রসায়ন ও এক মগ্ন শিল্পী

নুরুজ্জামান

পাহাড়, নদী, গাছপালা আর সমুদ্রের মধ্যে বড় হয়েছিল শিল্পী আশাসি সিওডে। তিন বোন আর বাবা-মায়ের ছোট গোছানো সংসার। বাবা-মা দুজনে চাকরিজীবী। মফস্বল ছোট্ট শহরে ছিল না নাগরিক কোনো ছোঁয়া। আজ এই ছোট্ট শহর, তো দুবছর পরে কাছের আর একটি ছোট্ট শহরে, এভাবেই
বাবা-মায়ের চাকরির সঙ্গে অদলবদল করে বেড়ে উঠছিলেন আশাসি। ফুল-লতা, পাখি, গাছপালা, নদী আর সমুদ্রই ছিল তাঁর শৈশবের সাথি। স্কুল-শুরুর দিনগুলো তাই ছিল অন্যরকম। ভিন্ন এক নির্জনতাকে সাথি করেই মধুর করুণভাবে কাটছিল তাঁর দিন। খাতার পাতায়-পাতায় নিজের অজামেত্ম এঁকে ফেলত হরেকরকমের ছবি। ওপরের ক্লাসে উঠতেই বাবা এনে দিতেন হরেকরকমের কার্টুনের বই। সেগুলো পড়তেন আর কার্টুন আঁকতেন। স্কুলের গ– পেরোতেই স্বপ্ন দেখতেন কার্টুনিস্ট হবেন। কিন্তু অঙ্ক আর রসায়নের মধ্যে ডুবে ছিল কলেজের দিনগুলো। নতুন ভাবনা এলো বিজ্ঞানী হওয়ার। রসায়নের ল্যাব-ক্লাসে মগ্ন থাকতেন বিভিন্ন কেমিক্যাল, টিউব, পাইপ, বিক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া এসব নিয়ে। দারুণ টানত ল্যাবের ক্লাসগুলো। রাসায়নিক বিক্রিয়া ধীরে-ধীরে তাঁর ভেতর ফেলল এক গভীর ছাপ। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে যখন তিনি দেখলেন শিল্পকলার বিশাল দিক, মনস্থির করলেন, তিনি শিল্পীই হবেন। শৈশব-কৈশোরের আঁকাজোখার সেই অভ্যেস পরিশেষে মোড় নিল আবারো শিল্পকলায়। কাগজ-কলম-ক্যানভাস, রং-ব্রাশ আবারো নেচে উঠল আপন তালে। আশাসি সিওডে যেন ফিরে পেলেন তাঁর আপন ঠিকানা। স্কুল-কলেজের রসায়নের ল্যাবরেটরির রাসায়নিক নানা মিশ্রণ হয়ে উঠল তাঁর আঁকার বিষয়। প্রাণের রসায়ন, জীবনের রসায়ন। হেক্সাগান (hexagons) বা ষড়ভুজ রসায়নের এক প্রতীক, যা তাঁর ছবির দিকে তাকালে সহজ সত্যের সেই উপপাদ্য ফুটে ওঠে আপন মহিমায়। কীভাবে রাসায়নিক যৌগগুলো ভাংচুর হয়, রূপান্তরিত হয় মানুষের মাঝে, জীবের মাঝে, সেই নিয়েই যেন তাঁর নিরন্তন নিরীক্ষা সেই ক্যানভাস, কাগজ কিংবা অন্য যে-কোনো মাধ্যমে।

আশাসি সিওডে খুব অল্প এবং দুই-একটি রঙে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। তাঁর শিল্পকর্মের দিকে তাকালে নীল, সাদা বা কালোর বাইরে অন্য কোনো রঙের উপস্থিতি খুবই কম চোখে পড়ে। পুরো ক্যানভাসের মধ্যে হালকাভাবে ছড়িয়ে থাকা রসায়নের প্রতীক ষড়ভুজ আর ক্যানভাসের নিচের দিকে আবারো একটু গভীরভাবে সেই ষড়ভুজ দারুণ এক কাব্য তৈরি করে। তাঁর ছবিগুলো যেন নিছক কোনো বিবৃতি নয়, স্রষ্টা এবং সৃষ্টির আবেগের স্পন্দনময় রাসায়নিক প্রকাশ। পৃথিবীর সব কিছুই পরিবর্তনশীল এবং রূপান্তরধর্মী আর রূপান্তর ও পরিবর্তনের মূলমন্ত্রই হলো রসায়ন। যেমন – পানিকে শূন্য ডিগ্রিতে বাষ্পায়িত করলে একরূপ হয়, আবার সেই পানিকে একশ ডিগ্রিতে বাষ্পায়িত করলে আরেকভাবে রূপান্তরিত হয়। এই যে পরিবর্তন হওয়া বা রূপান্তরিত হওয়া, সেটি আসলে রাসায়নিক পরিবর্তন। আশাসি সিওডে সেই বিষয়টিকে বারবার এনেছেন, শুধু তাই নয়, এটিই তাঁর শিল্পের মূল উপাদান।

লক্ষ করলে দেখা যায়, শিল্পী তাঁর ছবিতে যেমন এক নিজস্বতা এনেছেন, তেমনি তাঁর ক্যানভাস এবং পেপারেও এক নিজস্বতা তৈরি করেছেন, যা সত্যি প্রশংসার দাবিদার। বেশিরভাগ ক্যানভাস আর পেপারে তিনি কিছু নিজস্ব টেকনিক ব্যবহার করেছেন। মোটা চট কিংবা ক্যানভাসের ওপর তাঁর নিজস্ব টেকনিক ব্যবহার করে ভিন্ন এক মাত্রা সংযোজন করেন। তবে মূল ছবিটি এঁকেছেন অন্যভাবে। ইভেন-আনইভেনের মজাদার এক খেলা ছবির বিষয়টিকে আরো উজ্জ্বলভাবে তুলে ধরেছে। টেক্সচার এমনভাবে ক্যানভাসে তৈরি হয়েছে, যাতে দ্বিমাত্রিক এক রূপ আলাদাভাব তৈরি করেছে ভিন্ন মাত্রা। শুধু তাই নয়, স্পেসের মধ্যে এনেছে বৈচিত্র্য। গতানুগতিক সরাসরি ফ্রেম ভেঙে ভিন্ন এক রূপে রূপান্তর করেছেন ক্যানভাস আর পেপারের সাইজ সেপকে, সেখানেও শিল্পী সুনিপুণতার পরিচয় দিয়েছেন। মোটা ক্যানভাসের ওপর বলিষ্ঠ তুলির টান, তার ওপর ক্ষীণ বা ধোঁয়াশে নীল রঙের হেক্সাগান বা ষড়ভুজের ছাপ আর রাসায়নিক যৌগের বিন্যাস, যা সৃষ্টির অণু-পরমাণুতে ভেঙে যাওয়া কিংবা রূপান্তরিত হওয়া, সেটি অকপটে ভেসে উঠেছে বারবার। আশাসির গভীর সেই চিমত্মা বলে গেছে বারবার অকপটে তাঁর চিত্রকর্মে এক রূপান্তরের গল্প। ব্যঞ্জনার দীর্ঘ ব্যাখ্যা কোথাও নেই, নেই রঙের আধিক্য; কিন্তু রয়ে গেছে শিল্পীর গভীর ধ্যানের গভীরতা। তাঁর ছবিতে রোম্যান্টিসিজমের কোনো ব্যাখ্যা বা ছাপ নেই; কিন্তু বৈজ্ঞানিক বিভাজনের খেলা বারবার খুঁজে নিয়েছে সত্যের এক সন্ধান। নানা মাধ্যমে আর নানা সাইজের মধ্যে কাজ করলেও শিল্পীর যে নিজস্ব ঘরানা, সেটি প্রায় প্রতিটি ছবিতে স্পষ্ট। বিভিন্ন যৌগের মাধ্যমে বায়ু, পানি, শুদ্ধতা-বিশুদ্ধতা, রূপান্তরিত হওয়া রাসায়নিক ক্রিয়া-বিক্রিয়ার মাধ্যম যৌগিক ভাঙাচোরা – সেসব বারবার উঠে এসেছে তাঁর ক্যানভাসে। ষড়ভুজের প্রতীকের মাধ্যমে বিভিন্নভাবে তাঁর এই পরীক্ষা-নিরীক্ষা কখনোই অস্বসিত্মকর হয়ে ওঠেনি, বরং পরের চিত্রে যাওয়ার জন্য মন আনচান করে উঠেছে। তার মূল কারণ ছিল, প্রতিটি কাজ তাঁর ভীষণভাবে সুনিয়ন্ত্রিত। নিজের ভেতর তাঁর যে নিয়ন্ত্রণ আছে, শিল্পী সেটি বোঝাতে সমর্থ হয়েছেন। আর এখানেই তাঁর মুন্শিয়ানা। সত্যি কথা, রাসায়নিক বিক্রিয়ার মাধ্যমে ঘটে প্রতিটি সৃষ্টির পরিবর্তিত রূপ। আর সেই রূপই হলো তাঁর দর্শন ও অনুপ্রেরণা, যেটি তিনি বারবার ট্রান্সফার করেছেন ভিন্ন-ভিন্ন ভাবে ভিন্ন-ভিন্ন রূপে।

ঢাকার চারুকলা অনুষদের জাপানি শিল্পী আশাসি সিওডের সদ্য শেষ হওয়া একক এই প্রদর্শনীর আয়োজক হিসেবে কাজ করেছেন ড্রইং ও পেইন্টিং বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ ইকবাল ও চেয়ারম্যান নিসার হোসেন। জাপান ও বাংলাদেশের শিল্পকলার ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে এই আদান-প্রদান প্রক্রিয়া এবং শিল্প-প্রদর্শনী আন্তর্জাতিকভাবে এক নতুন দিগন্ত তৈরি করবে। আয়োজকদের এই উদ্যোগ নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবিদার।