বুলবন ওসমান
কাঁটায় কাঁটায় এগারোটা পনেরোয় নেতাজি সুভাষ বিমানবন্দরে বিমানের অবতরণ।
দশ কিলোর একটা ট্রলি নিয়ে ইমিগ্রেশনে দশ মিনিট। ঠিক বারোটা চারে বহির্গমন ধরে ফজলের নির্গমন। দরজার পাশেই অনুজবৎ প–ত দ-ায়মান।
নমস্কার দাদা।
নমস্কার। তোমার মেয়ের বৈবাহিক অনুষ্ঠানের সব তৈরি?
প্রায় সেরে এনেছি। চাকরিটা এবার ছাড়তে হবে তো, তাই কিছুটা অফিসিয়াল ঝামেলা রয়ে গেছে।
মেয়ে কি চাকরিতে জয়েন করেছে?
না। এই হবো হবো করছে। আমি আর বিলম্ব করতে চাই না।
ভালো করেছ। গুরুদায়িত্বটা সেরে ফেলাই ভালো।
পাশে দাঁড়ানো এক টিন-এজার যুবককে প–তের নির্দেশ, জেঠুকে নমস্কার করো! সুমন, ছেলে।
আরে, এ তো তোমার দ্বিগুণ দীর্ঘ।
তাই তালপাতার সেপাই।
ঠিক আছে। সময়ে ভারী হয়ে যাবে।
অদূরে ট্যাক্সি দাঁড়ানো।
ফজলের ট্রলিটা প–ত নিয়ে নেয়।
চলো, ডালহৌসি …
ডালহৌসি কেন?
একটা ছোট কাজ আছে। ওটা সারতে ঘণ্টাখানেক লাগবে।
বিমানপোত ছাড়িয়ে গাড়ি বড় রাস্তায়। নজরুল সরণির দুপাশে বেশকিছু গাছ ফজলের নজরে পড়ে, মৃত।
মরা গাছগুলো কেটে ফেলে দাও না কেন! এমনিতে তো হাজার রকম সংস্কার নিয়ে বাস করো। মরাগাছ শুধু অলক্ষুনে নয়, ওগুলো অসুখে মরেছে। অন্য গাছও সংক্রমিত হবে। মড়কের রূপ নিতে পারে।
এটা তো করপোরেশনের কাজ। আগামী বছর সাধারণ নির্বাচন, এখন এদিকে কে নজর দেবে বলুন!
তা ঠিক। আগামী বছর নির্বাচন তাই এখন থেকে তো খাওয়া-দাওয়া বন্ধ করে দেওয়া উচিত।
আড়চোখে চেয়ে প–ত মিটমিটিয়ে হাসে।
ফজলের বাবা ছিলেন শিক্ষক। ফজলও সারাজীবন বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেছে, তাই পিতৃস্বভাবসুলভ কথায় কথায় ঠোক্কর মারা স্বভাব।
প–ত নীরব।
ট্যাক্সি-শহরে। সামনের ফ্লাইওভার ধরে। মাঝামাঝি পৌঁছেছে, ফজল দেখে ডানে একটি সুউচ্চ ভবন। সব বাড়ি ছাড়িয়ে।
প–ত, এটা ক-তলা?
পঁয়ষট্টি।
বলো কী! ঢাকায় তো এর কাছেপিঠে কোনো বাড়ি নেই।
এটা এই উপমহাদেশের সর্বোচ্চ ভবন।
ফজল খেয়াল করে, অনেকটা এম্পায়ার স্টেট বিল্ডিংয়ের আদল। সুচালো চুড়ো। একটি প্রায় সমাপ্ত। ফিনিশিং টাচ চলছে।
এরপর এসে তোমাদের ভবনটা দেখতে হবে তো!
আমারও দেখা হয়নি।
দেখার দরকার কী, কবিতা লেখো।
কবি-প–তকে খোঁচা ফজলের।
জানো, আমার বাবা কী বলতেন! বলতেন, এদেশে গন্ডায় গন্ডায় কবি, কারণ গদ্য লেখা অনেক কষ্টের ও ধৈর্যের। অবশ্য রবি, নজরুল, জীবনানন্দকে ব্যতিক্রম ধরতেন। বলতেন, সাতাশ বছরে কবির জীবন শেষ হয়ে যেতে পারে। কিন্তু পরিপূর্ণ ঔপন্যাসিক হতে সত্তর বছর লাগে।
তিনি ক্ষণজন্মা পুরুষ, ঠিকই ধরেছেন।
রাইটার্স ছাড়িয়ে রাজ্যপাল ভবন শেষ হতে চলল।
বাবু কোনদিকে?
উত্তর গেটের পরের গেটের বিপরীতে।
গাড়ি একটা তিনতলা ভবনের সামনে দাঁড়ায়।
সুমন, তুমি একে নিয়ে মাসির বাড়ি চলে যাও। কাজ শেষ করে আমরা আসছি।
ভবনটা দেখে ফজল নস্টালজিয়ায় ভোগে। ডালহৌসিতে এমনি এক ভবনে তার নানা চাকরি করতেন। কোন ভবন এখন ঠিক মনে করতে পারছে না। দেশ ভাগ হয়ে গঙ্গার জল অনেক গড়িয়েছে।
নানার অফিসে পৌঁছলেই তার সামনে আসত ঢাউস চেহারার গরম গরম শিঙাড়া, ফ্রুটস কেক, লেমোনেড … চিপ্পু খুললেই ফস করে উথলে উঠত। গস্নাসে ঢাললে অনেকক্ষণ বুদ্বুদ করত। নানা ছিলেন কেমিস্ট। ডাক্তারের কম্পাউন্ডার। ব্রিটিশ ডাক্তারের সঙ্গে নানাকে ইংরেজিতে কথা বলতে দেখে সে অবাক চোখে চেয়ে থাকত। বড়দিনের ছুটিতে নানা যখন গ্রামে যেতেন কত রকম খাবার। আপেল, বেদানা, আঙুর, কমলা তো থাকতই। নানার হ্যাভারস্যাকটা খুললেই আপেলের মিষ্টি গন্ধ ভেসে আসত। এখনো আপেলের গন্ধে তার নানার কথা মনে পড়ে। এটা সাব-রেজিস্ট্রি অফিস। এখানেই আমার কাজ। সবকিছু তৈরি আছে। বেশিক্ষণ লাগবে না।
অফিসটা দোতলায়।
অনেকগুলো সিঁড়ি। ফজল শঙ্কিত।
দুদিন থেকে কোমরের ব্যথাটা জানান দিচ্ছে।
কিছুই করার নেই। রেলিং ধরে সে ধীর পদক্ষক্ষপে চড়াই।
পৌঁছে অবশ্য স্বসিত্ম। রুমে এসি।
বসার ব্যবস্থাও আধুনিক। মেঝে-সাঁটা চেয়ার।
প–ত তার অ্যাডভোকেটের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিলো।
কতক্ষণ লাগবে?
খাবার সময় পড়ে যাওয়ায় ঘণ্টাখানেক লেট হয়ে গেলাম।
কিছু খাবেন?
পেস্ননে খাওয়াটা কম ছিল না, ক্ষক্ষদে লাগছে না। তোমার কাজ শেষে খাওয়া যাবে।
প–ত সায় জানিয়ে বাইরে যায়। খানিক পর প্রত্যাবর্তন। হাতে একটা কাগজের বাটি। ভরা টুকরো ফল। আপেল, কলা, পেঁপে, পেয়ারা … কাঠি গেঁথে খেতে খেতে ফজল তৃপ্ত। গলায় আলাদা করে জল ঢালতে হচ্ছে না। সব ফলই বেশ সুস্বাদু। আর ফ্রেশ। রুচি আছে বলতে হবে বিক্রেতার।
কাউন্টারে সব ফাঁকা। সবাই আহারে গেছে।
এই ফলের দোকানটা কোথায়?
আপনি খেয়াল করেননি! একেবারে সিঁড়ির পাশে।
ফল সব ফ্রেশ।
এই দুপুরে আপনার জন্যে তেলে ভাজা খাবার আর আনলাম না।
খুব ভালো করেছ। ঢাকায় এই চলটা নেই বললেই চলে। ফলের দামও চড়া। বেশিরভাগ ফল আসে বাইরে থেকে। পেঁপে, পেয়ারা, কলা, আনারস শুধু দেশি। মুম্বাইয়ে কাটা ফলের চলটা খুব বেশি। মিক্সড ফ্রুটস জুসটাও খুব চলে। নাগপুরে হয় আঙুরের চাষ। সফেদাও খুব ভালো … ওরা বলে চিকু। বড় বড় বাগান দেখেছি। ফলটা খেতেও ভালো আর আয়রনে ভরা। বীরভূম আর পুরুলিয়ায় ট্রাই করলে হয়। লাল মাটি, শুকনো আবহাওয়া … কাজ শেষ।
সিঁড়ি ভেঙে শেষ মাথায় পৌঁছে ফজল দেখে বাঁপাশে এক মেয়ে ফলের সরঞ্জাম সাজিয়ে বসে। মেয়েটি সুদর্শনা। গায়ের উজ্জ্বল রং রোদকে টক্কর দিচ্ছে। বয়স ত্রিশ-বত্রিশ।
মেয়েটির সঙ্গে চোখাচোখি হয়ে যায়। কী কথা হয় কে জানে। ফজল দাঁড়িয়ে পড়ে।
প–ত, আর একপ্রস্থ ফল হয়ে যাক। দুপুর তো এখন বিকেল, সুতরাং ও-খাওয়াটা বাদ।
ঠিক আছে। এর কাছ থেকেই আগে দুবার নিয়ে গেছি।
তাই! বাটির কোনো হেরফের আছে নাকি?
হ্যাঁ। কুড়ি-তিরিশ। ছোট-বড়।
তাহলে তিরিশ, দুপুর-বিকেল।
এবার ফজল মেয়েটির দিকে চায়।
তোমাকে কী সম্বোধন করব?
আমার নাম রানি।
ব্যস, কোনো অসুবিধা নেই।
ফজল উদ্ধার পেয়ে যায়।
মনে মনে বলে, রাসন্তার ওপারে মহারাজের বাড়িতে তোমাকে ঠিক মানাত। এখানে বড় বেশি মানানের বাইরে …
বাড়িতে কে কে আছেন?
এক ছেলে এক মেয়ে।
স্বামী …
নেই …
কী ছেড়ে চলে গেছে … বলতে গিয়েও বলল না। এমন সুদর্শনা, সুস্বাস্থ্যের মেয়েকে একজন ছেড়ে যাবে কেন!
মনে হয় স্বামী গত হয়েছেন … অনুমানে বলে প–ত।
তিন বছর হলো মারা গেছেন।
কী হয়েছিল? ফজলের অনুসন্ধান।
ক্যান্সার।
কী ক্যান্সার?
থ্রোট … খইনি খেত। কত মানা করেছি। শুনত না।
নেশা ছাড়া মুশকিল, প–তের উক্তি।
ছেলেমেয়েরা কী করে?
মেয়ে বড়। উচ্চমাধ্যমিক দেবে … ওর বিয়ের সম্বন্ধ আসছে নানা জায়গা থেকে …
খুব সাবধান। দেখেশুনে মেয়েকে বিয়ে দেবে। মেয়েদের জীবনে অনেক দুর্ভোগ আসে। ফজলের উচ্চারণ।
সে তো নিজের জীবন দিয়েই দেখতে পাচ্ছি বাবু।
ছেলে কোন ক্লাসে?
ক্লাস সেভেন।
তোমার বাড়ি কোথায়?
আমি বিহারি।
বিহারি! দ্বৈতস্বর।
তোমার চেহারা, কথাবার্তায় একটুও অবাঙালি ছাপ নেই।
আমি কলকাতাতেই জন্মেছি।
তাই! তুমি ভূমিকন্যা হয়ে গেছ।
মিষ্টি হাসি উপহার। রানিকে আরো রানি করে তোলে।
এদিকে নতমুখে সে হাত চালিয়ে চলেছে। এক এক করে ফল সংহার করছে দুর্গার মতো। কলা, পেয়ারা, শসা, আপেল …
শুধু পেঁপের অনুপস্থিতি। ওই গোলাপি রঙের পেঁপেটা স্টিল লাইফ সাজাতে বড় সাহায্য করত। রঙে আনত বৈচিত্র্য। আর স্বাদেও। দেশি পেঁপের মতো কড়ামিঠে নয়। হেলথ কনসাস মানুষের জন্যেই যেন তৈরি।
এক বাটি তৈরি হতেই ওটা ফজলের দিকে বাড়িয়ে দেয়।
প–ত, তুমি নাও।
না, দাদা, আপনি।
বাধ্য হয়ে জ্যেষ্ঠ-সংস্কৃতিতে আবদ্ধ।
বাটি হাতে নিয়ে তার চোখে পড়ে পেঁপের অনুপস্থিতি!
রানি, পেঁপে নেই যে!
সব শেষ বাবু।
ঠিক আছে, ঠিক আছে …
কোনো দিন তোমার সব ফল শেষ হয়ে গেলে কী করো?
বেলা থাকলে অল্প করে এনে আবার বসি। তবে তেমনটা খুব একটা হয় না। পরবের দিনে হয়।
তোমার ফলগুলো খুব টাটকা।
এ-ব্যাপারে বাবু, আমি একটু খুঁতখুঁতে মানুষ। নিটোল জিনিস ছাড়া আমি আনি না। লোকে ফল খায় শরীরে একটু খাঁটি জিনিস যাবে বলে, সেখানে আমি যদি নিরস জিনিস সাপস্নাই দিই ঈশ্বর মানবেন না।
মনে মনে ফজল বলে, ঈশ্বর কিন্তু তোমার স্বামীকে নিয়ে নিয়েছে।
ফজলের মনে হলো কথাটা যেন রানির কানে গেছে। সে বলছে, আমার স্বামী তো ঈশ্বরের বিধান মানেননি, তাই অকালে চলে যেতে হলো।
তুমি থাকো কোথায়?
এন্টালি মার্কেটের পেছনে।
তোমাদের আসল বাড়ি কোথায়?
সাসারাম।
কথাটা শুনেই ফজলের লোম খাড়া হয়ে ওঠে। মনে পড়ে ভারতের ইতিহাসের অন্যতম নায়ক শের শাহর কথা। রানির প্রতি তার একটা অন্যরকম প্রীতির ভাব জেগে ওঠে। ভাবে, ওর জন্যে যদি কিছু করতে পারত!
রানি, তুমি যে গৃহস্থবাড়ির মেয়ে হয়ে রাসন্তায় বসে ব্যবসা করছ এতে কোনো বাধা আসেনি?
বাধা আসেনি মানে! সবাই বাধা দিয়েছে। অনেকে বিয়ে করতেও চেয়েছে। আমি কিন্তু স্বাধীনভাবে চলার পথ থেকে সরিনি।
এই সময় রানি ফজলকে বলে, বাবু, হাতটা একটু নামান তো!
ফজল ঠোঙাটা নামাতেই সে দু-টুকরো গোলাপি পেঁপে দিলো।
কোথায় পেলে?
এই দু-এক টুকরো এদিক ওদিক থেকে যায়।
খুব ভালো লাগছে তোমার ফল।
একটু রসিকতাও জুড়ে দেয়, দেখতে হবে তো, কার হাতে ফল কাটা হচ্ছে … রানির হাতের ছোঁয়ায় সব মিষ্টি হয়ে গেছে …
রানি হাসি ফুটিয়ে তা গ্রহণ করে। সহজভাবে বলে, তা ঠিক, আমার হাতের মিষ্টি তো লাগছেই।
বেলা পড়ে এসেছে। রাসন্তার ওপাশের ছায়া এপাশে। গঙ্গার হাওয়া সামান্য গরম নিয়ে পরশ বোলায়। পাখির ঝাঁক কিচকিচ শুরু করেছে রাজ্যপাল ভবনের বাগানে।
প–ত ট্যাক্সির খোঁজে। এই সময় ডালহৌসিতে ট্যাক্সি পাওয়া কঠিন। ফজলের খাওয়া শেষ।
ঠোঙাটা কোথায় ফেলব রানি?
আমাকে দিন। আমি সব জমিয়ে রাখি।
প–ত আগেই পেমেন্ট দিয়ে গেছে।
এই সময় এক বাটি গোলাপি পেঁপের টুকরো ফজলের দিকে বাড়িয়ে দেয় রানি।
ফজল অবাক!
তুমি না বললে, সব শেষ হয়ে গেছে!
স্মিত হেসে রানি বললে, এটা আমি আমার জন্যে রেখেছিলাম।
Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.