মানবচিন্তার বর্তমান উন্নয়ন ও বিকাশে আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানের ভূমিকা

অনুবাদ : সুব্রত বড়ুয়া

পূর্ববর্তী অধ্যায়গুলিতে আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানের দার্শনিক তাৎপর্যসমূহ নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে এটি দেখাতে যে, বিজ্ঞানের সবচেয়ে আধুনিক এই অংশটি বহু বিষয়ে চিন্তার অতিপুরনো প্রবণতাগুলিকে ছুঁয়ে যায়, অর্থাৎ এটি নতুন দৃষ্টিকোণ থেকে কিছু অত্যন্ত পুরনো সমস্যার দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করেছে। এ-কথা সম্ভবত বেশ সাধারণভাবে সত্য যে, মানবচিন্তার ইতিহাসে সবচেয়ে ফলপ্রদ উন্নয়নগুলি প্রায়শ সেসব স্থানে ঘটে যেখানে দুটি ভিন্ন চিন্তাধারা মিলিত হয়। এসব চিন্তাধারার মূলসমূহ হয়তো থাকতে পারে মানব সংস্কৃতির দুটি যথেষ্ট ভিন্ন অংশে, ভিন্ন সময়গুলিতে অথবা ভিন্ন সাংস্কৃতিক পরিবেশসমূহে অথবা ভিন্নধর্মীয় ঐতিহ্যসমূহে; অতএব সেগুলি যদি বাস্তবে মিলিত হয়, অর্থাৎ যদি অন্তত পরস্পরের সঙ্গে এত বেশি সম্পর্কিত হয় যে, বাস্তব মিথস্ক্রিয়া ঘটতে পারে, তাহলে আশা করা যেতে পারে যে, নতুন ও আকর্ষণীয় কিছু ঘটবে। আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানের একটি অংশ হিসেবে পারমাণবিক পদার্থবিজ্ঞান আমাদের কালে প্রকৃতপক্ষে অত্যন্ত ভিন্ন সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যসমূহে অনুপ্রবেশ করেছে। এটি শুধু ইউরোপ ও পাশ্চাত্য দেশগুলিতে পড়ানো হয় না যেখানে তা প্রাকৃতিক বিজ্ঞানসমূহের মধ্যে ঐতিহ্যবাহী সক্রিয়তার অন্তর্গত, বরং এর পঠন-পাঠন ও চর্চা চলছে দূরপ্রাচ্যেও – জাপান, চীন ও ভারতের মতো দেশগুলিতেও তাদের যথেষ্ট ভিন্ন সাংস্কৃতিক পটভূমিসহ, এবং রাশিয়ায়, যেখানে আমাদের সময়ে চিন্তার একটি নতুন ধারা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে; উনিশ শতকের ইউরোপের বিশেষায়িত বৈজ্ঞানিক উন্নয়ন এবং রাশিয়ার নিজের পুরোপুরি ভিন্ন ঐতিহ্যসমূহ – উভয়ের সঙ্গে সম্পর্কিত। অবশ্য পরবর্তী আলোচনার উদ্দেশ্য হবে না আধুনিক পদার্থবিজ্ঞান এবং পুরনো ঐতিহ্যগুলির ধারণাসমূহের মধ্যে সম্মুখসংঘর্ষের সম্ভাব্য ফলাফল সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করা। কিন্তু বিভিন্ন ধারণার মধ্যে মিথস্ক্রিয়া যেখান থেকে শুরু হবে সেসব বিষয়ের সংজ্ঞার্থনির্ণয় হয়তো সম্ভব হতে পারে।

আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানের এই প্রসারণ-প্রক্রিয়া বিবেচনা করতে গিয়ে অবশ্যই একে প্রাকৃতিক বিজ্ঞান, শিল্প ও প্রকৌশল, ভেষজ ইত্যাদি অর্থাৎ যথেষ্ট সাধারণভাবে বিশ্বের সকল অংশের সার্বিক প্রসারণ থেকে পৃথক করে ফেলা সম্ভব হবে না। আধুনিক বিজ্ঞান আসলে বেকন, গ্যালিলিও ও কেপলারের কাজ এবং সপ্তদশ ও অষ্টাদশ শতাব্দীতে প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের ব্যবহারিক প্রয়োগ থেকে শুরু হওয়া দীর্ঘ শিকলের একটি সংযোগ মাত্র। প্রাকৃতিক বিজ্ঞান এবং কারিগরি বিজ্ঞানের মধ্যেকার সম্পর্ক সবসময় ছিল পারস্পরিক সহযোগিতার সংযোগ : কারিগরি বিজ্ঞানে অগ্রগতি, হাতিয়ারসামগ্রীর উন্নয়ন, নতুন কারিগরি কৌশলসমূহের উদ্ভাবন প্রকৃতির অধিক থেকে অধিকতর নিখুঁত, প্রায়োগিক জ্ঞানের ভিত্তি জুগিয়েছে, এবং প্রকৃতিকে বুঝতে পারার ক্ষেত্রে অগ্রগতি ও চূড়ান্তভাবে প্রাকৃতিক নিয়মসূত্রগুলির গাণিতিক সূত্রায়ন কারিগরি বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে এই জ্ঞানের নতুন প্রয়োগসমূহের পথ খুলে দিয়েছে। দৃষ্টান্তস্বরূপ, টেলিস্কোপের উদ্ভাবন জ্যোতির্বিদদের পূর্বের চেয়ে আরো নিখুঁতভাবে তারকাসমূহের গতি পরিমাপ করার সুযোগ করে দিয়েছে; এর ফলে জ্যোতির্বিজ্ঞানে ও বলবিদ্যায় উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন সম্ভব হয়েছিল। পক্ষান্তরে যান্ত্রিক সূত্রগুলির যথাযথ জ্ঞান ছিল যান্ত্রিক হাতিয়ারসামগ্রীর উন্নয়ন, ইঞ্জিন নির্মাণ ইত্যাদির জন্য সবচেয়ে বেশি মূল্যবান। প্রকৃতির বলগুলির মধ্যে কিছু মানুষের ব্যবহারে নিয়োগ সম্ভব হওয়ার ফলে প্রাকৃতিক ও কারিগরি বিজ্ঞানের এই সমন্বয়ের বিশাল সম্প্রসারণ শুরু হয়েছিল। যেমন, কয়লার মধ্যে সঞ্চিত শক্তি সেই কাজের কিছু কিছু সম্পন্ন করতে সমর্থ হলো যে কাজ এর আগে মানুষদের নিজেদেরই করতে হতো। এসব নতুন সম্ভাবনার ভেতর থেকে যেসব শিল্প-কারখানা গড়ে উঠতে থাকে সেগুলিকেই প্রথমে বিবেচনা করা যেত পুরনো শিল্পকাজগুলির অনুগামিতা ও প্রসারণ হিসেবে; বহু ক্ষেত্রেই যন্ত্রের কাজগুলি এখনো পুরনো দিনের হস্তশিল্পগুলির সঙ্গেই সাদৃশ্যপূর্ণ এবং রাসায়নিক কারখানাগুলির কাজকে বিবেচনা করা যেতে পারে পুরনো কালের রঞ্জন-কারখানা ও ফার্মেসিগুলির ক্রমানুসরণ হিসেবে। কিন্তু পরবর্তীকালে শিল্পের নতুন শাখাগুলির উদ্ভব ঘটে যেগুলির সঙ্গে তুলনীয় কোনোকিছু পুরনোকালের হস্তনির্ভর শিল্পগুলিতে ছিল না – যেমন, বৈদ্যুতিক প্রকৌশল।

প্রকৃতির আরো বেশি প্রত্যন্ত অংশগুলিতে বিজ্ঞানের অনুপ্রবেশ প্রকৌশলীদের সমর্থ করে প্রকৃতির বলগুলিকে কাজে লাগাতে যা আগেকার যুগগুলিতে কদাচিৎ জানা ছিল; এবং এসব বলকে নিয়ন্ত্রণকারী নিয়মসূত্রগুলির গাণিতিক সূত্রায়নের ভাষায় বলগুলির সম্পর্কে নিখুঁত জ্ঞান সব ধরনের যন্ত্রপাতি নির্মাণের জন্য শক্ত একটি ভিত্তি গঠন করে।

প্রাকৃতিক ও কারিগরি বিজ্ঞানের এই সমন্বয়ের বিপুল সাফল্য সেসব জাতি বা রাষ্ট্র বা সম্প্রদায়কে প্রবল ভারাধিক্য (preponderance) অর্জনের দিকে চালিত করে যেসব দেশে এ-ধরনের মানবকর্মকাণ্ডের সমৃদ্ধি ঘটেছিল এবং এর স্বাভাবিক পরিণতি হিসেবে এ-ধরনের কর্মকাণ্ড এমনকি সেসব জাতিকেও গ্রহণ করতে হয়েছিল যারা ঐতিহ্যগতভাবে প্রাকৃতিক ও কারিগরি বিজ্ঞানসমূহের প্রতি অনুরাগ দেখাতে চাইত না। যোগাযোগ ও যাতায়াতের আধুনিক উপায়সমূহ অবশেষে কারিগরি সভ্যতার প্রসারের এই প্রক্রিয়া চূড়ান্তভাবে সম্পূর্ণ করে। নিঃসন্দেহে এই প্রক্রিয়া আমাদের পৃথিবীতে জীবনের শর্তগুলিকে মৌলিকভাবে বদলে দিয়েছে; এবং কেউ অনুমোদন করুন বা না করুন, কেউ একে প্রগতি বা বিপদ
যা-ই বলুন না কেন, আমাদের অবশ্যই অনুধাবন করতে হবে যে, মানবশক্তির মাধ্যমে এটি যে-কোনো নিয়ন্ত্রণকে অতিক্রম করে অনেকদূর এগিয়ে গেছে। কেউ বরং একে বৃহত্তম মাত্রায় একটি জীববিদ্যীয় প্রক্রিয়া হিসেবে বিবেচনা করতে পারেন, যার দ্বারা মানবিক জীবসত্তায় সক্রিয় কাঠামোসমূহ সীমালঙ্ঘন করে জড়বস্তুর বৃহত্তর অংশগুলিতে প্রবেশ করতে পারে এবং একে ক্রমবর্ধমান মানব জনসংখ্যার জন্য উপযোগী একটি অবস্থায় রূপান্তরিত করতে পারে।

আধুনিক পদার্থবিজ্ঞান এই উন্নয়নের সর্বাধিক সাম্প্রতিক অংশগুলির অন্তর্গত এবং দুর্ভাগ্যক্রমে এর সবচেয়ে দৃশ্যমান ফলাফল, নিউক্লীয় অস্ত্রাদির উদ্ভাবন, এই উন্নয়নের নির্যাসকে সম্ভাব্য তীব্রতম আলোয় তুলে ধরেছে। একদিকে, এটি সবচেয়ে স্পষ্টভাবে প্রদর্শন করেছে যে, প্রাকৃতিক ও কারিগরি বিজ্ঞানসমূহের সমন্বয়ের দ্বারা সংঘটিত পরিবর্তনগুলিকে শুধু আশাব্যঞ্জক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখা যেতে পারে না; এটি অন্তত আংশিকভাবে হলেও তাঁদের দৃষ্টিভঙ্গিসমূহের যৌক্তিকতা প্রতিপন্ন করেছে, যাঁরা সবসময় আমাদের জীবনের স্বাভাবিক শর্তের অনুরূপ মূলগত রূপান্তরের বিপদগুলির বিরুদ্ধে সতর্কবাণী উচ্চারণ করেছিলেন। অন্যদিকে, এটি এমনকি সেসব জাতি বা ব্যক্তিকে বাধ্য করেছে, যারা এসব বিপদ থেকে নিজেদের দূরে রাখতে চেষ্টা করেছিল, নতুন উন্নয়নের প্রতি সর্বাধিক জোরদার মনোযোগ প্রদান করতে, যেহেতু স্পষ্টত সামরিক শক্তি ভাবার্থে রাজনৈতিক শক্তি নির্ভর করে পারমাণবিক যুদ্ধাস্ত্রাদির অধিকারী হওয়ার ওপর। নিশ্চয়ই এ-বইটির প্রতিপাদ্য বিষয় নয় নিউক্লীয় পদার্থবিজ্ঞানের রাজনৈতিক তাৎপর্য নিয়ে ব্যাপক আলোচনা করা। কিন্তু এসব সমস্যা নিয়ে কিছু কথা অন্তত বলা যেতে পারে, যেহেতু পারমাণবিক পদার্থবিজ্ঞানের কথা যখন বলা হয় তখন সবসময় এটিই মানুষের মনে আসে। স্পষ্টত নতুন যুদ্ধাস্ত্রসমূহ, বিশেষত তাপ-নিউক্লীয় যুদ্ধাস্ত্রগুলি, উদ্ভাবনের ফলে বিশ্বের রাজনৈতিক কাঠামোর মৌলিক পরিবর্তন ঘটেছে। স্বাধীন জাতি বা রাষ্ট্রগুলির ধারণাই যে একটি নিশ্চায়ক পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে গেছে তা নয়, যেহেতু যে জাতি উপর্যুক্ত যুদ্ধাস্ত্রগুলির অধিকারী নয় সে জাতিকে কোনো-না-কোনো ভাবে নির্ভর করতে হয় সেই অত্যন্ত অল্প কয়েকটি জাতির ওপর যারা অনুরূপ অস্ত্রশস্ত্র ব্যাপক পরিমাণে উৎপাদন করে; এছাড়াও সেসব যুদ্ধাস্ত্রের সাহায্যে ব্যাপক ভিত্তিতে যুদ্ধবিগ্রহ চালানোর প্রয়াস বাস্তবিকভাবে সেই জাতিগুলির জন্য একধরনের অর্থহীন আত্মহত্যার বিষয়েও পরিণত হয়েছে। ফলে আমরা প্রায়শ এই আশাপ্রদ কথা শুনতে পাই যে, যুদ্ধ এখন একটি বাতিল বিষয়ে পরিণত হয়েছে এবং তা আর কখনো ঘটবে না। দুর্ভাগ্যক্রমে এই অভিমতটি একটি খুব বেশি আশাব্যঞ্জক অতিসরলীকরণ। অন্যদিকে, তাপ-নিউক্লীয় যুদ্ধাস্ত্রগুলির মাধ্যমে যুদ্ধপ্রয়াসের যুক্তিহীনতা হয়তো, প্রথম আসন্নতা হিসেবে, ক্ষুদ্র পরিসরে যুদ্ধের পক্ষে একটি উৎসাহ রূপে কাজ করতে পারে। যে-কোনো জাতি বা রাজনৈতিক গ্রুপ যারা বর্তমান পরিস্থিতির কিছু পরিবর্তন সাধনকে তাদের ঐতিহাসিক বা নৈতিক দায়িত্ব বলে স্থিরপ্রতিজ্ঞ হবে, তারা অনুভব করবে যে – এ উদ্দেশ্যে প্রচলিত যুদ্ধাস্ত্রগুলির ব্যবহার কোনো বড় ঝুঁকির কারণ হবে না; তারা ধরে নেবে যে, অপর পক্ষের নিশ্চিতভাবেই নিউক্লীয় যুদ্ধাস্ত্রসমূহ ব্যবহার করার সুযোগ থাকবে না, যেহেতু এ বিষয়ে ঐতিহাসিক ও নৈতিকভাবে নেতিবাচক অবস্থানের কারণে তারা ব্যাপক আকারে যুদ্ধ চালানোর ঝুঁকি নেবে না। এই পরিস্থিতি আবার অন্যান্য জাতিকে এ-কথা বলতে প্ররোচিত করবে যে, আক্রমণকারীদের দ্বারা তাদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া ক্ষুদ্র আকারের যুদ্ধগুলির ক্ষেত্রে বাস্তবে তাদের কাছে নিউক্লীয় যুদ্ধাস্ত্রসমূহ ব্যবহারের সুযোগ থাকবে এবং এভাবে বিপদ স্পষ্টত থেকেই যাবে। এটা খুব ভালো হতো যদি এখন থেকে আগামী প্রায় বিশ বা ত্রিশ বছরের মধ্যে বিশ্বে এমন বড় ধরনের পরিবর্তন ঘটতে পারত যে, ব্যাপক আকারে যুদ্ধবিগ্রহের বিপদ, বিরোধীদের নির্মূল করার জন্য সর্বপ্রকার কারিগরি সম্পদের প্রয়োগ বহুলাংশে হ্রাস পাবে অথবা একেবারেই অদৃশ্য হয়ে যাবে। কিন্তু এই অবস্থার দিকে যাত্রার পথটি ভয়াবহতম বিপদসমূহের দ্বারা পরিপূর্ণ। আগের মতো এখনো আমাদের অবশ্যই অনুধাবন করতে হবে যে, এক পক্ষের কাছে যা ঐতিহাসিকভাবে অথবা নৈতিকভাবে সঠিক মনে হয় অপরপক্ষের কাছে তা ভুল মনে হতে পারে। স্থিতাবস্থার ক্রমানুসরণ সবসময় যথার্থ সমাধান নাও হতে পারে; বিপরীতক্রমে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে নতুন পরিস্থিতিসমূহের সঙ্গে সমন্বয়ের শান্তিপূর্ণ উপায়সমূহ খুঁজে বের করা; এবং বহু ক্ষেত্রে কোনো ন্যায্য সমাধান আদৌ খুঁজে পাওয়া অত্যন্ত দুঃসাধ্য হতে পারে। অতএব এটা সম্ভবত খুব বেশি নৈরাশ্যজনক হবে না যে, মহাযুদ্ধ পরিহার করা কেবল তখনই সম্ভব হবে যদি সব রাজনৈতিক গ্রুপ তাদের আপাতদৃষ্টে সবচেয়ে স্পষ্ট অধিকারগুলি পরিত্যাগ করতে প্রস্তুত হয় – এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে যে, সঠিক অথবা ভুল বিবেচনার বিষয়টি অপরদিক থেকে নিশ্চিতভাবে ভিন্নরূপ মনে হতে পারে। এটি নিশ্চয়ই নতুন কোনো দৃষ্টিভঙ্গি নয়; বস্তুত এটি শুধু সেই মানবিক প্রবণতা প্রয়োগ যা বহু শতাব্দী ধরে মহান ধর্মগুলির মধ্যে কয়েকটি শিক্ষা দিয়ে আসছে।

নিউক্লীয় যুদ্ধাস্ত্রসমূহের উদ্ভাবন বিজ্ঞান ও বিজ্ঞানীদের জন্য সম্পূর্ণ নতুন সমস্যাগুলিরও জন্ম দিয়েছে। বিজ্ঞানের রাজনৈতিক প্রভাব দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পূর্বে যেমন ছিল তার চেয়ে অনেক বেশি প্রবল হয়ে উঠেছে এবং তা বিজ্ঞানীদের  বিশেষত
পরমাণু-বিজ্ঞানীদের ওপর বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে দ্বিগুণ দায়িত্ব আরোপসহ। তিনি সম্প্রদায়ের জন্য বিজ্ঞানের গুরুত্ব সম্পর্কিত বিষয় নিয়ে দেশের প্রশাসনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করতে পারেন; অতঃপর তিনি তাঁর নিজের কাজ তথা গবেষণা ও বিশ^বিদ্যালয়ের কাজকর্মের ক্ষুদ্র চৌহদ্দির অনেক বাইরের ব্যাপক গুরুত্বসম্পন্ন সিদ্ধান্তের জন্য দায়িত্বস্বীকারের মুখোমুখি হতে বাধ্য হবেন, যে কাজের দায়িত্ব তাঁর নেওয়ার কথা ছিল না। অথবা তিনি স্বেচ্ছাপ্রণোদিতভাবে রাজনৈতিক সিদ্ধান্তসমূহে অংশগ্রহণ করা থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করে নিতে পারেন; তবে তার পরও তিনি ভুল সিদ্ধান্তগুলির জন্য দায়ী থাকবেন যেগুলি তিনি সম্ভবত প্রতিরোধ করতে পারতেন যদি না তিনি বিজ্ঞানীদের নিরিবিলি শান্তজীবন অধিক পছন্দ করতেন। স্পষ্টত তাপ-নিউক্লীয় যুদ্ধাস্ত্রগুলির সাহায্যে যুদ্ধের কারণে বিশ্ব যে অভূতপূর্ব ধ্বংসের কবলে পড়বে সে-সম্পর্কে নিজেদের সরকারদের অবহিত করা বিজ্ঞানীদের কর্তব্য। এর বাইরেও, বিজ্ঞানীদের প্রায়শ বিশ্বশান্তির পক্ষে ভাবগম্ভীর প্রস্তাবে অংশগ্রহণের অনুরোধ জ্ঞাপন করা হয়; কিন্তু এই দাবির বিষয়টি বিবেচনা করে আমাকে অবশ্যই স্বীকার করতে হবে যে, আমি কখনো এ-প্রকার ঘোষণার মধ্যে কোনো বিবেচনার বিষয় খুঁজে পাইনি। এরূপ সিদ্ধান্তগুলি সদিচ্ছাকে স্বাগত জানানোর মতো প্রমাণ বলে মনে হতে পারে; কিন্তু শান্তির শর্তগুলি যথাযথভাবে উল্লেখ না করে কেউ যদি শান্তির পক্ষে কথা বলতে চান তাহলে অবশ্যই তাৎক্ষণিকভাবে সন্দেহ করা হবে যে, তিনি কেবল সেই শান্তির কথা বলছেন যে শান্তিতে তিনি এবং তাঁর গ্রুপ সবচেয়ে ভালোভাবে সমৃদ্ধি লাভ করতে পারবেন – যা অবশ্যই সম্পূর্ণত অর্থহীন হবে। শান্তির পক্ষে যে-কোনো নিষ্কপট ঘোষণা অবশ্যই হতে হবে এর সংরক্ষণের জন্য প্রয়োজনীয় আত্মত্যাগসমূহের একটি তালিকা। কিন্তু নিয়ম অনুসারে বিজ্ঞানীদের এরূপ ঘোষণা প্রদানের কোনো কর্তৃত্ব নেই।

একই সঙ্গে বিজ্ঞানী তাঁর নিজের কাজের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা বৃদ্ধির জন্য তাঁর সর্বোত্তম প্রয়াস চালিয়ে যেতে পারেন। আজকাল বহু দেশের সরকার নিউক্লীয় পদার্থবিজ্ঞানের গবেষণার ক্ষেত্রে যে বিরাট গুরুত্ব আরোপ করে থাকেন এবং বিভিন্ন দেশে বৈজ্ঞানিক গবেষণার স্তর যে ভিন্ন ভিন্ন তা এ-বিষয়ে কাজের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক সহযোগিতার দাবি রাখে। ভিন্ন ভিন্ন বহু দেশের তরুণ বিজ্ঞানীরা একত্রিত হতে পারেন গবেষণা ইনস্টিটিউশনগুলিতে যেসব প্রতিষ্ঠানে আধুনিক পদার্থবিজ্ঞান বিষয়ে ব্যাপক ক্রিয়াকর্ম চলছে; এবং এর ফলে কঠিন বৈজ্ঞানিক সমস্যাগুলির বিষয়ে যেসব অভিন্ন কাজ চলছে সেগুলির ক্ষেত্রে পারস্পরিক সমঝোতা বৃদ্ধি পাবে। একটি ক্ষেত্রের কথা জেনেভা সম্মেলনে কয়েকটি ভিন্ন দেশের মধ্যে এমনকি একটি সার্বজনিক গবেষণাগার এবং নিউক্লীয় পদার্থবিজ্ঞানের গবেষণার জন্য সমন্বিত প্রয়াসের মাধ্যমে ব্যয়বহুল পরীক্ষণ-সরঞ্জামাদি নির্মাণের জন্য ঐকমত্যে পৌঁছানোও সম্ভব হয়েছিল।

এ-ধরনের সহযোগিতা বিজ্ঞানের সমস্যাগুলির প্রতি – অভিন্ন এমনকি বিশুদ্ধ বৈজ্ঞানিক সমস্যাগুলির বাইরেও – তরুণ প্রজন্মের বিজ্ঞানীদের মধ্যে অভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি গঠনে নিশ্চয়ই সাহায্য করবে। অবশ্য কেউ আগে থেকেই জানতে পারেন না, এভাবে রোপিত বীজগুলি থেকে কী ফসল পাওয়া যাবে, যখন বিজ্ঞানীরা ফিরে যাবেন তাঁদের নিজ নিজ পুরনো পরিবেশে এবং আবার অংশ নেবেন তাঁদের নিজস্ব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যসমূহে। কিন্তু এ বিষয়ে কদাচিৎ সন্দেহ পোষণ করা যাবে যে, বিভিন্ন দেশের তরুণ বিজ্ঞানীদের মধ্যে এবং প্রতিটি দেশের বিভিন্ন প্রজন্মের মধ্যে ধারণাসমূহের বিনিময় তেমন বেশি চাপ ছাড়াই নতুন অবস্থাসমূহের দিকে অগ্রসর হতে সাহায্য করবে, যেখানে পুরনো ঐতিহ্যভিত্তিক শক্তিসমূহ ও আধুনিক জীবনের অনিবার্য প্রয়োজনসমূহের মধ্যে একটি ভারসাম্যে পৌঁছানো যাবে। এটি বিশেষভাবে বিজ্ঞানের একটি বৈশিষ্ট্য যা বিভিন্ন সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের মধ্যে প্রথম শক্ত বন্ধন গড়ে তোলার পক্ষে অধিক উপযোগী অন্য যে-কোনোকিছুর চেয়ে। এ-কথা সত্য যে, বিশেষ একটি বৈজ্ঞানিক কাজের মূল্য সম্পর্কে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তসমূহ, কাজের মধ্যে কোনটি সঠিক কোনটি ভুল, কোনো মানব-কর্তৃপক্ষের ওপর নির্ভর করে না। একটি সমস্যার সমাধান সম্পর্কে এবং সেটি সঠিক কি ভ্রান্ত সে বিষয়ে জানার আগে কখনো কখনো বহু বছর লেগে যেতে পারে; কিন্তু চূড়ান্তভাবে প্রশ্নগুলি সম্পর্কে সিদ্ধান্ত পাওয়া যাবে এবং সে সিদ্ধান্তগুলি গ্রহণ করে বিজ্ঞানীদের কোনো গ্রুপ নয়, বরং প্রকৃতি নিজেই। অতএব বৈজ্ঞানিক ধারণাগুলি বিস্তার লাভ করে তাঁদের মধ্যে যাঁরা বিজ্ঞানে আগ্রহী হন, রাজনৈতিক ধারণাগুলির প্রসারের চাইতে সম্পূর্ণ ভিন্ন এক উপায়ে।

রাজনৈতিক ধারণাগুলি যেখানে বিপুলসংখ্যক সাধারণ মানুষের মধ্যে নিরঙ্কুশ প্রভাব বিস্তার করতে পারে শুধু এ-কারণে যে, সেগুলি মানুষের মনে বর্তমান আগ্রহগুলির সঙ্গে সংগতিপূর্ণ মনে হয় অথবা সংগতিপূর্ণ বলে প্রতীয়মান হয়, সেখানে বৈজ্ঞানিক ধারণাগুলি প্রসার লাভ করবে কেবল সেগুলি সত্য বলেই। একটি বৈজ্ঞানিক বক্তব্যের সত্যতা নিশ্চিতকারী বস্তুগত ও চূড়ান্ত নির্ণায়ক মানসমূহ সেখানে রয়েছে।

আন্তর্জাতিক সহযোগিতা ও ধারণাসমূহের বিনিময় সম্পর্কে যা বলা হয়েছে তার সবই অবশ্য সমভাবে সত্য হবে আধুনিক বিজ্ঞানের যে-কোনো অংশের জন্যই; এটি কোনোভাবেই পারমাণবিক পদার্থবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে সীমিত নয়। এক্ষেত্রে আধুনিক পদার্থবিজ্ঞান শুধু বিজ্ঞানের বহু শাখার একটি মাত্র এবং এমনকি এর কারিগরি প্রয়োগসমূহ তথা অস্ত্রশস্ত্র ও পরমাণু-শক্তির শান্তিপূর্ণ ব্যবহার এই শাখার ওপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করলেও অন্য যে-কোনো ক্ষেত্রের চেয়ে এই ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক সহযোগিতাকে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনা করার কোনো কারণ থাকবে না। কিন্তু এখন আমাদের আবার আধুনিক বিজ্ঞানের এই বৈশিষ্ট্যগুলি নিয়ে আলোচনা করতে হবে যেগুলি আবশ্যিকভাবে প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের পূর্ববর্তী উন্নয়নসাধন থেকে ভিন্ন এবং এর জন্য আমাদের আবার এই উন্নয়নসাধনের ইউরোপীয় ইতিহাসে ফিরে যেতে হবে যে উন্নয়ন সাধিত হয়েছিল প্রাকৃতিক ও কারিগরি বিজ্ঞানসমূহের সমন্বয়সূচক সন্নিবেশের দ্বারা।

ইতিহাসবিদদের মধ্যে এ-কথাটি নিয়ে প্রায়শ আলোচনা হয়েছে – ষোড়শ শতাব্দীর পর প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের উত্থান কোনোভাবে মানবচিন্তার আগেকার প্রবণতাগুলির একটি স্বাভাবিক পরিণতি কি না। এ বিষয়ে তর্ক হতে পারে যে, খ্রিষ্টীয় দর্শনের নির্দিষ্ট কিছু প্রবণতা ঈশ্বরের অত্যন্ত বিমূর্ত ধারণার দিকে চালিত করেছে, তাঁরা সেখানে ঈশ্বরকে বিশ্বের এতো ওপরে স্থাপন করেছেন যে – একই সময়ে ঈশ্বরকে বিশ্বে দেখতে না পেয়ে মানুষ ঈশ্বরবিহীন এক বিশ্বের কথা চিন্তা করেছে। কার্টেসীয় বিভাজনকে (Cartesian partition) এই বিকাশলাভের ক্ষেত্রে চূড়ান্ত পদক্ষেপ বলা যেতে পারে। অথবা কেউ বিশেষভাবে বলতে পারেন যে, ষোড়শ শতাব্দীর সকল ধর্মতাত্ত্বিক মতবিরোধ সেসব সমস্যা সম্পর্কে সাধারণ অসন্তোষ সৃষ্টি করেছিল যেগুলি যুক্তি দ্বারা বাস্তবে মীমাংসা করা যায়নি এবং সে-সময়কার রাজনৈতিক সংগ্রামসমূহের কাছে উন্মোচিত করা হয়েছিল; আর এও ঘটেছিল যে, এই অসন্তোষ সেই সমস্যাগুলির ক্ষেত্রে অধিক ছিল যেগুলিকে ধর্মতাত্ত্বিক বিবাদগুলি থেকে পুরোপুরি পৃথক করে ফেলা হয়েছিল। অথবা কেউ বলতে পারেন শুধু সেই ক্রিয়াকর্মের কথা, সেই নতুন উদ্দীপনা যা ইউরোপীয় সমাজগুলিতে সঞ্চারিত হয়েছিল রেনেসাঁসের মাধ্যমে। সে যেভাবেই হোক, এ-সময়কালে একটি নতুন কর্তৃত্বের আবির্ভাব ঘটেছিল যা খ্রিষ্টধর্ম অথবা চার্চের দর্শন থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত ছিল, সেটি অভিজ্ঞতার কর্তৃত্ব, ব্যবহারিক সত্যের কর্তৃত্ব। এই কর্তৃত্বের উৎস হয়তো আগেকার কালের দর্শনগুলির মধ্যে খুঁজে পাওয়া যেতে পারে, দৃষ্টান্তস্বরূপ যেমন Occum এবং Dunas Scotus-এর দর্শনের মধ্যে; তবে তা মানুষের সক্রিয়তার প্রধান শক্তি হয়ে দাঁড়ায় কেবল ষোড়শ শতাব্দীর পর থেকে। গ্যালিলিও শুধু যান্ত্রিক গতিসমূহ, দোলক এবং পড়ন্ত প্রস্তরখণ্ড সম্পর্কেই চিন্তা করেননি; তিনি পরীক্ষণসমূহের সাহায্যে, পরিমাণগতভাবে নির্ণয়ের চেষ্টা করেছেন কীভাবে এসব গতি সংঘটিত হয়েছিল। এই নতুন সক্রিয়তা – এর শুরুতে – নিশ্চয়ই ঐতিহ্যগত খ্রিষ্টধর্ম থেকে বিচ্যুতি বোঝাত না। একটি লিখিত ছিল ‘বাইবেল’-এ এবং অপরটি পাওয়া গেছে প্রকৃতির পুস্তকে। পবিত্র গ্রন্থটি লিখেছে মানুষ এবং তাই সেখানে ভুল-ভ্রান্তি থাকা স্বাভাবিক; অন্যদিকে প্রকৃতি ছিল ঈশ্বরের অভিপ্রায়সমূহের অব্যবহিত প্রকাশ।

অবশ্য অভিজ্ঞতার ওপর জোর দেওয়ার বিষয়টি সম্পর্কিত ছিল বাস্তবতার রূপের মধ্যে একটি ধীর ও ক্রমিক পরিবর্তনের সঙ্গে। মধ্যযুগে যখন আমরা আজ যাকে বলি একটি বিষয়ের প্রতীকী অর্থ সেটি কোনো-না-কোনো ভাবে এর প্রাথমিক বাস্তবতায় ছিল, তখন বাস্তবতার রূপটি পরিবর্তিত হয় আমরা যাকে আমাদের বোধ দ্বারা প্রত্যক্ষ করতে পারি সেই রূপটির দিকে। আমরা যেটি দেখতে পাই ও স্পর্শ করতে পারি সেটিই প্রাথমিকভাবে বাস্তব হয়ে ওঠে। এবং বাস্তবতার এই ধারণাকে নতুন সক্রিয়তার সঙ্গে সংযুক্ত করা যেত : আমরা পরীক্ষণ সম্পাদন করতে এবং দেখতে পারি জিনিসগুলি বাস্তবে কেমন। এটা সহজেই দেখতে পাওয়া গেল, এই নতুন দৃষ্টিভঙ্গির অর্থ ছিল, ব্যাপক সম্ভাবনার জগতে মানবমনের প্রস্থান, এবং
এ-বিষয়টি ভালোভাবে বুঝতে পারা যায় যে – চার্চ নতুন এই আন্দোলনে আশার পরিবর্তে বিপদের আশঙ্কাই দেখতে পেল বেশি। কোপার্নিকান পদ্ধতির প্রতি তাঁর দৃষ্টিভঙ্গির যুক্ততার কারণে গ্যালিলিওর বিখ্যাত বিচার চিহ্নিত করেছিল এক সংগ্রামের সূচনা, যা অব্যাহত ছিল এক শতাব্দীরও বেশি সময় ধরে। এই মতবিরোধে প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের প্রতিভূরা যুক্তি উত্থাপন করতে পারতেন যে, অভিজ্ঞতাই নির্দেশ করে একটি অবিতর্কিত পথ এবং প্রকৃতিতে বাস্তবে কী ঘটে সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের দায়িত্ব কোনো মানব-কর্তৃপক্ষের হাতে তুলে দেওয়া যায় না; এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে প্রকৃতি অথবা এই ভাবার্থে ঈশ্বর। ঐতিহ্যবাহী ধর্মের প্রতিভূরা, পক্ষান্তরে, এই যুক্তি প্রদর্শন করতে পারতেন যে, বস্তুজাগতিক বিশ্বের প্রতি এবং আমাদের বোধসমূহ দ্বারা আমরা যা প্রত্যক্ষ করি তার প্রতি অত্যধিক মনোযোগ প্রদান করার মাধ্যমে আমরা মানবজীবনের অত্যাবশ্যক মূল্যবোধসমূহের প্রতি তথা বস্তুজাগতিক বিশ্বকে ছাড়িয়ে যে বাস্তবতা তার সঙ্গে আমাদের সংযোগ হারিয়ে ফেলি। এই দুটি যুক্তি কোথাও এক জায়গায় মিলিত হয় না এবং সেজন্য কোনোপ্রকার মতৈক্য বা সিদ্ধান্ত দ্বারা এ-সমস্যার সমাধান হবে না।

ইতোমধ্যে প্রাকৃতিক বিজ্ঞান বস্তুজাগতিক বিশ্বের আরো বেশি স্পষ্ট ও ব্যাপক চিত্র পাওয়ার পথে অগ্রসর হয়েছিল। পদার্থবিজ্ঞানে এই চিত্র বর্ণিত হচ্ছিল সেসব ধারণার সাহায্যে যেগুলিকে আমরা আজকাল চিরায়ত পদার্থবিজ্ঞানের ধারণাসমূহ নামে অভিহিত করি। বিশ্ব গঠিত দেশ-কালে অবস্থিত বস্তুসমূহ দ্বারা, ওই বস্তুসমূহ আবার গঠিত জড়বস্তু দ্বারা এবং জড়বস্তু বল সৃষ্টি করতে পারে ও বলসমূহ জড়বস্তুর ওপর ক্রিয়া করতে পারে। ঘটনাবলির আগমন ঘটে জড়বস্তু ও বলসমূহের আন্তঃক্রিয়া থেকে; প্রতিটি ঘটনাই হচ্ছে অন্যান্য ঘটনার পরিণাম ও কারণ। একইসঙ্গে প্রকৃতির প্রতি মানুষের দৃষ্টিভঙ্গিও গভীর চিন্তামূলক থেকে বাস্তববাদী বা প্রায়োগিক হয়ে ওঠে। প্রকৃতি যেমন তাতে কেউ আগ্রহী ছিলেন না; তাঁরা বরং জানতে চাইতেন

প্রকৃতিকে নিয়ে কী করা যেতে পারে। অতএব প্রাকৃতিক বিজ্ঞান পরিবর্তিত হলো কারিগরি বিজ্ঞানে; জ্ঞানের প্রতিটি অগ্রগতি সম্পর্কিত ছিল এই প্রশ্নটির সঙ্গে – এ থেকে কোনো ব্যবহারিক প্রয়োগ পাওয়া যাবে। এটি শুধু পদার্থবিজ্ঞানের ক্ষেত্রেই সত্য ছিল না; রসায়নবিদ্যা ও জীববিদ্যার ক্ষেত্রেও দৃষ্টিভঙ্গি ছিল অনিবার্যভাবে সেটিই এবং ওষুধ অথবা কৃষির ক্ষেত্রেও নতুন পদ্ধতিসমূহ আবিশ্যকভাবে অবদান রাখল নতুন প্রবণতাসমূহের প্রসারে।

এভাবে, শেষ পর্যন্ত ঊনবিংশ শতাব্দীতে প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের একটি অত্যন্ত দৃঢ় কাঠামো গড়ে ওঠে যা শুধু বিজ্ঞানের নয়  বরং বিপুলসংখ্যক মানুষেরও সাধারণ দৃষ্টিভঙ্গি গঠন করে। এই কাঠামোর সমর্থন আসে চিরায়ত পদার্থবিজ্ঞান, দেশ, কাল, সময়, জড়বস্তু এবং কার্যকারণতার মৌলিক ধারণাসমূহ থেকে; বাস্তবতার ধারণা প্রযুক্ত হয় সেই সব বস্তু বা ঘটনায় যেগুলিকে আমরা আমাদের বোধ দ্বারা প্রত্যক্ষ করতে পারি অথবা যেগুলি পর্যবেক্ষণ করা যেতে পারে কারিগরি বিজ্ঞান আমাদের যা দিয়েছে সেই সুসংস্কৃত হাতিয়ারগুলির সাহায্যে। জড়বস্তুই ছিল প্রাথমিক বাস্তবতা। বিজ্ঞানের অগ্রগতি চিত্রিত হলো জড়জগতে বিজয়ের ক্রুসেড বা ধর্মযুদ্ধ হিসেবে। উপযোগিতা কথাটি ছিল সময়ের উচ্চকিত উচ্চারণ।

অন্যদিকে, কাঠামোটি এতোই সংকীর্ণ আর অনমনীয় ছিল যে, আমাদের ভাষার এমন বহু ধারণার, যেগুলি এর সারাংশের মধ্যে সবসময়ে ছিল, এতে স্থান পাওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। এসব ধারণার দৃষ্টান্ত হিসেবে বলা যায়, মন, মানবাত্মা অথবা প্রাণ সম্পর্কিত ধারণাগুলির কথা। মনকে সাধারণ চিত্রে নিয়ে আসা সম্ভব হয়েছিল শুধু বাস্তবজাগতিক বিশ্বের একধরনের দর্পণ হিসেবে; এবং কেউ যখন মনোবিজ্ঞানে এই দর্পণের ধর্মাবলি বিষয়ে গবেষণা করতে চেয়েছিলেন তখন বিজ্ঞানীরা সবসময় এতে আগ্রহবোধ করেছিলেন – আমি যদি তুলনাকে আরো এগিয়ে নিয়ে যেতে পারি – এর আলোকতত্ত্বীয় ধর্মাবলির চেয়ে যান্ত্রিক ধর্মাবলির প্রতি আরো বেশি মনোযোগ প্রদান করতে পারি। এমনকি সেখানে একজন চিরায়ত পদার্থবিজ্ঞানের ধর্মাবলি, প্রাথমিকভাবে কার্যকারণতার, প্রয়োগ করার চেষ্টাও করেছিলেন। একইভাবে প্রাণকে ব্যাখ্যা করতে হবে – প্রাকৃতিক নিয়মসূত্রাবলি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত, সম্পূর্ণ কার্যকারণ দ্বারা নির্ধারিত একটি ভৌত ও রাসায়নিক প্রক্রিয়া হিসেবে। ডারউইনের বিবর্তনের ধারণা এই অধিব্যাখ্যার জন্য যথেষ্ট প্রমাণের ব্যবস্থাও করেছিল। এই কাঠামোর মধ্যে বাস্তবতার সেই অংশগুলির জন্য জায়গা খুঁজে পাওয়া কঠিন ছিল যেগুলি ছিল ঐতিহ্যগত ধর্মের লক্ষ্য এবং এখন যেগুলি প্রতীয়মান হচ্ছিল কমবেশি শুধু কাল্পনিক। অতএব সেই ইউরোপীয় দেশগুলিতে, যেখানে কেউ ধারণাগুলিকে তাদের চরম পরিণাম পর্যন্ত অনুসরণ করতে অভ্যস্ত ছিলেন, ধর্মের প্রতি বিজ্ঞানের একটি প্রকাশ্য বৈরিতা তৈরি হয়েছিল এবং এমনকি অন্যান্য দেশেও সেসব প্রশ্নের প্রতি ঔদাসীন্যের ক্রমবর্ধমান প্রবণতা ছিল; শুধু খ্রিষ্টধর্মের নৈতিক মূল্যবোধগুলিই এই প্রবণতার বাইরে থেকে গিয়েছিল, অন্তত কিছু সময়ের জন্য। বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি এবং যৌক্তিক চিন্তার ওপর আস্থা মানবমনের অন্য রক্ষাকবচগুলিকে প্রতিস্থাপিত করেছিল।

এখন আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানের অবদানগুলির প্রসঙ্গে ফিরে এলে কেউ হয়তো বলতে পারেন যে, এর ফলাফল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে পরিবর্তন নিয়ে এসেছিল তা হলো – আমাদের মনের ঊনবিংশ শতাব্দীর ধারণাসমূহের অনমনীয় কাঠামোকে ভেঙে দেওয়া। অবশ্য এর আগেও এই অনমনীয় কাঠামো থেকে বেরিয়ে যাওয়ার অনেক চেষ্টা হয়েছিল, যে কাঠামো স্পষ্টতই বাস্তবতার অপরিহার্য অংশগুলি অনুধাবনের পক্ষে ছিল অতিশয় সংকীর্ণ। কিন্তু বিজ্ঞানের ইতিহাসে যা এতো বেশি সফল পরিগণিত হয়েছিল সেই জড়বস্তু, স্থান-পরিসর, সময় ও কার্যকারণতার মৌলিক ধারণাগুলি নিয়ে কি সমসা হচ্ছিল তা দেখতে পাওয়া সম্ভব হয়নি। শুধু কারিগরি বিজ্ঞান দ্বারা উদ্ভাবিত অতি উন্নতমানের সরঞ্জামগুলির সাহায্যে সম্পাদিত পরীক্ষণমূলক গবেষণা এবং এর গাণিতিক অধিব্যাখ্যাই বিচারমূলক বিশ্লেষণের ভিত তৈরি  করেছিল – অথবা কেউ হয়তো বলতে পারেন যে, এসব ধারণার বিচারমূলক বিশ্লেষণ করতে বাধ্য করেছিল এবং অবশেষে পরিণামস্বরূপ অনমনীয় কাঠামোটি ভেঙে পড়েছিল।

ভেঙে পড়ার এই ঘটনাটি ঘটেছিল দুটি পর্যায়ে। প্রথমটি হলো আবিষ্কার, আপেক্ষিকতা তত্ত্বের মাধ্যমে, যেখানে বলা হলো – এমনকি স্থান-কালের মতো মৌলিক ধারণাগুলির পরিবর্তন ঘটতে পারে এবং বস্তুত অবশ্যই ঘটবে নতুন অভিজ্ঞতার কারণে। এই পরিবর্তনের সঙ্গে স্বাভাবিক ভাষায় প্রকাশিত স্থান-কালের মোটামুটি অস্পষ্ট ধারণাগুলির সঙ্গে কোনো সম্পর্ক নেই; কিন্তু এর সঙ্গে নিউটনীয় বলবিদ্যার বৈজ্ঞানিক ভাষায় প্রকাশিত এদের যথাযথ সূত্রায়নের সম্পর্ক আছে, যে সূত্রায়নকে ভুলক্রমে চূড়ান্ত বলে গ্রহণ করা হয়েছিল। দ্বিতীয় পর্যায়টি ছিল পারমাণবিক কাঠামো-সম্পৃক্ত পরীক্ষণগত ফলাফল দ্বারা বলবৎকৃত জড়বস্তুর ধারণাসমূহ সম্পর্কে আলোচনা। জড়বস্তুর বাস্তবতার ধারণা ছিল সম্ভবত ঊনবিংশ শতাব্দীর ধারণাসমূহের সেই অনমনীয় কাঠামোর সর্বাপেক্ষা সুদৃঢ় অংশ এবং নতুন অভিজ্ঞতার পরিপ্রেক্ষিতে অন্তত এই ধারণা সংশোধন করতে হয়। আবার যেসব ধারণা স্বাভাবিক ভাষার অন্তর্গত ছিল সেগুলি অপরিবর্তিত থেকে যায়। যখন কাউকে পারমাণবিক পরীক্ষণসমূহ এবং সেগুলির ফলাফল বর্ণনা করতে হতো তখন জড়বস্তু অথবা তথ্যাদি বা বাস্তবতা সম্পর্কে কথা বলার ক্ষেত্রে কোনো দুঃসাধ্যতা থাকত না। কিন্তু জড়বস্তুর ক্ষুদ্রতম অংশগুলিতে এসব ধারণার বৈজ্ঞানিক বহিঃপাতন (extrapolation) চিরায়ত পদার্থবিজ্ঞানে প্রস্তাবিত সরল উপায়ে করা সম্ভব হতো না, যদিও তা ভুলভাবে জড়বস্তুর সমস্যা সম্পর্কে সাধারণ দৃষ্টিভঙ্গি নির্ধারণ করেছিল।

এসব নতুন ফলাফলকে প্রথমত বিবেচনা করতে হয়েছিল সেগুলি যেসব ক্ষেত্রের অন্তর্গত নয় সেসব ক্ষেত্রে বলপূর্বক বৈজ্ঞানিক ধারণা প্রয়োগের বিরুদ্ধে গুরুতর সতর্কবার্তা হিসেবে। যেমন রসায়নবিদ্যায় চিরায়ত পদার্থবিজ্ঞানের ধারণাসমূহের প্রয়োগ ছিল একটি ভুল। অতএব আজকাল যে-কেউ এমন অনুমান করতে কম ইচ্ছুক হবেন যে, পদার্থবিজ্ঞানের ধারণাসমূহ, এমনকি কোয়ান্টাম তত্ত্বের ধারণাসমূহও, জীববিজ্ঞান অথবা অন্যান্য বিজ্ঞানের সর্বক্ষেত্রে নিশ্চিতভাবে প্রয়োগ করা যাবে। পক্ষান্তরে আমরা এমনকি বিজ্ঞানের যেসব অংশে, পুরনো ধারণাগুলিও অত্যন্ত উপযোগী ছিল প্রতিভাসসমূহ অনুধাবনের জন্য, সেসব অংশে নতুন ধারণাসমূহের প্রবেশের জন্য দরজা খোলা রাখার চেষ্টা করব। বিশেষত সেসব বিষয়ে যেখানে পুরনো ধারণাগুলির প্রয়োগ কিছুটা জবরদস্তিমূলক অথবা সমস্যাটির ক্ষেত্রে যথেষ্ট পর্যাপ্ত নয়, সেসব ক্ষেত্রেও যে-কোনো অপরিণামদর্শী সিদ্ধান্ত গ্রহণ পরিহার করার চেষ্টা করব।

এছাড়াও, আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানের বিকাশলাভ এবং বিশ্লেষণের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্যগুলির একটি হচ্ছে সেই অভিজ্ঞতা যে – স্বাভাবিক ভাষার ধারণাসমূহ, সেগুলি যেমন সেরূপ অস্পষ্টভাবে সংজ্ঞায়িত, জ্ঞানের প্রসারের ক্ষেত্রে কেবল প্রতিভাসসমূহের সীমিত গ্রুপগুলি থেকে আদর্শায়ন রূপে আহরিত বৈজ্ঞানিক ভাষার যথার্থ ভাষিক শব্দগুলির চেয়ে অধিকতর সুস্থিত রূপে। এটি বস্তুত বিস্ময়ের কোনো ব্যাপার নয়, যেহেতু স্বাভাবিক ভাষার ধারণাসমূহ গঠিত হয় বাস্তবতার সঙ্গে অব্যবহিত সংযোগ দ্বারা; সেগুলি বাস্তবতার প্রতিরূপায়ণ করে। এ-কথা সত্য যে, সেগুলি খুব বেশি সুসংজ্ঞায়িত নয় এবং
সে-কারণে আগামী শতাব্দীগুলিতে পরিবর্তিতও হতে পারে যেমনটা ঠিক বাস্তবতার নিজের ক্ষেত্রেও ঘটেছিল, কিন্তু সেগুলি কখনো বাস্তবতার সঙ্গে অব্যবহিত সংযোগ হারাবে না। অন্যদিকে, বৈজ্ঞানিক ধারণাসমূহ হচ্ছে আদর্শায়নসূহ; সেগুলি আহরিত হয় সুসংস্কৃত হাতিয়ারসমূহের দ্বারা অর্জিত অভিজ্ঞতা থেকে এবং যথাযথভাবে সংজ্ঞায়িত স্বতঃসিদ্ধ ও সংজ্ঞাসমূহের মাধ্যমে। শুধু এসব যথাযথ সংজ্ঞার মাধ্যমে একটি গাণিতিক পরিকল্পের সঙ্গে কি ধারণাগুলিকে যুক্ত করা সম্ভব এবং গাণিতিকভাবে আহরণ করা সম্ভব এই ক্ষেত্রের অসংখ্য সম্ভাব্য প্রতিভাস! কিন্তু আদর্শায়ন এবং যথার্থ সংজ্ঞার এই প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে বাস্তবতার সঙ্গে অব্যবহিত সংযোগ হারিয়ে যায়। ধারণাসমূহ এর পরও প্রকৃতির সেই অংশের বাস্তবতার সঙ্গে অত্যন্ত ঘনিষ্ঠভাবে প্রাতিসঙ্গিক থাকে যা ছিল গবেষণার বিষয়বস্তু। কিন্তু এই প্রাতিসঙ্গিকতা অন্যান্য গ্রুপের প্রতিভাসসমূহ ধারণকারী অন্যান্য অংশে হারিয়ে যেতে পারে।

বৈজ্ঞানিক বিকাশসাধন প্রক্রিয়ায় স্বাভাবিক ভাষার ধারণাসমূহের স্বকীয় সুস্থিতির কথা মনে রেখে আমরা দেখতে পাই, আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানের অভিজ্ঞতালাভের পর, মন অথবা মানবাত্মা বা প্রাণ বা ঈশ্বরের মতো ধারণাগুলির প্রতি আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি ঊনবিংশ শতাব্দীর ধারণাগুলি থেকে ভিন্ন হয়ে পড়বে, কারণ এসব ধারণা স্বাভাবিক ভাষার অন্তর্গত এবং সেজন্য বাস্তবতার সঙ্গে এদের অব্যবহিত সংযোগ রয়েছে। এ-কথা সত্য, আমরাও অনুধাবন করব যে, এসব ধারণা বৈজ্ঞানিক ভাবার্থে সুসংজ্ঞায়িত নয় এবং এদের প্রয়োগ নানা ধরনের অসংগতির দিকে নিয়ে যাবে। সেজন্য আপাতত আমাদের সেগুলি যেভাবে আছে সেরূপ অবিশ্লেষিত রূপে গ্রহণ করতে হতে পারে; কিন্তু তবু আমরা জানি যে সেগুলি বাস্তবতাকে ছুঁয়ে যায়। এ-প্রসঙ্গে স্মরণ করা উপযোগী হতে পারে যে, এমনকি বিজ্ঞানের সবচেয়ে যথাযথ অংশ গণিতেও আমরা অসংগতি-সংশ্লিষ্ট ধারণাগুলি পরিহার করতে পারি না। দৃষ্টান্তস্বরূপ, এটি সুবিদিত যে, অসীমের ধারণা অসংগতিসমূহের দিকে চালিত করে যা বিশ্লেষণ করা হয়েছে, কিন্তু এই ধারণাকে বাদ দিয়ে গণিতের প্রধান অংশগুলি তৈরি করা ব্যবহারিকভাবে অসম্ভব হবে।

ঊনবিংশ শতাব্দীতে মানুষের চিন্তার সাধারণ প্রবণতা ছিল বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি ও যথাযথ যৌক্তিক পূর্বশর্তসমূহের ওপর ক্রমবর্ধমান আস্থার প্রতি এবং তা স্বাভাবিক ভাষার সেসব ধারণা বিষয়ে সংশয়ের দিকে নিয়ে গেছে যেগুলি বৈজ্ঞানিক চিন্তার আবদ্ধ কাঠামোর মধ্যে ঠিকমতো বসতে পারে না – যেমন ধর্মের ধারণাসমূহ। আধুনিক পদার্থবিজ্ঞান বহু দিক থেকে এই সংশয় বৃদ্ধি করেছে; কিন্তু একই সঙ্গে তা একে যথাযথ বৈজ্ঞানিক ধারণাসমূহের অতিমূল্যায়ন, সাধারণভাবে অগ্রগতি বিষয়ে অতি আশাবাদী দৃষ্টিভঙ্গি এবং চূড়ান্তভাবে সংশয়ের নিজ প্রকৃতির বিরুদ্ধে দাঁড় করিয়েছে। যথাযথ বৈজ্ঞানিক ধারণাসমূহের বিরুদ্ধে সংশয় এ-কথা বোঝায় না যে, যৌক্তিক চিন্তা প্রয়োগের ক্ষেত্রে একটি সুনির্দিষ্ট সীমাবদ্ধতা থাকা উচিত। অন্যদিকে কেউ হয়তো বলতে পারেন, অনুধাবন করার ব্যাপারে মানুষের সামর্থ্য এক অর্থে সীমাহীন হতে পারে। কিন্তু বিদ্যমান বৈজ্ঞানিক ধারণাসমূহের আওতা সবসময় বাস্তবতার শুধু একটি সীমিত অংশ পর্যন্ত প্রসারিত এবং অপর যে-অংশটি এখনো পর্যন্ত বুঝতে পারা যায়নি তা অসীম। যখনই আমরা জ্ঞাত থেকে অজ্ঞাতের দিকে অগ্রসর হই তখন আমরা হয়তো অনুধাবন করার আশা করতে পারি, কিন্তু একই সময়ে আমাদের হয়তো শিখতে হতে পারে ‘অনুধাবন’ কথাটির একটি নতুন অর্থ। আমরা জানি, শেষ পর্যন্ত যে-কোনো অনুধাবনেরই ভিত্তি হবে স্বাভাবিক ভাষা, কারণ শুধু সেখানেই আমরা বাস্তবতাকে ছুঁয়ে যাওয়ার ব্যাপারে নিশ্চিত হতে পারি এবং সে-কারণে এই স্বাভাবিক ভাষা ও এর আবশ্যিক ধারণাসমূহ সম্পর্কে আমাদের অবশ্যই সংশয়ী হতে হবে। অতএব সর্বকালে যেভাবে ব্যবহৃত হয়েছে সেভাবেই হয়তো আমরা এসব ধারণা ব্যবহার করতে পারি। এভাবেই আধুনিক পদার্থবিজ্ঞান সম্ভবত মানবমন ও বাস্তবতার মধ্যেকার সম্পর্কের ক্ষেত্রে একটি ব্যাপকতর দৃষ্টিভঙ্গির দুয়ার খুলে দিয়েছে।

এই আধুনিক বিজ্ঞান, অতঃপর, আমাদের সময়ে বিশ্বের অন্যান্য অংশেও অনুপ্রবেশ করেছে যেখানে সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ছিল ইউরোপীয় সভ্যতা থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। সেখানে প্রাকৃতিক ও কারিগরি বিজ্ঞানে এই নতুন সক্রিয়তার প্রভাব একে অবশ্যই এমনকি ইউরোপের চেয়েও অধিকতর প্রবলভাবে অনুভূত করাবে, যেহেতু ইউরোপে জীবনের অবস্থানসমূহের যে পরিবর্তনগুলির জন্য দুই থেকে তিন শতাব্দী সময়ের প্রয়োজন হয়েছে সেখানে তা ঘটবে কয়েক দশকের মধ্যে। আমাদের মনে রাখা উচিত – বহু স্থানেই এই নতুন সক্রিয়তার আবির্ভাব ঘটা উচিত পুরনো সংস্কৃতির প্রত্যাখ্যান রূপে, একটি নিষ্ঠুর ও বর্বর মনোভাব হিসেবে, যার ওপর মানুষের সকল সুখ নির্ভর করে সেই সংবেদী ভারসাম্যকে ওলটপালট করে দিয়ে। অনুরূপ পরিণাম এড়িয়ে যাওয়া যায় না; সেগুলিকে অবশ্যই গ্রহণ করতে হবে আমাদের সময়ের একটি অনুবর্তী রূপ (aspect) হিসেবে। কিন্তু এমনকি সেখানেও পুরনো ঐতিহ্যগুলিকে চিন্তার নতুন প্রবণতাগুলির সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানের উন্মুক্ততা হয়তো কিছুটা সাহায্য করতে পারে। দৃষ্টান্তস্বরূপ, বিগত যুদ্ধের [দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ] পর তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে জাপানের দিক থেকে যে বিশাল বৈজ্ঞানিক অবদান এসেছে সেটি দূরপ্রাচ্যের ঐতিহ্যে দার্শনিক ধারণাসমূহ এবং কোয়ান্টাম তত্ত্বের দার্শনিক ধারণাসমূহের মধ্যে একটি নিশ্চিত সম্পর্কের ইংগিতবহ বিষয় হতে পারে। কারো পক্ষে নিজেকে বাস্তবতার কোয়ান্টাম তত্ত্বগত ধারণার সঙ্গে অভিযোজিত করা সহজতর হতে পারে, যিনি এই শতাব্দীর প্রথম দশকগুলিতে ইউরোপে তখনো বিরাজমান অপরিপক্ব বস্তুবাদী ধরনের চিন্তার মধ্য দিয়ে তখনো যাননি।

অবশ্য এসব মন্তব্যকে কারিগরি অগ্রগতির প্রভাব দ্বারা পুরনো ঐতিহ্যসমূহের যে ক্ষতি হতে পারে বা যে ক্ষতি সেগুলির করা হয়েছে সেসবের ঊনমূল্যায়ন রূপে ভুল বোঝা উচিত নয়। কিন্তু এই সামগ্রিক উন্নতিসাধন যেহেতু দীর্ঘকাল ধরে মানুষের শক্তিসমূহের যে-কোনো নিয়ন্ত্রণের অনেক বাইরে ছিল, অতএব আমাদেরকে একে আমাদের সময়ের সর্বাধিক আবশ্যিক বৈশিষ্ট্যগুলির একটি হিসেবে গ্রহণ করতে হবে এবং অবশ্যই চেষ্টা করতে হবে একে পুরনো সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় ঐতিহ্যগুলির লক্ষ্য ছিল যেসব মানবিক মূল্যবোধ সেগুলির সঙ্গে যত বেশি সম্ভব সংযুক্ত করার। এই পর্যায়ে Hasidic ধর্ম (ইহুদিধর্মের একটি সামাজিক শাখা) থেকে একটি গল্প উদ্ধৃত করার সুযোগ আমাকে দেওয়া যেতে পারে : সেকালে তাঁর জ্ঞানের জন্য বিখ্যাত একজন বৃদ্ধ ধর্মযাজক (rabbi) তথা পুরোহিত ছিলেন যাঁর কাছে সবাই আসত তাঁর পরামর্শ গ্রহণ ও উপদেশ শোনার জন্য। একবার একটি লোক তাঁর কাছে এসেছিল তথাকথিত কারিগরি অগ্রগতি দ্বারা সাধিত সকল ক্ষতির জন্য খেদ ব্যক্ত করে সংঘটিত সকল পরিবর্তন সম্পর্কে হতাশার কথা বলতে। সে চিৎকার করে বলেছিল, ‘এইসব কারিগরি উৎপাত কি অর্থহীন নয়, যদি আমরা জীবনের প্রকৃত মূল্যের কথা বিবেচনা করি?’ ধর্মযাজক মহোদয় তখন উত্তরে বলেছিলেন, ‘হয়তো তেমনই, কিন্তু যদি কারো মধ্যে সঠিক দৃষ্টি বা প্রবণতা থাকে তাহলে তিনি সবকিছু থেকে শিখতে পারেন।’ আগত লোকটি এর প্রতিবাদ করে বলেছিল, ‘না, রেলওয়ে বা টেলিফোন বা টেলিগ্রাফের মতো বোকামিপূর্ণ জিনিসগুলি থেকে কেউ কখনো কোনোকিছু শিখতে পারে না।’ কিন্তু ধর্মযাজক মহোদয় এর উত্তরে বলেছিলেন, ‘আপনি ভুল বলছেন। রেলওয়ে থেকে আপনি শিখতে পারেন, আপনি যদি এক মুহূর্ত দেরি করেন তাহলে আপনি সবকিছু হারাতে পারেন। টেলিগ্রাফ থেকে আপনি শিখতে পারেন, প্রতিটি শব্দেরই একটি মূল্য আছে। আর টেলিফোন থেকে আপনি শিখতে পারেন যে, আমরা এখানে যা বলি তা সেখানে শুনতে পারা যায়।’ আগত লোকটি বুঝতে পারল যাজক মহোদয় কী বলতে চেয়েছেন। তখন সে চলে গেল।

সবশেষে, আধুনিক বিজ্ঞান অনুপ্রবেশ করে আমাদের বর্তমান বিশ্বের সেসব বৃহৎ এলাকায় যেগুলিতে নতুন ও শক্তিশালী বিজ্ঞানসমূহের জন্য ভিত্তি হিসেবে মাত্র কয়েক দশক পূর্বে নতুন মতবাদসমূহ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। সেখানে আধুনিক বিজ্ঞানের সঙ্গে বিরোধ ঘটেছিল ঊনবিংশ শতাব্দীর ইউরোপীয় দার্শনিক ধারণাসমূহ (হেগেল এবং মার্কস) এবং আপোসহীন বিশ্বাসের প্রতিভাস, উভয়ের সঙ্গে। যেহেতু আধুনিক বিজ্ঞানকে অবশ্যই এসব দেশে একটি বড় ভূমিকা পালন করতে হবে এর ব্যবহারিক প্রয়োগযোগ্যতার কারণে, অতএব কদাচিৎ এটি এড়িয়ে যাওয়া যাবে যে, মতবাদসমূহের সংকীর্ণতা তাঁদের দ্বারা অনুভূত হবে যাঁরা যথার্থই আধুনিক পদার্থবিজ্ঞান এবং এর দার্শনিক মর্মার্থ অনুধাবন করতে পেরেছেন। অতএব, এই জায়গায় বিজ্ঞান এবং চিন্তার সাধারণ প্রবণতার মধ্যে একটি মিথস্ক্রিয়া ঘটতে পারে। অবশ্য বিজ্ঞানের প্রভাবকে অতিরিক্ত করে দেখানো উচিত হবে না; কিন্তু এমন হতে পারে যে, আধুনিক বিজ্ঞানের যুক্ততা একে এমনকি মানুষজনের বৃহত্তর গ্রুপসমূহের জন্য সহজতর করে তুলতে পারে এমনটা দেখতে যে – মতবাদগুলি সম্ভবত সমাজের জন্য তত গুরুত্বপূর্ণ নয় যেমনটা আগে ধরে নেওয়া হয়েছিল। এভাবে, আধুনিক বিজ্ঞানের প্রভাব সহনশীলতার একটি মনোভাবের প্রতি হয়তো সমর্থন জোগাতে পারে এবং এর দ্বারা একে মূল্যবান প্রতিপন্ন করতে পারে।

পক্ষান্তরে, আপোসহীন বিশ্বাসের প্রতিভাস ঊনবিংশ শতাব্দীর কিছু বিশেষ দার্শনিক ধারণার চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্ববহ। আমরা এই সত্যের দিকে আমাদের চোখ বন্ধ করে রাখতে পারি না যে, জনগণের একটি বিরাট সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশের মধ্যে নির্দিষ্ট কিছু গুরুত্বপূর্ণ ধারণা বা মতবাদের সঠিকতা বিষয়ে কদাচিৎ কোনো সুপ্রতিষ্ঠিত বিচার-বিবেচনা থাকতে পারে। অতএব ‘বিশ্বাস’ শব্দটি এই সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষদের জন্য ‘কোনো বিষয়ে সত্য প্রত্যক্ষণ’ অর্থটি বহন করে না, কিন্তু একে শুধু ‘জীবনের ভিত্তি হিসেবে গ্রহণ করা’ অর্থেই তাঁরা অনুধাবন করতে পারেন। আমরা সহজেই বুঝতে পারি যে, এই দ্বিতীয় প্রকারের বিশ্বাস অনেক বেশি দৃঢ়, প্রথমটির চেয়ে অনেক বেশি স্থায়ী, অর্থাৎ এটি এমনকি অব্যবহিত অসংগতির বিরুদ্ধেও টিকে থাকতে পারে এবং সেজন্য যোগ-করা বৈজ্ঞানিক জ্ঞান দ্বারাও ঝাঁকি খায় না। বিগত দুটি দশকের ইতিহাস অনেক দৃষ্টান্ত দ্বারা আমাদের দেখিয়েছে যে, এই দ্বিতীয় প্রকারের বিশ্বাসকে কখনো কখনো এমন এক স্তরে তুলে ধরা যেতে পারে যেখানে তা সম্পূর্ণ যুক্তিহীন মনে হয় এবং বিশ্বাসকারীর তিরোধানের সঙ্গে সঙ্গে এরও মৃত্যু ঘটে। বিজ্ঞান ও ইতিহাস আমাদের এই শিক্ষা দিতে পারে যে, যারা এরূপ বিশ্বাস করে তাদের জন্য এই প্রকারের বিশ্বাস মহাবিপদ হয়ে উঠতে পারে। কিন্তু অনুরূপ জ্ঞান লাভ করা যায় না যেহেতু আমরা বুঝতে পারি না কিভাবে একে পরিহার করা যেতে পারত এবং সেজন্য এরূপ বিশ্বাস মানব ইতিহাসের বিরাট শক্তিগুলির মধ্যে সবসময় বিদ্যমান ছিল। ঊনবিংশ শতাব্দীর বৈজ্ঞানিক ঐতিহ্য থেকে আমরা অবশ্য এই প্রত্যাশার দিকে ঝুঁকে পড়ি যে, সব বিশ্বাসের ভিত্তি হওয়া উচিত প্রতিটি যুক্তির বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ ও সতর্ক বিচার-বিবেচনা; এবং এই অন্যপ্রকার বিশ্বাসের, যেখানে কিছু প্রকৃত অথবা আপাত সত্যকে জীবনের ভিত্তি হিসেবে গ্রহণ করা হয়, অস্তিত্ব থাকা উচিত নয়। এ-কথা সত্য যে বিশুদ্ধ যৌক্তিক যুক্তিসমূহের ভিত্তিতে সতর্ক বিচার-বিবেচনা আমাদের বহু ভুল ও বিপদ থেকে রক্ষা করতে পারে, যেহেতু তা নতুন পরিস্থিতিসমূহের সঙ্গে পুনঃউপযোজনের সুযোগ দেয় এবং এটি হতে পারে জীবনের জন্য একটি প্রয়োজনীয় শর্ত। কিন্তু আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানে আমাদের অভিজ্ঞতার কথা স্মরণে রেখে সহজেই দেখতে পাওয়া যায় যে, বিচার-বিবেচনা ও সিদ্ধান্তের মধ্যে অবশ্যই সবসময় একটি মৌলিক পরিপূরকতা থাকা উচিত। জীবনের প্রায়োগিক সিদ্ধান্তগুলিতে এটি কদাচিৎ কখনো সম্ভব হবে একটি সম্ভাব্য সিদ্ধান্তের পক্ষে অথবা বিরুদ্ধে সব যুক্তি বিবেচনা করে দেখা এবং সেজন্য আমাদের সবসময় অপর্যাপ্ত প্রমাণের ভিত্তিতে কাজ করতে হবে। সিদ্ধান্তটি সবশেষে আসে সব যুক্তিকে দূরে সরিয়ে দিয়ে – এদের উভয়টিই অর্থাৎ যা বুঝতে পারা গেছে এবং অন্যগুলি যা উঠে আসতে পারে আরো বিচার-বিবেচনার মাধ্যমে – এবং আরো বেশি, অন্যসব চিন্তাভাবনা বাতিল করে দিয়ে। সিদ্ধান্ত হতে পারে
বিচার-বিবেচনার পরিণাম, কিন্তু একই সঙ্গে তা বিচার-বিবেচনার পরিপূরক; এটি বিচার-বিবেচনাকে বাইরে রেখে দেয়। এমনকি জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তসমূহের মধ্যেও অযৌক্তিকতার এই অবশ্যম্ভাবী উপাদান অবশ্যই সবসময় অন্তর্ভুক্ত থাকতে হবে। সিদ্ধান্তটি নিজে থেকে প্রয়োজনীয়, যেহেতু এমন কিছু অবশ্যই থাকতে হবে যার ওপর নির্ভর করা যায় – আমাদের কাজগুলিকে নির্দেশনা দেওয়ার জন্য কোনো নীতি। অনুরূপ দৃঢ় কোনো অবস্থান ছাড়া আমাদের নিজেদের সব কাজ তার সকল শক্তি হারিয়ে ফেলবে। অতএব, এটি এড়িয়ে যাওয়া যাবে না যে, কোনো প্রকৃত অথবা আপাত সত্য জীবনের ভিত্তি গঠন করে; এবং এই বিষয়টির স্বীকৃতি প্রদান করা উচিত সেই গ্রুপগুলির লোকদের কথা মনে রেখে যাদের ভিত্তি আমাদের নিজেদের ভিত্তি থেকে আলাদা।

এখন আধুনিক বিজ্ঞান সম্পর্কে যা কিছু বলা হয়েছে সেই কথাগুলি থেকে উপসংহারে এসে, আমরা হয়তো বলতে পারি যে – আধুনিক পদার্থবিজ্ঞান সার্বিক ঐতিহাসিক প্রক্রিয়ার কেবল একটি অংশ, কিন্তু অত্যন্ত বৈশিষ্ট্যপূর্ণ, অংশ যা আমাদের বর্তমান বিশ্বকে একীভূতকরণ ও ব্যাপকতর করার প্রয়াসে নিয়োজিত এই প্রক্রিয়া নিজের মধ্যে থেকেই সেইসব সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক চাপ হ্রাসকরণের দিকে চালিত করবে যেগুলি আমাদের সময়ের মহাবিপদ সৃষ্টি করছে। কিন্তু এর সঙ্গে রয়েছে আরো একটি প্রক্রিয়া যেটি কাজ করছে বিপরীত দিকে। একীভূতকরণের এই প্রক্রিয়া বিষয়ে মানুষ যে সচেতন হয়ে ওঠে সে ঘটনাটি বিদ্যমান সাংস্কৃতিক সম্প্রদায়গুলির মধ্যেকার সকল শক্তিকে একটি প্ররোচনার দিকে নিয়ে যায়, যে সম্প্রদায়গুলি একীভূতকরণের চূড়ান্ত পর্যায়ে তাদের ঐতিহ্যগত মূল্যবোধসমূহের সর্ববৃহৎ সম্ভাব্য ভূমিকা নিশ্চিত করার চেষ্টা করে। এভাবে স্নায়বিক চাপগুলি বৃদ্ধি পায় এবং পরস্পর-প্রতিযোগী প্রক্রিয়াসমূহ একে অপরের সঙ্গে এতো ঘনিষ্ঠভাবে সংযুক্ত যে একীকরণ প্রক্রিয়ার প্রতিটি গাঢ়তাবর্ধন – যেমন নতুন কারিগরি অগ্রগতি প্রয়োগের মাধ্যমে – চূড়ান্ত পর্যায়ে প্রভাব আরোপের সংগ্রামকেও তীব্রতর করে এবং এর দ্বারা ক্ষণস্থায়ী অবস্থার অস্থিতিশীলতা বৃদ্ধি করে। আধুনিক পদার্থবিজ্ঞান সম্ভবত একীকরণের এই বিপজ্জনক প্রক্রিয়ায় শুধু একটি ক্ষুদ্র ভূমিকা পালন করে। কিন্তু উন্নয়নকে একটি অধিকতর শান্ত ধরনের বিবর্তনে চালিত করার জন্য দুটি অত্যন্ত নিশ্চায়ক বিষয়ে এটি সাহায্য করে। প্রথমত, এটি দেখায় যে, এই প্রক্রিয়ায় অস্ত্রের ব্যবহার বিপর্যয়কর হবে এবং দ্বিতীয়ত সর্বপ্রকার ধারণার জন্য উন্মুক্ততার মাধ্যমে এটি এ আশা জাগিয়ে তোলে যে – একীকরণের চূড়ান্ত অবস্থায় সেটি বহু ভিন্ন সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য একসঙ্গে নিয়ে আসতে পারবে এবং বিভিন্ন মানব-প্রচেষ্টাকে হয়তো চিন্তা ও কাজ এবং সক্রিয়তা ও ধ্যানের এক নতুন প্রকারের ভারসাম্যের মধ্যে একসূত্রে গ্রথিত করতে পারবে।