মুখোমুখি (মার্টিন কেম্পশেনের সাক্ষাৎকার)

সাক্ষাৎকার : জয়কৃষ্ণ কয়াল

জয়কৃষ্ণ : নমস্কার মার্টিনদা। আশা করি ভালো আছেন। সবকিছু চলছে ঠিকঠাক।
মার্টিন : হ্যাঁ, জয়কৃষ্ণ। ভালো আছি। তুমি কেমন আছো বলো, বাড়ির সবাই?
জয়কৃষ্ণ : ভালো আছি মার্টিনদা। বাড়ির সবাইও ঠিক আছে। আপনাকে আগে জানিয়েছি, কালি ও কলমের পক্ষ থেকে কিছু প্রশ্ন নিয়ে কিছুক্ষণ বসতে চাই দুজনে। আপনার সময় হবে তো?
মার্টিন : তুমি বলেছ, সময় তো করতে হবে। বলো কী জানতে চাও?
জয়কৃষ্ণ : আজকাল লক্ষ করছি মার্টিনদা, আপনার লেখা পড়ে পাঠকরা আপনার ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে উৎসুক হয়ে উঠছে।
মার্টিন : তাই নাকি (হাসি), কী রকম!
জয়কৃষ্ণ : এই যেমন আপনি দেশ ছেড়ে এতদিন পড়ে আছেন এদেশে। তা সত্ত্বেও এখানে আপনার কোনো নাগরিক অধিকার নেই। রাষ্ট্রহীন দেশের মুক্তমনা মানুষ আপনি। এ-ব্যাপারে আপনার কোনো কোনো লেখায় একটা আবছা আক্ষেপ সাড়া দেয়। আপনার প্রকৃত অবস্থাটা জানতে চায় মানুষ।
মার্টিন : ভারতে আমার স্বাভাবিক নাগরিক অধিকার না থাকাটা নিঃসন্দেহে একটা কষ্টকর অভিজ্ঞতা। আমি এখানে ঘরবাড়ি বা জমি-জায়গা রাখতে পারি না। কোনো দায়িত্বপূর্ণ সরকারি পদে বা শাসনের নীতিনির্ধারণের ব্যাপারে কোনো ভূমিকা নিতে পারি না। শামিত্মনিকেতনের বিশ্বভারতীতে আমাকে শিক্ষকতার অনুমতি দেওয়া হয়নি। এরকম কত ঘটনা। তবে ব্যাপারটা সম্পর্কে আমি সচেতন। নিজেকে সবসময় মনে করিয়ে দিই যে, এই সীমাবদ্ধতা আমি স্বেচ্ছায় মেনে নিয়েছি। আগে হলে জার্মানি বা ইউরোপের অন্য কোনো দেশে থাকার সিদ্ধান্ত নিতে পারতাম। তবে দেশ ছেড়ে এত দূরে থাকার জন্যে আমাকে যেমন কিছু ছাড়তে হয়েছে, এদেশে থাকার সুবাদে তেমনি আমি পেয়েছিও অনেক কিছু।
আমার লেখালেখি বা গ্রামের গরিব মানুষের কাজে লাগা, মানে আমি যে কাজটা পারি, ভারতে তা করতে পারছি। আমার লেখার বিষয়বস্ত্ত খুঁজে পাই এখানে – এদেশের ধর্ম, সংস্কৃতি এবং এই দেশ-সীমানার মধ্যে যেসব মানুষজন আছে, তাদের কাছ থকে। কাজটা আমার মনের মতো। ভারতবর্ষ আর তার মানুষজন, তার ধর্ম, তার সাংস্কৃতিক আর শৈল্পিক ভাবাবেগ – এসব বোঝার চেষ্টার যেন শেষ নেই। বরিষ্ঠ-কনিষ্ঠ অনেক মানুষকে আমি পেয়েছি এখানে। তাঁরা আমাকে অনুপ্রাণিত করেছেন, আশা করি ভবিষ্যতেও করবেন। এতদিন যে এখানে আছি কিসের টানে, তা খুব কম লোক বোঝে। নিজের দিকে তাকালে কিন্তু সেই রহস্যটা আমি প্রতিনিয়ত উপলব্ধি করতে পারি।
জয়কৃষ্ণ : ধর্মীয় না সাংস্কৃতিক ভাবধারা, এদেশের কোন ব্যাপারটা আপনাকে বেশি আকৃষ্ট করে?
মার্টিন : ধর্ম বলতে যদি এদেশের হিন্দুধর্মের কথা বলা হয়, তাহলে বলব, ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক ভাবধারার মধ্যে পার্থক্য খুব সামান্য। ধর্মীয় তথা আধ্যাত্মিক ভাবধারায় হিন্দু-সংস্কৃতি গভীরভাবে সমৃদ্ধ। ভারতীয় সংস্কৃতি আর ধর্মের ভাগাভাগিটা আমরা বলতে পারি হাল আমলের ব্যাপার, এই ধরো গত একশ বছর বা তারও কিছু কম সময়ের। পাশ্চাত্য আধুনিকতার হাত ধরে তা ভারতে এসেছে। তাতে ধর্ম আর সংস্কৃতি আলাদা হয়ে গেছে। তবে ইউরোপীয় বা মার্কিন আদর্শে উদ্বুদ্ধ এই আধুনিকতার প্রভাব কেবল সমাজের ওপরের স্তরে। বিজ্ঞান আর যুক্তিনির্ভর পাশ্চাত্য শিক্ষার সুফল এই বর্গের মানুষজনই পেয়েছে।
জয়কৃষ্ণ : রামকৃষ্ণ মিশনের সঙ্গে আপনার ঘনিষ্ঠতা দীর্ঘদিনের। কথামৃত অনুবাদ করেছেন। বিবেকানন্দকে নিয়ে লেখালেখি করছেন। তাঁর সমসাময়িক আর কোন ভারতীয় ব্যক্তিত্ব আপনাকে টানে?
মার্টিন : অবশ্যই রবীন্দ্রনাথের কথা বলতে হবে। শ্রীরামকৃষ্ণ ও বিবেকানন্দের ব্যক্তিত্ব এবং কীর্তি আমাকে দীর্ঘকাল
আচ্ছন্ন করে রেখেছিল। কিন্তু পাশাপাশি গত তিরিশ বছর, যে-সময়টায় আমি রবীন্দ্রনাথ পড়েছি বা তাঁর রচনা অনুবাদ করেছি, তাঁর কীর্তি আর বিশ্ববীক্ষার ব্যাপারে আমার আগ্রহ একটুও সিত্মমিত হয়নি। আমার মতে, তিনি শ্রীরামকৃষ্ণ আর স্বামী বিবেকানন্দের মূল্যবোধ বিস্ময়করভাবে মিলিয়ে দিয়েছেন, এমনকি তা ছাড়িয়েও গিয়েছেন।
আমাদের স্বকালের আরো যেসব ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব আমার মন টেনেছেন তাঁরা হলেন শ্রী অরবিন্দ (১৮৭২-১৯৫০) আর বিশেষ করে রামানা মহর্ষি (১৮৭৯-১৯৫০) ও জিড্ডু কৃষ্ণমূর্তি (১৮৯৫-১৯৮৬)। শ্রী অরবিন্দ তাঁর আধ্যাত্মিক অনুশীলনে একান্তই একনিষ্ঠ আর সৎ। তবু যেন বড় বেশি ভাষ্যমুখর, এমনকি আমার রুচির পক্ষে বাগবহুল। সেই অর্থে, তিনি ইংরেজিটা বড্ড বেশি জানতেন। উলটোদিকে জিড্ডু কৃষ্ণমূর্তি বক্তব্যে মিতবাক আর পুরোপুরি নির্দিষ্ট বিষয়ে কেন্দ্রীভূত। তিনি ছকভাঙা মানুষ, তাই তাঁর বক্তব্য ওজস্বিনী। তাঁর অন্তর্দৃষ্টি বিস্ময়কর আর উদ্ভাবনী প্রকৃতির। তা ভাবতে প্রলুব্ধ করে। একই কথা রামানা মহর্ষি সম্পর্কে। তিনি নিজে কিছু লেখেননি বা কোনো ভাষণ দেননি। কি তাঁর কথালাপ যা লিপিবদ্ধ হয়ে অনূদিত হয়েছে, তা আমাদের চৈতন্যের অমত্মঃমূলে গিয়ে ধাক্কা দেয়। তা মানুষের চিরাচরিত অসিত্মত্বের ব্যাপারে প্রশ্ন তোলে। মানুষকে তার অসিত্মত্বের নগ্নতার মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয়। মানুষের আত্মা আর অদৃশ্য ঈশ্বর পরস্পরের সঙ্গে সংযোগ তৈরি করে নেয়।
এছাড়াও আছেন অসংখ্য লেখক। বছরের পর বছর তাঁরা আমাকে মুগ্ধ করে রেখেছেন। যেমন প্রথমেই বলব সালমান রুশদির (Salman Rushdie) কথা। তাঁর উদ্ভাবনীশক্তি মাথা ঘুরিয়ে দেয়। তাঁর অধিকাংশ উপন্যাস আমাকে পড়তে হয়েছে প্রায় দম বন্ধ করে। এই সঙ্গে যোগ করব অমিতাভ ঘোষকে। তাঁর উপন্যাসে চমকের অভাব আছে। তা সত্ত্বেও সেগুলো কল্পনার নির্মাণ, সৃজনাত্মক উদ্দীপনা আর প্রাণের দীপ্তি দিয়ে রচনা। বিশেষভাবে আমাকে নাড়া দিয়েছে দ্য হাংগরি টাইড (The Hungry Tide) আর ইন অ্যান অ্যান্টিক ল্যান্ড (In an Antique Land)। আরো বলব বিক্রম শেঠের (Vikram Seth) নাম। যাঁরা ভারতের প্রাদেশিক ভাষায় লেখালেখি করেন তাঁদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি প্রশংসনীয় মনে হয়েছে ভীষ্ম সাহনি (Bhisham Sahni), মহাশ্বেতা দেবী, ও.ভি. বিজয়ন (O. V. Vijayan) আর পল জাখারিয়া (Paul Zacharia)। জার্মান ভাষায় আমাকে আধুনিক ভারতীয় সাহিত্যের ইতিহাস সংকলন করতে হয়েছে (Indische Literatur der Gegenwart, 2006)। সেজন্যে ইংরেজি বা জার্মান তর্জমায় আমাকে বিস্তর ভারতীয় সাহিত্য পড়াশোনা করতে হয়েছে।
জয়কৃষ্ণ : আপনার ছোটবেলাটা কেটেছে জার্মানির মফস্বল শহরে। এখন কাটছে বীরভূমের গ্রামের পিছিয়েপড়া মানুষজনের নিবিড় সান্নিধ্যে। গ্রামের অদৃশ্য মায়াজালে আপনি যেন আটকে গেছেন। এই ব্যাপারটার কী ব্যাখ্যা দেবেন?
মার্টিন : দেখো, আটকে আমি যাইনি। গ্রামের ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্যে থাকার সিদ্ধান্ত আমি সচেতনভাবেই নিয়েছি। শহরে আমি থেকেছি। থেকেছি ভিয়েনায়, প্যারিসে। পরে মাদ্রাজ (চেন্নাই) আর কলকাতায়। শহর ভালো লেগেছে তার বহুমুখী আর বিচিত্র সাংস্কৃতিক জীবনের জন্যে। ভিয়েনায় ছিলাম খুব কম বয়সে। তখন যাত্রা, নাটক ও গানের আসরে যেতে ভালো লাগত। শিল্প-প্রদর্শনীতে গেছি, গেছি সাহিত্য-আসরে, বক্তৃতাসভায়। এভাবে আমার একটা রুচি গড়ে উঠেছে। শিখেছি কোন শিল্পটা ভালো, কোনটা মধ্যমেধার। তাতে অনুপ্রেরণা পেয়েছি, আমার আবেগ আর মননের জীবন যথেষ্ট সমৃদ্ধ হয়েছে। সৃজনধর্মী লেখক হওয়ার ইচ্ছের ভিতটা আমার তৈরি করেছে ভিয়েনার সাংস্কৃতিক আবহ।
প্যারিসেও তাই। সময় কাটিয়েছি জাদুঘরে ঘুরে, বিভিন্ন প্রদর্শনী দেখে, পুরনো গির্জাগুলোয় বেড়িয়ে আর সিনেমা দেখে। প্যারিসের রাসত্মাগুলো ধরে মাইলের পর মাইল হেঁটেছি এই বিশেষ শহরটার নাড়ির স্পন্দন বোঝার জন্যে। মাদ্রাজে আর কলকাতায় ছিলাম পড়াশোনার জন্যে। ভিয়েনা আর প্যারিস যেভাবে আমার কাছে মন খুলেছে, ভারতের এই শহর দুটোয় কিন্তু তা হয়নি। তা কি জনাকীর্ণ বলে, ভিড় উপচানো বাস আর দূষণের জন্যে? যাই হোক, এ-দুটো শহরেও আমার সাংস্কৃতিক লাভ হয়েছে। তা সত্ত্বে মাদ্রাজে এম.এ. শেষ করার পর ঠিক করলাম কোনো গ্রামীণ পরিম-লে থাকব। স্বাভাবিকভাবেই বেছে নিলাম শামিত্মনিকেতন। দ্বিতীয়বার
পিএইচ.ডি করার জন্যে যখন বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দিলাম, শামিত্মনিকেতন তখন গ্রাম। বিশ্ববিদ্যালয়ের চত্বর ছাড়ালেই সরাসরি মাঠ আর গ্রাম। সন্ধের দিকে সাইকেল নিয়ে বেরোতাম আর কয়েক মিনিটের মধ্যে গিয়ে পড়তাম চাষি ও ক্ষেতমজুরদের মধ্যে।
ভারতের গ্রামজীবনের ব্যাপারে আমার আকর্ষণের কারণ তার অনাবিল সরলতা। আধ্যাত্মিকতার লক্ষণও তাই। সে-কারণেই বলতে পারো গ্রাম আমাকে টানে। জার্মান ভাষার শিক্ষক হিসেবে কলকাতায় থাকার সময়েই আমার দক্ষিণবঙ্গের গ্রামজীবনের অভিজ্ঞতা হয়েছে। সে তো তুমি জানো। তোমার সঙ্গে তোমাদের গ্রাম খেজুরতলায় গেছি সেই ১৯৭৩ সালে। কয়েক দফায় যে কদিন কাটিয়েছি তাতে তখন রীতিমতো উত্তেজনা বোধ করেছি। সেই প্রথম আমি উপলব্ধি করলাম প্রকৃতির কোলে মানুষ কীভাবে থাকতে পারে। কল বা যন্ত্রপাতির মতো বাহ্যিক উপকরণের সাহায্য না নিয়ে মানুষ তাদের আরাম বা মানসিক ও আত্মিক পরিতৃপ্তির জন্যে
প্রকৃতিকে কীভাবে কাজে লাগায়। মানুষ ও প্রকৃতির পরস্পর নির্ভরতার ব্যাপারে আরো অনেক কিছু জানতে পারলাম শমিত্মনিকেতনে এসে। শামিত্মনিকেতনের বাইরে সাঁওতালদের সঙ্গে থাকার সময় গ্রামজীবন সম্পর্কে নিজে যা উপলব্ধি করেছি, রবীন্দ্রনাথও তাঁর কবিতায় সেই কথা বলেছেন।
জয়কৃষ্ণ : বাঙালি সমাজ আর বাংলা ভাষা সম্পর্কে আপনার অভিজ্ঞতার কথা যদি কিছু বলেন, মার্টিনদা।
মার্টিন : চল্লিশ বছরের বেশি হয়ে গেল আমি পশ্চিমবঙ্গে আছি। ভারতবর্ষ সম্পর্কে আমার যা কিছু অভিজ্ঞতা, তা গড়ে উঠেছে এই পশ্চিমবঙ্গে। এর বাইরে থেকেছি মোটে পাঁচ বছর। তিন বছর মাদ্রাজে, ওখানের বিশ্ববিদ্যালয়ে দর্শনে এম.এ. করার সময়। আর দু-বছরের মতো থেকেছি সিমলায়, ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব অ্যাডভান্সড স্টাডির (Indian Institute of Advanced Study) সদস্য হিসেবে। ভারতের অনেক জায়গায় ঘুরেছি, কিন্তু ভারতবর্ষ সম্পর্কে আমার অভিজ্ঞতা মুখ্যত এখানে। তাছাড়া বাংলা ভাষাটা জানি বলে এখানের লোকের সঙ্গে সরাসরি কথাবার্তা বলতে পারি।
শুরু থেকেই আমাকে আকর্ষণ করেছে বাঙালির টগবগে আর সৃজনশীল মন। আকর্ষণ করেছে তাদের সহজাত বুদ্ধি আর অসংখ্য সমস্যা সত্ত্বেও তাদের বেঁচে থাকার মুন্শিয়ানা। জীবনের বাস্তবতার ক্ষেত্রে তাদের উদ্ভাবনী প্রতিভা সত্যিই বিস্ময়কর। অবশ্য অনেক সময় তা নিয়ম ভাঙা কিংবা কোনো প্রথা বা আইনের নিজের সুবিধামতো ব্যাখ্যা হয়ে দাঁড়ায়। দেখে অবাক হয়ে যাই (আর সেজন্যে খুব কষ্টও পাই) যে, সমাজের সর্বস্তরে কীভাবে সততা আর শৃঙ্খলা দুমড়ে-মুচড়ে নিজের সুযোগমতো কাজে লাগানো হচ্ছে, কীভাবে সর্বাধিক সুবিধা উসুল করা হচ্ছে। এবং তা হচ্ছে এমন একটা সমাজে, যেখানে পালস্নাটা ঝুঁকে আছে মূলত ধর্মের দিকে। দুটো বিপরীত প্রবণতা কীভাবে যে চলছে পাশাপাশি, গত চল্লিশ বছর ধরেই তা বেশ জল্পনার ব্যাপার।
রাজনীতির কথা শুনে শুনে আমি হালস্নাক, হালস্নাক পারিবারিক ব্যাপারে তার নাক গলানোর কথা শুনে। আমি বিদেশি মানুষ, যদিও খোঁজখবর রাখা বিদেশি। কোনো বাঙালি পরিবারের সদস্য নই বলে আমাকে কখনো সেই সমাজের অন্তর্ভুক্ত ধরা হবে না। কিন্তু আমি কি এই সমাজের অন্তর্ভুক্ত হতে চাই পুরোপুরি? না, সত্যিই চাই না। আমার স্বাধীনতাকে আমি ঈর্ষা করি, যদিও একাকী কখনো পাকড়ে ধরে আমাকে, আমাকে ভয়ার্ত করে। কিন্তু বুঝি, যে-জীবন আপনা মর্জি চলতে চায়, তার জন্যে এটুকু মূল্য আমাকে দিতে হবে।
অন্য কোনো ভারতীয় ভাষা না শিখে আমি যে বাংলা শিখেছি, সেজন্যে আমি খুশি। এর ধ্বনিটা কানজুড়ানো, মনমাতানো, অবশ্য যদি না হুড়মুড়িয়ে বলা হয়। বিপুল পরিমাণ আবেগের ভার জড়িয়ে আছে এ-ভাষায়। এখানের মানুষজনও খোলাখুলি তাদের আবেগ প্রকাশ করায় অকুণ্ঠ। এটা সুস্বাস্থ্যের লক্ষণ, বাঙালি সমাজে তা সজীবতা আর সরলতার আবহ সৃষ্টি করেছে।
জয়কৃষ্ণ : মার্টিনদা, আপনার প্রিয় বিষয় জার্মানি ও রবীন্দ্রনাথ তথা শামিত্মনিকেতনের সম্পর্কের ব্যাপারে কিছু বলবেন?
মার্টিন : রবীন্দ্রনাথ জার্মানিতে গিয়েছেন তিনবার। ১৯২১, ১৯২৬ আর ১৯৩০-এ। সময়টা দুই বিশ্বযুদ্ধের মাঝের কাল। দুটো বিশ্বযুদ্ধই করেছে জার্মানি আর দুটোতে পরাজিতও হয়েছে। সময়টা ছিল যুদ্ধবিধ্বস্ত জার্মান জনগণের সামাজিক সংক্ষোভ আর গভীর সাংস্কৃতিক সংকটের সময়। রবীন্দ্রনাথ জার্মানিতে উপস্থিত হয়েছেন যেন মসিহা হিসেবে। জার্মান জনগণকে তিনি স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন মানবতা আর শামিত্মর ব্যাপারে তাদের সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকারের কথা। ভারতের সহিষ্ণুতা, আন্তর্সাংস্কৃতিক বোঝাপড়া আর অহিংসার কথা শোনাতে চেষ্টা করেছেন তিনি। নিজেকে দেখেছেন প্রাচীন ভারতীয় মূল্যবোধের মশাল-বাহক হিসেবে।
তাঁর বইগুলো সে-সময় বিস্ময়কর বাণিজ্যিক সাফল্য পেয়েছে। লন্ডনের ম্যাকমিলান কোম্পানি থেকে তাঁর যত বই ইংরেজি অনুবাদে প্রকাশিত হয়েছে, সমস্তই জার্মান ভাষায় অনূদিত হয়েছে ১৯১৪ থেকে ১৯২৫ সালের মধ্যে। ১৯২১ সালে, প্রথম যে-বছর তিনি জার্মানিতে গেলেন, তখন জার্মানি জুড়ে ছিল সুস্পষ্ট ‘রবীন্দ্র- উন্মাদনা’। খবরের কাগজ ভরে থাকত তাঁর প্রতিটি গতিবিধির প্রতিবেদনে। সব মিলিয়ে তাঁর দশ লাখ কপি বই বিক্রি হয়েছিল। সেই সেকেলে রবীন্দ্রনাথ ছিলেন বেস্ট সেলার।
তবে রবীন্দ্রনাথের খ্যাতি শিগগির সিত্মমিত হয়ে আসে। তাঁর রচনার জার্মান অনুবাদের একচেটিয়া স্বত্ব ছিল কুর্ট উওল্ভ কোম্পানির। তারা শেষবার তাঁর বই প্রকাশ করে ১৯২৫ সালে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষ পর্যন্ত তাঁর নাম উচ্চারিত হয়েছে কদাচিৎ। তারপর ১৯৫০ আর ১৯৬০-এর দশকে তাঁর কিছু বই আবার প্রকাশিত হয়েছে। মূল বাংলা থেকে সরাসরি জার্মান ভাষায় তাঁর কবিতার অনুবাদ হতে সময় লেগেছে আরো ত্রিশ থেকে চল্লিশ বছর।
বিশ্বখ্যাত কবি হিসেবে এই মুহূর্তে তাঁর খ্যাতি মোটামুটি রকমের। বিশ্বসাহিত্যের ব্যক্তিত্ব হিসেবে তাঁকে আবার দেখতে শুরু করেছি আমরা।
জয়কৃষ্ণ : ধন্যবাদ, মার্টিনদা। অনেকটা সময় নিলাম আপনার। আজ এই পর্যন্ত। পরে আবার অন্য কোনো বিষয় নিয়ে বসব আমরা।
মার্টিন : ধন্যবাদ, জয়কৃষ্ণ। ভালো থাকো সব সময়, শামিত্ম ও আনন্দে থাকো।