যন্ত্র ও জন্তু

জন্তু

মল্লিকবাড়ি আর খোন্দকারবাড়ির মধ্যে যে-বাগানটা নিয়ে কয়েক বছর ধরে মামলা চলছে, সেখানেই এক বিকেলে শওকত আলমের নয় বছরের ছেলেটা একটা চতুষ্পদ জন্তু দেখে ভয় পেল।

ছেলেটা চঞ্চল এবং অনভিজ্ঞ। গ্রামে আনাগোনা করার অভিজ্ঞতা না থাকলে অতি সাধারণ শব্দও চমকে দিতে পারে। পাতাঝরার শব্দে মনে হতে পারে জানালার পাশে কেউ হাঁটছে; মুরগি খাবার খোঁজার সময় পা দিয়ে ঘষে ঘষে শুকনো ডালপাতা সরায়, সেই শব্দকে মনে হতে পারে ঘরের দেয়ালে কেউ আঁচড় কাটছে। বাগানে সাপ থাকার কথা তার মাথায় আসেনি। প্রায় অব্যবহৃত বাগানটাতে সে এক ফাঁকে ঢুকে পড়েছিল। খুব ভেতরেও ঢোকেনি, এই হাত দশেক, তাতেই দেখা হয়ে গেল। জীবজন্তুর কথা ছেলেটা খুব একটা পড়েনি বা দেখেওনি, তবে সিনেমায় দেখেছে জঙ্গলে ভূত থাকে। সে চিৎকার করে দৌড়ে বেরিয়ে এলো এবং পরবর্তীকালে জানাল যে সে ভূত দেখেছে। সমবয়সী গ্রাম্য ছেলেপুলে

মজা পেয়ে হাসে, তাদের পরিষ্কার ধারণা শহরের ছেলেমেয়েগুলো স্মার্ট, তুলনামূলক ফর্সা, পরিপাটি করে পোশাক পরবে, কথায় কথায় ইচ্ছে করে দু-চারটে ইংরেজি শব্দ উচ্চারণ করবে, অল্প বয়সেই মোবাইল হাতে পাবে; কিন্তু তারা অবধারিতভাবে ভীতু হবে, অন্ধকারে একা যেতে ভয় পাবে, বাঁশবাগানে ভূত আছে বলে বিশ্বাস করবে, গ্রামের ছেলেদের মতো দৌড়াতে পারবে না এবং দ্রুত ক্লান্ত হয়ে যাবে, গাছপালা-শাক-সবজি চিনবে না, সাঁতার জানবে না, সাইকেল চালাতে পারবে না, হেঁটে বেশিদূর যাতায়াত করতে গেলে হাঁপাবে, ঢিল ছোড়ার প্রতিযোগিতায় বরাবরই লাড্ডুগুড্ডু হবে। তারা ধরে নেবে শহরের ঘিঞ্জিতে সাইকেল চালানোর সুযোগ কম কিংবা চালাতে পারলেও কাঁচা রাস্তায় সেই শিক্ষা অচল, জলাশয়ের অভাবে সাঁতার শেখার সম্ভাবনাও কম, কিংবা কমবেশি শিখলেও গ্রামের বাচ্চাদের মতো কখনোই কাজীদের বিশাল দিঘিটা এপার- ওপার করতে পারবে না। শওকত আলমেরও তাই হয়েছিল। আড়াই বছর বয়সে তার বাবা তাকে এবং তার মাকে ঢাকায় নিয়ে যান। বছরে একবার তারা গ্রামে আসত। তার সমবয়সী ছেলেমেয়েরাও তার দিকে অদ্ভুত চোখে তাকাত। তার গায়ের সোয়েটারের দিকে তাদের নজর যেত যদিও অতি সাধারণ অল্প দামের সোয়েটার, সে কী ক্রিম মুখে মাখে সেদিকে তাদের নজর যেত, এবং তারা গর্বের সঙ্গে শহুরে ছেলেকে সাঁতার এবং সাইকেল শেখানোর দায়িত্ব নিত, কারণ গ্রামে থেকে ওটুকুই এগিয়ে আছে বলে তারা বিশ্বাস করত। এসব না পারলেই তাকে সমবয়সী এমনকি কাকা-ফুফুদের কাছেও শুনতে হতো, ‘শহরে কী যে খাইস কিডা জানে! থাহিস কইতরের খোপের মদ্যি, খাইস চাষের মাছ, ওইসব খা’লি পরে গা’র রং বাইরি সাদা হয় আর মদ্যি কালা হয়ে যায়। গ্রামের মাটিতি খালি পায় হাঁটাহাঁটি কর, সাঁতার জানিস না শিখে যা, সাইকেলও শেখ।’ তাকে সাইকেল চালানো শিখিয়েছিল তার আট মাসের ছোট ফুফাতো ভাই। যেহেতু ফুফাতো ভাই সাইকেল চালাতে জানে, কাজেই সে-ই তখন বড়ভাইয়ের মতো আচরণ শুরু করল। সাইকেল শেখা শুরু করার চারদিনের মাথায় শওকত আলম প্যাডেলের ঘষায় হাঁটুর নিচে ক্ষত সৃষ্টি করে ফেলল এবং ভয় পেয়ে বলেছিল, ‘আমার সাইকেল শেখা লাগবে না রে। বাদ দে।’ ফুফাতো ভাই তখন নাটকীয়ভাবে ঘোষণা দিয়ে ফেলল, ‘শোন ছকু, মনে রাখপি, রক্ত বিসর্জন না দিয়ে কেউ কোনোদিন সাইকেল শিখতি পারে না। দুই ফোঁটা রক্ত দিয়ে ভয় পাইয়ে গেলি? আমি দিসি আধা কেজি। ওঠ সাইকেলে, ওঠ ক’লাম।’

শওকত আলমের ছেলেকেও তার সমবয়সীরা বলতে লাগল, ‘ওই বাগানে যাইয়ে ভয় পাইছো? কোনো কথা! আমরা তো রাত্তিরিও যাই দরকার হলি। হাগামুতা করতিও যাই। আমাগে কইতে, সাথে যাতাম।’

‘তোমরা ভূতের সঙ্গে পারবা?’

‘হিহি। দিনির বেলা ভূত নেই। চাইর পাও না? তালি পরে ওডা হয় শাইরেল নয় খাটাশ। নাকি শিয়েল দেহিছো? জন্তু আর ভূতির ফারাক জানো না?’ ভূত সম্পর্কে অন্তত গ্রামবাসী বাচ্চারাই বেশি অভিজ্ঞ বলে স্বীকৃত।

শহরের বাচ্চা হলো মেহমান। সে ভয় পেলে সবাইকে তটস্থ হতে হয়। গ্রামের কোনো বাচ্চা এই ভয় পেলে ঠাট্টা-তামাশা করাই রীতি। কাজেই সকলেই তাকে অভয় দেওয়ার চেষ্টা করল, ‘কী দেহিছো? ও কিছু না। খাটাশ। খাটাশ নিজিই মানষিরে ভয় পায়। ও আমরা বহুৎ দেহিছি। মারিছিও কত!’

‘খাটাশ! আমার মা মাঝেমাঝে বাবাকে খাটাশ বলে। খাটাশ কি বিড়ালের মতো দেখতে!’

মুরুব্বিরা খানিক থতমত খেয়ে বলেন, ‘বিলেই দেহিছো? তা’লি তো হয়েই গেল। তা বিলেই তো তোমাগো ঢাকায়ও রাস্তাঘাটে আছে। ভয়ের কিছু নেই।’

‘সাইজ বিড়ালের মতো, চেহারা বাঘের মতো। গায়ে চকরাবকরা।’

‘ও আচ্ছা। বুজিছি। ও তো বনবিড়েল।  সেও বহুৎ মারিছি।’

‘মারলেন কেন?’

‘ওই মুরগি খায় যে! রাত্তিরি আইসে খোপের ফাঁক দিয়ে থাবা ঢুকোয়ে মুরগির গলা টিপে ধরে।’

‘কী করে মারলেন?’

‘পিটেয়ে মারিছি, আবার ফান্দে পড়েও মরে। ওই দ্যাখো মুরগির খোপের সামনেই জাল পাতা। সব বাড়ি এইরাম একখান করে জাল আছে।’

‘সব বাড়িতে?’

‘যে বাড়ি হাঁস-মুরগি আছে, সেই বাড়ি জালও আছে।’

শওকত আলম কিছু বলছে না। গ্রামের ছেলেমেয়েদের কাছ থেকে ছেলের ভূতজ্ঞান আহরণ করা দেখছে। তার সময়ে তাও বছরে একবার গ্রামে আসা যেত। সে গ্রামের ভাষাও ভোলেনি। যখনই আসত নিজের গ্রামের ভাষায়ই কথা বলত। এতে গ্রাম্য ছেলেপুলেদের দলভুক্ত হতে বেশি সময় লাগত না। খুব দ্রুতই সে সাইকেল আর সাঁতার শিখে ফেলেছিল। গাছেও উঠতে পারত একটু-আধটু। সাপখোপ দেখলে ভয় পেত না সহজে। কিন্তু তার ছেলে আরো লুতুপুতু। কয় বছর পরে গ্রামে আসা হয়েছে তার কোনো হিসাব নেই। আগের সেই ছুটি এখন আর স্কুলও দেয় না, অফিসও দেয় না। তার বাবা যদি দাদার মতোই একটা বড়ো ভুল না করে যেত তাহলে সে বাধ্য হয়ে মহামারির আগমুহূর্তে গ্রামে এসে আটকা পড়ত না। বাবা উনার পাঁচ ভাইবোনের মধ্যে জমিজমা ঠিকঠাক মীমাংসা না করেই যথাযথ বয়সে মরে  গেলেন। সুতরাং জমিজমা নিয়ে গণ্ডগোল এই বাড়িতে একটা বংশানুক্রমিক ঐতিহ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। শওকত আলম জমিজমার হিসাব কিছুই বোঝে না। সুতা মেপেও যে জমির হিসাব হয়, সেটা সম্প্রতি জানার পর জমিজমার ওপর আগ্রহ আরো হারিয়েছে। জমির প্রয়োজন তার আছে ঠিকই, তবে জমির এইসব হিসাবের খানাখন্দ পার হয়ে নিজের প্রাপ্য বুঝে নেওয়া তার কাছে অসম্ভব মনে হচ্ছে। তার ওপর তার কাকা-ফুফুরা তো সহজ মানুষ না যে সুন্দর করে যার যারটা বুঝে নেবে। তাদের বাস্তুভিটার অবস্থাও ওই মল্লিক-খোন্দকারদের বাগানের মতো হওয়ার দশা হচ্ছে। কবে যেন আদালত একটা স্টে অর্ডার লাগিয়ে দেয় আর মীমাংসা না হওয়া পর্যন্ত এই বাড়ি অব্যবহার্য ঘোষণা করে কে জানে! শওকত আলম জমি নেব না নেব না করছিল, তবে তার স্ত্রী তাকে সুবুদ্ধি দিলো। তাদের ঢাকায় কিছু নেই। শওকত আলম সরকারি চাকুরেও না যে অবসরের পর এক গোছা টাকা পাবে। বরং  সে ভবিষ্যতে অবসরের কোনো সম্ভাবনাই দেখে না। কাজেই যেটুকু জমি পাওয়া যায় তার লোভেই হাজিরা দেওয়া আর পরিচিত একজন আইনজীবীর সঙ্গে মাঝে মাঝে মোবাইলে কথা বলা। বড়ো কুক্ষণে এবার গ্রামে এসে আটকে গেছে। বেসরকারি চাকরি, কদ্দিন থাকবে অনিশ্চিত। অফিসে যাওয়ার পথ নেই এখন। যানবাহন বন্ধ। তার চেয়ে বড় কথা প্রাণের ভয় তো আছে! প্রাণ আগে না চাকরি! তবে সামাজিক দূরত্ব গ্রামে নেই। ঢাকায়ও নেই বলেই সে খবর পাচ্ছে। এখানে ঘরবাড়ি ঢাকার তুলনায় দূরে দূরে সন্দেহ নেই, তবে তাকে সামাজিক দূরত্ব বলা কঠিন। সামাজিক দূরত্বের বালাই নেই, মানসিক দূরত্বের কামাই নেই। মানুষ কী অদ্ভুত বিচ্ছিন্ন-সামাজিক জীব! 

জন্তুর কাহিনি এখানে ফুরোল না। কদিন পরেই ইরাজ মণ্ডলের বাড়ির ফাঁদে সেই জন্তু ধরা পড়ল এবং প্রাণীবিশারদরা সকলে দেখল, তাদের অনুমান সম্পূর্ণ ভুল। ওটা বনবিড়াল বা খাটাশ নয়। জন্তুটা যে কী, কেউ চিনতে পারল না, তবে একটা জীবিত কিছু, তাতে সন্দেহ নেই। শওকত আলমের ছেলের কথা ঠিক আছে – গায়ে চকরাবকরা দাগ, একেবারে গুটিয়ে আছে বলে প্রকৃত আকৃতিটা বোঝার উপায় নেই। চোখদুটোতে জান্তব দৃষ্টি আছে, তবে গঠন মানুষের চোখের মতো। কানদুটো গোল। চেহারায় একটা নিরীহ-গোবেচারা ভাব আছে, লজ্জাবতী বানরের যেমন থাকে, অবশ্য মুখটা বানরের মতো একেবারেই নয়। হাঁসের পায়ের মতো চ্যাপ্টা পায়ের পাতা। কয়েকটা পোষা এবং অপোষা কুকুর এসে ফাঁদটার চারদিকে দূরত্ব রেখে চক্কর দিচ্ছে আর ঘেউঘেউ করছে। অচেনা প্রাণী দেখে সামনে এগোতে সাহস পাচ্ছে না। প্রাণীটা ক্রমাগত ঘাড় ঘুরিয়ে চারপাশের কুকুরগুলোর দিকে নজর রাখছে আর নিঃশব্দে দাঁত খিঁচাচ্ছে। সামাজিক দূরত্ব এবার আরো ঘুচে গেল। এক ইরাজ মণ্ডলের বাড়িতে পুরো গ্রাম উপচে পড়ল। বাধ্য হয়ে ইরাজ মণ্ডল যখন জালসুদ্ধ জানোয়ারটাকে টানতে টানতে পাশের শুকনো বিলে নিয়ে এলো, তখনো জন্তুটা মাথা ছাড়া কিছু নাড়াচ্ছে না। স্কুলপড়ুয়া ছেলেরা ইতোমধ্যে গাছের ডাল সংগ্রহে মন দিয়েছে। তারা ধরেই নিয়েছে জন্তুটাকে মেরে ফেলা হবে। জালবন্দি জন্তুকে পিটিয়ে মারার মজাই আলাদা। আক্রান্ত হবার ভয় থাকে না। মারার পর গাছের ডালে একদিন ঝুলিয়ে রাখার রোমাঞ্চও কম নয়। আর জন্তুকে পিটিয়ে মারাই নিয়ম। হালাল কোনো পশুকে খাওয়ার জন্য মারতে হলে অবশ্য ভিন্ন নিয়ম। কিছু তরুণ-তরুণী মোবাইলে ছবি তুলতে শুরু করল। লোকজনের মধ্যে জন্তুবিষয়ক কথাবার্তা শুরু হলো :

‘বাঘডাশ নাকি?’

‘আরে ধুর ছেমড়া! বাঘডাশ দেহিসনি কোনোদিন? আমার বয়স হইছে বাহাত্তর। তোর কত? বাইশ? কত বাঘডাশ পিটেয়ে মারিছি জানিস? এডা কোনোদিন বাঘডাশ না।’

‘তা’লি কী?’

‘কতি পারি না। এই চিজ কোনোদিন দেহিনি এই গ্রামে।’

‘এই গ্রামের বাইরি দেহিছেন?’

‘না, তাও দেহিনি।’

‘আচ্ছা, এডাই করোনা না তো? ভাইরাস না তো?’

‘ধুরো!’ শওকত আলম বললেন, ‘ভাইরাস চোখি দেখা যায় নাকি?’

‘চায়নাতে বলে কোন জন্তুর মাদ্যমেই ভাইরাস আইছে, এডা সেই জন্তু না তো?’

‘তা এহানে আসপে কী করে?’ কোবাদ খোন্দকার বলে ওঠেন।

‘চায়না পাঠাতি পারে।’

‘কইছে তোরে!’ খাঁ বাড়ির সদ্য বিবাহিত আইয়ুব খাঁ বলে, ‘চায়না খুঁজে পাইতে এই গ্রামে করোনা সাপ্লাই দেবে, না?’

‘কেন, তোর শ্বশুরির দেওয়া টিভিডা চায়নার না? তোর বাড়ির মদ্যি যদি চায়নিজ মাল ঢুকতি পারে, তা’লি ওই মল্লিকগে বাগানে ঢোকপে না কেন?’

কোবাদ খোন্দকার গলা খাঁকারি দিয়ে বললেন, ‘বাগানডা কার, তা কিন্তু এহনো মামলায় আছে। কাজেই মল্লিকগে বাগান কওয়া ঠিক না।’

হাসু মল্লিকও গলা খাঁকারি দিলেন, ‘খোন্দকারগে বাগানও কওয়া যাতিছে না।’

‘তালি কী ক’বো? মল্লিক-খোন্দকার বাগান?’

‘খালি বাগানই কও, তাই ভালো। সময় বাঁচে, দম খরচও কম হয়। এই, দূরি দূরি দাঁড়াও সবাই। বাচ্চাকাচ্চারা সব বাড়ি ওঠ। নয় সবাইরে করোনা একসঙ্গে ধরবে। জন্তুডা তাকাচ্ছে কেমন করে দ্যাখ, মনে হতিছে চোখ দিয়েই ভাইরাস ছড়ায়ে দিতিছে।’ অদৃশ্য ভাইরাস দৃশ্যমান হয়ে যেন গ্রামবাসীকে পরিস্থিতির প্রকৃত অবস্থাটা দেখিয়ে দিলো।

জন্তুটা কী, কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছানো গেল না। তবে শওকত আলমের ফুফাতো ভাই মফিজুর নিজের ফেসবুকে জন্তুটির ছবিসহ পোস্ট দিলো, ‘আমাদের গ্রামের একটি শিশুকে এই রহস্যময় জন্তুটি বাগানে আক্রমণ করতে চায়। শিশুটি নাটকীয়ভাবে প্রাণ রক্ষা করে। পরে ফাঁদ পেতে সেই জন্তুটি ধরা হয়। আমরা কেউ জন্তুটি চিনতে পারছি না।’ কথাগুলো আংশিক মিথ্যা। জন্তুটা মোটেই আক্রমণের চেষ্টা করেনি।  ছেলেটা যতক্ষণ থ’ হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল, জন্তুটাও ততক্ষণ স্থির দাঁড়িয়ে। ছেলেটা যখন ঘুরে চিৎকার করে দৌড় দিয়েছে, জন্তুটাও উলটোদিকে ঘুরে নিঃশব্দে ছুটেছে।

জন্তুটাকে গ্রামের চিরায়ত রীতি অনুযায়ী জালসুদ্ধ পিটিয়ে মেরে ফেলার সব আয়োজনই সম্পন্ন হয়েছিল। বিশেষ করে যাদের হাঁস-মুরগির খামার আছে, তাদের উৎসাহ খুবই বেশি। তবে গ্রামের মধ্যবয়স্ক চেয়ারম্যান অযাচিতভাবে খানিকটা ভয় ছড়িয়ে দিলেন, ‘যদি এই জানোয়ারডা চায়নার ষড়যন্ত্র হয়, তা’লি এরে মারা ঠিক হবে না। শুনিসনি, চায়নায় জন্তুগুলো মাইরে বিক্কিরি করতো, সেই জাগাত্তেই ছড়াইছে করোনা। আর ওরা কি আল্লার নামে জবোই দে? পিটেয়েই মারে নয়তো গরম শিক ঢুকোয়ে দিয়ে জান কবজ করে।’

‘মারলি ছড়াবে কেন? খা’লি পরে ছড়াবে। আমরা তো খাবো না। মাইরে  সোজা মাটিচাপা।’

‘আরে খাওয়া লাগে না, বাতাসেও ছড়ায়। জানিস না কিছু। ওই যারা ঢাকাত্তে গ্রামে আইসে আটকে গেইছে তাগো জিজ্ঞেস কর।’

শওকত আলম বলল, ‘হ্যাঁ, ঠিক। নিঃশ্বেসের সঙ্গে ভাইরাস ঢুকতি পারে। ডাক্তাররা তো তাই কয়।’

চেয়ারম্যান আবার বললেন, ‘নরেন কই? তুইও তো ঢাকাত্তে আসলি। তুইও জানিস না?’

নরেন পাল বলল, ‘কিডা জানে! শুনিছি। আমাগে গার্মেন্টে কিছু কইনি। তয় গার্মেন্ট বন্ধ করে দিসে।’

সুতরাং সিদ্ধান্ত হলো, প্রাণীটা আজ রাতে ফাঁদেই থাকুক। সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে কিছু করা ঠিক হবে না। একে মেরে ফেলা বেশি বিপদ, নাকি ছেড়ে  দেওয়া বিপদ আগে বোঝা দরকার। করোনা থেকে বাঁচবে, নাকি জন্তুর হাত থেকে হাঁস-মুরগি বাঁচাবে, এই সিদ্ধান্ত নেওয়া সহজ নয়। গালিয়াকান্দার পির এবং গ্রামের মসজিদের ইমামের পরামর্শও নেওয়া হবে বলে ঠিক করা হলো। জন্তুটাকে পশ্চিমের বিলের কিনারে ফাঁদসহ একটা গাছের সঙ্গে বেঁধে রাখা হলো। 

ইমাম সাহেব প্রথমেই দুঃখ প্রকাশ করলেন, ‘কী দিন যে আসলো রে! মসজিদি কাতারে ফাঁকা ফাঁকা হয়ে দাঁড়াতি হয়। আগে আমরা কাতার ফাঁকা রাখতি মানা করতাম। কাতারে ফাঁক থাকলি শয়তান ঢোকে। এহন করোনা শয়তানের চেয়ে ক্ষমতাবান হয়ে গেইছে। কী বিপদ! ফাঁক রাখলি শয়তান, না রাখলি করোনা। তা শয়তানরে ভয় পাবো, না করোনারে? এডা আল্লার পরীক্ষা। আমরা করোনার ভয়তে শয়তানরে জাগা দিই নাকি আল্লা দেখতিছে। শয়তানই আসলে করোনা ছড়াইছে যাতে সে কাতারে ঢুকতি পারে! ওই জন্তু বরং আগুনি পোড়ায়ে দেন।’ পরদিন সিদ্ধান্ত নেওয়া সম্ভব হলো না, কারণ ইমাম সাহেব মতামত দিলেও পিরসাহেবকে পাওয়া গেল না, উনি পাশের জেলার এক ওরশে  গেছেন। ফলে আরো দুদিন জন্তুটা রয়ে গেল। তখন নতুন ভীতি দেখা দিলো। জন্তুটা না খেয়ে মারা গেলে করোনা ছড়াবে বলে সবাই ভীত হলো। জন্তুটাকে ফাও খাবার দিতে হাঁস-মুরগি খামারিদের কলজে ছিঁড়ে যেতে লাগল। শেষে কোনোরকমে দুটো ভাত দেওয়া হলো। জন্তুটা কপকপ করে খেয়ে নিল। এ পর্যন্ত একটা শব্দও করেনি। বোবাজন্তু কি না কে জানে!

শেষে পিরসাহেবের মাসালা পাওয়া গেল। তিনি ইমাম সাহেবের মাসালা শুনলেন এবং মাসালা দিলেন, ‘এই দানবের আগমনের আলামত আমি আগেই পাইছি, আমার পিরহুজুর আমারে মরার আগে বলে গেছিলেন। মুক্তির উপায়ও বাতলাইছেন। তয় জন্তুডা হাজির না হওয়া পর্যন্ত কথাডা গোপন রাখতি কইছিলেন। এই জন্তু হলো ইয়াজুজ মাজুজির অনুচর। জাহান্নামের আগুনি যার জম্ম, সে কি দুনিয়ার আগুনি মরবে? মরার ভান করবে খালি। এইসব শয়তানের অনুচরের মরণ নেই। আমারে দুইদিন সময় দেন আর বিশ হাজার টাকার ব্যবস্থা করেন। আমি চারটে রুপো বান্দানো তাবিজ দিবানে। সেইগুলোন ওই জন্তুর চারপায় বাইন্দে বস্তায় ভরে কোনো মজা পুকুরি ডুবোয়ে দেবেন। আর কোনোদিন ওঠপে না। আগুনির প্রাণীর ওষুধ হলো পানি। জাহান্নামে আছে আগুন, বেহেশতে আছে পানি।’ 

ইমাম সাহেব না পিরসাহেব, কার কথা মান্য করা হবে – এ নিয়ে মোটামুটি একটা বিবাদ গজিয়ে উঠেছিল, তবে চতুর্থ দিন বেশ বড় একটা পাজেরো আর তার পেছনে একটা ছোট গাড়ি সাঁইসাঁই করে গ্রামে ঢুকে পড়ল। ডিসির গাড়িতে স্থানীয় বন কর্মকর্তা এসেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জীববিজ্ঞান অনুষদের একজন অধ্যাপককে সঙ্গে নিয়ে। সঙ্গে চারজন বনপ্রহরী। কারো চেহারা দেখা যাচ্ছে না, মুখে মাস্ক, পরনে পিপিই। আবার সামাজিক দূরত্ব ঘুচে গেল। সবাই চেয়ারম্যানবাড়ির উঠোনে জড়ো হলো, সেই জন্তুটিও। গ্রামবাসী বেশ অবাক, একটা মুরগিখেকো জন্তু দেখতে এতবড় গাড়িতে করে সরকারি লোকজন আক্রমণাত্মক ভঙ্গিতে গ্রামে ঢুকে পড়বে তারা বোঝেনি। সঙ্গে কয়েকজন পুলিশও আছে। কিছু সাংবাদিক মাস্কমুখে ছবি তুলছে। খানিকক্ষণ দূরত্ব বজায় রেখে ঘুরেফিরে প্রাণীটিকে দেখার পর অধ্যাপক উঠে দাঁড়ালেন। বন কর্মকর্তাকে কিছু বললেন। বন কর্মকর্তা ডিসি সাহেবকে কিছু বললেন। ডিসি সাহেব হাতমাইকটা মুখের সামনে তুলে ধরে ধমক দিলেন, ‘আপনাদের মাস্ক কোথায়? অর্ধেকের মুখেই তো মাস্ক নেই দেখি। আপনারা দূরে গিয়ে দাঁড়ান। সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখেন। মিডিয়াতে এতবার করে বলা হচ্ছে, মাইকিং হচ্ছে, আপনাদের কানে ঢোকে না? আমরা কিন্তু সবাই মাস্ক পরে আছি। আপনাদের চলেই যেতে বলতাম কিন্তু আমরা কিছু কথা বলব যা সবার শোনা দরকার।’

গ্রামবাসী আগ্রহী হয়ে দূরত্ব সৃষ্টি করল। ডিসি সাহেব বললেন, ‘এই প্রাণীটা কী, সেটা অধ্যাপক সাহেবও বুঝতে পারছেন না। এমন প্রাণী নাকি তিনি কোনোদিন দেখেননি, শোনেনওনি। আপনারাও নাকি  চেনেন না। তবে আপনারা ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে একটা ভালো কাজ করেছেন, নইলে বিষয়টা আমাদের দৃষ্টিগোচর হতো না। বন প্রতিমন্ত্রীরও পোস্টটা চোখে পড়েছে, উনার কাছ থেকে স্পষ্ট নির্দেশনা নিয়ে আমরা এসেছি। আমরা ধারণা করছি এটি একটি বিরল-বিলুপ্তপ্রায় প্রাণী। আপনারা বিলুপ্ত প্রাণী কাকে বলে চেনেন?’

বয়োজ্যেষ্ঠ একজন বলে উঠলেন, ‘জি চিনি। মানিকজোড়, হাড়গিলে, শকুন, ভোঁদড়, বাঘডাশা এইসব। এই গ্রামে অন্তত নেই।’

জীববিজ্ঞানী অধ্যাপক বললেন, ‘ঠিক ধরেছেন। আমরা এদের মেরে ফেলেছি। মানিকজোড় শেষ করেছি খেয়ে, শকুন শেষ করেছি গবাদিপশুর ওপর ডাইক্লোফেনাক অ্যাপ্লাই করে, ভোঁদড়কে মাছের ভাগ না দিয়ে ওদের তাড়িয়েছি, বাঘডাশা-বনবিড়াল  শেষ করেছি কারণ তারা হাঁস-মুরগি খেয়ে  ফেলে। আর এরকম শেষ হওয়া প্রাণী অসংখ্য।’

‘শখ করে তো মারিনি। হাঁস-মুরগি খাইয়ে ফ্যালায়। মেলা ক্ষতি হয় আমাগে। বাদুড় আইসে পাকা সফেদা খায়।’ ভিড়ের ভেতর থেকে কেউ বলে উঠল।

‘কিন্তু আমরা একটা বড় বিষয় জানি না। প্রত্যেকটা প্রাণীর পৃথিবীতে বেঁচে থাকা দরকার। এটা একটা সাইকেলের মতো, ন্যাচারাল ইকুইলিব্রিয়াম। ওরা না বাঁচলে মানুষের জীবন নানাভাবে বিপন্ন হবে। আপনারা দেখবেন, শকুন বিলুপ্ত হবার পর থেকে দেশে অসুখ-বিসুখ বেড়ে গেছে। মানুষ লোভী হয়ে মরা গরুর মাংস বিক্রি করে, চামড়া বিক্রি করে। শকুনের ভাগ্যে কিছু জোটে না। তো আপনারা বলেন, মরা গরুর মাংস মানুষের পেটে যাওয়া উপকারী, নাকি শকুনের? তার ওপর গরু মোটা করার জন্য ডাইক্লোফেনাক দেওয়া হয়, ওই গরুর মাংস খেলে শকুন শুকিয়ে মরে যায়। বাঘডাশা হাঁস-মুরগি খাবে, ওটাই ওদের খাবার। আমরাই বরং হাঁস-মুরগিকে খামারে আটকে রেখে ন্যাচারাল ফুড সাইকেল ভায়োলেট করেছি। এখন আমরা যদি মুরগির খাবার নিয়ে ব্যবসা করি, তাহলে মুরগি বাঁচবে কী করে? আমি জানি, এই এলাকাতে এখন গাবগাছ প্রায় বিলুপ্ত। কেন? গাবগাছ থেকে কাঠ হয় না বলে কেউ রাখে না। অথচ এই গাবগাছ নিয়ে কত লোককথা আর গল্প প্রচলিত ছিল। আমরা ধারণা করছি, এটা কোনো বিলুপ্ত প্রাণী। ফিরে এসেছে।’

চেয়ারম্যান মাথা ঝাঁকালেন। নরেন পাল বলল, ‘যে জন্তু শেষ হয়ে গেইছে তা ফিরে আসে কেমন করে?’

অধ্যাপক বললেন, ‘অনুগ্রহ করে একে জন্তু বলবেন না। মানুষের প্রাণ আছে, এরও আছে। এও একটা প্রাণী। বিলুপ্ত মানে, জানামতে বিলুপ্ত। হয়তো কোনোভাবে টিকে ছিল। হয়তো ছিল সুন্দরবনে, বেশি দূরে না এখান থেকে। চলে এসেছে কোনোভাবে। হয়তো মাত্র কয়েক জোড়া টিকে আছে। অথবা বর্ডার পার হয়ে ইন্ডিয়া বা মিয়ানমার থেকে আসাও সম্ভব।’

ইরাজ মণ্ডল বলে ওঠে, ‘ও, ইন্ডিয়ার মাল? তা’লি পরে মাইরে ফেলানোই ভালো। ইন্ডিয়ান জন্তু আইসে আমাগে হাঁস-মুরগি খাবে, এডা আমরা সহ্য করবো কেন?’

বন কর্মকর্তা দু-পা এগিয়ে এলেন, ‘প্লিজ না বুঝে কথা বলবেন না। এখানে সাংবাদিক ভাইয়েরা উপস্থিত আছেন। ভারত আমাদের বন্ধুরাষ্ট্র। একসময় আমরা একই দেশ ছিলাম। ইংরেজরা ভাগ করেছে বলেই আমরা পরস্পরকে শত্রু ভাবব, এটা ঠিক না। ভারতের গরু যদি বর্ডার পার হয়ে না আসত আপনাদের কোরবানি দেওয়ার সামর্থ্য থাকত? তাহলে সেখান থেকে আসা একটা বিরল প্রাণীকে আপনারা আশ্রয় দিতে পারবেন না! এই তো, এখানে ইমাম সাহেব উপস্থিত আছেন, আপনি তো কোরবানির সময় বাড়ি-বাড়ি ঘুরে গরু জবাই দিয়ে আসেন। আপনিই বলেন, দেশি গরু বেশি জবাই দেন, না ইন্ডিয়ান গরু?’

ইমাম সাহেব চোখ পিটপিট করে বললেন, ‘জি ইন্ডিয়ান গরুই বেশি।’

‘মিয়ানমার থেকেও এসে থাকতে পারে, তবে রোহিঙ্গারা যদি এখানে আশ্রয় পায়, তাহলে একটা নিষ্পাপ প্রাণী কেন আশ্রয় পাবে না?’

অধ্যাপক বললেন, ‘আমি হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটির জুওলজি ডিপার্টমেন্টে এবং ন্যাশনাল জিওগ্রাফিতে এই প্রাণীর ছবি পাঠাবো। দেখা যাক এর পরিচয় জানা যায় কি না। এর একটা স্থানীয় নাম, ইংরেজি নাম এবং বৈজ্ঞানিক নাম দেওয়া দরকার। তবে আপনাদের প্রতি আমার কিছু দিকনির্দেশনা আছে। সবাই মনোযোগ দিয়ে শুনবেন। একে মারা যাবে না।’ শেষ বাক্যের প্রতিটি শব্দ আলাদাভাবে জোর দিয়ে উচ্চারণ করলেন অধ্যাপক, ‘বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইনে যে-কোনো প্রাণী হত্যা করা নিষেধ। আর বিলুপ্তপ্রায় প্রাণী হলে তো কথাই নেই। এই প্রাণীটিকে আমরা অবমুক্ত করব, যে-বাগানে তাকে দেখা গিয়েছিল, সেখানেই।’

শওকত আলম বলল, ‘আপনারা নিয়ে যান না হয়। কোনো অভয়ারণ্যে ছেড়ে দেন। এখানে থাকলে কেউ মেরে-টেরে ফেলতে পারে। বাড়িতে বাড়িতে ফাঁদ পাতা।’

অধ্যাপক হেসে বললেন, ‘আমরা নিলে তো আগেই নিয়ে যেতাম। আপনাদের এত বোঝাতাম না। ও আপনাদের কাছে থাকবে বলেই এত কথা বলছি। ইকোলজিক্যাল একটা ইস্যু আছে। এখানে ধারেকাছে কোনো অভয়ারণ্য নেই। গাজীপুর বা লাউয়াছড়াতে নিয়ে ছেড়ে দেওয়া যায়, তবে কয়েকটি ব্যাপার মাথায় রাখতে হবে। প্রথমত, এই প্রাণীর উপযুক্ত বাসস্থান। সুন্দরবনের বাঘকে লাউয়াছড়ায় ছেড়ে দিলে কী হবে? বেঙ্গল টাইগার ম্যানগ্রোভের প্রাণী। হয় সে মারা যাবে, অথবা অন্য প্রাণীর জন্য ব্যাপকহারে ক্ষতিকর হবে। লাউয়াছড়ার পাশেই লোকালয়, চা-বাগান, তাদের প্রাণ হুমকিতে পড়বে।’

শওকত আলম বলল, ‘কিন্তু ঢাকার চিড়িয়াখানায় তো সব আছে। সারা পৃথিবীর নানান প্রাণী সেখানে একই পরিবেশে থাকে।’

‘চিড়িয়াখানায় কৃত্রিম পরিবেশ সৃষ্টি করা হয়। আর সব প্রাণীর উপযুক্ত খাবার সরবরাহের ব্যবস্থা আছে। তবুও প্রায়ই  দেখবেন প্রাণী মারা যায়। সীমাবদ্ধতাও আছে। যেমন চিড়িয়াখানায় উট নেই, কারণ মরুভূমির সেই পরিবেশ কোথায়? একই কারণে পেঙ্গুইনও নেই। এই প্রাণীটা হয়তো গ্রামীণ পরিবেশেই নেটিভ। আমরা চাই না এর চেয়ে বড় কোনো প্রাণী একে মেরে ফেলুক।’

শওকত আলমের বলতে ইচ্ছে করল, বাঘডাশ বা চিতাবিড়াল টিকে থাকলে হয়তো একে মেরেই ফেলত। তাহলে কি ওদের শেষ করে দেওয়াই উচিত হয়েছে?

‘দ্বিতীয়ত, আমরা ধারণা করছি, এই প্রাণীটির সঙ্গী হয়তো এই বাগানেই বা আশেপাশে কোথাও আছে। এখন আমরা যদি একে আলাদা করে নিয়ে যাই, তাহলে সে একা হয়ে যাবে, বিষণ্ন হবে। মারাও যেতে পারে।’

সামান্য হাসির কলরোল শোনা গেল। একটা জন্তু বিষণ্ন হয় শুনে অনেকেই বেশ মজা পেয়েছে। অধ্যাপক কষ্টজড়িত গলায় বললেন, ‘হাসির কিছু নেই। প্রতিটি প্রাণীর আবেগ আছে। একটা মুরগিকে তার বাচ্চাদের কাছ থেকে আলাদা করে দেখেন কী হয়। দশ বছর একটা গরুকে লালন-পালন করে তাকে বিক্রি করে দেন, দেখেন তার চেহারাটা। যা হোক, আমাজনে আর অস্ট্রেলিয়ায় আগুনে যত প্রাণী মরেছে, তার প্রভাব সারা পৃথিবীকে ভোগ করতে হবে, সেটা বোঝেন?’

‘জি বুজি।’ ফড়ের মা বুড়ি বলে উঠল, ‘আমার গোয়ালঘরে গতবছর কিডা জানি আগুন লাগায়ে দিলো। বাছুরডা মরে গেল। তার ফল আমি এহনো ভুগি।’

‘তাহলে দেখেন, আমাজন হলো সারা পৃথিবীর গোয়ালঘর। সেখানে আগুন লেগে প্রাণী মরলে কী হবে! আপনাদের একটা মুরগি বা গরু মরে গেলে ক্ষতি হয় না? মানুষের বেঁচে থাকার প্রয়োজনেই ওদের আমাদের বাঁচিয়ে রাখতে হবে। ইমাম সাহেব, এ প্রসঙ্গে ইসলাম কী বলে?’

‘জি সুবহানাল্লাহ। আল্লাহপাক একটা প্রাণীও বিনা কারণে সৃষ্টি করেন নাই, সবই মানুষের জন্য নিয়ামত। বিশেষ করে গৃহপালিত পশুপাখি মানুষের জন্য খুবই উপকারী। এগো বাঁচায়ে রাখলি আমাগেই লাভ।’

‘এখন শোনেন, এই প্রাণীটিকে আপনাদের বাঁচিয়ে রাখতে হবে। গ্রামের স্কুল-কলেজের ছেলেরা যাতে একে মেরে না ফেলে। আর এই খবরটা যেহেতু ভাইরাল হয়েছে, আগামীকাল পত্রিকায়ও যাবে, কাজেই পোচারদের নজর পড়তে পারে। সেজন্য পাহারাও বসানো লাগতে পারে। এ বড় বিরল প্রাণী।’

‘কে পাহারা দেবে? পুলিশ?’

‘না, আপনারাই দেবেন। কেউ আছেন  যে বেকার? ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের ফান্ড থেকে তাকে মাসিক ভাতা দেওয়া হবে।’

কোবাদ খোন্দকার গলা উঁচু করে বললেন, ‘বাগানডায় কোর্টের স্টে অর্ডার আছে। ওহানে কারো ঢোকা নিষেধ, যতদিন না মীমাংসা হয়। সাইনবোর্ডও আছে একখান।’

‘কোর্টের অর্ডার ঠিকই আছে’, খানিকটা নাখোশ মনে হলো বন কর্মকর্তাকে, ‘কিন্তু বন্যপ্রাণী আইনও ঠিক আছে। এই যে প্রাণীটা এতদিন আপনার বাগানেই হয়তো ছিল, একে কি আপনি অবৈধ বলবেন? বাগানে পাখি আছে, পিঁপড়া আছে, হয়তো  মৌমাছির চাকও আছে। ওদের ওপর কি আপনি পাহারা বসাবেন? এই স্টে অর্ডার বিবাদ এড়ানোর জন্য দেওয়া হয়েছে। নিজেরা বিবাদ না করলে কোনো সমস্যা নেই। প্রাকৃতিক প্রাণীকে আর কাঠা-একরে বাঁধবেন না। বরং কে পাহারা দেবেন সেটা বলেন। একজন প্রাণীপ্রেমিক ফেসবুকে পোস্ট দিয়েছেন, তিনি কি রাজি হবেন? আছেন আপনি?’

মফিজুর সেখানেই ছিল, তার পোস্ট ভাইরাল হওয়াতে গ্রামে সরকারি লোকজন তাকে দেখতে এসেছে বলে সে আরেকটা পোস্ট টাইপ করছিল। নাম উচ্চারিত হওয়ামাত্র মোবাইল বন্ধ করে ভিড়ে মিশে রইল।

নরেন পাল হাত তুলল। এই মহামারির সময়ে তার চাকরি পড়েছে হুমকির মুখে। কয়েক মাসের বেতন আগে থেকেই বাকি। এখন কারখানা খুললে কবে বেতন হবে তার নাই ঠিক। মালিকপক্ষ ইতোমধ্যে বলতে শুরু করেছে যে, মহামারি তাদের পথের ফকির করে দিয়েছে, কয়েক দশক ধরে কোটি ডলারের মুনাফা তারা শ্রমিক কল্যাণেই ব্যয় করেছে, সরকার কিছু ভিক্ষা দিলে তবে শ্রমিকদের বেতন হতে পারে। সুতরাং সে আগ্রহ করেই এই চাকরিটা নিল। একটা মাচার ওপর একচালা বেঁধে বাগানেই থাকবে। আর দিনের বেলা বাগানের আশেপাশে ঘোরাফেরা করবে। বন কর্মকর্তা বললেন, ‘আমরা এই প্রাণীটির গলায় একটা রেডিও কলার পরাবো আর বাগানটাতে কিছু জায়গায় মোশন সেন্সর বসাবো। কেউ যদি মনে করেন যে আমরা তো এই গ্রামে থাকব না, প্রাণীটাকে মারলে টের পাওয়ার কোনো পথ নেই, সেটা ভুল। সুন্দরবনে বাঘের দিকেও আমরা এভাবে নজর রাখতে পারি, আর এ তো ছোট একটা প্রাণী, দেখেও একেবারেই হিংস্র মনে হয় না। সুতরাং আমি যদি ঢাকায়ও চলে যাই, সেখান থেকেও জানতে পারব এই গ্রামে প্রাণীটা এখন ঠিক কোথায় আছে। বরং প্রাণীটাকে দেখে রাখেন, তাতে সবারই মঙ্গল। আর যদি এই প্রাণীর কোনো ক্ষয়ক্ষতির খবর আমরা পাই, তাহলে কিন্তু গ্রামে পুলিশের বন্যা বয়ে যাবে। অপরাধীকে শনাক্ত করতে না পারলে গ্রামসুদ্ধ বেঁধে নিয়ে যাবো। নরেন, আপনি এখন থেকে সরকারি লোক। ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের পক্ষে কাজ করবেন। প্রাণীটা যেন বিপন্ন না হয়। ধরে নেন, এ এখন এই গ্রামের দায়িত্ব।’

মফিজুলের প্রশ্ন, ‘করোনা ভাইরাসও তো একটা প্রাণ। তা সে বাঁচলি তো মানুষ মরে যাতিছে।’

এবার অধ্যাপক মাইক নিলেন, ‘আপনি খুবই জরুরি প্রশ্ন করেছেন, অনেকেই বিষয়টা বোঝে না। ভাইরাসও একটা প্রাণ। সব প্রাণেরই একটা উপযুক্ত বাসস্থান আছে। করোনার বাসস্থান হচ্ছে কিছু প্রাণীর শরীর। ওই প্রাণীগুলোকে যখন মেরে খেয়ে ফেলা হয়েছে, করোনা তার বাসস্থান হারিয়েছে। ধরেন একাত্তরে যখন এদেশ বসবাসের অযোগ্য হয়ে গেল, বহু মানুষ কী করেছিল? ইন্ডিয়া চলে গেছিল। নতুন বাসস্থানে। রোহিঙ্গারা কী করেছে? করোনাও তাই করেছে। সে মানুষের শরীরে চলে এসেছে। জীবজন্তু-পাখি-গাছপালা-পাহাড়-সমুদ্র-নদী যত অবিকৃত থাকবে, মানুষ ততো নিরাপদে থাকবে। আজ থেকে মাত্র বিশ বছর আগের কথা ভাবেন। বাজ পড়ে এত মানুষ মরতে দেখেছেন? শুনেছেন? এখানে তো অনেক মুরুব্বি আছেন, আপনারা বলেন। এখন কেন এত মরছে? গাছপালা কমে গেছে। বেড়ে গেছে রেডিও অ্যাক্টিভেশন। ইন্টারনেট, রাউটার, মোবাইল টাওয়ার, ফোন এসব দিয়ে আমরা নিজেদের একটা চৌম্বকীয় জালে আটকে ফেলেছি। এটা ঠিক ইন্টারনেট বা অন্তর্জাল নয়, আমি এর নাম দিয়েছি ম্যাগনেটিক নেট, চৌম্বকীয় জাল। এই চুম্বক শুধু তথ্য নয়, আকর্ষণ করছে নানান সংকটও। সুতরাং, এই প্রাণীর দেহে করোনা আছে কি না আমরা জানি না। উপায় একটাই – একে বাঁচিয়ে রাখেন। এ মরে গেলে কিন্তু এর দেহের জিনিস মানবদেহে আশ্রয় খুঁজতে পারে। প্রকৃতি যাকে যেখানে রেখেছে, সেখান থেকে তাকে বিচ্যুত করবেন না, বিপদে পড়বেন।’

শওকত আলমের আবার বলতে ইচ্ছে করল, ওই মোবাইল টাওয়ার ছিল বলেই আপনারা বিলুপ্তপ্রায়-অজ্ঞাত প্রাণীর খবরটা পেলেন।

অধ্যাপকের শ্রেণিকক্ষসুলভ ভাষণে কয়েক ধরনের প্রতিক্রিয়া হলো। বয়স্ক পুরুষ-মহিলারা বুঝদারের মতো মাথা নাড়লেন, প্রৌঢ়-প্রৌঢ়ারা এদিক-সেদিক হারিয়ে যাওয়া বাছুর খোঁজার মতো জিজ্ঞাসুদৃষ্টিতে তাকাতে লাগলেন, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া যুবক-যুবতীরা উদাস চোখে তাকিয়ে আছে, কারণ ইন্টারনেট তাদের বিশেষ আগ্রহের বিষয়, এর চৌম্বকীয় আকর্ষণ সম্পর্কে তাদের সন্দেহ নেই, ক্রমশই তারা সেদিকে আকৃষ্ট হচ্ছে, এর মধ্যে দু-চারজন যুবক-যুবতী খানিকটা নাখোশ। এদের দলে নিয়ামত মোল্লার ছেলে ইমন আর সুখন শেখের মেয়ে ঝুমাও আছে। মামলা চলছে বলে সহজে কেউ ওই বাগানে ঢোকে না, খোন্দকার আর মল্লিকের শ্যেনদৃষ্টি বরাবরই ওখানে আছে। মামলায়  হেরে গেলে পালটা মামলার প্রস্তুতিও আছে দুজনেরই। শুধু অতি দরিদ্ররা মাঝেমধ্যে জ¦ালানি কুড়াতে ঢোকে, তাও চোখে পড়লে ধমক খেতে হয়। এই সুযোগটা গ্রামের কিছু প্রেমিক দম্পতি কাজে লাগায়। স্কুল-কলেজ ফাঁকি দিয়ে বা বিকেলে তারা টুপ করে ঢুকে পড়ে। প্রায় অব্যবহৃত বাগানটা এত গহন, বিশ পা ভেতরে গেলেই আর বাইরে থেকে দেখা যায় না। অসন্তুষ্টের দলে আরো আছে টিটু। সে আশপাশের তিন গ্রামের গাঁজাখোরদের প্রধান। ওই বাগানে পাহারা বসা মানে গাঁজার নিরাপদ আড্ডার পক্ষে হুমকি। এই থানার যুব পরিষদের সভাপতি অসীমও সামান্য তটস্থ। সাড়ে চার বছর আগে প্রতিপক্ষের নেতা একরামকে খুন করে ওই বাগানেই মাটিচাপা দিয়েছিল। তখন কে জানত, এখানে একদিন সরকারি পাহারা বসবে! এখন সেখানে নরেন পাল মাচার ওপর কুঁড়েঘর বাঁধবে এক অচেনা প্রাণীকে পাহারা দেওয়ার জন্য।

একজন বনপ্রহরী কাঁধ থেকে একটা বন্দুক নামাল, গ্রামবাসী ভাবল তাদের ভয় দেখানোর জন্যই নামিয়েছে। কিন্তু সে বন্দুকটা তাক করল বোবা প্রাণীটার দিকে। ছিক করে হালকা একটা শব্দ হলো আর গ্রামবাসী দেখল জন্তুটা দ্রুতই নেতিয়ে পড়েছে। বন কর্মকর্তা, অধ্যাপক এবং বনপ্রহরীরা এগিয়ে গেল ফাঁদের কাছে। লাঠি দিয়ে ঠেলে ধরে জন্তুটাকে বাইরে এনে একটা খাঁচার কাছে রাখা হলো, জন্তুটা গোলগাল হয়ে পড়ে আছে। তার গলায় একটা ঝকঝকে সোনালি রঙের কলার পরিয়ে দেওয়া হলো। দেখে মনে হচ্ছে কোনো ধনী ব্যক্তির পোষা শখের প্রাণী। বন কর্মকর্তার ইশারায় একজন বনপ্রহরী প্রাণীটার ঠোঁট লাঠি দিয়ে উপরে তুলল। ঝকঝকে দাঁত। আবার তাকে ঠেলে ঢোকানো হলো খাঁচায়। আধাঘণ্টার মধ্যে জন্তুটার জ্ঞান ফিরল, নড়াচড়া করল না। খানিকক্ষণ খাঁচার ভেতরটা তাকিয়ে দেখল। নিতান্ত প্রতিবন্ধী মানুষের মতো চাহনী। অধ্যাপক একটা বড় আতসী কাচ নিয়ে খাঁচার বাইরে থেকেই প্রাণীটাকে পর্যবেক্ষণ করতে লাগলেন। বন কর্মকর্তা বললেন, ‘কী অদ্ভুত প্রাণী, তাই না? হঠাৎ কেউ দূর থেকে দেখলে ভাববে একটা নোংরা পাগলকে আটকে রাখা হয়েছে। কীভাবে তাকাচ্ছে দেখেন! চোখদুটো ঠিক মানুষের মতো না হলেও শিম্পাঞ্জির সঙ্গে মিল আছে। চোখের গড়নটাও কেমন কোনাচে, মানুষের মতোই। এই জন্তু রাতে দেখতে পায় বলে মনে হয় না।’

‘তা তো আছেই। সেই সঙ্গে দেখেন, ওর কানের পাশেই একটা ছিদ্র আছে, অনেকটা কান ফোঁড়ানোর ছিদ্রের মতো। আমার সন্দেহ হচ্ছে, ওগুলো ফুলকা; প্রাণীটার উৎস মনে হচ্ছে পানি, অন্তত উভচর হবে।’

‘ইন্টারেস্টিং! ঠিকই বলেছেন, পা দেখেন। হাঁসের পায়ের মতো আঙুলগুলো পর্দা দিয়ে জোড়া। মানে কী? এ কি হাঁটতেও পারে আবার হাঁসের মতো সাঁতারও দেয়?’

ইরাজ মণ্ডল এগিয়ে এসে বলল, ‘স্যার, জালে ধরা পড়ার পরেত্তে একবারও ছাড়া পাওয়ার চেষ্টা করেনি জন্তুডা।’

অধ্যাপক একটু ঝুঁকে একনজর দেখে বললেন, ‘কানের ওপরটাও ঠিক বন্যপ্রাণীর মতো তিনকোনা নয়। বেশ গোলাকার। পান্ডার মতো অনেকটা। মুখের গঠনটা দেখেন, সামনে থেকে দেখলে মনে হয় মানুষের মতো ফ্ল্যাট, আবার একপাশ থেকে  দেখলে খানিকটা লম্বাটে, হায়েনার মতো। দাঁতগুলো অবশ্য খুব একটা মাংসাশী প্রাণীর মতো নয়। মনে হয় ঘাসটাসই বেশি খায়, তবু দু-পাশে শ্বদন্ত দুটো কম বড় নয়। তবে অদ্ভুত ব্যাপার হলো, প্রাণীটা কোনো শব্দ করছে না।’

কোবাদ খোন্দকার বললেন, ‘এই কলার কি থাকপে? জন্তু তো, দৌড়াবে, গাছে ঘষা খাবে, অন্য জন্তুর সঙ্গে মারামারি করবে, কলার যদি খসে যায় তা’লি তো আবার আমাগে দোষ দেবেন।’

বন কর্মকর্তা তাচ্ছিল্যমাখা হেসে বললেন, ‘বন্যপ্রাণীর গলায় পরানো হবে, এই চিন্তা করেই কলারটা বানানো হয়েছে। জন্তু নাও থাকতে পারে, কলারের কিছু হবে না।’

বনপ্রহরীরা বন কর্মকর্তা আর অধ্যাপকের পেছন পেছন খাঁচাটা নিয়ে এলো মল্লিক-খোন্দকার বাগানে। পেছনে গ্রামবাসী। এমনকি দুধের শিশু কোলে নিয়ে সদ্যপ্রসূতিরাও এসেছে। বাগানে খানিকটা  ঢুকে বন কর্মকর্তা পেছন ফিরে গ্রামবাসীকে ইশারায় দূরে থাকতে বললেন। বনপ্রহরীরা এবার সত্যিকার বন্দুক নিয়ে তৈরি হলো আর একজন খাঁচার দরজাটা উঁচু করে ধরল। জন্তুটা সঙ্গে সঙ্গে বেরোল না, নির্বিকার বসে রইল খোলা দরজার দিকে তাকিয়ে। খানিক পরে পেছন দিকে তাকিয়ে লোকজন দেখল, মায়ের কোলে সদ্যজাত শিশুকে দেখল, বন কর্মকর্তার মুখের দিকেও তাকাল একবার। তারপর যেন খানিকটা অনিচ্ছা নিয়েই কিছুটা হেলেদুলে বেরোল, ভাব দেখে মনে হয় সে বুঝতে পেরেছে খাঁচাটা তার স্থায়ী বাসস্থান নয়, তাকে সেখানে কেবল আতিথ্য দেওয়া হয়েছিল। ঝকঝকে কলারটার অস্তিত্ব সম্পর্কে তাকে একেবারেই সচেতন মনে হলো না। প্রাণীটাকে গোটানো অবস্থায় যেমন ছোট মনে হচ্ছিল, আসলে তার চেয়ে বেশ বড়। সাত-আট বছরের একটা শিশুর মতো। আবার পেছনে তাকাল, বনপ্রহরী নিখুঁত নিশানায় অস্ত্র তাক করে আছে, জন্তুটা হিংস্রতা দেখালে এর বুক বরাবর সিসা ঠুকে দিতে হবে। হিংস্র প্রাণীর জন্য মানুষ মারা পড়তে পারে না। সব প্রাণীকেই বাঁচানো যেতে পারে যদি মানুষ বাঁচে তো। গ্রামবাসী স্থির, কার কোলে যেন একটা সদ্যজাত শিশু কেঁদে উঠল। সঙ্গে সঙ্গে জন্তুটা হঠাৎ সামনের দু-পা উঁচু করে প্রায় মানুষের মতো নব্বই ডিগ্রি সোজা হয়ে বেশ কয়েক গজ দৌড়ে এগোল, তারপর আবার চারপায়ে ভর দিয়ে দৌড়ে একটা গাছে উঠে অদৃশ্য হয়ে গেল। 

বাগানের সামনে কোর্টের স্টে অর্ডারের পাশে কোবাদ খোন্দকার আর হাসু মল্লিকের হতাশ-নারাজ চোখের সামনে বন বিভাগের একটা সাইনবোর্ড বসল, ‘বিরল প্রাণীর অভয়াশ্রম, প্রবেশাধিকার সংরক্ষিত।’

যন্ত্র

দুই সপ্তাহ ধরে নীরব বাগান পাহারা দিতে নরেন পালের ভালোই লাগছে। দিনের বেলা সে প্রায়ই বাগানটার আশপাশে এবং ভেতরে হাঁটাহাঁটি করে। মাঝেমধ্যে তার ছোট মেয়েটাকেও নিয়ে আসে। বাগানটা পেরিয়ে একটু সামনে গেলেই রাস্তার ধারে সুরেনের চায়ের দোকান। বিকেলে সেখানে চা খায়। দু-চারটা বিড়ি কিনে ট্যাঁকে গোঁজে। সন্ধ্যার একটু পরেই রাতের খাবার খেয়ে একটা হারিকেন, লাঠি আর টর্চ নিয়ে সে বাগানে আসে। মশারিটা থাকে কাঁধে ঝোলানো। মশারি রেখে যাওয়া বিপজ্জনক, পোকামাকড়ে ভরে যায়। বাড়িতে নিয়ে ঝেড়ে রোদে টানিয়ে রাখা হয় সারাদিন। প্রথম কিছুদিন একটা চার্জার লাইট এনেছিল, তাতে ভালোই আলো হতো, তবে চার্জ থাকে না বেশিক্ষণ, ঘণ্টা তিনেক পরেই মিটমিট করতে থাকে আর চার ঘণ্টার মধ্যে নিভে যায়। এর চেয়ে হারিকেনের আলো মøান হলেও দীর্ঘস্থায়ী। কেরোসিন টেকে অনেকক্ষণ। পায়ের কাছে হারিকেন জ্বলে। রাতে খুব একটা ঘুমায় না নরেন পাল। ছাড়া ছাড়া ঘুম, মাঝেমধ্যেই টর্চ জ্বালিয়ে আশপাশে দেখে নেওয়া। গ্রামের সদ্য পাকা হওয়া রাস্তাটা দিয়ে  মোটরসাইকেলের আওয়াজ, রিকশাভ্যানের টুনটুন, গান শুনতে শুনতে যাওয়া পথিকের মোবাইলের আওয়াজ শোনা যায় রাত নয়টা পর্যন্ত। লোকালয় পাশেই; কিন্তু চোখে পড়ে না, অথচ লোকালয়ের আভাস মেলে। ক্লান্ত না লাগলে অন্ধকারেই খানিক হাঁটাহাঁটি করা। আর নিভিয়ে নিভিয়ে একেকটা বিড়ি টানা। তিনটে বিড়ি হলে তার এক রাতের খোরাক হয়। মাঝেমধ্যে বৃষ্টি নামে। নরেনের একচালায় কিছুটা পানি ঢোকে। তবে সে পাত্তা দেয় না। সে শোনে বৃষ্টি নামলে কীভাবে পুরো বাগান অদ্ভুত নিস্তব্ধ হয়ে যায়। নিশাচররা সবাই চলাচল বন্ধ করে দেয়। চঞ্চল হয় শুধু গাছের পাতারা। জলের পতনে অদ্ভুত শব্দে থরথর করতে থাকে ওরা।

ইতোমধ্যে নরেন পাল এই বাগানে বেশকিছু আনাগোনার সাক্ষী হয়েছে। প্রথমে দেখেছে এক চোরকে। বাগানের লিচুগাছটা খালি করে দিচ্ছে। সম্ভবত দূর থেকে এসেছে, পাহারাদার আছে সেটা জানা নেই। অথবা পাহারাদার থাকলেও সে নিরুপায়। গাছের আগায় মৃদু শব্দ শুনে তার মনে হলো বোধহয় কোনো পাখি অথবা সেই জন্তু। নরেন হাঁটতে হাঁটতে টর্চের আলোয় একবার দেখল তাকে, তারপর মসৃণভাবে টর্চের আলোটা অন্যদিকে ঘোরাতে ঘোরাতে গাছটা পার হয়ে গেল। বছর দুয়েক আগে হলে সে চেঁচিয়ে পুরো গ্রাম এক জায়গায় করে চোরকে ‘পাবলিকের মাইর’ দিত। ঢাকায় থাকার কারণে চুরিচামারি দেখে নির্বিকার থাকার ভালোই অভ্যাস হয়েছে। খানিক সামনে গিয়ে বেশ হাসতে লাগল নিজেই। চোরটা নিশ্চয় ভয়ে সিঁটিয়ে গিয়েছিল। সে চৌকিদার না, চোর ধরার কাজ নিয়ে এখানে আসেনি। এখন সে সরকারি চাকরিজীবী, একটা বিরল জন্তুর নিরাপত্তা নিশ্চিত করছে, যার বেঁচে থাকা মানুষজাতির জন্য খুব দরকার। আর সে চোর ধরবেই বা কেন? সরকারি সাইনবোর্ড বলছে এখন পর্যন্ত বাগানটা কারো নয়। যা কারো নয়, সেটা নিশ্চই সবার। অন্যের জিনিস নিলে চুরি হয়, তা ভগবান তো পাহারা বসাননি। যেমন সে যে গার্মেন্টে কাজ করত, সেটা শুধু মালিকের। আর কারো নয়। ওখানে শ্রমিক আসে, শ্রমিক যায়, চাকরি দেওয়া হয়, নেওয়া হয় এবং এর কোনোকিছুর পেছনে নরেন পালদের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। তারা শুধু মেশিন নিয়ন্ত্রণ করে। আর তাদের নিয়ন্ত্রণ করে মালিক, ঠান্ডা ঘরে বসে সিসি ক্যামেরায় শ্রমিকদের ওপর নজর রাখে।

এরপর একদিন সে দেখে ফেলল এক প্রেমিক দম্পতিকে। তখন মাত্র সন্ধ্যা। নরেন পাল বিড়ি ট্যাঁকে গুঁজে হারিকেনটা নিতে এসেছে বাড়ি নিয়ে তেল ভরবে বলে। মাচার দিকে যাচ্ছিল, তখনই সে হাত পঞ্চাশেক ডানদিকে খসখস আওয়াজ শুনল। নরেন ধরে নিল সেই জন্তুটিই হয়তো। ইদানীং এই একটা পরিস্থিতি হয়েছে। যে-কোনো শব্দকেই মনে হয় বিরল প্রাণীর শব্দ। এই বাগানের সব দৃশ্য এবং শব্দ যেন একটি একককেই নির্দেশ করছে। সে টর্চ জ্বালল না। একটা ঝোপের মধ্যে উবু হয়ে বসে জ্যৈষ্ঠের সন্ধ্যায় প্রায়-অব্যবহৃত বাগানের ছায়ায় সে দুটি ছায়ামূর্তি দেখল। তাদের শরীরের নিচের অর্ধেক ঝোপে ঢাকা পড়ে আছে, ওপরের অর্ধেকে দেখা যাচ্ছে ছায়ামূর্তি দুটোর একজনের বুক উঁচু, চুল লম্বা। হাত ধরাধরি করে আছে। দুজনের মুখ খুব কাছাকাছি। একেবারে একরৈখিক একটা ছবি। তবে নরেন পালের কী হলো, সে দুই হাত, দুই মুখ আর দুই বুকের মাঝখান দিয়ে যে গাছ আর ঝোপঝাড়ের শূন্য-সবুজ একটিমাত্র আকৃতি ফুটেছে সেদিকে তাকিয়ে ফেলল। প্রেমিক যুগলের মাঝখানে যেন ঠিক সেই জন্তুটির অবয়ব ফুটে আছে। কেবল নাক-মুখ নেই, তবে কানের ওপরদিকের গোলাকার                                                     আকৃতিটা শূন্যের মধ্যেই স্পষ্ট আকৃতি পেয়েছে  প্রেমিকের বগলের কাছে। নরেন অন্যদিকে তাকিয়ে সোজা হেঁটে হারিকেন নিয়ে বাড়ি গেল। প্রেমিক বা প্রেম খেদানো তার কাজ নয়। তার কাজ জন্তুটিকে পাহারা দেওয়া। বাড়ির পথে হাঁটতে হাঁটতে ভাবল, জন্তুটার কান ওপরদিকে গোলাকার বলে অধ্যাপক তাকে পান্ডার সঙ্গে তুলনা করলেন, মানুষের কানও তো ওপর দিকে গোল, তা তিনি নিজের সঙ্গে কেন মিল পেলেন না? নরেন নিজের কানে হাত বোলাতে শুরু করল এবং জানল না যে এই কানছোঁয়া তার মুদ্রাদোষে পরিণত হবে। 

সে-রাতেই নিয়ামত মোল্লা মোটরসাইকেলের ঝাঁঝালো আলো বাগানে  গেঁথে দেওয়ার চেষ্টা করে বাইরে থেকে ডাক দিলেন, ‘নরেন আছিস নাহি?’

নরেন মাচা ছেড়ে বাগানের চৌকাঠে এসে দাঁড়াল, ‘কী কাকা?’

‘বাগানে আইজ কেউ আইল নাহি?’

‘না কাকা। কেন?’

‘কিছু দেহিসনি?’

‘না কাকা।’

‘আমার তো মনে কয় দেহিছিস। মিথ্যে কথা কচ্ছিস না তো?’

‘বাগানে গাছপালা আর পাখি ছাড়া কিছু দেহিনি, কাকা। এই বাগানের সব জন্তু মনে হয় আমরা মাইরে ফেলাইছি।’ নরেন কানের ওপর হাত বুলিয়ে গোলাকৃতি অনুভব করছে।

‘বুজিস। ফাও কথা কইস না। তোরে আমার সন্দেহ হয়। সুখন শেখের মাইয়েরে দেহিসনি কারো সঙ্গে?’

‘আমি কেউরে দেহিনি। একা মানুষ, একদিক হাঁটলি বাকি তিনদিক তো আর দেখতি পারি না।’

‘যদি জানতি পারি তুই মিথ্যে কতিছিস, তোর খবর আছে, এমন কষা দেব! বালের বাগান, বালের স্টে অর্ডার। বাগানে কেউ ঢোকপে না। এহ্! যে-বাগানে মানুষ ঢোকে না, সেহানে জেনা শুরু হয়। তুই হিন্দু, তোগো ধর্মে তো জেনা নেই। কিন্তু এহানে বেশিরভাগ মুসলমান। তাগো ধর্মরে সম্মান দিয়ে চলবি।’

‘সম্মান দিই কাকা। আমি কেউরে দেখলি ক’বানে।’ তার ধর্মে জেনা আছে কি না তার জানা নেই।

কিছুদিন পরে এক দুপুরে এলেন কোবাদ খোন্দকার, ‘নরেন, পশ্চিম কোনায় আমার লাগানো কয়ডা শিরীষ গাছ আছে। এট্টু দেহে রাহিস বাপ। কাঠের মেলা দাম।’

‘জে কাকা, দেহে রাখপো। কাইল দেখলাম ঠিকই আছে। মেলা বড় হইছে। আপনি একবার দেহে যান না, অসুবিধা কী?’

‘আরে না, মল্লিকবাড়ির কেউ দেখলি মহাসর্বনাশ হবেনে। স্টে অর্ডারের মদ্যি বাগানে ঢুকলি শেষে আরেক মামলা খাবো। যাই রে। তুই এট্টু দেহিস। তোর কানে কী হইছে? পোকা কামড়াইছে নাকি?’

একবার হাসু মল্লিকও এসেছিলেন, তার লাগানো তেঁতুলগাছগুলোর একটাতে নাকি মৌমাছি চাক বেঁধেছিল। কাজেই সেই মৌচাক তারই প্রাপ্য। চাকটা আর কেউ নামাতে এলে যেন সে ত্বরিত মল্লিক বাড়িতে খবর পাঠায়। মধুর অনেক দাম।

নিয়ামত মোল্লার ছেলে ইমন একদিন চুপিসারে দেখা করতে এলো, ‘নরেনদা, আপনি কি গত শুক্কুরবারে কিছু দেহিছেন?’

‘কী দ্যাখপো? এহন তো আমি বাগান ছাড়া কিছু দেহি না।’

‘সত্যিই কিছু দ্যাহেননি? আব্বা যে ক’লো আপনি দেহিছেন?’

‘কী দেহিছি?’

‘সত্যি কেউরে দ্যাহেননি?’

‘না তো। ও, সেইদিন ইবাদত আলীর ছোট মেয়েডা কয়ডা পাতাপুতা কুড়োতি আইলো। তা দিছি দাবড়ানি।’

‘আচ্ছা, ঠিক আছে।’

‘কী হইছে কও দেহি?’

‘কিছু হইনি। আচ্ছা যাই।’

ইমন চলে যেতে যেতে কয়েকবার পেছনে তাকাল। নরেন পালও হাসিমুখে চেয়ে রইল। শেষে ইমন আবার ফিরে এলো, ‘নরেনদা, এই দুইশো টাহা রাহেন। সারাদিন বাগানে থাহেন, কহন কী খান না খান।’

‘কীসির টাহা? আরে আমি তো বাড়ি যাইয়ে খাইয়ে আসি। তুমি কী কতি চাও তা বুজিছি। আমি কিছু দেহিনি। দেখলিও  কেউরে কবো নানে। ওই জন্তুডারে না দেখা পর্যন্ত আমি আর কিছুই দ্যাখপো না।’

‘টাহাডা রাহেন। অসুবিধা নেই।’ বলে ইমন আর দাঁড়াল না। টাকা যেহেতু গছিয়ে দেওয়া গেছে, নরেন আর কিছু বলবে না।

একটা একশ, একটা পঞ্চাশ, দুটো বিশ আর একটা দশ টাকার নোট। নরেন পাল সেদিকে তাকিয়ে রইল। বহুদিন টাকার অভাবে সিগারেট খাওয়া হচ্ছে না। বিড়ি আর কদ্দিন?

রাতদুপুরের পরে একদিন টিটু এলো, ‘নরেন! এ নরেন! মরিছিস!’

‘কিডা!’ হারিকেনের আগুন বাড়িয়ে দিলো নরেন।

‘আমি। তোর কুঁড়েয় এট্টু বসলাম।’  দেরি না করে টিটু বসে গেল। পকেট থেকে একটা মাথা-প্যাঁচানো সিগারেট বের করে বলল, ‘ম্যাচ দে। খাবি?’

‘আপনি খান। সিগারেট আছে আমার।’

‘আরে ইডা সিগারেট না। গাঞ্জা। খাইস তুই?’

‘ঢাকায় খাইসি দুই-একবার।’

‘নে টান।’

‘আপনি টাইনে দেন।’

কিছুটা আসর হওয়ার পরে টিটু শুরু করল, ‘তুই গাঁজারে সিগারেট ক’লি কেন, শালা?’

‘অন্ধকারে বুজিনি। দেখতি তো সিগারেটের মতো।’

‘আমি গাঁজা খাই, তুই জানিস না?’

‘জি না।’

‘চোপ শালা মালায়ন! ‘জি’ কীরে! তুই কবি ‘আজ্ঞে’, ‘জি’ কবো আমরা। আমরা মুসলমান। এই দ্যাশ আমাগো। আশি পার্সেন্ট মুসলমান, শালা!’

‘আজ্ঞে, ঠিক কইসেন।’

‘এহন ক, গাঁজারে সিগারেট ক’লি কেন? এমনিই তো এহানে আস্তানা গাঁড়িছো, শালা! গাঁজার আড্ডা ভাইঙ্গে দিসো। এহন আবার গাঁজার ইজ্জত দইরে টানলি।’

‘আপনি রোজ আইসে গাঁজা টাইনে যাবেন, অসুবিধা কিছু নেই।’

‘শাবাশ মালায়ন! শাবাশ! এরে কয়  দেশপ্রেমিক! তোরা গাঁজারে কইস শিবের প্রসাদ! এএএএহ! গাঁজা হলো সুফিগো ফানাফিল্লায় যাওয়ার পথ। বুজিস শালা মালায়ন!’

‘আজ্ঞে।’

‘এই বাগানে জিন আছে। যেদিন তোরে উলটো করে এই কুঁড়ের সঙ্গে ঝুলোয়ে রাখপেনে, সেইদিন বুজবিআনে। তোর আকাটা ধোন ঝোলবেনে উলটো হয়ে।’

কাছেই কোথায় খোঁ খোঁ খোঁ করে একটা শব্দ উঠল। টিটুর গাঁজায় ধরা মাথা কাঁপতে লাগল, ‘কী রে ওডা? ওডা কী?’

‘আরে কিছু না, বনবিড়েল-টিড়েল হবে! ঝগড়া লাগাইসে। আপনি টানেন।’

‘ওডা কীরে? আবার ডাকতিসে।’

‘কই, আর ডাকে না তো!’

‘আরে ওই তো আবার ডাকল! তুই আমারে বাগানের বাইরি দিয়ে আয়, নরেন! বাড়ি দিয়ে আয়!’

‘আরে আপনি খালি খালি ভয় পাতিসেন। কিচ্ছু না।’

‘ওরে জলখাসিখেকোর বাচ্চা, আমারে বাড়ি দিয়ে আয়!’

সে-রাতে শুয়ে নরেন পালের মনে হলো, সবাই যার যার মতো করে তাকে নিজস্ব পাহারাদার ভাবছে, বন বিভাগের আরোপিত দায়িত্ব পাওয়ায় হয়তো শত্রুও মনে করছে। কিন্তু যে-কারণে সে এই বাগানে থাকা শুরু করেছে, সেই জন্তুটির কথাই এখন পর্যন্ত কেউ একবারও জিজ্ঞেস করেনি। অবশ্য সে জানেও না জন্তুটি কোথায়। বাগানে সে বহু পাখি দেখেছে, পাখির বাসা-ডিম-ছানাও দেখেছে। শিয়ালের দৌড়ে যাবার শব্দ শুনলেই লাঠি দিয়ে আওয়াজ করেছে নরেন পাল। মাচার ওপর তার কুঁড়েঘরটার খুঁটিতে কোনো প্রাণী যেন প্রতিরাতে গা ঘষে, ঘর সামান্য দোলে। নরেন পালের দেহে আরাম লাগে, উঠে তাড়াতে ইচ্ছে করে না, শৈশবে মা তাকে এভাবেই দোলাতো কি না সে ভাবে। তবু কয়েকদিন মেঝেতে লাঠির বাড়ি দিয়ে ভয় দেখিয়েছে, এখন আর দেখায় না। তার ভাবতে ভালো লাগে যে, বিরল প্রাণীটা গা ঘষে অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে এবং নরেন পালের উপস্থিতি পছন্দ করছে। সে ঘষার তালে তালে কানের ওপর হাত বোলায়। তবে প্রধান উদ্দেশ্যের দেখা এখনো পায়নি। কয়েকবার কুঁড়ের নিচে উঁকি দিয়েছে, তবে কিছুই দেখা যায়নি। সেই জন্তু আর একবারও কারো সামনে পড়েনি। এখন পর্যন্ত সে এমন কোনো পাখি বা জন্তুর  আওয়াজ শোনেনি, যে-ডাক সে চেনে না। 

দু-বছর আগে গার্মেন্টের চাকরি নিয়ে ঢাকায় যাওয়ার আগে সে বছর ছয়েক মোজাফফর কাজীর চিংড়ির ঘের পাহারা দিয়েছে। এর চেয়েও নির্জন সেই জায়গা, গ্রাম থেকে দূরে ধু-ধু বিলের মধ্যে পানির ওপর মাচা বেঁধে জেগে থাকা। রাতকাবারি তিরিশ টাকা পেত। তখন কোলাহলের জন্য মন আকুপাকু করত। গ্রাম নির্জন, নিশীথ ঘের আরো নির্জন। সে পরিত্রাণের জন্য ঠাকুরের কাছে প্রার্থনা করত। ঠাকুর তার প্রার্থনা শুনলেন। সরাসরি পাঠিয়ে দিলেন গার্মেন্টে, যেখানে এক মুহূর্ত  কোলাহলের বিরাম নেই। মানুষ থামলেও যন্ত্র থামে না। বউকেও কোনোরকমে সেখানে ঢুকিয়ে গ্রামের পাট চোকানোর পরিকল্পনা ছিল নরেনের। করোনা আসার পরে চাকরি হুমকিতে পড়ে গেল। সব বন্ধ। প্রথম সুযোগেই চলে এলো গ্রামে। এখন এই রাতভর নির্জনতা তার ভালোই লাগে। ঘুম ছাড়াছাড়া হলেও ক্লান্তি আসে না। ঘের পাহারা দেওয়ার অভিজ্ঞতার কারণে ভয়ডরও কম। চাকরিতে চাকরিতে কত তফাৎ! নরেন পাল প্রায়ই শুয়ে শুয়ে ভাবে। গার্মেন্টের চাকরিও চাকরি, বিলুপ্ত জন্তু পাহারা দেওয়াও চাকরি। পার্থক্য শুধু নির্জনতা আর কোলাহলের। কোলাহলের চাকরি নাও থাকতে পারে বলে শোনা যাচ্ছে। ঢাকায় শ্রমিক-বিক্ষোভ হচ্ছে বেতন-ভাতার দাবিতে। কিছু গার্মেন্ট থেকে ব্যাপক হারে ছাঁটাই করা হচ্ছে। বিজিএমইএ শুরুতে বলেছিল ছাঁটাই হবে না। তবু হয়েছে। এখন বিজিএমইএও বলছে, ছাঁটাই ছাড়া পথ নেই। কী হবে কে জানে! তার সহকর্মীর ভাষায়, ‘বুজস না! ক্যাপিটালে হাত দিবো না। লাভ হইলে বেতন দিবো, নাইলে কানবো। কিন্তু নিজেগো লাভ এদিক-সেদিক করব না।’ 

কদিন আগে পর্যন্ত এসব ভেবে তার খুব দুশ্চিন্তা হতো, রাতে উঠোনে হাঁটাহাঁটি করত। স্টে অর্ডার লাগানো বাগানে থাকা শুরু হবার পর থেকে ওই দুশ্চিন্তা আর হচ্ছে না। আর এই বিলুপ্ত জন্তু পাহারা দেওয়াও অস্থায়ী। কবে এই জন্তু মরে যাবে অথবা বন বিভাগের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী কোনো অভয়ারণ্যে পাচার হবে, তার চাকরিও যাবে। জন্তুটার দেখা পেলে বরং তাকে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করা যেত। নরেন পাল বাড়ি থেকে একথালা ভাত এনে রোজই তার কুঁড়ে থেকে খানিকটা দূরে রেখে আসা শুরু করল। সকালে দেখা যেত সেই ভাত চেটেপুটে খেয়ে ফেলা হয়েছে। ওই জন্তুটা খেয়েছে কি না বলার উপায় নেই। এই জন্তুর আয়ু কত কে জনে? জন্তুর দেখা না পেলেও মোশন সেন্সর দেখেছে নরেন পাল। বিভিন্ন গাছে বসানো আছে। সে এই বাগানে রাতের পর রাত কাটিয়েও যার দেখা পাচ্ছে না, বন কর্মকর্তা কি শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত অফিসে বসে সেই জন্তুর গতিবিধি দেখতে পাচ্ছে? অদ্ভুত লাগল নরেন পালের কাছে। সেই জন্তু যে এখনো এই বাগানেই আছে, তারই বা প্রমাণ কী? অবমুক্ত করার পরে আর কেউ তাকে দেখেছে বলে শোনা যায়নি। আর জন্তুটা কি আসলেই মুরগি খায়? মুরগির খাঁচার সামনে জালে আটকা পড়েছে বলেই তাকে মুরগিখেকো নাম দেওয়া কি ঠিক হবে? জন্তুটা আর কারো ফাঁদে আটকা পড়েনি, আবার কারো মুরগি হারানোর খবরও পাওয়া যায়নি। বরং জন্তুটা ভাতই খায় বলে সবাই দেখেছে। অবশ্য এই বাগান থেকে বেরিয়ে আরেকটা বাগানে ঢুকতে হলে ওটাকে অনেকটা পথ পাড়ি দিতে হবে। দিনের বেলা নির্ঘাৎ মানুষের নজরে পড়বে। রাতে অবশ্য যাওয়া সম্ভব। জন্তুটা নিশাচর কি না তাও তো বোঝা যাচ্ছে না। অধ্যাপক অবশ্য বলেছিলেন, এর চোখ দেখে মনে হয় রাতে দেখতে পায় না। তবু সন্দেহ যাচ্ছে না নরেন পালের। সবার চোখ এড়িয়ে সে যদি এই বাগানে ঢুকে পড়তে পারে, তাহলে বেরিয়েও কি যেতে পারে না, নাকি এই বাগানেই জন্মে সে এতদিন নজরআন্দাজ থেকেছে? শওকত আলমের ছেলেটা ঘটনাক্রমে তাকে দেখে না ফেললে তো এই বাগান একরকম অভয়ারণ্যই ছিল, মানুষের নজরে পড়েছে কি পাহারা বসেছে। নরেন পাল রাতে শুয়ে শুয়ে এসব ভাবে আর নানান পরিচিত শব্দ শোনে। জন্তুটা যদি বেরিয়ে গিয়ে থাকে, তাহলে তো সে এই বাগানে নেই। যা নেই, সে কি তাকেই পাহারা দিয়ে যাচ্ছে? তবু কিছু পয়সা তো আসছে। মাসশেষে ঠিকই তার নামে বিকাশে দুই হাজার টাকা এসেছে। উপজেলা সদরে গিয়ে সে ভাঙিয়েও এনেছে। গ্রামে দুই হাজার টাকা তার জন্য কম নয়। বাসাভাড়া নেই, ঝোপজঙ্গলে একটু খুঁজলেই হেলেঞ্চা কি ঢেঁকিশাক পাওয়া যায়। ডোবানালায় দুবার জাল ফেললে দু-চারটা ছোট-বড় মাছ হয়। তার বউয়ের মুরগিগুলো মোটামুটি ডিম দেয়। তার কিশোরী মেয়ে সেগুলো সাপ্তাহিক বাজারে নিয়ে যায়। ঢাকায় সাড়ে ছয় হাজারেও তার একার কুলোয় না। ঘুমের মধ্যেও টাকা খরচ। মাথার ওপর ফ্যান ঘুরছে, টাকা উঠছে; পানি ব্যবহার করছে, টাকা উঠছে; রান্না হচ্ছে, টাকা উঠছে। তবু তার মনের ভেতর দোলাচল চলে। প্রাণীটা আছে কি নেই কে জানে, সে কেন বাড়ি ছেড়ে বাগানে শুয়ে থাকে? কুৎসিতদর্শন হতে পারে, তবু একটা বাড়ি তো তার আছে! জন্তু না থাকে না থাকুক, তার চাকরি তো আছে! এই মহামারির সময়ে মাসে দুই হাজার টাকা নেহাত ঠাকুরেরই কৃপা। আর গার্মেন্টের চাকরিই বা সে কেন করছে? কী পেয়েছে? অপুষ্টিতে তার শরীর আরো দুর্বল হয়েছে। সত্যিই, গার্মেন্টের চাকরিটা কেন করত, সে ভেবে পেল না। জন্তুটা যদি মারাও যায়, আর নরেন পাল যদি সেই মৃতদেহ পায়, তাহলে গোপনে পুঁতে ফেলতে হবে। যদিও রেডিও কলার আর মোশন সেন্সর দিয়ে বোঝা যেতে পারে যে, জন্তুটা নড়াচড়া করছে না, তবু একটা চান্স নিতে হবে। বিরল প্রাণী মৃত অবস্থায় আবিষ্কার হওয়ার চেয়ে গুম হয়ে যাওয়া ভালো, তার চাকরিটা থাকবে। আরো কিছুদিন পরে পুরো ব্যাপারটা তার কাছে অবাস্তব মনে হতে শুরু করল। সন্ধ্যার পর বাগানে ঢোকার পরেই তার জগৎ বিবর্তিত হয়। বাগানের বাইরের সমাজ যেন তার প্রতি বিচ্ছেদ ঘোষণা করে। পরিচিত গ্রামীণ শব্দের মধ্যে বিশ্বাস জন্মে, সে বিলুপ্ত কিছুকেই পাহারা দিচ্ছে, এমন কিছু, যা আসলে নেই। আর সেই অবাস্তবই তার কাছে সবচেয়ে জীবন্ত মনে হয়।

একরাতে ঘুম ভেঙেই নরেন পালের অসাড় শরীরে ঝাঁকুনি লাগল। হিজল গাছের যে-ডালটা তার কুঁড়ের কাছে ঝুঁকে আছে, সেখানেই একজোড়া কয়লা-রঙিন চোখ তার দিকে চেয়ে আছে। রাগানি¦ত? না। বরং কৌতূহলী বলা যায়। নরেন ভয় পেয়েছিল কি না সে বলতে পারে না, তবে নিমিষের মধ্যে টর্চটা ছোঁ মেরে নিয়ে আলো ফেলেছিল। ঠিকঠাক দেখার আগেই কেউ একজন একলাফে মাটিতে পড়ে ফটফট শব্দে দৌড় দিলো।

যন্ত্র ও জন্তু

হঠাৎ করেই নরেনের এই দোলাচল-জীবনে বাধা পড়ল। ঢাকা থেকে খবর এলো, গার্মেন্টে যোগ দিতে হবে, নইলে চাকরি না থাকার নিশ্চয়তা। বেতনের নিশ্চয়তা অবশ্য নেই। নরেন পাল খুব দ্বিধায় পড়ে গেল। এখানে মাসে নিশ্চিত দুই হাজার টাকা পাচ্ছে, চলে গেলে পাবে না। আবার এই চাকরি অতি অনিশ্চিত, গার্মেন্টে গেলে তাও চাকরিটা থাকবে। কে জানে কবে বন বিভাগ বলে বসবে যে – জন্তুটা আর এই গ্রামে নেই। সুতরাং বিকাশ অ্যাকাউন্ট শূন্য। হাসু মল্লিক আর কোবাদ খোন্দকার দুজনেই নরেন পালকে উস্কে দিলো ঢাকায় ফিরে যেতে, ‘আরে ছাগল, কীসির আশায় এই বাগানে থাকপি? কবে ওই জন্তু মরে গেইছে! তুই যে প্রায় সাড়ে দুই মাস বাগানেই থাকলি, জন্তুডারে দেখলি কোনোদিন! একদিন তো দেখপি!’

নরেন পাল বলে, ‘কিন্তু সেই স্যাররা তো কিছু কইনি। তাগো তো জানার কথা। কী কী সব যন্তর দিয়ে গেল গেরামে!’

হাসু মল্লিক হাসে, ‘হে হে হে। সরকারি অফিসারগো চিনিস? তারা গার্মেন্টে কাজ করে না যে কাজ নেই তো বেতন নেই। তাগো কাজ যে করে হোক চাকরিডা বাগানো। তারপরে কাজ করুক না করুক বেতন আসে।’

‘তা’লি পরে আমিও তো সরকারি। সরকারি অফিসারই তো নিয়োগ দিছে আমারে।’

‘ধুরো বোকা’, কোবাদ খোন্দকার কটাক্ষ করে, ‘তোর তো এই পাহারা দেওয়ারই কথা না। এরাম কোনো পদ সরকারি তালিকায় নেই। এই পাহারা তাগোই দেওয়ার কথা। তোরে তারা পোছেও না। কয়দিন পরেই শুনবি তুই নেই।’

হাসু মল্লিক উসকায়, ‘আর নিজির গেরামে চাকরি! কেমন না! চাকরি করবি ঢাকায়। চিন্তা করে দ্যাখ, ওই বাগান কোনোদিন অফিস হতি পারে? অফিসির সঙ্গে কোনো মিল আছে এর? পশ্চিম পাড়ার শোয়েব মুন্সীর করোনা হইছে শুনিছিস না? ওই জন্তু আসার আগে করোনা ছেল এই গ্রামে? ইমাম নয় পিরসাহেবের মাসালা শুনলি পরে করোনা ঢোকতো না এহানে। তুই বাগানে থাহিস, তোরও কবে হবে দেহিস।’

নরেনের হাত তার কানে, ‘কিন্তু জন্তুডার কী হবে? স্যাররা তো ক’লো ওরে বাঁচানো দরকার, সব জন্তুর টিকে থাকা দরকার।’

‘তুই কি মগা? ওই প্রফেসর থাহে ঢাকায়, দ্যাখগে কত বড়ো বিল্ডিংয়ে থাহে। সেই বিল্ডিং অবশ্যই ওই জাগার গাছ কাইটে বানানো। সে মুরগি কিনে খায়, তা শিয়েল-বনবিড়েলে সব মুরগি খাইয়ে গেলি সে রোস্ট খা’তো কী করে? যে মুরগিডা সে কেনে, তার পেছনে কত মুরগির শিয়েল-বনবিড়েলের প্যাটে যাওয়ার ইতিহাস আছে সে জানে? তার কি মুরগির খামার আছে? আমার প্রথম মেয়েডারে আঁতুড়ঘরেত্তে শিয়েলে টাইনে নিয়ে গেইল। তার মাইয়েরে নেতো, তা’লি দ্যাখতাম জীবপ্রেম কোন জাগাত্তে আসে। আর সে কয় কী! মানুষ হাঁস-মুরগি পোষবে না? ধানের দাম কমে গেইছে। গরিব কারে কয় সে চেনে? হাঁস-মুরগি আর ডিম-টিম বেচে মানুষ দুইটে পয়সা পায়, তা হতি দেবে না! কান না চুলকোয়ে, কাজের কাজ কিছু কর।’

সুতরাং ঢাকায় যাওয়ারই সিদ্ধান্ত হলো। যানবাহন বন্ধ, কীভাবে যাবে তার ঠিক নেই, কিন্তু যেতে হবে। কাপড়চোপড় গোছাতে গোছাতে নরেন পাল উপলব্ধি করল, জন্তুটার জন্য তার মনে গভীর মায়া জন্মেছে। পোষা পাখি, কুকুর বা বিড়ালের জন্য যেমন জন্মায়। জন্তুটাকে পেলে বুকে জড়িয়ে ধরত বলে মনে হচ্ছে তার। যাকে সে একবার শুধু চোখের দেখা দেখেছে, রাতের পর রাত পাহারা দিয়ে যার দেখা সে পায়নি, এমনকি কোথায় আছে – আছে কি নেই না বুঝেই যার নিরাপত্তার ভার য়েছে, তার প্রতি এ কেমন টান! দুই বছরের গার্মেন্ট জীবনে তো ওই প্রতিষ্ঠানের প্রতি সে এই টান অনুভব করেনি! দুই মাসের চাকরিতে তার এত মমতা কোত্থেকে  এলো? সকল প্রাণীর নিরাপত্তার ওপর মানুষের স্বাভাবিক জীবন নির্ভর করছে, মানুষের স্বার্থেই প্রাণীকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে, অথবা সম্পূর্ণ প্রকৃতি মানুষের সেবায় নিয়োজিত, এটা কোনো কথা! মনে মনে গজগজ করে নরেন, ‘খোন্দকার আর মল্লিক এরে মারতি চায় মামলার জন্যি, গিরামের মানুষ মারতি চায় হাঁস-মুরগির জন্যি, ডিসি আর ফরেস্ট অফিসার এরে বাঁচাতি চায় চাকরির জন্যি, আর ও বাঁচতি চায় প্রাণের জন্যি। আরে জানোয়ার, তুই বাঁচলি এক তুই ছাড়া কারো কোনো ফায়দা নেই।’ দুই মাসের বাগান-জীবন তার ভেতরে কিছু একটা ঘটিয়েছে। নরেন পাল অনুভব করল, মানুষ যদি নাও বাঁচে, এই জন্তুটার প্রতি ভালোবাসা তার কমবে না। সে জন্তুটাকে পাহারা দিয়েছে নিজে বাঁচার জন্য নয়, চাকরির জন্যও নয়, সে জন্তুটাকে বাঁচিয়ে রাখতে পাহারা দিয়েছে। অধ্যাপকের একটা কথা ঠিকই আছে – ওটা জন্তু নয়, প্রাণী।

সোজা পথ থাকতেও সে ঘুরপথে বাগানটার সামনে দিয়ে মহাসড়কের দিকে রওনা হলো। হাঁটা না থামিয়েই সে নিজের পরিত্যক্ত কুঁড়েটার দিকে তাকাল, হয়তো শেষবারের মতো প্রাণীটাকে দেখার আশায় বাগানে একবার চোখ বোলাল, তারপর হেঁটে মহাসড়কে উঠল এবং উপলব্ধি করল, প্রাণীটাকে বাঁচানো যাবে না। হয়তো আজ বিকেলেই ফুটফুটে শিশু-কিশোরের দল ওই বাগানে চিরুনি অভিযান চালাবে, ঢিল ছুড়বে, আগুনের ধোঁয়া দিয়ে প্রাণীটাকে নিজেদের নাগালে এনে ফেলার চেষ্টা করবে। আইন প্রাণীকে কোনো নিরাপত্তা দিতে পারে না। ফাঁদে পড়ে মরে, মার খেয়ে মরে, কে বাঁচায়? তার নিজের জন্যও তো আইন আছে, বেতন পাবার আইন, তাতে কী? মাইল পাঁচেক হেঁটেই বুঝল সে একা নয়। অতিথির মিছিল লেগেছে। দশ থেকে শত, শত থেকে হাজার। যতই সে কান চুলকাতে চুলকাতে এগোচ্ছে, শ্রমিকদের ভিড় ততই বাড়ছে। নরেন পালের আর নিজেকে একা লাগছে না। তার ভাবতে ভালো লাগছে, ওই প্রাণীটা নিরপেক্ষ বাগানটাতে তার সঙ্গিনীকে খুঁজে পেয়েছে। সে আর বিষণ্ন নয়। দুজনের অসংখ্য বাচ্চাকাচ্চা হয়ে বাগান ভরে গেছে বিলুপ্ত প্রাণীতে।

শওকত আলমেরও ঢাকায় ফেরা দরকার। সেটা সম্ভব হচ্ছে না। বউ-বাচ্চা নিয়ে গ্রামে আসা ভুল হয়েছে। একা হলেই বা কীভাবে যেত? যানবাহন পাওয়া অনিশ্চিত। সে নরেন পালের মতো গার্মেন্ট শ্রমিক নয়। অত প্রাণশক্তি নেই। এরা কীভাবে যে বাসি-পচা খেয়েও এত পরিশ্রম করতে পারে কে জানে! কীভাবে এত অনিশ্চয়তা বহন করে! শওকত আলমের অফিস থেকে জানানো হয়েছে আপাতত অর্ধেক বেতন দেওয়া হবে, কোম্পানি ক্লায়েন্ট পাচ্ছে না। শওকত আলম ভাবে, এত বছর কোম্পানি কী করেছে? রমরমা ব্যবসার আঠারো বছরের কোনো সুফল এই তিন মাসে নেই কেন! কিন্তু বেতন একেবারে না দিলেও তার যাওয়া খুব জরুরি। চাকরি মানে তো শুধু খাওয়া-পরা নয়। চাকরি মানে সমাজে দেখানোর মতো মুখ। নরেনের অনুপস্থিতিতে যে কর্মখালি হয়েছে, সেই সুযোগটা নেওয়ার কথাও একবার তার মাথায় এলো। এর মধ্যেই তার ছেলে এসে জিজ্ঞেস করল, ‘আচ্ছা বাবা, আকাশে যে এত তারা, ওগুলো কি সূর্যের মতোই বড়? সূর্যের চেয়েও সুন্দর?’

নক্ষত্রের সৌন্দর্য উপভোগ করার মতো মানসিকতা শওকত আলমের নেই। নিজের  বাড়িতে বসে সে ভাবছে, বাসাভাড়া কীভাবে দেবে? গ্রামের বায়ান্ন শতাংশ জমি তার দাদা করে গেছেন, সেদিকে তাকিয়ে সে ভাবছে, চাকরি থাকবে তো? পুকুরের ওপারে খোলা মাঠের বাতাস খেতে খেতে ভাবছে বিদ্যুৎ বিল কীভাবে দেবে। 

‘হ্যাঁ বাবা। ওরা হয়তো সূর্যের চেয়েও বড়।’

‘বাবা, সৌরজগতে এত গ্রহ কেন? আর কোনো গ্রহে তো মানুষ নেই, তাই না?’

‘এখনো কেউ জানে না বাবা। হয়তো নেই।’

‘তাহলে অন্য গ্রহগুলো কেন আছে?’

‘পৃথিবীকে ধরে রাখার জন্য। সবগুলো গ্রহের মধ্যে একরকম ম্যাগনেটিক অ্যাট্রাকশন আছে। একটা গ্রহ যদি এদিক-ওদিক হয় তো পৃথিবীও শেষ।’

‘আমরা মরে যাবো?’

‘হ্যাঁ।’

ছেলে নির্বিকার মুখে খেলতে চলে গেল। মৃত্যুকে সে খুব স্বাভাবিকভাবে নিয়েছে। শওকত আলমের মনে হলো, বিষয়টা উলটোও হতে পারে, নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য অন্য গ্রহগুলো পৃথিবীকে খসে যেতে দিচ্ছে না। পৃথিবী খসে গেলে ওরাও খসে যাবে হয়তো।

রাতে খাওয়ার একটু পরে যখন শওকত আলম বারান্দায় বসে এসব ভাবছে, তখন চুপিসারে এক অজ্ঞাত চোর ঢুকেছে মল্লিক-খোন্দকার বাগানে। তার উদ্দেশ্য অন্ধকারের সুযোগে মৌচাকটা নামানো। আগুনের ধোঁয়া দেওয়ার জন্য সে একগোছা পাটকাঠি এনেছে। পাটকাঠির ধোঁয়াতে অত ভালো কাজ হয় না, সময় বেশি লাগে। তবু আপাতত কিছু করার নেই। বেশ কিছু কামড় খাওয়ার প্রস্তুতি নিয়েই সে ঢুকেছে। এই গরমেও একটা মোটা চাদর জড়িয়েছে। চাকের মধুর সঙ্গে খানিকটা গুড়ের সিরা মিশিয়ে হাটের দিনে বিক্রি করা যথেষ্ট লাভজনক। তখন কামড়ের ব্যথাও চলে যাবে। গাছের নিচে পৌঁছে পাটকাঠিতে সবে আগুন ধরিয়েছে, হঠাৎ পূর্ব কোণে খসখস আওয়াজ হলো। চুরি করতে হলে জিন-ভূতের ভয় থাকলে চলে না এবং সাপ খসখস শব্দ করে না। এই বাগানে আর এমন কোনো জন্তু নেই যে মানুষকে এড়িয়ে চলে না। সমস্যা হলো বিলুপ্ত সেই জন্তু নিয়ে। ওই জন্তু হিংস্র কি না কে জানে! খসখস শব্দটা আবার হলো, এবার একটু বেশি সময় ধরে। কোবাদ খোন্দকার বা হাসু মল্লিক লুকিয়ে বাগানে ঢুকছে না তো? নাকি কেউ পিরিত করতে চলে এলো? আগে খালি নরেন ছিল, এখন যে কেউ হতে পারে। নাহ্, এই চিন্তা নিয়ে তো চুরি করা যাবে না। আগে দেখা দরকার চিন্তার কিছু আছে কি না। চোর পাটকাঠির আগুন নিভিয়ে ফেলল। তারপর পূর্বমুখে গাছের আড়ালে আড়ালে এগিয়ে চলল। অস্থায়ী মাচার ওপরে নরেন পালের একচালা খড়ের কুঁড়েটা এখনো আছে। শব্দটা সেখান থেকেই আসছে নাকি? নরেন পাল ফিরে এলো? নাকি কোনো পাখি সেখানে বাসা বাঁধল? আবার সেই শব্দ। আরো তীব্রভাবে, এবার চোরের মনে হলো শব্দটা তাকে উদ্দেশ করেই করা হয়েছে। 

কিছু একটা মাথা তুলল মাচার ওপর থেকে। একজোড়া আংটির মতো চোখ জ্বলতে দেখা গেল, দুটো বৃত্তাকার অন্ধকারকে ঘিরে একজোড়া আগুনের বলয়। ভয়ে কিছু না বুঝেই টর্চ ফেলল চোর। যে অস্তিত্বটা মাচার ওপর দেখা যাচ্ছে, তাকে প্রথমে নরেন বলে মনে হলেও এটাই যে সেই জন্তু কোনো সন্দেহ নেই। ভয়ংকর চোখ নিষ্পলক মেলে আছে, প্রায় মানুষের মতো সোজা হয়ে দাঁড়ানো। টর্চ মেরেই আফসোস হলো চোরের, বৈদ্যুতিক টর্চের আলোর চেয়ে অন্ধকারে জন্তুটা তুলনামূলক সুদর্শন ছিল। এবার দাঁত খিঁচিয়ে উঠল, তবে নিঃশব্দ। নিঃশব্দ জন্তু বিভীষিকার মতো মনে হলো চোরের কাছে, সাপ তাও ফোঁস ফোঁস করে, এ তাও করছে না। পাহারাদারের বিছানায় বিলুপ্ত জন্তু! ঘুরে দৌড় দিতে সাহস হলো না। পেছন থেকে যদি ঝাঁপিয়ে পড়ে! বিলুপ্ত প্রাণী চোরকে অবশ করে দিয়েছে। জন্তুটার টানটান দেহ দেখে তার দৃঢ় বিশ্বাস জন্মাল, যে-কোনো মুহূর্তে ঝাঁপ দেবে আর সেই হবে চোরের জীবনে দেখা শেষ দৃশ্য। হিংস্র জন্তু দাঁত মেলে লাফিয়ে পড়ছে, মৃত্যুর আগে এই দৃশ্য কোনো মানবসন্তান দেখতে চায় না। এটা আর মল্লিক-খোন্দকারের মামলা জড়ানো  কোনো গ্রামের বাগান নেই, সুন্দরবন হয়ে উঠেছে যেন। জন্তুটার দিকে চোখ রেখেই পাটকাঠির গোছায় আবার আগুন ধরালো চোর, আত্মরক্ষার আর কিছু নেই সঙ্গে। দৃশ্যটা অতীতের মতো, মনে হচ্ছে মানুষ এইমাত্র আগুন আবিষ্কার করেছে আর ইতিহাসের প্রথম আগুন জ্বালিয়েই সে এক প্রাক-আদিম জন্তুর মুখোমুখি নিজেকে খুঁজে পেয়েছে, একেই বুঝি সে দেবতা মানবে যতদিন না একেশ্বরবাদ নেমে আসে। আগুন দেখে জন্তু ভয় পেয়েছে বলে মনে হলো না, বরং লাফ দেওয়ার প্রস্তুতি আরেক ধাপ বাড়ল, সামনের দু-পা নিচে নামিয়ে দিয়ে দেহ টানটান করে মাটিতে পেট মিশিয়ে ফেলল, পিঠের মাঝখানটা টিলার মতো উঁচু হয়ে উঠেছে, মুখের হা আরো বড় হয়েছে, কপালের চামড়া কুঁচকে বাদুড়ের মতো দেখাচ্ছে। এই কি সেই নিরীহ জন্তু, যে খাঁচা থেকে বেরোতেই ভয় পাচ্ছিল! চোখ বুজে জন্তুটাকে লক্ষ করে আগুন ছুড়ে দিয়ে ঘুরে অন্ধকারেই দৌড় দিলো চোর। কোনো আঘাত বা শব্দ তার পিঠ স্পর্শ করল না।

অধ্যাপক এবার আসতে পারেননি, বন কর্মকর্তা আর ডিসি সাহেব এসেছেন। সঙ্গে বনপ্রহরী। নরেন পালের পুরো কুঁড়ে বেশ বড় একটা ছাইয়ের স্তূপ হয়ে পড়ে আছে, তার মাঝে বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে আছে পুড়ে কালো হয়ে যাওয়া বাঁশ। আশপাশের কিছু গাছপালাও ধোঁয়াটে রঙের হয়ে গেছে। বন কর্মকর্তা দু-হাত পকেটে ভরে দাঁড়িয়ে আছেন। ডিসি সাহেবের এক হাত কোমরে, অন্য হাতে সিগারেট। বনপ্রহরীরা লাঠি দিয়ে ছাইয়ের গাদা ঘাঁটছে। ডিসি সাহেব একবার বললেন, ‘আগুনটা কে লাগাল?  খোন্দকার সাহেব, জানেন নাকি?’

কোবাদ খোন্দকার বলে, ‘না স্যার। স্টে অর্ডার লাগানো, আমি তো আসি না এদিক।’

‘মল্লিক সাহেব?’

‘জি না, আমিও আসি না। শেষে থানা হাজতে যাব নাকি?’

‘আপনাদের ওপর ভরসা করে গেলাম যে আপনারা প্রাণীটা দেখবেন, সবাই মিলে বাগানে আগুন লাগিয়ে দিলেন? প্রতিমন্ত্রীকে আমি কী জবাব দেব?’ বন কর্মকর্তা বেশ খেপে গেছেন, ‘সবার নামে মামলা হবে। থানায় তো যেতেই হবে। রিমান্ডও হবে। নরেন পালও বাদ যাবে না। সে চাকরি ছাড়বে, সেটা জানায়নি। ভেরি আনপ্রফেশনাল।’

ডিসি সাহেব ধোঁয়াটে রঙের গাছপালার দিকে সিগারেটের ধোঁয়া নিক্ষেপ করে বললেন, ‘আমার তো মনে হয় বাগান নিয়ে গণ্ডগোলের জের ধরে আপনাদের দুজনেরই কেউ বাগানে আগুন দিয়েছেন। অন্য কারো তো এই বাগানের মালিকানা পাওয়ার সম্ভাবনা নেই। আপনাদেরই আগে দেখতে হবে আমাদের। একটা প্রাণীর জীবনের নিশ্চয়তা আপনারা দিতে পারেন না, বাগান নিয়ে কী করবেন?’

বেশ কিছু ছাই সংগ্রহ করা হলো, ময়নাতদন্ত করে দেখা হবে এর মধ্যে কোনো প্রাণীর সারবস্তু আছে কি না। ছাইয়ের গাদা থেকে হাত বিশেক দূরে রেডিও কলারটা পাওয়া গেল। নিখুঁতভাবে আটকানো, যেন কলারের ভেতর থেকে প্রাণীটা স্রেফ গায়েব হয়ে গেছে। এবার বন কর্মকর্তার মুখে সামান্য হাসি দেখা গেল, কলারটা হাতে নিয়ে বললেন, ‘বলেছিলাম না! প্রাণী নাও থাকতে পারে, কিন্তু যন্ত্র অক্ষয়!’