শিরোনামহীন
আমার রোদ্দুর ঢেকে যাচ্ছে কালো মেঘে
হায় ছায়াবৃতা দাও, আমাকে দাও সজীব
সহজ উজ্জ্বলতা
ঘুম নেই চোখে, তাকিয়ে থাকি
অক্সিজেনের মিটারে।
* ওপরের কবিতাটি হাসপাতালে শুয়ে শেষ লেখা কবিতা। কবিতাটির কোনো শিরোনাম দেননি কবি; তাই শিরোনামহীন নামেই প্রকাশিত হলো।
ঝড়ো হাওয়া আর পোড়ো বাড়িটাকে মেলাবেন?
মালতী সেদিন অপরাহ্ণের রোদে
উদ্বাস্তু হলো
নদীর স্রোত আর পাখির কলরব
শুনতে শুনতে
সে বিলীন হয়ে গেল জনারণ্যে
ট্রেনে যেতে যেতে ধর্ষিত হয়েছিল
তারপর গহন অরণ্যের নীরবতায়
দেখেছিল ত্রাস ও উল্লাস
তুমি একরৈখিক হয়ো না
রোদ বৃষ্টি ঝড়ে
যাবতীয় না স্কন্ধে নিয়ে
ছুটে চলেছি
একপথ থেকে অন্যপথে
মনে পড়ে ১৯৭২-এ সেপ্টেম্বরে শুনতে শুনতে
বন্ধুর ক্রূর হাসি, নারীর শোকস্তব্ধ ধূসর চোখ
বলির বাজনার দুঃখ নিয়ে হিমজলের মতো প্রত্যাখ্যান
মনে পড়ে মুখে জীর্ণ ও শীর্ণ
পাথরে ফাটল, অগ্রজের অটল বিশ্বাসের
কোথাও কেউ নেই, যিশুর মতো ক্রুশবিদ্ধ
একটি মানুষ কেবলই হাঁটছে
এক ফুটপাত থেকে অন্য ফুটপাতে
সেই সেপ্টেম্বরের যাওয়া বলে দিচ্ছে নারী নয় হিরণ্যমতি
তুমি কেবল একা, পাঠ কারো আদিলিপিতে ভাগ্যলিপি
আজ আর ধর্মযাজকের জামায়
কাফকার রোদ নেই
রোদলেয়ারের বিষাদ নেই
কামুর ক্লান্তি নেই
কেমন করে ডাকবে সে প্রভু যিশুকে?
কেননা মঙ্গলালোকের প্রার্থনা
ক্ষুধা-তৃষ্ণায়
অমোচনীয় হয়ে পড়ে থাকে বিমুখ প্রান্তরে
রোদচশমা পরা কালো নধর বেড়াল
সভ্যতার আদি-অন্তে
হাজারবার হিংসা নিয়ে ফিরে আসে।
আর হাড়-হিম সন্ত্রাস জনপদে, লোকালয়ে
লাশ হয়ে যখন ফিরে আসে আর হাঁটে
কিংবা অজগর সাপের মতো কালো পোশার যখন জাপটে ধরে
রোধের তপস্যা প্রকৃতই শূন্য হয়ে ওঠে।
শিশু বলে, ওঠো, যৌবন বলে ওঠো
সভ্যতার বীজতলায় যাবো
হা ঈশ্বর, তুমি একরৈখিক হয়ো না
স্বপ্ন ভেঙে যায়
বার্ন ইউনিটের আর্ত হাহাকারে, দগ্ধ
মুখমণ্ডল, শিশুর ব্যান্ডেজ
যখন স্বপ্ন ভেঙে দিয়ে যায়
আমি মৃত্যু হলেও দেখি মানুষ মানব থেকে যায়।
এ জীবন হয়ে ওঠে পতঙ্গের আর ফড়িঙের
তখন একটি মানুষের আমতলায় জামতলায়
হয়ে ওঠা দেখতে থাকি।
সেই ছায়ায়
ফেব্রুয়ারি মাসেই তো এই চাতালে
বাংলাদেশের কথা বলেছিল সে
শত শত জল ঝর্ণার ধ্বনিতে
মিছিলের মুখ, কার্ফু ভাঙার উৎসব
হয়ে উঠেছিল উদ্বেলিত রেনেসাঁ।
ফেব্রুয়ারি মাসেই তো
মৃত্যু আর জাগরণ
ফেব্রুয়ারি মাসেই তো বিষাদ ও প্রেমে উজ্জীবন।
অথচ
উন্মাদের আস্ফালন
অথচ
মানুষ হত্যাযজ্ঞের দুঃখবিলাসীর দম্ভ উদ্যত ফনা তুলে
হৃদয়কে করে তুলেছে উথালপাথাল।
অসুস্থ বিকারগ্রস্তের তর্জন গর্জন
উদার, প্রসারিত বেলাভূমিতে হয়ে ওঠে শূন্য
বিষণ্ন হাওয়ায় কবর কথা বলে না
মানুবের আর্তনাদ আর হাহাকার এখন চতুর্দিকে
তুমি যাও, দুঃখবিলাসিনী
তুমি যাও বনেজঙ্গলে
তুমি যাও বার্ন ইউনিট থেকে।
জ্বলতে জ্বলতে, পুড়তে পুড়তে, শিশুর আর্তনাদে হাত রেখে
আমি চলে যাবো
দূরে, আরো দূরে।
আমি নদীর কাছে যাবো
আর মাতৃভাষার
গান শুনবো
সবিতা হালদারের চিঠি
মেঘে ভেসে সবিতা হালদারের চিঠি আসে
বাৎসায়নের কামগন্ধ লেফাফায় লেখে থাকে
সকালবেলার ভৈরবীর সুরে
চিঠি হাতে বলি, তুমি ভালো থেকো
তুমি নেই, অথচ তুমি আছো, তৃষ্ণার্ত আমি
তবুও
যাকে পাই ইমন কল্যাণে, আর কোমলগান্ধার
কিংবা কখনো বসন্ত বিলাসে
রক্তের ভেতরে টের পাই, সে বলে চলেছে
কষ্ট নিয়ে কোথায় যাও,
মধ্যরাতে তোমার পাঁজরে দাঁড়ের শব্দ;
তখন
এই শহর হয়ে ওঠে
অশান্ত বারুদগন্ধ নিয়ে ভয়ার্ত হরিণ শাবকের বুক
নদীর আকুলতা নিয়ে মাইল মাইল বিষাদ ডাকে নারীর মুখ
আত্মবিনাশে পাপ আর পুণ্যের এক মাধুরী ঝ’রে পড়ে এই চিঠি থেকে
কে সে?
সবিতা হালদার, তার চিঠি
সমুদ্রের জলস্রোতে
সমুদ্রের কল্লোল আকাশ ছাড়িয়ে যায় নীল আকাশে
আমি জানি আমিও একদিন ঝরে যাব
দীর্ঘ অবসাদ, ক্লান্তির নির্বেদে এখন তোমাকে কেবল মনে পড়ে
আর বুকের মধ্যে বেজে চলে দামামা।
অন্ধকারে অন্ধকার
সারি সারি লক্ষ্মীর পা।
আবার এ অন্ধকার
মনে হয় কে যেন মরে গেছে
এই জলস্রোতে।
কারণবারি, ধোঁয়ার কুণ্ডলী
প্রান্তরে যুদ্ধদিনের স্মৃতি
ছল ছল শব্দ জলস্রোতে।
একটু বাদেই হাসপাতাল
প্রার্থনার শূন্যতায়
দরোজায় মৃত্যুগন্ধ
সিসিইউ, ডেটলের ঘ্রাণ, সেবিকা নম্র কণ্ঠ-বিষাদ প্রতিমা
নাকে নল
হৃৎপিণ্ডের ধুঁকপুকানি, কখনো নামে, কখনো ওঠে
তুমি কোথায়
প্রিয় মুখ আমার
এই অন্ধকার শোকসভার পরিব্যাপ্ত বিষাদের মতো
আমি জানি
তুমি কোনোদিন আর ফিরবে না।
আমি চেয়ে দেখি
ভুবনডাঙার সাঁওতালদের পরিচ্ছন্ন উঠোন, নারীর খোঁপায় ফুল
কালো শরীর মনোরম, ভাস্কর্যের উপমা দেহ জুড়ে
মন্দিরের ঘণ্টাধ্বনি প্রশান্ত
কোপাই আর শালবীথিকার ঐশ্বর্য
কানোদিন আর ফিরবে না বলে
আমি যাই
অন্ধকারের গভীরে, অন্ধকারের গভীর সুড়ঙ্গে কালো সেই অন্ধকার।
কালো বেড়াল
মুখোশে মুখ ঢেকে যখন
কেড়ে নাও সবকিছু
মৃত মানুষের চোখ, শ্মশান বৈরাগ্য থাকে
বুকের ভিতরে
কেননা নিসর্গ আর প্রমত্ত এক নদ
দিয়েছিল আশ্চর্য সংযম
নদের অপরূপ সৌন্দর্য আর স্রোত
বাজতে বাজতে, দেখতে দেখতে
আমি যাই স্থির বিষয়ের দিকে
ও বেড়াল, নধর কালো বেড়াল
কেড়ে নাও সবকিছু,
পাজি-পুঁথি, দলিল-দস্তাবেজ ভূ দৃশ্য, পিতার প্রতিকৃতি
রৌদ্রের ছায়াও কেড়ে নাও
তুমি তো বলদর্পী,
শক্তিমান
কেউ কিছু বলবে না, কেউ কিছু বলবে না
ব্যক্তিগত জীবনানন্দ
গবেষক এক বন্ধু
জীবনানন্দ দাশকে খুঁজে
বেড়িয়েছেন পার্কে, রাস্তায় এভিনিউতে
পেয়েও পাননি তাকে
কেবল আবছা ছুঁয়ে গেছে তাঁকে জীবনানন্দের
পাঞ্জাবির ঝুল।
আর আমি
দীর্ঘ তিন দশক ধরে খুঁজে বেড়াচ্ছি
জীবনানন্দ দাশকে।
আহারিটোলায়, রাসবিহারী এভিনিউর ট্রামলাইনে
কখনো
পার্কে নিঃসঙ্গ মানুষের ভিড়ে
ভুমেন্দ্র গুহের হাতে হাত রেখে
অনুভব করতে চেয়েছি শরীরের রক্ত সঞ্চালনের মধ্যে জীবনানন্দের
গভীর প্রশান্ত সুখের প্রত্যাখ্যান লেগে আছে কিনা
ট্রামের ঘর্ঘর বাজে বুকে। সবিতা হালদারের প্রেম বুকে নিয়ে
ঘন অরণ্যে ক্যাম্প দেখি; চন্দ্রলোকে নগ্ন নারীর নাচ দেখি
সর্বনাশপন্থী নারী কখন যে অবৈধ সঙ্গম তৃষ্ণায়
কাতর হয়ে ওঠে এও দেখি
জীবনানন্দের ঘেরাটোপে বন্দি
অন্তর্মুখী যুবকের আত্মলীনতা
ছায়া ফেলে আর বলে
কে না খোঁজে জীবনানন্দ দাশকে
কখনো কামুর অভিপ্রায়ে
কখনো কাফকার স্বরূপে
বিজন নায়ক এক
প্রেম আর ক্ষমতার অলীক রেখায় হাঁটতে থাকে
তার আরেক নারীর কথা মনে পড়ে
ধানের গন্ধ ছিল যার বুকে
কলস্রোতা নদীর ঐক্যতান
শাড়ির আঁচলে নিয়ে
যে নগরীর মিছিলে হয়ে পড়েছিল
স্বপ্নের কাছে
স্বপ্নের কাছে ফিরে যাওয়া সহজ নয়
তোর পাঞ্জাবির ঝুল ধরে টান দিচ্ছে
অদৃশ্য আততায়ী।
তুই কেমন করে ফিরে যাবি স্বপ্নে
তোকে কুরে কুরে খাচ্ছে প্রতিস্পর্ধী শক্তি
যে শিশু জন্ম নেয়নি সেও জানে
স্বপ্ন স্বপ্ন খেলা অত সহজ নয়
এ অন্ধকার আর নির্জনতা
কালো কাপড়ে মুখ ঢেকে
নিঃসীম বেদনা হয়ে পড়ে আছে
হাসপাতালের দোরগোড়ায়
খাবি খাচ্ছে
আর ক্রন্দনের জন্য কিংবদন্তী মানুষ অপেক্ষা করছে
কিংবা ঘুমহীন ঘুমের ভিতরে
একা একা হাঁটছে শূন্যতার দিকে
এবার অলৌকিক অশ্বারোহীকে
রাজপথে ফের দেখবো বলে
হাঁটছি, কেবল হাঁটছি
পিতৃপুরুষের রোদ্দুর খেলা করে পায়ে
নামহীন, গোত্রহীন বিজন মানুষেরা কখন যে
রূপালি ডানার বাউল হয়ে
পিতাকে গাঢ় স্বরে ডাকে
দেখি তার ছবি
অফুরান, অগুনতি ঝাঁক ঝাঁক পাখি
কখনো কীর্তিনাশা, পদ্মা, ধলেশ্বরী, ধানসিঁড়ি নদী
ঘূর্ণাবর্তে, দুঃখ দৈন্যে
মগ্নচৈতন্যে স্বপ্নের কাছে ফিরে যাওয়া সহজ নয়।
জল
বুকের অনন্ত পিপাসায় সবিতা হালদার
আমাকে জল দাও
নদীর জল, অবিরল বৃষ্টির জল, সমুদ্রের জল
কিংবা ছিপছিপে মাছের তৃষ্ণার জল
তোমার ছিন্নদৃশ্যাবলী
অস্থিরতার মায়ায় একটি সরলরেখায়
দীর্ঘ ছায়া হয়ে উদাসী যৌবন হয়ে আছে
আমি গোরখোদকের চোখে চোখ রাখি মধ্যরাতে
আমার ভেতরে জল তৃষ্ণা প্রবল হয়ে ওঠে
লাশের মিছিলে শিশুর হৃদয়ের স্থির ছবি
স্তব্ধতায় আর শূন্যতায় জল চায়, শুধুই জল
অন্ধকারে গাঢ় আকাঙ্ক্ষার কথা বলে নীল প্রজাপতি
ভয়াবহ স্মৃতির প্রতিবাদে
সংঘর্ষ আর বিপন্নতায় বাংলাদেশের হৃদয়ের
মানবিক বাগানে
ট্যাঙ্কের শব্দ, উদ্যত সঙিন, কালো পোশাকের উত্থানে
যা কিছু হোক, ভিতরে ভিতরে, করুণা কিংবা ক্রোধ
সবিতা, আজ একটু জল দাও
বিবর্ণ হলুদ চিঠির খাম ধূসর পড়ে আছে
১৬ আমির আলি এভিনিউ, পার্ক সার্কাস, কলকাতা
সাঙ্গুভ্যালি কাফে, একাডেমি অব ফাইন আর্টসে সুন্দরকে খোঁজা
মরচে পড়া জীবনে স্বপ্নলোকের ঘর হয়ে গেছে
শুধুই জল
আর
জল দাও আমাকে
যাও
ক্ষুধাজলের লক্ষ্মীছাড়া কাণ্ডে উপড়ে
গিয়েছে গাছগাছালি
গৃহস্থালি।
তের লক্ষ মানুষের জলের শরীরে
ছলকে যাচ্ছে অলৌকিক কাল।
ফিরবে না স্তব্ধতার এফোঁড়-ওফোঁড় শূন্য আঙ্গিনায় কোন
প্রস্ফুটিত কুসুম, কোন ফুল
তবুও বেঁচে যাচ্ছে বিনষ্টির সীমাকে
বধিরের মতো চেপে নিয়ে সন্তর্পণে বেঁচে যাচ্ছে।
কী উজ্জ্বল ছিল চোখের চাহনি।
ফুটেছিল নতুন দীপ্তি
অথচ শব; দীর্ঘ ছায়ার মধ্যে গহন অরণ্য শব
দেখছে
পথ সরু বিপন্ন, এখনও জলোচ্ছ্বাসের
শব্দ
মুহূর্তে, আতঙ্ক
মিনতি করি
এখানে করুণার চোখে
আর ঠাট্টা কোর না। বুক চিরে তোমাকে কি
দেখাবে?
জলোচ্ছ্বাসের লবণ জল
না মনস্তাপ? না তেড়ে আসা চৌদ্দ বছরের ভয়?
একদা তুমিও ছিলে হত্যাকারী; তুমি
এখন যাও।
এই যে লোনা জলে ভেসে যাচ্ছে লাশ
এই যে জোয়ারের জলে চড়ায় এসে পড়েছে
সাহসী বাংলাদেশের প্রতীক
তুমি চোখ বন্ধ কর
তুমি তাকিয়ো না, তুমি তাকালেই
লজ্জা আর ঘৃণায়
শরণার্থী শিবিরে এক কবির সঙ্গে আলাপ
চুয়াত্তর আল-সাঈদা শরণার্থী শিবিরে কবি মাহমুদ
দারবীশের সঙ্গে
যখন আলাপ
তখনও এখানে ওখানে বোমায় বিধ্বস্ত আর ধ্বংসযজ্ঞের চিহ্ন ছড়ানো!
দুজন ফিদেল ক্যাস্ট্রোর মতন
তরুণ
শারণাস্ত্র কাঁধে নিয়ে
ঝড় বৃষ্টি জলে
দিগন্ত রেখার দিকে চেয়ে আছে –
দারবীশ বলেছেন – ‘ঐ ওপার থেকেই ওরা আসে
আকাশ গর্জায়
হাঁ করে গিলে ফ্যালে মরণজ্বালা আলো, যাক
এ প্রসঙ্গ থাক
এটাই তো সব নয়;
সেবার কাকে তুলে দিয়েছি কবরে মনে নেই, কাঁধে
কাঁধ করে নিয়ে গেছি পাহাড়ি গ্রামে
ভুলে গেছি,
বিস্তৃতি গিলে ফেলেছে আমাকে।
সঙ্গে কে কে ছিল সবই হারিয়ে গেছে স্মৃতি থেকে;
শুধু একটিমাত্র তরুণ এই শরণার্থী শিবিরকে
রক্ষা করেছিল; হত্যাযজ্ঞ শেষ করার আগেই
তরুণটি আহত হয়েছিল; সে কাঁদেনি
ফুল ফোটাবার আবেগে
থরথর শুধু কেঁপেছিল, তারপর
নিজেকে পবিত্র করেছিল এল.এম.জি.
প্রেয়সীর হাতে তুলে দিয়ে -’
আল সাঈদা শরণার্থী শিবিরে এই
গল্প শুনছি দূরে গমের শীষে রঙ ধরছে
ভিড়ের ভিতর নীল আহূতি দেখছি শরণার্থী
শিবিরেও দিগন্ত ছিঁড়ে অনন্ত মহাকাশ
কথা বলছে
সীমান্তে আলো নরম হয়ে এলে
সার্চ লাইটে দেখা দিচ্ছে পাহাড়,
মালভূমি জুড়ে
খোঁচা খোঁচা দাড়ির মত
শ্যামল সবুজ।
মাহমুদ দারবীশ বলছেন যারা যায়
হয়তো ফিরবে
হয়তো ফিরবো না
কিন্তু তবু স্বাধীনতার রক্ত কল্লোলে
সারাক্ষণ
এই গ্রামে বাজবে দামামা
অগ্নিদাহের মধ্যেও
দেখতে পাবে
পুষ্পের জ্বলে ওঠা,
বিউগল বেজে উঠলে সবাই সুন্দর কোরে
এসে দাঁড়াবে লাইনে
মাহমুদ দারবীশের উক্তি
হীরক দ্যুতির মত জ্বলতে থাকে
বুনো ঘাসের প্রান্তরে
এই কবিই প্রাণের অঙ্কুরে
ফুটিয়ে গেলেন
একটি কাহিনী
আল সাঈদার সুভাষ মুখোপাধ্যায়
এই সময়
এক বৃদ্ধার দিকে তাকিয়ে
থাকেন আর
হাত মুঠো করেন তারপর
খোলেন, হাত মুঠো করেন তারপর
খোলেন।
কখনও কোন দুঃখে
কখনও কোন দুঃখে চলে যেতে পারি ওপারে,
নদীতে নিসর্গে
কিংবা
কঠিন অসুখে ভুগে
স্বপ্নের ভেতর
ভগ্নস্তূপে।
ফেরে না কোন নারী; ট্রাজিক মুহূর্তে
প্রাণশক্তিতে
বিস্ফোরিত হয় অন্তরালের
শুদ্ধতা।
খুঁজতে খুঁজে মধ্য দুপুরের প্রচ্ছদে
তাকিয়ে থাকি।
চেনা যায় না আদল; চেহারা।
মাটির গভীরতায়
ঘনীভূত হয়ে ওঠে ছায়াচ্ছন্নতা।
বাজে বুকের মধ্যে যে, সে কেমন যেন
কোমল ভয়াল।
কেউ শোনে, কেউ শোনে না।
শুধুই জ্বলে ওঠে উল্টো মুখে স্মৃতি।
বৃষ্টিতে ভিজিয়ে শরীর
দুঃখ বলে কোথায় রোদ্দুর, কি এর মানে
রঙিন ভাঙা কাচ
চেনা শহরের অলিগলিতে
সন্ত্রস্ত নিঃশব্দ চেতনাহীন মানুষের
যে ক্রন্দনধ্বনি ওঠে
তা আমাদের ধমনিতে ও মস্তিষ্কে লগ্ন হয়ে যায়
আমি জানি
এই সময় সেই সময় নয়।
আমি জানি
দীপ্ত প্রেমিকার ম্লান মুখে
ছদ্মবেশী ঘাতকের ছায়া।
বিশুদ্ধ দুঃখে
হৃৎপিণ্ড ছুঁয়ে দেখল
কোথায় ঠিক ভালোবাসা
এই সময় সেই সময় নয়।
কোথায় যাচ্ছো বন্ধু অশোক,
মারণাস্ত্র উঁচিয়ে কেউ নেই
তবুও মৃত্যুভয়তাড়িত এই আস্তানা
দেয় না কোনো নক্ষত্রোজ্জ্বল ছায়া।
হাহাকার আর সর্বনাশে
খুইয়ে বসেছি হৃদয়
তাকে নিয়ে কোনো বিলাপ নেই,
শিশুর মুখের অনাবিল আনন্দে
সুখ নেই,
মড়কে উজাড় ঘরবাড়ি
সন্ত্রাস ছুঁয়ে গেল মেঘ-জল-হাওয়া
যাচ্ছি এক হাসপাতাল থেকে আরেক হাসপাতালে
কোথাও কেউ নেই।
চিৎকার থাকে শহরের সোনালি রোদ্দুরে
বিপদসংকেত বাজিয়ে প্রিয় মানুষের দেহ ছেড়ে যায় অ্যাম্বুলেন্সে
হাঁপরের মতো বুক করে ওঠানামা
সেবাসদনের শার্সিতে দেখি চেনা মানুষের আনাগোনা।
কেউ কথা বলে না।
দাউদাউ আগুন জ্বলে শহরের অলিন্দে
মন্থর মেঘের প্রার্থনা চতুর্দিকে।
প্রিয়জনদের মুখ থমকে থাকে বিলাপে
চেনা যায় না
মৃত্যু অনিবার্য জেনে
শিরায় কালো রক্ত নীল রক্তের দোর্দণ্ড প্রতাপে
ভালোবাসার হৃৎযন্ত্র বধির হয়ে থাকে।
অশোক, পুতুলের মতো চেতনাহীন শরীর নিয়ে তুমি যাবে যাও
শ্রান্ত নিঃসঙ্গ নায়কের বিষণ্নতায়
স্বদেশ দেবে বিমর্ষ স্মৃতি
লাল নীল হলুদ
রঙে ভরা আকাশ
আর রঙিন ভাঙা কাচ।
জর্জ ফ্লয়েড
I know why the caged
Birds sing
Maya Angelou
কালো মানুষ তুমি এখনও
অস্পৃশ্য
শত শত বছর ধরে তুমি
হাঁটছো পথে ও প্রান্তরে।
ছুঁয়ে দেখেছো কি পাথর;
পাথরে কি আছে?
পিতৃপুরুষের হৎপিণ্ড ও শহিদ স্তম্ভ
কি আছে পাথরে?
কি আছে সমুদ্রে
শীতল, ঠান্ডা, হিম নৈঃশব্দ্য।
কালো মানুষ তুমি হাঁটতে থাকো
চোরা ঘূর্ণিস্রোতে হারিয়ে যেও না
মার্কিন পতাকা আজ শতচ্ছিন্ন
দহনে দহনে পুড়ে যাচ্ছে পতাকা ছোট্ট বস্ত্রখণ্ড
নেমে আসছে বিনাশের স্রোত
বিপজ্জনক এক মানুষের ছায়ায়
নিভে যাচ্ছে আমেরিকার আলো।
রাস্তায় রাস্তায়, পার্ক ও স্ট্যাচু অব লিবার্টির সামনে
চেরি ফুলের গন্ধে
আটলান্টা আর ওয়াশিংটনে
হাঁটতে হাঁটতে
তোমার কি মনে পড়ে, কালো মানুষ
মার্টিন লুথার কিং-কে।
গান্ধীজির মন্ত্রে উজ্জীবিত
যে মেলাতে চেয়েছিল ভাঙা কাচ
যে হেঁটেছিল দেশের এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্ত
তোমার কি মনে পড়ে
পল রোবসনকে
যে কেবল বলেছিল
স্বাধীনতা তুমি দয়িতার মতো।
কখনো জলদগম্ভীর স্বরে পল রোবসন বলেছিল,
কালো মানুষ তুমি জেগে ওঠো।
ও ফ্রিডম তুমি জেগে থাকো।
নদীর তীরে জলের ছলাৎ ছলাৎ শব্দে
মিসিসিপি কিংবা হাডসন নদীর তীরে।
কালো মানুষ, তুমি হাঁটতে থাকো
আর গান গাও
চোরা ঘূর্ণিস্রোতে হারিয়ে যেও না।
বিনাশের শব্দগুলো
বিনাশের শব্দগুলো এখন ভাঙছে
খেলা করছে
কুলুপ লাগিয়ে ঠোঁটে ঔদাস্যে
মাদারীর খেল দেখছি নাগরিক আহ্লাদে
এই শহর একদা আমার ছিল
কলরব আর মিছিলের ধ্বনিগুলো স্কন্ধে নিয়ে
ধুলোমাটি হয়ে উঠেছিল পবিত্র
স্বাধীনতার বজ্রকণ্ঠ ছিল, মুক্তিযোদ্ধাদের রণাঙ্গন
উঠে এসেছিল স্নেহময় শরীরে।
দাবদাহে ছিল কখনো অগ্নিকুণ্ড
শৈশবের ছন্নছাড়া জীবনে একটি লাল ঘোড়া
পূর্ণতা এনে দিয়েছিল।
শামসুর রাহমান এই শহরের স্পন্দমান দুপুরে
জনারণ্যে কামানের গর্জন শুনেছিল
আমি এখন খনন করছি
পিতৃপুরুষের অহংকার।
ফুল ফোটে আর ঝরে পড়ে
পাখি ডাকে অলিন্দে
সবুজের উদ্গম ও নিঃশব্দে
স্তব্ধতা মেখে এই শ্রাবণে জেগে থাকে।
বলির বাজনার মতো সাইরেন বাজিয়ে
যখন অ্যাম্বুলেন্স যায়
অ্যাম্বুলেন্স আসে
দেখেছি মায়াবী শিল্পীর চোখ
পাণ্ডুর ললাট, বুক হাঁপরের মতো উঠছে নামছে
সে কি করবে? সে কি ফেরার গান গাইবে
আবার মধ্যরাতে?
সে কি ম্লান অন্ধকারে
নদীর ছলছল শব্দে জেড়ে উঠবে?
সে কি রণক্লান্ত যুবকের অলীক স্বপ্নে
মায়াময় নারীর আকাক্সক্ষায়
ফের যুদ্ধে যাবে?
Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.