‘এখন আর ফোন আসে না’

২৬ অক্টোবর ২০২০। সন্ধ্যা সাড়ে ৬টা। বিকেল ৫টার দিকে যথারীতি কালি ও কলমের কাজ সেদিনকার মতো সেরে বিছানায় শুতেই চোখ লেগে এসেছিল। মাঝে মোবাইল বাজলেও রিং টোন কানে পৌঁছেনি। যা হোক সাড়ে ৬টার দিকে মোবাইল হাতে নিয়ে দেখি ধনুভাইয়ের মিসড কল, সোয়া ৫টার দিকে। কী হলো? বুক ধক্ করে উঠল। ধনুভাই হাসনাতভাইয়ের গাড়ির চালক। হাসনাতভাই হাসপাতালে ভর্তি। অসুস্থ। অনেক জটিলতা একের পর এক সামনে এসে দাঁড়াচ্ছে। হৃৎপিণ্ডের ঊর্ধ্বগতি নিয়েই ধনুভাইকে ফোন দিলাম।

ধনুভাই, কী অবস্থা? হাসনাত স্যার কেমন আছেন? (অফিসের সবাই ‘স্যার’ বলেন, একেবারে ঊর্ধ্বতন কয়েকজন ছাড়া, তাই আমিও ‘স্যার’ সম্বোধনেই থিতু। যদিও সংবাদে ‘ভাই’ বলে সম্বোধন করতাম।)

‘না স্যার, কোনো সমস্যা নাই। স্যার কথা বলবেন।’ ধনুভাইয়ের উত্তর।

আচ্ছা দিন।

ফোনটা হাতে নিয়েই হাসনাতভাই বললেন, ‘আশফাক খুব কষ্ট … গলাটা জড়ানো, অস্ফুট, যেন-বা অনেক দূর থেকে ভেসে আসা নদীর ঢেউয়ের ক্ষীণ শব্দ। আমি বলতে চেষ্টা করলাম ‘স্যার, সব ঠিক হয়ে যাবে।’ কিন্তু শুনলেন কি না জানি না, আবারো সেই একই কথা ‘আশফাক খুব কষ্ট …।’ এরপরই ফোন দিলেন ধনুভাইয়ের হাতে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘ধনুভাই কী অবস্থা স্যারের? তিনি জানালেন, ‘আগের থেকে স্যারের অবস্থা একটু ভালো।’ আমি আর কথা বাড়ালাম না, লাইন কেটে দিলাম, জানতাম ধনুভাই সর্বক্ষণ হাসনাতভাইয়ের দেখাশোনায় ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন হাসপাতালে।

এ-ঘটনার কদিন আগে ২৪ অক্টোবর একঝলক হাসপাতালে গিয়ে হাসনাতভাইকে দেখে এসেছিলাম। তখনো গলার স্বর বেশ স্পষ্ট। আমাকে দেখে খুশি হলেন। জানতে চাইলেন, আমরা সবাই মানে কালি ও কলম, বেঙ্গল পাবলিকেশন্সের সবাই কেমন আছেন? কাজ কেমন চলছে? আমি কথার মাঝে বললাম, ‘আপনি একটু সুস্থ হলেই কাজের ডিটেইলটা আপনাকে দেখিয়ে নেব।’ তিনি বললেন, ‘দরকার নেই, এবার আপনারাই করুন।’ আমরাই তো করছি এখন, কিন্তু এমনটা কী কথা ছিল হাসনাতভাই?

করোনা-পরিস্থিতির কারণে বেশ নিয়মনীতি মেনেই হাসপাতালে দেখা করতে গিয়েছিলাম। সেখানে সর্বক্ষণ হাসনাতভাইয়ের পাশে ছিলেন তাঁর সহধর্মিণী নাসিমুন আরা হক, আমাদের মিনু আপা। তিনি বললেন, ডাক্তাররা আশাবাদী, ওষুধ কাজ করছে। তবে পুরোপুরি সেরে উঠতে সময় লাগবে। তা লাগুক, হাসনাতভাইয়ের সুস্থতাই যে আমার, আমাদের, কাম্য। আনিসুজ্জামান স্যার ছিলেন আমাদের ছাদ, হাসনাতভাই কাঠামো। সেই ছাদ সরে গিয়েছে এ-বছরেরই মে মাসে। আনিসুজ্জামান স্যার চলে গেছেন করোনার কাছে পরাস্ত হয়ে। হাসনাতভাইকে নিয়ে তাই ভয়। তিনি চলে গেলে যে আমাদের বিপদ!

মানুষ ভাবে এক, হয় আর এক। সব আশা-আকাঙ্ক্ষা, ইচ্ছা, স্বপ্নকে আঁধারে ঢেকে দিয়ে ১ নভেম্বর সকাল ৯টার দিকে বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের জিএম আতাউর রহমানভাইয়ের ফোন এলো ‘আশফাক, তুই কই? খবর শুনছিস? হাসনাতভাই তো নাই! প্রতিদিনকার মতো সকালে উঠে কম্পিউটার খুলে বসার প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। ছেলেমেয়ে তখনো ঘুমে। স্ত্রী ঘুমের আলস্যে বিছানায়। আমার কেমন জানি সব কিছু হঠাৎ ফাঁকা হয়ে গেল কী করব এখন? কাকে জানাব? বোকার মতো দাঁড়িয়ে আছি দেখে স্ত্রীর প্রশ্ন ‘কী হয়েছে? আমি কোনোমতে বলতে পারলাম, ‘হাসনাত স্যার নেই।’ আমার গলা খরখরে, শুষ্ক, কিন্তু ডুকরে উঠল আমার স্ত্রী, যে কি না জীবনে একবারই মাত্র হাসনাত স্যারকে সামনাসামনি দেখেছে, তাও কথা হয়েছে খুবই কম, হয়তো একটি কি দুটি বাক্যে কুশল বিনিময়। তাহলে সে কেন কাঁদছে? আমি কেন কাঁদতে পারছি না? পুরুষ হয়তো এমনই হয়, চাইলেই কাঁদতে পারে না।

সেদিন ছুটে হাসপাতালে যাওয়া থেকে শুরু হলো অন্য একটা দিন। অসংখ্য ফোন আসছে। কথা বলতে পারছি, পারছি না। হাসনাতভাইয়ের ছবি মনে ভাসছে। হাসপাতালে শেষ দেখা, শেষ কথা, হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার আগে ৩০ সেপ্টেম্বর শেষ মিটিং বেঙ্গল গ্যালারিতে। কত স্মৃতি, কত কথা, কত অভিমান, কত ঘটনা সব তখন মনের ভেতর জমাট বেঁধে আছে। যখন হাসনাতভাইকে নিয়ে আমরা এই শহরে তাঁর শেষ ঠিকানা মিরপুরের বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে পৌঁছলাম তখন আকাশ কালো করে অঝোরে ঝরছিল অশ্রুধারা। সেই ধারায় আমরা সবাই কমবেশি ভিজছিলাম, কিন্তু কারো কোনো বিকার নেই; প্রিয়জন যে শেষ শয়ানে সেই বিরহের কাছে বৃষ্টির বাধায় কিইবা এমন এসে-যায়। আমরা যে একটি সময়কে রেখে গেলাম এখানে, একটি ইতিহাস চির-আশ্রয় পেল এই মাটিতে, একটি আদর্শ স্থির-অবিচল হয়ে রইল এখানে। কান্না এলো না তখনো, হয়তো এলেও বৃষ্টির ফোঁটা তা ধুয়ে দিয়েছে।

দুই

কালি ও কলম পত্রিকার সম্পাদক আবুল হাসনাত বা কবি মাহমুদ আল জামান এই দুই পরিচয়ের মধ্যে সম্পাদক পরিচয়টাই সবার কাছে বেশি চেনা। অবশ্য দৈনিক সংবাদে দীর্ঘদিন সাহিত্যপাতার সম্পাদকের দায়িত্ব পালন এবং এ-পাতাটিকে পাঠকপ্রিয় ও সমৃদ্ধ করে গড়ে তোলাও তাঁর অনন্য কীর্তি। মূলত এ-সাহিত্যপাতাই তাঁকে শ্রেষ্ঠ সাহিত্য সম্পাদকের পথে এগিয়ে দিয়েছিল বহুদূর আর পথের সমাপ্তিতে শেষ গতির বিজয়ের হাসি ছিল কালি ও কলম। শুধু কালি ও কলমই নয়, তিনি তাঁর চওড়া কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন উপমহাদেশের একমাত্র চিত্রকলাবিষয়ক বাংলাভাষার পত্রিকা শিল্প ও শিল্পীর দায়িত্ব। একাগ্র মনোযোগে এগিয়ে নিয়ে গেছেন প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান বেঙ্গল পাবলিকেশন্সকে; অধিষ্ঠিত করেছেন সম্মানজনক আসনে। এত এত কাজের ছক কেটে তা সুন্দরভাবে বাস্তবায়ন করেছেন একাই। সঙ্গে ছিলাম আমরা সৈন্যবাহিনী আর বিশেষভাবে ছিলেন বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান আবুল খায়ের এবং সবসময় বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের মহাপরিচালক ও কালি ও কলমের সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য লুভা নাহিদ চৌধুরী। লুভা আপা আমাদের এখন আরো বেশি করে আগলে রেখেছেন হাসনাতভাই চলে যাওয়ার পর।

হাসনাতভাইয়ের যৌবনকাল ছিল উত্তাল সময়ের স্রোতে ভাসা। ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, সত্তরের নির্বাচন, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় যোদ্ধাদের অন্যতম তিনি। ছিলেন ছাত্র ইউনিয়ন ও পরে কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য। মুক্তিযুদ্ধের প্রায় পুরোটা সময়ই কলকাতায় কমিউনিস্ট পার্টির অফিস সামলেছেন। সে-সময় পার্টির পক্ষ থেকে একটি পত্রিকাও বের হতো, নাম ছিল মুক্তিযুদ্ধ, এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিলেন তিনি। মূলত কলকাতায় অবস্থানকালেই সেখানকার কবি-সাহিত্যিক-শিল্পী ও বুদ্ধিজীবীদের সঙ্গে গভীর সখ্য গড়ে ওঠে হাসনাতভাইয়ের, যা তাঁর লেখা এবং তাঁর সম্পর্কে বিভিন্ন জনের লেখায় জানা যায়। সেই সম্পর্ক আমৃত্যু লালন করেছেন তিনি পরম যত্নে।

মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের পর যে-স্বপ্ন চোখে নিয়ে স্বাধীন দেশে ফিরে এসেছিলেন হাসনাতভাই, তার অনেক কিছুই কালক্রমে ধূসর হয়ে গিয়েছে। স্বার্থবাদ আর লোভ-লালসার কাছে নতজানু হয়েছে আদর্শ, দুঃখ পেয়েছেন তিনি। মাঝে মাঝে হঠাৎই হয়তো বলতেন আমাদের আমাকে ও কালি ও কলমের ডিজাইনার আতাউর রহমানকে ‘আরে কী ভেবেছি আর কী হয়েছে! সবচেয়ে কষ্ট পেতেন একসময় তাঁর সঙ্গে একই পথে চলা, কিন্তু পরে সাম্যবাদের আদর্শ ছেড়ে পুঁজিবাদের ডানার নিচে আশ্রয় নেওয়া সঙ্গীদের নিয়ে। তাঁর সেই কষ্টভরা মুখ এখনো মাঝে মাঝে চোখে ভাসে।

স্বাধীনতার পর এদেশের মানুষের রুচি-সুখ-দুঃখ-আনন্দকে তুলে ধরতে দায়িত্ব নিয়েছিলেন গণসাহিত্য পত্রিকার। সেটাও সে-সময়ে বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছিল বলেই জানতে পারি গুণীজনদের লেখায়। এমন অসংখ্য মাইলস্টোন সৃষ্টি করা হাসনাতভাই কখনোই নিজেকে জাহির করতে চাননি জনপ্রিয়তার স্পটলাইটে। বড় নিভৃত, একাকী, মুখচোরা তিনি। মাঝে মাঝে অফিসে যখন বড় কোনো লেখক এসে হাসনাতভাইয়ের সামনে বিনীত ভঙ্গিতে বসে কথা বলতেন, তখন বিস্মিত হয়ে তাকিয়ে থাকতাম। আসলেই হাসনাতভাইকে পরিপূর্ণভাবে আমার, আমাদের, চেনাই হলো না।

তিন

কবিতা লিখতেন মাহমুদ আল জামান নামে। চিত্র-সমালোচনা আর গ্রন্থ-আলোচনায় ছিলেন আগ্রহী। চিত্র ও গ্রন্থ দুটোই ছিল তাঁর অতি প্রিয়। প্রবন্ধও লিখেছেন অনেক। সম্পাদনা করেছেন বহু গ্রন্থ। তাঁর বন্ধু-স্বজনদের কাছে এবং তাঁর লেখা থেকে পাওয়া, একসময় ক্রীড়া সাংবাদিকতাও করেছেন। খেলেছেন ক্রিকেটও। তবে সবকিছুর ওপরে তিনি সম্পাদক।

এবার কালি ও কলমের হাসনাতভাইকে নিয়ে কিছু বলার চেষ্টা করব। কালি ও কলমের আগামী সংখ্যা কী হবে? কনটেন্ট কী থাকবে? কারা লিখবেন? এগুলো কখনোই আমাদের ভাবার বিষয় ছিল না, কারণ পুরো ভাবনাটা ছিল হাসনাতভাইয়ের। তিনি হয়তো মাসের ১৫ তারিখে (ওইদিন কালি ও কলম নিয়মিত বাজারে থাকে, মানে প্রকাশের দিন) আমাকে ডেকে বললেন, ‘আশফাক এঁদের নাম লেখেন, আগামী সংখ্যায় লিখবেন। আর হাতে কী আছে দেখুন।’ ‘হাতে কী আছে’ মানে আমাকে সমুদ্রে ফেলা কারণ কালি ও কলমে যে কত  লেখা আসে, দুই বঙ্গ থেকেই, তা বলে বোঝানো মুশকিল। অগত্যা হাতে যা আছে গুছিয়ে নিয়ে তাঁর টেবিলে হাজির, সঙ্গে ডিজাইনার আতাউরভাই; কখনো কখনো সঙ্গে থাকেন সহকর্মী মনি গোস্বামী। তবে আমি সাগরে পড়লেও হাসনাতভাই কিন্তু ডাঙাতেই থাকতেন; চট করে বেছে বের করে ফেলতেন কী কী যাবে পরের সংখ্যায়। তারপরও কোথাও ঘাটতি থাকলে ঠিকই জোগাড় করে ফেলতেন লেখা।

এরপর মেকাপ। আমি আর আতাউরভাই বিশেষ করে আতাউরভাই-ই করতেন, আমি মাঝে মাঝে মতামত দিতাম মাথা খাটিয়ে কিছু একটা বের করে তাঁর কাছে নিয়ে গেলে তিনি দ্রুত চোখ বুলিয়ে তাঁর পছন্দ জানাতেন। কখনো আমাদের পছন্দেও আস্থা রাখতেন। তবে যা-ই করতেন সেখানে গণতান্ত্রিক একটা আবহ থাকত।

এরপর প্রুফ, ডিজাইন, আউটপুট ছাড়া থেকে পত্রিকা হাউসে আসা পর্যন্ত তাঁর একটা কথাই বারবার আমাদের শুনতে হতো ‘ভালো করে চেক করে দেবেন। খুব সাবধানে কাজ করবেন। ওভার কনফিডেন্ট হয়ে কিছু করবেন না।’ মাঝে মাঝে আমরা বিরক্ত হলেও কখনো কখনো তাঁর এই সাবধানীবাণী যে কত গুরুত্বপূর্ণ তা হাড়ে হাড়ে বুঝতে পারতাম। তখন মাথা নিচু করে তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে থাকতাম কিন্তু তিনি বিরক্তভরা চোখে তাকিয়ে থাকলেও, একটু বকাঝকা করলেও কখনো চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্ত নেননি। কারণ তিনি যে তাঁর সহকর্মীদের (অধীনস্থ নয়, সহকর্মী) ভালোবাসতেন। হয়তো মুখে বলতেন না, কিন্তু তাঁর কথায়-আচরণে আমরা বেশ বুঝতে পারতাম। তাই সেই সময়গুলো তাঁর সামনে থেকে একরকম পালিয়ে থাকলেও বুঝতে পারতাম, রাগ নয়, তিনি অভিমান করেছেন আমাদের সঙ্গে। এমনকি অভিমান করে কখনো কখনো আমাদের কারো কারো সঙ্গে দুই-তিন দিন কথাও বলতেন না, একেবারেই বাচ্চা ছেলের মতো। আমরা তখন অপেক্ষায় থাকতাম কখন বরফ গলবে। বরফ গললে আমাদের আর পায় কে। আসলে কালি ও কলমের সকল ভার তিনি পরম মমতায়, যত্নে সবসময়ই বহন করেছেন। তাই পত্রিকার যে-কোনো ভুল বা সমালোচনা তাঁকে পীড়া দিত, যে পীড়ন অবশ্য আমরাও ভোগ করতাম। কিন্তু সম্পাদক হিসেবে তাঁর জন্য বিষয়টি ছিল অধিক কষ্টের।

এ-পত্রিকার অসংখ্য বিশেষ সংখ্যা নিজ পরিকল্পনায় ও কর্মদক্ষতায় সাজিয়েছেন হাসনাতভাই। সঙ্গে আমরা সৈন্যবাহিনী তো ছিলামই। কবিতা সংখ্যা, চিত্রকলা সংখ্যা, গল্পসংখ্যা, মোহাম্মদ কিবরিয়া সংখ্যা, সৈয়দ শামসুল হক সংখ্যা এমন বহু সংখ্যার সফল উদ্যোক্ত ও বাস্তবায়নকারী তিনি। একটা ব্যাপার অবশ্য এখানে আমাদের সঙ্গে তাঁর ঘটেছিল তিনি কী চাইছেন সেটা অনেকটাই আমরা অনুধাবন করতে পারতাম। তাই কোনো কাজই কখনো আটকে থাকেনি, সময়মতোই শেষ হয়েছে।  

এই করোনাকালেও প্রথম দিকে যখন কী হবে ভেবে হতাশায় ডুবে আছি তখন একদিন হাসনাতভাই জানালেন, ‘আশফাক কালি ও কলম গল্পসংখ্যা করব। প্রস্তুতি নিন।’ ‘কিন্তু কীভাবে? বাড়িতে তো কোনো সেটআপ নেই? জানাতেই বললেন, ‘অফিস থেকে যার যার কম্পিউটার বাড়িতে নেওয়ার ব্যবস্থা করুন। আমি লুভাকে বলে দিচ্ছি।’ তাঁর বলতে দেরি কিন্তু আমার আর এগোতে দেরি হলো না, আমি দ্রুত অফিস ব্যবস্থাপনায় যাঁরা ছিলেন তাঁদের সঙ্গে কথা বলে যার যার বাড়িতে কম্পিউটার পাঠানোর ব্যবস্থা করলাম। এটা সম্ভবত গত এপ্রিলের ৩ কি ৪ তারিখের ঘটনা। বাসায় কম্পিউটার আসার সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয়ে গেল তোড়জোড়। গল্পসংখ্যার কাজ শুরু। দ্রুত লেখা আসতে লাগল। প্রতিদিন হাসনাতভাই সকাল-বিকেল ফোন করছেন, কথা বলছেন, নির্দেশনা দিচ্ছেন। আমি কোনো লেখা বাসায় বসে প্রিন্ট দিচ্ছি আর আমাদের অফিস সহকারী জাকির তা নিয়ে যাচ্ছে হাসনাতভাইয়ের বাসায়। সেগুলো তিনি দেখে পাঠাচ্ছেন। জাকির হোয়াটসঅ্যাপে আমাকে কারেকশন কপি পাঠাচ্ছে। আমি বা আতাউরভাই সংশোধন করে লেখা তৈরি করছি। সঙ্গে যুক্ত আছেন মনি গোস্বামী। কখনো সাহায্য নিচ্ছি বেঙ্গল পাবলিকেশন্সের সহকর্মী আজগর আলী, সারোয়ার হোসেন, মহসীন আলীর। টাইপ করছেন হারুন অর রশীদ। একসময় মেকাপের প্রশ্ন এলো কালি ও কলমের গল্প সবসময়ই চিত্রশিল্পীদের দিয়ে অলংকরণ করানো হয়। কিন্তু এবার কীভাবে হবে? আমাদের ওপর আস্থা রাখলেন হাসনাতভাই, বললেন, ‘আপনারা নিজেদের মতো করুন। আমাকে দেখিয়ে নেবেন।’ আর কী, কাজে লেগে পড়লাম আমি আর আতাউরভাই। গল্প পড়ে সে-অনুযায়ী কোলাজ তৈরি করি আর পাঠাই হাসনাতভাইকে, কখনো ই-মেইলে, কখনো হোয়াটসঅ্যাপে। তিনি দেখে জানান, ‘ঠিক আছে’, ‘ভালো হয়েছে’ আমাদের মনে আনন্দ হয় হাসনাতভাইকে খুশি করা গেছে!

এভাবে গল্পসংখ্যা করতে করতেই মে মাসে আনিস স্যার চলে গেলেন। এবার কিন্তু অনলাইন নয়, কাগজে ছাপা। আবারো হাসনাতভাইয়ের পরিকল্পনা, আমাদের সর্বতো চেষ্টা এবং অবশেষে আনিসুজ্জামান স্যার স্মরণসংখ্যা প্রকাশ। এ-সংখ্যা প্রকাশের আগে প্রতিটি লেখা-ক্যাপশন মনোযোগ দিয়ে দেখেছেন হাসনাতভাই, বেশ কয়েকবার আমরা বসেছি বেঙ্গল বইয়ের লালমাটিয়ার কার্যালয়ে, আমাদের ধরিয়ে দিয়েছেন ভুল-ত্রুটি, আমরাও আমাদের মতামত জানিয়েছি। এত পরিশ্রমের ফল একটি সুন্দর সংখ্যা, যার চাহিদা এখনো প্রচুর। অনেকেই চান, কিন্তু আমরা দিতে পারি না।

হাসনাতভাইয়ের আরেকটি অসাধারণ কীর্তি ‘বঙ্গবন্ধু সংখ্যা’। একটি সাহিত্য পত্রিকায় বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে যে একটা সংখ্যা হতে পারে তা কেউ ভাবতে পেরেছিলেন কি না জানি না; কিন্তু হাসনাতভাই ভেবেছিলেন এবং তিনি খুব দ্রুত সে-সংখ্যার লেখা সংগ্রহ করে প্রকাশও করেছিলেন। আমার জানামতে এমন সমৃদ্ধ সংখ্যা এখনো আমাদের দেশে হয়নি। হয়তো বঙ্গবন্ধুর জীবনের ওপর আরো বেশি আলোকপাত করা হয়েছে অন্যান্য গ্রন্থ বা পত্রিকায়; কিন্তু এপার-ওপার বাংলার কবি-সাহিত্যিক-বুদ্ধিজীবীদের দৃষ্টিতে বঙ্গবন্ধুকে দেখার-জানার যে অনন্য অভিজ্ঞতা, তা কালি ও কলমের এই সংখ্যাটিতে ধরা আছে।

কালি ও কলমের বিভিন্ন সংখ্যা এবং অন্যান্য কর্মে হাসনাতভাইয়ের সাফল্য ও পরিকল্পনার সফল বাস্তবায়ন দেখে আমার তাই কখনো কখনো মনে হতো কীভাবে পারেন তিনি! আমার এখনো মনে হয় এবং বিশ্বাস করি, তাঁর মতো এমন গুণী ও সহকর্মীসজ্জন সম্পাদক দুই বাংলাতেই আর কেউ হবেন না। 

চার

শেষে একেবারেই ব্যক্তিগত অনুভব। লকডাউনের সময় প্রায়ই সকাল, বিকেল, রাতে কথা হতো হাসনাতভাইয়ের সঙ্গে। তখন বাইরে বের হওয়া যেত না আর সবার মধ্যে কাজ করছিল এক অজানা আতঙ্ক। সে-সময় বা তার পরও, যেহেতু বাসায় বসে অফিস, তাই ফোনই ছিল যোগাযোগের মাধ্যম। সাধারণত প্রতিদিনই বিকেল ৫টার পর সন্ধ্যা ৬টা থেকে ৭টার মধ্যে হাসনাতভাইয়ের ফোন আসত। সে-সময় আমি হয়তো ফোনের আশেপাশে নেই কিন্তু আমার স্ত্রী বা ছেলেমেয়ে যে কেউ ফোন না দেখেই বলে দিত ‘হাসনাত স্যার ফোন দিয়েছেন’ এবং কী পরম সত্য! তাই হতো। অর্থাৎ আমার পরিবারের সঙ্গে হাসনাতভাই জড়িয়ে গিয়েছিলেন এক অদৃশ্য বন্ধনে, হোক না মোবাইলে কল দেওয়ার মধ্য দিয়ে; কিন্তু একটা বন্ধন তৈরি হয়ে গিয়েছিল। আমাদের সবাইকে ছেড়ে হাসনাতভাই চলে গেছেন প্রায় এক মাস হলো। এখনো মাঝে মাঝে হঠাৎ সেই সময়ে মোবাইল বেজে ওঠে, কিন্তু পরিচিত সেই নাম ভাসে না স্ক্রিনে। আমার স্ত্রী হঠাৎ একদিন ভুল করে বলে বসেছিল ‘জলদি ফোন ধরো, হাসনাত স্যার ফোন দিয়েছেন।’ তারপরই নিজের ভুল বুঝতে পেরে চুপ। আমিও চুপ। একসময় মৌনতা ভেঙে ছোট্ট নিশ্বাস ছেড়ে বলল, ‘এই সময়ে তো হাসনাত স্যারই ফোন দিতেন বেশিরভাগ সময়। এখন আর ফোন আসে না।’ জানি না কোন সে-মায়ায় মানুষ মানুষকে জড়ায় না দেখে, না জেনে, না শুনে; কিন্তু সে-মায়া যে হাসনাতভাইয়ের অন্তর জুড়ে ছিল তা আমি জানি, জানে আমার মতোই তাঁর সহযাত্রীরা। ভালো থাকুন ভাই, যেখানেই থাকুন। আমাদের আশীর্বাদ করুন যেন আপনার স্বপ্নকে আমরা এগিয়ে নিয়ে যেতে পারি।