রবীন্দ্রনাথের আঁকা ছবির প্রদর্শনী

১৯৩০ সালের ১৯শে নভেম্বর বুধবার। নিউইয়র্ক, ম্যানহাটনের ছাপ্পান্ন স্ট্রিট গ্যালারিতে উদ্বোধন করা হয় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের চিত্রকর্মের একটি প্রদর্শনী। গ্যালারির পেছন দিকে এক কোণে একটা উঁচু চেয়ারে বসেছিলেন কবি। যেসব পুরুষ এবং মহিলা কক্ষটি পূর্ণ করে রেখেছিলেন কবি তাঁদের বলছিলেন তাঁর চিত্রশিল্পী হয়ে ওঠার গল্প।

চিত্রকলা রবীন্দ্রনাথের কাছে এতটাই নতুন ছিল যে, তিনি বলেছিলেন – তিনি এতে অভ্যস্ত নন। ‘এটি সম্পর্কে আমার এখনো দ্বিধা-সংকোচ আছে।’ তিনি যোগ করেন, ‘আপনি যখন তাদের দেখেন তখন আমি চাই যে আপনি ভুলে যান যে আমি একজন কবি, এবং ছবিগুলি একজন কবি করেছেন বলে তাকে ছাড় দেওয়া যেতে পারে। এগুলি স্বতঃস্ফূর্ত সৃষ্টি এবং তাদের নিজেদের মতো করে দাঁড়াতে হবে।’ কবি বলতে থাকেন, ‘এই ছবির সাথে কোনো বিশেষ তাৎপর্য সংযুক্ত নয়, আমি ছবিগুলি ব্যাখ্যা করতে পারি না। আমার মনে কোনো দৃশ্যরূপ ছিল না এবং আমি কিছুই অনুকরণ করিনি। আমার অকুশলী আঙুলগুলি কলমের ভার নিয়েছিল; পরে আমার সচেতন মন তা দখল করে নেয়।’ তিনি ব্যাখ্যা করেছিলেন যে, কয়েক বছর আগে, তাঁর পাণ্ডুলিপিতে কাটাকুটি করতে গিয়ে যে স্কেচগুলি তৈরি করেছিলেন তা তাঁকে আগ্রহী করতে শুরু করেছিল। সেই অসমাপ্ত লাইনগুলি তাদের অসমাপ্ত অবস্থায় চিৎকার করেছিল। তিনি তাদের ‘চূড়ান্ত’ রূপ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। তাঁর

প্রাথমিক স্কেচগুলির বেশিরভাগই তিনি ফেলে দিয়েছিলেন, তবে শিল্পীবন্ধুদের পরামর্শে কিছু সংরক্ষণ করেছেন। ইউরোপীয় সমালোচকরা এদের অনুকূলভাবে গ্রহণ করেছেন। কবি যোগ করেন, ‘আমার ছবির লাইনগুলি আমার পদ্যরচনা। দৈবক্রমে যদি তারা স্বীকৃতি দাবি করার অধিকারী হয় তবে এটি অবশ্যই প্রাথমিকভাবে ছন্দোবদ্ধ গঠনের জন্য এবং কোনো ধারণার ব্যাখ্যা বা বাস্তবের উপস্থাপনার জন্য নয়।

রঙিন কালিতে আঁকা প্রায় পঁচাত্তরটি চিত্র গ্যালারিতে প্রদর্শিত হচ্ছে, সেগুলি আজ থেকে জনসাধারণ দেখতে পাবে  – অনেক ক্ষেত্রে পেইন্টিংগুলি বস্তুজগৎকে চিত্রিত করে, কখনো কখনো উজ্জ্বল এবং কখনো কখনো বিষণ্ন রঙে। অন্যান্য পেইন্টিংয়ের ফর্মগুলি সম্পূর্ণ কাল্পনিক।’

এভাবেই নিউইয়র্ক টাইমস পরদিন ২০শে নভেম্বর কবির চিত্র-প্রদর্শনীর খবর ছাপে। দশদিন পর নিউইয়র্ক টাইমস কবির প্রদর্শনী নিয়ে প্রায় হুবহু আরেকটি সংবাদ ছাপে, তবে এই সংবাদটিতে প্রদর্শনীতে কবির একটি কাঠের আবক্ষ মূর্তি থাকার খবর দেওয়া হয়, যেটি তৈরি করেছিলেন একজন রাশিয়ান-আমেরিকান ভাস্কর, গ্লোব ডেরুজিনস্কি। এর আগে কবি নিউইয়র্ক পৌঁছে ‘ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ে’ বক্তৃতা করতে চলে যান কানেকটিকাট রাজ্যে; কিন্তু সেখানে গিয়ে কবি অসুস্থ হয়ে বিশ্রামরত অবস্থায় সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপ প্রসঙ্গে বলেন যে, তাঁর বই বিক্রির অর্থ দিয়ে তাঁর স্কুলের কিছু ব্যয় মিটছে, তবে তাঁর শিল্পকর্ম বিক্রি করে আরো অর্থ সংগ্রহ করতে চান। নিউইয়র্ক টাইমস সেই সংবাদটি প্রকাশ করে ২৭শে অক্টোবর, ১৯৩০ তারিখ। সেই সংবাদে কবির আমেরিকান স্ত্রীর অর্থসাহায্যে স্কুল চলছে বলে খবর ছাপে; পরে যার প্রতিবাদ জানানো হয়। সেই সময় বস্টন শহরেও কবির একটি

চিত্র-প্রদর্শনী হয়, তবে তা তেমন সাড়া জাগাতে পারেনি, যা কবিকে ব্যথিত করে।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর জীবনের শেষের দিকে ১৯২৮, সালে, ছবি আঁকা শুরু করেছিলেন, যখন তাঁর বয়স ৬৭ বছর। তাঁর পরিবারে আরো দুজন বিখ্যাত চিত্রশিল্পী ছিলেন, তাঁর ভাতুষ্পূত্র অবনীন্দ্রনাথ এবং গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুর। তাঁর এক বড় ভাই জ্যোতিরিন্দ্রনাথও ভালো ছবি আঁকতেন। পাণ্ডুলিপিতে কাটাকুটি করতে করতেই এই শিল্পকর্মের প্রতি কবির আগ্রহ জন্মে, তবে সেগুলি মানুষকে দেখাতে কবি ছিলেন দ্বিধাগ্রস্ত। তিনি তাঁর জীবনের শেষ ১৫ বছর ধরে এই শিল্পের অন্বেষণ করেন এবং প্রায় আড়াই হাজার ছবি আঁকেন।

এই প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথের ছবির সমালোচনা করা আমার উদ্দেশ্য নয়। তাঁর ছবি ভালো কি মন্দ, দুর্বোধ্য নাকি সহজ – সেই নিয়ে অনেক আলোচনা হয়েছে এবং আগামীতেও হবে। আমি শুধু পশ্চিমে তাঁর ছবির প্রদর্শনী কেমন হয়েছিল সেটা নিয়েই আলোচনা করবো।

রবীন্দ্রনাথের আঁকার গল্প বলতে আমাদের একটু পেছনে, ১৯২৪ সালে, ফিরে যেতে হবে। দক্ষিণ আমেরিকান রাষ্ট্র পেরুর স্বাধীনতা সংগ্রামের শতবার্ষিকী উৎসবে যোগ দিতে কবিকে আমন্ত্রণ জানানো হয়। কবি অনেক উৎসাহে কিছুটা অসুস্থ শরীর নিয়েই ১৯শে সেপ্টেম্বর ইউরোপগামী জাহাজ ধরতে গেলেন মাদ্রাজ থেকে শ্রীলংকার রাজধানী কলম্বোতে। সেখান থেকে ২৪শে সেপ্টেম্বর উঠলেন ইউরোপগামী জাপানি জাহাজ ‘হারুনা-মারু’তে। জাহাজেই লিখতে শুরু করেন পূরবী কাব্যগ্রন্থ। অভ্যাসমতো কোনো লাইন পছন্দ না হলে কালির আঁচড়ে কেটে ফেলেন, কাটাকুটি করতে করতেই তৈরি হয় নানা ধরনের চিত্র। পথে কবির শরীর এতটাই খারাপ হয় যে, পেরু যাওয়া অসমাপ্ত রেখে অনির্ধারিত যাত্রাবিরতি করেন আর্জেন্টিনায়। সেখানেই কবির সঙ্গে পরিচয় হয় ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর, যিনি আগেই রবীন্দ্রনাথের গীতাঞ্জলির ফরাসি অনুবাদ পড়ে কবির প্রেমে বুঁদ হয়ে ছিলেন। আর্জেন্টিনায় কবি তাঁর অতিথি হয়ে থাকেন প্রায় দেড় মাস। কবিকে পেয়ে আপ্লুত হন ওকাম্পো, ধীরে ধীরে কবির সঙ্গে হয় গভীর সম্পর্ক। 

রবীন্দ্র-জীবনে ওকাম্পোর উল্লেখযোগ্য প্রভাব হলো কবির শেষ বয়সে ‘চিত্রকর রবীন্দ্রনাথ’ হয়ে ওঠা। রবীন্দ্রনাথ নিজেই তাঁর ছবি আঁকার শখকে উল্লেখ করেছেন ‘শেষ বয়সের প্রিয়া’ হিসেবে। ওকাম্পোর বাড়িতেই, রবীন্দ্রনাথ পূরবী কাব্যগ্রন্থ লিখে চলছিলেন। ওকাম্পো লিখেছেন – ‘ওঁর একটি ছোট খাতা টেবিলে পড়ে থাকতো, ওরই মধ্যে কবিতা লিখতেন বাংলায়। বাংলা বলেই যখন-তখন খাতাটা খুলে দেখা আমার পক্ষে তেমন দোষের কিছু ছিল না। এই খাতা আমায় বিস্মিত করল, মুগ্ধ করল। লেখার নানা কাটাকুটিকে একত্রে জুড়ে দিয়ে তার ওপর কলমের আঁচড় কাটতে যেন মজা পেতেন কবি। এই আঁকিবুঁকি থেকে বেরিয়ে আসতো নানা রকমের মুখ, প্রাগৈতিহাসিক দানব, সরীসৃপ অথবা নানা আবোলতাবোল…।’

১৯৩০ সালে প্যারিসে যখন প্রথম ছবির প্রদর্শনী হয় তখন স্বদেশে কবির এই নতুন প্রতিভার পরিচয় ও স্বীকৃতি কোনোটাই হয়নি। কবি তাঁর ছবি সম্পর্কে এক চিঠিতে লিখছেন (পথে ও পথের প্রান্তে, ৪৯ পত্র) – ‘আমাদের দেশের সঙ্গে আমার

চিত্র-ভারতীর সম্বন্ধ নেই বলে মনে হয়। কবিতা যখন লিখি তখন বাংলার বাণীর সঙ্গে তার ভাবের যোগ আপনি জেগে উঠে। ছবি যখন আঁকি তখন রেখা বলো রং বলো কোনো বিশেষ প্রদেশের পরিচয় নিয়ে আসে না। অতএব এ জিনিসটা যারা পছন্দ করে তাদেরই, আমি বাঙালি বলে এটা আপন হতেই বাঙালির জিনিস নয়। এইজন্যে স্বতঃই এই ছবিগুলিকে পশ্চিমের হাতে দান করেছি। …’

ফ্রান্সে রবীন্দ্রনাথের ছবির প্রদর্শনীর একটা আকাক্সক্ষা ছিল, আর সেজন্যে ১৯৩০ সালে মার্চের শেষে তিনি যখন ফরাসি ব্যাংকার আলবার্ট খানের অতিথি হয়ে ফ্রেঞ্চ রিভেরায় গেলেন সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলেন তাঁর আঁকা চারশো ছবি। ফ্রান্স তখন ছিল শিল্পের বিশ্বরাজধানী, কবি সেখানে গিয়ে বুঝলেন, প্যারিসে ছবির প্রদর্শনী করা অত সহজ নয়। ভালো গ্যালারি এমনিতেই চট করে পাওয়া যায় না, আর তার মধ্যে আবার প্যারিসে রবীন্দ্রনাথের জানাশোনাও ছিল কম।

সৌভাগ্যবশত সেই সময় ওকাম্পো প্যারিসেই ছিলেন। সেটা এপ্রিলের প্রথম দিক। তিনি আসলে দেখা করতে এসেছিলেন তাঁর জীবনের ‘নতুন পুরুষ’ পিয়া দ্রিউ রা হোসেলের সঙ্গে। ওকাম্পো প্যারিসে আছেন জেনে রবীন্দ্রনাথ তাঁকে টেলিগ্রাম করেছিলেন। হয়তো ভেবেছিলেন এত মানুষের সঙ্গে সংযোগ রাখা ওকাম্পো হয়তো কোনোভাবে সাহায্য করতে পারবেন।

খবর পেয়েই চলে এলেন ওকাম্পো। রবি ঠাকুরের সঙ্গে তাঁর দ্বিতীয় সাক্ষাৎ। এসেই খুব কম সময়ের মধ্যে পিগাল গ্যালারিতে রবি ঠাকুরের ছবির প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করে ফেললেন তিনি। এমনকি তাঁর বন্ধু লেখিকা কঁতেস দ্য নোয়াইকে দিয়ে চিত্রসূচির একটা ভূমিকাও লিখিয়ে নিলেন ওকাম্পো। এত দ্রুত এবং সুচারুভাবে তিনি কাজগুলি সমাধান করে ফেললেন যে সবাইকে অবাক করে দিয়েছিল।

রথীন্দ্রনাথ তাঁর পিতৃস্মৃতিতে উল্লেখ করেছেন – ‘১৯৩০ সালে বাবা আবার যখন প্যারিস যান, সঙ্গে ছিল তাঁর আঁকা কিছু ছবি। ছবি দেখে কয়েকজন ফরাসি শিল্পী বাবাকে একটা চিত্র-প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করতে অনুরোধ করলেন। খোঁজ খবর নিয়ে জানা গেল, চট করে প্যারিস শহরে প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করা অসম্ভব বললেই হয়। মোটামুটি একটা পছন্দসই হল পেতে হলে বছরখানেক আগে থেকে চেষ্টাচরিত্র করতে হয়। বাবা সেনিওরা ওকাম্পোকে তারযোগে অনুরোধ জানালেন তিনি এসে যেন বাবার সহায় হন। সঙ্গে সঙ্গে তিনি চলে এলেন এবং আপাতদৃষ্টিতে মনে হল বিনা আয়াসেই প্রদর্শনীর সব রকম ব্যবস্থা তাঁর সাহায্যে হয়ে গেল।’

চিত্রকর আঁদ্রে কার্পেলেস, পল ভেলেরি এবং আঁদ্রে জিদের মতো কলা-বিশেষজ্ঞরা ছবিগুলিকে চিহ্নিত করলেন ‘আগামী যুগের আর্ট’ হিসেবে।

স্থাপত্যশিল্পী আর এস মিলওয়ার্ড প্যারিসে পিগাল গ্যালারিতে প্রদর্শনী দেখে এসে লেখেন : ‘আমি কী করে বর্ণনা করি আমি কী দেখলাম? কোনো ছবির নাম নেই – স্বপ্নকে কি নামে বাঁধা যায়? যে দেখবে সেই নাম চিনে নিক। নিষ্ঠুর কালো কালো আকৃতি আছে, তারা ভয় দেখাচ্ছে – তিনকোনা সুন্দর আকৃতি আছে যাদের দিকে চেয়ে থাকলে তারা নৃত্য করে ওঠে। হয়তো ওই মাথার ভঙ্গি আমার মন আকর্ষণ করে, কত আকারের মুখ, হয়তো বা শুধু দুটি চোখের দৃষ্টি অন্ধকারের মধ্যে আমাকে অনুসরণ করে ফেরে। … হয়তো একটি পোর্ট্রেট – একটি মুখের ভঙ্গিমা, ডিম্বাকৃতি মুখে ঠোঁটের ওপর ভেসে যাওয়া হাসি। স্বপ্ন? হ্যাঁ স্বপ্নই বটে। …’ (মৈত্রেয়ী দেবীর বিশ্বসভায় রবীন্দ্রনাথ থেকে)

প্যারিসে প্রদর্শনীর পর রবি ঠাকুরের চিত্র-প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করতে হয় লন্ডনে এবং বার্লিনেও। কবিগুরু প্রায় শিশুর মতো উৎফুল্ল হয়ে সে-সময়কার আরেক ‘গুণমুগ্ধা’ রানী মহলানবিশকে লিখলেন, ‘আজ আমার জার্মানির পালা সাঙ্গ হল, কাল যাব জেনেভায়। এ পত্র পাবার অনেক আগেই জানতে পেরেছ যে, জার্মানিতে আমার ছবির আদর যথেষ্ট হয়েছে। বার্লিন ন্যাশনাল গ্যালারি থেকে আমার পাঁচখানা ছবি নিয়েছে। এই খবরটার দৌড় কতকটা আশা করি তোমরা বোঝো …’

ড্রেসডিন, বার্লিন ও মিউনিখে প্রদর্শনী হলো। ড্রেসডিনের আর্ট অ্যাসোসিয়েশন লিখল – ঠাকুরের ছবি তাঁর কবিতা ও গানের মতোই তাঁর আত্মার এক-একটি কণা। এর মধ্যে অতি স্বাভাবিক ছন্দে মনের রূপ নিঃসৃত হয়ে এসেছে। পরিণতবয়স্ক কবি নতুন আনন্দে রঙের কাব্য লিখেছেন – এ ঘটনা বিস্ময়কর।

২৩শে জুলাই রবীন্দ্রনাথ মিউনিখের জনসাধারণকে চমৎকৃত করে দিয়েছিলেন। ক্যাসপ্রি গ্যালারিতে (Caspari Gallery) তাঁর প্রদর্শনীর সংবাদ মিউনিখের জনসাধারণকে আনন্দবিমূঢ় করেছিল। মিউনিখ সমাজের বিশিষ্ট নরনারীরা কবির প্রদর্শনী উন্মোচন উপলক্ষে প্রদত্ত ভাষণ শুনতে এসেছিল – একটি সংক্ষিপ্ত সুন্দর বক্তৃতায় কবি বললেন যে, কবিতা কখনোই অন্য ভাষায় যথাযথরূপে অনুবাদ করা যায় না। অনুবাদ প্রক্রিয়ার ফলে ভালো কবিতার সূক্ষ্ম ব্যঞ্জনা ও কবিত্ব নষ্ট হয়ে যায়। কিন্তু ছবির কোনো অনুবাদের প্রয়োজন নেই। তারা সকলই প্রত্যক্ষ জ্ঞানগম্য। কবি বললেন, ‘আমার কবিতা রইল আমার দেশবাসীর জন্য, আমার ছবি পশ্চিমকে উপহার দিলাম।’

এরপর রাশিয়া, ইংল্যান্ড ও আমেরিকায় প্রদর্শনী হয়। রাশিয়ার একজন আর্ট-ক্রিটিক তাঁকে জিজ্ঞাসা করেন :

‘আপনি আগে কখনো ছবি আঁকেননি?’

‘না।’

‘আপনি একজন শ্রেষ্ঠ শিল্পী। এ ছবি দেখতে দেখতে ক্রমশ চিত্তে এর প্রভাব ঘনীভূত হয়ে আসে – দর্শক অভিভূত হয়ে পড়ে। আপনার কাজ অনেকটা ভ্রুবেলের (Mikhail Aleksandrovich Vrubel, একজন রাশিয়ান চিত্রকর) মতো। তাঁর ছবি কি কখনো দেখেছেন? হয়তো নয়?’

‘মনে তো হয় না।’

‘এ কি দান্তের পোর্ট্রেট?’

‘না। গত বছর জাপান থেকে ফেরার পথে এঁকেছি, আমার কলম আপন খেয়ালে চলে এই ছবি এঁকে তুলেছে।’

‘এ কিসের রং?’

‘কিছুই না। নীল ফাউন্টেন পেনের কালি।’

‘আপনি তেলরঙে ছবি আঁকেন?’

‘না।’

‘এটা কি মস্কোর ছবি?’

‘হবে। আমি কাল এঁকেছি হতেও পারে।’

(মৈত্রেয়ী দেবীর বিশ্বসভায় রবীন্দ্রনাথ থেকে)

১৭ই সেপ্টেম্বর মস্কোর বৃহত্তম মিউজিয়াম দি স্টেট মিউজিয়াম অফ নিউ ওয়েস্টার্ন আর্ট ভবনে কবির চিত্র-প্রদর্শনী হয়। সেখানে প্রচুর মানুষ তা দেখতে আসেন।

১৯৩০ সালে ইউরোপ এবং আমেরিকার নয়টি শহরে কবির চিত্র-প্রদর্শনী হয়। রবীন্দ্রনাথ ১৯৩৪ সালের ৭ই এপ্রিল, কবি সুধীন্দ্রনাথ দত্তকে উৎসর্গ করা একটি কবিতায় (শেষ সপ্তক, ১৬ নম্বর কবিতা) কবির পরিবর্তে একজন চিত্রশিল্পী হিসেবে তাঁর উৎসাহের কথা বলেছেন।

ষোলো

(শ্রীযুক্ত সুধীন্দ্রনাথ দত্ত কল্যাণীয়েষু)

পড়েছি আজ রেখার মায়ায়।

কথা ধনীঘরের মেয়ে,

অর্থ আনে সঙ্গে করে,

মুখরার মন রাখতে চিন্তা করতে হয় বিস্তর।

রেখা অপ্রগল্‌ভা, অর্থহীনা,

তার সঙ্গে আমার যে ব্যবহার সবই নিরর্থক।

গাছের শাখায় ফুল ফোটানো ফল ধরানো,

সে কাজে আছে দায়িত্ব;

গাছের তলায় আলোছায়ার নাট-বসানো

সে আর-এক কাণ্ড।

প্রবন্ধটি লিখতে যে সমস্ত পুস্তকের সাহায্য নেওয়া হয়েছে –

১.    Visvasabhay Rabindranath by Maitraye Devi, Publisher : Oriental Langman, New Delhi, 1951.

২.    Rabindranath Tagore : His world of art, Publisher : Niyogi Books, New Delhi, 2014.

৩.   The Last Harvest : Painting of Rabindranath Tagore by Siva Kumar et al. Publisher : Mapin, New Delhi, 2011

৪. In Your Blossoming Flower-Garden :  Rabindranath Tagore and Vitoria Ocampo, Publisher : Sahitiya Akademi, New Delhi, 1988..

৫.         রবীন্দ্রজীবনী ও রবীন্দ্রসাহিত্য-প্রবেশক, লেখক : প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়, প্রকাশক : বিশ্বভারতী গ্রন্থনবিভাগ, কলকাতা, আশ্বিন, ১৩৯৭।

৬. The New York Times archive, October 27, November 20, 30 — 1930.