ম্যাঙ্গো কাঁকড়া

বিকেল পাঁচটায় ডিনারের শিফট রিসালের। মিজ রবার্টের ক্লাস শেষ হতেই সে এক দৌড়ে রাস্তায় পড়ল। লাফায়েট আর মালব্যারি ধরে সিক্সটিন্থ স্ট্রিট থেকে গ্র্যান্ড অ্যান্ড মটের কোনায় যেতে লাগে তিরিশ মিনিট। সে হেঁটেই যায়। রোজ রোজ উবারে যাতায়াত তার পক্ষে সম্ভব নয়। আর ম্যানহ্যাটনের ডাউন টাউনে বেশিরভাগ সময়েই গাড়িতে স্ট্রিটগুলির ওয়ান ওয়ের ঝক্কি, মেজাজ খারাপ করে দেয়। হাঁটাই উত্তম। আর একটা জিনিস হাঁটার সঙ্গে পাওয়া যায়, জিমে আলাদা করে যেতে হয় না। দুনিয়ার সব ডাক্তার বলে, হাঁটার চাইতে আর কোনো ভালো ব্যায়াম হয় না। সাবওয়েতে যাওয়া যায় মিনিট বিশের মধ্যে ইউনিয়ন স্কয়ার স্টেশন থেকে। বৃষ্টি-টৃষ্টি না হলে, হেঁটে যেতে তার কষ্ট হয় না। বরং উল্টো, ব্যায়াম-আরাম দুটোই মেলে। তাছাড়া রোজ রোজ আসা-যাওয়ার খরচটা বেহুদা। হেভি লস। এই বেঁচে যাওয়া পয়সা দিয়ে সায়ন্তীকে নিয়ে অন্তত মাসে দুবার ভালো কোনো রেস্টুরেন্টে যাওয়া যায়। সে যে-রেস্টুরেন্টে ওয়েটারি করে তার নাম ‘টি-পট’। এশিয়ান ফিউশন, কেবল চায়নিজ খাবার-দাবার নয়, ওই অঞ্চলের প্রায় সব দেশেরই শেয়ার রয়েছে মেন্যুতে। টি-পট ফেমাস হয়েছে সব দেশের মানুষের কাছে, স্টুডেন্টদের কাছে তো বটেই। খাবারের স্বাদ যেমন, পরতাও তেমন।

টি-পটের খাবার খেয়ে সায়ন্তী বলে, সোনা, মিথ্যা বলছি না, ওরা খাবারে নিশ্চয়ই ইন্ডিয়ান স্পাইস ইউজ করে, সঙ্গে কাঁচা লংকাও, দুদিন পরেও সেন্ট পাচ্ছি! 

দৌড়ে দৌড়ে যেতে হয় না রিসালের, ঢিলেঢালা তিরিশ মিনিট ক্যাম্পাস থেকে যথেষ্ট। আজ মাঝদূরত্বে সময়কে সে অযথা খরচ করতে থেমে গেল। এফ অ্যাম ৯৫.৫-এর স্ট্রিট রিপোর্টারের খপ্পরে পড়ল সে। ঠিক খপ্পরে নয়, মজা করতে সে নিজেই আটকা পড়ল। রেডিও জকির নির্দেশে, নিছক আনন্দের জন্য রিপোর্টার বিকেলের রাস্তার পথচারীদের যাকে পায় তাকে পথ রুখে জুতমত ‘কুইজ’ করে, জিজ্ঞেস করে, সব সিলি সিলি প্রশ্ন। সিলি প্রশ্নের উত্তর থেকে ঠমক দিয়ে বের হয় বিশ^সেরা নগরবাসীর কমনসেন্সের নন্সেন্স অ্যানসার, যা হয়ে ওঠে বাড়ি-ফেরতা মানুষের জন্যে এক পশলা বৃষ্টির মতো দিনশেষের রিলিফ; অন্যদিকে কৌতুকের মোড়কে আবর্তিত হয় জকির কমেন্টে ‘ফান’। শহরের সিংহভাগ মানুষ ‘চিল’ করে করে এত অস্থির যে, জীবনটা  মিষ্ট, কিন্তু কেন মিষ্ট তা তারা জানে না, জানতেও চায় না। আর তারা যে এই রিপোর্টার ও রেডিও জকির সারকাজমের শিকার হলো, তা তারাও জানে; হোক না একটু জানা-অজানার মধ্যে ঠোকাঠুকি, নো প্রবলেম, ইটস ফান বেবি! আজ রিসালকে রিপোর্টার প্রশ্ন করে, আমেরিকার ভাইস প্রেসিডেন্টের নাম কী? ইতালি কোন দেশে? ম্যানহাটনের সবচেয়ে বড় পার্কের নাম কী? রিসাল সঠিক উত্তর দিতে পারল। রিসালের পর সঙ্গে সঙ্গে এক তরুণীকে প্রশ্ন করল, আমেরিকার বর্তমান প্রেসিডেন্ট কোন রাজনৈতিক পার্টি করে? কানাডা কোন দেশে অবস্থিত? শেষটা ছিল, নিউইয়র্কের নিক নেম কী? জানি না, জানি না বলে দুলালী হাসি দিয়ে তরুণীটি চলে গেল। সঠিক উত্তরের জন্য, রিসাল পেল একশ ডলার। সে হঠাৎ কড়কড়ে একটি শ-ডলারের নোট পেয়ে খুশিতে প্রায় আত্মহারা। এই প্রাপ্তি অপ্রত্যাশিত। ঘড়িতে রিসাল দেখে, মিনিট সাতেক সময় নষ্ট হয়ে গেছে। সে দ্রুত পা বাড়াল টি-পটের দিকে। হাঁটতে হাঁটতে ফোনে সায়ন্তীকে হঠাৎ পাওয়া একশ ডলারের সংবাদ দিলো। সায়ন্তীর কণ্ঠে চন্দ্রপক্ষ, ডাঙর মেয়ের মতো জ্বলজ্বল উঁকি দিলো, সত্যি? বলো কী। ও মাই গড!

সত্যি সত্যি, তিন সত্যি। রিসাল সায়ন্তীর প্রশ্নে স্রোত দিলো।

তাহলে? তাহলে এখন তুমি কী করবে গো? সায়ন্তীর গলা গলে গেল।

‘নায়না?’ দুজনেরই ফেভারেট মালয়েশিয়ান রেস্টুরেন্ট।

একদম। সায়ন্তী নিশ্চিত করল।

কবে? রিসাল জানতে চাইল।

কবে কী, কালই গো, ডিনার, ঠিক তো?

ঠিক। জাঁকানো কণ্ঠ রিসালের। রিসাল ফোন ছেড়ে দিলো। হঠাৎ পাওয়া একটু আনন্দের সম্ভাবনা তার আজকের কাজের নিশ্চিত কষ্টকে হালকা করে দিলো।

ডিনারের জন্য টি-পট তৈরি হচ্ছে। আর একটু পরেই লোকজন, বিশেষ করে অল্পবয়সী অভুক্তদের ভিড় জমতে শুরু করবে। অ্যাভারেজ ওয়েটিং টাইম তিরিশ থেকে চল্লিশ মিনিট। তবু অন্য কোথাও যাবে না বান্দারা। রিসাল খাবার সার্ভ করতে করতে গলদঘর্ম হয়, মনে মনে বাংলায় যত গালি আছে কাস্টমারদের উদ্দেশে শালা শালা বলে ছুড়ে দিয়ে যোগ করে, যা ঘরে গিয়ে প্রেম কর, একটু রিলিফ দে। গালি দিলেও, রেস্টুরেন্টের ভিড় সব ওয়েটারই কামনা করে, যত কাস্টমার তত টিপস, যত টিপস তত গরম হয় পকেট ও তত কমে টেনশন। বছর বছর সেমিস্টারের ফি সামলানো ডিফিকাল্ট। রিসাল এখন জুনিয়র, আর একটি বছর মাত্র, তার ফিল্মের ওপর ডিগ্রি মিলবে। সায়ন্তীও জুনিয়র, ক্রিয়েটিভ রাইটিংয়ে।

রিসাল ঢাকার আর সায়ন্তী কলকাতার। ফ্রেশম্যান থাকতেই, মিডটার্মের পর ওদের মেলামেশা দিনে দিনে বর্ষী ও বেগী হয়। ভালো লাগার মোহ বাড়ে। মোহ এখন ‘তুমি ছাড়া আমি নেই’ এই অঙ্গীকারে সকল সময় রাঙা হয়। জীবন যেমন জড়িয়ে যায় আরেক জীবনে সারা জীবনের আশায়, রিসাল আর সায়ন্তীর প্রেম এখন এরকম মধুর-টলমল ও প্রতিশ্রুতির অসামান্য দাবিতে অনড়। অনড়, কিন্তু আগামীর জন্যে পূর্ণতার প্রাপ্তিটুকু তুলে রেখেছে তারা। ঠিক তারা নয়, সায়ন্তী স্পর্শ কামনা করে, রিসালও ঝাঁপ দেবে বলে সারাক্ষণ অস্থির, কিন্তু  সায়ন্তী বলে, উহু, পাবে না, বিয়ের পর। সায়ন্তীকে তখন ভীষণ কঠিন শোনায়। রিসাল তার আশা ধরে রাখে। ধরে না রেখে কোনো পথ নেই, অমন ঝকঝকে লাস্যময়তাকে সায়ন্তী যদি তাকে তছনছ না করতে দেয়, তার ভেতরে সে সায়-সাড়া কোনোটাই ভরসা পায় না।

ফিল্মের নেশা রিসালের অতিশয় তীব্র। ভিজ্যুয়াল এই মিডিয়াটি ভীষণ পাওয়ারফুল। ঢাকায় আজকাল আগের থেকে ভালো দু-একটি মুভি তৈরি হচ্ছে, ভালো কিছু ফিল্ম মেকারও আছে, কিছু কিছু ভালো কাজও হচ্ছে। কিন্তু রিসাল নিজে কিছু করতে চায়। নতুন কিছু। যাকে আটকানো যায় মগজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে, চিন্তা-ভাবনার খোরাক হয়ে যা বেঁচে থাকবে চিরকাল। বড় আশা, তাই ব্যাপক প্রস্তুতি জরুরি। রিসালের হবে, সায়ন্তী সে-ই উন্মেষ-তাড়না রিসালের ভেতর দেখে, বলে, হবে গো হবে, তুমি পারবে। রিসাল এই শুনে স্বপ্নের সম্রাট হয়, চোখ-মুখ উজ্জ্বল করে বলে, তুমি পাশে থাকলে সব হবে। সায়ন্তী রিসালের চুলে আঙুলের আদর ঘন করে।

সায়ন্তীর এন্ডলেস পরিশ্রম তার লেখাজোখা নিয়ে। সে ফুল স্কলারশিপ নিয়ে নিউ স্কুলে এসেছে। সপ্তাহে বিশ ঘণ্টার মতো স্কুলের লাইব্রেরিতে কাজ পেয়েছে। গত দু-বছর অক্লান্ত খেটেখুটে সে তার জীবনের প্রথম ফিকশন, নভেল, কমপ্লিট করেছে। পড়াশোনার ফাঁকে ফাঁকে সে পাবলিশারের সঙ্গে যোগাযোগের একটা পথ খুঁজছে। সায়ন্তীর তাড়াহুড়ো নেই, একদিন সে বড় এক অথার হবে, সে কনফিডেন্ট। রিসাল আর সায়ন্তী নিউ স্কুলে তাদের স্বপ্নের পেছনে বিন্যস্ত ও ধাবমান।

রিসাল বেইজমেন্টে গিয়ে ইউনিফর্ম পরে ওপরে বারে এসে গ্ল­াসে সামান্য কোক ঢালল। এক ঢোক গিলে, সে ডাইনিং এরিয়ায় এলো। টেবিলগুলি ঠিকঠাক আছে কি না দেখে নিচ্ছে। টেবিলক্লথ ছাড়া টেবিল, বড়ই আটপৌরে দেখায়, কিন্তু এই ব্যবস্থায় ওয়েটারকুল বেজায় আরাম পায়, একটা ন্যাপকিন নিয়ে ঝেড়ে-মুছে নিলেই হলো। সসগুলি, এমনকি সল্টপেপারও খাবারের ট্রেতে আসে। অবশ্য ট্রে সাজাতে হয় ওয়েটারদেরই। তবু এত এত ভিড় সামলায় এরা, এসব টুকটাক অথচ আবশ্যিক বুদ্ধিযুক্ত আয়োজনের জন্যেই তা সম্ভব হয়।

দুটি টেবিলে কাস্টমার, না  না, গেস্ট এসেছে। ম্যানেজার গেস্ট বলে আপ্যায়ন করতে শিখিয়েছে, আদতে নিছক কাস্টমার বই তো আর কিছু নয়! পয়সা দিয়ে খাবার কিনে খাচ্ছে, অতিথি হতে যাবে কার আমন্ত্রণে! রিসাল এইসব ব্যাপারেই উত্তেজিত হয় বেশি, যা না তা হবে কেন, যত্তসব! এসবকে সে চিহ্নিত করে ইয়ার্কি বলে। ভাবনাটা তার মেজাজকে খিঁচিয়ে দিলো। সে তার এই মুহূর্তের সাম্রাজ্যে একমাত্র বাঙালি, বলে উঠল, শা-লা! ঠিক তখন তার সেলফোন রিং দিলো। ব্যাক পকেট থেকে বের করে দেখল, লিরয়ের ফোন। লিরয় তার রুমমেট। লিরয় ছাড়াও আরেকজন রুমমেট আছে, টিম। রিসালের মেজাজ তুচ্ছ কারণে খিঁচিয়ে ছিল, সেটা থিতিয়ে যাওয়ার আগেই সে বলল, কী শালা, ফোন করছস ক্যান? রিসাল অন্যপ্রান্তে কান্না শুনল, সে জিভে কামড় দিয়ে বলল, কাঁদছ কেন লিরয়? লিরয় তবু কান্না থামায় না। রিসাল মনে মনে মজা নেয় – একুশ বছরের যুবক, মাইয়াদের মতো কান্না করছে, মুখে বলে, কী হয়েছে বলবে লিরয়? আমি তো কাজে! বিজি!

মাইক আমার সঙ্গে চিট করছে। বলে আবার কান্না। ম্যাটার সিরিয়াস, রিসাল নিজেকে সামলে বলল, কী চিট করেছে? নিজের কানেই ফালতু প্রশ্ন বলে মনে হলো রিসালের। চট করে আবার জিজ্ঞেস করে, চিট মানে, মানে অন্য কাউকে মাইক লাভ করে?

বলছি কী! লিরয় কান্না থামায়।

কী করে বুঝলে তোমার সঙ্গে চিট করেছে? রিসাল প্রশ্ন করে।

ন্যান্সি, আমাদের অ্যাপার্টমেন্টে এসেছে, তুমি তাকে দেখেছ। আমি মাইকের সঙ্গে মিট করতে ওর অ্যাপার্টমেন্টে যাই, আগে থেকে ফোন করিনি, মাইক জানে আমি ক্লাসে, কিন্তু … – তারপর আবার কান্না।

রিসাল আর নিতে পারছে না, গেস্টও এসে গেছে বেশকিছু, সে বলে, কুল ম্যান, কুল, যা বলার তাড়াতাড়ি বলো, ম্যানেজার আমার দিকে তাকাচ্ছে।

আমি দরজা খুলে দেখি মাইক আর ন্যান্সি, জড়িয়ে ধরে চুমু খাচ্ছে। রি, আমি মাইককে ছাড়া বাঁচব না। বলে হাউমাউ করে লিরয়ের কান্না।

রিসাল থ হয়ে গেল। এসব সে শুনেছে, কিন্তু দৈববাণী শ্রুত হলো এই প্রথম। সে শুধু বলতে পারল, সব ঠিক হয়ে যাবে। মাইক তো তোমারই, তোমরা তিন বছর ডেট করছ। সে তোমাকে অনেক ভালোবাসে – আমরা সবাই জানি। চিন্তা করো না। ভেঙে পড়ো না। রাতে দেখা হবে। ফোন অফ করে দিলো রিসাল। সত্যিই আর নিতে পারছিল না সে। অল্প কথায়, মাইক দুজনের সঙ্গেই ডেট করে, লিরয় আর ন্যান্সি, দুজনেই তার প্রেমিক।

রিসালের কাছে ভিকটিম লিরয় সাহায্য প্রার্থনা করছে, সেইসঙ্গে বন্ধুকে ভাঙা প্রেমের জলজ বয়ানে বুকের ভাপ-ব্যথা হালকা করতে চাইছে। পুরো ব্যাপারটাই রিসালকে জ্বলন্ত অঙ্গারে দগ্ধ করছে, সাহায্য দূর অস্ত‌। ত্রিকোণ প্রেম, কঠিন কী সরল, সে বিবেচনা পরে, আগে ব্যাপারটা হজম করার দাবি করে।

রিসাল ‘টি-পট’-এ আজ অমনোযোগী থাকল বেশির ভাগ সময়। কী করে কেউ ভালোবাসাকে ভাগাভাগি করে? তার মাথা কাজ করছে না। কেউ ফর্ক চাইলে দিয়েছে চামচ, ট্রে থেকে চলকে পড়েছে মার্টিনির অলিভ।  সারাক্ষণ সার্ভ করেছে কাঁপা হাতে। ম্যানেজার লক্ষ করেছে। কিছু বলেনি। অভিজ্ঞতা যত্রতত্র মেলে না, রিসাল পরিশ্রমী সৎকর্মী। সিনসিয়ার। রেস্টুরেন্ট থেকে গুডনাইট বলার সময়, ম্যানেজার রিসালের পিঠ চাপড়ে বলল, ভালো করে ঘুম দাও। রেস্ট নাও। পরশু দেখা হবে। পরশু কেননা আগামীকাল রিসালের ডে-অফ।

রাতের ডাউন টাউনের রাস্তা। জনবিরল। ক্যাম্পাস এরিয়া বলে এই উইকডেতে ছাত্রছাত্রী এখনো অল্পস্বল্প বিরাজমান। রিসালের মাথা আজ প্রায় পুরোটাই নষ্ট। নষ্ট ঘটনায় নয়, নষ্ট, কেননা এই ঘটনার প্রসূতিঘর তার ঘর। মানে, তার অ্যাপার্টমেন্ট। রিসাল, লিরয় আর টিমের, তিনজনের তিন রুম। একটা লিভিংরুম রয়েছে।

দরজা খুলেই দেখে টিম লিরয়ের প্রায় নিথর দেহের পাশে বসে লিরয়ের এক হাতের কব্জিতে ব্যান্ডেজ লাগাচ্ছে। রিসাল দ্রুত কাছে গেল, টিমকে জিগ্যেস করল, কী হয়েছে? টিমের বয়ান এরূপ : অনেকক্ষণ কান্নাকাটি, লাফালাফি, ফোনে মাইকের সঙ্গে অনুনয়-বিনয়, শিশুর মতো ভালোবাসার দাবি ইত্যাদি চলতে থাকে। মাইক বলে, আমি তোমাকেও ভালোবাসি লিরয়। লিরয় এই শুনে বলে, না, তুমি শুধু আমার। মাইক অনেস্টলি বলে, আমি ন্যান্সিকেও ভালোবাসি। লিরয় অনেকক্ষণ চুপ করে থাকে, কাঁদে, অস্থির পদচারণা করে। তারপর আবার মাইককে বলে, তুমি কাকে বেশি ভালোবাস? আমাকে, না ন্যান্সিকে? মাইক বলে, দুজনকেই। রিসাল আসার মুহূর্ত আগে লিরয় ব্লেড দিয়ে কব্জির রগ কাটতে যায়, টিম তখন ত্বরিত লিরয়ের মুখে প্রচণ্ড জোরে ঘুষি মারে, লিরয় রগ কাটা থেকে বিরত হয়। টিম লিরয়কে হাসপাতালে নিয়ে যেতে চায়, লিরয় কিছুতেই যাবে না। সে কিছুক্ষণ একা থাকতে চায়। টিম ঠিক করেছে আজ সে লিরয়ের সঙ্গেই থাকবে।

সব শুনে রিসালও সিদ্ধান্ত নিল, সেও আজ লিভিং রুমে রাত্রিযাপন করবে।

রাত কেটে গেল নতুন কোনো অঘটন ছাড়াই। লিরয় বেশিরভাগ সময় ঘুমিয়েছে। ভোরের দিকে পানি খেতে চেয়েছে, রিসাল পানি এনে মুখে গ্লাস তুলে ধরেছে। লিরয় বলল, তার হেল্প লাগবে না, পানির গ্লা­স সে একাই ম্যানেজ করতে পারবে। সব ঠিকঠাক। রাতে সায়ন্তীর সঙ্গে রিসালের আর কথা হয়নি। সকালে এক সøাইস রুটি আর একটি কলা রিসালের নিত্যদিনের ব্রেকফাস্ট। বাংলাদেশ থেকে প্রথম প্রথম এসে নাস্তা খেতে তার সময় হতো না। প্রায়দিন সে নাস্তা স্কিপ করত। প্রথমত, প্রথম সেমিস্টারে তার সকালের আর্লি ক্লাসটা থাকত, আর দ্বিতীয়ত, সে কী খাবে সেটা তখনো নির্ণয় করতে পারেনি। নতুন দেশ, নতুন আচার-বিচার, ভিন্ন ভিন্ন খাবার-দাবার, স্বাদ নেই কিছুতেই, ফাস্টফুড চলে; কিন্তু সে-ই বাইরে যাওয়া আর কেনার ব্যাপার! ডর্মে ক্যান্টিন ছিল; কিন্তু বাইরে যাওয়া যা ক্যান্টিনে যাওয়াও তা, কালপ্রিট অপ্রতুল সময়। থার্ড ইয়ারে সব আমলে এসে গেছে। কলা আর রুটি সহজ ও সুলভ, ব্যস, এই নাস্তা-উপকরণেই সে অনেকদিন থেকে সন্তুষ্ট। আজো যথারীতি কলা-রুটি। তারপর এক কাপ কড়া কফি। আজ ক্লাস দশটায়। কফির কাপে তার চুমুক পড়ল একটু একটু, ধীরে ধীরে। রিসাল এই ধীরে ধীরে চুমুক দিয়ে দিয়ে সায়ন্তীকে ফোনে পেতে চেষ্টা করল। কথা তো না! মানে কেউই আজকাল প্রথম চয়েসে কল করে না, করে টেক্সট।

সায়ন্তীকে কাল রাতের ঘটনা বলতে চেষ্টা করে। লিরয় চূড়ান্ত আপসেট, ন্যান্সিকে সে গালাগাল করেছে অকথ্য ভাষায়, বিচটাকে লিরয় মাইকের কাছে ঘেঁষতে দেবে না ইত্যাদি। চার অক্ষরের গালির উপর্যুপরি বর্ষণে সারা ঘরে মনে হয় কেউ পেট্রোল ঢেলে দিয়েছে। দপ করে সব জ্বলে উঠবে। রিসালের মন তেতো হয়ে আছে, কিছুই ভাল্লাগছে না। সায়ন্তী বলে, আমার আজ তিন-তিনটে ক্লাস, একটু লাইব্রেরিতে যেতে হবে। আরো বলেন, আজ তো ডিনারে যাচ্ছি আমরা! তখন কথা হবে।

রিসাল দশটার ক্লাস সেরে অ্যাপার্টমেন্টে ফিরল না। মনটা এখনো চিটচিটে হয়ে আছে। ক্লাস থেকে বেরিয়ে সিদ্ধান্ত নিল সে, মনের এই ভেজাল অবস্থাকে অতিক্রম করবে। একটা অগোছালো বিক্ষুব্ধতা তার নিত্যদিনের চিন্তাভাবনার সক্রিয়তাকে বিপন্ন করে তুলছে। তার চৈতন্য সর্বক্ষণ একটা অনাবিষ্কৃত ঘটনার সার্বিক চিত্র, যা নতুন, টাটকা, অভাবিত, যে-চিত্রটি আগে কেউ দেখেনি, এমনকি অনুভবও করেনি, এরকম একটা কিছু পেয়ে জখম হতে চায়। জখমেই তো বিচ্ছুরিত হয় অদৃশ্য, অদৃশ্যের আনন্দ-বেদনা মানুষ বহন করে; কিন্তু সেসব সম্পর্কে তারা অবহিত নয়। আর, পৃথিবীর মানুষের মন তো বিচিত্রতায় ঠাসা। এই বিচিত্রতার কোনো না কোনো অংশে, সবসময় একটি চাপা চাপল্যও নিগৃহীত থাকে, রিসাল সেই নিগ্রহের স্বরূপ সম্পর্কেও হদিস ও নলেজ পেতে চায়। সে ফিল্ম বানাবে, তবে শখের কনস্ট্রাকশন হবে না তা। রিসাল ড্যাম সিরিয়াস, তার চৈতন্যের ডাকে সাড়া দিতে সে অষ্টপ্রহর প্রস্তুত। সায়ন্তীও তার পাশে তার প্রস্তুতির পথে অষ্টপ্রহর বাহু বাড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সায়ন্তীর সঙ্গে তার একটি ন্যাচারাল বোঝাপড়া আছে, পৃথিবীর সবকিছু তারা জয় করতে পারে! অল্পবয়সের প্রথম প্রেম, বটম কথা, সায়ন্তী তাকে বোঝে। দুজন দুজনের জীবনের প্রার্থনা, চিরদিনের।

রিসাল আর সায়ন্তী ‘নায়না’য় এলো ঠিক সাতটায়। এসে দেখে ওয়েটিং এরিয়ায় আরো তিনটি কাপল টেবিলের জন্য অপেক্ষা করছে। ‘নায়না’ রিজারভেশন নেয় না। ফার্স্ট কাম ফার্স্ট সার্ভ। কিন্তু যারা এখানে আসে তারা এই অপেক্ষাটিকে কামনা না করলেও মেনে নেয়। এদের খাবারের তুলনা হয় না। সুস্বাদু খাবার, গমগম পরিবেশ, যুগল যুগল প্রেমিক-প্রেমিকার নিবিষ্ট আলাপ-সালাপের মধ্যে হঠাৎ হঠাৎ হাস্যরোল একটা অ্যাডেড ভ্যালু দেয়, যার টান অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠে সবার কাছে। সায়ন্তী রিসালের শরীর ঘেঁষে দাঁড়ায়, তার চিবুক আঙুল দিয়ে একটু তুলে ধরে বলে, কী গো, ঠিক আছো তো? এত ঝলসানো আর এত মমতা ঝরলো সায়ন্তীর কণ্ঠে, আর অমন একটা স্পর্শের এত নৈকট্যে রিসাল যে, রিসালের সারা শরীর যেন বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হলো, চট করে সে কিছু বলতে পারল না। সায়ন্তী আবার বলে, কী কাণ্ড বলো, ভালোবাসায় ভাগ বসিয়েছে মেয়েটা, তাই বলে লিরয়কে মরে যেতে হবে?

লিরয়ের জায়গায় আমি হলে তাই করতাম। রিসাল কপট হলো।

কক্ষনো না। আর আমি সোনা তোমাকে আর কারো হতে দিলে তো? ঝলমল সায়ন্তী চোখে এমন টান তুলল, এটা গিলে খেয়ে রিসাল একটু উতলা হলো, অনেকটা বেসামাল, সায়ন্তীর দুই বাহুতে দু-হাত চেপে ধরে বলল, তুমি আমাকে পাগল করে  দাও সায়ন্তী, যতবার কাছে আসো ততবার, তারপর হুট করে বিভক্ত সেকেন্ডে সায়ন্তীর ঠোঁটে চুমু খেল। চট করে সায়ন্তী ডানে-বাঁয়ে তাকিয়ে বলল, দুষ্টু, আশপাশে কত লোক! আমি তো পালিয়ে যাচ্ছি না গো! তারপর একটু মোমমাখানো শাসন, এত সাহস যে আজ?

আজ বেশি অপেক্ষা করতে হলো না তাদের। মিনিট পনেরো পরে টেবিলে গিয়ে বসল দুজন। ছোট টেবিল, মুখোমুখি দুটি চেয়ার। দুজনেই প্রায় একসঙ্গে তাদের দুই হাত পরস্পরের দিকে প্রসারিত করে, সায়ন্তী রিসালের হাত নিজের দুই হাতের মুঠোর মধ্যে ধরে বলে, নতুন কোনো প্লট এলো মাথায়? স্ক্রিপ্ট?

এলো কই? কাল রাতের ঘটনাই মাথা থেকে সরাতে পারছি না। সিমপ্লি আজাইরা। ফালতু। তারপর রিসাল বলে, স্যরি স্যরি, তুমি আবার এসব বাংলা বুঝবে না। রিসাল বলল।

বুঝি বাবা বুঝি। আর ফালতু নয়, ক্র্যাশ তো খাওনি, তুমি বুঝবে না।

খাইনি মানে? জলজ্যান্ত সামনে বসে আছো তুমি!

আমাদেরটা ক্র্যাশ না সোনা, আমাদেরটা দুজনের ভালোবাসা। সায়ন্তী এমনভাবে বলল, মনে হবে থার্ড পারসনের কাছে যে, এরা আন্ডারগ্রেডের মাত্র বিশ-উত্তর দুই অল্প বয়সী যুবক যুবতী, জীবনের ধড়ফড়ের ধারেকাছেও নেই তারা, কী পাকা পাকা কথা! মরাল অব দ্য স্টোরি, প্রেমে পড়ার কোনো বয়স নেই।

ওয়েটার এলো মেন্যু নিয়ে। চেনা ওয়েটার। পছন্দের রেস্টুরেন্ট, সুযোগ পেলেই তারা এখানে আসে। রিসাল আর সায়ন্তীর চোখচোখি হলো। রিসালই বলল, রেগুলার।

ম্যাঙ্গো ক্র্যাব? ওয়েটার নিশ্চিত হতে চাইল।

ইয়েস। সায়ন্তী বলল। আর একটা মিক্সড ভেজিটেবল, রাইস।

ড্রিঙ্কস?

রিসাল চট করে উত্তর দিলো, কাঁকড়ার সঙ্গে ওয়াইন যাবে ভালো। আমার জন্যে এক গ্লাস হোয়াইট ওয়াইন, সায়ন্তী?

না না, আমার পানি হলেই চলবে। সায়ন্তী তার সিদ্ধান্ত জানায়। রিসাল বলল, ওয়াইন, মাত্র এক গ্ল­াস খেয়ে দেখো, কাঁকড়া খেয়ে মনে হবে তুমি নির্ভানায় আছো। তারপর সায়ন্তীর উত্তরের জন্যে অপেক্ষা না করে ওয়েটারকে দুই গ্ল­াস হোয়াইট ওয়াইন দিতে বলল।

সায়ন্তী ড্রিঙ্ক করে না। কালেভদ্রে কোনো কোনো অনুষ্ঠানে শ্যাম্পেইন পান করেছে, সামান্য, এই-ই। এই দু-এক চুমুকের শ্যাম্পেইনেই তার গা গুলিয়েছে, এসব তাই সে এড়িয়েই চলে। আজ ওয়াইনের গ্লাস হাতে নিয়ে ভাবল, রিসাল চেয়েছে, ওর মনটাও গেল রাত থেকে ভালো নেই, ঠিক আছে, সে সামলে নেবে। রিসাল আর সায়ন্তী গ্লাস ঠোকাঠুকি করে, চিয়ার্স বলে গ্লাসে চুমুক দিলো। ড্রাই, হালকা ঝাঁঝালো, হালকা লেমন লেমন টেস্ট, রিসাল সঙ্গে সঙ্গে আরেক চুমুক দিলো।

কপোত-কপোতি হাত ধরে আছে। সময় হালকা ও উষ্ণ হচ্ছে।

অল্পক্ষণ পরেই কাঁকড়া এলো, সবজিও এলো। এই কাঁকড়ার তুলনা নেই। মশলায় জাদু আছে। আচারজাতীয় কিছু আছে, সে ব্যাপারে সায়ন্তী নিশ্চিত, কিন্তু আর কী আছে? আর আমের সøাইস, ইয়াম ইয়াম। এই কাঁকড়ার জন্যে যতবার ইচ্ছা ততবার এখানে আসা যায়। সঙ্গে ওয়াইন, গ্রেট। অনেকক্ষণ ধরে তারা খাবার এনজয় করল।

এবার উঠতে হবে। কাল সকালে দুজনেরই ক্লাস। ওয়েটার বিল নিয়ে এলো। রিসাল তার পকেট থেকে ওয়ালেট বের করে। গতকালের পাওয়া কড়কড়ে একশ ডলারের নোট। সায়ন্তী বলে, কী ভাগ্য নিয়েই না বেরিয়েছিলে কাল।

ভাগ্য না, আমি বলব, ফাও খাওয়া।

ফাও না সোনা, কপাল, কপাল!

চলো, তোমাকে নামিয়ে দিয়ে আসি। রিসাল বলল।

নামিয়ে না, আমরা একসঙ্গে ঘরে যাচ্ছি। আচমকা হেঁয়ালি সায়ন্তীর।

মানে?

মানে কিছু না, আজ আমার সঙ্গে থাকবে। তোমাকে ওই নরকে আর ফিরতে দিচ্ছি না। সায়ন্তীর গলায় মমতার উদ্ভিন্ন মহিমা, না এতদিনের অপেক্ষার ডাক – রিসাল চমকে উঠল। তার শরীরে বিদ্যুৎ খেলে গেল।

কী বলছ?

তুমি আজ আমার অ্যাপার্টমেন্টে ঘুমুবে সোনা। তোমার অ্যাপার্টমেন্টে ওরা থাকুক, ওখানে থাকলে তোমার কিছুই হবে না। প্লট আসবে না, স্ক্রিপ্ট আসবে না, থট আসবে না, তুমি ওদের ঝামেলা সামলাতে সামলাতে টায়ার্ড হয়ে পড়বে সোনা। তোমাকে ফিল্ম বানাতে হবে না? বড় ফিল্ম। পৃথিবীর মানুষ দেখবে। আমি বলব, আমার রিসাল এর স্রষ্টা, চলো চলো।

তারা রাস্তায় নেমে দেখে জনবিরল চারদিক। সায়ন্তীর কেমন গরম গরম লাগছে। একটু উড়ু উড়ু, তবু ভালো লাগছে। তার মনে হলো, এই ওয়াইন জিনিসটা সে টেস্ট করেনি কেন এতকাল? বেশ তো লাগছে। আসলেই ম্যাঙ্গো ক্র্যাবের সঙ্গে খুব ভালো লেগেছে। রিসালটা জানে ভালো, ভীষণ শার্প। সায়ন্তী একটু ঢলে পড়ছে কি? রিসালের আগে আগে চলে যায় সায়ন্তী। উড়ে উড়ে হাঁটছে, যেন কিছুটা দ্রুত।

সায়ন্তী রাস্তা পার হচ্ছে, এরই মধ্যে পেছন ফিরে তাকায়, বলে, কী  হলো, এত পেছনে কেন? এসো এসো আমাকে ধরবে সোনা। রিসাল পা বাড়াল, কিন্তু সায়ন্তীকে ধরতে পারল না। তীব্র বেগে কালো একটি গাড়ি সায়ন্তীর ওপর দিয়ে চলে গেল। রিসাল চিৎকার দিলো, সায়ন্তী!

পাগলপ্রায় রিসাল সায়ন্তীর শরীর ঝাঁকাচ্ছে, বলছে, একবার তাকাও সায়ন্তী, সায়ন্তী একবারটি তাকাও। চিৎকার করে, হেল্প, হেল্প।

রিসাল চিৎকার করে যাচ্ছে, অল্প কিছুক্ষণ পরে তার চোখেমুখে পুলিশ-অ্যাম্বুলেন্সের আলো এসে পড়ে।