রবীন্দ্রনাথের নোবেলপ্রাপ্তি নিউইয়র্ক টাইমসের বিশ্লেষণ

রবীন্দ্রনাথ নোবেল পুরস্কার পেলেন ১৯১৩ সালের ১৩ নভেম্বর। এই প্রথম কোনো অশ্বেতাঙ্গ এই পুরস্কার পেলেন। কবি তখন আমেরিকায় প্রায় অজানা, যদিও মাত্র এক বছর আগে ১৯১২ সালে আমেরিকা ঘুরে গেছেন। রবীন্দ্রনাথ যখন প্রথমবার ইংল্যান্ড থেকে আমেরিকা আসেন, তখন নিউইয়র্ক টাইমস সে-সংবাদটি প্রকাশ করতে পারেনি। কারণটা সহজেই অনুমেয়, রবীন্দ্রনাথ তখনো আমেরিকায় তেমন পরিচিতিলাভ করেননি। তখন কোনো পত্রিকা কেন, আমেরিকার সুধীজনরাও তাঁকে চিনতেন না।
রবীন্দ্রনাথ নোবেল পাওয়ার পরই এ-পত্রিকায় প্রথমবার তাঁকে নিয়ে সংবাদ এবং প্রবন্ধ ছাপা হয়। আমার এ-প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথের নোবেলপ্রাপ্তিতে তাঁকে নিয়ে নিউইয়র্ক টাইমসে প্রকাশিত সংবাদ এবং প্রবন্ধ নিয়ে আলোচনা করেছি।
স্টকহোমে রবীন্দ্রনাথের নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্তির সংবাদটি পরদিন ১৪ নভেম্বর নিউইয়র্ক টাইমস ছাপে। তবে টাইমস সংবাদটি ছাপে একটু ভিন্নভাবে। রবীন্দ্রনাথের আগে দশজন নোবেল বিজয়ীর সংবাদ পর্যবেক্ষণ করে দেখা গেছে, তাঁদের সংবাদে নোবেল বিজয়ীর জীবনবৃত্তান্ত এবং কী কারণে নোবেল পেয়েছেন এসব সম্পর্কেই আলোকপাত করা হয়েছে; কিন্তু রবিঠাকুরের ক্ষেত্রে দেখা যায়, সংবাদটির পরিবেশন একেবারে অন্যরকমভাবে করা হয়েছে।
প্রথমেই উলেস্নখ করতে হয় যে, খবরটিতে কবির নামের বানানটি ভুলভাবে ছাপা হয়েছে। Rabindranath-এর স্থলে ছাপা হয়েছে Babindranath। শুধু শিরোনামে নয়, সংবাদের মাঝেও একই ভুল করা হয়েছে। নোবেলপ্রাপ্তির মূল সংবাদের সঙ্গে সংযুক্ত করা হয়েছে আরো কিছু তথ্য, যা সংবাদটিকে দিয়েছে ভিন্নতা।
পুরো সংবাদটিকে তিনটি পর্বে ভাগ করা হয়েছে। সংবাদের মূল শিরোনামের নিচে আরো তিনটি সাব-হেডিং বা উপ-শিরোনাম দেওয়া হয়েছে। নিচে সংবাদটির একটি সংক্ষিপ্ত অনুবাদ দেওয়া হলো।
শিরোনাম : একজন হিন্দু কবিকে নোবেল প্রাইজ দেওয়া হলো।
(NOBEL PRIZE GIVEN TO A HINDU POET)
উপ-শিরোনাম : এই বছরের সাহিত্যে পুরস্কার প্রদত্ত হয়েছে বাংলার ববীন্দ্রনাথকে।
(This year’s Literature Award Conferred on Babindranath Tagre of Bengal)
উপ-শিরোনাম : রচনা সম্প্রতি অনূদিত হয়েছে
(WORK LATELY TRANSLATED)
উপ-শিরোনাম : ইউরোপে সৃষ্টি হয়েছে উন্মাদনা – ঠাকুর ভারতে একটি বিশিষ্ট পরিবার (Created a Furore Europe – The Tagore Family of the Most Distinguished India)

স্টকহোম, নভে, ১৩ – অদ্য সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার ঘোষিত হয়েছে যা পেয়েছেন ব্রিটিশ ভারতীয় কবি ববীন্দ্রনাথ ঠাকুর। এই প্রথমবার এই পুরস্কার শ্বেতাঙ্গ ছাড়া কোনো ব্যক্তি পেলেন।
ঠাকুর পরিবার বাংলা (বেঙ্গল) প্রদেশের অধিবাসী। এই পরিবারের অনেক সদস্যই সাহিত্য এবং কলায় অনুরক্ত, এবং কেউ কেউ ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিসে কর্মরত। রাজা স্যার সৌরীন্দ্র মোহন ঠাকুর ইউনিভারসিটি অব ফিলাডেলফিয়া থেকে ১৮৭৫ সালে সংগীতে ডক্টরেট ডিগ্রি পেয়েছেন।
লন্ডনের একটি পত্রিকার (নাম উলেস্নখ করা হয়নি) সূত্রে বলা হয়েছে –
কিছুদিন আগে কবির কিছু কবিতা অনূদিত হয়েছে যা ইউরোপে তৈরি করেছে উন্মাদনা। সেই পত্রিকা কবিকে ‘জীবিত কবিদের মধ্য সবচেয়ে বেশি আধ্যাত্মিক মনস্ক’ হিসেবে উলেস্নখ করেছে।
নিউইয়র্ক টাইমস সেই সংবাদে আরো উলেস্নখ করেছে যে, কবি সম্প্রতি প্রতীচী সফর করেছেন, তিনি ভারতের উদ্দেশে রওনা দেওয়ার পর কবির একটি সাক্ষাৎকার ওই পত্রিকায় প্রকাশিত হয় যেখানে একজন পশ্চিমা নৃত্যশিল্পী, মড অ্যালানের (Maud
Allan) কোলকাতা (কলকাতা) সফর নিয়ে কবিকে প্রশ্ন করা হয়। মিস অ্যালান ছিলেন কানাডায় জন্মগ্রহণকারী একজন নৃত্যশিল্পী (১৮৭৩-১৯৫৬), আমেরিকার সানফ্রান্সিসকোতে কেটেছে বাল্যকাল এবং পরে জার্মানিতে স্থায়ী হয়েছিলেন। তাঁর নতুন ধারার নৃত্য বিশ্বব্যাপী তাঁকে পরিচিতি দিয়েছিল। তিনি পিয়ানো বাজাতেও দক্ষতা অর্জন করেছিলেন। কবিকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, যে-নাচ ভারতীয় সংস্কৃতির সঙ্গে যায় না সেই নাচকে কবি কোন দৃষ্টিতে দেখেন? কবি বলেন, ‘তাঁর নাচ যদি ইংরেজদের জন্য ভাল হয়, তবে তা ভারতীয়দের জন্যেও ভাল।’ পরবর্তী সময়ে মিস অ্যালান তাঁর ভারত সফরে রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে নিউইয়র্ক টাইমসের কাছে তাঁর অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেন। মিস অ্যালান একই সফরে আফ্রিকা, চীন, অস্ট্রেলিয়া এবং নিউজিল্যান্ড সফরশেষে নিউইয়র্ক টাইমসের সঙ্গে সাক্ষাৎকার দেন, যা ১৯১৫ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর পত্রিকায় ছাপা হয়। সেখানে তিনি ঠাকুরবাড়িতে কোনো একটা অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়ার অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেন। উলেস্নখ করেন কলকাতার ট্রামের কথা, সরু গলির কথা, দোতলার কার্নিশে দাঁড়িয়ে মেয়েদের অনুষ্ঠান দেখার কথা। তিনি যখন ঠাকুরবাড়িতে যান, তখন সেখানে রবীন্দ্রনাথকে ঘিরে কিছু একটা হচ্ছিল। অনুষ্ঠানে শুভ্র শ্মশ্রম্ন সাদা আলখাল্লায় রবিঠাকুরকে তাঁর কাছে মনে হয়েছিল এক আধ্যাত্মিক পুরুষ, যেরকমটি তিনি তাঁর জীবনে আর কখনো দেখেননি।
নিউইয়র্ক টাইমস সংবাদটিতে লন্ডনের দি পল মল গেজেটের উদ্ধৃতি দিয়ে আরেকটি বিষয় উলেস্নখ করে – রবীন্দ্রনাথ যখন জাহাজে করে ইংল্যান্ড থেকে ভারত ফিরছিলেন, তখন দুজন মিশনারি কবিকে ধর্মান্তরিত করার চেষ্টা করেন। কবি খুবই শান্তভাবে তাঁদের বললেন, ‘আমি এটার জন্য অনেক বয়স্ক।’ তিনি তাঁদের চমৎকারভাবে বলেন, তাঁরা কেন তাঁদের নিজেদের লোকদের কাছে ধর্মোপদেশ দিচ্ছেন না, যাঁরা সবসময়ই মদ্যপান এবং জুয়া খেলায় লিপ্ত থাকে। তিনি মিশনারিদের এক্ষণই কিছু করতে চাইলে জাহাজের ধূমপানকক্ষে যেতে বলেন।
কবি বিষয়টিকে নমনীয়ভাবে সমাধান করায় পল মল গেজেটে কবির প্রশংসা করা হয়। নিউইয়র্ক টাইমসে সংবাদটির শেষ অংশে কবিপরিবারের বর্ণনা দিয়ে বলা হয়, ঠাকুর পরিবারকে বাংলার একটি ঐশ্বর্যশালী, বিশিষ্ট এবং প্রগতিশীল হিসেবে উলেস্নখ করে। ঠাকুরদের একজন হলেন মাননীয় মহারাজ বাহাদুর স্যার প্রদ্যোৎ কুমার, যিনি ১৯০৬ সালে নাইট উপাধিতে ভূষিত হয়েছেন, যার কোলকাতার চমৎকার বাড়িটি ভারতীয় শিল্পকলার নমুনায় পরিপূর্ণ। তিনি সংগীতের একজন পৃষ্ঠপোষক, ভারতীয় জাদুঘরের একজন তত্ত্বাবধায়ক এবং বহু জন-সংস্থার সদস্য। বেনারসে তাঁর একটি প্রাসাদ আছে এবং মধুপুরেও একটি আবাস আছে।
রাজা স্যার শরদিন্দু মোহন ঠাকুর ১৮৭১ সালে বেঙ্গল মিউজিক স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন এবং ১০ বছর পর প্রতিষ্ঠা করেন বেঙ্গল অ্যাকাডেমি অব মিউজিক। তিনি ইংরেজি, সংস্কৃত এবং বাংলায় বহু বই লিখেছেন।
সংবাদের শিরোনামে রবিঠাকুরকে একজন হিন্দু কবি হিসেবে উলেস্নখ করা হয়েছে, যদিও বাঙালি কবি শব্দটি হতো আরো উপযোগী।
পরদিন অর্থাৎ ১৯১৩ সালের নভেম্বরের ১৫ তারিখ নিউইয়র্ক টাইমস তার ‘টাইমস টপিক’ কলামে রবীন্দ্রনাথের নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্তি নিয়ে আলোচনা করে। সাধারণত কোনো গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ নিয়েই এই বিভাগে আলোচনা হয়। এই আলোচনা থেকে বোঝা যায়, টাইমস এবং পশ্চিমা দুনিয়া রবিঠাকুরের এই পুরস্কারপ্রাপ্তিতে অনেকটাই আশ্চর্যান্বিত হয়েছে। আশ্চর্যজনক হলেও সত্যি, সেদিনও টাইমস রবিঠাকুরের নাম ভুলভাবে ববীন্দ্রনাথ-ই লেখে। সংবাদটির শিরোনাম ছিল ‘আমাদের জন্য হতাশাজনক নয়’। সংবাদটি ভাবানুবাদ করলে যা দাঁড়ায় তা হলো …
সম্ভবত কিছুটা সংকীর্ণ পূর্বধারণার ফলাফল হিসেবে অনেকেই মনে করতেন, সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার বরাবরই পাশ্চাত্যের কোনো কবি অথবা গদ্যরচয়িতা পাবেন। তাঁরা কিছুটা বিস্মিত এবং অসন্তুষ্ট হলেন, যখন এটা কোনো হিন্দু কবি পেলেন যাঁর নাম উচ্চারণ করা কষ্টসাধ্য এবং মনে রাখা এর চেয়েও কঠিন। এর সবই সত্য হতে পারে; কিন্তু এটি একটি রূঢ় সত্য যে, আমাদের মনে গভীরভাবে এ-ধারণা প্রোথিত হয়ে আছে যে, আমরাই এর দাবিদার … শুধুমাত্র নোবেল কমিটি এর বিপরীত চিন্তা করেছে।
ঘটনাটিকে আরো সযত্নে বিশ্লেষণ করে কেউ কেউ এই বলে সান্তবনা খুঁজছেন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (নিউইয়র্ক টাইম লিখেছে BABINDRANATH TAGORE) ঠিক আমাদের মতো শ্বেতাঙ্গ না হলেও একজন আর্য, যারা শ্বেতাঙ্গদের দূর-আত্মীয়। উপরন্তু প্রাচ্যে জন্মগ্রহণ করলেও তিনি পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত। বাংলা ভাষায় তাঁর রচনা বৃহৎ জনগোষ্ঠীর কাছে তিনি চমৎকার ইংরেজিতে অনুবাদ করে পৌঁছে দিয়েছেন, যারা তাঁকে মুকুট পরাতে পারে আবার অবহেলাও করতে পারে।
কিছু ব্রিটিশ সমালোচক তাঁর কবিতা বিশ্লেষণ করে তাঁকে জীবিত কবিদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি আধ্যাত্মিকতামনস্ক হিসেবে অভিহিত করেছেন। তাঁর কাজের কিছু নমুনা এখন পরীক্ষা করে দেখার জন্য লভ্য – তিনি কি শুধুমাত্র আধ্যাত্মিকতামনস্ক নাকি তাঁর রয়েছে কল্পনার শক্তি, অন্তর্দৃষ্টি, সুরেলা ধ্বনি যা তাঁকে দিয়েছে শ্রেষ্ঠত্ব।

নোবেলপ্রাপ্তির পর রবীন্দ্রনাথের ওপর নিউইয়র্ক টাইমসের প্রথম প্রবন্ধ
রবীন্দ্রনাথের নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্তির পর ২৩ নভেম্বর, ১৯১৩ সালে নিউইয়র্ক টাইমস তাঁর ওপর একটি পূর্ণাঙ্গ প্রবন্ধ প্রকাশ করে। প্রবন্ধের মাঝখানে রবিঠাকুরের প্রতিকৃতির একটি স্কেচ ব্যবহার করা হয় এবং সন্নিবেশিত করা হয় বেশকিছু কবিতার ইংরেজি অনুবাদ। এবার রবিঠাকুরের নামের বানানে কোনো ভুল ছিল না। শিরোনাম ছিল, হিন্দু কবি, যিনি নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন ‘The Hindu Poet who won the Nobel Prize’ প্রবন্ধটিতে উপ-শিরোনাম ছিল – নিজ দেশের বাইরে সম্পূর্ণ অজানা, যদিও তিনি পঞ্চাশ মিলিয়ন মানুষের সমাদৃত কবি, বাঙালিরা যাকে বলে ‘রবীন্দ্রনাথের যুগ’।
(Entirely Unknown Outside His Own Country, He Is Yet the Accepted Poet of Fifty Million People, and the Bengalis Call This ‘The Epoch of Rabindranath’)
মূল প্রবন্ধে বলা হয় – সম্প্রতি স্টকহোম থেকে সবচেয়ে বিস্ময়কর ঘোষণাটি আসে, যেখানে সারাবিশ্বকে জানানো হয় যে, সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন একজন বাঙালি কবি, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। এটা করতে কমিটি শুধু অনেক দূরেই যাননি, এই প্রথমবার এই মহান সম্মান প্রাচ্যের কোনো ব্যক্তিকে দিলেন, তার চেয়েও বেশি হলো লেখকের নাম প্রতীচীতে সম্পূর্ণ অজানা।
তিনি যে কত সামান্য পরিচিত তা এই তথ্য থেকে সহজেই অনুমেয়, গত গ্রীষ্মে যখন তিনি এই দেশে ভ্রমণ করেন তখন আগ্রহের সামান্য তরঙ্গও আন্দোলিত হয়নি। এই প্রসঙ্গে উলেস্নখযোগ্য, একই সময় সাহিত্যে নোবেল পেতে পারেন বিবেচনায় একজন ইংরেজ কবি, আলফ্রেড নোয়ালকে বেশকিছু সাহিত্যানুরাগী অভ্যর্থনা প্রদান করেন। (২০১২ সালে রবীন্দ্রনাথ প্রথম আমেরিকায় আসেন, এবং তাঁর পুত্র রথীন্দ্রনাথের সঙ্গে অ্যালাবামায় প্রায় ছয় মাস অবস্থান করেন।)
নোবেল পরিষদ এই কাব্যিক প্রতিভাকে পৃথিবী ওলট-পালট করে খুঁজে বের করতে কোনো অবহেলা করেনি : তিনি হলেন ঠাকুর, যিনি বেশকিছু বছর ধরে, প্রায় পাঁচ কোটি মানুষ যারা বাংলায় কথা বলে, তাদের কাছে সমাদৃত।
একজন পূর্বদেশীয় কেমন করে পাশ্চাত্যের সাহিত্য পুরস্কারপ্রাপ্তির মতো অসাধারণ ঘটনা ঘটাল তার কিছু তথ্য এখানে সন্নিবেশিত হলো : ঠাকুর তাঁর কবিতা পূর্বদেশীয় ভাবধারায় রচনা করেন, লেখেন বাংলা ভাষায় এবং কেবলমাত্র পূর্বদেশীয় পাঠকবর্গের জন্য, পরবর্তীকালে তিনি সেগুলো ইংরেজি ভাষায় রূপান্তর করেন।
সম্ভবত নোবেল কমিটি কোনো একজন বাঙালি কবিকে পুরস্কার দেওয়ার সময় তাঁর নিজের ভাষায় অর্জনকে বিবেচনায় নিয়েছে; কিন্তু সম্ভাবনা আছে ঠাকুরের প্রতিভা মূল্যায়নে শুধুমাত্র তাঁর নিজের কাজের অনুবাদকেও বিবেচনায় নিয়েছেন। বাংলা এবং ইংরেজি দুটি একেবারেই ভিন্ন ভাষা। একজন ইংরেজি সাহিত্য-সমালোচকের মতে, একজন ভিন্ন ভাষার কবির পক্ষে অন্য ভাষার অতি সূক্ষ্ম তারতম্য করা, একটি ভিন্ন দেশ এবং জাতির দার্শনিক ধারণা জানা কঠিন কাজ।
এদেশে ঠাকুরের ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে খুব অল্প তথ্যই পাওয়া যায়। নিউইয়র্ক পাবলিক লাইব্রেরির বিশাল জ্ঞানভা-ারে রবীন্দ্রনাথের ওপর শুধু দুটি বই পাওয়া গেল, একটি তাঁর কবিতার খ-, আরেকটি হলো বসন্ত কুমার রায়-রচিত একটি প্রবন্ধ। নিউইয়র্ক টাইমসের প্রবন্ধটিতে বসন্ত কুমারের প্রবন্ধ থেকে আহরিত তথ্য সংযোজিত হয়, যা নিচে উলেস্নখ করা হলো।
পারিবারিক ঐতিহ্যের সঙ্গে সংস্কৃতির যদি কোনো কিছু করার থাকে তবে রবীন্দ্রনাথের অভিযোগের কিছুই নেই। তিনি জন্মগ্রহণ করেন বিখ্যাত ‘ঠাকুর’ পরিবারে, যার ইংরেজিকরণ হয়েছে ‘ট্যাগোর’; ভারতীয় বুদ্ধিজীবী এবং সামাজিক জীবনের দিগন্তরেখায় এই পরিবারের ছায়া বিসত্মৃত হয়েছে সেই দশম শতাব্দী থেকে। ঠাকুর পরিবারের স্বখ্যাত ব্যক্তিদের মধ্যে আছেন – প্রসন্ন কুমার ঠাকুর, যিনি ছিলেন খ্যাতনামা সম্পাদক, আইন এবং শিক্ষাবিষয়ক লেখালেখি করতেন, তিনি ব্রিটিশ-ইন্ডিয়া অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ছিলেন; রাজা শ্রী শৌরীন্দ্র মোহন ঠাকুর নিঃসন্দেহে যিনি ছিলেন ভারতে সংগীতের একজন উচ্চপর্যায়ের প–ত, বেঙ্গল মিউজিক স্কুল এবং বেঙ্গল অ্যাকাডেমি অব মিউজিকের প্রতিষ্ঠাতা। তিনি বহু হিন্দুস্তানি গানের রচয়িতা এবং বহু বাদ্যযন্ত্রের উদ্ভাবক। অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন একজন স্বনামধন্য চিত্রকর এবং হিন্দু শিল্পজাগরণের অবিসংবাদিত নেতা। কবিপিতার পিতামহের ভাই মহারাজা রমানাথ ঠাকুর ছিলেন একজন লেখক এবং রাজনৈতিক নেতা, কবির পিতামহ দ্বারকানাথ ঠাকুর ছিলেন একজন জমিদার, সমাজ সংস্কারক ও দানবীর।
কবির পিতা, যিনি উপাধি হিসেবে মহারাজা গ্রহণ করেননি বরং তিনি উপাধি হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন মহর্ষি, যার মানে হলো একজন মহান ঋষি। তিনি ছিলেন একজন প্রখ্যাত আধ্যাত্মিক নেতা এবং বড়মাপের বুদ্ধিজীবী।
রবীন্দ্রনাথ এমন একটি পরিবারে জন্ম নিয়েছিলেন যে-পরিবারে একাধারে ছিল সংস্কৃতি এবং প্রাচুর্য। সুতরাং রবীন্দ্রনাথ জন্ম থেকেই একাধারে দেখেছেন সংস্কৃতি এবং বিত্ত। বলা হয়ে থাকে, জন্ম কবি সব সময়ই সুদর্শন হয়ে থাকেন, রবিঠাকুরও তার ব্যতিক্রম ছিলেন না।
বসন্তকুমার রায় আমেরিকানদের কাছে ব্যক্তি রবীন্দ্রনাথের একটা পরিচয় দিয়েছিলেন এইভাবে – ‘রবীন্দ্রনাথ ভারতবর্ষে তাঁর কবিতা এবং দৈহিক সৌন্দর্যের জন্য বহুকাল ধরেই বিখ্যাত। এই হিন্দু কবির কাঁধছোঁয়া কেশরাশি, চওড়া মসৃণ কপাল, উজ্জ্বল কালো আকর্ষণীয় চোখ, তীক্ষন নাক, দৃঢ় চিবুক, সুদৃশ্য হাত, মিষ্টি কণ্ঠস্বর, আনন্দপূর্ণ হাসি, সূক্ষ্ম রসবোধ এবং অন্তরের সুষমা তাঁকে বিরল ব্যক্তিত্বের অধিকারী করেছে। তাঁর দিকে চোখ ফেরালেই এক সমগ্র শিল্পীকে দেখা যায়।’
রবীন্দ্রনাথ তাঁর এক পত্রে শৈশব জীবন সম্পর্কে লিখেছেন – ‘আমার শৈশবের দিনগুলির কথা ক্ষীণভাবে মনে পড়ে। কিন্তু এটা স্পষ্ট মনে আছে, কোন কোন সকালে কোথা থেকে যেন কোন কারণ ছাড়াই অনির্বচনীয় আনন্দ এসে আমার মনটাকে ভরিয়ে দিত। সারা পৃথিবীটাকে মনে হতো রহস্যময়। …’
মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ তাঁর পুত্রের সহজাত প্রবৃত্তি দেখে স্কুল থেকে ছাড়িয়ে আনেন এবং কখনো সেখানে আর পাঠাননি। কবিকে নিয়ে যান হিমালয়ের প্রকৃতি থেকে শিক্ষা দিতে। পিতার কাছেই তিনি শেখেন ইংরেজি, সংস্কৃত, বাংলা, বিজ্ঞানের বিষয় – বোটানি এবং জ্যোতির্বিদ্যা। তখন সেই ছেলেটির ১১টি মাত্র গ্রীষ্ম অতিক্রান্ত হয়েছে, যাঁর জন্ম হয়েছে ১৮৬১ সালে। রবীন্দ্রনাথ সেই বয়সেই বাংলা সাহিত্যের বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ বই শেষ করেছেন। পরের বছর তাঁর মাতা দেহত্যাগ করেন, তাঁর প্রতি গভীর ভালোবাসা থেকেই কবির মনে প্রকৃতিপূজার জন্ম নেয়। সেই সময় কবি থাকতেন চন্দ্রাগড়ে, যেটি ছিল গঙ্গানদীর তীরে একটি বাগানবাড়ি। তিনি গঙ্গার রহস্যময় বয়ে চলা অথবা জ্যোৎস্নারাতে নদীর জলের ঢেউয়ে চাঁদের আলোর খেলা দেখে কাটিয়ে দিতেন ঘণ্টার পর ঘণ্টা। কবিতা লিখতে শুরু করেন পারিবারিক সাময়িক পত্রিকা ভারতীতে, যার সম্পাদক ছিলেন তাঁর জ্ঞানী বোন শ্রীমতী স্বর্ণকুমারী দেবী।
১৭ বছর বয়সে তিনি অল্পদিনের জন্য ইউরোপে যান। সেখান থেকে লেখা তাঁর পত্রগুলোতে বাংলা ভাষায় তাঁর দখল এবং সেখানকার সামাজিক জীবন সম্পর্কে তাঁর সূক্ষ্ম দৃষ্টির প্রমাণ পাওয়া যায়। ইংল্যান্ডে তিনি তাঁর ইংরেজি ভাষার দখল পাকাপোক্ত করেন এবং ইংরেজি কবিতা সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা লাভ করেন।
কবির বহুমুখিতা ছিল বিস্ময়কর। তাঁর বেশকিছু কার্যক্রম এবং সফলতা ছিল এরকম : তিনি ছিলেন একজন গভীর দার্শনিক, একজন আধ্যাত্মিক এবং দেশপ্রেমিক নেতা, একজন গায়ক এবং গীতিকার, দক্ষ সম্পাদক (তিনি চারটি ভিন্ন সাময়িকী যথা সাধনা, বঙ্গদর্শন, ভারতী এবং তত্ত্ববোধিনী সম্পাদনা করেন), দূরদর্শী শিক্ষক, একজন নমনীয় প্রশাসক (তিনি জমিদারি পরিচালনা করেছেন), কিন্তু সবার ওপরে তিনি একজন কবি – প্রেমের কবি। তিনি প্রেমকে বহুমাত্রিক অভিব্যক্তিতে প্রকাশ করেছেন। প্রেমের অভিব্যক্তি তাঁর কাছে ছিল একেবারেই স্বভাবগত কারণ অন্য কবির মতো তিনি জীবনের ধাপগুলো অতিক্রম করেছেন প্রেমে, যেমন ঘটেছিল লিও টলস্টয়ের ক্ষেত্রে।
কবি সময়ের এক অংশ কাটিয়েছেন কোলকাতার (কলকাতা) রাজকীয় বাড়িতে এবং আরেক অংশ বোলপুরের শামিত্মনিকেতনে। কোলকাতায় পেয়েছেন জীবনের বার্তা, কাজ, হইচই, রাজনীতি, এবং শৌখিন সমাজ, অপরদিকে বোলপুরের পরিবেশে কবি নিজেকে তাঁর লেখালেখির কাজে উৎসর্গ করতে পারছিলেন।

আমেরিকায় প্রকাশনা
ম্যাকমিলান কোম্পানি আমেরিকায় দুটি কবিতার বই প্রকাশ করে। একটি দি গার্ডেনার এবং অপরটি গীতাঞ্জলি। প্রথম বইটির মুখবন্ধে ঠাকুর বলেন :
প্রেম এবং জীবন নিয়ে বেশিরভাগ গীতিকবিতা বাংলা থেকে অনুবাদ করে এই বইয়ে প্রকাশ করা হয়েছে, এইগুলি গীতাঞ্জলিতে অন্তর্ভুক্ত আধ্যাত্মিক কবিতাগুলির আগে রচিত। অনুবাদগুলি সবসময় হুবহু হয়নি – কখনো আসল কবিতার চেয়ে সংক্ষিপ্ত এবং ভাষান্তরিত।
এরপর নিউইয়র্ক টাইমস কবির বেশকিছু কবিতা এই প্রবন্ধের শেষে ছাপে যেগুলো দি গার্ডেনার এবং ইংরেজি গীতাঞ্জলির অন্তর্ভুক্ত।
উপরিউক্ত প্রবন্ধটি নভেম্বর ২৩, ২০১৩-তে ছাপা হলে জনৈক পাঠক যাঁর নাম জোসেফ কুমেরিল টাইমসের চিঠিপত্র কলামে একটি পত্র লেখেন, যা ওই বছর ১ ডিসেম্বর ছাপা হয়। পত্রটির শিরোনাম ছিল ‘রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সুনাম’। পত্রলেখক বলেন –
বরাবর সম্পাদক নিউইয়র্ক টাইমস :
আপনার সাময়িকী বিভাগে শিরোনামটিতে আমার দৃষ্টি আকর্ষিত হয়েছে, যেখানে বলা হয়েছে বাংলার, ভারতীয় কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর নিজের দেশের বাইরে অচেনা। আমি প্রকৃতপক্ষে মনে করি এটি একটি ছাপার ভুল। এই ছন্দময় কবি-প্রতিভাকে নোবেল পুরস্কারে সাব্যস্ত করার অনেক আগে থেকেই ইউরোপে বিশেষভাবে ইংল্যান্ড এবং জার্মানির সাহিত্য এবং দার্শনিক জগৎ প্রতিভাবান মানুষটি সম্পর্কে অবহিত ছিল। তবে আরো উপযুক্তভাবে আপনি বলতে পারেন, মানুষটি যুক্তরাষ্ট্রে অজানা ছিলেন, আছেন এবং সম্ভবত অজানাই থাকবেন।
এরপর এই বছর নভেম্বর ৩০, ১৯১৩ সালে রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে নিউইয়র্ক টাইমস আরেকটি প্রবন্ধ ছাপে, যেখান রবীন্দ্রনাথকে আমেরিকার বিখ্যাত কবি ওয়াল্ট হুইটম্যানের সঙ্গে তুলনা করা হয়। যার শিরোনাম ছিল [Tagore : The winner of the Nobel Pprize compared with Walt Whitman]
হুইটম্যানের জন্ম ১৮১৯ সালের ৩১ মে। তিনি ছিলেন একজন কবি, প্রবন্ধকার, সাংবাদিক। একজন মানবতাবাদী। তিনি কবিতাকে অতীন্দ্রিয়বাদ থেকে বস্ত্তবাদে নিয়ে আসেন, কখনো তাঁর কবিতায় দুইয়ের মিশ্র দৃষ্টিভঙ্গিও দেখা যায়। হুইটম্যানের জন্মের ৪২ বছর পর রবীন্দ্রনাথের জন্ম।
নিউইয়র্ক টাইমস তাঁর প্রবন্ধের শুরুতে লিখেছে (প্রবন্ধ-লেখকের নাম নিউইয়র্ক টাইমস উলেস্নখ করেনি) – পূর্ব পূর্বই এবং অবশ্যই পশ্চিম পশ্চিমই, দুই যমজ কখনো মিলবে না। পশ্চিমে পূর্বের আরো অনেক কিছু আছে এবং পূর্বেও পশ্চিমের অনেক কিছু আছে। ইউরোপের জন্য এশিয়ার দর্শনের চিত্তাকর্ষক শক্তি যে কত বেশি তা উভয়ের আদান-প্রদান থেকে অনুমান করা যায়।
ভারতীয় কবির সম্প্রতি নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্তি তাঁকে এত পরিচিত করছে, যা এখানে উলেস্নখ করার খুব প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না। তাঁর নিজ দেশে তিনি এতই জনপ্রিয়, যেখানেই বাংলা বলা হয় সেখানেই তাঁর গান গাওয়া হয়। রবীন্দ্রনাথের গান অনেকটা পশ্চিমের চারণকবিরা যেভাবে নিজেদের বাঁধা গানে শুরু করতেন তিনিও নিজেই সেভাবে গান বাঁধেন এবং সুর দেন।
রবীন্দ্রনাথের রচনাকে স্বাভাবিকভাবেই তিন ভাগে ভাগ করা যায় : প্রথম অংশ নবযৌবনের, বেশিরভাগই প্রকৃতি নিয়ে লেখা; দ্বিতীয় অংশ যখন দি গার্ডেনারে রচিত হয়েছে, এই সময়ে কবি লিখেছেন প্রেমের গান এবং প্রচার করেছেন ‘অমরত্বের তথ্য’ যার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে সুখের ভালোবাসা। তৃতীয় অংশে কবি মানব আনন্দ এবং দুঃখের অভিজ্ঞতায় পূর্ণ বিকশিত। এই পর্যায়ে তারই বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে গীতাঞ্জলিতে, যদিও গার্ডেনারের পূর্বেই গীতাঞ্জলি প্রকাশিত হয়েছে।
রবীন্দ্রনাথকে যত বেশি পড়া যায় তার সাথে ওয়াল্ট হুইটম্যানের ততই মিল খুঁজে পাওয়া যায়। – সাদৃশ্য দেখাতে দুজনের দুটি কবিতা পরপর ছাপানো হয়।
হুইটম্যান থেকে :
Come, lovely and soothing Death –
Dark Mother, always gliding near.
With soft feet,
Have none chanted for thee a chant
Of fullest welcome

রবীন্দ্রনাথ থেকে :
Why do you whisper so faintly in my
ears, O Death, my Death?
is this how you must woo and win me
with the opiate of drowsy murmur
and cold kisses, O Death, my Death
এরপর ১০ ডিসেম্বর, ১৯১৩ সালে ছাপা হয় স্টকহোম থেকে পাঠানো সংবাদদাতার টেলিগ্রাম। যেখানে বলা হয়, এ-বছরের সাহিত্যে নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্ত রবীন্দ্রনাথ পুরস্কার নিতে উপস্থিত হতে পারেননি এবং তাঁর পক্ষে ভারতে ব্রিটিশ শার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স মি. ক্লাইভ সেটি গ্রহণ করেন। প্রাইজ হিসেবে দেওয়া হয় একটি মেডেল এবং ১০ হাজার ডলার।