হারানো সিঁড়ির চাবির খোঁজে আবুল হাসনাত

অক্টোবরের (২০২০) একত্রিশ তারিখেও জানতাম আবুল হাসনাত তাঁর অসুস্থতা কাটিয়ে উঠেছেন এবং দু-চার দিনের মধ্যে বাড়ি ফিরে যাবেন। মার্চের শেষ সপ্তাহে ধানমন্ডির ১৫ নম্বরের কালি ও কলম অফিস থেকে বেরুনোর পর আবুল হাসনাতের সঙ্গে আমার আর দেখা হয়নি, যদিও মাঝে-মধ্যেই ফোনে আলাপ হতো এবং পত্রিকা নিয়ে নানা কাজকর্মের বিষয়ে আমরা কথা বলতাম। আবুল হাসনাত তো শুধু নামেই সম্পাদক ছিলেন না, সর্বার্থে পত্রিকার সব দায়িত্ব পালনের জন্য অশেষ যত্নবানও ছিলেন। তাঁর সম্পাদিত বিভিন্ন সংকলনগ্রন্থ এবং সাময়িকী ও পত্রপত্রিকাগুলি তার প্রমাণ। সম্পাদকের একটি বড় দায়িত্ব হচ্ছে কী কী লেখা কাকে দিয়ে লেখাবেন তা নিয়ে বিশেষভাবে ভাবনাচিন্তা করা। এ-কাজের ব্যাপারে সম্পাদক আবুল হাসনাতের একটি বিশেষ সুবিধাজনক অবস্থান ছিল। ছাত্রজীবন থেকে প্রধানত একুশের সংকলন প্রকাশের কাজে হাসনাতের একান্ত সংশ্লিষ্টতা ছিল এবং তাঁর ও তাঁদের সম্পাদিত ছাত্র ইউনিয়নের একুশের সংকলন জয়ধ্বনি যেমন দৃষ্টিনন্দন হতো তেমনি বৈচিত্র্যময় ও মানসম্পন্ন রচনায় সমৃদ্ধ থাকত। এ-প্রসঙ্গে মনে পড়ল, প্রধানত ষাটের দশকে অফুরন্ত উৎসাহের সঙ্গে একুশের সংকলন প্রকাশের কথাটিও। মনে আছে, তখন এসব সংকলন প্রকাশের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছাত্রযুব কর্মীরা একুশের ভোরবেলায় শহিদ মিনারের সামনের বিস্তৃত খোলা জায়গায় দাঁড়িয়ে সেগুলি বিক্রি করতেন। আমাদের মধ্যে অনুচ্চারিত প্রতিযোগিতা ছিল কে কয়টি একুশের সংকলন সংগ্রহ করতে পারে একুশের সেই ভোরের সমাবেশ থেকে। মূল্য অতি সামান্য, কিন্তু সংগ্রহ অমূল্য, যেহেতু হৃদয়ের উষ্ণতা জড়ানো থাক সেসব সংকলনের প্রতিটির পাতায় পাতায়। একুশের সংকলনে লেখার ক্ষেত্রেও আমাদের আগ্রহ ও উৎসাহ কম ছিল না। ছাত্রছাত্রী ও যুবাবয়সীদের মধ্যে একুশের সংকলন প্রকাশের সে-উদ্দীপনা এখন আর তেমন চোখে পড়ে না।

ধান ভানতে শিবের গীত। বলছিলাম প্রিয় বন্ধু প্রয়াত আবুল হাসনাতের কথা। তবে এসব কথা আবুল হাসনাতের সঙ্গে অপ্রাসঙ্গিক মনে হয় না কখনো। বিগত শতকের ষাটের দশকের রাজনীতি ও ছাত্র-আন্দোলন থেকে আবুল হাসনাতের জীবনবীক্ষাকে আমার মনে হয়, কোনোভাবেই পৃথক করা চলে না। সাম্যবাদী দর্শনের সঙ্গে তাঁর পরিচয় ঘটে সে-সময়েই, বিশেষভাবে বন্ধু মতিউর রহমান (প্রথম আলো-সম্পাদক) এবং অধ্যাপক আবদুল হালিমের ঘনিষ্ঠ সাহচর্যে। এ-সময়কার নানা ঘটনা ও জীবনযাপনের অন্তরঙ্গ বিবরণ উঠে এসেছে তাঁর আত্মজৈবনিক ও সর্বশেষ প্রকাশিত গ্রন্থে (হারানো সিঁড়ির চাবির খোঁজে)। মনে পড়ছে, কী অসীম মনোযোগ ও অধ্যবসায়ের সঙ্গে তিনি লিখেছেন সে-বইটি। লেখার পর কোনো অংশ আমাকে পড়তে দিয়ে হাসতে হাসতে বলতেন, ‘দেখুন, চলবে কি না।’ এখন আমার মনে হচ্ছে আবুল হাসনাত এ-বইটি লিখেছিলেন প্রচণ্ড একটা ঘোরের মধ্যে। সারাক্ষণ ডুবে থাকতেন সেই লেখার চিন্তায়, প্রাসঙ্গিক তথ্যের জন্য খুঁজতেন নানা বই ও পত্রপত্রিকা। তাঁর আগ্রহ ও উদ্যোগের কারণে বইটির বেশিরভাগই আমার পড়া হয়ে গিয়েছিল সেটি প্রকাশিত হবার আগেই। তবে ছাড়াছাড়াভাবে পড়া হতো বলে তখন এর সমগ্রতার রূপ আমার কাছে স্পষ্ট হয়নি, বুঝতে পারিনি যে গদ্যকার আবুল হাসনাত স্মৃতিকথার আদলে ও আড়ালে খুব খোলামেলাভাবে তাঁর বেড়ে ওঠা, বিশ্বজগতের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক নির্মাণ এবং আমাদের জাতীয় ইতিহাসের একটি সময়কালকে নিজের মতো করে তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। বইটির ভূমিকায়ও তিনি এ-কথা বলেছেন : ‘আমার জীবন কোনো অর্থেই বর্ণময় নয়। সাধারণ ও আটপৌরে। তবে প্রত্যক্ষ করেছি এদেশের মানুষের সংগ্রাম ও বিজয়। এই বিজয় আত্মশক্তিতে বলিয়ান [বলীয়ান] হয়ে বাঙালি সমাজকে স্বাজাত্যবোধে উদ্দীপিত করেছে। জাতীয় বিকাশ ও শিল্প ও সাহিত্যের প্রতিটি ক্ষেত্রকে করে তুলেছে দীপিত। এ যে কত বড় অভিজ্ঞতা তা বলে শেষ করা যায় না। …

আমাদের অশেষ আনন্দানুভব এই যে, এ-অভিজ্ঞতার স্বাদ আমরাও পেয়েছি একই সঙ্গে। কিন্তু আবুল হাসনাতের সঙ্গে আমাদের অনেকের মোটা দাগে পার্থক্য এখানে যে, তিনি অভিজ্ঞতার অধিক্ষেত্রের বাইরের একজন দর্শকমাত্র ছিলেন না। তিনি এই অভিজ্ঞতালাভের সঙ্গে নিজ কর্মপ্রয়াসে একাত্ম হয়ে জীবনদৃষ্টি ও জীবনের প্রত্যয়গুলিকে মহত্তর চেতনার দিকে প্রসারিত করতে পেরেছিলেন। সে-কারণে তাঁর বইটি হয়ে উঠেছে ব্যক্তিমানুষের জীবন ও ইতিহাসের ঘটনাবলিকে বিশ্লেষণ করারও একটি প্রয়াস, যেখানে তিনি তাঁর চিন্তা ও ধারণাকে স্বচ্ছতরভাবে তুলে ধরেছেন।

আমি এখানে, বস্তুত, আবুল হাসনাতের এই বইটির আলোচনা করতে বসিনি, কেননা এই সময়ে সেটি সম্ভব বলে আমার মনে হয় না। বিগত ষাটের দশকের মাঝামাঝি সময় থেকে যদিও আবুল হাসনাতের সঙ্গে আমার পরিচয় ও ঘনিষ্ঠতা, তবু কোনো সময়েই সে-ঘনিষ্ঠতা অন্তরঙ্গ সুহৃদের পর্যায়ে পৌঁছতে পারেনি। দৈনিক সংবাদের সাহিত্য সাময়িকীর সাহিত্যপাতা, গণসাহিত্য এবং কালি ও কলমের সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে কখনো কখনো তাঁর অনুরোধে কিংবা কখনো নিজে থেকেই তাঁকে লেখা দিয়েছি কিংবা তাঁর কোনো কোনো সংকলনের জন্য কিছু কিছু লেখা অনুবাদও করেছি। এই সম্পর্ক ছিল বহুলাংশে কিছুটা আনুষ্ঠানিক, কিন্তু হৃদয়ের উষ্ণতায় জীবন্ত। নানা সময়ে একসঙ্গে কাজও করেছি কিছু কিছু ক্ষেত্রে। জীবনদৃষ্টির ক্ষেত্রেও মিল ছিল বহুলাংশে। তবু ব্যক্তি হাসনাতকে খুব নিবিড়ভাবে জানার সুযোগ তখন ছিল না, যা সম্ভব হয়েছে বছর চারেক আগে কালি ও কলম পত্রিকার সম্পাদকমণ্ডলীর একজন হিসেবে তাতে যোগদানের পর। সেই সময়ে একদিন ফোন করে হাসনাত আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন কালি ও কলমে তাঁর সহকর্মী হিসেবে কাজ করতে আমি রাজি আছি কি না। উত্তরে আমি বলেছিলাম, করা যায়। এরপর ঠিক হয়েছিল সপ্তাহে দুদিন কাজ করতে হবে আমাকে, তার বেশি নয়। খুব বেশি না ভেবেই সম্মতি জানিয়েছিলাম। আজো খুব বেশি ভাবনাচিন্তা না করেই বলতে পারি সিদ্ধান্ত আমার ভুল ছিল না। অনেক অভিজ্ঞতায় ঋদ্ধ হয়েছি এই ক’বছরে। প্রফেসর আনিসুজ্জামানের মতো পরম শুভার্থী ও আবুল হাসনাতের মতো অকৃত্রিম সুহৃদজনের বিশেষ সাহচর্য পেয়েছি সেখানে, অন্য আরো অনেক সহকর্মীর উষ্ণ সান্নিধ্যের সঙ্গে। দুর্ভাগ্য আমাদের, এই দুজনকে আমরা হারিয়েছি এ-বছরে, মাত্র মাসকয়েকের ব্যবধানে। দুটি মৃত্যুই যে আমাদের জন্য গভীর শোকাবহ সে-কথা সাড়ম্বরে বলার কোনো প্রয়োজন পড়ে না। কিন্তু মানুষকে তো চলে যেতেই হয় এ-পৃথিবী ছেড়ে কোনো-না-কোনো সময়।

বিগত চার বছরে কালি ও কলমে কাজের সূত্রে বন্ধু হাসনাতের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা ও হৃদ্যতা আরো অনেক বেড়ে গিয়েছিল। সম্পাদক আবুল হাসনাতের পূর্ণতর পরিচয় পেয়েছিলাম তখন। সেটি অনেকেরই জানা। পত্রিকার সম্পাদনা ছাড়াও বেঙ্গল পাবলিকেশন্সের দায়িত্ব ছিল তাঁর হাতে। লক্ষ করলে বুঝতে পারা যাবে, বেঙ্গলের প্রকাশনাগুলির পেছনেও আছে তাঁর সুচারু মনোযোগ, বিস্তর পঠন-পাঠন ও সর্বোপরি পরিচ্ছন্ন রুচিবোধ। আবুল হাসনাত এ-মানসিকতা আজীবন লালন করেছেন কর্মে, কথায় ও জীবনযাপনে। আমার মাঝে মাঝে মনে হয়, সম্পাদক আবুল হাসনাতের আড়ালে যে কবি মাহমুদ আল জামান ও নিপুণ গদ্যশিল্পী আবুল হাসনাত ছিলেন তাঁকে আমরা ঠিক সেভাবে জানতে পারিনি যেভাবে জানলে তাঁর লেখকসত্তার উজ্জ্বলতা আরো অনেক বেশি আমাদের চোখে পড়ত। ব্যক্তি আবুল হাসনাত যেমন ছিলেন আত্মপ্রচারবিমুখ, তেমনি নিজের লেখালেখির প্রচারের ব্যাপারেও তাঁর ছিল অতিরিক্ত কুণ্ঠাবোধ। নিজের জানাশোনা ও পড়াশোনার ব্যাপ্তি নিয়ে কখনো তাঁকে উচ্চকণ্ঠ হতে দেখিনি, যদিও আমাদের চারপাশে নিজের পাণ্ডিত্য ও প্রতিভা জাহির করার লোকের অভাব নেই। আবুল হাসনাতের এই বিনয় ও সৌজন্যবোধের দৃষ্টান্ত খুব বেশি নেই। তাঁর বইটির একেবারে শেষের দিকে তিনি লিখেছেন, ‘মাঝে মাঝে বিষণ্নবোধ করি যখন দেখি কোনো বন্ধু ও আত্মজন অহংকার ও দম্ভে মানুষকে অশ্রদ্ধা করেন। খ্যাতি ও প্রতিষ্ঠা পেয়ে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ আকস্মিকই উবে গেছে তাঁদের মনন ও জীবন থেকে।’ ব্যক্তি হাসনাতকে খুব উজ্জ্বলভাবে বুঝতে পারি তাঁর এ-কথাগুলো থেকে।