রাজপথ রাজার

রে জা উ র  র হ মা ন

সূজা অবসরে গেলে আন্না নিজেকে চিরসুখীজনের একজন মনে করে।

সেদিন বেলা থাকতে থাকতে অংকের প্রফেসর সূজাউদ্দৌলা ঘরে ফিরে আসে। এক হাতে তাঁর কতগুলো ফাইল ও অন্য হাতে একটা ব্যাগ। সূজার তা বহন করার অবস্থা দেখে আন্না ধরে নেয়, তাতে ভারী কিছু আছে।… আর ব্যাগে হাতলছোঁয়া একগোছা ফুল। ফুলগুলো তখন আর তেমন তাজা নেই। কিছুটা শুকিয়ে আসতে শুরু করেছে। আন্না প্রায় দৌড়ের ভঙ্গিমায় ছুটে এসে সূজার হাত থেকে ব্যাগটা নেওয়ার চেষ্টা করে।

‘দাও তো দেখি। দুই হাতে আর কত বোঝা বইবে?’

সূজা আন্নার হাতে ব্যাগটা তুলে দিতে দিতে হাসার চেষ্টা করে। তবে সেই হাসি সবসময়কার মতো নির্মল-সজীব নয়। বরং তাতে খানিকটা বিষাদের প্রচ্ছন্ন ছায়া।

‘সব শেষ করে দিয়ে এলাম। সাতাশ বছরের মাস্টারি…। আর কত…। আর কত চাপাবাজি করে কাটাব।’

‘কেন… চাপাবাজি হবে কেন? ছাত্ররা তোমার যা প্রশংসা করে। এমন অংকের মাস্টার নাকি হয় না।’

হাসে সূজা।

‘এদের তুমি কী করে চিনবে? আজকের পোলাপান… পাশের ব্যবস্থা একবার করে ফেলতে পারলে আড়ালে গিয়ে তারা আমাকে শ্যালক বানায়।’

‘তাই বুঝি?’ আন্না সূজাকে ঘরে টেনে নিয়ে চেয়ারে বসায়।

‘এখান থেকে এক পা-ও নড়বে না। আমি আসছি।’

আন্না ফিরে আসে। মাঝারি সাইজের এক গামলায় পানি নিয়ে। সে পায়ের কাছে বসে জুতার ফিতা খুলতে গেলে সূজা কৌতূহল প্রকাশ করে।

‘কী ব্যাপার… হঠাৎ করে আমার, জুতার ওপর খবরদারি?’

‘হ্যাঁ, তাই তো হওয়ার কথা। গরিবের বাড়িতে হাতির পাড়া…।’

‘বুঝলাম না?’

‘বুঝবে জুতাটা খুলতে দাও। একটু সবুর কর…।’

এতদিন ছিলে শিয়াল। সকাল হতে না হতেই কলেজের দিকে পা… সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে আবার সেই কলেজের পড়া, – লেকচার তৈরি – খাতা দেখা…।’

হাসে সূজা।

এতোদিন শিয়াল ছিলাম… এখন?

‘এখন হাতি, মানে তোমার পা হয়েছে ভারী। হাতির পা। শিয়ালের হালকা পা নয় যে ছোটোছুটি করবে।’

‘অর্থাৎ আমি এখন ভারী পা নিয়ে ঘরে বসে থাকব শুধু।’

‘তাই। অবসর হলে মানুষের আর কী করার থাকে। বিশ্রাম…।’

আন্না জুতা-মোজা খুলে সূজার পা গামলার পানিতে চুবায়। নিজের হাতে পানি নেড়েচেড়ে তার পা ভিজিয়ে দেয়।

‘গ্রীষ্মের শুরুতেই কেমন রোদ উঠছে দেখছ না? পা ঠান্ডা হলে গা-গতর জুড়াবে।’

আবার উঠে যায় আন্না। ঘর থেকে পরিষ্কার টাওয়েল-স্যান্ডেল নিয়ে আসে।

‘আরাম লাগছে না?’

‘হ্যাঁ তাই-তো।’ হাসে সূজা।

তারা শোয়ার ঘরে যায়। সূজাকে আন্না বিছানায় পা তুলে বসতে সাহায্য করে। আর সে নিজে বসে চেয়ারে।

একটু পরে উঠে গিয়ে কাচের ফুলদানিতে সূজার বয়ে আনা ফুলগুলো গুছিয়ে নিয়ে আসে। তা রাখে তাদের টি-পয় টেবিলে।

‘এখন সুন্দর লাগছে ঘরটা।’

আবার চলে গিয়ে আন্না ফিরে আসে। হাতে তার একগ্লাস শরবত।

‘বরফ সামান্য দিয়েছি।’ তোমার খুশখুশে কাশিটা যে যাচ্ছে না।’

‘একেবারে রাজ-সমাদর?’

‘হ্যাঁ তা-তো হবেই… তা না হলে আমি দরবেরে রানি হবো কী করে?’

‘ওহ্ ভালো কথা, শুধু ফুলটা আনলে… ওখানে যে আরো কিছু জিনিস রয়েছে।’

সূজা উঠতে গেলে আন্না তাকে বাধা দেয়।

‘তুমি বসো! আমি আসছি।’

আন্না ব্যাগ নিয়ে ফিরে আসে।

প্যাকেট খুলে আন্না উৎফুলস্ন হয়ে ওঠে।

‘ওমা… একি… ! আমার কতদিনের শখ, ভালো একটা কফি সেট কেনার… পেয়ে গেলাম।’

দুজনে মিলে সেটের কেতলি-কাপ-পিরিচ-মিল্ক-পট সাজিয়ে রাখে টেবিলে। গাঢ় বাদামি রঙের বডিতে সোনালি ফুলেভরা লতাপাতা আঁকা সেটটা।

প্যাকেটের ওপরে এঁটে দেওয়া স্ট্রিকারে লেখা, ‘বিদায়ী অধ্যাপক সূজাউদ্দৌলাকে – বিভাগীয় শিক্ষকবৃন্দ। আমরা সবাই আপনার সুখ-সমৃদ্ধি ও দীর্ঘজীবন কামনা করি।’

এই লম্বা দু-লাইনের লেখায় দুটি শব্দ ‘বিদায়ী ও দীর্ঘজীবন’ সূজাকে খানিকটা ভাবায়। তার মনে হয়, শব্দ দুটিতে কেমনতর একটা ব্যথা-কাতর সুরের আবহ তৈরি হয়েছে, যার বাস্তবতা উপেক্ষা করার উপায় নেই।

এদিকে পরিষ্কার ন্যাপকিন এনে আন্না সেটের সবগুলো আইটেম একে একে মুছে রাখায় ব্যস্ত হয়।

‘দোকানির শোকেসে রাস্তার ধূলো জমে জমে এটার গায়ে কী পরিমাণ ময়লা জমেছে… দেখেছো?’ মুহূর্ত আগের অন্যমনস্কতা কাটিয়ে সূজা বাস্তবতায় ফিরে আসে। আন্নার আনন্দ-খুশিতে সেও শরিক হয়। আন্নার সরলতা তার ভালো লাগে। সে তার চোখের সামনে দেখে, চিরন্তন সুন্দরী এক নারীমূর্তি। গায়ে সাধারণ হলেও গোছানো শাড়ি, কিছুটা অগোছালো চুল টেনে পেছনে খোঁপা করা। কথায় কথায় সে হাসে। সে যে এত সহজে এমন খুশি হতে পারে, তা তার জানা ছিল না। সে এখন মনে মনে আশ্বস্ত হয় খানিক… থাক তার অবসরে জীবন হয়তো তেমন একঘেয়ে, নিরানন্দময় হবে না। কেটে যাবে সময়।

 

ঘুম থেকে দেরি করে উঠে সূজা। ঘরের আধো-অন্ধকার বিছানায় হাত ফেলে আন্নাকে জায়গামতো না পেয়ে সে ভাবে, হয়তো সে আগে উঠে গেছে। ঘর ছেড়ে যাওয়ার আগে সে যে জানালা-দরজার পর্দা ভালো করে এঁটে দিয়ে গেছে তা সূজার বুঝতে অসুবিধা হয় না। বাইরে সকালি সূর্যের আলো ফুটে উঠতে থাকলেও সেই আলো ঘরে তেমন ঢুকতে পারেনি এখনো।

ততক্ষণে পর্দা সরিয়ে ঘরে ঢুকে আন্না। হাতে তার সেই গতকালকার উপহার পাওয়া সুচারু কফি সেট। ট্রেতে সাজানো।

‘কৈ-গো… আর কত ঘুমাবে? সময় তো সকাল ছাড়িয়ে দুপুরের দিকে গড়ান দিয়েছে। উঠো…।’

‘কীভাবে উঠবো? ঘর অন্ধকার করে রেখে গেছো।’

বিছানায় কফির ট্রে নামিয়ে জানালার পর্দাগুলো টেনে দেয় আন্না।

‘এবার দেখো বেলা কত হয়েছে?’ সে হালকা হেসে বলে, ‘হউক-না বেলা কলেজের তাড়া তো আর নেই।’

বিছানা থেকে উঠতে গিয়ে সূজা খানিকটা নির্ভারবোধ করে।

‘খাবারের টেবিল কী দোষ করল? আমি তো সেখানে যেতে পারতাম।’

‘সময় সময় যাবে। কিন্তু আমার অনেক দিনের শখ আমরা বিছানায় বসে একত্রে রসিয়ে রসিয়ে চা-কফি খাবো।’

‘এমন ইচ্ছাটা তোমার কতদিনের?’

‘অনেক দিনের। টিভির নাটক-সিনেমা-সিরিয়ালে তো এমনটা প্রায়শ দেখি।’

হাসে সূজা।

‘সিনেমা-নাটক আর বাস্তব জীবন কি এক হয় কখনো?’

‘হওয়ালেই হয়। এটা এমন কী কঠিন কাজ?’

‘কঠিন নয়… তবে নব-দম্পতি, প্রেমিক-প্রেমিকার ক্ষেত্রে এসব রোমান্টিক সিকুয়েন্স তৈরি করা হয়।’

আন্না কৃত্রিম রাগ দেখায়।

‘আমরা কি খুব বুড়িয়ে গেছি? আমাদের বিয়ের মাত্র তো সতেরো-আঠারো বছর হয়েছে।’

‘হ্যাঁ… এবার আমি হার মানছি। তুমি আমাদের বিয়ের দিনক্ষণের হিসাব যখন এমনভাবে রেখেছো… তখন তুমিই ঠিক। দাও দেখি কফি… আর কী এনেছো?’

‘আর কী আনবো… কড়কড়ে টোস্ট…।’

বিছানায় বসে আন্না নতুন ন্যাসকেফে গোল্ডের ঢাকনা খোলে। নতুন কফি সেটের পেয়ালায় ফুটন্ত জল ঢেলে দেয়। সারাঘর কফির হালকা মিষ্টি গন্ধে ম-ম করে।

‘নতুন কফি?’

‘হ্যাঁ… প্রথম দিনেই তোমাকে পুরনো কফি দেবো। গত সন্ধ্যায় তোমাকে ফাঁকি দিয়ে, রাজলক্ষ্মী মল থেকে কফি এনে রেখেছিলাম।’

সূজা আন্নার তৈরি কফির পেয়ালা হাতে নিয়ে বিস্ময় প্রকাশ করে। সে হেসে উঠে সশব্দে।

‘তাই… এমনটা জানলে-তো আরো আগেই অবসরে যেতাম। বিভাগ থেকে বিদায় নিয়ে বাড়ি আসতে আসতে ভাবছিলাম, একটা প্রাইভেট কলেজ অনেকদিন থেকে পিছে লেগে আছে যেন তাদের ওখানে জয়েন করি। অন্তত সময় কাটানোর জন্য। এখন দেখছি…।’

‘খবরদার এমন কথা মুখেও আনবে না।’ আন্না তাকে শাসন করে।

গরম কফি আর কড়কড়ে টোস্ট উপভোগ করে সূজা। সামনে বসা তার অতিচেনা, নাকি অচেনা মায়াময় আন্না। এই একদিনেই আন্না অনেক দেখাল, অনেক দিলো তাকে। এবার যেন তার দেওয়ার পালা।

যে-কথা সূজা কোনোদিন আন্নাকে সরাসরি বলেনি বা বলার সময় হয়নি তাদের দীর্ঘ এই যৌথ জীবনে, সেই কথাটি সাজিয়ে বলতে চাইল আজ।

‘সুন্দরী নায়িকা আন্না… বিখ্যাত এক ইউরোপীয় বইয়ের মূল চরিত্র – আন্না কারিনা বড়লোকের বাজার রাজলক্ষ্মী মল থেকে আনুমানিক হাজার দুই টাকার কফির এন্তেজাম নিয়ে এলে, এই টাকার সাপস্নাই কোত্থেকে আসবে ভেবেছো?’

ভ্রূ কুঁচকায় আন্না।

‘আমি আবার নায়িকা… তাও আবার সাদা মানুষের দেশের নায়িকা, সতেরো-আঠারো বছরের বিবাহিত জীবনে এমন কথা তো শুনিনি কোনোদিন।’

‘আগে এমনভাবে দেখার-ভাবার সময় হয়নি যে।’

‘তার মানে তুমি অবসরের আগে আমাকে ভালো করে দেখেওনি।’

অভিমানী হয় আন্না।

একটু থেমে উত্তর সাজায় সূজা।

‘তোমার অভিযোগ কিছুটা ঠিক। তুমি-তো বিয়ে করেছো অংকের মাস্টারকে। বিয়ের পরবর্তী দায়িত্ববোধ থেকে আমি শুধু অংকই কষেছি। আকর্ষণীয় কোনো নারীর রূপ-সংসারের দক্ষতা… ইত্যাদি নিয়ে ভাবিনি খুব একটা।’

আন্নার রাগ স্তিমিত হয়।

‘তা ঠিক। তাই না উত্তরার মতো সুন্দর আবাসিক এলাকায় আমাদের নিজস্ব বাড়িঘর হয়েছে। মাথা গোঁজার ঠাঁই হয়েছে। হউক না ছোট। ১২৫০ স্কয়ার ফিট।’

একটু থেমে আবার আন্না কথা ওঠায়।

‘টাকার সোর্সের কথা উঠিয়েছো… তাই না?’

‘হ্যাঁ’।

‘সেই সোর্স তো তুমি। তোমার পেনশন। হাতি মরলেও লাখ টাকা।’

‘কথাটা মন্দ বলোনি। একটা কাগজ-কলম দেও।’

একটু পরে সূজা আন্নাকে কাগজের লেখাটা দেখতে দেয়।

আন্না প্রায় লাফিয়ে চিৎকার করে ওঠে।

‘এত টাকা! ৪৫ লাখ… বল কী?’

‘এটা আংশিক, পুরো নয়। আধা-আধা প্রায়। এছাড়া আরো কী কী জানি আছে। এসব আমি তেমন মনেও রাখিনি। প্রভিডেন্ট ফান্ড, টিচার্স ব্যানোভোলেন্ট ফান্ড ইত্যাদি ইত্যাদি।’

‘আরো আছে নাকি?’ হাসতে হাসতে কৌতুক করে আন্না।

‘হ্যাঁ আছে বইকি।’

‘কেমন?’

‘কেন তুমি আমার ওই কোনার ডেরাজে রাখা চামড়ার ব্যাগটা দেখোনি?’

‘না তো… ওইসব কাগজপত্র-টুকিটাকি আমি খুলে দেখিনি কোনোদিন।’

‘তা হলে এখন দেখো।’

‘আমার তর সইছে না। তুমি বরং তাড়াতাড়ি বলো সংক্ষেপে।’

‘ওই ব্যাগে আরো আছে ১২-১৪ লাখ টাকার এফডিআর। অনেকদিন হয়ে গেছে। সেগুলো এতোদিনে ইন্টারেস্ট নিয়ে হয়তো ১৯-২০ লাখ হয়ে গেছে।’

‘বলো কি! তা হলে যা দাঁড়াল আমার তো বিশ্বাস হচ্ছে না। আমাদের হাতে এখন অর্ধকোটিরও বেশি টাকা আছে।’

‘হ্যাঁ আছেই তো।’ সূজা আত্মসন্তুষ্ট হয়।

‘তোমার ভবিষ্যৎ পস্ন্যানের প্রশংসা না করে পারছি না।’

‘তা হলে এবার আমার প্রোগ্রামটা শোনো।’

‘বলো’।

‘আমাদের অবসরজীবন ঘুরেফিরে কাটাব। বেড়াব।’ ‘আমিও তা-ই চাই… বদলির চাকরিজীবনে অবসর খুব একটা পাই নাই।’

‘একটু সময় নিয়ে আন্না বলে, এর জন্য যে একটা জিনিস দরকার।’

‘কী?’

‘বাহন… একটা গাড়ি।’

‘এ আর এমন কী? হয়ে যাবে। আমিও ভেবেছি সময় সময়। আর ফ্ল্যাটটা কেনার সময় যে ব্যাংক লোন করেছিলাম তা প্রায় শেষ হয়ে এসেছে।’

চারতলার তরফদার ভাবি তো প্রায়ই আমাকে বলেন, ‘ভাবি এবার একটা কিনে ফেলেন… গাড়ি ছাড়া এই ঢাকা শহরে চলাফেরা করা যায় নাকি? আর টোনাটুনি মিলে ঘুরে বেড়াবেন। আমাদের দেশেও দেখার কত কী আছে?’

‘কথা তো ঠিকই।’ সূজা আন্নাকে সমর্থন করে।

এবার আর পায় কে আন্নাকে। সে ঝটপট কফি শেষ করে উঠে দাঁড়ায়।

‘আমি গেলাম নাস্তা তৈরি করতে। আজ হবে তোমার প্রিয় খিচুড়ি-আন্ডাকারি-বড়ুইয়ের আচার। তুমি ধীরেসুস্থে স্নান সেরে তৈরি হয়ে নাও, নাস্তা হতে আর কতক্ষণ। ছুটা বুয়াও হয়তো এতোক্ষণে এসে গেছে।

 

সূজার বাড়ি চাঁদপুর সদরের বিলাসখালী গ্রামে। আর আন্নার চাঁদপুর-লক্ষ্মীপুর বর্ডার ধরে পানসিঘাটায়। মেঘনার ছড়া-নদী ছুঁয়ে গেছে সেই গ্রাম। আন্না ছোটবেলা থেকে নদীর পারে বসে বসে দেখতো, দূর থেকে বেয়ে আসা ছোট-বড় নৌকা। পালতোলা। এসে এসে চোখের আড়ালে চলে যেত। ছোটবেলা সে তেমন ভাবতে শেখেনি বা পরে যখন ভাবতে শিখেছে, তখন থেকে সে ভেবেছে, নৌকাগুলো লঞ্চের যাত্রী নিয়ে কোত্থেকে আসে, কোথায় চলে যায়? উঠতি ব্যবসায়ীর মেয়ে আন্না লেখাপড়ায় তেমন এগোতে পারেনি। বাবা-মা তাকে বিয়ে দিয়ে দেয় বিলাসখামী গ্রামের সূজার সঙ্গে।

সূজারা সচ্ছল গৃহস্থ পরিবার। বাবার অদম্য আগ্রহ ও সূজার ইচ্ছায় ঢাকার উচ্চ বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে লেখাপড়া শেষ করে সরকারি কলেজে চাকরি নিয়েছিল। তার প্রথম পোস্টিং রাজশাহী সরকারি ডিগ্রি কলেজে। বিয়ে-সংসার করার প্রতি তার তেমন তৎপরতা ছিল না। দেখা যাক… সময় তো চলে যায়নি? এভাবে ৪-৫ বছর চলে গেলে, তার বাবা-মা বুঝে নিল, কাজটা তাদেরই এগিয়ে নিতে হবে। তারা সূজার এক গ্রীষ্মের ছুটিতে প্রস্ত্ততি নিয়ে ফেলে। তারা তাদের এক দূরসম্পর্কের আত্মীয়তার সূত্র ধরে এগিয়ে যায়। সূজা তখন চট্টগ্রাম সরকারি কলেজে। সে বন্ধে বাড়ি এলে, মা-বাবা তার বিয়ের প্রস্তাব দেয়। সে এতে না-রাজি হওয়ার কোনো কারণ খুঁজে পায় না।

সূজার বিয়ে হয়ে যায় পানসিঘাটা গ্রামের কলেজে পড়ুয়া মেয়ে আমেনা বেগমের সঙ্গে।

বাসরঘরে সূজা প্রাথমিক সংকোচ-লজ্জা কাটিয়ে তার স্ত্রীকে বলে, আমি তোমার নামের মাঝের অক্ষর ছাগলের ডাক ‘মে’-টা কেটে দিলাম। তোমার নাম দাঁড়াল ‘আনা’… আন্না। আপত্তি আছে? আমেনা ঘোমটা সামান্য সরিয়ে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকে সূজার দিকে। একসময় নিচুস্বরে মুখ খোলে, ‘বুঝতে পারলাম না।’

হাসে সূজা।

‘মানে, তোমার নামটা বড় সেকেলে…।’

সলজ্জ হাসে আমেনাও।

‘আসলেও তাই।’

সেই থেকে সূজার কাছে আমেনা হয়ে গেল আন্না। এরপর কেটে গেছে বহু বছর।

তাদের সন্তান হয়নি। তারা বহু ডাক্তার-বদ্যি দেখিয়েছে। কলকাতাও গেছে। ডাক্তারদের একই মত। সমস্যা স্বামীর। স্ত্রী ঠিক আছে। তবে আজকাল কৃত্রিম উপায়ে বাচ্চা নেওয়া যায়। আন্না রাজি  হয়নি। সূজা খানিক অপরাধবোধ নিয়ে আন্নাকে প্রস্তাব দিয়েছে, ‘চলো আমরা একটা শিশু পালক নেই।’

আন্নার এক উত্তর। ‘না… আল্লাহ আমাদের কপালে সন্তান লেখেননি… তাই সন্তান হয়নি। আমার কিছু চাই না। তুমি আছো না? এটাই কি যথেষ্ট পাওয়া নয়?’

 

মাসখানেকের মধ্যে আন্না-সূজার গাড়ির ব্যবস্থা হয়ে যায়। সূজার এক প্রিয় ছাত্র মিরাজের বাবা প্রতিষ্ঠিত গাড়ির ডিলার। তারা সরাসরি জাপান থেকে রিকন্ডিশন গাড়ি আনে। ছেলে বাবার সঙ্গে এ-নিয়ে কথা বলে।

একদিন নিজে ড্রাইভ করে এসে তাদেরকে নিয়ে যায় মিরাজ। সেদিন আন্নার আনন্দ দেখে কে!

মিরাজের বাবার শোরুম মতিঝিলে। সূজাকে পেয়ে মিরাজের বাবাও খুশি হয়।

‘স্যার আপনি এসেছেন। না আসলেও হোত। আমি সব ঠিকঠাক করে রাখতাম, আপনি এসে গাড়ি নিয়ে যেতেন।’

দোকানির সাদর আপ্যায়নে আন্না-সূজা সন্তুষ্ট হয়। তারা সেখানে চা-সমুচা খায়।

দোকানি অল্প কথার লোক। সে ছেলেকে ডাকে।

‘স্যারকে বাম কাতারের শেষ গাড়িটা দেখাও। কভারে ঢাকা।’

তারা গাড়ি দেখে ফিরে আসে।

‘স্যার গাড়ির আসল হলো ইঞ্জিন। এ-গাড়ির ইঞ্জিন একেবারে নতুন। বছরে দু-চারটি এমন গাড়ি পাই। কোম্পানি ইঞ্জিনের অবস্থা খারাপ দেখলে তা একেবারে পালটে দেয়। আপনাকে আমি এই গাড়িটাই দিতে চাই। গাড়িটা সবদিক দিয়েই ভালো। মাইলঅ্যাজও কম।’

সূজা-আন্না নিচুস্বরে আলাপ করে। আন্না বলে, ‘এই গাড়িটাই নেব। করোল্লা কোম্পানির সিলভার রং…।’

সূজা মিরাজকে কাছে ডাকে।

‘তুমি কী বলো?’

‘সত্যি কথা বলতে কি, ডিলাররা চট্টগ্রাম বন্দর থেকে গাড়ি ঢাকায় আনতে আনতে ওরিজিন্যাল পার্টস অনেক বদলে ফেলে। এটা এনট্যাক্ট আছে। বাবা আপনাকে খারাপটা দেবে না।’

‘আচ্ছা তা হলে হয়ে গেল।’ মিরাজের বাবাকে জানায় সূজা।

‘তা হলে টাকা-পয়সা নিয়ে কবে আসব?’

‘টাকা-পয়সা আবার কী? গাড়ি নিয়ে যান। আপনার সুবিধামতো টাকা দেবেন।’

‘না তা কেন হবে? টাকা রেডি…।’

‘আসুন যেদিন খুশি।’ কালও আসতে পারেন। মিরাজ স্যারদের নিয়ে আসবি। আমি কালই গাড়ি ধুয়ে-মুছে সব ঠিকঠাক করে রাখব।

পরের দিন গাড়ি এসে যায় তাদের উত্তরার বাড়িতে। এর সপ্তাহখানেকের মধ্যে চারতলার তরফদার ভাবি সেলিম ড্রাইভারকে জোগাড় করে দেয়। এরপর থেকে তারা সকাল-বিকেল বের হয়। সকালে মাছ-তরকারির পছন্দসই বাজার… বিকালে উইন্ডোশপিং। কোনোদিন তারা চলে গেছে গুলশান-বনানীর শাড়ি-জামাকাপড়, গহনাগাটির দোকান দেখতে। কোনো কোনোদিন তারা চলে যায়, আশুলিয়া-আবদুল্লাহপুর। কোনোদিন আশুলিয়ার সাভারের পথ ধরে চলে যায় সাভার, সাভারের স্মৃতিসৌধ। পর্যটনের হোটেলে বসে চা-কফি খায়। ফিরে আসে আনন্দে। সুখী হয়ে।

মাসখানেক পর এক সকালে কফি খেতে খেতে আন্নাই কাগজ-কলম নিয়ে বসে।

‘ঢাকা তো চষে বেড়ালাম। সেলিম ড্রাইভারও মোটামুটি নির্ভরযোগ্য। এবার চলো ঢাকার বাইরে।’

‘মন্দ কী? পস্ন্যান করো।’

‘আমার মনে হয় প্রথমে কাছে থেকে শুরু করি। প্রথমে চলো কুমিল্লা।’

সূজা হাসে।

‘আমিও তাই ভাবছিলাম। বার্ডের গেস্টহাউসে থাকা যাবে। বৌদ্ধবিহার… ময়নামতি… অনেক কিছু দেখার আছে। এরপর না হয় অন্য জায়গায়…।’

‘তাও আমি ঠিক করে রেখেছি। শ্রীমঙ্গল… পরে একেবারে সাগর-পার, কক্সবাজার। আন্নাকে সপ্রতিভ দেখায়।’

কুমিল্লাযাত্রার দিনক্ষণ ঠিক করে ফেলে তারা।

 

কুমিল্লা অভিমুখে আন্না-সূজা রওনা হয়ে যায়। নির্দিষ্ট দিনে সকাল-সকাল।

তাদের গাড়ি ছুটে চলেছে কারওয়ানবাজারসংলগ্ন কাজী নজরুল ইসলাম অ্যাভিনিউ ধরে। হঠাৎ করে একটা ভারী মোটরসাইকেল বাঁদিক ঘেঁষে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলে তাদের গাড়ির সাইড-মিররটি ভেঙে মাটিতে পড়ে যায়। সেলিম গাড়ি থামায়। মোটরসাইকেলের ছেলে দুটিও নেমে আসে। চালক ছেলেটি বলে,

‘ওহ্ এমন কিছু না। সাইড মিরর। বাংলামটরে গেলেই ঠিক হয়ে যাবে। টাকা দিয়ে দে। কত লাগবে?’ ড্রাইভারকে ডাকে সে।

সেলিম গাড়ির ডালা খুলে বেরিয়ে আসে।

‘কত দেব?’

‘আমি ঠিক জানি না। আয়নাটাও তো গেছে গিয়া। তবে হাজারখানেক লাগতে পারে।’

‘কত!’ বলে সেলিমকে ভারী বুটের লাথি মারে সে।

‘বাবারা আমি তো জানি না… তোমাগোর যা মনে অয় দেও।’

এতোক্ষণে বিভ্রান্ত সূজা গাড়ি থেকে বের হয়।

‘কী হয়েছে? শালার ব্যাটা এক হাজার চায়।’

‘ঠিক আছে তোমরা যা মনে করো তাই দাও। মারছো কেন?

আমি একজন মাস্টার…।’

পেছনে বসা ছেলেটি এবার সূজাকে লাথি মারতে এগিয়ে আসে।  ‘শালার মাস্টার… আবার সাফাই গায়।’

গাড়িতে বসা আন্না অবস্থা বেগতিক দেখে হিমশীতল হয়ে যেতে থাকে।

‘একি… একি!’ রাস্তার মানুষ ডাকার চেষ্টা করে সূজা।

কেউ এগিয়ে আসে না। দূরে পথচারীরা দাঁড়িয়ে তামাশা দেখে। এগিয়ে আসে না কেউ। একটু দূরে বাঁপাশে পুলিশ বুথ।

ছেলেদের একজন কোত্থেকে হকিস্টিকজাতীয় একটা লাঠি বের করে ঘুরে ঘুরে উইন্ড শিল্ড, উইন্ডো গ্লাস, ব্যাক গ্লাস ভাঙতে থাকে।

আন্না কোনোরকমে দরজা ঠেলে গাড়ি থেকে বের হয়ে সূজার পাশে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে কান্না জুড়ে দেয়। ‘হায় হায়, আমার সব যে গেল! আপনারা দেখেন… আসেন…।’

অন্য ছেলেটি বনেটে চড়ে সজোরে নেচে চলে।

‘শালার ব্যাটা শালা… তোদের মতো আমার বাড়িতে তিনটা গাড়ি পড়ে আছে।’

ছেলে দুটি বাইক ঘুরিয়ে চলে গেলে জমে ওঠা লোকজনের মধ্য থেকে বয়স্ক একজন এগিয়ে আসে।

‘ড্রাইভার গাড়ি স্টার্ট দেও। চলে যাও এখান থেকে।’

সেলিম গাড়ি স্টার্ট দেওয়ার চেষ্টা করে যায়। গাড়ি স্টার্ট নেয় না।

লোকটি এবার বলে, ‘আপনারা সিএনজি নিয়ে চলে যান। ছেলেগুলো আবার আসতে পারে। দলে বলে…’ তার গা-গতর কাঁপছে।

ভগ্ন-বিমর্ষ আন্না সূজার হাত চেপে ধরে রাখে। সে শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকার চেষ্টা করে।

‘না সূজা, আমি গাড়ি ফেলে যাব না। কোথাও যাব না।’ r