রফিকুন নবী : গণজীবনের চিত্রকর

ছাত্রজীবন সমাপ্তির পর ষাটের দশকের মাঝামাঝি থেকে বর্তমান সময়ে তৈরি রফিকুন নবীর  শিল্পকর্মের যে বিশাল আয়োজন সেটি শুধু সময়ের ব্যাপ্তিতে  নয়, সকল মাধ্যমে কাজের দৃষ্টান্ত হিসেবেও পূর্বাপর (retrospective) প্রদর্শনী বলা যথার্থ হবে। শিল্পীর আশিতম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে এমন প্রদর্শনীকে বলা যায় তাঁর শিল্পসৃষ্টির আত্মজীবনী। তাঁর শিল্পজীবনের দীর্ঘ সময়কালে বিদেশে যে চারটি এবং দেশে যে তেরোটি একক প্রদর্শনী হয়েছে সেখানে তাঁর শিল্পকর্মের সঙ্গে দর্শক-শিল্পরসিকদের আংশিক পরিচয় হয়েছে। এই পূর্বাপর প্রদর্শনী রফিকুন নবীকে তাঁর শিল্পকর্মের সামগ্রিকতায় জানার সুযোগ করে দিয়েছে। তিনি এখনো সক্রিয়,পূর্ণোদ্যমে সৃষ্টি করে চলেছেন বড় আকারের কাজ, যে কারণে এই প্রদর্শনীর সামগ্রিকতা সত্ত্বেও তাঁর মূল্যায়নের সময় আসেনি। কিন্তু বিষয়বৈচিত্র্য, বহু মিডিয়ামের ব্যবহার, ড্রয়িং-নৈপুণ্য, রঙের বিন্যাসে অভিনবত্ব এবং আঙ্গিকের নতুনের উদ্ভাবনের যে বৈশিষ্ট্য প্রদর্শিত ছবিতে দৃশ্যমান তা তাঁর শিল্পকর্মের সার্বিক রসাস্বাদনে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে।

প্রায় সব শিল্পী-সাহিত্যিক সৃষ্টির একটা পর্বে এসে  তাঁদের কাজের ভিত্তিতে সাধারণ পরিচিতি লাভ করেন, যার মাধ্যমে তাঁদের কাজকে শনাক্ত করতে সুবিধা হয়। জীবনঘনিষ্ঠ, পশুপাখিসহ নিসর্গপ্রিয় এবং আঙ্গিকের ব্যবহারে কুশলী, এই সব বৈশিষ্ট্য রফিকুন নবীর সাধারণ পরিচিতির অন্তর্গত হয়ে গিয়েছে। তাঁর জীবনঘনিষ্ঠতা এতই প্রবল যে, তাঁকে সামাজিক আন্দোলনকারীর (social  activist) অভিধায়  অভিষিক্ত করা যায় অনায়াসে। কেবল নিজের যাপিত জীবন নয়, সংখ্যাগরিষ্ঠ নিম্নবর্গের সামষ্টিক জীবন – অভিজ্ঞতা রফিকুন নবীর শিল্পকর্মের প্রেরণা হয়ে ‘গণজীবনের চিত্রকর’ হিসেবে  তাঁর  পরিচিতি সুস্পষ্ট করে তুলেছে, একথা নির্দ্বিধায় বলা যায়।

দুই

রফিকুন নবীর চিত্রজগতের বিষয় বহু বিস্তৃত এবং বিচিত্র। মোটা দাগে বিষয়গুলিকে কয়েকটি শ্রেণিতে ভাগ করা যেতে পারে : (ক) মানুষ, (খ) নিসর্গ, (গ) নিরীহ এবং গৃহপালিত পশু-পাখি, (ঘ) গ্রামীণ দৃশ্য এবং (ঙ) নাগরিক দৃশ্য। এসব শ্রেণির বিষয়গুলি একে অন্যের থেকে সম্পূর্ণ পৃথক নয়, তাদের মধ্যে ওভারল্যাপ আছে। যেমন, মানুষের সঙ্গে নিসর্গ, পশু-পাখি জড়িয়ে আছে; একইভাবে নিসর্গে মানুষ এবং পশুপাখি পরস্পর অন্বিষ্ট।

মানুষকে রফিকুন নবীর ছবিতে দেখা যায় বিভিন্ন শ্রেণিতে। এদের মধ্যে নিম্নবিত্ত এবং নিম্নবর্গের মানুষের ছবিই বেশি। এদের দেখা যায় গ্রামীণ পরিবেশে কাজে, অবসরে এবং যাত্রাপথে। ছেলেবেলা থেকে এই পর্যন্ত নাগরিক জীবনে অভ্যস্ত অনেক  শিল্পীর মতো নবীর এই পক্ষপাতিত্বের পেছনে কাজ করে সংখ্যাগরিষ্ঠের প্রতি সহানুভূতি ও মমত্ববোধ। দ্বিতীয়ত, এই শ্রেণির জীবনযাপনের সংগ্রামে  শরীরের (শ্রমের অর্থে) যে ভূমিকা সেটি ভিজুয়াল শিল্পসৃষ্টিতে বেশি করে উদ্বুদ্ধ করে। তুলনায় মধ্যবিত্তের জীবন-যাপন বুদ্ধিবৃত্তিনির্ভর যার দৃশ্যকল্প (imagery) শুধু সীমিত নয়, প্রকাশে জড় এবং নির্জীব। ‘রেট্রোস্পেক্টিভে’র ছবিতে মধ্যবিত্তের ছবি আছে মাত্র তিনটি, সবগুলিই ফটোগ্রাফির মতো স্থিরচিত্র। যেমন, ‘পরিবার’ (২০১৩), ‘ব্যালকনি’ (২০২২), ‘এক মহিলার পোর্ট্রেট’। অবশ্য স্থিরচিত্রের বৈশিষ্ট্য দেখা যায় নিম্নবর্গের মানুষ সাঁওতাল পরিবারের ছবিতেও।

মানুষকে প্রধান করে নবীর যে-ছবি তার মধ্যে কাজে ব্যস্ত, এদের সংখ্যাই বেশি। এই কাজের মধ্যে প্রথমেই আসে মাছ ধরা এবং প্রাসঙ্গিক বিষয়। তারপর দেখা যায় রাখালের মতো গরু, মোষ এবং ছাগল নিয়ে নিম্নবর্গের মানুষের ব্যস্ততা। কর্মরত কৃষকদের ছবির অপ্রতুলতা, কিংবা বলা যায় অনুপস্থিতি ‘কাজ’  শীর্ষক শাখায় যে ঘাটতি তা কিছুটা অবাক করে। নিম্নবর্গের টোকাইদের ছবি নিশ্চল, স্থির হলেও তাদের যে কাজের জন্যই দেখা যায় তা বলার অপেক্ষা রাখে না। ‘টোকাই’  শিরোনামই এর জন্য যথেষ্ট। মুক্তিযুদ্ধের যে দুটি ছবি প্রদর্শনীতে অন্তর্ভুক্ত তার একটিতে শত্রুর বিরুদ্ধে  ‘অ্যাকশন’  কাজের প্রতিনিধিত্ব করে, দ্বিতীয়টিতে কাজের আগের প্রস্তুতির ইঙ্গিত পাওয়া যায়।

নিম্নবিত্ত এবং মধ্যবিত্ত, উভয় শ্রেণির মানুষকে দেখা যায় পারিবারিক পরিবেশে। যেমন, সপরিবারে গ্রুপ ছবির দৃশ্য। দ্বিতীয়ত, গার্হস্থ্য জীবনে দেখা  যায় শিশু কোলে নিয়ে জননী হিসেবে নারীকে। পিতার কাঁধে সন্তান একই দৃশ্যের লিঙ্গভিত্তিক  প্রকাশ।

কর্মক্লান্ত নিম্নবিত্তের মানুষকে অবসরে বিশ্রামরত দেখিয়ে তৈরি হয়েছে  বিভিন্ন মাধ্যমে একাধিক ছবি। কাজের পাশাপাশি অবসরের চিত্র খেটে খাওয়া মানুষের দৈনন্দিন জীবন-যাপনকে পূর্ণতা দিয়েছে। নদীপথে যাত্রা, কিংবা কাজ থেকে ফেরা জঙ্গম মানুষের ছবিও ‘মানুষ’ শ্রেণির কাজের একটা বিষয় হিসেবে এসেছে।

‘মানুষ’ শ্রেণিতে ফিগারগুলি বেশিরভাগই দেখা যায় যৌথ কিংবা অনেকের দলে যুক্ত। একা মানুষের ছবি আছে, তবে সেখানে পশু কিংবা পাখির সান্নিধ্য একাকিত্বকে দূর করেছে। অনেক মানুষকে একসঙ্গে দেখিয়ে তাদের সম্মিলিত (collective)  জীবনযাপন যে শক্তির উৎস, এর প্রতি ইঙ্গিত দিয়েছেন নবী। এস এম সুলতানের পর তিনি যেভাবে মানুষের, বিশেষ করে নিম্নবর্গের সম্মিলিত রূপ  দেখিয়েছেন, তুলনায় আর কোনো শিল্পীর কথা মনে পড়ে না। মানুষের সামাজিক, যূথবদ্ধ জীবনই মনে হয় নবীকে আকর্ষণ করে সবচেয়ে বেশি, কেননা তিনি হয়তো দেখেন তাদের একসঙ্গে থাকার মধ্যে শক্তি এবং সাহস।

বিষয় হিসেবে মানুষের পরই গুরুত্ব পেয়েছে নিরীহ পশু-পাখি, যাদের অর্ধেকের বেশি গৃহপালিত এবং বাকিরা মুক্ত-স্বনির্ভর হলেও মানববান্ধব। পশুর মধ্যে মোষ প্রাধান্য পেয়েছে নবীর ছবিতে, তাদের দেখা গিয়েছে বিভিন্ন ভঙ্গিতে। এরপর এসেছে ছাগল, মাঠে এবং মানুষের কোলে। পাখির মধ্যে কাক এসেছে অনেকবার, কখনো নিজেরা একা, কখনো  মানুষের সান্নিধ্যে। কাক নবীর ছবিতে নাগরিক জীবনের প্রতিনিধিত্ব করছে।

নবী ঢাকাসহ বিভিন্ন শহরের  অজস্র ছবি তৈরি করেছেন, বেশির ভাগই তাঁর প্রিয় মাধ্যম জলরঙে। কিন্তু প্রদর্শনীতে ঢাকা শহরের মাত্র তিনটি, বিদেশে ভেনিস আর রোমের একটি করে ছবি রয়েছে। নাগরিক দৃশ্যের এসব ছবিতে নিসর্গ নেই, যা বিপন্ন পরিবেশের কথা মনে করিয়ে দেয়। তুলনায় নিসর্গ যে-কটি ছবিতে এসেছে সেখানে বাড়িঘর, যানবাহন এবং মানুষ ও পশু-পাখি রয়েছে। অপাপবিদ্ধ সার্বভৌম হয়ে নিসর্গকে দেখা যায় না নবীর ছবিতে।

বিষয়ের মধ্যে ‘মানুষ’ শ্রেণিতে পথচারী ‘টোকাই’দের নিয়ে আঁকা ছবি নবীর সবচেয়ে বেশি এবং ষাট দশক থেকে শুরু এই সিরিজ। এখনো তিনি  টোকাইদের নিয়ে ছবি তৈরি করছেন, তবে কার্টুনের আকারে এবং প্রকারে না, বড় সাইজের ক্যানভাসে রঙের ব্যবহার করে। বলা যায়, এটাই তাঁর সিগনেচার ফর্ম এবং ফ্রেম। নাগরিক জীবনের রূঢ় কঠিন এবং নির্মম বাস্তবতায় টোকাই চরিত্র তাঁর কাছে দেখা দিয়েছে এক তীব্র লক্ষ্যভেদী কণ্ঠস্বর নিয়ে যার মধ্যে সুপ্ত  সামাজিক বৈষম্য এবং ক্ষমতার বিরুদ্ধে অন্যায়ের প্রতিবাদ এবং জেদের সঙ্গে টিকে থাকার সংকল্প। নবীর বাস্তববাদিতা এবং সমাজমনস্কতা টোকাই সিরিজে যেমন প্রতিফলিত আর কোনো ছবিতে তেমন নয়। বলতে গেলে, বাংলাদেশে তিনিই চারুশিল্পীদের মধ্যে প্রথম এবং এখন পর্যন্ত একমাত্র শিল্পী, যিনি বিদ্যমান বাস্তবতা নিয়ে এমন ব্যঙ্গ এবং কৌতুকের সঙ্গে আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক ধারাবিবরণী দিয়ে গিয়েছেন। আশ্চর্যের নয় যে, টোকাই সিরিজের জন্য তিনি পেয়েছেন প্রায়োগিক সৃজনশীলতার খ্যাতি এবং সকল শ্রেণির কাছে জনপ্রিয়তা।

‘মানুষ’ শ্রেণির বিষয়ে নবীর দ্বিতীয় যে ছবি প্রায় সিরিজধর্মী হয়েছে তা হলো জেলেদের নিয়ে তৈরি বড় এবং মাঝারি আকারের চিত্রগুচ্ছ। এই পেশাজীবীদের প্রতি তাঁর আকর্ষণের পেছনে নিশ্চয় রয়েছে তাদের নিত্যনৈমিত্তিক সংগ্রামের কঠোর বাস্তবতা এবং নদী, নৌকা, জাল ও  রুপালি মাছের সমাহারে তৈরি  শিল্প-চরিত্র। সমাজজীবনের কথক নবীর কাছে জেলেরা যেমন গল্পের সম্ভাবনাময়, তেমন যেন আর কোনো শ্রেণি নয়। তাদের প্রত্যেকের মধ্যে তিনি দেখতে পান মানিকের কুবের এবং হেমিংওয়ের সান্তিয়াগোকে। এরাও বৈরী পরিবেশে অসম শক্তির মোকাবিলায় ভাঙে কিন্তু মচকায় না। জেলেরা অবশ্য টোকাইদের মতো একাকী কিংবা দু-তিনজনে থাকে না, তাদের কাজ সম্মিলিত (collective)  উদ্যোগ, যেখানে শারীরিক শক্তির প্রয়োজন সব চেয়ে বেশি।

তৃতীয় যে-বিষয় নবীর ছবিতে প্রাধান্য পেয়েছে তা হলো, মানুষ এবং নিরীহ পশু-পাখির পাশাপাশি জীবন। পশুর মধ্যে মহিষ প্রাধান্য পেয়েছে, পাখির মধ্যে কাক। প্রথমটিতে গ্রামীণ জীবনের চালচিত্র উঠে এসেছে, দ্বিতীয়টিতে নাগরিক জীবন প্রতিফলিত। প্রায় সচেতন চেষ্টায় না হলেও নবী এইভাবে গ্রামীণ এবং নাগরিক জীবনের বিভাজন করেছেন পশু এবং পাখির প্রতীক ব্যবহার করে।

তিন

রফিকুন নবী ছবি তৈরি করেছেন প্রায় সব মাধ্যম ব্যবহার করে, যার মধ্যে রয়েছে ড্রয়িং, স্কেচ, জলরং, উডকাট, লিথো, অ্যাক্রিলিক এবং তেলরং। সব শিল্পীর ক্ষেত্রে যা হয়ে থাকে, ড্রয়িং দিয়েই তাঁর ছবি আঁকা শুরু। ড্রয়িং একক শিল্পকর্ম হওয়া ছাড়াও অন্যসব মাধ্যমে ভূমিকা রাখে, এক বিমূর্ত ছবি ছাড়া। প্রদর্শিত ছবিতে ড্রয়িংয়ের কাজ কম, কিন্তু উডকাট থেকে তেলরঙের ছবিতে ড্রয়িংয়ের যে সবল উপস্থিতি তা নবীর এই মাধ্যমে অনায়াস দক্ষতা এবং এর ওপর নিরঙ্কুশ নিয়ন্ত্রণের পরিচয় দেয়। ড্রয়িংয়ে তিনি ব্যবহার করেন কলম বা পেন্সিলের সূক্ষ্ম রেখা এবং প্যাস্টেল ও ব্রাশের মোটা দাগ। প্রথমটি সৃষ্টি করে লালিত্য এবং কমনীয়তা, দ্বিতীয়টি আনে বলিষ্ঠ উচ্চারণ। বিষয় অনুযায়ী নবী দুই-ই ব্যবহার করেন স্বচ্ছন্দে। প্রথমটির উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করা যায় পরপর দুটি বাঁশের সাঁকো এঁকে খালের প্রবহমান ধারার দু-পাশের গ্রামীণ দৃশ্যের ড্রয়িং (২০২২)। এখানে সূক্ষ্ম এবং অসম্পূর্ণ রেখা দিয়ে কেবল সাঁকো দুটি নয়, নৌকা, মাঝি এবং ফসলের জমি, গাছপালা আঁকা হয়েছে। এভাবে  চারকোলে সাদা-কালোয় বর্ষা মৌসুমের যে-ছবি আঁকা হয়েছে সেখানে  রয়েছে লিরিক্যাল ছন্দময়তা। একই কথা বলা যায় ‘ভিলেজ’ (২০২২) এবং  ‘ফিশারম্যান’ (২০২২) শীর্ষক ড্রয়িং দুটি সম্পর্কে। অন্যদিকে চারকোল এবং প্যাস্টেলে আঁকা দুই বোনের ছবিতে (ড্রয়িং নং ১০, ২০১০)  সম্পূর্ণ এবং মাঝারি দাগের রেখায় নাটকীয়তা ছাড়াই বাস্তব প্রতিফলিত। অন্য প্রান্তের দৃষ্টান্তে   ‘বিশ্রামরত জেলে’-এর (২০২৩) ছবিতে  ফিগারের যে সীমানা ব্রাশের মোটা দাগে চিহ্নিত সেখানে দেখা যায় টানটান উত্তেজনা এবং বলিষ্ঠতা। বিচিত্রতায় ড্রয়িংকে নবী এইভাবে করে তুলেছেন বহুমুখী সম্ভাবনার মাধ্যম, এককভাবে কিংবা অন্য মাধ্যমের ভিত্তি হিসেবে।

ড্রয়িংয়ের তুলনায় প্রদর্শনীতে জলরঙের ছবির সংখ্যা অনেক বেশি যা দেখে বোঝা যায়, এই মাধ্যমের প্রতি নবীর বিশেষ দুর্বলতা। সবারই জানা, জলরং সহজ মাধ্যম যতক্ষণ এই ছবির স্পেসে ফর্ম থাকে কম এবং মোটা আকারে। ছোট আকারের সূক্ষ্ম রেখার একাধিক ফর্ম নিয়ে জলরং তৈরি জটিল এবং আয়াসসাধ্য কাজ। আবার একটি কি দুটি ফর্মকে প্রাধান্য দিয়ে তেলরঙের  মতো বড় আকারের ফিগারেটিভ ছবি ড্রয়িংয়ের মাধ্যমে আঁকতে গেলে রঙের তরল অস্থিরতা তার জন্য অন্তরায়  হয়ে দাঁড়ায়। ‘বড় কাটরা’ শীর্ষক জলরঙের কাজ খুব সহজ না হলেও, আয়াসসাধ্য। কিন্তু  ‘জার্নি’র (২০১৩) মতো জটিল কম্পোজিশন যেখানে গরুর গাড়িতে দুটি গরু, চালক এবং ছইয়ের ভেতরে-বাইরে আরোহীদের দেখাতে হয়েছে, সেই জটিল ছবি জলরং দিয়ে আঁকা প্রায় দুঃসাধ্য। একই ধরনের প্রায় অসম্ভব মনে হয় তেলরঙের মতো তৈরি  ‘মা ও শিশু’ (২০০৬)  শিরোনামের ছবি,  যেখানে প্রায় কিউবিক ফর্মে দুজনকে শায়িতা দেখা যায়। এই সব ছবি এঁকে রফিকুন নবী মাধ্যম হিসেবে জলরঙের অপার সম্ভাবনার কথা জানিয়েছেন।

ছাত্রজীবনে রফিকুন নবী নিশ্চয় প্রিন্ট মেকিং কোর্সে এই মাধ্যমের অন্যতম শাখা হিসেবে উডকাট বিষয়ে শিক্ষাগ্রহণ করেছিলেন। এই ক্ষেত্রে তাঁর আগ্রহ মনে হয় যথেষ্টই ছিল যার জন্য ১৯৭৩-৭৬ সময়কালে এথেন্স স্কুল অব ফাইন আর্টসে ছাপচিত্রের ওপর প্রশিক্ষণের সময় তাঁর উডকাটের ওপর বিশেষ দক্ষতা লাভের সুযোগ ঘটে। দেশে ফিরে তিনি অনেক উডকাটের কাজ করেছেন, যাদের আকার প্রথাগত উডকাটের তুলনায় অনেক বড়। সত্তরের দশকে করা বেশ কিছু উডকাট ‘রেট্রোসপেক্টিভে’-এ  প্রদর্শিত হয়েছে। এখানে বিমূর্ত  এবং মূর্ত, উভয় ধরনের কাজই দেখা যায়। বস্তুত বিমূর্ত ধরনের কাজের একমাত্র দৃষ্টান্ত এই উডকাটেই রয়েছে। নবীর উডকাটের দুটি বৈশিষ্ট্য দর্শকের দৃষ্টি আকর্ষণ  করে। প্রথমত, এদের বিশাল আকার, যা আগেই বলা হয়েছে এদেশের উডকাটের প্রথাগত আকারের তুলনায় বড়। যে-কোনো ধরনের প্রিন্টের আকার বড় হলে সেখানে ফর্ম তৈরি জটিল এবং কঠিন হয়ে পড়ে, কেননা জলরঙের মতো প্রিন্ট মাধ্যমেও একবার সামান্য ত্রুটি হলে তা আর সংশোধনের উপায় থাকে না। নিজের দক্ষতার ওপর আস্থা থাকলেই বড় আকারের উডকাট তৈরি সম্ভব যার অভাব মনে হয় নবীর ক্ষেত্রে ছিল না এবং এখনো নেই, কেননা তিনি এই পরিণত বয়সে এসেও যে বড় আকারের উডকাটের কাজ করছেন তার দৃষ্টান্ত রয়েছে এই প্রদর্শনীতে। নবীর উডকাটে দ্বিতীয় যে বৈশিষ্ট্য চোখে পড়ে তা হলো রঙের ঐশ্বর্য এবং ঔজ্জ্বল্য। প্রথাগত উডকাট, যার সঙ্গে আমরা পরিচিত, সেখানে সীমিত সংখ্যক রং, অনেক ক্ষেত্রেই মাত্র একটি, থাকাই স্বাভাবিক। কিন্তু নবীর উডকাট দেখে মনে হয় যেন অ্যাক্রিলিক বা তেলরঙের কাজ, এমন  বহু রঙে বিচিত্র।

প্রদর্শনীতে অ্যাক্রিলিক মাধ্যমের পেইন্টিংয়ের সংখ্যা অনেক, যা দেখে মনে হয় তেলরঙের চেয়ে এই মাধ্যমই তাঁর বেশি পছন্দের। অ্যাক্রিলিকের সুবিধা হলো, পানি দিয়ে তৈরি হওয়ায়  এটি তাড়াতাড়ি শুকায়। এই সুবিধা আবার সমস্যা হতে পারে যদি বিভিন্ন রঙের মিশ্রণ (blending) করা হয়, কেননা তার জন্য সময় পাওয়া যায় না। বিশেষ করে বড় আকারের ক্যানভাসে (অ্যাক্রিলিক কাঠের ওপর এবং কাপড়েও ব্যবহার করা যায়) ছবি পেইন্ট করার সময় এই সমস্যা দেখা দিতে পারে। দ্বিতীয় সমস্যা হলো, শুকিয়ে যাওয়ার পর মূল রং থেকে ছবির রং কিছুটা পৃথক  হয়ে যেতে পারে। নবীর অ্যাক্রিলিকে আঁকা পেইন্টিংগুলির আকার বেশ বড়, যেজন্য এই দুটি সমস্যার মুখোমুখি নিশ্চয় তাঁকে কমবেশি হতে হয়েছে। যেহেতু সমাপ্ত (finished) ছবিগুলির রঙের বিন্যাস বিষয়ের সঙ্গে সামঞ্জস্যময়, সেই জন্য অনুমান করা যায় যে, তিনি সমস্যা দুটির সন্তোষজনক সমাধান করতে পেরেছেন। অবশ্য তেলরঙের তুলনায় অ্যাক্রিলিক মাধ্যমের সুবিধাও আছে। এই রং হালকা পরতে ব্যবহার করে যেমন  স্বচ্ছ উজ্জ্বলতা (glaze)  আনতে সক্ষম, একই ভাবে ব্রাশস্ট্রোকে ঘন ও পুরু করেও ব্যবহার করা যায়। নবীর অ্যাক্রিলিক পেন্টিংগুলিতে রঙের যে অবদমিত ঔজ্জ্বল্য (undertone) এবং  অতিমাত্রার ঔজ্জ্বল্য  (overtone), সেই বৈশিষ্ট্য এসেছে উপরে উল্লিখিত যথাক্রমে প্রথম এবং দ্বিতীয় পদ্ধতির  জন্য। অ্যাক্রিলিক মাধ্যমে করা ছবিগুলি শুধু রঙের ব্যবহারে বিশিষ্ট না, সেগুলির কম্পোজিশনেও রয়েছে কুশলতা। এসব ছবিতে ও অনেক পেইন্টিংয়ে বহু মানুষকে একসঙ্গে দেখা যায়। তাদের পারস্পরিক অবস্থান বেশ বাস্তব এবং পরিপূরকভাবে নির্ধারিত হয়েছে। কিন্তু বাস্তববাদী ফিগারেটিভ ছবির সঙ্গে মিল না রেখে রফিকুন নবী অ্যাক্রিলিকে তৈরি অনেক  ছবিতে  পার্সপেক্টিভ  নিয়ে নিরীক্ষা করেছেন, যেমন করেছেন অন্য আঙ্গিকের ছবিতেও। অ্যাক্রিলিকে করা পেইন্টিংগুলিতে তিনি নিয়ে এসেছেন অনেক  ডিটেইল, যেমন ‘ডেক’ (২০১৫) ছবিতে স্টিমারের ডেকে যাত্রীদের মাঝে দেখানো হয়েছে ডালায় কলার ছড়ি, খাঁচায় পাখি; ‘গঞ্জ’ (২০১৫) ছবিতে এসেছে নৌকা, গঞ্জের বাজার, হাটুরে মানুষ, ফেরিঘাটের সামনে বাস, সামনে দোকানপাট এবং পেছনে বাড়িঘর। অ্যাক্রিলিক পেইন্টিংয়ের অনেকগুলির একটি  বৈশিষ্ট্য, যা ওপরে রং সম্পর্কে আলোচনায় আসতে পারত, তা হলো মানুষের গায়ের আল্ট্রামেরিন নীল রং। যেহেতু বিষয়-নিরপেক্ষভাবে নীলের এই ব্যবহার করা হয়েছে, সেজন্য বলা যায়, নীল রং তাঁর ছবিতে প্রতীক হিসেবে নয়, কেবল পছন্দের রং হিসেবেই এসেছে। প্রচলিত প্রথা থেকে নবীর বেরিয়ে যাওয়ার এটাও একটা দৃষ্টান্ত। অ্যাক্রিলিক পেইন্টিংগুলির কোনো কোনোটায় ফিগারে স্টাইলাইজেশনের (stylization) দৃষ্টান্ত  চোখে পড়ে। যেমন, ‘ফ্যামিলি’ (২০০৬) এবং ‘এফেকশন’ (২০১২) ছবিতে যথাক্রমে নারী এবং পুরুষের অবয়ব হুবহু বাস্তবসম্মতভাবে না দেখিয়ে আঁকা।

প্রদর্শনীতে তেলরঙে তৈরি ছবির সংখ্যা বেশ কম, যা থেকে মনে করা যেতে পারে যে, এটি শিল্পীর খুব প্রিয় মাধ্যম নয়। তবে এই মাধ্যমে  ‘ফলেন ভাস’ (২০০২) শীর্ষক যে-ছবিটি দৃষ্টি আকর্ষণ করে সেটি শুধু অর্ধবিমূর্ত  হওয়ার জন্য নয়, কিউবিস্ট ঘরানার মতো ফর্মের ভাঙচুরের জন্যও। এই ছবিতে আধুনিকতার পরিচয় দিয়েছেন  তিনি। রং এবং ফর্ম নিয়ে কৌতুকের সঙ্গে বেশ খেলেছেন, একথাও বলা যায়।

মিক্সড মিডিয়ার ছবি প্রদর্শিত হয়েছে বেশ কয়েকটি। অ্যাক্রিলিক পেইন্টিং এবং ড্রয়িংয়ের সহযোগে তৈরি  এসব ছবিতে পেইন্টিংয়ের চরিত্রই প্রধান। পার্সপেক্টিভের অপ্রচল ব্যবহার ছবিগুলিতে বৈশিষ্ট্যের মাত্রা যোগ করেছে।

লিথোগ্রাফের কাজ আছে কয়েকটি, যেখানে ফিগারের আকার বড় থেকে ছোট, উভয়ই আছে। লিথোর ছবিতে নবীর ড্রয়িং-নৈপুণ্য এবং শিল্পিত কম্পোজিশন বেশ চোখে পড়ে।

চার

রেট্রোস্পেক্টিভ মানে একজন শিল্পীর সম্পূর্ণ কাজের প্রদর্শনী নয়, যদি তিনি সক্রিয় থাকেন। নবী যে এখনো সক্রিয় প্রদর্শনীতে ২০২৩ সালে তৈরি বিশাল আকারের ক্যানভাসের ছবি তা জানিয়ে দেয়। তাই তাঁর শিল্পকর্মের মূল্যায়নের  সময় এখনো আসেনি। কিন্তু প্রারম্ভেই  যেমন বলা হয়েছে, উপসংহারেও তার পুনরাবৃত্তি করে বলা যায়, এসব ছবি দর্শককে কিছু উপলব্ধি পেতে সাহায্য করে। এই উপলব্ধির মধ্যে থাকতে পারে ইতিমধ্যে শিল্পীর অর্জিত কিছু স্বকীয়তা, যা তাঁকে অন্যদের থেকে পৃথক করে। প্রথমত বলা যায়, আনুভূমিক এবং উল্লম্ব দূরত্বকে একাকার করে তিনি তাঁর অনেক ছবিতে স্বাতন্ত্র্য এনেছেন। এটা তাঁর একক কৃতিত্ব নয়, বহু আগে প্রাচীন যুগে মিশরের  শিল্পীরা এর প্রচলন করেন। আধুনিক যুগে মার্ক শাগাল এবং অন্যান্য শিল্পী এই কৌশল ব্যবহার করেছেন। কিন্তু বাংলাদেশে প্রধান শিল্পীদের মধ্যে তিনিই মনে হয় প্রথম যাঁর ছবিতে এর বহুল ব্যবহার দেখা গেল। এটি নিঃসন্দেহে একটি অর্জন।

দ্বিতীয়ত, নবী তাঁর কোনো কোনো ছবিতে টাইম অ্যান্ড স্পেসের ভেদরেখা ভেঙে দিয়েছেন। যেমন, রোমের সিস্টিন চ্যাপেলে মাইকেল অ্যাঞ্জেলোর বিখ্যাত ছবি ‘ক্রিয়েশনে’ এডামের স্থানে তিনি নিজেকে এঁকে কৌতুক করেছেন। এখানেও নতুনত্ব আছে, রয়েছে সৃজনশীলতার নতুন মাত্রা।

তৃতীয়ত, কোনো পুরনো বা নতুন বাস্তবতার প্রতীক হিসেবে নয়, নিছক নিজের আনন্দ লাভের জন্য তিনি নীল রঙের ব্যাপক ব্যবহার করেছেন। এটি কেবল নতুন নয়, বেশ সাহসী এবং স্বাধীন পদক্ষেপ।

সবশেষে বলতে হয়, ছবিতে টোকাই  চরিত্র সৃষ্টি করে রফিকুন নবী শিল্পজগতে স্থায়ীভাবে তাঁর আসন পাকা করে নিয়েছেন। বিদেশে কার্টুন চরিত্র চিত্রণ করে সমাজ ও রাজনীতির ওপর মন্তব্যের মাধ্যমে কেউ কেউ খ্যাত হয়েছেন। যেমন, আমেরিকায় শুলজের করা  ‘পিনাট’ কার্টুনের  লিনাস, চার্লি ব্রাউন, লুসি এবং বেলজিয়ামে হার্জের সৃষ্টি টিনটিন চরিত্র। কিন্তু এই উপমহাদেশে টোকাইয়ের মতো কার্টুন চরিত্র দ্বিতীয়টি নেই বললে মনে হয় ভুল হবে না। এই কার্টুন চরিত্র যে একজন প্রধান শিল্পীর তৈরি, সেই বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ।

আশিতম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত ‘রেট্রোস্পেক্টিভ’-এ রফিকুন নবী জানিয়ে দিয়েছেন, তিনি শুধু বাংলাদেশের একজন প্রধান শিল্পী নন, তাঁর সৃজনশীলতার নতুন দিগন্তে যাত্রা এখনো অব্যাহত।