অমানিশার কালে

হাশেম মিয়া এমনভাবে রিকশা টানছে যেন হাড্ডিসার রুগ্ণ কোনো গরু জোয়াল-কাঁধে চৈত্রের ভূমি কর্ষণ করছে। অথচ ভিআইপি এই সড়ক যেমন মসৃণ, তেমন তেলের মতো ঝাঁ-চকচকে।

ইয়াসমিন উদ্বিগ্ন স্বরে বলে, ‘ও আব্বা আইজ কি তুমার শইলডা খারাপ? এবায় চালাইতেছ যে? দিরং হইব তো!’

‘খারাপ না রে বেডি। তর ওজন বাড়তাছে মনে লয়!

হা-হা-হা-হা …’

রাত বারোটা পার হয়ে গেছে। ভিআইপি রোডে তাই রিকশা ঢুকতে বাধা নেই। আজ ছুটির দিন, রাস্তা একদম ফাঁকা। হাশেম মিয়ার হাসি দিকে-দিকে ছড়িয়ে পড়ছে।

বাবার হাসিতে মেজাজ খারাপ লাগে ইয়াসমিনের। বেশ রাগ রাগ কণ্ঠে বলে, ‘আব্বা এইডা কী ধরনের আবিল্লি? আমি মুডা হইছি, না তুমার শইলে ব্যারামে ধরছে?’

‘কোমরের বেদনাডা বেজায় যন্তনা দিতাছে আম্মা।’

‘তাইলে লও আইজকা কাম বাদ দেই, বাসাত চলো। কাল ডবল শিফটে কাম করবামনে।’

‘অসুবিদা নাই। এই তো হামনেই। দিরং হইত না। এক রাইত কামাই দিলে পরদিন তর বইনেরা কী খাইবো? তর মা আমারে কুন দইরায় যে ভাসাইয়া গেল! পাষাণীডা।’

বাবা প্রায়ই মাকে ‘পাষাণী’ বলে বকাঝকা করে। মা নাকি তাকে সাগর-মহাসাগরে ভাসিয়ে গেছে। কিন্তু মায়ের কী দোষ! ‘পোলার লাইগা বছর বছর কইন্যা পয়দা করতে কইছিল কেডা তুমারে?’ প্রশ্নটা করতে গিয়েও থেমে যায় ইয়াসমিন। হাজার হোক বাবা তো!

চৌদ্দ বছরে পাঁচ মেয়েকে জন্ম দিয়েছে মা। সন্তান জন্ম দিতে দিতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল বেচারী। পাঁচ নম্বরে গিয়ে আর টিকতে পারলো না। ইয়াসমিনের বয়স তখন চৌদ্দ, রাজিয়ার আট, রুমির চার, সুমির দুই আর খুশির মাত্র সাতদিন। এক গভীর রাতে আঁতুড়ঘরে মায়ের খিঁচুনি ওঠে আর তাতেই মা যাপিত জীবনের সকল যন্ত্রণা থেকে মুক্তিলাভ করে। খোদেজা দাদি বলেছিল, ‘তর মায়ের শইলে বাতাস নাগছে। দেহিস না চৌপর দিন ঘরের দুয়ারে কালা হুলো বইয়া আছিন? হেই তর মায়ের জানডা নিয়া গেছেগা।’

ইয়াসমিন অবশ্য কালো হুলোকে কখনো ঘরের দুয়ারে দেখেনি। তবে মা যে সারাদিনে একবেলার জন্যও পেট ভরে ভাত পেত না সেটা সে জানে।

ইয়াসমিনের পনেরো বছর বয়স থেকে এভাবে রিকশায় চাপিয়ে প্রায় প্রতি রাতে বেরুচ্ছে বাবা। কিন্তু ইয়াসমিনের মনে হয় রিকশায় নয়, বাবা তাকে পিঠে করে বয়ে নিয়ে যায়। তার পিঠ থেকে এই বোঝা কবে নামবে কে জানে?

বয়স তো দুজনেরই বাড়ছে, কিন্তু ইয়াসমিন যুবতী হয়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে শরীরে তেজ বেড়েছে, জেল্লা বেড়েছে, অন্যদিকে বাবার শরীরের শক্তি কমতে কমতে হাড্ডিসার গরুর মতো বাতিলের পর্যায়ে চলে গেছে প্রায়।

দশ বছর আগে হাশেম মিয়া তাগড়া জোয়ান ছিল। মাথায় ইটের উঁচু সারি নিয়ে দমাদম সিঁড়ি ভেঙে ওপরে উঠে যেত। হাত আর পিঠের পেশিগুলি তখন দড়ার মতো ফুলে থাকত। সারা শরীর থেকে ঝরনার ধারায় ঝরা ঘাম দেখে একদিন ইয়াসমিন বাবাকে জিজ্ঞেস করেছিল, ‘আব্বা তুমার শইলে এত্ত পানি কই থিকা আয়ে?’

মাথায় ইট নিয়েই হাশেম মিয়া হো-হো করে হেসে ওঠে।

‘এইসব পানি আল্লাহর মাল। আল্লায় গরিবগো ভালোবাইসা দান করছে। বড় হইলে বুঝবা আম্মা, অহন বুজতা না।’

‘আল্লারে কও আমার শইলেও পানি লাগবো।’

‘ছি মা! এইতা কথা কইও না। এই দান য্যান আল্লাহ‌ তুমরারে কুনুদিন না দেয়।’

এসব মনে হতে আচমকা খিলখিল করে হেসে ওঠে ইয়াসমিন। হাশেম মিয়া পেছন ফিরে তাকায়।

‘পাগলির মতোন হাসতাছস ক্যান মাইয়া?’

‘আব্বা আল্লাহ‌র দানের কথা মনে আছে তোমার?’

‘আছে না? আল্লাহর এই দান তো তোমার লাইগা আমি চাই নাই মা। কিন্তুক …’

‘আব্বা আইজকা কি অমাবইস্যা? এত্ত আন্ধার, বাপ্পুসরে! নিজের হাতডিও চোক্ষে নাগে না। রাস্তার লাইটগুলান সব বন্ধ কিয়ের নাইগা সেইডাও বুঝতাছি না।’

কথার মোড় ঘোরাতে চায় ইয়াসমিন। আজ অমাবস্যা নয়। আগামীকাল অমাবস্যা। হাশেম মিয়া জানলেও মেয়ের প্রশ্নের জবাব দেয় না। ভারবাহী পশুর মতো কুঁজো হয়ে রিকশা টানছে সে। ইয়াসমিন হেঁটে গেলেও তার আগে পৌঁছাতে পারতো। তার মনে হয়, বাবার বিশ্রাম প্রয়োজন।

বহুক্ষণ যাবত ইয়াসমিনের ফোন মৃদু টোনে বাজছে। সে কল রিসিভ করছে না। হাশেম মিয়া রিকশা চালাতে চালাতে বলে, ‘রাজ্জাকে ফোন দিতাছে, তাই না?’

জবাবে ইয়াসমিন ছোট করে বলে, ‘হুম।’

অকস্মাৎ হাশেম মিয়া পঙ্খিরাজের গতিতে রিকশা উড়িয়ে নেয়। সে মুখে বিড়বিড় করতে থাকে। ইয়াসমিন জানে বিড়বিড় করে বাবা অকথ্য ভাষায় গালাগাল করছে। কিন্তু এই গালি সে কার উদ্দেশে দেয় ইয়াসমিন জানে না।

বাংলামোটর, তেজগাঁও, মহাখালী পেরিয়ে বনানীর ভেতরে একটা আলিশান বাসার সামনে এসে হাশেম মিয়া রিকশা থামায়। ইয়াসমিন রিকশা থেকে নেমে কোনোদিকে না তাকিয়ে ভেতরে চলে যায়। এই বাড়িতে আগেও কয়েকবার এসেছে। ইয়াসমিনকে দারোয়ান ভালোভাবে চেনে। হাশেম মিয়া মেয়ের গমনপথে তাকিয়ে থাকে। তার চোখের কোনায় পানি জমতে শুরু করে। সে আর একটু সামনে এগিয়ে রিকশার পাদানিতে ‘দ’ হয়ে বসে থাকে। মাথা দুই হাঁটুর ফাঁকে। দৃষ্টি পায়ের পাতায়। ইয়াসমিন ফিরে না আসা পর্যন্ত হাশেম মিয়া এভাবেই বসে থাকবে। তার চোখ-কানসহ পঞ্চ ইন্দ্রিয় সজাগ। বাতাসের ফিসফাস শব্দও তার কান এড়াতে পারে না। অন্ধকারের মধ্যে একটা মশারও ক্ষমতা নেই তার দৃষ্টিকে ধোঁকা দেয়। অথচ এভাবে উৎকর্ণ থাকার কারণ তার জানা নেই।

ফজরের আজানের খানিকটা আগে প্রত্যাশিত লঘু পায়ের আওয়াজ পায় হাশেম মিয়া। রিকশা থেকে নেমে সে নতমস্তকে এমনভাবে দাঁড়ায় যেন মহামান্য কোনো অতিথিকে স্বাগত জানাচ্ছে। ইয়াসমিন খুব ধীরে, খুব সাবধানে স্খলিত পায়ে এগিয়ে আসে। হাশেম মিয়া সেদিকে না তাকিয়েই বুঝতে পারে ইয়াসমিন খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটছে। তার চোখের টলটল পানি দাঁড়ি স্পর্শ করে। মেয়েকে বুকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে মন চায়; কিন্তু কিছুই করে না সে।

আসার সময় সারা পথ বাপ-মেয়ে হাসি-তামাসা, সাংসারিক সুখ-দুঃখের গল্প করে। কিন্তু ফেরার পথে ওরা কেউ কারো মুখের দিকে তাকায় না। কেউ কোনো কথাও বলে না। হাশেম মিয়া খুব সাবধানে মন্থর গতিতে রিকশা চালায় আর ইয়াসমিন রিকশার মধ্যে নিজেকে গুঁজে দিয়ে অজ্ঞানের মতো পড়ে থাকে। একটু আগে তৈরি হওয়া শরীর-মনের তাজা ক্ষতগুলি ওকে বিমর্ষ ম্রিয়মাণ করে রাখে। ভোরের নরম হাওয়া, স্নিগ্ধ রূপ কিছুই ইয়াসমিনের দগদগে ঘায়ে মলম লাগাতে পারে না।

নুরবাগ বস্তিতে পৌঁছানোর আগেই ঢাকা শহর আড়মোড়া ভাঙতে শুরু করে। ভোরের আলোয় চারপাশ আলোকিত হয়ে ওঠে। বস্তি থেকে একটু দূরে রিকশা থেকে নেমে ওড়না দিয়ে ভালো করে মুখ পেঁচিয়ে নেয় ইয়াসমিন। তারপর দ্রুত নিজের ঘরের দিকে চলে যায়। ইয়াসমিন যখন বাইরে থেকে দরজার তালা খোলে একই সময়ে ভেতর থেকেও দরজার ছিটকিনি খোলার শব্দ হয়।

খোলা দরজার ওপাশে রুমি। প্রতিদিনের মতো দু-বোন মুচকি হাসি বিনিময় করে।

চার-চারটা বোনকে রাতভর ঘরে রেখে যেতে ভয় লাগে ইয়াসমিনের। বস্তিতে হারামির অভাব নেই। কার ডাকে আবার ওরা দরজা খুলে দেয়। তাই ভেতর থেকে দরজায় ছিটকিনি লাগালেও বাড়তি নিরাপত্তার কথা ভেবে বাইরে দিয়ে তালা লাগিয়ে যায় ইয়াসমিন।

চৌকিতে রাজিয়া আর খুশি ঘুমাচ্ছে। রাজিয়ার এক পা চৌকি থেকে নিচে ঝুলছে। খুশি ওর বুকের ওপর। সুমি মেঝেতে বসে দুলে দুলে সুর করে পড়ছে। এই বোনটার পড়ালেখার প্রতি প্রচণ্ড আগ্রহ। সে প্রায়ই বলে, ‘বুজি কুনুদিন আমার ইস্কুল বন্ধ কইরা দিবা না তো!’ ইয়াসমিন বোনের কথায় হেসে বলে, ‘না রে পাগলি।’ কিন্তু নিজে সে শংকিত। কতদিন দু-বোনের লেখাপড়ার খরচ সে চালিয়ে নিতে পারবে?

ইয়াসমিন রাজিয়ার পা সাবধানে চৌকির ওপর তুলে দিতে দিতে বলে, ‘রাইতের ভাত তরয়ারি আর আছিন রুমি? না

থাকলে দুইল্যা ভাত চাপাইয়া দে। আব্বা রাইতে তেমুন কিছু খায় নাই।’

‘পান্তা আছে বুজি, আর হুঁটকির সালুন। এইতা দিয়াই চইলা যাইব।’

‘আইচ্ছা। খুশি আর রাজিয়ার খাওন দিয়া তরা খাইয়া লইস। আইজকা ইস্কুল নাই?’

‘হুম আছে তো। যাইবাম।’

‘তাইলে আব্বা গুসল সাইরা আইলে খাইবার দিস। আমি গুসলে যাইতাছি।’

ঘরে ঢুকে কোনোকিছু ছোঁয় না ইয়াসমিন। পরনের কাপড় ছাড়ে না। সরাসরি গোসলখানায় ঢুকে যায়। এটি ইয়াসমিনের প্রতিদিনের রুটিন।

নুরনগর বস্তিতে অ্যাটাচড গোসলখানাসহ যে-কটি ঘর আছে তার একটি হাশেম মিয়া ভাড়া নিয়েছে। তার কথা, মেয়েরা পরপুরুষের সামনে উদলা হয়ে গোসল করলে আব্রু থাকে? তার জন্য মাসে এক হাজার টাকা বেশি ভাড়া গুনতে হচ্ছে, হোক। মেয়েদের আব্রু! রাতের কথা ভেবে হাসি পায় ইয়াসমিনের।

গোসলখানায় ঢুকে মাথায়, শরীরে বালতির পর বালতি পানি ঢালে ইয়াসমিন। নারকেলের ছোবড়ায় সুগন্ধি সাবান মাখিয়ে পুরো শরীর ঘষে ঘষে লাল করে ফেলে, তবু তার মনে হয়, শরীর থেকে ময়লা যাচ্ছে না। শরীর-মন থেকে ঘিনঘিন ভাবটা কমে না। আবারো ডলে। এভাবে গোসল শেষ হতে প্রায় ঘণ্টা পেরিয়ে যায়।

ইয়াসমিন বেরিয়ে দেখলো বাবা গোসল সেরে খেতে বসেছে। ইয়াসমিনের গোসল করার কারণ আছে, কিন্তু এই সাতসকালে বাবা কেন গোসল করে বুঝতে পারে না। তার শরীরে কিসের ময়লা? নাকি মেয়েকে ভাড়া খাটানোর লজ্জাগুলি ধুয়ে ফেলে।

ইয়াসমিন দেখলো, বাবা শুধু পান্তা ভাত খাচ্ছে, সঙ্গে কিছু নেই পাতে।

ইয়াসমিন রুমিকে উদ্দেশ করে বলে, ‘কি রে রুমি আব্বারে না হুঁটকির সালুন দিবার কইলাম?’

‘রুমি দিছিল আমিই নেই নাই আম্মা। প্যাটের অবস্থা বালা না। যেটুক আছে তুমরা খাইও।’

হাশেম মিয়া মেয়ের চোখে চোখ না মিলিয়ে জবাব দেয়। ইয়াসমিন কথা বাড়ায় না। বাড়িয়েও লাভ নেই। বাবা খাবে না।

শরীর ভেঙেচুরে আসছে। চোখ দুটো খুলে রাখা যাচ্ছে না। শরীরটাকে কোনোমতে বিছানায় ফেলে দেয় ইয়াসমিন। ঘুমে তলিয়ে যাওয়ার আগে শুধু বলে, ‘আব্বা তুমি একটু ঘুমাইয়া লও। অহনই রিশকা নিয়া বারাইও না। হারা রাইত তো ঘুমাও নাই।’

হাশেম মিয়া খেতে খেতে সায় দেয়। মায়ের মৃত্যুর পর খোদেজা দাদি অনেকদিন খুশির দেখাশোনা করেছে। এর জন্য দাদিকে মাসে মাসে বেতন দেওয়া হতো। বাবার যা পুঁজি ছিল ধীরে ধীরে শেষ হয়ে গেল। ছয় মুখ। বাবার একার রোজগারে একবারের খাবার জোটে না। বারো বছরের ইয়াসমিনই তখন পিঠাপিঠি চার বোনের মা। বাবা রিকশা নিয়ে ভোরে বেরিয়ে যায় ফেরে মাঝরাতে। একদিন গভীর রাতে সকলে ঘুমিয়ে পড়লে বাবা ইয়াসমিনের পাশে বসে, মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলে, ‘মা রো, আর তো পারতেছি না। শরীলে কুলায় না মা।’

ইয়াসমিন উঠে বাবার হাত ধরে, ‘আব্বা আমি বাসাবাড়িতে কাম লই? মা যেগুলান বাসায় কাম করত হ্যাগো ধারে গেলে আমারে কাজ দিব।’

‘আগে তর মা কামে গেলে তুই বইনগোরে সামলাইয়া রাখতি। অহন তর মা নাই, ওগো সামলাইবো কেডা?’

ইয়াসমিন চুপ করে থাকে। দীর্ঘক্ষণ কারো মুখে কোনো কথা নেই। কিন্তু ইয়াসমিন বুঝতে পারে বাবা আরো কিছু বলতে চায় । সে জিজ্ঞেস করে, ‘আব্বা আর কিছু কইবা?’

‘কি কইরা যে কই মা। একখান রাইতের কাম পাইছি। তর করণ লাগবো। পারবি মা? ভালা টেকা দিব কইছে। তর ফুবা রাজ্জাক মিয়া জোগাড় কইরা দিছে।’

হাশেম মিয়া ইয়াসমিনের মুখের দিকে অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। ইয়াসমিন কী কাজ, কোথায় করতে হবে, কিছুই জিজ্ঞেস করে না। শুধু বলে, ‘আইচ্ছা আব্বা করবামনে।’

বস্তিতে ইয়াসমিনের খুব সুনাম। তারা জানে, ইয়াসমিন রাতে হাসপাতালে আয়ার কাজ করে। দিনে বোনদের মায়ের মতো আগলে রাখে। দিনরাত এত খাটনি করেও মুখের হাসি কমে না। অন্যদিকে হাশেম মিয়ার বদনাম কম নয়। কেউ কেউ তো বলে, ‘মাইয়ার বিয়ার বয়স যাইতাছে গা, আলসি বেডা মাইয়ার কামাই খাইবার নাইগা বেডিরে বিয়া দেয় না।’

বস্তিতে আরো একদল মহিলা আছে যারা হাশেম মিয়াকে বস্তির একমাত্র পবিত্র পুরুষ ভাবে, যে কি না বউ মারা যাওয়ার পরেও দ্বিতীয়বার বিয়ে করেনি। দু-একজন নিজের শালি বা বোনের সঙ্গে হাশেম মিয়ার বিয়ে দিতে উদ্যোগ নিয়েছিল। কিন্তু হাশেম মিয়ার এক কথা, ‘মাইয়াগো সৎমা আনতাম না।’

দশটার একটু পরে ঘুম ভাঙে ইয়াসমিনের। এই ঘুমটাই সারাদিনের এনার্জি টনিক হিসেবে তার জন্য কাজ করে।

মাথার কাছে রাজিয়া বসে আছে। ওর মুখের দু-পাশ বেয়ে লালা ঝরছে। রাজিয়া জন্ম থেকে প্রতিবন্ধী। কথা বলতে পারে না। শুনতে পায় না। খাবার অনুভূতি আছে কি না বোঝা যায় না। অভাব-অভিযোগ কিছুই নেই। ইয়াসমিন রাজিয়ার মুখে হাত বুলিয়ে বলে, ‘তুই-ই সুখে আছস বইন।’

খুশিকে কোথাও দেখা যাচ্ছে না। এই মেয়েটা সারাদিন বাইরে বাইরে এর ঘরে ওর ঘরে টো-টো করে ঘুরে বেড়ায়। চারদিকে নানা কেচ্ছাকাহিনি শুনে ভয় লাগে ইয়াসমিনের। বস্তিতে বদলোকের অভাব নেই। মেয়েলোকের বয়স দেখে না তারা। ইয়াসমিনের মনে ছোট বোনটার জন্য কুডাক ডাকে। খুশিকে খুঁজতে দ্রুত ঘর থেকে বের হয় সে।

‘খুশি, ও খুশি। কই তুই? ঘরে আয় কইতাছি।’

তিন-চার ঘরের পরের ঘরের দরজা থেকে উঁকি দেয় খুশি। ‘আইতাছি বুজান’ বলে চিলের মতো ছুটে এসে বোনের কোলে ঝাঁপিয়ে পড়ে। ইয়াসমিন বোনকে এমনভাবে বুকের মধ্যে লেপ্টে ধরে যেন হারিয়ে যাওয়া মেয়েকে ফিরে পেয়েছে।

‘হুনো বুজি, তুমি আমার লক্ষ্মী বইন না? ঘর থেইকা আমারে না বইলা বাইর হইবা না। আর কুনু বেডালোকের কাছে যাইবা না। রাজিয়া বুজির কাছে বইয়া থাকবা। বুজছ না?’

খুশি কি বুঝে সে-ই জানে। কিন্তু সে প্রবল বেগে মাথা নাড়ে। না, সে যাবে না।

হাশেম মিয়া রাত আটটার দিকে রিকশা চালিয়ে ঘরে ফিরে বেশ খুশি খুশি গলায় মেয়েকে কাছে ডাকে, ‘মা রে আইজ কিন্তু আগেই বাইর হইতে হইব। আইজকার পাট্টি মেলা দূর। সেই দক্ষিণ খান।’

এতপথ বাবা রিকশা টেনে নিয়ে যাবে? ইয়াসমিন একটু উষ্মা প্রকাশ করে।

‘আব্বা এত দূরবায় আমি যাইতাম না। তুমি রিশকা টাইনা পারতা না।’

‘আইজকার কাজডা হামিদ দিছে। হ্যাই কইল ডবল টেকা দিব। আমি রিশকা বইতে পারবাম, চিন্তা করিস না।’

ইয়াসমিন কিছু বলে না। সামনে ঈদ। বোনগুলি নতুন কাপড়ের জন্য আহাজারি শুরু করে দেবে। যদি বাড়তি কিছু আয় হয়!

দশটার আগেই বাবা-মেয়ে বের হয়। আজ হাশেম মিয়ার মন বেশ উৎফুল্ল। রাস্তার প্রচণ্ড জ্যাম ঠেলে হাশেম মিয়াকে এগোতে হচ্ছে। এর মধ্যেও সে হেঁড়ে গলায় গান গায়, ‘মন মাঝি তর বৈঠা নে রে …’

বাবার কাণ্ড দেখে ইয়াসমিন খিলখিল করে হাসতে হাসতে ভেঙে পড়ছে। আশেপাশের কারো প্রতি বাবা-মেয়ের ভ্রুক্ষেপ করার সময় নেই। বেশ অনেক রাতেই দক্ষিণ খানে পৌঁছায় ওরা।

ইয়াসমিন মেসেজে ঠিকানা দেখে দেখে এগোয়। এলাকাটা খুব সুনসান। রাস্তায় লাইট নেই। ইয়াসমিনের গা ছমছম করে। একবার ভাবে ফিরে যায়। কিন্তু ডবল টাকার লোভ ওকে চুপ করিয়ে রাখে। বাসার নম্বর মিলিয়ে দোতলা পুরনো একটা বিল্ডিংয়ে এসে থামে। গেটে কোনো দারোয়ান নেই। ইয়াসমিন ভেতরে ঢুকে গেলে হাশেম মিয়া একটু এগিয়ে সামনে গিয়ে রিকশা থামায়।

চারপাশে অন্ধকার জমাট বেঁধে আছে। দু-হাত দূরেও কিছু দেখা যাচ্ছে না। আজ অমাবস্যা নাকি? হুম, আজ অমাবস্যা বটে! হাশেম মিয়া যথারীতি রিকশায় ‘দ’ হয়ে বসে থাকে। প্রচুর মশা এদিকে। হাত-পা ফুলিয়ে দিচ্ছে। রাজ্জাকই সবসময় কাজ জোগাড় করে দেয়। আজকের কাজটা হামিদের দেওয়া। হাশেম মিয়া হিসাব করতে থাকে, আজকের টাকাটা দিয়ে সে মুদিদোকানের ধার আগে শোধ করবে। অনেক টাকা বাকি পড়ে গেছে। কাল সামসু সাফ জানিয়ে দিয়েছে, আর একটা শুকনা মরিচের বোঁটাও সে বাকিতে দেবে না।

সময় গুনতে থাকে হাশেম মিয়া। আজ মনে হচ্ছে অনেক বেশি সময় নিচ্ছে। একবার বিল্ডিংয়ের সামনে থেকে ঘুরে যায়, কোনো সাড়াশব্দ নেই। ঝামেলায় পড়লো না তো? আগেও দুই-একবার মেয়েটা বিপদে পড়েছে। হারামিরা মেয়েটার জানটা নিতে শুধু বাকি রেখেছিল, অথচ একটা টাকা দেয়নি।

হাশেম মিয়া অস্থির হয়ে ওঠে। নাহ, আর অপেক্ষা করা যায় না। নিচের সিঁড়িতে পা রাখতে শরীরের রক্ত হিম হয়ে যায়। কান্নাটা ইয়ামিনের না? দৌড়ে দোতলায় যেতেই ইয়াসমিন বাবার গায়ের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে। ওর গায়ে একটা সুতো নেই। পুরো শরীরের জায়গায় জায়গায় কাটা-ছেঁড়া। সিগারেটের পোড়া কাঁচা ঘা। দুই ঊরুর ফাঁকে রক্তের হোলি। ইয়াসমিনের পেছনে পেছনে অন্তত ছয়-সাতজন জন্তুর মতো পুরুষ হইহই করতে করতে নেমে এসেছে। তারা ইয়াসমিনকে টেনে ঘরের ভেতরে নিতে চায়।

কোমর থেকে একটানে বারো ইঞ্চি লম্বা ছুরিটা বের করে হাশেম মিয়া। একজনের বুকে চেপে ধরে সেটি। এই অস্ত্রটি সবসময় তার কোমরে লুকানো থাকে। আগে দুই-একবার কাজেও লাগিয়েছে। সে হুংকার দেয়, ‘আয়, চুদির পুতাইন। ফাইড়া ফালাইবাম।’

আচমকাই সকল কোলাহল থেমে যায়। মুখে লবণ-পড়া জোঁকের মতো পিছিয়ে যায় সকলে। হাশেম মিয়া গায়ের গামছাটা দিয়ে মেয়ের শরীর পেঁচিয়ে কাঁধে তুলে রিকশার উদ্দেশে দৌড়ায়। বাবার পিঠের ওপরে ইয়াসমিনের দুই হাত আর মাথা ঝুলছে। আচমকা খিকখিক করে হেসে ওঠে ইয়াসমিন, গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে, ‘আব্বা, আব্বাগো, চাইয়া দেহো দুইন্যাডা উল্ডাইয়া আছে হি-হি-হি।’

অন্যদিনের মতো নুরনগর বস্তিতে ভোর হয়েছে। রক্তাক্ত বোনকে দেখার পর অন্য বোনদের মধ্যে খুব একটা শোরগোল হলো না। তারা এতদিনে বুঝে গেছে এসব বিষয়ে লোক জানাজানি করা যাবে না। ইয়াসমিনকে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে হাশেম মিয়া ভাবছিল মোড়ের ফার্মেসিতে যেতে হবে। ইয়াসমিন এক হাত দিয়ে বাবার লুঙ্গি চেপে ধরে আর অন্য হাতের মুঠো খুলে বাবার সামনে মেলে দেয়। হাতভর্তি টাকা। হাশেম মিয়া নিঃশব্দে টাকাগুলি নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়।

সন্ধ্যা নাগাদ হাশেম মিয়া ঘরে ফেরে। সে মুদির দোকানের সব দেনা শোধ করে চাল, ডাল আর একটা ব্রয়লার মুরগি কিনে এনেছে। ইয়াসমিন এই সময়ের মধ্যে নিজেকে মেরামত করে ফেলেছে। বাবার হাত থেকে সে বাজারের থলে নেয়। হাশেম মিয়া বেশ খোশমেজাজে বলে, ‘মা রো, আইজ তুমার আম্মার মতোন তেল-মশল্লা গেজাইয়া মুরগির সালুন রানবা। ঘরে কাডলের বিচি আছে না? কয়ডা বিচিও দিয়া দিও। বহুদিন হয় কাডলের বিচি দিয়া মুরগির সালুন খাই নাই।’

ইয়াসমিন থলে থেকে মুরগিটা টেনে বের করতে গিয়ে চমকে ওঠে। থলের ভেতর থেকে মুরগি নয় ইয়াসমিনের তরতাজা শরীর বেরিয়ে আসছে। তারই হাত, পা, মাথা শরীরের যাবতীয় অঙ্গ। ইয়াসমিন কিছু বলে না। চুপচাপ বঁটিতে বসে সে নিজেকেই নিজে টুকরো টুকরো করে কাটতে থাকে।