রায়পুরা থেকে ময়মনসিংহ

পাঁচ

জন্মস্থান রায়পুরায় আমি যতদিন থেকেছি তার চেয়ে বেশিদিন কাটিয়েছি ময়মনসিংহে। তারপরও ঘুরেফিরে রায়পুরার স্মৃতি কিছুতেই মন থেকে দূর হয় না। রায়পুরায় বালিকাবেলায় কত আনন্দ-উল্লাসের সঙ্গে সময় কাটাতাম। সমবয়সী ছেলেমেয়েরা খেলাধুলা করে, হইহুল্লোড় করে দিনের কতটা সময় চলে যেতো তার হিসাব করার প্রয়োজন বোধ করিনি।

মনে আছে, আমরা ছেলেমেয়ে একসঙ্গে গলা ছেড়ে গাইতাম সুরে কিংবা বেসুরে :

মেঘনা পাড়ের মেয়ে আমরা মেঘনা পাড়ের ছেলে

আমরা সবাই জীবন কাটাই গান গেয়ে আর খেলাধুলা করে।

আমাদের আগে-পরের ছোটরাও হয়তো এই গান গাইতো। এই গানের গীতিকার, সুরকারের নাম আমরা জানি না। সেটা জানার আগ্রহও আমাদের ছিল না। হয়তো কোনো লোককবি তাঁর মনের আনন্দে এই গান রচনা করেছিলেন। আর মুখে মুখে চলে সেটা আমাদের আগের, আমাদের সময়ের বা তার পরের প্রজন্মের ছোটদের গলায়ও নিশ্চয় গীত হয়েছে।

রায়পুরার কত কথাই এখনো স্মৃতিতে জ্বলজ্বল করছে। শীতকালে মেঘনা থাকতো শান্ত। নদীর তীরঘেঁষে মাছ ধরার জন্য বিশেষ ঘের তৈরি করতেন অনেকেই। একটি দিন মাছ ধরার উৎসব হতো। রুই, কাতল, কালিবাউসসহ কত মাছ। মাছ সংরক্ষণের ব্যবস্থা না থাকায় আত্মীয়স্বজনের বাসায় বিলিবণ্টন করা হতো। মাছ রান্না হতো নানা উপাদেয় উপায়ে। কোনো কোনো বাড়িতে জামাই-মেয়েকেও নিমন্ত্রণ করে আনা হতো মাছ খাওয়ার জন্য। আমাদের বাড়িতে মা-ঠাকুরমাকে মাছের শুঁটকি দিতেও দেখেছি। শুঁটকির গন্ধে কেউ কেউ বিরক্ত হলেও শুঁটকি রান্না হলে পাতে তুলতে আপত্তি করতে দেখিনি কাউকে।

আম-কাঁঠালের সময়টাও ছিল মহাআনন্দের। আম-কাঁঠালের সময়ও অতিথি আপ্যায়নের ধুম পড়তো।

আম-কাঁঠাল শুধু পাকলে খাওয়া হতো তা তো নয়। কাঁচা আম লবণ-মরিচ মাখিয়ে খাওয়াও কম লোভনীয় ছিল না। কাঁচা কাঁঠালের তরকারি খেতে কে না পছন্দ করতো। আম-কাঁঠাল পাকলে আমাদের খুশির সীমা থাকতো না। আমসত্ত তৈরি করা হতো কত যত্ন করে। চাটাই বিছিয়ে তাতে পরিষ্কার কাপড় দিয়ে আমের রস রোদে শুকিয়ে আমসত্ত বানাতে মা-ঠাকুরমাদের  উৎসাহের কমতি ছিল না।

পাকা আমের মধুর রসে আমরা যেমন ঠোঁট রাঙিয়েছি, তেমনি ‘আমসত্ত দুধে ফেলি, তাহাতে কদলি দলি’ ভাত মেখে খাওয়ার স্বাদও কি এখন পর্যন্ত ভুলতে পেরেছি!

আমাদের রায়পুরার বাড়িতে একটি আমবাগান ছিল। বাড়ির লাগোয়া সেই আমবাগিচা গ্রীষ্মের দুপুরে বাড়ির পুরুষ সদস্য ও ছোট ছেলেমেয়েদের বিশ্রামের জায়গা ছিল। পাটি বিছিয়ে কেউ শুয়ে

থাকতো, কেউ তাস খেলতো, আবার কেউ গলা ছেড়ে গাইতো বাউল বা পল্লিগীতি। পরে যখন একটু ওপরের ক্লাসে পড়ি তখন ময়মনসিংহ থেকে ছুটির সময় বাড়ি গিয়েও গ্রীষ্মের দুপুরে আমবাগিচায় অনেককেই অমন অলস সময় কাটাতে দেখে মনে পড়েছে কবিগুরুকে :

… খেলাধুলা সকল ফেলে তেমার কোলে ছুটে আসি

ও মা তোমার কোলে ছুটে আসি

ধেনু-চরা তোমার মাঠে, পারে যাবার খেয়াঘাটে

সারাদিন পাখি-ডাকা ছায়ায়-ঢাকা তোমার পল্লীবাটে

তোমার ধানে-ভরা আঙিনাতে জীবনের দিন কাটে …

এই সঙ্গে মনে পড়ছে পৌষ-সংক্রান্তিতে পিঠা-উৎসবের কথাও। পৌষপার্বণ বাঙালির একটি বহু পুরনো লোক-উৎসব। কৃষকের ঘরে ওঠে নতুন ফসল। মাঠজুড়ে সোনালি পাকা ধান চোখ জুড়িয়ে দেয়। নতুন ফসল ঘরে তুলে পিঠেপুলি তৈরি করে আয়োজন করা হয় এক উৎসবের। পাটিসাপটা, পুলি, ভাপা, সড়াই বা চিতই, গোকূল, মালপোয়া – কত বাহারি নামের সুস্বাদু পিঠা তৈরি হতো। মনে আছে নলেন গুড়ের পায়েসের কথাও। পিঠা তৈরিতে আমার মা-ঠাকুরমার হাতে ছিল শৈল্পিক দক্ষতা। পৌষ-পার্বণের সময়ও বাড়ি বাড়ি অতিথি আপ্যায়নের ধুম পড়তো। আত্মীয়স্বজন নিমন্ত্রিত হয়ে আমাদের বাড়িতে আসতো। মধ্যযুগের বাংলা মঙ্গলকাব্যে নানা প্রকার পিঠা ও পিঠা তৈরির বিচিত্রসব উপাখ্যানের উল্লেখ আছে।

রায়পুরার বাড়িতে দোলযাত্রার কথাও আমার খুব মনে পড়ে। ফাল্গুন মাসের পূর্ণিমাতিথিতে দোলযাত্রা হয় বলে একে বসন্তোৎসবও বলা হয়। দোল পূর্ণিমার দিন শ্রীকৃষ্ণ আবির নিয়ে রাধিকা ও অন্য গোপীদের সঙ্গে রং খেলতেন বলে প্রচলিত ধারণা থেকেই দোল উৎসব পালিত হয়। এখনো দোলের দিন নারী-পুরুষ নির্বিশেষে আবির ও নানা রং দিয়ে খেলায় মত্ত হতে দেখা যায়। রায়পুরার বাড়িতে আমরা দুদিন দোল উৎসব করতাম বলে আমার মনে আছে। প্রথমদিন প্রথমে মন্দিরে গিয়ে দেবতার পায়ে আবির ছুঁইয়ে শুরু হতো দোলযাত্রা। পরে বাড়ির বয়োজ্যেষ্ঠদের পায়ে আবির দিয়ে আমরা ছোটরা প্রণাম করে চার আনা আট আনা বখশিশ পেতাম। দ্বিতীয় দিন শুরু হতো আসল রং খেলা। নানা বর্ণের রং গুলিয়ে পিচকিরিতে ঢুকিয়ে বিভিন্নজনের গায়ে মেখে দেওয়া হতো। বাড়ি বাড়ি গিয়ে চলতো এই রং মাখানোর খেলা। কেউ কেউ তো রং মেখে উঠানে গড়াগড়িও দিতো। অনেকের চেহারা বদলে যেতো, চেনার উপায় থাকতো না। রং খেলাশেষে দলবেঁধে সবাই মেঘনায় গিয়ে স্নান করে গায়ের রং পরিষ্কার করতো। জলও রঙিন হয়ে যেতো। একদিনে সবার গায়ের রং পরিষ্কার হতো না।

দোলের দিন আমাদের বাড়িতে লুচি তরকারি খিচুড়ি পায়েস রান্না হতো। রাতে হতো কীর্তনের আয়োজন। আখড়া থেকে মনমোহন গোসাই এবং তাঁর সঙ্গীরা এসে কীর্তন পরিবেশন করতেন।

গ্রামাঞ্চলে হিন্দুদের বিয়ের কথাও আমার বেশ মনে পড়ে। বিয়ে হতো এক বাড়িতে ছেলে বা মেয়ের। কিন্তু আনন্দে মেতে উঠতো পুরো গ্রাম। পাড়া-পড়শিদেরও উৎসাহে কোনো ঘাটতি ছিল না। বিয়ে বাড়িতে কে কীভাবে সহযোগিতা করবে, তার যেন প্রতিযোগিতা লেগে যেতো। তখন তো আজকালের মতো ডেকোরেটর পাওয়া যেতো না। বিয়েবাড়ির সাজসজ্জা, রান্নাবান্না সব নিজেদেরই করতে হতো। এসব কাজে যাদের দক্ষতা ছিল তারা স্বতঃস্ফূর্তভাবে বিয়ে বাড়িতে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতো। বিয়ের অনুষ্ঠানে বয়স্ক মেয়েদেরও নেচেগেয়ে আনন্দে শরিক হতে দেখা যেতো। দু-চারটি বিয়েতে আমারও উপস্থিত থাকার সুযোগ হয়েছে। তবে মেয়েকে বিদায় দেওয়ার সময় তৈরি হতো আবেগঘন পরিবেশ। মেয়ে যেমন বাবা-মায়ের বাড়ি ছেড়ে নতুন বাড়িতে যাওয়ার সময় কেঁদেকেটে বুক ভাসাতো, তেমনি মেয়ের মা-বাবাও কান্না থামাতে পারতেন না। বাবা কিছুটা সংযম দেখানোর চেষ্টা করলেও মায়ের বুকফাটা কান্না বিষাদের আবহ তৈরি করতো। মানুষের জীবন যে আনন্দ-বেদনার সমাহার বিয়ের অনুষ্ঠানগুলো যেন ছিল তারই এক প্রামাণ্যচিত্র। এখন যান্ত্রিকতায় কৃত্রিমতায় মানুষের আবেগ অনেকটাই কমে গেছে বলে আমার মনে হয়।

লালপুরের সূর্যকান্ত চৌধুরীর কথা আগে বলেছি। একবার লালপুর বেড়াতে গিয়ে রাইমোহন নামে একটি ছেলের সঙ্গে বাবার পরিচয় হয়। রাইমোহন খুব ভালো গান গাইতে পারতো। তার গান শুনে বাবা মুগ্ধ হয়েছিলেন। জানতে চেয়েছিলেন ছেলেটি লেখাপড়া করে কি না। রাইমোহন জানায়, চতুর্থ শ্রেণির পর তার আর লেখাপড়া হয়নি। তারা খুবই গরিব। লেখাপড়ার খরচ চালানোর সামর্থ্য তার অভিভাবকের নেই।

বাবা রাইমোহনকে আমাদের বাড়িতে নিয়ে আসেন। আমার ছোট কাকার নাম সুনীল। তার সঙ্গে মিলিয়ে বাবা রাইমোহনের নতুন নাম রাখেন সুশীল। আমাদের বাড়িতে থেকেই সুশীল ম্যাট্রিক পাশ করে। পরে নরসিংদী কলেজ থেকে কৃতিত্বের সঙ্গে বি.কম পাশ করে সুশীল চট্টগ্রামে সূর্যকান্ত বাবুর কাছে গিয়ে ব্যবসা শুরু করে। এখন সুশীল একজন বড় ব্যবসায়ী।

আমাদের দেশে এমন মানুষের সংখ্যা কম নয়, একটু সাহায্য-সহযোগিতার অভাবে যারা জীবনে প্রতিষ্ঠালাভের সুযোগ পায় না। আবার  সাহায্য করার সামর্থ্য আছে – এমন মানুষও সমাজে কম নয়। শুধু দরকার সংযোগ এবং সমন্বয়। মানুষ সংবেদনশীল হলে, মানবিক হলে, আমাদের সমাজচিত্রটা নিশ্চয়ই বদলানো সহজ হতো। আমি আমার বাবা-মায়ের কাছ থেকে উদারতার যে-শিক্ষা পেয়েছি, তা-ই এখনো আমার কাছে আলোকবর্তিকা হয়ে আছে।

ছয়

একবার এক ছুটিতে রায়পুরা থেকে ফেরার সময় আমার সঙ্গী হলো ছোটভাই বিজন পাল (আকাশ)। লেখাপড়ার জন্য ওকে শহরে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেন আমার মা। আসলে আমাদের জন্য মা খুবই চিন্তা করতেন। আমাদের কীসে ভালো হবে, মঙ্গল হবে, সেটা ছিল মায়ের সারাক্ষণের ভাবনা। গ্রামের চেয়ে শহরে থেকে লেখাপড়া ভালো হবে ভেবেই তিনি আমাদের ময়মনসিংহে দাদুর বাড়িতে পাঠিয়েছিলেন। আমাদের ভাই-বোনদের ওপর মায়ের প্রভাব স্বাভাবিকভাবেই বেশি। আমাদের লেখাপড়া, চরিত্র গঠন, শিষ্টাচার শেখা – সবকিছুর দিকেই ছিল মায়ের নজর। তিনি শারীরিকভাবে সবসময় আমাদের সঙ্গে না থেকেও ছিলেন আমাদের ছায়াসঙ্গী।

আকাশকে নিয়ে ময়মনসিংহ আসার দিন মা আমাদের সঙ্গে এসেছিলেন। তার জন্য দুদিন ধরে মায়ের সে কি প্রস্তুতি! আকাশের বই-খাতা, জামা-কাপড় একটি ছোট টিনের বাক্সে গুছিয়ে নিয়েছেন। দুধের ক্ষীর তৈরি করেছেন। কয়েক রকম মাছ ভেজে নিয়েছেন। মুড়ি চিড়া নাড়ুও নিতে ভোলেননি। আকাশ আমার সঙ্গী হওয়ায় আমি খুব খুশি হয়েছিলাম। পিঠাপিঠি ভাই-বোন হওয়ায় আমাদের মধ্যে যেমন ঝগড়াঝাটি হতো, তেমনি আবার মিলও ছিল বেশি। একসঙ্গে খেলাধুলা করতাম। দুষ্টুমি করতাম। ট্রেনে ময়মনসিংহ আসার সময় দুজন ছড়া কেটেছি :

ঝক্কর ঝক্কর ময়মনসিংহ

ঢাকা যেতে কতদিন

আইতে যাইতে মোষের শিং

তার নাম ময়মনসিংহ।

মেঘনার ভৈরব ব্রিজ অতিক্রম করার সময় থেকেই আমাদের প্রতীক্ষা শুরু হতো ব্রহ্মপুত্র ব্রিজের। মেঘনা এবং ব্রহ্মপুত্র ছিল আমাদের প্রাণশক্তি।

দাদুর বাড়িতে আকাশ আসার পর আমার জন্য দাদু-দিদিমার যে-আদর ছিল, তা ভাগ হয়ে গেল। আমার প্রথম প্রথম একটু খারাপ লাগতো না তা নয়। পরে নিজেকে এই বলে সান্ত্বনা দিতাম যে, আকাশ তো আমারই ছোটভাই, আমারই খেলার সাথি। দাদু-দিদিমার আদর-স্নেহে ওরও সমান ভাগ আছে।

মনে আছে, আমরা দুই ভাই-বোন চুরি করে এটা-সেটা খেতে পছন্দ করতাম। চুরির তালিকায় এক নম্বরে ছিল আচার। দিদিমা বয়াম ভর্তি করে আচার বানিয়ে রাখতেন। খুব মজাদার ছিল সে-আচার। আমি আর আকাশ সুযোগ পেলেই বয়াম থেকে আচার নিয়ে চুপি চুপি খেয়ে নিতাম। দিদিমা বুঝতেন। কিন্তু বকাঝকা না করে কৃত্রিম রাগের ভান করে বলতেন, পুলিশে খবর দিতে হবে, আমার বয়াম থেকে আচার চুরি হচ্ছে! পুলিশের কথা শুনে আমরা ভাই-বোন মুখ চাওয়াচাওয়ি করতাম, দিদিমা আড়চোখে দেখে মুচকি মুচকি হাসতেন।

চুরির তালিকায় দুই নম্বরে ছিল পাটালি গুড়। পাটালি গুড় পরনের হাফ প্যান্টে গুঁজে রেখে একটু একটু করে জিহ্বা দিয়ে চেটে খেতাম। পুরোটা একবারে মুখে পুড়ে দিলে তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে যাওয়ার আশংকায় আমরা সময় নিয়ে এভাবে একটু একটু করে চেটে চেটে খেতাম।

আমাদের আরেকটি মজা ছিল ডিম খাওয়া নিয়ে। যেদিন ডিম রান্না হতো সেদিন ডিমটি আমি প্রথমেই খেয়ে নিতাম না। আকাশের ডিম খাওয়া শেষ হলে আমি ওকে দেখিয়ে দেখিয়ে একটু একটু করে খেতাম, প্রথমে সাদা অংশ, তারপর কুসুম। বেচারা আকাশ ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আমার ওভাবে তাড়িয়ে তাড়িয়ে ডিম খাওয়া দেখতো। পরে অবশ্য আকাশও আমার মতো করেই ডিম খেতো।

একটু ওপরের ক্লাসে ওঠার পর আকাশকে মাঝেমাঝে বাজার করতে পাঠানো হতো। মাছ-তরিতরকারি কেনার জন্য। দুই টাকার বেশি ওর হাতে দেওয়া হতো না। দুই টাকার বাজারই তখন অনেক। টাকা হাতে পেয়ে আকাশ আমার কাছে ছুটে আসতো। দুই টাকা থেকে কয় পয়সা মেরে দেবে সেই পরামর্শের জন্য। বাজারের পয়সা থেকে যে কিছু পয়সা বাঁচানো যায়, সেটা বুঝতে আমাদের আলাদা করে জ্ঞান অর্জন করতে হয়নি। বাজারের টাকা থেকে যে দুই-চার আনা মারা হতো তা জমিয়ে আমরা শিঙাড়া কিনে খেতাম। স্বদেশি বাজারের মোড়ে সেসময় ছোট ছোট শিঙাড়া পাওয়া যেতো। ওই শিঙাড়া গরম গরম খেতে বেশ লাগতো।

ময়মনসিংহে ছোটবেলায় চৈত্র সংক্রান্তি এবং পহেলা বৈশাখ ছিল আমাদের কাছে দুটি উৎসব-আনন্দের দিন। চৈত্র সংক্রান্তির দিন সকালে দই-চিড়া এবং ছাতু খেয়ে দিন শুরু হতো। দুপুরে তিতা খাওয়ার রেওয়াজ ছিল। তার আগের দিন সবাই মিলে বাড়িঘর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করা হতো। সাজ-সাজ রব পড়ে যেতো। পুরাতনকে বিদায় জানিয়ে নতুনকে বরণ করার আয়োজন। পহেলা বৈশাখ দোকানে দোকানে হালখাতা হতো। দাদুর ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানেও হালখাতা হতো। আমরা গিয়ে মিষ্টি খেতাম। বাড়িতে ভালো খাবারের আয়োজন হতো। রুই মাছ, পাবদা মাছের তরকারির কথা এখনো মনে আছে। জগা নামে একজন জেলে দাদুর বাড়িতে নিয়মিত মাছ দিতেন। পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে তো অবশ্যই। জগা আবার ভালো নাচ জানতেন। তিনি অনেককে নাচও শেখাতেন। এই গুণ তিনি কীভাবে অর্জন করেছিলেন, তা অবশ্য জানা হয়নি।

ময়মনসিংহে আমি চার-পাঁচ বছর বিখ্যাত সংগীতগুরু মিথুন দে-র কাছে গান শেখার চেষ্টা করেছি। সপ্তাহে একদিন তিনি আমাকে গান শেখাতেন। এজন্য আমার দাদু তাকে মাসে পাঁচ টাকা করে দিতেন। মিথুন দে ছিলেন অত্যন্ত গুণী শিল্পী। তিনি বলতেন, নিয়মিত রেওয়াজ করো, গলাটাকে গানের জন্য তৈরি করো। তারপরই না গান গাইতে পারবে। অমন গুণী শিল্পীর সান্নিধ্য পেয়েও আমি যে গানকে সেভাবে গলায় তুলতে পারিনি, সেটা আমার ব্যর্থতা। ‘উদীচী’ তখনো ময়মনসিংহে সেভাবে গড়ে না উঠলেও আলোকময় নাহা-সুমিতা নাহাদের মতো শিল্পীরা তখনই খ্যাতি পেতে শুরু করেছিলেন।

আমি ম্যাট্রিক পাশ করি ১৯৬৪ সালে। তখন ম্যাট্রিক পরীক্ষা এখনকার মতো দীর্ঘ সময় ধরে হতো না। বাংলা-ইংরেজি প্রথম ও দ্বিতীয় পত্রের পরীক্ষা একই দিনে হতো। অংক পরীক্ষার দিন অন্য পরীক্ষা থাকতো। এক পরীক্ষার পর অন্য পরীক্ষার জন্য বড়জোর একদিনের গ্যাপ থাকতো। ম্যাট্রিক পরীক্ষার সময়ও প্রাইভেট টিউটরের কাছে পড়িনি। স্কুলের শিক্ষকদের কাছেই ছিল আমাদের পরীক্ষার প্রস্তুতি। পরীক্ষার সময় আমার মা ময়মনসিংহে আসতেন এবং আমার সঙ্গে পরীক্ষাকেন্দ্রে যেতেন। আরো অনেক অভিভাবকই পরীক্ষাকেন্দ্রের বাইরে অপেক্ষা করতেন। বিরতির সময় মা আমাকে ডাব কিনে খাওয়াতেন। দু-একদিন চিড়া বা অন্য কোনো শুকনো খাবারও নিতেন। আমাদের সময় পরীক্ষায় নকল করার প্রবণতা ছিল না বললেই চলে।

সে-সময় থানা পর্যায়ে পরীক্ষাকেন্দ্র ছিল না। গ্রামাঞ্চলের পরীক্ষার্থীদের শহরে এসে পরীক্ষা দিতে হতো। আমার দাদুর বাড়িতে থেকেও অনেককে পরীক্ষা দিতে দেখেছি। পরীক্ষার্থীরা বালিশ শতরঞ্চি সঙ্গে নিয়ে আসতো। এই পরীক্ষার্থীদের দিনকয়েকের জন্য আশ্রয় দিতে কেউ বিরক্ত বোধ করতেন না। কোন পরিবারের ছেলে, সে-বাছবিচারও করা হতো না। আমার দাদুর বাড়িতে দু-চারজন কলেজ ছাত্রও থাকতো। তারা খাওয়া-দাওয়া বাইরে করতো। কিন্তু থাকার জন্য কোনো টাকা-পয়সা দিতে হতো না। যারা লেখাপড়া করতো তাদের প্রতি সবারই সহানুভূতি ছিল।

ম্যাট্রিক পরীক্ষার পর তিন মাস পড়াশোনার চাপ থাকতো না। এখন উচ্চমাধ্যমিকে ভর্তি হওয়ার জন্য যেভাবে কোচিং সেন্টারে দৌড়াতে হয়, আমাদের সময় তেমন ছিল না। শিক্ষার্থী কম ছিল, কলেজে ভর্তির চাপও তেমন ছিল না। ম্যাট্রিক পরীক্ষার পর ঘরে বসে অলস সময় না কাটিয়ে আমি টাইপ শেখার জন্য ভর্তি হয়েছিলাম।

ম্যাট্রিক পাশের পর আমি মমিনুন্নেসা কলেজে উচ্চমাধ্যমিকে ভর্তি হই। শুরু হয় নতুন জীবন। স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে কলেজে যাওয়ার পর মনে হলো আমি বড় হয়ে গেছি। কলেজে ওঠার পর আমার ভাবভঙ্গিও বুঝি কিছুটা বদলে গিয়েছিল। অন্যদিকে ওই সময় আমাকে নিয়ে আমার দাদুর মধ্যেও এক ধরনের আতঙ্ক তৈরি হয়েছিল। পথেঘাটে কী হয়-না-হয় তা নিয়ে তিনি উদ্বিগ্ন থাকতেন। আশপাশের লোকজনও দাদুকে বলতেন, পড়াশোনা অনেক হয়েছে, এবার নাতনিকে বিয়ে দিয়ে দিন। মেয়েরা তখন খুব বেশি পড়াশোনা না করলেও আমার মা এবং দাদু চাইতেন আমি লেখাপড়া চালিয়ে যাই। তবে আমাকে সাবধানে চলাফেরা করার পরামর্শ দিতেন দাদু সবসময়।

কলেজে ভর্তি হওয়ার পর আমি আস্তে আস্তে ছাত্র ইউনিয়নের সংস্পর্শে আসি। এরই মধ্যে আমার বড়ভাই বিকাশ পালও ময়মনসিংহে চলে এসেছে। দাদাও ছাত্র ইউনিয়ন করতেন। সমাজ-রাজনীতি নিয়ে আমার মধ্যে আগ্রহ তৈরি হতে থাকে। একুশের প্রভাতফেরিতে অংশ নিই। ‘ওরা আমার মুখের ভাষা কাইড়া নিতে চায়’ – গান গেয়ে নগ্নপায়ে প্রভাতফেরিতে অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে আমি এক নতুন জীবনের হাতছানি পাই। ছাত্র সংগঠনের সঙ্গে আমি যে জড়িয়ে পড়ছি, এটা পরিবারের অন্যরা বুঝতেন, কিন্তু কেউ বাধা দেননি।

বিএ পড়ার সময় আমি কলেজ ছাত্র সংসদের সাংস্কৃতিক সম্পাদিকা নির্বাচিত হই। ততোদিনে শেখ মুজিব ছয় দফা কর্মসূচি ঘোষণা করেছেন। দেশের রাজনীতি ক্রমেই গরম হয়ে উঠছে। তবে ময়মনসিংহে তখনো এক নম্বর ছাত্র সংগঠন হিসেবে ছাত্র ইউনিয়নই সবার কাছে পরিচিত। ছাত্রদের মধ্যে ছাত্রলীগ সেভাবে প্রভাব বিস্তার করতে সমর্থ হয়ে ওঠেনি। সে-সময় মতিয়া চৌধুরী একদিন আমাদের কলেজে এসে বক্তৃতা করেছিলেন। সে কি উদ্দীপনাময় বক্তৃতা! ততোদিনে তিনি অগ্নিকন্যা হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেছেন। মতিয়া চৌধুরী আমাকে দারুণভাবে প্রভাবিত করেছিলেন। ওই সময় ময়মনসিংহে ছাত্র ইউনিয়নের নেতা হিসেবে ছাত্রদের কাছে ব্যাপক পরিচিত ছিলেন নূর মোহাম্মদ তালুকদার, নজরুল ইসলাম, মকবুল হোসেন, প্রদীপ চক্রবর্তী, আব্দুল হান্নান, শফি আহমেদ, ফারুক, হাশেমসহ আরো কয়েকজন। ছাত্রীদের মধ্যে আমার সঙ্গে ছিলেন রুবী, চামেলি, শামসুন্নাহার। কলেজের সাংস্কৃতিক সম্পাদক হিসেবে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন করে আমি প্রশংসিত হয়েছিলাম।

একজন মানুষের কথা এই প্রসঙ্গে মনে পড়ছে। কলেজের কাছেই ছিল তাঁর একটি গ্রিলের দোকান। তিনি ছিলেন অবাঙালি। লুঙ্গি হাফ শার্ট পরা ওই মানুষটিকে আমি চাচা বলে সম্বোধন করতাম। তাঁর কাছ থেকে আমি ছাত্র ইউনিয়নের জন্য নিয়মিত চাঁদা নিতাম। তিনি আমাদের কাজকর্ম পছন্দ করতেন। তিনি ধার্মিক মানুষ হলেও তাঁর মধ্যে উদারতাও ছিল। আজকাল উদার মানুষের সংখ্যা কমছে। মানুষ ধর্মাচারের নামে সংকীর্ণতার পরিচয় দিচ্ছে। সমাজে প্রগতিশীলতার চর্চা কমছে। আমরা যে-জীবনসাধনা করে এসেছি, তা দিন দিন গতিহীন হয়ে পড়ছে। পেছনে তাকিয়ে ভাবি, আজকের এই অবস্থার জন্য আমাদের কি কোনো দায় নেই? যে সুন্দর ও কল্যাণের জন্য সংগ্রাম করলাম, তা কেন পূর্ণতা পেলো না?

সাত

ছাত্র ইউনিয়নের সংস্পর্শে এসে ধীরে ধীরে বাম রাজনীতির প্রতিও আগ্রহ তৈরি হতে থাকে। তখন কমিউনিস্ট পার্টি নিষিদ্ধ। কমিউনিস্ট নেতারা প্রায় সবাই হয় জেলে, না হলে আত্মগোপনে। কমিউনিস্ট পার্টির বড় নেতা মণি সিংহসহ অনেকের নাম শুনি। তাঁদের ত্যাগ এবং গরিব-দুঃখী মানুষের জন্য ভালোবাসার কথা শুনে তাঁদের প্রতি আমার শ্রদ্ধা বাড়তে থাকে। সুসং দুর্গাপুরের রাজপরিবারের সদস্য মণি সিংহ সাধারণ মানুষের জন্য লড়াই-সংগ্রাম করে নিজের পরিবারের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছেন, টংক প্রথার বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছেন – এসব কথা শুনে আমি যথেষ্ট অনুপ্রাণিত বোধ করি।

আমার দাদা আমাকে রাজনীতিবিষয়ক বইপত্র পড়তে দিতেন। ছোটদের রাজনীতি, ছোটদের অর্থনীতি, অনিল মুখার্জির লেখা রাজনীতির হাতে খড়ি বইগুলো পড়ে সমাজতন্ত্র তথা সাম্যবাদী রাজনীতির প্রতি কিছুটা যেন নেশাগ্রস্তই হয়ে পড়ি। এই সময়েই আমি ময়মনসিংহের খ্যাতিমান কমিউনিস্ট নেতা অজয় রায়ের নাম শুনি। ছাত্র ইউনিয়নের নেতাদের কাছ থেকেই মূলত কমিউনিস্ট নেতাদের সম্পর্কে শুনতাম, জানতাম। কমিউনিস্টরা তখন মূলত ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির (ন্যাপ) মাধ্যমে কাজ করতেন। আমরা যখন রাজনীতিতে আগ্রহী হয়ে উঠছি, তখন ন্যাপ আদর্শিক প্রশ্নে দুই ভাগ হয়ে গেছে। এক অংশের নেতৃত্বে অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমেদ (তিনি অবশ্য পূর্ব পাকিস্তান ন্যাপের সভাপতি ছিলেন। পাকিস্তান কেন্দ্রীয় ন্যাপের সভাপতি ছিলেন খান আব্দুল ওয়ালী খান। তাই এই অংশ ন্যাপ ‘ওয়ালী ন্যাপ’ হিসেবে পরিচিত ছিল)। ন্যাপের অন্য অংশের সভাপতি ছিলেন মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী। ওয়ালী বা মোজাফ্ফর ন্যাপ মোটা দাগে মস্কোপন্থি হিসেবে পরিচিত ছিল। আর ভাসানী ন্যাপ ছিল পিকিংপন্থি। ন্যাপের এই বিভক্তি বাম রাজনীতির জন্য ক্ষতির কারণই হয়েছিল।

ময়মনসিংহে তখন পাটের ব্যবসা ছিল বেশ জমজমাট। বড় বড় পাটের গুদাম ছিল। সেসব গুদামে অনেক শ্রমিক কাজ করতেন। এই শ্রমিকদের সংগঠিত করার কাজে ন্যাপের নেতাকর্মীরা ভূমিকা রাখতেন। তখন পর্যন্ত ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্র গঠিত হয়নি। ছাত্র ইউনিয়নের কেউ কেউ পাট গুদামের শ্রমিকদের মধ্যে কাজ করতেন।

ব্রহ্মপুত্রের ওপারে দাসপাড়া নামে একটি বড় গ্রাম ছিল। প্রায় চারশো পরিবারের বাস ছিল সেখানে। দাসেরা নানা পেশায় নিয়োজিত ছিলেন। জেলে হিসেবে মাছ ধরা তাঁদের মূল পেশা হলেও অন্য অনেক ধরনের কাজেই তাঁদের অংশগ্রহণ এবং পারদর্শিতা ছিল। কাঠের কাজ, বেতের কাজ যেমন করতেন, তেমনি শাকসবজি উৎপাদন, অন্য চাষাবাদ এবং মুড়ি-চিড়া ভাজার কাজেও তাঁদের ভূমিকা রাখতে দেখেছি। খুব ভোরে দাসপাড়ার লোকেরা নৌকা বা গুদারায় নদী পার হয়ে ময়মনসিংহ শহরে নানা পণ্য নিয়ে হাজির হতেন। বাড়ি বাড়ি ঘুরে সেগুলো বিক্রি করতেন। দাম অনেক সস্তা ছিল। সব জিনিসই ছিল টাটকা এবং ভেজালমুক্ত। মাত্র আট আনা বা এক টাকায় প্রচুর সবজি পাওয়া যেতো। দাসেরা বড়লোক ছিলেন না। আবার তীব্র অভাবও তাঁদের হয়তো ছিল না। সবাই মিলে পরিশ্রম করে মোটা ভাত, মোটা কাপড়ের সংস্থান তাঁদের হয়ে যেতো।

নারী-পুরুষ সবাইকে বেশ হাসিখুশি থাকতে দেখেছি। কেউ কেউ দোতারা বাজিয়ে গান করতেন। রাজনৈতিক প্রয়োজনে আমাদের দাসপাড়ায় যাতায়াত ছিল। আমরা তাঁদের আমাদের রাজনৈতিক আদর্শে উদ্বুদ্ধ করার চেষ্টা করতাম। পরে আমাদের মিছিল-মিটিংয়ে দাসপাড়া থেকে মানুষজনের ভালো উপস্থিতি থাকতো। একসময় দাসপাড়া আমাদের ঘাঁটিতে পরিণত হয়েছিল। বিপদে-আপদে দাসপাড়া কমিউনিস্টদের নিরাপদ আশ্রয়কেন্দ্র হয়ে উঠেছিল।

নদী পারাপারের জন্য গুদারাঘাটে সারিবাঁধা নৌকা দেখে আমার মনে গুনগুনিয়ে উঠতো :

ও গো তোরা কে যাবি পারে

আমি তরী নিয়ে বসে আছি নদী কিনারে –

বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর দাসপাড়ার সঙ্গে আমার আর তেমন যোগাযোগ ছিল না। ২০০৭ কিংবা ২০০৮ সালে ময়মনসিংহ গিয়ে দাসপাড়া যাওয়ার জন্য আমার প্রাণটা আনচান করে ওঠে। সাবেক ছাত্রনেতা ও মুক্তিযোদ্ধা শফিভাইকে আমার আগ্রহের কথা জানালে তিনি বলেন, দাসপাড়া তো এখন নামে আছে, দাসেরা তো কেউ নেই। শুনে আমার মনটা খারাপ হয়। তারপরও এতো বছর পর গ্রামটি দেখার ইচ্ছা থেকেই শফি ভাইকে যাওয়ার জন্য সম্মত করাই।

দাসপাড়া গিয়ে আমার বুকের মধ্যে হাহাকারধ্বনি বেজে ওঠে। কী সুন্দর সাজানো গ্রাম, গ্রামের সহজ-সরল মানুষগুলোর ছবির মতো জীবন, তার কিছুই আর অবশিষ্ট নেই। দাসপাড়ায় এখন প্রভাবশালীদের শখের বাগান এবং মাছের খামার গড়ে উঠেছে। দাসেরা সব কোথায় গেল? তারা জায়গাজমি বেচে গ্রামছাড়া, হয়তো বা দেশছাড়া হয়েছে। পঁচাত্তর-পরবর্তী সময়ে যারা ক্ষমতায় এসেছে তাদের সমর্থকরাই মূলত দাসদের ভিটামাটি নামমাত্র দামে কিনে নিয়েছে। ভূমিগ্রাসীদের মনোভাব ছিল যেন অনেকটা এমন :

পেলে দুই বিঘে, প্রস্তে ও দীঘে, সমান হইবে টানা। ও জমি দিতে হবে …

শফিভাইও দাসপাড়ায় একটি মাছের খামার করেছেন। তাঁর পরিচিত একজনই তাঁকে অনুরোধ করে তাঁর জমি কিনতে বাধ্য করেছেন। বলেছেন, দাদা, আপনি জমিটা নিলে ন্যায্য দামটা অন্তত পাবো। অন্য কেউ নিলে তো ঠকাবে।

জমি না বেচে তাঁকে এলাকায় থাকার কথা বলেছিলেন শফিভাই। জবাবে তিনি বলেছিলেন, আমি একা থেকে কী করবো? সবাই তো চলে যাচ্ছে। শেষে আমি মারা গেলে আমাকে দাহ করারও তো কেউ থাকবে না!

এসব দুঃখের কথা শুনে মনটা ভার হয়ে আসে। সত্যি, এক জীবনে কত কিছু দেখলাম, দেখছি। দেশের অনেক পরিবর্তন হয়েছে, হচ্ছে। জীবনযাত্রার মান উন্নত হয়েছে। হয়তো আরো হবে। কিন্তু জমিহারা দেশছাড়া মানুষের নীরব কান্না কি কেউ শুনতে পায়?

আমাদের বালিকাবেলার প্রমত্তা মেঘনা এবং ব্রহ্মপুত্র এখন শীর্ণকায়। নদী পারাপারের জন্য তৈরি হয়েছে একাধিক ব্রিজ। চলাচল, যাতায়াত সহজ ও সাশ্রয়ী হয়েছে। ক্ষীণতনু নদীর ওপর দিয়ে বাস, ট্রাক, ট্রেনসহ কত যানবাহন চলছে। কিন্তু এতো সব অগ্রগতি দেখেও আমার মনটা কেন উৎফুল্ল না হয়ে বিষণ্ন হয়ে ওঠে? এ কি জীবনসায়াহ্নে এসে দাঁড়ানোর ফল?

রবীন্দ্রনাথের বাণী বাজে কানে :

আর নাই রে বেলা, নামলো ছায়া ধরণীতে

এখন চলরে ঘাটে কলসখানি ভরে নিতে

জলধরার কলস্বরে

সন্ধ্যাগগন আকুল করে

ওরে, ডাকে আমায় পথের ’পরে সেই ধ্বনিতে। …

গত শতকের ষাটের দশকে ময়মনসিংহের সাংস্কৃতিক অঙ্গন বেশ উজ্জ্বলই ছিল। বিখ্যাত সংগীতশিল্পী মিতালী মুখার্জির জন্ম ও বেড়ে ওঠা ময়মনসিংহ শহরেই। মিতালীর বাবা অমূল্য মুখার্জি পুলিশ কর্মকর্তা হলেও সংগীতপ্রেমী মানুষ ছিলেন। মিতালীর মা কল্যাণী মুখার্জি একসময় বিভিন্ন অনুষ্ঠানে গান গেয়ে প্রশংসিত হয়েছিলেন। বিদ্যাময়ী স্কুলের ছাত্রী মিতালী ক্লাসিক্যাল সংগীতে তালিম নিয়েছেন ওস্তাদ মিথুন দে-র কাছে। ময়মনসিংহে ধ্রুপদী গানের বড় সাধক মিথুন দে-র কাছে আমিও গান শেখা শুরু করেছিলাম। কিন্তু আমি গানের ক্ষেত্রে সফল না হলেও ময়মনসিংহে গানের অনেক গুণী শিল্পী ছিলেন। প্রখ্যাত সংগীতশিল্পী আভা আলমও (দে) ময়মনসিংহেই বেড়ে উঠেছেন। তাঁর জন্ম মাদারীপুরে হলেও পরে ময়মনসিংহে স্থায়ী বসবাস শুরু করেন। তাঁর বাবা হরিপদ দে একজন সংগীতজ্ঞ ব্যক্তি ছিলেন। সংগীতবোদ্ধা তরীকুল আলমের সঙ্গে তিনি বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। আভা আর আমি প্রায় সমবয়সী। তবে আভা ১৯৭৬ সালে আমাদের ছেড়ে যান। তাঁরও সংগীতগুরু মিথুন দে। আলোকময় নাহা-সুমিতা নাহা দম্পতির কথা আগেই উল্লেখ করেছি। আলোকদা কমিউনিস্ট পার্টি করতেন। সুমিতাদির ছোটভাই সুবীর হোম রায়ও সংস্কৃতিমনা মানুষ। এখন কলকাতায় তাঁর বসবাস। পাকিস্তান আমলে রবীন্দ্রবিরোধিতার সময়েও ময়মনসিংহে রবীন্দ্রজয়ন্তী উদ্যাপিত হতো। খুব বড় পরিসরে না হলেও আলোচনা, গান, আবৃত্তির মাধ্যমে কবির প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর আয়োজন হতো। আমরাও সে-অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকতাম। রবীন্দ্রজয়ন্তী উদ্যাপনের মূল উদ্যোক্তা ছিলেন কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলার শিক্ষক নুরুল আনোয়ার; আমরা তাঁকে নুরুভাই বলতাম। ইতিহাসের শিক্ষক আমিনুল ইসলামও রবীন্দ্র-অনুরাগী মানুষ ছিলেন। নুরুভাইয়ের সঙ্গে থেকে অনুষ্ঠান আয়োজনে ভূমিকা রাখতেন।

Published :