হৃদয় গ্যালারির প্রিয় ছবি

জ্যোৎস্না ও দুর্বিপাক কবিতার বইটি ঢাকায় মুক্তধারার বইমেলা থেকে কিনেছিলাম; তখন আমি সদ্য বিশ্ববিদ্যালয়-ভর্তি হওয়া ছাত্র। এই বইয়ের কবি মাহমুদ আল জামানই যে ‘সংবাদ সাময়িকী’র কিংবদন্তি সম্পাদক আবুল হাসনাত, সেটা অবশ্য জানতাম কুমিল্লা থাকতেই। লেখালেখির প্রথম প্রভাতে পরিচয় হওয়া শান্তনু কায়সারের সূত্রে এমন নিগূঢ় অনেক কিছুই জানা হয়েছিল আমার। সংবাদে আবুল হাসনাতের মনোনয়নে কোনো লেখা ছাপা হলে, তবেই সে-লেখক জাতে উঠলেন; এমন কথা আলোচিত হতে শুনেছি ঢের, তবে নিজে যখন লেখা পাঠাব মনস্থির করছি, তখন তিনি সংবাদ ছেড়ে কালি ও কলমে। 

২০০৫ সালের অক্টোবরে কবি মোহাম্মদ রফিককে নিয়ে রুদ্র তোমার দারুণ দীপ্তি শিরোনামে একটি সংকলন সম্পাদনা করার পর কবির কয়েক প্রিয়জনকে ডাকে পাঠাতে থাকি সংকলনটি। আবুল হাসনাতের কালি ও কলম ঠিকানায়ও এক কপি পাঠাই, কারণ মোহাম্মদ রফিকের এক বইয়ে উৎসর্গপত্রে লেখা দেখেছি তাঁর এবং মফিদুল হকের নাম ‘দুইটা শালিখ ভালো’ এমন অপূর্ব বাক্যবিভূতিতে।

আরে, এক দুপুরে জাহাঙ্গীরনগর ক্যাম্পাসে হাঁটছি, হঠাৎ বেজে উঠল ফোন। ধরতেই একটা অচেনা কণ্ঠস্বর, ‘পিয়াস, আমি হাসনাত বলছি। সংকলনটা ভালো হয়েছে। আপনি ও বন্ধুরা লেখা পাঠাবেন কালি ও কলমে।’ বলেই ফোনটা কেটে দিলেন। আমি আমার বিস্ময় বা অভিভূতি প্রকাশের সুযোগ না পেলেও আপ্লুত অনুভব লালন করতে লাগলাম নিজের মধ্যেই। আবুল হাসনাত আমাকে নিজ থেকে ফোন করলেন! মোহাম্মদ রফিকের কাছেও কথাটা পাড়লাম। তাঁর কাছে এন্তার শুনলাম হাসনাত-গল্পগাথা। এর কিছু পরে ঢাকার এক হোটেলে প্রথম আলোর কোনো প্রীতি সম্মেলন থেকে বেরুবার পথে মোহাম্মদ রফিকের গাড়িতে আমিও ছিলাম সঙ্গে। আমরা সাভার ফিরব, ধানমন্ডি যাবেন বলে লিফট নিয়েছিলেন আবুল হাসনাত। তাঁরা দুজনায় এমন ষাটের দশকীয় আলাপ শুরু করলেন যে, আমি বলতে সাহসই পেলাম না ‘হাসনাতভাই, আমি সেই পিয়াস; যাকে আপনি ফোন দিয়েছিলেন।’ তবে আলাপ শুরু না করতে পারলেও কবিতা পাঠাতে লাগলাম কালি ও কলমে। ছাপা হয় না হয় না করে দেখা গেল ফেব্রুয়ারির এক প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী সংখ্যায় সর্বশেষ কবিতাটি আমার ‘সন্ত ও শয়তান’। আমার আনন্দ দেখে কে! কত রাত যে ছাপা পত্রিকাটি বুকে নিয়ে ঘুমিয়েছি, আবুল হাসনাত-সম্পাদিত পত্রিকায় আমিও লিখেছি তবে!

এরও বছর বেশ কয় পরে কবি আলতাফ হোসেনের সঙ্গে গিয়েছিলাম কালি ও কলমের কাওলার অফিসে। চিত্রশোভিত বিশাল অফিসে আলতাফভাই তাঁর লেখার বিল তুলতে গেলেন। হাসনাতভাইয়ের সঙ্গে দেখা হলে তাঁর  অল্পালাপ যে আহত করেনি তা নয়,  তবে সে-অফিসের আশফাক খানের আন্তরিক আপ্যায়নে ভুলে গিয়েছি সে হাসনাত সংযোগ-ব্যর্থতার বেদনা। ফিরতে ফিরতে আলতাফভাই বললেন, এটা আবুল হাসনাতের ধরন। কম কথা, কাজ বেশি। বুঝলাম, মানুষটা গড়পড়তা আমাদের মতো না।

এরপর আর তাঁর সঙ্গে প্রত্যক্ষ  সেতুশীল হওয়ার চেষ্টা করিনি। লেখা পাঠিয়েছি, ছাপা হয়েছে। পড়েছি তাঁর মৌলিক ও সম্পাদিত বইপত্র ইস্টিমার সিটি দিয়ে যায়, যুদ্ধদিনের ধূসর দুপুর, চার্লি চ্যাপলিন, নারীর কথা, হৃদয়ে আমার প্যালেস্টাইন। মুগ্ধ হয়েছি তাঁর ভাষার লাবণ্যে, বিষয়ের বৈচিত্র্যে, রুচির বৈদগ্ধ্যে। তবে তাঁর বেশিরভাগ বই-ই ‘আউট অব প্রিন্ট’ দেখে দুঃখ পেয়েছি।

বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বেরিয়ে কিছুকাল ‘শুদ্ধস্বর’ প্রকাশনীর সঙ্গে যুক্ত থাকার সুবাদে এক দুপুরে ভয়ে ভয়ে ফোন দিলাম আবুল হাসনাতকে। চার্লি চ্যাপলিন বইটি নবপ্রকাশের প্রস্তাব দিতেই রাজি হলেন তবে খুশি হলেন কি না বোঝা গেল না কারণ তাঁর উষ্মা অনুধাবন সহজ হলেও উচ্ছ্বাস উপলব্ধি করা যে-সে কাজ নয়।

তো, বইমেলায় সুমুদ্রিত হলো চার্লি চ্যাপলিন। ভালো নিশ্চয়ই লেগেছিল হাসনাতভাইয়ের, নয়তো কেন জসীমউদ্দীনসূর্য সেন নামের দুটো পুরনো বই পুনর্মুদ্রণের জন্য পাঠাবেন! সেগুলো বের হওয়ার পর ‘শুদ্ধস্বরে’র প্রকাশক আহমেদুর রশীদ চৌধুরী টুটুল ভাইকে বললাম, ‘হাসনাতভাইকে কী বলব তাঁর চিত্র-সমালোচনাগুলোর একটি সংকলন করে দিতে? তিনি সানন্দে সম্মতি দিলেন। বেরুল বই জয়নুল কামরুল সফিউদ্দীন ও অন্যান্য, ভূমিকায় আমার প্রতি ধন্যবাদজ্ঞাপক শব্দ দেখে প্রীত হলাম খুব। এরপর শুদ্ধস্বর থেকে তাঁর কিশোরসমগ্র এবং তৃতীয় কবিতার বই ভুবনডাঙার মেঘ ও নধর কালো বেড়াল বইদ্বয় প্রকাশ পেল। বইগুলোর সঙ্গে কাজ করার সূত্রে যেন মানুষটার সঙ্গে কাম্য আড্ডা দেওয়া হয়ে যেত আমার। ভাবনার এত অতলতা, প্রকাশের এত গভীরতা! আগে তো তেমনটা জানতাম না।

২০১১-তে আমি বাংলা একাডেমিতে যোগ দিলে তাঁর সঙ্গে সম্পর্কটা অন্য মাত্রা লাভ করে। একুশের কোনো সেমিনারে প্রবন্ধ পাঠাতে হলে বা কোনো তথ্য জানতে হলে আমাকেই মাধ্যম করে নিতেন। আমিও যত ব্যস্ত বা ঝামেলায় থাকি না কেন, আবুল হাসনাতকে ‘না’ বলার সাহস করিনি কখনো। এর মাঝে কদাচিৎ ফোন করে লেখাও চাইতেন তবে আবুল হাসনাত তো সেই সম্পাদক যিনি না চাইলেও ছেলেবুড়ো যে-কোনো বয়সের লেখকেরই যেচে তাঁর কাগজে লেখা পাঠাতে কারোরই কোনো ‘ইগো’ কাজ করত না।

২০১২ সালে প্রকাশিত আমার প্রবন্ধবই করুণ মাল্যবান অন্যান্য প্রবন্ধ এইচএসবিসি-কালি ও কলম পুরস্কার পাওয়ার খবরটি আমাকে দিয়েছিলেন স্বয়ং আবুল হাসনাত। জীবনের প্রথম পুরস্কার প্রাপ্তির খবর যাঁর কাছ থেকে পাওয়া, তাঁকে কি কখনো যাবে ভোলা?

পুরস্কার অনুষ্ঠানের দিন আমি যথাসময়েই যাচ্ছিলাম তবে যাওয়ার পথে তাঁর বারংবার ফোনে ‘আসবেন কিন্তু, মিস করবেন না’ শুনে যে-কোনো অনুষ্ঠান সুসম্পন্নের ক্ষেত্রে তাঁর উদ্বেগাকুল অন্তরাবস্থা টের পেয়েছি।

আমাদের তরুণ কবি-লেখকদের বিশেষ আকর্ষণ ছিল কালি ও কলমের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী সংখ্যা। দেশসেরা চিত্রকরদের পৃষ্ঠাসজ্জায় যে বিপুলায়তন সংখ্যা ফি ফেব্রুয়ারিতে প্রকাশ পেত তার কোনো একটিতে লেখা দিলেও না-ছাপা হওয়ায় দুঃখ পেয়ে জানিয়েছিলাম তাঁকে। ফোনটা দিয়েই সংকোচে মরে গেছি কারণ তিনি ক্ষুব্ধ না হয়ে দুঃখ প্রকাশ করেছিলেন।  হাসনাতভাইকে দুঃখিত করার বেদনা বহন করা কষ্টকর খুব কারণ বাইরে মানুষটি যত পাথরবৎ হোন, ভেতরে তো ছিল প্রাণের শতজল ফোয়ারা।

এরই মাঝে ‘বেঙ্গল পাবলিকেশন্স’ যখন শুরু করেন তখন আমার মতো প্রকাশনা-অপটু তরুণকে ‘বিশেষজ্ঞ’ ঠাউরে পরামর্শ নিয়ে সম্মানিত করেছেন। আজ সবাই তাঁর সম্পাদনা-কীর্তির প্রশংসা করছেন তবে আমি মনে করি নির্বাহী পরিচালক হিসেবে বেঙ্গল পাবলিকেশনকে যেভাবে তিনি গড়ে তুলেছেন, শ্রীময় করেছেন, তা সত্যি তুলনারহিত। বইমেলায় প্রায় প্রতিবছর ‘বেঙ্গল’ সেরা প্রকাশকের পুরস্কার পেত। যখন একটু আগেভাগে তাঁকে খবরটা জানাতাম, তিনি তাঁর স্বভাবী গাম্ভীর্যের আবরণ খুলে আনন্দের প্রকাশ ঘটাতেন। মনে হয়, নিজে কোনো পুরস্কার পেলেও এত আনন্দিত হতেন না। কাজের জায়গাটাকে এভাবেই ধারণ করতেন তিনি।

লেখালেখিতে সক্রিয় হয়েছি, ভেতরে ভেতরে বাসনা ছিল হাসনাতভাইয়ের কাছ থেকে শুনি কিছু হচ্ছে কি না আমার! সরাসরি এমন কিছু বলা তো তাঁর ধাতে নেই। কিন্তু যখন, ঢাকা বা কলকাতার বিশিষ্ট কেউ কেউ বলতেন, ‘আপনার কবিতার কথা আবুল হাসনাতের কাছে শুনেছি’ বা যখন নিজের নতুন কোনো বই বেরুলে আমাকে পাঠাতেন আলোচনার জন্য; তখন ভালো লাগত খুব। সম্ভবত তাঁর প্রত্যয়ী স্মৃতি ও অন্যান্য, হারানো সিঁড়ির চাবির খোঁজে এবং সম্পাদিত নভেরা আহমেদ বইয়ের প্রথম লিখিত আলোচক আমিই, প্রথম আলোতে লেখাগুলো প্রকাশের পর তাঁর সানন্দ অথচ সংকোচে ভরা ফোন পেয়েছি, ‘এত ভালো বলেছেন। মানুষ আবার মন্দ বলবে না তো?

আহা, হাসনাতভাই। অর্ধশতাব্দী লেখালেখি করেও কী বিনয় ও আত্মসমালোচনা। এখন তো সবাই নিজের লেখার শ্রেষ্ঠত্বের ব্যাপারে ‘ওভার কনভিন্সড’, আবুল হাসনাত এক্ষেত্রেও বিরল ব্যতিক্রম।

কালি ও কলমের নানা অনুষ্ঠানে  সর্বকনিষ্ঠ কবি হিসেবে কবিতা পড়তে ডেকেছেন, বেঙ্গল পাবলিকেশন্স থেকে আমার মৌলিক বই এক পৃথিবী বইয়ের বাড়ি আর সম্পাদিত বই সৈয়দ শামসুল হক-অনূদিত আফ্রিকান অন্যান্য অনুবাদ কবিতা সগুরুত্বে প্রকাশ করেছেন, এই তো ২০১৯ সালের বইমেলায় বেঙ্গল বই চালু হলে হাসান হাফিজুর রহমানের একুশে ফেব্রুয়ারি সংকলন নিয়ে বিশেষ আলোচনা-চক্রে আনিসুজ্জামান ও শামসুজ্জামান খানের সঙ্গে এক মঞ্চে আলোচক হিসেবে আমাকে নির্বাচন করে হাসনাতভাই ও লুভা নাহিদ চৌধুরী আপা যে-সম্মান আমাকে দিয়েছেন তা কখনো ভুলে যাওয়ার নয়। তারুণ্যের প্রতি তাঁদের এই পক্ষপাত ছিল বিশেষ মুগ্ধকর।  সিলেটে বেঙ্গলের সাহিত্য উৎসবে গিয়েছি। সেখানের রাত্রিকালীন আড্ডায় তারিক সুজাত, মারুফুল ইসলাম, প্রশান্ত মৃধা এবং আমার সঙ্গে এক টেবিলের উষ্ণতায় মেতে উঠেছিলেন হাসনাতভাইও। সদ্য জার্নিম্যান থেকে তাঁর নির্বাচিত কবিতা বেরিয়েছে। সে-আনন্দের উদ্বেলতা মুহূর্তে উবে গেল যখন প্রশান্তদা তাঁর লেখালেখি-জীবনে হাসনাতভাইয়ের অবদানের কথা ধারাস্রোতের মতো বলছিলেন। নিজের প্রশংসা শুনতে কাতর সমাজে এমনটা খুব স্বাভাবিক দৃশ্য নয় মোটেও।

আমার সম্পাদিত সৈয়দ শামসুল হক বা সনজীদা খাতুন-সংক্রান্ত সংকলনের জন্য তাঁর লেখা নিয়ে যখন শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত ফোন পেতাম সংশোধনীসূচক; তখন বুঝতাম তৃপ্তি খুব সহজ নয় তাঁর কাছে। অবিরাম কাটাকুটিতেই তাঁর পরিতৃপ্তি; যেমন নিজের লেখার ক্ষেত্রে, তেমনি পত্রিকা সম্পাদনার ক্ষেত্রেও।

নতুন কোনো বইয়ের খোঁজ দিয়ে তাঁকে যতটা আনন্দ দেওয়া যেত, সেটা আর কোনো কিছুতেই দেওয়া সম্ভব হতো বলে মনে করি না আমি। কলকাতা গেলে তাঁর ফোন-অনুযায়ী পার্থশঙ্কর বসু দাদার  ‘নয়া উদ্যোগ’ থেকে তাঁর ফরমাশের বই আনা তো হতোই,  নিজে কোনো বই এনে উপহার দিলে দেখতাম, ওটা আগেই সংগ্রহ করে ফেলেছেন তিনি। নবনীতা দেবসেনের মৃত্যুর কালে আমি কলকাতায় ছিলাম, তাঁর একটি কবিতার বই উপহার দিয়েই বোধ করি হাসনাতভাইকে তৃপ্ত করতে পেরেছিলাম। শামসুর রাহমান রচনাবলি সম্পাদনার সময় ভূমিকা লেখার জন্য আমার রাহমান-সংগ্রহ তাঁর কিছুটা কাজে লেগেছে; এই তথ্য জানিয়ে তিনি আমাকে বিস্মিত করেছেন।

আমার মতো এক এলেবেলে তরুণকে অনেক সম্মান দিয়েছেন তিনি। তাঁর সম্পাদিত মুক্তিযুদ্ধের কবিতার নতুন সংস্করণে সম্পাদনা পরিষদে তারিক সুজাত ভাই ও আমাকে যুক্ত করার বাসনা প্রকাশ করে গেছেন তারিকভাইয়ের কাছে। শুধু তাই নয়, কলকাতা থেকে রুদ্র মুহাম্মদ শহীদুল্লাহর শ্রেষ্ঠ কবিতা প্রকাশের জন্য আবুল হাসনাত ও আমাকে সম্পাদক হিসেবে নির্বাচনে কোনো এক প্রকাশকের আগ্রহের কথা জানিয়েছেন তিনি, যদিও শেষ পর্যন্ত কাজটা হয়নি। আর চিরদিনের মতো অসমাপ্ত থেকে গেল তাঁর সঙ্গে সৈয়দ শামসুল হক রচনাবলি সম্পাদনার প্রতিশ্রুত কাজটি।

হাসনাতভাইয়ের গহন বেদনাহত রূপও আমি চাক্ষুষ করেছি। হারানো সিঁড়ির চাবির খোঁজের পাণ্ডুলিপি পড়ে দেখার জন্য এক ঈদের ছুটিতে তাঁর ক্ষণকালীন অফিস ধানমন্ডির ‘মেগা ডোরি’তে ডেকেছেন। সেদিন কফির কাপে ধোঁয়া উড়ছিল, বারান্দায় গাছের পাতা নড়ছিল, প্রিয় সব শিল্পীর চিত্রকাজ মনোলোভা ছড়াচ্ছিল আর আবুল হাসনাত বলছিলেন, শামসুর রাহমান একটি শিশুসাহিত্য পুরস্কারের জন্য তাঁর নামে কয়েকবার মনোনয়ন পাঠালেও তাঁরই বন্ধুবান্ধবের অনাগ্রহের কারণে সেটি না পাওয়ার কথা। অপ্রাপ্তির বেদনা তিনি অনেক সয়েছেন, সেটা তাঁকে দুঃখ দিত না আর, দুঃখ দিত মানুষের বিরূপতা যদিও প্রিয় কবি সুধীন দত্তের মতোই মানতেন ‘বিরূপ বিশ্বে মানুষ নিয়ত একাকী’ কিংবা ‘নাস্তির নেমির মধ্যে জীবন।’

হাসনাতভাইকে মুষড়ে পড়তে দেখেছি সৈয়দ হক, শহীদ কাদরী আর রবিউল হুসাইনের প্রয়াণে।

হকভাইয়ের চলে যাওয়ার রাতে ভেঙে পড়া আমি ততোধিক ভেঙে পড়া হাসনাতভাইয়ের গাড়িতে ঘরে ফিরি। ফিরতে ফিরতে গল্প হলো কত কী, হৃৎকলমের টানে, বৃষ্টি ও বিদ্রোহীগণ, আমার শহর, নদী কারো নয়, জলেশ্বরীর দিনপত্রী ছাপাছাপির কারিগর আবুল হাসনাতের চোখে আমি জল দেখেছি সেদিন। শহীদ কাদরীর প্রয়াণের পর নীরা কাদরী আপাকে ঘিরে হাসনাতভাই ও মিনু আপা তাঁদের বাড়িতে যে ঘরোয়া আড্ডার আয়োজন করেন, সেখানে আমিও নিমন্ত্রিত ছিলাম। বুঝেছি সেদিন কবি কাদরীর জন্য কবি মাহমুদ আল জামানের কাতরতা। আর গত নভেম্বরে রবিউলভাইয়ের মৃতদেহ ঘিরে হাসপাতালে সমবেত মানুষের এককোণে হঠাৎ হাসনাতভাইয়ের করস্পর্শ ভুলি কেমনে! বললেন অতীব মৃদুস্বরে, ‘এরা অধিকাংশই রবিউলের বিপদে পাশে ছিল না পিয়াস।’

দুই

এই করোনা মহামারির কালে হাসনাতভাইয়ের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল ফোনেই। নৃত্য-মহীয়সী অমলাশঙ্করের মৃত্যুর খবরটা আমার কাছ থেকে পেয়ে হোয়াটসঅ্যাপ-কলে কত কথা যে বললেন উদয় আর অমলাকে ঘিরে! অনুরোধ জানিয়েছিলেন বাংলা একাডেমি গ্রন্থাগার থেকে উদয়শঙ্করের মৃত্যুর পর প্রকাশিত তাঁর লেখাটা জোগাড় করে দিতে, যেমন করে দিয়েছিলাম ষাটের দশকে রক্তকরবী মঞ্চায়নের পত্রিকা সংবাদ বা জাহিদুর রহীমকে নিয়ে তাঁর লেখা।

করোনার কালেই তাঁর প্রিয় বন্ধু, আমার শ্রদ্ধেয় মতিউর রহমানের আবাসে স্বাস্থ্য-সতর্কতা মেনে কয়েকবার আড্ডা হয়েছে আমাদের। মতিভাইয়ের উপস্থিতিতে আবিষ্কার করেছি অন্য এক আবুল হাসনাতকে। ‘মতি, তুই ওই বইটা কবে দিবি আমাকে’ বা ‘তোর মনে আছে হাসনাত, নেরুদার ওই কবিতা বা কাইয়ুমভাইয়ের ওই ছবিটার কথা? এ-জাতীয় বাক্যাবলির বিনিময়ে বুঝতাম কী অসামান্য বিদ্যাব্রতী বন্ধুত্ব ছিল এই দুজনার!

আবুল হাসনাতের সঙ্গে আমার শেষ দেখা বাংলা একাডেমির পুকুরপাড়ে। একাডেমির একটি সংকলন সম্পাদনার সভায় এসেছিলেন। একটু আগেভাগেই চলে এসেছিলেন।  আমাকে গাড়িতে বসেই ডাকলেন ফোনে, কথা বলার জন্য। তার একটু বাদে একাডেমির পরিচালক মোবারক হোসেন এলে তাঁর সঙ্গে উঠলেন সভাস্থলে।

এর দিন কয় পর এক দুপুরে ফোন। বাংলা একাডেমি প্রেসে কাজ করছিলাম। নেটওয়ার্ক সমস্যায় ধরতে পারিনি। পরে কলব্যাক করায় বললেন, ‘এমনিতেই ফোন করেছিলাম। সব ঠিকঠাক তো?

তারপর এক সন্ধ্যায় বেঙ্গল বইয়ের ফারুকী ভাইয়ের কাছে শুনলাম তাঁর অসুস্থতা ও হাসপাতালে ভর্তির সংবাদ। মিনু আপার ফোনে জানতাম সর্বশেষ অবস্থা আর প্রায় প্রতি সকালে কলকাতা থেকে ফেসবুক মেসেঞ্জারে চিন্ময় গুহের বার্তা ‘পিয়াস, ওঁকে দেখে রাখবেন। অমন মানুষ  আর হবে না।’ হাসনাতভাই, ওইদিন একটু আগেভাগে সভায় চলে আসার মতো এমন আগেভাগে, আমাদের সবাইকে নিরাময়হীন রোদনে ফেলে আপনি কীভাবে ভাবেন আমরা ‘ঠিকঠাক’ থাকব?