রাত্রিমা ও ঘুমগাছের বন

এই গল্পটা আমার মায়ের। এটাকে গল্প বলা যাবে কিনা বুঝতে পারছি না; কিন্তু গল্পের মতোই। এখনো ভাবলেই সব দৃশ্য হয়ে যায়।

আমাদের ছিল ঘুমগাছের বন। সেই বনের ভেতর আমাদের কাঠের দোতলা বাড়ি, টিনের ছাউনি। ওখানে থাকতো আমার রাত্রিমা, আমি, আমার ভাইবোনেরা, একটি ভয়ানক রূপবতী বৃদ্ধ দাদি, আর মধ্যে মধ্যে বাবা। বাবা তো দূর বনের সরকারি চাকর ছিল, তাই দূরের বনে বনে ঘুরে বেড়াতো শাম্বা হরিণের মতো, মোষের মতো। মধ্যে মধ্যে বাড়ি আসতো। বাবার কাঁধের চারপাশে তখন লেগে থাকতো শালবনের মাইল মাইল অন্ধকারের ঘ্রাণ। আমি বাবার কোলে চড়ে কাঁধে নাক রেখে সেই ঘ্রাণ নিতাম।

রাত্রিমা মানে আমার মা। আমার মায়ের নাম লায়লা। লায়লা মানে রাত্রি। ঘুমগাছ মানে রেইনট্রি। রেইনট্রির বাংলা বর্ষাতরু, বৃষ্টিগাছ ইত্যাদি হতে পারে। মা বলতো শিশু বটগাছ। পাড়া-প্রতিবেশী বলতো ঘুমগাছ। কারণ সূর্য ডোবার সঙ্গে সঙ্গে এই গাছের পাতাবলি লজ্জাবতী পাতার মতো ভাঁজ হয়ে ঘুম যায়। তাই এর নাম ঘুমগাছ। ঘুমগাছের ফুল সূর্যের মতো অনেকটা, পাপড়িগুলি আঁকা সূর্যের আলোকরশ্মির মতো। সে যাই হোক আমি ঘুমগাছ নামটাই নিলাম।

আমার মায়ের বিয়ে হয়েছিল মায়ের যখন এগারো বছর বয়স। মা ঘরসংসার করার জন্যে শ্বশুরবাড়িতে যায় তার পনেরো বছর বয়সে। যাওয়ার সময় গরুগাড়ি ভর্তি করে সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিল নানা গাছের চারা – যেন আমার কাঠমিস্ত্রি গরিব নানার পক্ষে এর চেয়ে বেশি যৌতুক দেওয়ার সামর্থ্য ছিল না। তো মা সেইসব গাছের চারা শ্বশুরবাড়ির ভিটায় লাগিয়ে একদিন বড় করে ফেললো। তারপর আরো অনেক বছর পর বাবা আমার জন্মের এক বছর আগে নদীর চরঘেঁষে, ব্রিজের দক্ষিণ-পশ্চিম কোনায় একটা জমি কিনলো। জমির পরিমাণ আশি শতাংশ। সেই বেলে জমিতে ধু-ধু কাশবন ছাড়া আর কিছু ছিল না। সেই কাশবনের মাঝখানে বালু ও পাথরের ভিটায় আমাদের বাড়ি হলো। কাঠের দোতলা বাড়ি, টিনের ছাউনি।

মা কাশবন রেখে দিলো। শরৎকালে সাদা হয়ে থাকতো আমাদের বাড়ির চারপাশ। মা চারপাশের বাউন্ডারি আর কাশবনের ফাঁকে ফাঁকে গুঁজে দিলো শয়ে শয়ে ঘুমগাছের বীজ। বীজ থেকে মাটি ভেদ করে উদ্গত হতে থাকলো ঘুমগাছের দল। ওরা আমার সঙ্গেই বড় হতে লাগলো।

আমার বয়স যখন সাত-আট, তখন একদিন ছোট মামা আমাদের বাড়ির পূর্বপাশের দেয়ালে একটা আলগা হয়ে যাওয়া তক্তায় পেরেক ঠুকছিল হাতুড়ি দিয়ে। আর হাতুড়ির ঘায়ে ঘায়ে বলছিল বিশকরম, বিশকরম, বিশকরম …। তখনো বুঝতাম না এই বিশকরমের মানে কী। মামা শুধু বলেছিল, ‘বিশকরম বললে পেরেক সোজা হয়ে ঢুকে, বাঁকা হয়ে যায় না।’

পরে বড় হয়ে জেনেছি বিশকরম মানে বিশ্বকর্মা। বিশ্বকর্মা তো নিজ হাতে পৃথিবী সৃষ্টি করেছিল। তাই এই জাতীয় ব্যবহারিক কাজে তার নাম নিলে কাজ ঠিকমতো হয়। যাই হোক, সেইদিন মামা পেরেক ঠুকতে ঠুকতে হঠাৎ করে একটা পেরেক বাঁকা হয়ে গেল। মামার আঙুলেও হাতুড়ির ঘা লাগলো। তো মামা দেখি নতুন পেরেক আরেকটা নিয়ে বেশ রেগে রেগে ঠুকছিল, আর বিশকরমের জায়গায় বলছিল ‘নুরুসেইন্না, নুরুসেইন্না, নুরুসেইন্না …।’ হাতুড়ি আর পেরেকের ঘষায় ছুটছিল আগুনের ফুলকি। আমি মানে কিছু বুঝলাম না। পরে জেনেছি নুরুসেইন্না মানে নুর হোসেন। নুর হোসেন মানে নুর হোসেন চেয়ারম্যান। আমার মা-বাবার দূরসম্পর্কের মামা। মা-বাবার কেন? আমার মা আর বাবা বিয়ের আগে ছিল পরস্পরের খালাতো ভাইবোন।

তো, আমাদের জমিটা বাবা কিনেছিল তার মামা নুর হোসেন চেয়ারম্যানের কাছ থেকে। সে টাকা নিয়েছিল, কিন্তু জমিটা বাবার নামে রেজিস্ট্রি করে লিখে দেয়নি। আজ দেবো কাল দেবো করে বছর কেটে গেছে। বলতো, ‘দরকার কী, আমি তো বেঁচে আছি, আমি থাকতে তোমাদের কেউ কিছু বলতে পারবে না …’ জাতীয় কথা।

তবু তার বাড়িতে আসা-যাওয়া করতে করতে আমার মা-বাবা যেন রাস্তা বানিয়ে ফেললো। কারণ তার সেই কথার ওপর মা-বাবা-মামা কারো ভরসা ছিল না। তখন একমাত্র ভরসার জায়গা ছিল ‘৭৮৬-এলাহি ভরসা’।

নুর হোসেন চেয়ারম্যান একই কাহিনি অনেকের সঙ্গে করেছে, টাকা খেয়ে জমি কেড়ে নিয়েছে। এইসব প্রতারণার কারণে তাকে ‘চিটিং’ নামেও ডাকা হতো। তাই সেইদিন মামা রেগে গিয়ে পেরেক ঠোকার সময় তার নাম বলছিল, যেন তার মাথাতেই পেরেক ঠুকছিল।

এইভাবে বাস্ত্ত হারানোর ভয়ে মানসিক চাপ আর অনিশ্চয়তায় কেটে গেছে আমাদের আঠারো বছর। আমার বয়স তখন আঠারো, আমাদের ঘুমগাছেদের বয়সও আঠারো। তবে আমার থেকে ওরা কয়েক মাসের ছোট। তার মানে ওরা আমার অনুজ সহোদরার মতোই। ঘুমগাছের শরীর আকাশগামী, ডালপালায় প্রতিদিন গাছভর্তি লাল লাল সূর্যফুল। শীতে হাজার হাজার টিয়াপাখি এসে ঘুমগাছের বনে দিনভর ডাকে।

সেই সময় নুর হোসেনের কাছ থেকে চাপ আসতে লাগলো। নতুন করে টাকা না দিলে সে জমির দখল নেবে। আমাদের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লো। মাঝখানে বাবার চাকরি নাই সাত বছর। আমরা খেয়ে, না-খেয়ে, কখনো কচুঘেচু, শাক-লতা-পাতা খেয়ে দিন কাটাচ্ছি। বাবার পাগলের মতো অবস্থা। নুর হোসেনের
হাতে-পায়ে ধরে আসে, কিন্তু নুর হোসেন মানে না। একমাসের সময় বেঁধে দেয়। কোনো উপায় মেলে না। আমাদের আর কোনো জমিজমা ছিল না। আমার রাত্রিমা, গভীর রাতে বাবাকে বলে, ‘গাছ বিক্রি করে দেন।’

শুনে বাবা বেকুবের মতো হয়ে যায়; কিন্তু কোনো উপায় নাই। শুধু ক্ষীণস্বরে বলেন, ‘আচ্ছা।’

তার পরদিনই গুনে গুনে একান্নটা ঘুমগাছ বিক্রি হয়ে যায়। আঠারো বছরের তরুণ একান্নটা ঘুমগাছ আমার স্বপ্নের সমান। আমরা কিছু জানতে পারি না। আমাদের ভিটেবাড়ি নতুন করে রেজিস্ট্রি হয়। আঠারো বছর পর অনিশ্চয়তা নেমে যায় ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ার মতো।

একদিন ভোরবেলা কাঁধে ভারী ভারী করাত নিয়ে করাতিয়া দল আমাদের বাড়ির সামনে এসে নামে লাইন ধরে। তখন আমি বুঝতে পারি গাছবন বিক্রি হয়ে গেছে। তিনদিনে সব গাছ কাটা হয়ে গেল। গাছ কাটার দিনগুলোতে আমি কলেজে যাই না। আমার জানালাবিহীন অন্ধকার ঘরে দরজা বন্ধ করে শুয়ে থাকি। আমার মাথার বালিশ ভিজে যায়। আমার কান্নার কথা জেনে যায় কেবল বালিশের পাশে রাখা প্রিয় গীতবিতান

তিনদিন পর দুপুরবেলা বাড়ির সামনের রাস্তায় লাইন ধরে ট্রাক দাঁড়ায় অনেকগুলো। সন্ধ্যা পার হয়ে রাত্রি-ছুঁইছুঁই হলে গাছভর্তি ট্রাকগুলো এক এক করে ছেড়ে চলে যায়। শেষ ট্রাকের শব্দ মিলিয়ে যেতেই আমি ঘর থেকে বের হই। গাছহীন মরুভূমির মতো আমাদের বাড়ির চারপাশে আকাশের চাঁদ গলে গলে পড়ছে যেন বা। আমি দেখি গেটের কাছে কেউ দাঁড়িয়ে। কাছে গিয়ে দেখি মা, আমার রাত্রিমা। আমি মায়ের পাশে দাঁড়িয়ে থাকি নীরবে। আর চাঁদের আলোয় ঝলসে যাচ্ছিল আমার মায়ের চোখ থেকে গড়িয়ে পড়া জলস্রোত।

তারপর মা একদিন অসুস্থ হয়ে পড়লো। মা পরপর দুইবার স্ট্রোক করলো। যে-মাকে কখনো ঘুম ছাড়া বসে থাকতে দেখিনি, কোনো না কোনো কাজ করতো, গভীর জ্বরের মধ্যেও কোনো না কোনো হাতের কাজ করতো, সোয়েটার বুনতো বা কাপড়ে ফুল তুলতো – সেই মা বিছানায় পড়ে রইলো পাঁচ বছর, কথা বলতে পারে না, নড়তে পারে না। আমরা বছর বছর আমাদের বাগানে রেইনট্রি গাছের বীজ পুঁতে দিই, চারা লাগাই, হয় না, মরে যায় বন্যায় কিংবা দেখাশোনার অভাবে।

তারপর মা একদিন মরে গেল। মাকে কবর দিলাম বাড়ির পূর্বদিকে একটা শিমুলগাছের তলায়। আমি আর ভাই মিলে কবরে নামালাম। মাটি দিলাম। কবরের ওপর হুজুর মাষকলাইয়ের দানা ছিটিয়ে দিলো। তারপর ছিটিয়ে দিলো পানি। পুঁতে দিলো একটা খেজুরের ডাল।

এক সপ্তাহ পর দূর থেকে দেখি মায়ের কবরসহ আশপাশ অনেকদূর সবুজ হয়ে আছে। কাছে গিয়ে দেখি মাষকলাইয়ের চারা নয় – সব ঘুমগাছের চারা। অবাক হলাম না। কারণ আমি জানতাম আমার মা তো আসলে ঘুমগাছের বীজ