রবীন্দ্রনাথের কয়েকটি অগ্রন্থিত পত্র ভূমিকা ও টীকা :

ভূঁইয়া ইকবাল

পত্র : ১৩

সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়কে

 

শান্তিনিকেতন

[২৩ নভেম্বর ১৯২৭]

 

সুনীতি

[পত্রের এই অংশে ব্যক্তিবিশেষ বা কোনও বিশেষ ঘটনা সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের মন্তব্য থাকাতে, তা বাদ দেওয়া হ’ল।]

কিভাবে আছ, কি অবস্থায়? বিশ্ববিদ্যালয়ের চক্রান্ত চক্রে ঘুরপাক খাচ্চ, না লিখতে আরম্ভ করেচ? অর্থাৎ সরস্বতীর কমলবনের পঙ্ক ঘোলাচ্চ না পঙ্কজ রেণু বিকীর্ণ করচ?

নূতন অক্ষর রচনা সম্বন্ধে যে আলোচনা হয়েছিল সেটাকে কাজে খাটাবার সময় এল। বিচিত্রা সম্পাদক তোমার নির্দ্দেশ অনুসারে অক্ষর ঢালাই করতে রাজি আছেন এবং তুমি সে বিষয়ে ব্যাখ্যা করে যদি কিছু লেখ তাঁরা সেটাকে প্রকাশ করতে চান – এ সম্বন্ধে এদেশে তোমার মতই সবচেয়ে প্রামাণ্য এই কারণে বাংলা বর্ণমালায় নূতন অক্ষর যোজন তোমার মত ধ্বনিতত্ত্ব বিশারদের কাছেই প্রত্যাশা করি। তোমার কাছে আরো অনেক কিছু প্রত্যাশা করবার আছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিপুল চাপে তোমার মানসক্ষেত্রের অনেক বীজ হয়ত অঙ্কুরিত হতে বাধা পাবে – তার মধ্যে উপন্যাস রচনা একটা। তবু যদি উপন্যাস লেখো তাহলে শুদ্ধির জাদুজাল জড়িত কোনো একটা কৃত্রিম বিবাহের ট্র্যাজেডি তার বিষয় হতে পারে। ইতি ৯ অগ্রহায়ণ ১৩৩৪

তোমাদের

শ্রীরবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

 

তোমার ভ্রমণবৃত্তান্ত বেশ লাগবে, তবে প্রধান কারণ, ওর ভাষাটা অত্যন্ত তোমার নিজের মতো। অধিকাংশ লোক শিশুকাল থেকেই পরের মতো লেখা লিখতে অভ্যাস করে পরীক্ষায় মার্কা পায়  তাদের পক্ষে সকলের চেয়ে কঠিন কাজ হচ্চে নিজের কথা নিজের ভাষায় লেখা। তোমার এই লেখায় ধীরেন যাকে বলে ‘মজা’ সেইটে পাওয়া যাচ্চে। এ কলের জল নয় ঝরনার জল।

 

পত্র : ১৪

সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়কে

 

[মংপু, কালিম্পঙ্]

 

অমিয় বলছিলেন আমার সঙ্গে সায়াহ্নে ভ্রমণকালে তোমার খাতায় যেসকল তন্ন তন্ন বিবরণ জমিয়েছ তা প্রচুর এবং প্রকাশযোগ্য। এগুলি হাতের অক্ষরের অমত্মঃপুরে অবগুণ্ঠিত না থাকাই শ্রেয় মনে করি। ইতি ৪/৫/৪০

 

তোমাদের

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

 

পত্র : ১৫

প্রমথনাথ বিশীকে

 

ওঁ

[ফেব্রম্নয়ারি ১৯২৮]

কল্যাণীয়েষু

কাজে ছিলুম। লম্বা লেফাফাওয়ালা চিঠি এল – বোধ করি তোর কবিতায় ছিল ভরা। কাজ সেরে যখন খোঁজ করলুম কোথাও দেখ্তে পেলুম না। এমন অন্তর্দ্ধান কি করে সম্ভব হল বুঝতে পারচিনে। আর একবার কপি করে যদি পাঠাস তাহলে পালাতে দেব না। দেরি করিসনে।

তোর বসন্তসেনা পেয়েছি। ভাল লেগেচে। কেবল একটা কথা বুঝতে পারিনে। তোরা কি এ সংসারে ছেলেমানুষ হয়ে জন্মাস নি?

বিশ্বটা যে ফাঁকি সেটা একেবারে গোড়া থেকেই তোদের কাছে ধরা পড়েচে? যে কবি চিরছেলেমানুষ – বিশ্বের ভিতরে কিছু আছে এ বিশ্বাস যার কিছুতেই ঘুচল না, আর সেই আনন্দেই যার গান  – সাহিত্যের আসরে তার সুর কোনো দিন ক্লান্ত হয় না। বিশ্বকে যারা বিশ্বাস করেচে বিশ্বের সম্পদ তারাই পেয়েচে। মনে রাখিস Scienceও জগতের রহস্যে বিশ্বাস করেচে বলেই রহস্যের দ্বার তার কাছে খুলেচে – ও বলেনি যা পাই উপরে, তাই নিয়েই লোহার সিন্ধুক ভর্ত্তি করি। সায়ান্সও নবীনের, সাহিত্যও নবীনের – বিশ্বাসের সীমা নেই। ইতি ফাল্গুন ১৩৩৪

শুভাকাঙক্ষী

শ্রীরবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

পত্র : ১৬

প্রমথনাথ বিশীকে

[ফেব্রম্নয়ারি ১৯২৮]

 

তোর কবিতাভরা চিঠিখানা সম্পূর্ণ অদৃশ্য হয়েচে। ভারি দুঃখিত হয়েছি। এই অপরাধের দায়িত্ব বসমেত্মর হাওয়ার উপরে চাপাতে পারিনে – যদি কবিতা না হয়ে হিসাবের কাগজ হত তাহলেও সন্দেহ করতে পারতুম।

ওঁ

কল্যাণীয়েষু

তুই আমার কথাটা ঠিক বুঝতে পারিস্নি। তুই যে সুন্দরকে চিন্লি নে, বিশ্বাস করিস্ নে, বা অভ্যর্থনা করতে কুণ্ঠিত হোস আমি তা বলিনে। তোর লেখা পড়ে মনে হয় সুন্দরকে তুই কেবল বাইরে দেখতে চাস – ফুল গোপনে গোপনে যে ফলের ভূমিকা করে তাও যে সুন্দর – তার রস যে আরো নিবিড় ও বিচিত্র সে কথাটাকে তুই যেন হাল্কা করতে চাস্। সুন্দর সেখানে অতিপ্রকাশ্য, অতি প্রগল্ভ নয়, সে আপনার অমরত্বের গাম্ভীর্য্যে সমাহিত। বিশ্বগ্রন্থের মলাট খুব সুন্দর সন্দেহ নেই – কিন্তু যদি বলিস্ ভিতরে এর তুল্য কিছুই নেই তা হলে বল্ব, যা পড়তে পারিস্নে তাকে অবজ্ঞা করচিস। মলাটের রঙ ভিতরে নেই কিন্তু আর একটা রঙ আছে, শাদার ভিতরে মিলিয়ে থাকে বলেই যার বিশেষ মূল্য। তোর লেখায় সেই সুগভীরের প্রতি শ্রদ্ধার যেন কম্তি দেখি। অথচ কি সাহিত্যে কি কলায় এই সুগভীরের বাণীই অমস্নান থাকে। তোর রচনা আমার ভাল লাগে, তুই ঘর সাজিয়েছিস্ সুন্দর, কিন্তু এখনো বর আসেনি। তোর বন্দনা বিশ্বসুন্দরের বেদীর কাছে গিয়ে পৌঁছল না – তুই দেউড়িতে বসে সানাই বাজিয়ে চলেচিস। শুন্তে ভাল লাগে, কিন্তু মন বলে এইখানেই যদি থেমে যাই তাহলে সানাইয়েরও মানে পাওয়া যাবে না। সানাইওয়ালা কবিকে জিজ্ঞাসা করি, কই হে ভিতরের দরজা কোথায়? বাজিয়ে জবাব দেয়, ‘ভিতর’ বলে কোনো বালাই নেই, তোরণের সামনে কান পেতে বসে হাঁ করে চেয়ে থাকো। তারপরে? তারপরে বাস্! যাত্রী বলে, যতই ভালো লাগুক বেশিক্ষণ চল্বে না  – আমার নৈবেদ্য তোমার সানাইকে দিয়ে যেতে পারব না। ইতি ১৭ ফাল্গুন ১৩৩৪

শুভাকাঙক্ষী

শ্রীরবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

পত্র : ১৭

প্রমথনাথ বিশীকে

 

ওঁ

কলকাতা

[২১ মার্চ ১৯২৮]

কল্যাণীয়েষু

তোর ‘শকুন্তলা’ পড়ে খুসি হলুম। বেশ ভালো হয়েচে।

গত শনিবারে এবং কাল মঙ্গলবারে বিচিত্রায় এখনকার তরুণ সাহিত্যিকদের সঙ্গে তাদের সাহিত্যের রঙ্গিমা ও ভঙ্গিমা নিয়ে বিস্তর আলোচনা হয়ে গেছে। আমার যা বলবার ছিল তা যথেষ্ট স্পষ্ট করে বলেছি। আমার বিশ্বাস তাতে ফল হয়েচে। দূর থেকে এরা আপন কোণে আপন খেয়ালমতো সাহিত্যের খুব হাল্কা আদর্শ ঠিক করে নিয়ে মনে করে সেটাতে খুব বাহাদুরী এবং অপূবর্বতা দেখানো হোলো  – মোকাবিলায় আলোচনা করতে গিয়ে বুঝতে পারে জিনিষটাতে গৌরবের কিছুই নেই। সাহিত্যের পন্থা সহজপন্থীদের জন্যে নয়। এর মধ্যেও তপস্যা আছে। মানুষের প্রকৃতির মধ্যে যেসব জিনিষ অত্যন্ত শস্তা তাকেই খুব খেলো রকম করে লিখ্লেই সাহিত্যের উৎকর্ষ দেখানো হয় এই এক অদ্ভুত মত একদলের মধ্যে চল্তি হয়েচে। এরা পদ্মাবন থেকে কচুরীপানার মধ্যে সরস্বতীর আসন সরিয়ে আন্তে চায়। অথচ এদের অনেকের মধ্যেই প্রতিভার অভাব নেই। সেই প্রতিভাকে ধেনোমদ খাইয়ে তাকে নিয়ে শুঁড়িখানায় আসর জমানোকে এরা মনে করচে পৌরুষ এবং বাস্তব সত্যের পালোয়ানি। ইতি ৮ই চৈত্র ১৩৩৪

শুভাকাঙক্ষী

শ্রীরবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

 

পত্র : ১৮

প্রমথনাথ বিশীকে

 

ওঁ

‘Uttarayan’

Santiniketan, Bengal

কল্যাণীয়েষু

বিশি শেষকালে আমাকে নিয়ে পড়েছিস। বিষয় হিসাবে আমি কি নিতান্ত সহজ। আমার ইংরেজ বন্ধু Elmhirst আমাকে কিছুকাল ভালো করে জানবার সুযোগ পেয়েছিল, তার মতে আমার জীবনী লেখক অর্থাৎ খাঁটি বিচারক জন্মাবার আশা নেই। কিন্তু তুই প্রমাণ করেছিস কালোহ্যয়ং নিরবধি বিপুলা চ পৃথ্বী, অতএব অসম্ভবও সম্ভব হতে পারে। সাহিত্যিকদের মুস্কিল এই যে আমাদের সম্বন্ধে বিচার সরাসরি বিচার হতে বাধ্য। সে বিচার রসিকের আদালতে পালটিয়ে দিতে দেরি হয় না। কিন্তু তোর এই বইয়ের একটা মস্ত গুণ এই দেখলুম নিরবচ্ছিন্ন প্রশংসা এতে নেই। কিন্তু আমার হাসি পায় যখন দেখি, সাদা কথায় ভালো লাগল বা লাগল না, না বলে বড়ো বড়ো ছাঁদ বানিয়েছিস। যেন তোর আত্মবচনই আপ্তবচন। এর কোনো উপায় নেই। আর যাই হোক বইয়ের ভাষাটা ভালো। সুতরাং এটা সাহিত্য শ্রেণীর গণ্য। অর্থাৎ এর মূল্য কোনো চরম তত্ত্ব নিয়ে নয় নিজেরই স্বরূপ নিয়ে। শিক্ষালাভের জন্য না পড়লেও চলে আনন্দলাভের জন্যে পড়া যায়। মাঝে মাঝে তোর ইস্কুল মাস্টারি দেখে হেসেছি – কিন্তু মোটের উপর খুশি হয়েছি, বলেছি সাবাস। এতে আমার পরিচয় হয়তো আছে কিন্তু তোর নিজের পরিচয়ও আছে। ইতি ১/১০/৩৯

 

শুভার্থী

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

পত্র : ১৯

অন্নদাশঙ্কর রায়কে

কল্যাণীয়েষু,

এইমাত্র তোমার রাখী পড়লুম। বিশেষ ভালো লাগল। এর ভাষায় রূপ আছে, সবশুদ্ধ জড়িয়ে একটি বিশিষ্টতা দেখা গেল। ইতিপূর্বে তোমার গদ্য প্রবন্ধ পড়ে আনন্দ পেয়েছি। তোমার কবিতার মধ্যে সহজ নৈপুণ্য ও আবেগের নিবিড়তা এবং ছন্দের গতিশীলা দেখে তোমাকে সাধুবাদ দিচ্ছি।  ইতি ২ জানুয়ারি ১৯৩০

 

শ্রীরবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

 

পত্র : ২০

অন্নদাশঙ্কর রায়কে

কল্যাণীয়েষু,

কাল দৈবাৎ আমার হাতে একটু সময় ছিল তাই মনোযোগ করে তোমার ‘রাখী’ আর একবার পড়লুম। দেখলুম তোমার যথার্থই শক্তি আছে কিন্তু এখনো দ্বিধা ঘোচেনি। কতকগুলি কবিতা সম্পূর্ণ ভালো, আবার কতকগুলি যেন পিছিয়ে পড়েচে। এই বইয়ে সাধারণের কাছে তোমার প্রথম পরিচয়, এই জন্যে বিশেষ বাছাই করে কবিতাগুলি যদি সাজাতে তাহলে ভালো হত। সামনে তুমি উপস্থিত থাকলে আলোচনা করতে পারতুম। তোমার বইখানিতে স্থানে স্থানে হস্তক্ষেপ করেচি – এর থেকে বুঝতে পারবে আমার মতে কোথায় কি আকারের ত্রম্নটি। অবশ্য আমার মত তোমার মতের সঙ্গে যে মিলবেই এমন কোনো কথা নেই – এক্ষেত্রে তোমার মতেরই চরম অধিকার। ইতি ৩ জানুয়ারি ১৯৩০

শুভাকাঙক্ষী

শ্রীরবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

পত্র : ২১

জগদীশ গুপ্তকে

মংপু [১৯৩৮?]

 

কল্যাণীয়েষু,

তোমার বইখানা পেয়েছি, তোমাকে আশীর্বাদ জানাই। কবিতা যে পরিমাণে উৎকর্ষে পৌঁছলে তাকে অসঙ্কোচে অভ্যর্থনা করে নেওয়া যায় সে অত্যন্ত দুর্লভ। যে দুঃসাধ্য সাধনায় সিদ্ধি লাভ করলে সরস্বতীর অমর বর লাভ করা যায় তোমার ভাগ্যে যদি তা না ঘটে তবে কোহত্র দোষঃ। যত্ন করারই আনন্দ আছে।

আমার আশীর্বাদ গ্রহণ করো।

ইতি ১৫ জ্যৈষ্ঠ [১৩৪৫]

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

 

শ্রীজগদীশ গুপ্ত

অন্নদা সাহিত্য ভবন – কুষ্টিয়া

পত্র : ২২

অসিতকুমার হালদারকে

 

[২১ জুলাই ১৯৩৫]

শান্তিনিকেতন

কল্যাণীয়েষু

বানান সংস্কার পড়লুম। তিন সয়ের মধ্যে মূর্দ্ধণ্য [।] ষকে রক্ষা করার অর্থ বুঝি নে। শ বাংলা উচ্চারণে ব্যবহৃত হয় বাকি দুটো হয় না। জ-এর বদলে য ব্যবহার করাও ভ্রমাত্মক। বাংলায় অন্তস্থ্য য কে আমরা বর্গীয় জয়ের মতোই উচ্চারণ করি। অন্তস্থ্য য-এর উচ্চারণ বাংলায় নেই।

উপসংহারে বক্তব্য এই যে বাংলাদেশে কামাল পাশার আবির্ভাব যদি হয় তবেই বর্ত্তমান প্রচলিত বানানের পরিবর্ত্তন সম্ভবপর হতে পারে, যুক্তিতর্কের দ্বারা হবে না। ইতি ২১ জুলাই ১৯৩৫

রবিদাদা

 

পত্র : ২৩

বীণা বাগচীকে

 

ওঁ

শান্তিনিকেতন

কল্যাণীয়েষু

তোমাদের দাবী কেবল যে ক্লান্তিকর তা নয় হাস্যকর হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশে সমস্ত নবজাত শিশুদের নামকরণের দায় আমার উপরে চেপেছে। তুমি ভাবছ সমত্মান কেবল তোমারই কোলে আসে কিংবা তুমিই একমাত্র সমত্মানজননী আমার উপরে আবদার খাটে। যাকে রূপ দিয়েছ তুমি তাকে নাম দিতে পারো না? যাই হোক এই আমার শেষ – ‘কুসুমিকা’ নাম যদি পছন্দ হয় গ্রহণ কোরো নইলে আর কোনো নামাবলীর সৃষ্টিকর্তার স্মরণ নিয়ো। ইতি ২৫/৯/৩৮

 

শুভার্থী

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

 

পত্র : ২৪

অমিতা সেনকে

 

ওঁ

‘টঞঞঅজঅণঅঘ’

ঝধহঃরহরশবঃধহ, ইবহমধষ

[৪/৬/৩৯]

কল্যাণীয়েষু

ইতিপূবের্ব কবে তুই চিঠি লিখেছিস আমার তো মনেও নেই। তার থেকে প্রমাণ হয় না যে চিঠি আসে নি, প্রমাণ হয় যে আমার বিস্মরণশক্তির উন্নতি হচ্ছে। আজকাল পত্র ব্যবহারে আমার অসৌজন্য প্রায় ঘটে থাকে সেটা ইচ্ছাকৃত নয়। হিন্দুর লেখা সাহিত্যে হিন্দুর মনোভাব প্রকাশ পেয়ে থাকে বলে আজকাল মুসলমানেরা নালিশ করচে। এর প্রতিকারের একমাত্র উপায় হিন্দু সাহিত্যিকদের ধরে মুসলমান করে দেওয়া। আমরা তো শেষ প্রহরে এসে পৌঁচেছি এখন সমস্যাটা তোদেরই স্কন্ধে এসে চাপবে। হরিজনরা মুসলমান হবার জন্যে কোমর বাঁধচে, তারপরে তোদের পালা আসবে। কোরানের তর্জ্জমা যদি হাতের কাছে থাকে তাহলে এখন থেকে পড়তে সুরু করে দে।

আশ্রমবাসিনী দুটি কন্যার বিবাহ আসন্ন। যমুনা এবং নিবেদিতা আগামী আষাঢ় মাসেই পাত্রস্থা হবে। তুই যদি এখানে থাকতিস তাহলে প্রজাপতি এতদিনে তোর প্রতিও মনোযোগ করতেন। ইট্ ইজ্ নেভর টু লেট্ ইত্যাদি। ইতি ২১ জ্যৈষ্ঠ ১৩৪৬

স্নেহরত

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

পত্র : ২৫

কামাক্ষীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়কে

 

কালিম্পঙ

[৪ মে ১৯৩৮]

কল্যাণীয়াসু

তোমার ছবিগুলো ভালো হয়েছে। তোমাদের শান্তিনিকেতন পরিক্রমার স্মরণ-চিহ্ন রয়ে গেল। সেখানে কয়টা দিন উপভোগ করেছিলে, সে সংবাদ আমার পক্ষে স্মৃতি-সুখকর। তোমার রচনা সম্পর্কে আমার অভিমত চেয়েছ। আমি তোমাদের থেকে বহু দূরে পড়ে গেছি, তাই ঝাপসা দেখি। তোমাদের ছন্দহারা কবিতাগুলি দেখে মনে হয় যেন আধুনিক কাব্যযুগের বিনতানন্দন। ডিম ভালো করে ফোটবার আগেই বেরিয়ে পড়েছে ডানা সম্পূর্ণ হয়নি। কিন্তু খিদে এবং চঞ্চলতা কম নয়। উপমাটিকে আরো একটু সুসঙ্গত করতে পারলে খুশি হতুম। কিন্তু হোলো না। তোমরা রবিরথের বল্গা ছিন্ন করে ধূমকেতুর মতো দৌড় মারবার চেষ্টায় আছ, একটা সৃষ্টিছাড়া জগতের দিকে এমন পথ বানাতে চাও, যার কেন্দ্র খুঁজে পাওয়া যাবে না – কেন্দ্রবিরোধী বৈরাগী তোমরা। ইতি ২১শে বৈশাখ ১৩৪৫

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

 

পত্র : ২৬

কামাক্ষীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়কে

কালিম্পঙ

কল্যাণীয়েষু

দৃষ্টির ক্ষীণতায় পড়তে কষ্ট হয়, লিখতেও বাধা পাই।

এলিয়ট, অডেন প্রভৃতি ইংরেজ কবির মনে বর্তমান কালের দুর্যোগের যে আঘাত লেগেছে সেটা সত্য এবং প্রচ-। সেই সংঘাতে চিমত্মার তরংগ উঠে আগেকার কালের অভ্যস্ত ভাষাধারার কাঠামো ভেঙে ফেলেছে। ভঙ্গী বদল হয়েছে, কিন্তু তাঁদের রচনায় এ যুগের বাণী উঠছে জেগে কতক স্পষ্ট রূপ নিয়ে। কতক অস্পষ্ট ব্যঞ্জনায়। তাঁরা যথার্থ কবি এই জন্যে বাণী তাঁদের মনে আলোড়িত হয়ে উঠলে সেটা ব্যক্ত না করে থাকতে পারেন না বলেই লেখেন। কিন্তু যে সাহিত্যে মানুষকে বলবার মতো কোনো বাক্য দুর্নিবার হয়ে ওঠেনি কেবলমাত্র একটা এলোমেলো প্যাটারন্ চলছে আঁকাবাঁকা আঁকজোক কেটে, সেখানে এনে কোনো একটা দান পায় না, কেবল হুঁচোট খেয়ে মরে। সে সাহিত্যে একটা কোনো তাৎপর্য হাৎড়িয়ে বেড়ানোর মতো ক্লান্তিকর আর কিছুই নেই। আমাদের সেকেলে রচনার প্রয়াসে আধুনিকের চোখে নানা প্রকার ত্রম্নটি ঠেকতে পারে কিন্তু একথা বলতেই হবে যে, বিশ্বব্যাপারের সম্পর্কজনিত একটা কিছু বলবার আবেগ থেকেই তার প্রেরণা। হালের বাজারদর অনুসারে ভোজের আয়োজনকে অবজ্ঞা করতে পারো… পাতে যদি মুড়ি মুড়কি থাকে তবে আমার পক্ষে সেই ভালো কিন্তু কেবলমাত্র হাপুসহুপুস শব্দের [?] বিচিত্র স্বরভঙ্গির দ্বারা নিমন্ত্রণের মর্যাদা রক্ষা হয় না। …এই যা বলা গেল এটা বাংলাদেশের বিশেষ শ্রেণীর আধুনিকতা সম্পর্কে আমার মত। বিশেষভাবে তোমাকে আমি বলচি নে। তোমার লেখায় রূপের একটা উন্মেষ দেখা দিয়েছে। এই রূপ জাগরণের উদ্যম। ভিতরে বাণীর বেদনা না থাকলে সম্ভব হয় না।

সব জায়গার বিকাশ সম্পূর্ণ হয়নি, অন্তত আমার বোধের কাছে। মনে হয়, যে-আঙ্গিককে গ্রহণ করেছ সেটা তোমার স্বভাবের সঙ্গে সম্পূর্ণ সহজ হয়ে মেলেনি। সে পাগলা ঘোড়ার মত দৌড় দেয় কিন্তু কবিকে পিঠের উপর থেকে ছিটকিয়ে ফেলে। মুস্কিল এই, আধুনিকের বাজারে কাব্যের স্বচ্ছতার মূল্য কমে গেছে। ইচ্ছা করে আবিলতার চর্চা করত কিনা বুঝতে পারি নে। রচনার পক্ষে এটা অস্বাভাবিক। কিন্তু মানব সমাজে ফ্যাশন জিনিষটা বারে বারেই অস্বাভাবিকতাকে অবলম্বন করে মনোযোগকে ছিনিয়ে আনতে চেয়েছে। কিন্তু যে ফ্যাশন মানব স্বভাবকে উদ্ধত অবজ্ঞায় বিদ্রূপ করে সেইসব অদ্ভুত ছাপের উল্কি পরা ফ্যাশন বেশি দিন টেঁকে না। [অস্পষ্ট…] বলবার কথা সত্য হয়ে না থাকলে বাঁকা ভঙ্গী দুর্বোধ্যতা বানিয়ে ভুলে বাহাদুরি নেয় কিন্তু যথার্থ বলবার কথা যদি থাকে তাকে স্বভাবতই সে স্বচ্ছতাকে কামনা করে। ইতি ১৯/৫/৪০

রবীন্দ্রনাথ

 

আমার ক্ষীণ-দৃষ্টি সত্ত্বেও তোমার বই আরো কিছু পড়ে দেখলুম। পড়বার জিনিস আছে বটে।

 

 

পত্র : ২৭

শ্যামাদাস লাহিড়ীকে

কল্যাণীয়েষু

শব্দতত্ত্ব গ্রন্থে লেখায় চিহ্ন বর্জন সম্বন্ধে আমার মত প্রকাশ করেছি। নিত্য ব্যবহারে আমার এ মত চলবে না তা জানি। এটা একটা আলোচনার বিষয় মাত্র। চিহ্নগুলোর প্রতি অতিমাত্রা নির্ভরতা অভ্যস্ত হলে ভাষায় আলস্যজনিত দুর্বলতা প্রবেশ করে এই আমার বিশ্বাস। চিহ্ন সঙ্কেতের সহায়তা পাওয়া যাবে না এ-কথা জানি তবে ভাষার আপন সঙ্কেতের দ্বারাতেই তাকে প্রকাশবান করতে সতর্ক হতে পারি : অন্তত আজকাল ইংরেজির অনুকরণে লিখিত ভাষাগত ইঙ্গিতের জন্যে চিহ্নসঙ্কেতের অকারণ বাড়াবাড়ি সংযত হতে পারে। এই চিহ্নের প্রশ্রয় পেয়ে পাঠসম্বন্ধে পাঠকদেরও মন পঙ্গু হয়, প্রকাশ সম্বন্ধে লেখকদেরও তদ্রূপ। কোনো কোনো মানুষ আছে কথাবার্তায় যাদের অঙ্গভঙ্গি অত্যন্ত বেশি। সেটাকে মুদ্রাদোষ বলা যায়। বোঝা যায় লোকটার মধ্যে সহজ ভাবপ্রকাশের ভাষাদৈন্য আছে। কিন্তু কথার সঙ্গে ভঙ্গি একেবারে চলবে না এ-কথা বলা অসঙ্গত তেমনি লেখার সঙ্গে চিহ্ন সর্বত্রই বর্জনীয় এমন অনুশাসনও লোকে মানবে না।

বাংলাসাহিত্যে নাটক আজো প্রাধান্য পায়নি, এ-কথা নিঃসন্দেহ। কারণ কি, সে সম্বন্ধে আমি চিমত্মা করেছি। মনে ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ে

বক্তৃতাধারার মধ্যে এই প্রসঙ্গের অবতারণা করব। সে ধারা বন্ধ হয়ে গেছে। বিনা তাগিদে লিখব শরীরে মনে সে উদ্যম নেই। অতএব অধ্যাপকদের উপরই মীমাংসার ভার রইল।  দুর্ভাগ্যক্রমে আমাদের দেশে অধ্যাপনার আদর্শ উচ্চদরের নয়। অন্যদেশের অধ্যাপকদের পরিচয় পেয়েছি; তাঁরা কেবল হাটের মাল বহন করেন না, ক্ষেতেফসল উৎপাদন করেন। এখানকার অধ্যাপকদের লেখা সমালোচনা পড়েছি; বাঁধা মতের পণ্য নিয়ে ছাত্র পড়াতে তাঁদের মন অভ্যস্ত; ইস্কুল মাস্টারির গ– তাঁরা পেরোতে পারেননি। য়ুরোপীয় অধ্যাপকদের রচিত আলোচনা তো পড়েছ, তার মধ্যে মতামতের চেয়ে বড়ো জিনিস হচ্ছে তার শক্তি, তার অনুপ্রেরণা। এই শক্তির একটা কারণ সেখানকার পাঠকেরা ছাত্রশ্রেণির নয়, তাদের বুদ্ধিবিদ্যাকে নাবালকের মতো গণ্য করা চলে না। সুশিক্ষিত চিমত্মাশীল পাঠকেরাই বলবান ও মূল্যবান চিমত্মার প্রবর্তনা করে। ইতি ৩/৩/৩৭

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

 

পত্র : ২৮

শ্যামদাস লাহিড়ীকে

 

ওঁ

কল্যাণীয়েষু

তুমি যে সব প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করেছ তার যথোচিত উত্তর দেবার মতো শক্তি ও সময় আমার নেই।

গোরা উপন্যাস সম্বন্ধে আমার কোনো লেখায় কোনো সংশয় প্রকাশ করেছি বলে মনে পড়ে না – করবার কোনো কারণ ঘটেনি।

ললিতা বিনয়ের বিবাহে সামাজিক বিঘ্ন কী ঘটতে পারে, সে কথা গোরা নভেলে বিচার্য বিষয় নয়, যে দুর্নিবার আবেগে তারা মিলিত হয়েছে সেইটের মনস্তত্ত্বঘটিত সত্যতাই লেখক কল্পনা করেছে, তার থেকে তাদের সমত্মানদের কী দুর্গতি হতে পারে সেই সামাজিক তত্ত্ব নিয়ে দুশ্চিমত্মা করবার স্থান উপন্যাস নয়।

আর্টই আর্টের পরিণাম এ-কথা বলতে বোঝায় আনন্দই আনন্দের পরিণাম। আনন্দের পরিণাম বিজ্ঞান নয়, দর্শন নয়, হিতোপদেশ নয়। সকালবেলার ভৈরোঁ গান শোনা হয়তো স্বাস্থ্যের অনুকূল কিন্তু আরোগ্যতত্ত্বই ভৈরোঁ গানের চরম তত্ত্ব এ-কথা না বলে বলা উচিত গানের মধ্যেই গানের চরমতা আছে। জাপানে যখন ছিলেম একজন পুরাতন চৈনিক চিত্রকরের আঁকা একটি অত্যাশ্চর্য বাঘের ছবি দেখেছি। আমি নিশ্চিত জানি সেই ছবি এঁকে তিনি অহিংস নীতি প্রচার করতে চাননি – প্রাণী বিজ্ঞান শিক্ষা দেওয়া তাঁর উদ্দেশ্য ছিল না ছবির মধ্যেই আছে তার প্রমাণ – কারণ তাতে বাঘের প্রকৃতিই প্রকাশ পেয়েছে, আকৃতির হয়তো বৈষম্য ছিল। মুখ্য কথা এই যে, এ-ছবি আঁকতে তাঁর আনন্দ, ছবি দেখতে আমার আনন্দ। এই কথাটাকে ৎবধষরংস-এর লক্ষণ বলা একেবারেই চলে না – ওফবধ-কেই ওফবধ-র লক্ষ্য বলে স্বীকার করে বিশুদ্ধ ওফবধষরংস – টঃরষরঃধৎরধহরংস তা করে না। ইতি ১৭ অক্টোবর ১৯৩৫

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

 

 

পত্র : ২৯

শ্যামাদাস লাহিড়ীকে

 

ঠরংাধ-ইযধৎধঃর

ঝধহঃরহরশবঃধহ, ইবহমধষ.

ওঁ

কল্যাণীয়েষু

তোমার পূর্বের কোনো চিঠি আমার হাতে পৌঁছয় নি। পত্রের উত্তর দেওয়া আমার পক্ষে দুঃসাধ্য হয়েছে বলেই সকল চিঠি আমার হাতে আসে না।

আমার জীবনের ইতিহাস আমার পক্ষে লেখা সম্ভব হবে না। ইচ্ছাও নেই সময়ও নেই। আমার রচনার মধ্যে দিয়েই আমার জীবনের যেটুকু প্রকাশ পায় আমি বোধ করি পাঠকদের পক্ষে তাই যথেষ্ট। মানুষ হিসাবে নিজেকে আমি বিশেষভাবে আলোচ্য বলে মনেই করি নে।

আমার সম্বন্ধে অন্যরা যা লিখেচে তা নিঃসন্দেহই নির্ভরযোগ্য নয়।

আমি অনেককাল নিরামিষাশী ছিলাম – এখনো মাঝে মাঝে ছেড়ে দিই। রুচি নেই আমিষে, শরীরের প্রয়োজনে খেতে হয়। মন তাতে প্রসন্ন হয় না। ইতি ২২ কার্তিক ১৩৩৯

শ্রীরবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

 

প্রাসঙ্গিক তথ্য

পত্র : ১৩-১৪

প্রাপক সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় (১৮৯০-১৯৭৭) – The Origin and the Development of the Bengal Language (1926) [ODBL]-খ্যাত, রবীন্দ্রনাথ যাঁকে ‘ভাষাচার্য’ অভিহিত করে বাংলা ভাষা-পরিচয় উৎসর্গ করেছেন এবং শেষের কবিতায় তাঁর উলেস্নখ করেছেন। তাঁর পরিচয় সারস্বত সমাজে সুবিদিত। সুনীতিকুমার বৈদেশিকী (১৯৪৩) উৎসর্গ করেন রবীন্দ্রনাথকে।

১৯২৭ সালে রবীন্দ্রনাথের আমন্ত্রণে তাঁর সফরসঙ্গী হয়ে জাভা, সুমাত্রা, বালি, মালয় ও শ্যামদেশে তিন মাস ভ্রমণ করে দিনপঞ্জিতে অভিজ্ঞতার অনুপুঙ্খ বিরবণ তুলে ধরেছেন। রবীন্দ্র-সংগমে দ্বীপময় ভারত ও শ্যামদেশের (দ্বি-স ১৯৬৫, পুনর্মুদ্রণ ১৯৮০) ভূমিকায় উলেস্নখ করেছেন :

শ্যামদেশে ভ্রমণকালে, আমার খাতায় দিনের পর দিন ধ’রে যে-সমস্ত কথা আমি লিখে রেখেছিলুম, সে-সমস্ত প্রকাশের ইচ্ছা ছিল, আর স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ, এগুলি যাতে আমি তাড়াতাড়ি ছাপিয়ে ফেলি, সে-বিষয়ে ইচ্ছা প্রকাশ ক’রে আমাকে চিঠি লিখেছিলেন।

এখানে গৃহীত চিঠি দুটিতেই ওই সফরনামা প্রকাশের তাগিদ দিয়েছিলেন কবি।

রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে পরিচয়ের বিবরণ দিয়েছেন :

রবীন্দ্রনাথকে প্রথম চাক্ষুষ দেখি স্বদেশী আন্দোলনের গোড়ার দিকেই – বোধহয় ১৯০৫ খ্রিষ্টাব্দে… পরে ইউনিভার্সিটি ইন্সটিটিউটে দ্বিতীয় দর্শন। সাধারণ ব্রাহ্মসমাজে যেবার তিনি আত্মপরিচয় বলে প্রবন্ধ পাঠ করেন, সেবারও তার দর্শন-লাভ আর পাঠ-শ্রবণ ঘটেছিল। পরে এম.এ পাশ কর্বার পরে, শান্তিনিকেতনে যাই, সেখানে তাঁর সঙ্গে বাঙ্লা ভাষা নিয়ে প্রথম আলোচনা করি।…

(উদ্ধৃত, অভ্র বসু, ‘বাকপতি’ ও ‘ভাষাচার্য’, কোরক শারদ সংখ্যা ১৪১৪, পৃ ৩২৩-৩২৪।)

১৯২০-২১-এ লন্ডনে তাঁর সঙ্গে কবির যোগাযোগ ও ঘনিষ্ঠতা হয়।

এই দুটি ছাড়াও সজনীকান্ত দাসের মারফত কবি তাঁকে একটি চিঠি পাঠিয়েছিলেন (শনিবারের চিঠি, মাঘ, ১৩৩৪)।

 

পত্র : ১৫-১৮

প্রাপক প্রমথনাথ বিশী (১৯০১-৮৫) রাজশাহীতে জন্মগ্রহণ করেন। শৈশবেই শান্তিনিকেতন বিদ্যালয়ে ভর্তি হন। কবির স্নেহধন্য। ১৯১৯-এ প্রবেশিকা পরীক্ষা পাশ করে শান্তিনিকেতনেই শিক্ষকতা শুরু করে আই.এ. পাশ করেন। রাজশাহী কলেজ থেকে স্নাতক হয়ে প্রাইভেট পরীক্ষার্থী হিসেবে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলায় এম.এ. পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থান অর্জন করেন। কলেজে শিক্ষকতা ও সাংবাদিকতা করে ১৯৫০-এ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেন এবং পরে বাংলা বিভাগের প্রধান হন।

রবীন্দ্রনাথের কাছে অভিনয় শেখেন, তাঁর লেখা যাত্রাপালা শান্তিনিকেতনে মঞ্চস্থ হয়। ছাত্রাবস্থায়ই শান্তিনিকেতন পত্রিকা সম্পাদনা করেন এবং ওই পত্রিকায় বহু রচনা প্রকাশ করেন। তাঁর বই : রবীন্দ্রকাব্যপ্রবাহ, রবীন্দ্রনাট্যপ্রবাহ, রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্প, রবীন্দ্রনাথ ও শান্তিনিকেতন এবং শিলাইদহে রবীন্দ্রনাথ। উপন্যাস কেরী সাহেবের মুনশী রবীন্দ্র পুরস্কারপ্রাপ্ত।

তাঁকে লেখা আঠারোটি চিঠি (১৯১৮-৩৯) নিজেই পরিচয়সহ টেগোর রিসার্চ ইনস্টিটিউটের মুখপত্র রবীন্দ্রভাবনার বিশেষ সংখ্যায় (অক্টোবর ১৯৭৯) প্রকাশ করেন।

 

পত্র : ১৫

এই চিঠির বিষয়ে প্র. না. বি. মনে করেন, তাঁর বসন্তত্মসেনা কাব্য সম্পর্কে কবি যে মন্তব্য করেছেন, তা সাধারণভাবে সত্য হলেও ওই বই সম্পর্কে সত্য নয়। তিনি চিঠি পেয়ে সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবাদপত্র পাঠান।

 

পত্র : ১৬

এখানে সংকলিত দ্বিতীয় পত্র বিষয়ে প্রাপক জানান, ‘এই মন্তব্য আমার বই সম্পর্কে সর্বাংশে সত্য হতে পারে না তা তাঁকে জানিয়েছিলাম।’

 

পত্র : ১৭

এই চিঠির বিষয়ে বিশীর বক্তব্য : শকুন্তলা নামে আমার দুটি কবিতা আছে তারই উলেস্নখ।

পরবর্তী অংশে বিচিত্রার সভার প্রসঙ্গ। চিঠিখানি ১৯২৮ সালে লেখা…। তখনকার তরুণ সাহিত্যিকেরা কেউ কেউ ভূঁই ফুঁড়ে উঠে আধুনিকতার জয়ধ্বজা তুলেছিলেন। কিছু প্রবীণ সাহিত্যিক তাঁদের উৎসাহও দিলেন। এই পত্রে তাঁদেরই আধুনিকতার সম্বন্ধে কবির মন্তব্য। [দ্র. পত্র-পরিচয়] পত্র পরিচয়ে বিশী উলেস্নখ করেছেন, রবীন্দ্রনাথকে যখনই যে বই পাঠিয়েছি সে সম্বন্ধে ভালয় মন্দয় মেলানো একটা উত্তর পেয়েছি।… আজকের দিনে যাঁরা বাংলা সাহিত্যের প্রধান লেখক তাঁরা অপর লেখকের বই সম্বন্ধে মতামত না-জানাতেই সচেষ্ট। অনুজ লেখকদের প্রশংসা বড়ো একটা চোখে পড়ে না। বোধ হয় ধারণা এই যে, অনুজ লেখকের প্রশংসায় তার যে পরিমাণ সুবিধা নিজের সেই পরিমাণ অসুবিধা।

 

পত্র : ১৮

১৯৩৯-এ প্রকাশিত রবীন্দ্রকাব্যপ্রবাহ সম্পর্কে এই চিঠি। প্র. না. বি-র নিজের বয়ান : রবীন্দ্রনাথকে এক কপি পাঠালাম। কয়েক মাস পরে এই চিঠিখানি পাই।… তিনি যে খুসি হয়েছেন তা মনে হয় না। বইখানিতে ‘রবীন্দ্রকাব্যে দোষ’ বলে একটা পরিচ্ছেদ আছে। আমার বিবেচনায় দোষ দুটি ‘অতিকথন’ ও ‘সামান্যকথন’। এটা তাঁর মনে খুব লেগেছিল। ইতিপূর্বে তাঁর সম্বন্ধে এমন উক্তি কেউ করেনি আর শেষকালে করল কি না এমন একজন যে বাল্যকাল থেকে তাঁরই ছায়ায় বড় হয়ে উঠেছে। এই ‘অতিকথন’ কথাটায় যে তাঁর মনে খুব আঘাত লেগেছিল তা জানতে পারলুম তাঁর মৃত্যুর পরে। কাব্যপ্রবাহের আগে প্রকাশিত জোড়াদীঘির চৌধুরী পরিবার নামে উপন্যাসখানা তাঁকে পাঠিয়েছিলাম, ভাল মন্দ কোন উত্তর পাইনি। বইখানা ছিল উত্তরায়ণের লাইব্রেরীতে। বইখানার ভিতরে কবির হস্তাক্ষর লক্ষ্য করে আমার কোন বন্ধু আমাকে পাঠিয়ে দিলেন এই সর্তে যে বইখানা পড়ে ফেরৎ পাঠাতে হবে। বই খুলে অতিপরিচিত হস্তাক্ষরে লিখিত দেখলাম, ‘একি অতিকথন নয়।’ আরও অনেক মন্তব্য ছিল যেমন – ‘একি পাগলামী’ ‘একি অদ্ভুত কা-।’ কিন্তু সবচেয়ে বেশি ছিল ‘একি অতিকথন নয়’ ‘অতিকথন আর কাকে বলে।’ সেই সঙ্গে সঙ্গে পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা উপর থেকে নীচ পর্যন্ত দাগ দিয়ে কেটে দেওয়া।

পত্র : ১৯-২০

২রা জানুয়ারি ও পরদিনই ৩রা জানুয়ারি ১৯৩০-এ কবি এই

চিঠি-দুটি লেখেন অন্নদাশঙ্কর রায়ের (১৯০৪-২০০২) প্রথম কাব্য রাখীর পাঠ-প্রতিক্রিয়া জানিয়ে। ইউরোপে রচিত (১৯২৭-২৯) কবিতার এই সংকলনের প্রথম প্রকাশকাল ১৯২৯ আর দ্বিতীয় সংস্করণ বেরোয় পরের বছর। রবীন্দ্রনাথের ‘সংকেত অনুসারে’ কবিতাগুলি পরিমার্জিত। অন্নদাশঙ্করের রাখী কাব্য কবিকে উপহার দেওয়ার ও কবির প্রতিক্রিয়ার কথা তিন দশক পরে বিস্তারিত লিখেছেন ‘কবিগুরু’ স্মৃতিকথায় : কবিগুরু হেসে বললেন যে, ‘রাখী’ নামটা তাঁরই কল্পনায় ছিল, আমি কেমন করে জানতে পেরে আমার কাব্যগ্রন্থের নামকরণ করেছি। তারপর বইখানা নাড়াচাড়া করতে করতে বললেন, ‘এ ভুলটা অনেকেই করে। তুমিও করেছ দেখছি।’ আমি তখন ভয়ে কম্পমান। কী জানি কী ধরা পড়ে গেছে।

‘কথাটা অমৃত। অম্রিত নয়।’ এই বলে তিনি উচ্চারণের তফাৎ বুঝিয়ে দিলেন। প্রথমে ‘অ’ উচ্চারণ করে ‘মৃত’। পরে ‘অম্’ উচ্চারণ করে ‘রিত’।

বলা বাহুল্য ছন্দের দিক থেকে ঘোরতর পতন। আমি তখন লজ্জায় অর্ধমৃত। কবি আমারি কবিতা আমাকে পড়ে শোনালেন। বুঝলুম কানের মাথা খেয়ে বসে আছি।

রবীন্দ্রনাথ যখন আমার বইখানি একপাশে সরিয়ে রাখলেন তখন আমার ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ল। আমি মনে মনে বললুম, নিউ কাসলে কয়লা বয়ে আনা আর কবিগুরুর কাছে কবিতা বয়ে আনা একই রকম ব্যাপার নয় কি?

…শান্তিনিকেতন থেকে বহরমপুরে ফিরে এসেই পেলুম পর পর দুই চিঠি। দ্বিতীয়টির সঙ্গে তাঁকে উপহার দেওয়া আমার কবিতার বই। বইখানার পাতায় পাতায় তাঁর নিজের হাতের লেখা। তিনি যত্ন করে পড়েছেন ও সংশোধন করেছেন। আমি ধন্য। (‘কবিগুরু’, দেশ, রবীন্দ্রজন্মশতবর্ষ সংখ্যা, ৬ মে, ১৯৬১, পৃ ২৩।) অন্নদাশঙ্কর রায়কে রবীন্দ্রনাথ ১৯৪১-এর ৬ই মে শান্তিনিকেতন থেকে বাঁকুড়ায় একটি কবিতা উপহার পাঠান ‘শ্রীযুক্ত অন্নদাশঙ্কর রায় আই. সি. এস-কে।’ শেষ লেখা কাব্যের ১০-সংখ্যক কবিতা (প্রবাসী, শ্রাবণ, ১৩৪৮)।

আমার এ জন্মদিন-মাঝে আমি হারা

আমি চাহি বন্ধুজন যারা

তাহাদের হাতের পরশে

মর্তের অন্তিম প্রীতিরসে

নিয়ে যাব জীবনের চরম প্রসাদ,

নিয়ে যাব মানুষের শেষ আশীর্বাদ।

শূন্য ঝুলি আজিকে আমার;

দিয়েছি উজাড় করি

যাহা কিছু আছিল দিবার,

প্রতিদানে যদি কিছু পাই –

কিছু স্নেহ, কিছু ক্ষমা –

তবে তাহা সঙ্গে নিয়ে যাই

পারের খেয়ায় যাব যবে

ভাষাহীন শেষের উৎসবে।

…‘কবিতাটি অত্যন্ত করুণ। যতদূর মনে পড়ে নিচে কবির স্বাক্ষর ছিল কম্পিত হসেত্মর হিজিবিজির মতো। আমাকে তিনি তাঁর শেষ জন্মদিনে স্মরণ করেছিলেন। আমি ধন্য।’

অন্নদাশঙ্কর রবীন্দ্রনাথ বই প্রকাশ করেন (১৯৬২); তাঁর জীবন- শিল্পী উৎসর্গ করেন কবির শেষ জন্মদিনে (২৫ বৈশাখ, ১৩৪৮)।

 

পত্র : ২১

প্রাপক জগদীশ গুপ্ত (১৮৮৬-১৯৫৭)। কথাসাহিত্যিক জগদীশ গুপ্ত বোলপুর আদালতে কর্মসূত্রে দীর্ঘকাল কর্মরত থাকলেও রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ আলাপ-পরিচয়ের কোন তথ্য আমাদের কাছে নেই। তাঁর দুটি কাব্যগ্রন্থের প্রথমটি – অক্ষরা (১৯৩২) রবীন্দ্রনাথ পাঠিয়েছিলেন কুষ্টিয়া থেকে। রবীন্দ্রভবনে তাঁকে লেখা কবির একটি চিঠি সংরক্ষিত। কুষ্টিয়ার অন্নদা সাহিত্যভবনের ঠিকানায় প্রেরিত চিঠিটি কবি লিখেছিলেন মংপু থেকে। চিঠির নিচে কবির স্বাক্ষরের ওপরে ‘ইতি ১৫ জ্যৈষ্ঠ’ লেখা আছে। চিঠিটি কবির সচিব-কর্তৃক নকল। কবির নিজের বা সচিবের অসতর্কতায় সাল উলেস্নখ নেই। ১৯৩৮-৪০-এ তিন কিসিত্মতে মংপুতে মাসচারেক অবস্থান করেছিলেন। আমাদের ধারণা, ১৩৪৫/৪৬-এর ১৫ই জ্যৈষ্ঠ কবি জগদীশ গুপ্তকে তাঁর কাব্য সম্পর্কে মতামত জানিয়ে এই চিঠি লেখেন। তবে ১৯৩২-এ প্রকাশিত প্রথম কাব্য অক্ষরা পাঠ-প্রতিক্রিয়ায় না-কি দ্বিতীয় কাব্য কশ্যপ ও সুরভি (তারিখবিহীন) সম্পর্কে তা স্পষ্ট নয়। জীবনীকার ড. আবুল আহসান চৌধুরী জানিয়েছেন যে, কবির এই চিঠি কশ্যপ ও সুরভিতে উদ্ধৃত হয়েছে।

১৯৩১-এ প্রকাশিত লঘুগুরু উপন্যাসের সুদীর্ঘ সমালোচনা লিখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ (পরিচয়, কার্তিক, ১৩৩৮) [দেখুন, রবীন্দ্র-রচনাবলী, (দ্বাত্রিংশ খ-) বিশ্বভারতী ১৪১৯, পৃ ২৭১-২৭৪]। লেখক এই আক্রমণাত্মক সমালোচনা পড়ে ক্ষুব্ধ হয়ে তীব্র মন্তব্য করেছেন :

আমার লঘুগুরু বইটি সম্বন্ধে ‘জজিয়তি’ করিতে বসিয়া বিভিন্ন জনগণ যে রায় দিয়াছেন তাহার মধ্যে পরিচয়ে প্রকাশিত রায়টিই প্রধান – কারণ, তাহার ঘোষক স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ; এবং দ্বিতীয় কারণ বিচার্য্য বিষয় ছাড়িয়া তাহা বিপথগামী হইয়াছে, অর্থাৎ আসামীকে ত্যাগ করিয়া তাহা আসামীর নির্দ্দোষ জনককে আক্রমণ করিয়াছে।… পুস্তক পরিচয়ের শেষ অংশের চেহারাটাকে তার অভদ্র স্থলের দরুন নিঃসন্দিগ্ধ পুস্তক পরিচয়ের মত দেখাইতেছে না – ইহাই আমার আপত্তি।

‘নিবেদন’, উদয়লেখা (১৩৩৯), উদ্ধৃত, শ্রীলা বসু, পরিচয় পত্রিকায় রবীন্দ্রপ্রসঙ্গ, টেগোর রিসার্চ ইন্সটিটিউট, ২০০৭, পৃ ৬৮।

 

পত্র : ২২

প্রাপক অসিতকুমার হালদার (১৮৯০-১৯৬৪) – রবীন্দ্রনাথের দিদি শরৎকুমারীর দৌহিত্র। চিত্রশিল্পী অসিতকুমার কবি, শিশুসাহিত্যিক, গীতিকার, শিল্পের ইতিহাসবিদ, অভিনয়কলা, মূর্তিকলা ও মঞ্চস্থাপত্যেও সফল। তাঁর লেখা গানের স্বরলিপি করেছেন মাসী ইন্দিরা দেবী চৌধুরানী। তাঁর মাতুল ছিলেন অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর। অসিতকুমার শান্তিনিকেতনে বিদ্যালয়ে যোগ দেন (১৯১৪)। তিনি কলকাতা সরকারী আর্ট স্কুলে শিক্ষকতা করেন (১৯২০)। পরে কলাভবনের প্রথম অধ্যক্ষ হন। তিনি লখনউ সরকারী আর্ট কলেজে অধ্যক্ষতা করেন।

তাঁর ছবির একটি অ্যালবাম রুবাইয়াত অফ ওমর খৈয়াম (১৯৩৫)। তিনি রবিতীর্থে স্মৃতিকথা প্রকাশ করেছেন (১৩৬৫)।

রবীন্দ্রনাথ অসিতকুমারের বাগগুহা ও রামগড় (১৩২৮) বইয়ের ভূমিকা লেখেন। কবি তাকে অর্ধশতাধিক চিঠি লিখেছিলেন (দ্র. দেশ শারদীয় সংখ্যা, ১৪০৩)।

তিনি যুক্তাক্ষরবর্জিত শিশুতোষ সাহিত্য রচনা করেন। ১৯৩৫-এর ৯ জুলাই তিনি বাংলা বানান সম্পর্কে একটি প্রবন্ধ পাঠিয়েছিলেন কবির মতামত চেয়ে। তাঁর বক্তব্য ছিল টাইপরাইটারে যুক্তাক্ষর বর্জন করে হসন্ত ব্যবহার করে বাংলা লেখা সম্ভব।

পত্রে উলিস্নখিত কামাল পাশা তুরস্কে ভাষাসংস্কারের জন্যে আরবি -ফারসির পরিবর্তে রোমান লিপিমালা প্রবর্তন করেছিলেন।

অসিতকুমারের জন্মদিনে কবির দুটি আশীর্বাণী কবিতা :

কলাবিদ্যা কুঞ্জে-কুঞ্জে পুঞ্জ পুঞ্জ ফল

ভুঞ্জ তুমি রাত্রিদিন আনন্দে চঞ্চল।

কীর্তিতে রবিরে তুমি করো সমাচ্ছন্ন

লোমশ তুলিকা তব হোক ধন্য ধন্য।

সিন্ধুপারে দ্বীপতটে উচ্চ জয়নাদে

খ্যাতি যাক এক লম্ফে বায়ুর প্রাসাদে

রবি করে আশীর্বাদ। চির-আয়ুষ্মান

রবি-সুত তোমারে না দিক দৃষ্টি দান।

[১ বৈশাখ, ১৩২২]

 

আমার মূর্ত্তি পূর্ণ করি

মুক্তি পেল তোমার শক্তি,

রেখায় রেখায় নিত্যশিখায়

দীপ্তি পেল তোমার ভক্তি।

চক্ষে তোমার প্রাণের মন্ত্র

তাইত তোমার ধ্যানের দৃষ্টি

তোমার রসে আমার রূপে

রচিল এই নূতন সৃষ্টি।

[১৩৩৪ বঙ্গাব্দ]

দ্র. রবীন্দ্র-রচনাবলী-৩১, বিশ্বভারতী, ১৪০৭, পৃ ২৩-২৪।

 

পত্র : ২৩

প্রাপক বীণা বাগচী ১৯৩৮-এর ২২শে সেপ্টেম্বর পিরোজপুর থেকে কবিকে লেখা চিঠিতে দাবি করেছেন, ‘আপনি আমাকে আশ্রমে ছাত্রী থাকার সময় বিশেষ স্নেহের চোখে দেখতেন,…। ওই চিঠিতেই জানিয়েছেন তাঁর প্রথম শিশুকন্যার নাম রেখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ – ‘মুকুলিকা’।

রবীন্দ্রনাথ ওই চিঠি পেয়ে বিরক্ত হয়ে এই চিঠি লেখেন। এটি সঞ্জীব মুখোপাধ্যায়-সম্পাদিত বাহা পত্রিকায় (মে, ২০১৫) প্রকাশ পেয়েছে, পৃ ৯।

কবিকে লেখা বীণা বাগচীর চিঠিটি রবীন্দ্রভবনে সংরক্ষিত :

বৃহস্পতিবার

২২/৯/৩৮

কে/অব সমরেন্দ্রনারায়ণ বাগচী এসকোয়ার

মুনসিফ পো: পিরোজপুর (জে. বরিশাল)

 

পরম শ্রদ্ধাভাজনেষু

গুরুদেব। ২২শে ভাদ্র আমার আর একটি শিশুকন্যা হয়েছে। আমার প্রথম শিশুকন্যার নাম ‘মুকুলিকা’ আপনিই রেখেছিলেন। এই নবজাত শিশুকন্যাটিরও আপনি যদি একটা নামকরণ করে দেন, তাহলে বড়ই ধন্য হব। আপনি আমাকে আশ্রমে ছাত্রী থাকার সময় বিশেষ স্নেহের চোখে দেখতেন, তাই বারংবার আপনার কাছে নানান দাবী উপস্থিত করবার দুঃসাহস হচ্ছে।…

নবজাত শিশুকন্যা যদি আপনার দেওয়া নাম না পায়, তাহলে বড় হয়ে দুই বোনে তুমুল ঝগড়া বাধবে। মুকুলিকা তার ছোট বোনকে বলবে – ‘তোর নাম তো বিশ্বকবির দেয়া নয়।’ অতএব, সেই ঝগড়ার সমাধান করার জন্য মুকুলিকার ছোট বোনের জন্য, একটা নতুন নাম ভিক্ষা আপনার কাছে চাচ্ছি। আশা করি বঞ্চিত হব না। …ইতি

শ্রদ্ধাবনতা

বীণা

 

দ্র. ভূঁইয়া ইকবাল, রবীন্দ্রনাথ : তাঁর চিঠি, তাঁকে চিঠি, ঢাকা, মূর্ধন্য, ২০১১, পৃ ৭৪-৭৫।

 

পত্র : ২৪

প্রাপক অমিতা সেন (খুকু, ১৯১৪-১৯৪০)। বিশ্বভারতী পাঠভবন (স্কুল) ও শিক্ষাভবনের (কলেজ) প্রাক্তন ছাত্রী; সংস্কৃতে বি.এ সম্মান পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছিলেন। তিনি সুকণ্ঠের অধিকারী ছিলেন, রবীন্দ্রসংগীত-ভাণ্ডারী দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সুযোগ্য শিষ্যা ছিলেন। তিনি এক বছর সংগীতভবনের শিক্ষয়িত্রী ছিলেন। তাঁকে লেখা এক চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন : গান শুধু তোর কণ্ঠের কুশলতা নয়, তোর অন্তরের সম্পদ, বিধাতার দুর্লভ দান – এই কথা মনে করে তাকে কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্বীকার ও যত্নের সঙ্গে রক্ষা করবি।’ অমিতাকে প্রদত্ত শংসাপত্রে কবি বলেন : আমার রচিত যত গান অমিতা তাঁহার [দিনেন্দ্রনাথ] এবং আমার নিকট হইতে সংগ্রহ করিতে পারিয়াছে এমন দ্বিতীয় আর কেহ পারে নাই…। তাহার সাহায্যে আমার গানগুলি বহু পরিমাণে রক্ষা পাইবে ও বিস্তার লাভ করিবে এই আমার আশা ও আনন্দের বিষয় রহিল।’ ১৯৩৮-এর ১০ই ফেব্রম্নয়ারি এক চিঠিতে কবি তাঁকে লেখেন : ‘…আমার রচিত গান সংগ্রহ করবি, ব্যবহার করবি ও বিস্তার করবি এর জন্য আমার মন উৎসুক আছে। তোর শক্তি আছে, অনুরাগ আছে, এবং কণ্ঠ আছে সেই জন্যে আমার এই কাজে তোকে পেতে অনেকদিন থেকে ইচ্ছা করেছি।’

রবীন্দ্রভবনের মহাফেজখানায় অমিতাকে লেখা কবির কুড়িটি চিঠির ও একটি শংসাপত্রের নকল সংরক্ষিত।

এই চিঠিতে উলিস্নখিত ‘আজকাল মুসলমানেরা নালিশ করচে’ – প্রসঙ্গটি এরকম : মওলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁ-সম্পাদিত মাসিক মোহাম্মদী পত্রিকায় (জ্যৈষ্ঠ, ১৩৪৩) কবিতায় রবীন্দ্রনাথের পৌত্তলিক মনোভাবের অভিযোগ করা হয়। ক্ষুব্ধ কবি আনন্দবাজার পত্রিকায় প্রতিবাদ করে সুদীর্ঘ পত্র লেখেন। দ্র. ‘বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা প্রবেশিকা পাঠ্য’, রবীন্দ্র-রচনাবলী-৩২ (বিশ্বভারতী, ১৪১৯, পৃ ১৭৫-১৮১)।

 

পত্র : ২৫

প্রাপক কামাক্ষীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় (১৯১৭-৭৬) প্রেসিডেন্সি কলেজের স্নাতক। বি.এ সম্মান পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণিতে প্রথম (১৯৩৭)। এম.এ, পাশের পর দিলিস্নতে তথ্য ও প্রচার দপ্তরে প্রকাশন সহযোগীর কর্ম নেন। পরে দামোদর ভ্যালি কর্পোরেশনে সুধীন্দ্রনাথ দত্তের সহকারীর পদে কাজ করে মস্কোর প্রগতি প্রকাশনালয়ে অনুবাদক ছিলেন (১৯৫৭-৬১)। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে সাক্ষাৎ-পরিচয় ১৯৩৮-এ, তিনি যখন বুদ্ধদেব বসু ও সমর সেনের সঙ্গে শান্তিনিকেতনে বেড়াতে যান। কবি, শিশুসাহিত্যিক, অনুবাদক ও সম্পাদক কামাক্ষীপ্রসাদ উঁচুদরের আলোকচিত্রী ছিলেন।

এই চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ কামাক্ষীপ্রসাদের প্রথম কাব্য শবরী (১৯৩৭) সম্পর্কে মত জানান।

চিঠির অংশ অনুষ্টুপ (শারদীয়, ১৩২০) থেকে নেয়া। আর ‘তোমাদের ছন্দহারা… পারলে খুশি হতুম, কিন্তু হোলো না।’ নিয়েছি পিনাকী ভাদুড়ীর উত্তরসূরিদের প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ, নিউ এজ পাবলিশার্স, দ্বি-স ২০০৯, পৃ ১৩০ থেকে।

 

পত্র : ২৬

কামাক্ষীপ্রসাদ দ্বিতীয় কাব্য মৈনাক (১৯৪০) পাঠিয়ে কবির অভিমত প্রার্থনা করেন ১৬ই মে, ১৯৪০-এ লেখা এক চিঠিতে। তিনদিন পর তার জবাব এই চিঠি। ১৭ দিন পর (৬. ৬. ৪০) আবার লিখলেন এক অপ্রত্যাশিত পত্র :

‘হতবুদ্ধি পাঠকদের অনুরোধে তোমার মৈনাক আবার মন দিয়ে পড়তে হলো। মন যথেষ্ট পরিমাণে দিয়ে দুর্বল স্বাস্থ্যকে ক্লিষ্ট করেছি। অবশেষে বহু চেষ্টার পর স্বীকার করতে হলো এমন বিস্ময়কর দুর্বোধ্যতা ইতিপূর্বে অল্পই দেখেছি। অমিয়র [চক্রবর্তী] উৎসাহ বাক্যে স্থির করেছিলুম এর মধ্যে কাব্যের স্পষ্ট মূর্তি কিছু কিছু আছে। তাঁর সেই বিচারের উপর নির্ভর করে নিজের একান্ত ক্লান্ত দৃষ্টি বাঁচিয়ে তোমাকে যে চিঠি পূর্বে লিখেচি এখন দেখচি সেটা অসঙ্গত হয়েছে অন্তত আমার মতে। অমিয়র সঙ্গে দেখা হলে তাঁর সাহায্যে বোঝবার চেষ্টা করব। তিনি যে আর একজনকে বোঝাবার প্রয়াস করেছেন তাঁকেও জিজ্ঞাসা করে জানলুম তিনিও আমারি মত কিছুই বুঝতে পারেননি। স্পষ্ট দেখচি বোঝাবার অভিপ্রায় তোমার নেই, অতএব আমার এই চিঠিতে তোমাকে দুঃখ দেবে না।’

উদ্ধৃত, সুতপা ভট্টাচার্য-সম্পাদিত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের চিঠিপত্র (ষোড়শ খ-), বিশ্বভারতী, ১৯৯৫, পৃ ৩৯২-৩৯৩। বুদ্ধদেব বসুকে লেখা ২৭-সংখ্যক পত্রের গ্রন্থপরিচয় অংশে সংকলিত।

এই চিঠির ১৮ দিন পর (২৪. ৬. ১৯৪০) কালিম্পঙ থেকে বুদ্ধদেব বসুকে রবীন্দ্রনাথ লিখলেন : ‘…কামাক্ষীর শেষ বইটাতে দুঃসাধ্য রকমের দুর্বোধ দেখে তার লেখা সম্বন্ধে প্রশংসা প্রত্যাহার করেছিলুম, কিন্তু তার পরে মাসিকপত্রে তার কয়েকটি লেখা পড়ে দেখলুম সে সরল, আধুনিকতার ফ্যাশন প্রবেশ করে তাদের অস্বাভাবিক রকমের মোচড় দেয়নি, তাদের টেরা চোখে দেখতে হয়নি, আমার মতো তিনকুল খোয়ানো মানুষকেও কবুল করতে হোলো ভালো লেগেছে – এ কথা শুনে নতুন বাজারে তার লেখার দর কমে যাবার আশঙ্কা আছে। তা হোক তবু বিদঘুটে মালে খদ্দেরের ফরমাসে সে আপন সহজ শক্তিকে খোয়ায় না যেন,… সেই শক্তির পরিচয় পাওয়া যাচ্ছে।’… দেশ, মাঘ সংখ্যা, ১৩৮১ থেকে উদ্ধৃত, দীপেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়, ‘বিস্মরণের কামাক্ষীপ্রসাদ : অনুরাগীর অনুভবে’, শারদীয় অনুষ্টুপ ১৪২০,

পৃ ৭৫৭-৭৫৮।

ওই চিঠি দেখে তেইশ বছর বয়েসি কবি যশোপ্রার্থী কামাক্ষীপ্রসাদ কবিকে লেখেন : ‘আমার কাছে এ খবর অত্যন্ত আনন্দের। আপনার প্রশংসাবাক্য আমাকে উৎসাহিত করেছে।’ বুদ্ধদেব বসুকে উলিস্নখিত চিঠি লেখার তিনদিন আগে কবি কামাক্ষীপ্রসাদের বিয়ে উপলক্ষে এই আশীর্বাদী কবিতা লিখে পাঠিয়েছিলেন :

যে মিলনে সংসারের দুঃখ সুখ সহস্র ধারায়

আনন্দ সমুদ্র মাঝে দ্বন্দ্ব ভুলি আপনা হারায়

সে মিলন পূর্ণ হোক তোমাদের যুগল জীবনে,

লহ এই আশীর্বাদ তব শুভ দৃষ্টির লগনে।

৭ই আষাঢ়, ১৩৪৭

কালিম্পঙ

[২১.৬.১৯৪০]

দ্র. স্ফুলিঙ্গ (৪৭), রবীন্দ্র-রচনাবলী (৩১), বিশ্বভারতী, ২০০০,

পৃ ৪০। রবীন্দ্রভবনে সংরক্ষিত এই কবিতার ওপরে রবীন্দ্র-হস্তাক্ষরে লেখা : ‘কল্যাণীয় শ্রীমান কামাক্ষী’; রচনাবলীতে নামটি নেই।

 

পত্র : ২৭

দেশ শারদীয় ১৯৫৮ থেকে গৃহীত।

শব্দতত্ত্ব : প্রথম প্রকাশ ১৩১৫। ১৩৪২-এ বাংলা শব্দতত্ত্ব নামে প্রকাশিত। ১৩৯১-এ তৃতীয় স্বতন্ত্র সংস্করণ মুদ্রিত। সংকলক : পুলিনবিহারী সেন ও শুভেন্দুশেখর মুখোপাধ্যায়। ‘চিহ্নবিভ্রাট’ প্রবন্ধে সুধীন্দ্রনাথ দত্তকে লেখা দুটি চিঠি ভূমিকারূপে সংকলিত : পৃ ২৮৬-২৯২। এই প্রবন্ধে জীবনময় রায়কে লেখা চিঠিও অন্তর্ভুক্ত।

 

পত্র : ২৮

বিশ্ববিদ্যালয়ে বক্তৃতা ধারা : ১৯২৪-এর ১-৩ মার্চ কবি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে সাহিত্য বিষয়ে তিনটি মৌখিক ভাষণ দেন। পরে পুনরায় সেগুলি লিখে প্রকাশ করেন; ‘সাহিত্য’, ‘তথ্য ও সত্য’, ‘সাহিত্যের পথে’ ও ‘সৃষ্টি’ শিরোনামে। প্রথমে বঙ্গবাণী পত্রিকায় ও পরে সাহিত্যের পথে বইয়ে সংকলিত (নূতন সংস্করণ ১৩৬৫)।

 

পত্র : ২৯

আমার জীবনের ইতিহাস : আত্মপরিচয়-এর (১৩১১-র) সূচনা-বক্তব্য এ প্রসঙ্গে তুলনীয় : কাব্যের মধ্য দিয়া আমার কাছে আজ আমার জীবনটা যেভাবে প্রকাশ পাইয়াছে…। ইহাতে যে অহমিকা প্রকাশ পাইবে… ক্ষমা প্রার্থনা করি। (দেখুন, রবীন্দ্র-রচনাবলী, ২৭তম খ-, বিশ্বভারতী, ১৯৬৫, পৃ ১৮৯)। ৎ

 

[বি. দ্র. গত সংখ্যায় প্রকাশিত ৬ নম্বর পত্রের চৈতন্যমগ্নের জায়গায় চৈতন্যমঙ্গল পড়তে হবে]