে যাচ্ছে প্ল্যাটফর্ম। ট্রেনটা এগিয়ে চলেছে আর ক্রমশ দূরে সরে যাচ্ছে স্টেশনটা। একটু বাদে স্টেশনের ক্ষীণ আলোকরেখাটুকুও মিলিয়ে গেল। একটা অন্ধকার সুড়ঙ্গের ভেতর দিয়ে ছুটে চলেছে রাতের ট্রেন। যতদূর দেখা যায় আলোর চিহ্ন মাত্র নেই। নিঝুমপুর ছেড়ে এসেছি বহুক্ষণ।

জানালায় মাথা রেখে ভাবতে ভাবতে ঝিমুনিমতো এসে গিয়েছিল। দেখি ওজান আমার মাথার কাছে দাঁড়িয়ে আছে। আমি চমকে উঠলাম। বললাম, তুমি? জানো, আমি তোমাকে কত জায়গায় খুঁজেছি।

– কেন?

– বাহ্, তোমায় দেখতে ইচ্ছা করে না বুঝি?

– আমি তো তোমার মনের ভেতরেই আছি। কি আছি না?

– হ্যাঁ, তা আছো। তবু –

– তবু কী? আমাকে তোমার আর কি প্রয়োজন আছে?

– প্রয়োজন নেই বলছো?

– তোমায় তো সেই আশ্চর্য পেয়ালা ধরিয়ে দিয়েছি। অনেক কাজ তোমার এখন। যে-কাজ আমি করতাম এখন তোমার দায়িত্ব সেটাই। এই পেয়ালা সবাইকে দেওয়া যায় না। উপযুক্ত মানুষ বাছতেই সময় চলে যায়। আমি তোমার ভেতরে সেই মানুষটাকে খুঁজে পেয়েছিলাম। জানি তুমি পারবে এই পেয়ালার ভার বহন করতে।

আমি বললাম, হ্যাঁ, আমি সেই দায়িত্ব পালন করতেই তো নিঝুমপুরে এসেছি। আজ একজনের আসার কথা আছে। তাকে নিয়ে যাওয়ার জন্য আমায় স্টেশনে থাকতে হবে।  

হঠাৎ একটা ঝাঁকুনিতে ট্রেনটা দাঁড়িয়ে পড়ল। আর আমার ঘুম ভেঙে গেল। আমি বিস্ময়ে চারদিকে তাকিয়ে বুঝতে পারলাম, এতোক্ষণ আমি স্বপ্নের ভেতরে আর এক স্বপ্ন দেখছিলাম।

পরের স্টেশন নিঝুমপুর। আমার পাশে বসা সহযাত্রী আমায় ডেকে দিয়ে বলল, আপনি নিঝুমপুরে নামবেন বলেছিলেন না? সামনেই –

আমি মুখে সামান্য কৃতজ্ঞতার হাসি নিয়ে ধন্যবাদ জানালাম।

স্বপ্নটা মিথ্যে নয়। আমি ওজানের দায়িত্ব নিয়ে কাজ শুরু করেছি পুরোদমে। একদিন ওজান আমার দায়িত্ব নিয়েছিল আর আজ আমি আর একজনের দায়িত্ব নিয়েছি। এরপরে সেই পেয়ালা চলে যাবে আর একজনের হাতে। সে তখন হয়ে উঠবে নিজেই জামশেদিয়া পেয়ালা।

এখন আমার ফেসবুক খুললে আমার ফটোর পরিবর্তে দেখা যায় একটি রুপোর পেয়ালা।

আমার নামের পরিবর্তে লেখা আছে – ‘ওজান’।

এই পেয়ালা আর এই নামটার দায়িত্বভার তুলে দেওয়ার মানুষটার খোঁজেই আমার আজ নিঝুমপুরে আসা।

দেখি কোথায় তারে পাই।