সাতচল্লিশের দেশভাগের পর ভারতের উত্তরপ্রদেশের এলাহাবাদ থেকে দিনাজপুরে এসেছিল উর্দুভাষী আরিফ হাশমীর পরিবার। পরে দিনাজপুর শহর ছেড়ে পরিবারটি ঠাকুরগাঁওয়ে চলে আসে। উনিশশো একাত্তর সালে ওরা ঠাকুরগাঁওয়েই থাকত। হাশমী সাহেবের হার্ডওয়্যারের দোকান ছিল রেলস্টেশনের পাশে বাজারে। ঠাকুরগাঁও শহর ছাড়াও পঞ্চগড়, দেবীগঞ্জ এসব জায়গায় ওর পাইকারি দোকানের মাল চালান যেত। তাই ব্যবসাটা বেশ জমজমাটই ছিল হাশমী সাহেবের। উত্তরপ্রদেশ থেকে এলেও যেহেতু পরিবারটি উর্দুতে কথা বলত, বাঙালিরা তাই ওদেরকে বলত ‘বিহারি’। অবশ্য বাঙালিরা সব উর্দুভাষীকেই ‘বিহারি’ মনে করে থাকে। তা মানুষটা বিহার, উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ, কলকাতা, এমনকি বিহার রাজ্য থেকে বা বহুদূরের সুদূর দক্ষিণ ভারতের হায়দরাবাদ থেকে এলেও।
ঠাকুরগাঁও শহরের পেশকারপাড়ার একতলা বাড়িটা হাশমী সাহেব ১৯৪৭ সালে কিনেছিলেন এক হিন্দু উকিলের কাছ থেকে। বেশ সস্তাতেই পেয়েছিলেন। কারণ উকিল ভদ্রলোক বাড়িটা দ্রম্নত বেচে যেটুকু যা অর্থ পাওয়া যায় তা নিয়ে ভারতের জলপাইগুড়িতে চলে যেতে চেয়েছিলেন। হিন্দুদের জন্যে তখন কেবল সম্পত্তি নয়, জীবন বাঁচানোটাও ছিল ঝুঁকিপূর্ণ।
১৯৭১ সালে যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর পাকিস্তান সেনাবাহিনী যখন ঢাকা-রংপুর-সৈয়দপুরসহ বিভিন্ন জায়গায় বাঙালিদের নির্বিচারে হত্যা করতে শুরু করল, বাঙালিরাও তার বিরুদ্ধে হিংসায় মেতে উঠল। কোনো অবাঙালিকে, বাঙালিদের ভাষায় ‘মাউরা’কে অরক্ষিত ধরতে পারলে, তার রক্ষা পাওয়া তখন কঠিন ছিল।
দিনাজপুর শহর থেকে ভয়াবহ সব খবর পাচ্ছিলেন হাশমী সাহেব। ইপিআর বাহিনী শহরে ঢুকে খাসিয়াপাড়ার অনেক বিহারি পুরুষকে ট্রাকে চাপিয়ে কোথায় যে নিয়ে গেছে তা কেউ জানে না। তবে কাঞ্চন নদীর পারে অনেক লাশ পড়ে থাকতে দেখা গেছে। যদিও সে-সময়ে ভয়ে কেউ আর নদীর পারে দেখতে যায়নি এগুলো কাদের লাশ।
ঠাকুরগাঁওয়ের খবরও ভালো নয়। সীমান্ত চৌকিগুলোতে যেসব অবাঙালি ইপিআর সদস্য ছিল তাদের অনেককে গুলি করে মেরে ফেলা হয়েছে। আবার কাউকে কাউকে বন্দি করে এনে স্টেডিয়াম চত্বরে বেঁধে রাখা হয়েছে। বেশকিছু বেসামরিক উর্দুভাষী নারী-পুরুষকেও ধরে এনে এখানে বেঁধে রাখা হয়েছে। স্টেডিয়ামের ফুটবলের গোলপোস্টের সঙ্গে বেঁধে রাখা হয়েছে এক অবাঙালি নারীকে। দলে দলে বাঙালি এসে এসব বন্দিকে দেখছে, যেন তারা খাঁচায় রাখা কোনো প্রাণী। ঠাকুরগাঁও কলেজের নিরীহ এক বাঙালি অধ্যাপক এ-ব্যাপারে ক্ষীণ প্রতিবাদ জানালে এক ইপিআর সৈনিক মহাক্ষিপ্ত স্বরে বলে উঠেছিল : ‘বেশি কথা বলবেন না। বন্দুক কিন্তু ঘুরে যাবে!’ সৈনিকটির রক্তচক্ষু দেখে ভদ্রলোক চুপ করে গিয়েছিলেন।
ঠাকুরগাঁওয়ের অনেক উর্দুভাষী পরিবারই বিপদের আঁচ পেয়ে সৈয়দপুরে চলে গিয়েছিল। সৈয়দপুরে রয়েছে বিহারিদের বিশাল কলোনি। তাই সৈয়দপুর উর্দুভাষীদের জন্যে নিরাপদ। সৈয়দপুরে বিহারিরা এতটাই শক্তিশালী ছিল যে, সেখান থেকে দলবেঁধে সশস্ত্র বিহারিরা আশপাশের বাঙালি গ্রামগুলোতে আক্রমণ, হত্যা, লুণ্ঠন এসবও করছিল। হাশমী সাহেবও সপরিবারে সৈয়দপুরে চলে যেতে চেয়েছিলেন। কিন্তু দোকানের ব্যবসাপাতি গুটিয়ে ফেলা আর পুরনো কিছু পাওনা টাকা জোগাড় করতে গিয়ে তিনি বেশি দেরি করে ফেললেন। আর এখন তো দু-তিনদিন ধরে কোনো অবাঙালির পথে বের হওয়াই মহাবিপজ্জনক হয়ে পড়েছে। বাঙালিরা তাদের দেখলেই মারতে ছুটে আসে। শহরের অধিকাংশ অবাঙালির বাড়িঘর-দোকান আক্রান্ত হয়েছে। অনেক ভয়াবহ কাহিনি এরই মধ্যে শুনে ফেলেছেন হাশমী সাহেব। তিনি জানেন তাদের এ-বাড়িটিও যে-কোনো সময় আক্রান্ত হতে পারে।
এ-পাড়ায় উর্দুভাষী বলতে বর্তমানে একমাত্র হাশমী সাহেবের পরিবারই। তাদের পাড়ার মানুষজনের, যাদের কারো কারো সঙ্গে হাশমী সাহেবের প্রায় বিশ বছরের বেশি সম্পর্ক, তারাও ইদানীং কেমন যেন অন্যরকম আচরণ করছে। আরো সমস্যা হচ্ছে, শহরে খুনোখুনি শুরু হলে পাড়ার পরিচিত প্রায় অধিকাংশ বাঙালি পরিবারই বউ-বাচ্চা নিয়ে শহর ছেড়ে গ্রামের দিকে চলে গেছে। কিন্তু হাশমী সাহেবদের তো কোনো গ্রাম নেই। তারপরও দু-একজন বিপদে সহায়তার আশ্বাস দিয়েছে। যেমন তাদের পাশের বাড়ির বদিউর রহমান সাহেবের পরিবারটি, যে-বাড়ির ছেলেমেয়েদের সঙ্গে হাশমী সাহেবের পরিবারের ছেলেমেয়েদের রয়েছে বহুদিনের বন্ধুত্ব। হাশমী সাহেবের বড় মেয়ে ইয়াসমিন বদিউর সাহেবের মেয়ে রোকেয়ার সঙ্গে একই ক্লাসে পড়ে। দুজনে স্কুলেও যায় একসঙ্গে।
ছেলেমেয়েদের ভাগ ভাগ করে ছড়িয়ে দেওয়ার কথাটা হাশমী সাহেবের স্ত্রী রওশন বিবিই প্রথম বললেন। হাশমী সাহেবেরও পরে মনে হলো, এই ভয়ংকর এক সময়ে সেটাই হয়তো শ্রেয় হবে। চারদিকে খুনোখুনির এই চরম দুঃসময়ে সবাই একসঙ্গে মারা পড়ার চেয়ে ছেলেমেয়েদের ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রাখলে কেউ কেউ হয়তো প্রাণে বেঁচেও যেতে পারে।
বড় মেয়ে ইয়াসমিনকে তাই পরশু রাতে পাঁচিল টপকে পাশের বাড়ির বদিউর সাহেবের বাসায় রেখে আসা হয়েছে। আশা যে, বদিউর সাহেবের বাড়ির মেয়েদের মাঝে লুকিয়ে থেকে মেয়েটা হয়তো বাঁচতে পারবে। আর গতকাল বেশ গভীর রাতে হাশমী সাহেবের দোকানের পুরনো বাঙালি কর্মচারী সিদ্দিক মিয়া তাদের বাড়ির পেছনের পাঁচিলের কাছে এসে ডাক দিয়েছিল – ‘হাশমী সাহেব! ও হাশমী সাহেব!’ হাশমী সাহেবের বাড়ির পেছনটা কিছুটা জঙ্গলের মতো। তার পেছনে নদী। ফলে লোকজন এদিকটায় তেমন আসে না। গ্রামে চলে যাওয়ার আগে সিদ্দিক শেষবারের মতো তার দোকানের মালিকের সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল। তখন সবার সঙ্গে কিছুক্ষণ শলাপরামর্শ করে বড় ছেলে জাভেদকে দিয়ে দেওয়া হলো সিদ্দিকের সঙ্গে। জাভেদকে সিদ্দিক ওর বোনের বাড়ি নীলফামারীর দিকে নিয়ে যাবে। ওদিকটা এখনো কিছুটা নিরাপদ।
এখন শুধু ছোট দুটি ছেলেমেয়ে রইল হাশমী সাহেবদের সঙ্গে। বছর এগারোর মুন্নী ও পাঁচ বছরের আলী নওয়াজ। এদিকে শহর থেকে মাঝে মাঝেই মানুষের চিৎকার ভেসে আসছে। দু-চারটে গুলির আওয়াজও। আর ভেসে আসছে কুকুরের, কেমন জানি, কান্নার মতো ডাক। সন্ধ্যাটা কোনো রকমে কাটল। তারা পুরো বাড়ি অন্ধকার করে বসে আছেন। আজ রাতে সবাই যেন খাওয়ার কথাও ভুলে গেছেন। যে-কোনো আওয়াজেই চমকে চমকে উঠছেন সবাই।
রাত তখন বেশ গভীর হয়ে গেছে। একটু তন্দ্রামতো ভাব এসেছিল হাশমী সাহেবের। এমন সময় মনে হলো কে যেন গেটে খটখট করে আওয়াজ করছে। হাশমী সাহেব ও রওশন বিবি ভয়ে মুখ-চাওয়াচাওয়ি করলেন। আতঙ্কে মনের ভেতরটা শূন্য হয়ে গেলেও, হয়তো নিজেকে ভরসা দিতেই, বউয়ের দিকে তাকিয়ে হাশমী সাহেব বললেন : ‘ডর কা কোই বাত নেহি।’ কথাটা বলে কিছুটা অসংলগ্ন পায়ে গেটের দিকে এগিয়ে গেলেন। দরজার খটখট আওয়াজটা যেন এবার আরো একটু বেড়ে উঠল। অন্ধকারের মধ্যে দরজার পাশে এসে হাশমী সাহেব ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করলেন : ‘কৌন?’

  • আমি জয়নাল মাস্টার। … মুন্নী-নওয়াজদের টিচার।
    এ দুঃসময়ে কাউকেই ঠিক বিশ্বাস করা যায় না। হাশমী সাহেব এবার তাই জিজ্ঞেস করলেন :
  • আপ কো সাথ কোই হ্যায়?
  • না। আমি একাই।
    জয়নাল মাস্টারের মুখে এ-কথা শুনে হাশমী সাহেব ধীরে ধীরে গেটটা খুললেন। দেখলেন সাইকেল নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন বছর তিরিশের রোগা চশমাপরা জয়নাল মাস্টার, যিনি মুন্নী আর নওয়াজকে অঙ্ক আর ইংরেজি পড়ান। সময়ের বিপদটা জয়নাল মাস্টারও ভালো বোঝেন বোঝা গেল। সাইকেলটা নিয়ে বাড়ির ভেতর ঢুকেই দ্রম্নত গেটটা ভেতর থেকে বন্ধ করে দিলেন।
    জয়নাল মাস্টারকে দেখে আর তার কথা শুনে একটা ক্ষীণ আশা জেগে উঠল হাশমী সাহেব ও রওশন বিবির মনে। তবে শহরের ও চারপাশের গ্রামগুলোর যে অগ্নিগর্ভ অবস্থা তাতে চারজনের একটা বিহারি পরিবারকে নিরাপদে দূরে কোথাও নিয়ে যাওয়া জয়নাল মাস্টারের একার পক্ষে সম্ভব নয়। তবে জয়নাল মাস্টার বললেন, তারা চাইলে বাচ্চাদুটোকে সাইকেলে চাপিয়ে জয়নাল মাস্টার ঠাকুরগাঁও শহর থেকে মাইল সাতেক দূরে তার গ্রামের বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতে পারেন। একবার নিজের বাড়িতে পৌঁছতে পারলে নিজের ভাই-বেরাদরদের সহায়তায় বাচ্চাদুটোকে হয়তো বাঁচানো যেতে পারে, বললেন জয়নাল মাস্টার।
    কিন্তু রওশন বিবি শিশু নওয়াজকে ছাড়তে চাইলেন না। যা ঘটে ঘটুক, নিজের কোলের ছোট ছেলেটাকে নিজেদের সঙ্গেই রাখতে চাইলেন। জয়নাল মাস্টার বরং মুন্নীকে নিয়ে যাক। মেয়েটা তাতে বেঁচে গেলেও যেতে পারে।
    সেভাবেই সব ঠিক হলো। রওশন বিবি কাঁপা-হাতে খুব দ্রম্নত একটা ছোট কাপড়ের পোঁটলা তৈরি করে মুন্নীর হাতে তুলে দিলেন। আর পোশাকের ভেতরে গুঁজে দিলেন কিছু টাকা ও দুটো সোনার গহনা। তবে বাইরের গেট দিয়ে নয়, জয়নাল মাস্টারকে বলা হলো ঘুরে বাড়ির পেছনের অন্ধকার জায়গাটায় আসতে। ছোট মেয়েটি যেন ঠিক বুঝতে পারছিল না কী ঘটছে। বাবা-মা যা বলছে যন্ত্রচালিতের মতো তা করে যাচ্ছিল। পেছনের পাঁচিল টপকে মুন্নীকে জয়নাল মাস্টারের হাতে তুলে দেওয়া হলো। মুন্নী ওর হাতের পোঁটলাটা নিয়ে জয়নাল মাস্টারের সাইকেলের পেছনের ক্যারিয়ারে উঠে বসল। পাঁচিলের ওপাশ থেকে রওশন বিবি শুধু একবার শুনেছিলেন মুন্নী ডুকরে কেঁদে উঠেছিল – ‘আম্মি !’ তারপর জয়নাল মাস্টারের সাইকেলটা টেনে নিয়ে যাওয়ার শব্দটা ধীরে ধীরে দূরে অন্ধকারে মিলিয়ে গেল।
    মুন্নীরা যখন জয়নাল মাস্টারের গ্রামে পৌঁছল তখন গভীর রাত। ঘন অন্ধকারে নীরব গ্রামটা। দূরে দূরে কিছু শেয়াল ও কুকুরের ডাক ছাড়া এই দুঃসময়ে প্রকৃতিও যেন নিস্তব্ধ। মুন্নীকে ওর স্ত্রী ও বৃদ্ধ মায়ের জিম্মায় রেখে ওই রাতেই জয়নাল মাস্টার চলে গেলেন ওদের গ্রামের ভেতরেই, তবে আরেক পাড়ায়, ওর দূরসম্পর্কের এক ফুফুর বাড়িতে। এ-বাড়ির দুই ছেলে মুশফেক ও কালাম আনসার বাহিনীর সদস্য এবং পাকিস্তান সেনাবাহিনী দিনাজপুরে আক্রমণ শুরু করার পর থেকেই এ-এলাকায় মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত করার ব্যাপারে এ দুজন খুবই তৎপর। দু-ভাইয়েরই আছে আনসার বাহিনী থেকে পাওয়া থ্রিনটথ্রি রাইফেল। জয়নাল মাস্টারের মুখে সব কথা শুনে দুজনেই কিছুটা চিমত্মামগ্ন হলো। দুই ভাইয়ের মধ্যে বয়স্ক কালাম বলল : ‘মেয়েডারে তো বাঁচায় রাহন লাগব। কিন্তু কথা হচ্ছে গ্রামের মানুষদের বোঝাবা কেমনে? বিহারিদের উপর মাইনষে যে ঘ্যাপা ঘ্যাপে আছে! আজ সকালেও তো এ-গ্রাম থিকা দলবেঁধে কিছু মানুষ শহরে গেছে বিহারি কাটতে।’ কথাটা সত্য। এবং শুধু আজই নয়, তিন-চারদিন ধরেই লোকজন সশস্ত্র হয়ে এ-উদ্দেশে ঠাকুরগাঁও শহরে যাচ্ছে। যদি ওরা টের পায় জ্বলজ্যান্ত একটা বিহারি মেয়ে ওদের গ্রামেই এসে উঠেছে, ওরা কি ছাড়বে! আর মেয়েটা যে ওদের গ্রামে লুকিয়ে আছে এ-কথাটাও তো দু-চারদিনের বেশি লুকিয়ে রাখা যাবে না। পাশাপাশি লাগোয়া ঘরবাড়ি মানুষজনের। এক বাড়ির মেয়েরা যখন-তখন আরেক বাড়িতে যাতায়াত করে থাকে। মেয়েটাকে কদিন-ই বা লুকিয়ে রাখা সম্ভব হবে? তিনজন মিলে অনেক আলোচনা ও শলাপরামর্শ করে। বলতে গেলে প্রায় সারারাত ধরে। তারপর তারা ঠিক করে গ্রামবাসীকে মেয়েটার কথা জানাবে ওরা।
    পরদিন দুপুরে জয়নাল মাস্টারের বাড়ির উঠোন লোকে লোকারণ্য। ওদের গ্রাম ছাড়াও আশেপাশের দু-চারটা গ্রাম থেকেও চলে এসেছে বেশ কিছু উৎসাহী মানুষ। গ্রামের বউ-ঝিরাও সব আগ্রহ নিয়ে এসেছে ওদের গ্রামে আসা বিহারি মেয়েটাকে দেখতে। নারীরা মূলত বারান্দায় বসা বা খুঁটিতে হেলান দিয়ে দাঁড়ানো। পুরুষরা উঠোনে। চারদিকে গিজগিজ করছে লোকজন। মুন্নীকে দেখা যায় বাড়ির ভেতরের দিকে একটা আধো অন্ধকার ঘরে ওর পুঁটলিটা নিয়ে চুপচাপ একলা বসে রয়েছে। ওকে নিয়ে গ্রামবাসীর যে এত উত্তেজনা, এত কৌতূহল, এত কথাবার্তা, এসব কিছুই যেন ওকে তেমন স্পর্শ করছে না। কেমন ভাবলেশহীন মুখে চেয়ে রয়েছে মেয়েটি। জয়নাল মাস্টারের বউ সকালে মেয়েটাকে কিছু খাবার দিয়েছিল। খেয়েও ছিল। কিন্তু দুপুর থেকে বারবার সাধাসাধি করলেও মেয়েটা আর কিছুই খায়নি। ওভাবেই তাকিয়ে চুপচাপ বসে রয়েছে। কারো সঙ্গে কোনো কথা বলছে না।
    এদিকে বাইরে মিটিং ক্রমশ উত্তেজনায় ভরে উঠছে। বাক্যবাণও হয়ে উঠছে উত্তপ্ত। সবাই জানাচ্ছে কীভাবে বিভিন্ন জায়গায় বিহারিরা বাঙালিদের পৈশাচিকভাবে মেরেছে। এখনো মারছে। কেউ বলল, একটা বিহারির বাচ্চা মানে একটা সাপের বাচ্চা। ওকে বাঁচিয়ে রাখা খুবই বিপজ্জনক। ঘটনাটি আরো উত্তপ্ত হলো কারণ সৈয়দপুরের রেলওয়ে কারখানায় কাজ করে ওদের গ্রামের এমন দুজন আজ দুপুরেই সৈয়দপুর থেকে পালিয়ে গ্রামে এসেছে। তারা জানাল কীভাবে সৈয়দপুর রেল জংশনে বাঙালি পেলেই কেটে ফেলা হচ্ছে। মিটিংয়ে উত্তেজনা ক্রমশ চড়ছে। সবাই-ই কথা বলতে চায়। অনেকেই এ-ব্যাপারে খুব তীব্রভাবে জয়নাল মাস্টারকে দোষারোপ করে চলল। কোন বুদ্ধিতে সে ওই বাচ্চা বিহারি মেয়েটিকে ওদের গ্রামে নিয়ে এসেছে! ও কী দেশের স্বাধীনতা চায় না? জয়নাল মাস্টার ‘বিহারিদের দালাল’ হয়ে গেছে, এ-কথাও বলল উত্তেজিত জনতার কেউ কেউ। কিন্তু কেন জানি না জয়নাল মাস্টার, কালাম ও মুশফেক সভায় তেমন কথা বলল না। অনেক বাকবিতন্ডার পর ঠিক হলো বিহারি মেয়েটাকে মেরে ফেলা হবে। কালাম সভায় দাঁড়িয়ে বলল যে, কাজটা তারা দু-ভাই করবে। কথাটা সবার বেশ যুক্তিসংগত মনে হলো, কারণ গ্রামের মধ্যে এ দুজনেরই কেবল রাইফেল আছে। তবে কালাম বলল, কাজটা করা হবে দিনের বেলায় নয়, গভীর রাতে এবং সেটা করা হবে কাঞ্চন নদীর চরে। গ্রামের তিন-চারজনকে পাঠানো হলো নদীর পারে ছোট একটা কবর খুঁড়ে রাখার জন্যে।
    মুন্নীর মৃত্যুদ- ঘোষিত হওয়ার পর প্রথমে দলে দলে গ্রামের বউ-ঝি ও পরে পুরুষের দলও এক নতুন বিস্ময়ে এই বিহারি বালিকাটিকে দেখতে থাকল। যেন জীবনে এই প্রথম তারা কোনো বিহারি মানুষকে দেখছে! তবে এটাও ঠিক যে, মৃত্যুদ-প্রাপ্ত কোনো মানুষকে তো তারা এর আগে কখনো দেখেনি। বিশেষ করে সে যদি হয়ে থাকে ভয়ে ফ্যাকাসে হয়ে নিশ্চুপ বসে থাকা বছর এগারোর কোনো বালিকা।
    বেশ গভীর রাতে রাইফেল হাতে মুশফেক ও কালাম মুন্নীকে নিতে এলো। ওদের মুখচোখ গম্ভীর। মুন্নী ওদের সঙ্গে যাওয়ার জন্য নীরবে দাঁড়িয়ে পড়ল। আজ বিকেলের সভায় কী আলোচনা হয়েছে, কী ঘটেছে, সেটা হয়তো ওর অজানা থাকার কথা নয়। তবে মুন্নী চুপচাপই ছিল। কেবল বাড়ি থেকে বের হওয়ার সময় জয়নালের বউকে একবার শুধু জিজ্ঞেস করল : ‘মামি, মুঝে কাহা লে যা রাহা হ্যায়?’ জয়নাল মাস্টারের বউ শুষ্ককণ্ঠে শুধু বলতে পারলেন : ‘তোমার মামাগো লগে যাও।’ ওরা বেরিয়ে গেলে মুখে আঁচল চাপা দিয়ে জয়নালের বউ রুদ্ধকণ্ঠে কেঁদে উঠলেন। আশপাশের অনেকের চোখেই জল এসে পড়ল। বিশেষ করে বাড়ির বউ-ঝিদের।
    সামনে দুপাশে রাইফেল হাতে মুশফেক ও কালাম। মাঝে মুন্নী। ওর হাতে ওর কাপড়ের পুঁটলিটা ধরা। পেছনে বেশ বড় এক কৌতূহলী জনতা। তবে তারা সবাই এখন কেন জানি বেশ চুপচাপ। এমনকি বিকেলের সভায় যে-মানুষরা খুবই উচ্চকিত ছিল, মেয়েটিকে মৃত্যুদ- দেওয়ার ব্যাপারে ছিল সবচেয়ে সোচ্চার, তারাও কেমন যেন নীরব হয়ে গেছে। কিছুটা দ্বিধাগ্রস্ত পায়ে তারা যেন মেয়েটির পেছন পেছন হাঁটছে।
    গ্রামের শেষ প্রামেত্ম এসে মুশফেক ও কালাম ঘুরে দাঁড়াল। সমবেত জনতার উদ্দেশে মুশফেক বলল, কাজটা তারা দুজনেই করতে পারবে। তাদের সঙ্গে কারো আসার দরকার নেই। সবাই যেন গ্রামে ফিরে যায়। কথাটার যুক্তির দিকটা সবাই বুঝতে পারছিল। তাছাড়া মুশফেক ও কালাম আজ বিকেল থেকে যেরকম গম্ভীর হয়ে রয়েছে, তাতে ওদের কথার প্রতিবাদ করার তাগিদও কেউ তেমন বোধ করল না। আর রাইফেল হাতে ধরা মানুষদের কেই-বা সহজে ঘাঁটাতে চায়!
    মুন্নীকে নিয়ে শুধু মুশফেক ও কালাম কাঞ্চন নদীর চরের দিকে হাঁটতে শুরু করল। ধীরে ধীরে তিনজনের ছায়ামূর্তি দূর-অন্ধকারে মিলিয়ে গেল। গ্রামের মানুষজনও আসেত্ম আসেত্ম সব গ্রামে ফিরে গেল। পরে ওরা রাইফেলের গুলির দুটো শব্দ শুনতে পেয়েছিল। মুন্নীর আর্তনাদ কী ওরা শুনতে পেয়েছিল? কেউ কেউ বলল, তারা শুনতে পায়নি। কেউ কেউ বলল, তারা শুনেছে। তবে সে-শব্দটা নদীর দিক থেকে ভেসে আসা বাতাসের শোঁ-শোঁ শব্দও হতে পারে। পরদিন ভোরে উৎসাহী কিছু মানুষ গিয়ে দেখে এলো কাঞ্চন নদীর চড়ায় সদ্য খোঁড়া কবরটার ওপর নতুন কিছু মাটি দিয়ে লেপা।
    জয়নাল মাস্টার বৃথাই রংপুরের কারমাইকেল কলেজ থেকে বিএসসি পাশ করেননি, বৃথাই এতদিন শিক্ষকতা করেননি। গতকাল সন্ধ্যাবেলাতেই তিনি ওর ছোটভাইকে দিয়ে জরুরি এক চিঠি পাঠিয়েছিলেন নদীর ওপারের গ্রামে ওর কলেজজীবনের ঘনিষ্ঠ বন্ধু নুরুর রহমান নুরুর কাছে, যে-নুরু ছিল স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা বাহিনীর কমান্ডার। আজ এত বছর পরে কেউ যদি নুরু কমান্ডারের গ্রামে যান, দেখবেন ফর্সা রঙের প্রৌঢ়া এক মহিলা সাংসারিক নানা কাজের ব্যস্ততার মধ্যেই মাঝে মাঝে দূরে কাঞ্চন নদীর দিকে তাকিয়ে কেমন জানি বিষণ্ণ হয়ে যান। নারীটি হচ্ছেন নুরু কমান্ডারের ছোটভাই স্কুলশিক্ষক আহাদ মাস্টারের বউ, যিনি এখন তিন সমত্মানের জননী ও একটা পরিপূর্ণ সংসারের ব্যস্ত এক গৃহিণী। নদীর দিকে তাকিয়ে মহিলাটি হয়তো ভাবেন, ভাগ্যিস সে-রাতে ওর বাবা-মা ওকে জয়নাল মাস্টারের হাতে তুলে দিয়েছিল। কারণ হাশমী পরিবারের কেউই আর বাঁচেননি।