রিজিয়া রহমানের আবে-রওয়াঁ জলরেখায় লেখা ইতিহাস

আমি বুড়িগঙ্গা। আমি চলমান এক আবে-রওয়াঁ। আমার বেদনার্ত বুক ঘেঁষে, জলের দেবী ভেনাসের মত উঠে দাঁড়িয়েছে আমার প্রায় চারশো বছরের প্রিয় সহচরী, আমার ঢাকা। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে আমার বুকে জড়িয়ে আছে তার মহার্ঘ সেই জলে ভাসা শাড়ি। জলে ভেসে থাকলে তাকে জলই মনে হয়, দেখা যায় না। বোঝা যায় না। এতো দীর্ঘ টানাপড়েনের সুদীর্ঘ সময়ের সৃষ্টি, পৃথিবী পাগল করা সেই আবে-রওয়াঁ। দেখেছেন এর পরতে পরতে আঁকা রয়েছে কত ছবি, কত ঘটনা আর কত মানুষের কাহিনী! প্রাচুর্য আর বঞ্চনার, মহত্ত্ব আর নিষ্ঠুরতার সাক্ষী – আমার এই ঢেউ তোলা বুক। স্বপে­র হাওয়ায় ওড়া মসলিনের ইতিহাসে ঢাকা আমার এই দেহ। প্রাচ্যের এক প্রাচীন সমৃদ্ধ রহস্যময়ী নগরীর জলে ভাসা প্রতিবিম্বটিকে আজও জড়িয়ে রেখেছি আমি। আমি এই নগরীর ইতিহাস।
(আবে-রওয়াঁ, পৃ ১২৮)

সমকালীন বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রতিনিধিত্বকারী লেখিকা রিজিয়া রহমানের আবে-রওয়াঁ উপন্যাসটি প্রাচ্য নগরী ঢাকার পত্তনপর্ব থেকে শুরু করে বিকাশ ও বিস্তারপর্বের একটি বিশেষ সময়কে ধারণ করেছে। ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন যুগের সভ্যতা বিকাশে নদী একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। আর সভ্যতার বিকাশ মানেই নগরপ্রতিষ্ঠা এবং বাণিজ্যের সূচনা। নগরপ্রতিষ্ঠা মানেই শাসন প্রতিষ্ঠা এবং আধিপত্য বিস্তারের প্রতিযোগিতা। সভ্যতাবিকাশ, নগরনির্মাণ, বাণিজ্যবিস্তার, শাসনপ্রতিষ্ঠা প্রভৃতি অনুষঙ্গ ঢাকা নগরীর পত্তন-প্রসারে উদ্দেশ্যমূলক অনুঘটক হিসেবে কাজ করেছে। আর সকল উদ্দেশ্য পূরণের সবচেয়ে বড় ভূমিকা যার সে হলো একটি নদী – বুড়িগঙ্গা। ঢাকা নগরী প্রতিষ্ঠার বহুপূর্ব থেকেই বুড়িগঙ্গার উৎপত্তি, তার প্রবহমানতা। বুড়িগঙ্গা যেন এক নারীর মতো, মমতাময়ী জননীর মতো ঢাকাকে তার সবুজ-শ্যামল ক্রোড়ে ধরে রেখেছে। আবার এই বুড়িগঙ্গা যেন ত্রিকালজ্ঞ তপস্বিনীর মতো মহাকালের এক নীরব সাক্ষী। সে দেখেছে ঢাকার জন্ম, তার বেড়ে ওঠা, তার সমৃদ্ধি, তার বঞ্চনা, তার মহত্ত্ব, তার নিষ্ঠুরতা, তার ভালোবাসা, তার হিংসা। কতবার রক্তাক্ত হয়েছে তার বুকের স্ফটিকস্বচ্ছ জলধারা। এই বুড়িগঙ্গাই যেন কথকঠাকুরের মতো একের পর এক গল্প বলে যায়। সেই গল্পের পরতে পরতে উঠে আসে ঢাকা নগরীর আদি ইতিহাস। মহাকালের শ্রোতারা উৎকর্ণ হয়ে শোনে সেই গল্প। লেখিকা রিজিয়া রহমানের আবে-রওয়াঁ উপন্যাসে এই বুড়িগঙ্গা যেন কথকঠাকুরের মতো ব্রতকথা বলা এক নারীচরিত্র।
বুড়িগঙ্গা প্রথমেই শোনায় তার জন্মবৃত্তান্ত। তার আসল নাম ছিল লক্ষ্যা – শীতলক্ষ্যা। ‘শ্যামল পলির বুকে আঁকাবাঁকা দেহের সুন্দরী নারীর মত – এক সুন্দরী যৌবনবতী নদী।’ (পৃ ৮) স্বর্গ থেকে ব্রহ্মপুত্র নেমে এলেন পৃথিবীতে। লক্ষ্যার রূপশ্রম্নতিতে যুগপৎ আকৃষ্ট এবং আসক্ত হলেন তিনি। তার কবল থেকে নিজেকে বাঁচাতে লক্ষ্যা এক বৃদ্ধ রমণীর ছদ্মবেশে আত্মগোপন করল। ‘যৌবনবতী সুন্দরী লক্ষ্যার রূপের জৌলুসে বুড়ি বেশের বুড়িগঙ্গা নামের আড়ালে লুকিয়ে পড়ল।’ (পৃ ৮) তবু লক্ষ্যা রেহাই পেল না ব্রহ্মপুত্রের কামনার উন্মাদনা থেকে। সেই থেকে শীতলক্ষ্যা হলো বুড়িগঙ্গা। এই বুড়িগঙ্গারই প্রতিবেশী ঢাকা। বুড়িগঙ্গার মুখেই শোনা যায় ঢাকার নামকরণের ইতিহাস। রাজা আদিশূর তার এক অত্ম:সত্ত্বা মহিষীকে ভ্রষ্টচরিত্রা সন্দেহে বনবাসে পাঠান। রাজার লোকেরা নৌকাযোগে সেই মহিষীকে বুড়িগঙ্গার তীরে ঢাকগাছে আচ্ছন্ন জনপ্রাণীহীন গভীর বনে ফেলে রেখে যায়। কোনো রকমে প্রাণধারণ করে সেই মহিষী এক পুত্রসমত্মানের জন্ম দিলেন। কিছুদিন পর আবার ফিরে এলো রাজার অনুচরেরা। ততদিনে রাজমহিষী পরলোকগতা। তারা শিশুপুত্রটিকে নিয়ে হাজির হলেন রাজা আদিশূরের সামনে। পুত্র পরিচিত হলেন ইতিহাসখ্যাত বল্লাল সেন নামে। কালপরিক্রমায় পরিপূর্ণ যুবক বল্লাল সেন একদিন রাজকীয় নৌবহর নিয়ে এসে নোঙর করলেন ঢাকগাছে আচ্ছন্ন বুড়িগঙ্গার তীরে। কূলে নেমে খুঁজে পেলেন তার মায়ের স্মৃতিচিহ্ন, পেলেন দৈবপ্রাপ্ত বিগ্রহ। বল্লাল সেনের আদেশে বনজঙ্গল কেটে পরিষ্কার করা হলো। মায়ের স্মৃতিরক্ষার্থে নির্মিত হলো মন্দির। সেই মন্দিরে প্রতিষ্ঠিত হলো প্রাপ্ত বিগ্রহটি। ‘ঢাকা পড়া ঈশ্বরীর নামে মন্দিরের নাম রাখা হলো ঢাকেশ্বরী।’ মন্দির প্রতিষ্ঠা করে রাজা বল্লাল সেন ফিরে গেলেন রাজধানীতে। কালের প্রবাহে মন্দির ক্রমে ঢাকা পড়ে গেল গভীর জঙ্গলে। তবু নামটা তার রইল। আশপাশের জনপদবাসী আর মাঝিমাল্লারা ওদিকে আঙুল তুলে বলতে শুরু করল, ‘ওই তো সেই মন্দির, ওখানেই আছে ঢাকা। লোকের মুখে মুখেই এই বনাচ্ছন্ন কূলের নাম হয়ে গেল ‘ঢাকা’। ঢাকেশ্বরীর ঢাকা।’
(পৃ ৯)
কালক্রমে এই ঢাকাই হয়ে ওঠে এক ‘ঐন্দ্রজালিক’ শহর। ধনলক্ষ্মীর আশীর্বাদও যেন বর্ষিত হয় তার ভাগ্যশিয়রে। নগর-তীরবর্তী লোকেরা সাগর সেচে মুক্তো তোলে, সবুজ মাঠগুলো ভরিয়ে তোলে কার্পাস তুলোর শুভ্রহাসিতে। গৃহের নারীরা কার্পাস তুলো দিয়ে সুতা তৈরি করে। আর সেই সুতা দিয়ে তাঁতিরা বোনে মসলিন শাড়ি। সাগরসেচা মুক্তা আর মসলিনের কেনাবেচায় সরগম হয়ে ওঠে নদীকন্যা সুবর্ণগ্রাম আর বায়ান্ন বাজার তেপান্ন গলির এই ঢাকা। যেন পাখির ডানায় এই মণিমুক্তো আর মসলিনের খবর ছড়িয়ে যায় পৃথিবীর এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্ত। বিভিন্ন দেশের বণিকেরা তাঁদের বাণিজ্যতরী নিয়ে এসে ভেড়ে এই বাণিজ্যকেন্দ্রে। বিভিন্ন দেশের বিচিত্রভাষী মানুষের ভাষা আর পদচারণায় মুখর হতে থাকে এই শহর। বাড়তে থাকে শহরের সীমানা। ‘এর সম্পদ প্রাচুর্যের জনশ্রম্নতিতে আকৃষ্ট হয় লুণ্ঠনকারী সম্পদলোভী অভিযানকারীরা। স্বর্ণহংসী হাতছানি দিয়ে ডেকে আনে মগ আর হার্মাদ জলদস্যুদের। যেন উড়ে আসে হিংস্র লোভী বাজ।’ (পৃ ১০) এক-এক করে রাজ্যশিকারিরা ছুটে আসতে থাকে এই নগরকে লক্ষ্য করে। আসে তুর্কি, পাঠান, মোগল, আসে আরাকানি, পর্তুগিজ। স্বাধীন মুসলমান সুলতানরা যখন ক্ষমতার দ্বন্দ্বে লিপ্ত, তখন দোর্দ-প্রতাপে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে বাংলার বারো ভূঁইয়ার দল। মোগলদের পরোয়ানা নিয়ে ঢাকায় আসেন মান সিংহ। তিনিও বেশিদিন অবস্থান করতে পারলেন না। সাগরের মোহনায় এসে আচম্বিতে নোঙর ফেলে পর্তুগিজ-হার্মাদদের বহর। দ্রম্নতগামী ছিপ নৌকো নিয়ে এসে ঢুকে পড়ে গ্রাম-গঞ্জ-হাট-বাজারে। পুড়িয়ে দেয় শান্ত সবুজ জনপদ। লাঞ্ছিত হয় কুলবধূরা। নির্যাতিত হয় মসলিনের কারিগররা। হরিণীর মতো আশ্রয় খোঁজে ভীতসন্ত্রস্ত মানুষ। সোনার বাংলা পুড়ে ছাই হয়। ‘দিল্লির মোগল সিংহাসনের কব্জাবন্দি সুবা-ই-বাঙ্গাল বুঝি হাতছাড়া হয়ে যায়। হাতছাড়া হয় বুঝি মণি-মুক্তো মসলিনের সম্ভার।’ (পৃ ১১) সুবাদার কাশিম খানকে সরিয়ে সুবা-বাংলায় এলেন মোগল সেনাপতি ইসলাম খান। তাঁর কাছে সুবা বাংলা ‘জান্নাত-উল-বেলাত’ – পৃথিবীর স্বর্গ। যে-কোনো মূল্যে একে কব্জা রাখতেই হবে। বুড়িগঙ্গার তীরে দাঁড়িয়ে ইসলাম খান ঘোষণা দিলেন, এই নদীর কিনারেই গড়ে উঠবে সুবা-বাংলার রাজধানী। হলোও তাই। রাজধানীর জৌলুস বাড়াতে একে একে মাথা তুলতে শুরু করল অট্টালিকা, মসজিদ, মন্দিরসহ বিভিন্ন স্থাপনা। গড়ে উঠতে থাকলো মহল, চক, রাজপথ, আশ্রম, কেল্লা। বসতি গড়ে উঠল স্পেনিয়ার্ড, গ্রিক, পর্তুগিজ, দিনেমার, ওলন্দাজ, আর্মেনি, ফরাসি, ইংরেজদের। গড়ে উঠল আফগানি, ইরানি, মোগল, তুর্কি, তাতার, তাজিক, উজবেক, আরব, চিন আর ব্রহ্ম দেশীয়দের নিয়ে বহুজাতিক এক সম্পন্নগোষ্ঠী। তৈরি হলো ক্যাথলিক চার্চ। ধর্মপ্রচারে এলেন জেসুইট পুরোহিত আর সুফি-দরবেশগণ। এই শহর ‘পাশ্চাত্যের জলোত্থিত ভেনিস নগরীর মতোই’ শরীরে মসলিন জড়িয়ে যেন নিজেকে সাজিয়েছে গ্রিক পুরাণের কোনো দেবীর মতো। এই দেবীর বেদি ছুঁয়ে বয়ে চলেছে বুড়িগঙ্গা। বুড়িগঙ্গায় ভাসছে তার শাড়ি, শাড়ির আঁচল। জলে ভেসে থাকলে সেই শাড়িকে জলই মনে হয়। ‘দেখা যায় না। বোঝা যায় না। এতো অনেক টানাপড়েনের সুদীর্ঘ সময়ের সুতোয় বোনা পৃথিবী পাগল করা আবে-রওয়াঁ। সুন্দরী সম্রাজ্ঞী নূরজাহানের প্রিয় আব-ই-রওয়ান। অর্থাৎ চলমান জল। … এর পরতে পরতে বোনা রয়েছে কত অসংখ্য মানুষের জীবন আর কাহিনী, কত ভাষার বিচিত্র কথা। … কালের ইতিহাস। মসলিনে জড়ানো ঢাকার কথা। … একের পর এক উল্টে যায় ঢেউয়ের পৃষ্ঠা। একটির পর একটি কাহিনীর মোড়ক খুলে যায় – এ তো কাহিনী নয়। অসংখ্য মানুষের জীবনের প্রতিদিনের সুতোয় বোনা আবে-রওয়াঁ …।’
(পৃ ১২)
আবে-রওয়াঁ উপন্যাসে মূল কাহিনির পাশাপাশি রয়েছে কতগুলো ভিন্ন আখ্যান। এগুলোকে আপাতদৃষ্টিতে বিচ্ছিন্ন মনে হতে পারে। কিন্তু একটু খেয়াল করলে দেখা যায় এই আখ্যানগুলো মূল আখ্যানের সমান্তরাল গতিতে এগিয়ে চলেছে এবং উপন্যাসের কাহিনিকে বেগবান করে এগিয়ে নিয়ে গেছে পরিণতির দিকে। কোনো কোনো আখ্যান রূপকের আধারে উপস্থাপন করে লেখিকা মুন্সিয়ানার পরিচয় দিয়েছেন। উপন্যাসের কেন্দ্রে আছে ঢাকার মসলিন শিল্প। এই শিল্পকে কেন্দ্র করেই এই নগর-বন্দরের খ্যাতি-অখ্যাতির পালাবদল। মসলিনের টানেই এখানে এসে নোঙর করেছে ভিনদেশি বাণিজ্যতরী। বণিকদের পাশাপাশি এসেছেন ভিনদেশি শাসক-সেনাপতি-যোদ্ধা। শুরু হয়েছে আধিপত্য বিস্তারের নগ্ন নির্মম প্রতিযোগিতা। আবার দূর-মুলুক থেকে এখানে এসেছে ভাগ্যশিকারি সাধারণ শ্রমজীবী মানুষও। ঢাকার ভূমিপুত্রদের আধিপত্যকে ক্ষুণ্ণ করে উড়ে এসে জুড়ে বসেছে তারা। মোগল শাসনামলেই এদের আগমন ঘটে ব্যাপক হারে। ইতিহাসের এই সময়টিকে ঢাকার স্বর্ণযুগও বলা যেতে পারে। সব মিলিয়ে আবে-রওয়াঁ উপন্যাসের আখ্যান বিন্যাসকে কয়েকটি পর্বে ভাগ করা যেতে পারে। বিন্যস্ত আখ্যানের সামগ্রিক রূপটিই উপন্যাসের পূর্ণাঙ্গ কাঠামো।

মসলিন পর্ব
মোগল আমলে যে-পণ্যের জন্য ঢাকার খ্যাতির বিস্তার ঘটেছিল, তা মসলিন শাড়ি। এই শাড়ি বোনার পূর্বে কার্পাস তুলা থেকে সূক্ষ্ম সুতা তৈরি করতে হয়। এই সুতা কাটে মূলত মহিলারা এবং তারা কাটুনি বা সুতাকাটুনি নামে পরিচিত। ঢাকার উপকণ্ঠে আলাবালি গ্রামটিতে মূলত এই কাটুনি বা তাঁতিদের বাস। রাত না পোহাতেই টিকারার শব্দে জেগে উঠে কাটুনিরা দলবেঁধে সুতা কাটতে যায়। গাঙের পাড় ধরে তারা চলে সুতার কারবারি নিত্যপ্রসাদের গুদামে। কাটুনিদের একজন প্রতিনিধি সখিনা, এককালে বিখ্যাত মসলিন কারিগর হাতেম আলীর কন্যা। হাতেম আলী শবনম, আবে-রওয়াঁ, কাসিদা, মখমলখাস প্রভৃতি মসলিন বুনতে বুনতে এখন অন্ধ। তবু দু-চারজন পুরনো কারিগর আসে তার সঙ্গে দেখা করতে। হাতেম স্মৃতির ঝাঁপি খুলে বসে। সেই কবে কোন আরবীয় বণিক এসেছিল তার বাড়িতে। ঘরের দাওয়ায় চাটাই পেতে নামাজ পড়েছিল। হাতেমের বোনা কাসিদা নৌকো বোঝাই করে কিনে নিয়েছিল। কাপড়ের দাম ছাড়াও হাতেমকে সে পাঁচটি সোনার মোহর উপহার দিয়েছিল। সেই হাতেমের মেয়ে সখিনার সুতা কাটার দক্ষতা এবং উপার্জনের চমকে ঈর্ষান্বিত অন্য কাটুনিরা। সুবাদার শায়েস্তা খানের হুকুমে শাহি তাঁতখানা বসানো হচ্ছে ঢাকা শহরে – সেখানে কাজ করার সুযোগ পাচ্ছে সখিনা। নিত্যপ্রসাদই এইসব ব্যবস্থা করে এসেছে। শাহি তাঁতখানার তৈরি মসলিন কেনাবেচা হবে ঢাকার মোকামে। ঢাকার অনেক খবরই রাখে হাতেম। সুবা-বাংলার রাজধানী ঢাকা বিজয়ে এসে ইসলাম খান সীমানা নির্ধারণের জন্য ঢাকিদের নির্দেশ দিয়েছিলেন ঢাক বাজাতে। আর ঘোড়সওয়ার সিপাহিরা ঘোড়া ছুটিয়ে গিয়েছিল চারিদিকে। ঢাকের শব্দ যতদূর পর্যন্ত শোনা গেল ততদূর বিসত্মৃত হলো ঢাকার সীমানা। তারপর ইসলাম খান তাঁবু গাড়লেন। ক্রমে তৈরি হলো দালানকোঠা-ঘরবাড়ি-সেনাছাউনি। শহরের প্রান্তসীমায় বসল নজরদারি পাহারা। দিল্লির বাদশাহর নামানুসারে ঢাকার নাম হলো জাহাঙ্গীরনগর।
মসলিনের সুতাকাটুনি তাঁতিরা একসময় হিন্দু ছিল। তারপর অনেকে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে। সখিনাদের ব্যাপারটিও তাই। সখিনার নাম ছিল রাধারানী। সখিনার দাদামশাই ছিলেন গোঁড়া হিন্দু। আট বছর বয়সে রাধারানীর বিয়ে দিয়েছিলেন তিনি। পরের বছরই বিধবা হলো সে। স্বামীর চিতার আগুনে পুড়িয়ে তাকে যখন ‘সতী’ করার আয়োজন চলছিল, তখন রাধারানীকে লুকিয়ে নিয়ে এলেন দাদামশাই। এক আরব বণিকের জাহাজে এসেছিলেন এক দরবেশ। তার কাছে কলেমা পড়ে মুসলমান হয়ে গেল রাধারানীদের পরিবার। রাধারানীর নাম হলো সখিনা। এখন সে আলাবালি গ্রামের সবচেয়ে নামি ও দামি সুতাকাটুনি।
সখিনারা একদিন শুনতে পায়, নওরোজের দিন নবাবজাদি পরীবিবির মহলে এক মিনাবাজারের আয়োজন করা হয়েছে। সেখানে ‘দিনে হবে মসলিনের কেনাবেচা, রাতে খেইল-তামাশা নাচ-গান আর জাদু।’ টিকারা বাজিয়েরা জানিয়ে দেয় যে, এই মিনাবাজারে ভিনদেশি সওদাগররাও ঢোকার অনুমতি পাবেন, ইচ্ছেমফিক কেনাবেচাও করতে পারবেন। যাদের ঘাম-রক্তে সিক্ত হয়ে মসলিনের সুতা সূক্ষ্ম ও সুনিপুণ হয় তাদের কথা নবাব জানেন না। আলাবালি গ্রামের এই মসলিন-শিল্পীরা কীভাবে বঞ্চনার শিকার হয় তা মসলিনের জমিনে লেখা থাকলেও সকলের দৃষ্টিগোচর হয় না। মসলিন-সুতোর জোগানদার সত্যপ্রসাদ এবং তার ছেলে নিত্যপ্রসাদ সুতাকাটুনিদের ন্যায্য পাওনা থেকে বঞ্চিত করে। ক্রমাগত এই বঞ্চনা কাটুনিদের মুখে ভাষা জোগায়। একদিন কমলা নামে এক কাটুনি মজুরি কম দেওয়ার দায়ে নিত্যপ্রসাদকে অভিযুক্ত করে। কথাকাটাকাটির একপর্যায়ে নিত্যপ্রসাদ কমলাকে খানিকটা ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ করে কাজ থেকে ছাড়িয়ে দেওয়ার হুমকি দেয়। তাতে অবশ্য দমে না কমলা। অন্য কাটুনিরাও কমলার পক্ষ নেয়। চতুর ব্যবসায়ী নিত্যপ্রসাদ জানে আলাবালির কাটুনিরাই মসলিনের সেরা কাটুনি। তারা হাতছাড়া হয়ে গেলে ব্যবসার সমূহ সর্বনাশ। গলার স্বর নরম করে পালিশ দেওয়ার চেষ্টা করে সে, ‘গঞ্জে, আড়ঙে আমার সুতার কদর ক্যান, আমার সুতায় বুনা বেগমখাস আবে-রওয়াঁ ছাড়া বাদশাহর বেগমেরা অন্য কাপড় পছন্দ করে না ক্যান, কও তোমরা। সবই আমার কাটুনিগে গুণে …।’ পরিস্থিতি একটু স্বাভাবিক হবার পরই হঠাৎ দুর্গাদাসী নামের এক কাটুনি গলা চড়ায় –
সারাটা বচ্ছর চক্ষু খাইয়া সুতা কাটি, কয়ডা পয়সা আমরা পাই? আমাগো সুতার বুনা কাপড় কত আমির-উমরাহ, বাদশা-বেগম ফিন্দে। কত সওদাগরেরা জাহাজ ভইরা কিনা নিয়া যায়। আমরা কয়ডা দামড়িই বা পাই? একটা সিক্কা টাকা কামাই করতে দিন, মাস, বছর যায়। আঙুলের মাথা খইসা যায়, চক্ষু আন্ধা হয়, বয়স গ্যালে ভিক্ষা কইরা খাই।
(পৃ ৪২)
আরেক কাটুনি কথা বলে ওঠে, ‘ভাল দাম না পাইলে ভাল সুতা ক্যামনে কাটি। ঘরের পাতিলে ভাত, তয় না চলে হাত।’ (পৃ ৪২) কাটুনিদের যে পয়সা কম দেওয়া হয় সেটা নিত্যপ্রসাদের চেয়ে ভালো আর কে জানে! এতকাল কাটুনিরা মাথা নিচু করে নিঃশব্দে বিনা প্রতিবাদে এই মজুরিতেই সুতা কেটে এসেছে। এখন দিনকাল বদলে গেছে। আর ‘যাবে না কেন, যেভাবে মসলিনের চাহিদা বাড়ছে, জমজমাট ব্যবসা জমে উঠছে – আর শাহিনগরের খবর এসে পৌঁছেছে, চিরদিনের নিঃশব্দ কাটুনিরাও চালাক-চতুর হয়ে উঠছে।’ (পৃ ৪২) ধুরন্ধর ব্যবসায়ী নিত্যপ্রসাদ কাটুনিদের চোখের সামনে স্বপ্নের পট মেলে ধরে।
কাটুনিরা, দুঃখ মনে আনিস না। দেখতে আছস না, দ্যাশে অহন শামিত্ম। হার্মাদের ডর নাই। নবাব শায়েস্তা খান হইলেন শামিত্মর অবতার। তাইতো শাহি নেকনজর অহন মসলিনের উপরেই। চাইলের দর নামতাছে, তুলার ফলন ভাল, আর মসলিন কাপড়ের দর বাড়তাছে ধাধাইয়া। অহন খুশি মনে সুতা কাটবি, দিন ফিরব। বাড়িতে সোনার দালান উঠাবি।
(পৃ ৪২)
দূরদিগমেত্মর এক স্বপণঘোরে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে কাটুনিরা। তারা চুপসে যায়। সখিনা যে শাহি তাঁতখানার কাটুনি হতে যাচ্ছে এটা অন্যদের ঈর্ষার কারণ। আজকের বচসায় সে যোগ দেয়নি। কাজ সেরে বাড়ির পথে যেতে যেতে হরিসুন্দরী তার পিছু নেয়। অভাবী সংসারের কথা পাড়ে। তাকে স্বপ্ন দেখায় সখিনা। সখিনার কণ্ঠে যেন নিত্যপ্রসাদের সুর শুনতে পায় হরিসুন্দরী। তবে কি সত্যিই সুদিন অপেক্ষা করছে তাদের জন্য? সখিনা রসিকতা করে বলে, ‘আমরা হইলাম সুতার পরী। পরীর লেবাস বুনি, পরীর খেয়াবে থাকি। পরী গো তো কোনো দুঃখ থাকে না। থাকে রে?’
(পৃ ৪৩)
পরীর খোয়াবে থাকা সখিনার ভাগ্যে নেমে আসে এক ঘোর অমানিশা। কাটুনির কাজ শেষ করে একদিন সে একাকী ইচ্ছামতির পাড় ধরে বাড়ি ফিরছিল। নদীর পাড়ের কার্পাস ক্ষেতে সোনালি রোদের ঝলক দেখে সখিনার মনে হচ্ছিল, ‘সকালের রোদ মাখা কার্পাস ক্ষেত নয়, যেন মা-ই সবুজ শাড়ি পরে দাঁড়িয়ে আছে।’ (পৃ ৮৪) ইথারে সে মায়ের কণ্ঠস্বর শুনতে পাচ্ছিল। মা যেন তাকে আলাবালি গ্রাম ছেড়ে নগরীর শাহি তাঁতখানায় যেতে নিষেধ করে। আনমনে হাঁটছিল সখিনা। হঠাৎ যমদূতের মতো সামনে এসে দাঁড়ায় অচেনা দুজন মানুষ। জমিদার দেওয়ানের পাইক এরা। তুলার ফসল উঠলেই প্রতিবছর এরা আসে খাজনা তুলতে। এবারো এসেছে। একজন সখিনাকে ধমক দিয়ে বলে, ‘কেরে তুই? এত বড় সাহস। নজরানা না দিয়ে দেওয়ান হুজুরের বহরের সামনে দিয়া হাঁইটা যাস? ফালা নজরানা ফালা, স্যালামি দে।’ (পৃ ৮৪) আরেক পাইক জানতে চায় সখিনা হিন্দু না মুসলমান। যখন জানলো যে সখিনা মুসলমান তখন তাকে বেপর্দা, বেশরম বলে ধমক দেয়। বেপর্দা হওয়ার শাস্তি হিসেবে তারা ‘দুইখানা কাসিদা আর এক সিককা নগদ টাকা, অনাদায়ে নায়েবের বজরায় সাতদিনের বাঁদিগিরি’ জরিমানা করে। পাইকদের পায়ে ধরে ক্ষমা চাইলেও মাফ পায় না সখিনা। দুজন পাইক সখিনাকে পাহারা দিয়ে নিয়ে যায় তার বাড়িতে। পথে দেখা হয়ে যায় সখিনার মনিব নিত্যপ্রসাদ-সত্যপ্রসাদের সঙ্গে। পুরো ঘটনা তারা অবগত হয়। তারপর কৌশলী নিত্যপ্রসাদ সখিনার পক্ষ নিয়ে করজোড়ে বলে।
হুজুরেরা। আপনেরা তো আমাগো এই দ্যাশেরই মানুষ। আপনেগো ঘরেও মাইয়া বউ আছে। বিদেশী এই নবাব দেওয়ানের খাজনা দিতে না পারলে কি আমাগো মাইয়া বউ তাগো হাতে তুইলা দিবেন। (পৃ ৮৬)
পাইকরা দেওয়ানের আজ্ঞাবাহী দাসমাত্র। দেওয়ান আবার জমিদারের গোলাম। জমিদাররা তটস্থ হয়ে আছে শায়েস্তা খানের ভয়ে। বৃহৎ এক চক্রব্যূহ। নিত্যপ্রসাদ যখন জানালো যে, সখিনা নবাবের মখমলখানার চুক্তিবদ্ধ কাটুনি তখন নরম হলো পাইক দুজন। খানিকটা ভয়ও পেল তারা। সখিনাকে ছেড়ে দিয়ে তারা নিত্যপ্রসাদকে জামিনদার করে দেওয়ানের নৌকায় নিয়ে গেল। সুতাকাটুনি কমলা এসে সখিনার পাশে দাঁড়ায়। প্রথমে ধমক তারপর সান্তবনা দিয়ে বলে, ‘জানিস না জমিদারের দেওয়ান হইল রাক্ষস। বোয়াল মাছের মত হা কইরা থাকে।’ (পৃ ৮৭) ঘরে ফেরার কথা বললে সখিনা জবাব দেয়, ‘কই যামুরে কমলা? এমুন দুখের কপাল নিয়া ক্যান জন্ম হইছিল। মান নাই, ইজ্জত নাই, প্যাটের ভাতের চিমত্মায় রাইত কাটে, দিনে মসলিনের সুতা কাইটা চক্ষু আন্ধার হয় …’
(পৃ ৮৭)
পাড়ার লোকের মুখে মুখে দুঃসংবাদটি হাতেম আলীর কানেও পৌঁছে যায়। সখিনা বাড়ি ফিরলে হাতেম কাছে ডেকে সান্তবনা দেয়। নবাবের দরবারে গিয়ে নালিশ করার প্রত্যয় ব্যক্ত করে। কিন্তু অন্ধ হাতেম আলীর কথা আজ যে কেউ শুনবে না। তার ওস্তাগিরি এখন রূপকথা মাত্র। একসময় সখিনাও বিশ্বাস করত মসলিনের নামকরা কারিগর তার বাবা সম্ভ্রান্ত সম্মানিত মানুষ। তারপর জীবনের ঘাত-প্রতিঘাতে বুঝতে শিখল মসলিনের মর্যাদা থাকলেও তার কারিগরদের কোনো মূল্য থাকে না। দেওয়ানের শাস্তি আর জরিমানার ভয়ে শঙ্কিত সখিনা বাবাকে বলে এই গ্রাম ছেড়ে অন্য কোথাও চলে যেতে। স্থিরপ্রতিজ্ঞ হাতেম আলী মেয়েকে শান্ত হতে বলে। অশান্ত অস্থির হলে হাতও শক্ত হয়ে যায়, সূক্ষ্মতর সুতা বোনা যায় না। সখিনার একটি হাত শক্ত করে চেপে ধরে হাতেম বলে –
এই আলাবালি ছাইড়া অহন কুনখানে যামু না আমরা। কত কীই তো দ্যাখলাম। সোনারগাঁয়ের সুলতানে গো রবদপ, পাঠান খানে গো তলোয়ার ঘুরানি, মগ হার্মাদের জুলুম। কত কী। শুইনা রাখ জুলুমবাজেরা টিকা থাকে না চিরকাল, থাকি আমরা। থাকুম আমরাই, উঠ। মনে সাহস কর। মনে রাইখো তুমি মসলিনের সুতাকাটুনি, তুমি সুতা না কাটলে আবে-রওয়াঁ, বেগমখাস, মখমল আর পাখা মেইলা দিব না। ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ হইব। নবাব-বাদশাহগো খাজাঞ্চিখানায় সোনার মোহর ঝলকাইব না।
(পৃ ৮৯)
সখিনার এক সিক্কা জরিমানার টাকা নিত্যপ্রসাদই পরিশোধ করে দেয়। খবরটি প্রশামিত্মর পরশ বুলিয়ে দেয় হাতেমের দেহমনে। এখন দুটি কাসিদা বাকি। তা ধীরে-সুস্থে বুনে দিলেও চলবে। সখিনার মন থেকেও ভয়ের মেঘ অনেকখানি সরে যায়। সে বলে –
আমি তোমারে সুতা কাইটা দিমু বাবা। তুমি ঘরে বইসা কাসিদা বুনাইবা। দেওয়ান, জমিদার, জায়গিরদার, নবাব বেগম কারোরেই আর ডরাই না। আমরা আলাবালির মানুষ। মসলিনের কারিগর।
(পৃ ৮৯)
কিছুটা স্বস্তি ফিরে এলেও মাঝে মধ্যেই দুঃস্বপ্নেরা এসে তাড়া করে সখিনাকে। শিয়াল খাটাশের শব্দে তার ঘুম ভেঙে যায়। নিজেকে সাহস দেওয়ার চেষ্টা করে সে। কিন্তু সাহসটা যেন টেকসই হয় না। ‘বাঁশঝাড়ে ঝড়ো বাতাসের শব্দ একটার পর একটা ভয় ছুঁড়ে দিতে থাকে। জরিমানার ভয়, নায়েবের বাঁদি হওয়ার ভয়, মহাজনের কাছে ভিটা বন্ধক পড়ার ভয়, আর আলাবালির সেরা কাটুনির সুনাম হারানোর ভয়।’ (পৃ ১০৫) একদিন সকালে নিত্যপ্রসাদ আসে দারুণ এক সুখবর নিয়ে। আশ্বিন মাসে ঢাকায় এক বিরাট মেলা বসবে। সেখানে
আবে-রওয়াঁ, বেগমখাস, শবনমের কেনাবেচা হবে। আর সেইসব শাড়ি বুনবে হাতেম আলী আর সুতা কাটবে সখিনা। শাহি তাঁতখানার দারোগা এসে একদিন বায়না করে যায় সখিনাদের। নায়েবের পাইক এসে সখিনার জরিমানা মওকুফ করে দিয়ে যায়। খুশির চাঁদ ওঠে সখিনাদের আকাশে। সেদিন নিত্যপ্রসাদকে কাছে পেয়ে হাতেমের পুরনো স্মৃতিগুলো বাঙ্ময় হয়ে ওঠে কথার তোড়ে। সুবাদার ইব্রাহিম খান তখন শাহি তাঁতখানা বসিয়েছিলেন ঢাকায়। সম্রাট জাহাঙ্গীরের বেগম নূরজাহানের হুকুমে শুরু হয় কারিগরদের মসলিন বোনার কাজ। আবে-রওয়াঁ ছিল বেগমের খুব প্রিয় পোশাক। একবার জাহাঙ্গীরের সঙ্গে দিল্লি থেকে ঢাকায় এলেন নূরজাহান। দিগন্তপস্নাবী দুধসাদা জোছনার আলোতে বসে হাতেম স্বপ্নসুতায় বুনে চলে গল্পের আবে-রওয়াঁ। তাঁতখানা পরিদর্শনে এসে নূরজাহান নজর দিলেন হাতেমের বোনা মসলিনে, চাঁপাকলি আঙুলে তা ছুঁয়ে দেখলেন। এসব গল্প এখন আর সখিনাকে উচ্ছ্বসিত করে না। বরং মায়ের কাছে শোনা চাঁদের মা বুড়ির গল্পটি তাকে এক দূরলোকে ভাসিয়ে নিয়ে যায়। সেই কোন এক দূরঅতীতে বাতাস এক মেয়ের তুলো উড়িয়ে নিয়ে গিয়েছিল। বাতাসের সঙ্গে ছুটতে ছুটতে সে চাঁদের মায়ের কাছে গিয়ে বলেছিল যে, সে আর তার মা চরকায় সুতা কাটে, কাপড় বোনে, তাই দিয়েই তাদের সংসার চলে। চাঁদের মা বাতাসকে দিয়ে তুলো উড়িয়ে এনেছে। এখন কীভাবে তারা কাপড় বুনবে, আহার জোগাবে। মেয়েটির দুঃখের কান্না শুনে চাঁদের মা তাকে শিখিয়ে দিলো পরীরা যে শাড়ি বোনে তা বোনার কৌশল। ‘সে কাপড় সাদা মেঘের মত কোমল, কুয়াশার মত নরম, পাখির পালকের মত হালকা আর সূর্যের আলোর মত স্বচ্ছ। চাঁদের মা তাকে শিখিয়ে দিল মাকড়সার জালের মত হালকা সূক্ষ্ম সুতো কাটার নিয়ম। বলল – এই সুতোয় যে কাপড় বুনবি, সে কাপড়ের নাম পরীর পোশাক, জলে ভাসিয়ে দিলে জল হয়ে ভেসে যায়, দূর্বাঘাসে রাখলে মিশে যায় দূর্বায়।’ (পৃ ১০৮) চাঁদের মা তাকে সবটুকু তুলো ফেরত দেয় না। কিছুটা রেখে দেয়। তাই দিয়ে সে সুতা কাটে আর পরীর কাপড় বোনে। পূর্ণিমা রাতে সেই কাপড় মেঘ হয়ে ভাসে আকাশে। চাঁদের মা মেয়েটিকে সেই সাদা মেঘ দেখে কাপড় বুনতে বলে। তাতেই তাদের কপাল ফিরে যায়। সখিনার মা বলত, চাঁদের মা আকাশে বসে সেরা কাটুনিদের ওপর নজর রাখে। হয়তো সেই নজর পড়েছে সখিনার ওপর। তাই সে শাহি তাঁতখানার কাটুনি হতে চলেছে।
চমৎকার এক আনন্দঘন স্বপ্ন দুলতে থাকে সখিনার চোখে। পরম মমতায় সে সুতা কাটে। অন্ধপ্রায় হাতেম সেই সুতায় বোনে আশ্চর্য নকশাদার আবে-রওয়াঁ। ‘সে নকশায় ফুটে উঠেছে সেই দুখিনী কাটুনির কথা। যাকে চাঁদের মা শিখিয়েছিল পরীর পোশাকের সুতো কাটতে, পরীর পোশাক বুনতে।’ (পৃ ১২৫) বুঝি পরী হওয়ারই স্বপ্ন দেখে সখিনা। হঠাৎ একদিন ঝড় উঠল – আশ্বিনের ঝড়। সেই তা-বে সখিনাদের ভেতর-বার সব ল-ভ- হয়ে গেল। শিকারি বাজের মতো এসে হামলে পড়ল নবাবের মখমলখানার দারোগার লোকেরা। হাতেমের বোনা কাপড়গুলো বিনামূল্যে ছোঁ মেরে নিয়ে গেল। বিক্রির পরে টাকা পাওয়া যাবে। ঝড়ের বেগ তীব্র হয়। শাহিশহরের দ্বার রুদ্ধ হয়ে যায়। সর্বগ্রাসী ক্ষুধার্ত জলরাশি তার লকলকে জিহবা বের করে ধেয়ে আসে জলোচ্ছ্বাসের গতিতে। অন্ধ হাতেম তখনো বালকপুত্র মালেককে কাছে বসিয়ে গল্প বলে চলে – পরীর গল্প, চাঁদের মায়ের গল্প, নূরজাহান বেগমের গল্প। ঝড়ের বেগ বুবি বা সে আঁচ করতে পারে না। গান ধরে হাতেম –
জলেতে ভাসাইয়া দিলে
জলে মিশা যায়
আকাশে উড়াইয়া দিলে
হাওয়ায় মিলায় …
ঝড়ের বিপরীতে দাঁড়িয়ে সখিনা পুরনো প্যাটরা খুলে বের করে আনে হাতেমের পরমযত্নে বোনা আশ্চর্যসুন্দর আবে-রওয়াঁ। মেলে ধরে হাতেমের সামনে। আবে-রওয়াঁর জমিনে খুঁজে পেতে চায় নিজের অস্তিত্ব। তখনই দমকা বাতাসে সখিনাদের ঘরের আলো নিভে যায়, খুঁটি ভেঙে পড়ে, চাল উড়ে যায়। হাতে ধরে থাকা আবে-রওয়াঁ যেন পরীর ডানা হয়ে বাতাসে উড়তে থাকে। উড়তে থাকে সখিনাও। বিক্ষুব্ধ ঝড়ের গর্জন আর ধূসর বৃষ্টির অন্ধকারে চাপা পড়ে যায় সখিনার আর্তচিৎকার।
আবে-রওয়াঁ, আমার আবে-রওয়াঁ, আমার জলে ভাসা শাড়ি, তুমি উইড়া যাইও না, ভাইসা যাইও না, তোমারে ছাড়া ক্যামনে বাঁচি …। (পৃ ১২৬)

লড়াইপর্ব
মসলিন-নগরী হিসেবে খ্যাতি লাভের পর দেশ-বিদেশের বণিকদের পাশাপাশি ঢাকায় আসে ভাগ্যশিকারি সাধারণ মানুষ। ভাগ্য ফেরানোর জন্য লড়াই করতে চায় নিয়তির বিরুদ্ধে। এদেরই একজন আজিজ বোখারী। নিজের জবানিতে সে বলে, ‘আমি হিন্দুস্থানে এসেছি আমির হতে, ফকির হতে নয়।’ (পৃ ৩৬) সে ঢাকার কুট্টিয়াপাড়ার বাসিন্দা। পেশা তার মোরগের লড়াই দেখানো। ছেলে সুলতান বাবার এই খেলার একজন সহকারী। একসময় আজিজ বোখারীর ব্যবসায় ভাটা পড়ে। মোরগের লড়াই যেন মানুষ আর দেখতে চায় না। শহরে নতুন এক খেলোয়াড় এসেছে। বিশালাকৃতির দুটো বাঘ নিয়ে পাড়ায় পাড়ায় সে খেলা দেখিয়ে বেড়ায়। তাছাড়া হোসনি দালানের সামনে কবুতরের লড়াই দেখতেও মানুষের ভিড় লেগে যায়। ‘এ শহর তো এখন লড়াইয়ের শহর হয়ে দাঁড়িয়েছে।’
(পৃ ৯০) আজিজ বোখারীর মনে পড়ে, আগে ঈদের মেলায় মোষের লড়াই, কুকুরের লড়াইও হতো। ‘এখন সারা বছর পথে পথে নানারকম লড়াইয়ের খেলা চলছে।’ (পৃ ৯০) মহররমের মিছিলে জঙ্গি লড়াকু হাতি নামানোর খবরও হাওয়ায় ভাসছে। ‘হাতি, ঘোড়া, শের, বান্দর সব কিছুই এখন লড়াকু হয়ে গেছে। এরপর দেখতে হবে মানুষের লড়াই।’ (পৃ ৯০) মোরগগুলো মূলত আজিজের মতোই সমাজের সাধারণ মানুষের প্রতিনিধি। সভ্যতার সূচনায় যাদের ভূমিকা থাকে, পরবর্তী প্রতিযোগিতায় তারা আর টিকতে পারে না। যেমন মোরগগুলো টিকতে পারে না হাতি-ঘোড়া-বাঘের সঙ্গে লড়াইয়ে প্রতিযোগিতা করে। প্রথমে লড়াই চলে মোরগে মোরগে। তারপর বাঘে বাঘে। সাধারণ মানুষের লড়াই পর্যবসিত হয় রাজা-বাদশাহর লড়াইতে, তাদের কূটকৌশলে। আবার তাদের বিরুদ্ধে এসে অবতীর্ণ হয় ভিনদেশি যোদ্ধারা। ঘরের লড়াই ছড়িয়ে পড়ে বাইরে। আজিজ বোখারীদের কিছুই করার থাকে না। তাদের লড়াই কারো মনোযোগ কাড়ে না যখন লড়াই হয় রাজায়-রাজায়। তবু আজিজ বোখারীদের লড়াই চালিয়ে যেতে হয়। আমির হওয়ার কত আশা নিয়ে সে হিন্দুস্থানে এসেছিল। আজিজের স্ত্রীর ‘খায়েশ ছিল ধনী আমিরের স্ত্রী হয়ে দিল্লির খানদানি আওরতদের মত দামি মসলিন পরবে। সোনার অলংকারে ঝলমল করবে, বান্দি-গোলাম খাটাবে। দেউড়িতে বাধা থাকবে হাতি-ঘোড়া।’ (পৃ ৯১) রুটির আটা মাখতে মাখতে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে সে। জীবিকার সংগ্রামে থেমে থাকে না আজিজ-পুত্র সুলতানও। এক ঘাট সর্দারের গানের দলে যোগ দেয় সে। সুলতান একদিন নজরে পড়ে যায় নবাবজাদা বুজুর্গ খানের। সুলতানকে তার চাই-ই চাই। একদিন বুজুর্গ খানের বন্ধু বুরহান শাহ এসে সুলতানকে নিয়ে যায় বুজুর্গ খানের কাছে। মোটা বেতনে সুলতানের এক অদ্ভুত চাকরি মেলে। এই চাকরিটিই তার কাল হলো। এটি যে আসলে গুপ্তচরবৃত্তি তা বোঝার সাধ্য ছিল না সুলতানের। একদিন ধরা পড়ে সে। চিহ্নিত হয় গুপ্তচর হিসেবে। বধ্যভূমিতে নেওয়ার সময় সে কাকুতি-মিনতি করে, ‘আমাকে কতল কোরো না, আমার কোনো দোষ নেই, বুরহান শাহ আমাকে নিয়েছিল, আমরা খুব গরিব। আমাকে ছেড়ে দাও, আমি শাহি মহলে নকরি করব না, বাবার সঙ্গে এই শহরে মোরগের লড়াই দেখাব … আমার বাবা আজিজ বোখারী এ দেশে আমির হতে এসেছিল, আমাদের কোনো দোষ নেই।’ (পৃ ১২০) ভাগ্য ফেরানোর লড়াইয়ে হেরে যায় বোখারী পরিবার।

বাণিজ্যপর্ব
মসলিনের শহর ঢাকা শুরু থেকেই ভিনদেশি বণিকদের আকৃষ্ট করেছে তার বাণিজ্যের ঐশ্বর্যে। এখানে বাণিজ্য করতে এসেছে ডাচ, ফরাসি, আর্মেনিয়ান, ইরানি, পর্তুগিজ, ফিরিঙ্গি, ইংরেজ প্রভৃতি সওদাগর। মোগল শাসনামলই মূলত ঢাকার সোনালি অধ্যায়। এই সময়ই ফরাসি বণিক চার্ল আর আন্দ্রে চন্দননগর হয়ে ঢাকায় আসেন ফরাসি পণ্যে জাহাজ বোঝাই করে। চার্লের এই প্রথম বঙ্গ মুলুকে আগমন। সেই অর্থে আন্দ্রে পুরনো মানুষ। এখনকার মানুষের রীতিনীতি চরিত্রবৈশিষ্ট্য সম্পর্কে সে সম্যক ওয়াকিবহাল। আন্দ্রের সুপারিশেই চার্ল এদেশে বাণিজ্য করার সুযোগ পেয়েছে। ঘাটে ঘাটে মোগল চৌকির পাহারা মোকাবেলা করে চার্লের বাণিজ্যতরী ঢাকায় এসে নোঙর করে। ধুতি-ফতুয়া পরা এদেশীয় মুহুরিরা এসে তাদের অভিবাদন জানায়। এ-বছর এখানে কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ হয়নি। ফলে কার্পাসের ফলনও খুব ভালো হয়েছে। কার্পাসের ফলন ভালো মানেই মসলিনের রমরমা। মুহুরি খবর দেয়, তাদের ব্যবসা এখানে ভালোই চলছে তবে ইংরেজরা ভালো ফড়িয়াদের হাত করে নিয়েছে। ইংরেজদের গুদাম তৈরি হচ্ছে নিমতলিতে। সুবাদারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার সূত্রে তারা নাকি বাণিজ্য শুল্কও মওকুফ করিয়ে নেওয়ার তদবির চালাচ্ছে।
দিন কয়েক পরে আন্দ্রেকে সঙ্গে নিয়ে চার্ল বের হয় বাজার প্রদক্ষিণে। আন্দ্রে তাকে পরামর্শ দেয় ব্যবসা শুরুর পূর্বে বাজার যাচাই করে নিতে। একজন গ্রিক ও দুজন ওলন্দাজ নাবিকের সঙ্গে আলাপ হয় চার্লের। ওরা জমিয়ে ব্যবসা করছে। স্পেনিয়ার্ড ও পর্তুগিজদের ব্যাপক আনাগোনা চোখে পড়ে চার্লের। নগর ঘুরতে ঘুরতে চার্ল দেখতে পায় ইটের তলায় চাপা পড়ে মরতে বসা এক কয়েদির আর্তচিৎকার শুনেও কেউ তাকে উদ্ধার করছে না। নবাবের লোকদের এ এক নিষ্ঠুর খেলা। দয়াবান চার্ল লোকটিকে উদ্ধার করতে গেলে স্পেনীয় কাপড় ব্যবসায়ী আলফানসো তাকে নিবৃত করে। এদেশের আইনকানুন সম্পর্কে ধারণা দেয়। বলে, ‘আবেগপ্রবণ হবেন না। ভুলে যাবেন না, অনেক সাগর-মহাসাগর পেরিয়ে এদেশে এসেছি আমরা কেবল ভাগ্য ফেরাবার জন্য।’ (পৃ ৩৩) এদেশের অনেক অসঙ্গত আর অমানবিক দিকের সঙ্গে ইউরোপের অনিয়ম আর অব্যবস্থার তুলনা করে আলফানসো। সেখানে শাসনব্যবস্থা পরিচালিত হয় চার্চের নির্দেশে। সাধারণ শ্রমজীবী মানুষ ক্রীতদাসতুল্য। সামগ্রিক তুলনাটি অধিকতর স্পষ্ট করে আলফানসো মন্তব্য করেন –
এ নগরীর যত রাজকীয় অট্টালিকা আর পথঘাট দেখছেন – সবই ওই হতভাগ্য কয়েদি শ্রমিকদের রক্ত আর ঘামের নির্যাস দিয়ে তৈরি। এখন নবাব শায়েস্তা খান নদীর ধারে তৈরি করছে কাটারা – শত শত কয়েদি সেখানে উদায়াস্ত পরিশ্রম করছে।
(পৃ ৩৩)
আলফানসোর মন্তব্যটি মনে ধরে চার্লের। সেও তার সমর্থন জুড়ে দেয়।
ঠিক আমাদের দেশের মতই। দাস আর দরিদ্র মানুষের শ্রম আর রক্তে একদিকে গড়ে উঠছে রাজার প্রমোদ উদ্যান। আর একদিকে হতভাগ্য অভুক্ত-দরিদ্র মানুষেরা এক টুকরো রুটির জন্য হাহাকার করছে।
(পৃ ৩৩)
বাজার প্রদক্ষিণে এসে নগরীর কেনাবেচার সমৃদ্ধ জগৎটি দেখে রীতিমতো বিস্মিত চার্ল। পালের জাহাজ, হাজারমণী নৌকো, ডিঙি নৌকো, শত সহস্র মানুষের ওঠানামা আনাগোনা, মালবোঝাই মালখালাস, বিচিত্র সুরে বিক্রেতাদের খদ্দের ধরার চেষ্টা – এসবের পাশাপাশি পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে আসা বিচিত্রবেশী বিচিত্রভাষী সওদাগর নাবিকদের আনাগোনা চার্লকে যেন ঘোরের মধ্যে ফেলে দেয়। লোকমুখে সে শুনেছে – ‘এখানকার পণ্যের হাটে ঢুকবার দরজা হাজারটা। কিন্তু বেরিয়ে যাওয়ার পথ রুদ্ধ। একবার এখানে ঢুকলে আর বের হয়ে আসা যায় না।’ (পৃ ৪৪) চার্ল দেখে কাপড়ের আড়তেই বিদেশি বণিকদের ভিড় সবচেয়ে বেশি। বিদেশি বণিকরা এখানে সরাসরি কেনাবেচা করতে পারে না, চার্ল সেটা জানে। এখানে শায়েস্তা খান আর তার লোকেরা ইচ্ছামতো অল্পদামে বিদেশি পণ্য কেনে। তবে বিদেশি সওদাগররা ফড়িয়াদের যোগসাজশে গোপন বেচাকেনার মাধ্যমে লোকসান পুষিয়ে নেয়। ‘ফরাসিদেরও নিজস্ব ফড়িয়া আছে। তবে তাদের দাম পছন্দ না হওয়াতে চার্লকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে বাজার যাচাইয়ের। আবে-রওয়াঁ, আবওয়াব, শবনম, বেগমখাস, সরবতী, জঙ্গলখাস, কাসিদা প্রভৃতি শাড়ি দেখতে দেখতে চার্লের মনে হয় যেন তার চারপাশে ইন্দ্রজাল ছড়ানো। যেন ডানা মেলে উড়ছে সব অলৌকিক পরী। মায়ের মুখ মনে পড়ে চার্লের। একবার ভার্সাই নগরীতে রাজকীয় উৎসবে লুই পরিবারের মহিলাদের পরিধানে মসলিনের পরিধেয় দেখে মা বলেছিল – ‘মসলিন তো কাপড় নয়, হালকা কুয়াশা। সেই কুয়াশায় নিজেকে জড়িয়ে রানী এসে দাঁড়িয়েছিলেন রাজার হাত ধরে, আলোকস্তম্ভের পাশে। হাজার নক্ষত্র যেন আকাশ ছেড়ে নেমে এসেছিল, ঝিলমিলিয়ে জ্বলে উঠেছিল রানীর শরীরে। আর এত আশ্চর্য স্বচ্ছ সেই আলোকখচিত পোশাক, রানীর কণ্ঠের নীল শিরাগুলো পর্যন্ত দেখা যাচ্ছিল।’ (পৃ ৪৭) চার্ল আজ সেই শাড়ির রাজ্যে বিচরণ করছে। স্বপ্ন যেন সত্যি হয়ে উঠল তার কল্পনায়। এই স্বপ্নের বাস্তব রূপদান করাটাও তার জন্য কঠিন কিছু নয় এখন। ‘স্বচ্ছ স্ফটিকের মত মসলিনের শরীরে মুগ্ধ দৃষ্টি রেখে ফরাসি ভাষায় ফিস ফিস করল – মনামি-বেলামি মসলিন! তুমিই আমার সব। তোমাকেই আমি চাই। তোমাকে নিয়েই আমি ভাগ্য ফেরাব।’
(পৃ ৪৭)
চার্লের মতো ভাগ্য ফেরাতে এখানে এসে জড়ো হয়েছে ইংরেজরাও। ফ্যাক্টরি বসিয়েছে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। এসেছে ডাচরা। নদীর পাড়ঘেঁষে নির্মাণ করেছে ঘরবাড়ি। আর্মেনীয় আর গ্রিকরা তো দেশটিকে প্রায় ‘দ্বিতীয় হোমল্যান্ড’ বানিয়ে ফেলেছে। আক্রমণকারী পর্তুগিজরাও বহাল তবিয়তে আছে। নবাবের বিভিন্ন বাহিনীতে গুরুত্বপূর্ণ পদ দখল করে বসেছে। ইংরেজ কর্মচারী তথা ব্যবসায়ীদের অন্যতম প্রতিনিধি মি. রিচার্ড এ-দেশটিকে নিয়ে নতুন স্বপ্ন লালন করেন, ‘আমি এদেশকে নিয়ে একটা স্বপণ দেখি। আমার সেই স্বপ্নে আমি দেখতে পাই, এদেশে একদিন ইংল্যান্ডের ফ্লাগ উড়বে, ইংলিশরা আধিপত্য নিয়ে এখানে গর্বিত পায়ে হাঁটবে, আর এ দেশের মানুষরা সবই ইংল্যান্ডের ভাষায় কথা বলবে।’ (পৃ ৬৩) যেন – ‘বণিকের মানদ- দেখা দিল পোহালে শর্বরী রাজদ-রূপে।’ রিচার্ডের স্বপ্নকে হেসে উড়িয়ে দেয় জন। কলম্বাসের নতুন আবিষ্কৃত দেশগুলোতে কীভাবে ইংরেজ শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল তার বিবরণ দেয় রিচার্ড। পালটা যুক্তি দেখিয়ে জন জবাব দেয়, ‘সেটি ছিল কতগুলো দুর্বল জংলি রেড ইন্ডিয়ানদের দেশ। আর এটা হচ্ছে বিশাল জনগোষ্ঠীর এক সুসভ্য দেশ। নিজস্ব ভাষা, শিক্ষা-দীক্ষা, সংস্কৃতি নিয়ে এরা আমাদের তুলনায় কম শক্তিশালী নয়। সুতরাং এমন একটি অদ্ভুত স্বপ্ন দেখে আমাদের কোনোই লাভ নেই। বরং এদেশে ব্যবসা বাণিজ্য করে যতটুকু লাভবান হওয়া যায়, তাতেই আমাদের সন্তুষ্ট থাকা উচিত।’ (পৃ ৬৪) রিচার্ড জনকে জানিয়ে দেয় যে, ফরাসিদের পণ্যবাহী জাহাজ শীতলক্ষ্যার মোহনায় আটকে দিয়েছেন প্রিন্স আযম। সেসব পণ্য বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে। শোনা যাচ্ছে বিদেশি বণিকদের মসলিন বোনার দাদন কিংবা নিজস্ব ফ্যাক্টরি তৈরির অধিকার বন্ধ করা হবে। মসলিন ক্রয়-বিক্রয়ের ক্ষমতা থাকবে কেবল সরকারের হাতে। বিদেশিদের বাণিজ্যের অধিকার সংকুচিত করতে মাঠে নামেন সুবাদার শায়েস্তা খানের সঙ্গে সম্রাট আওরঙ্গজেবের প্রতিনিধি প্রিন্স আযমও। বাণিজ্যের এই সংকটে চিমিত্মত আন্দ্রে এবং চার্লও। চার্লকে চাঙ্গা করা এবং সংকট উত্তরণের কৌশল বাতলানোর জন্য আন্দ্রে তাকে নিয়ে যায় নগরীর এক অভিজাত এবং প্রভাবশালী বাঈজি রওশন বাঈয়ের বাংলোয়। সেখানে সাক্ষাৎ হয় আন্দ্রের বন্ধু আগা পারভেজের সঙ্গে। নবাবের সঙ্গে আগা পারভেজের ব্যবসায়িক সম্পর্ক রয়েছে। রওশন বাঈয়ের জলসায় আলাপচারিতার এক ফাঁকে আন্দ্রে চার্লকে বুঝিয়ে দেয় যে, আগা পারভেজকে খুশি করতে পারলেই তাদের বাণিজ্যস্বার্থ চরিতার্থ হবে। আগা পারভেজের পরামর্শ মতো রওশন বাঈয়ের মধ্যস্থতা গ্রহণ করে তারা। কেননা, শাহজাদা আযম সম্পূর্ণভাবে রওশন বাঈয়ের কব্জাগত। রওশন বাঈকে লাভের একটি অংশ দিতে হবে। পাশাপাশি আগা পারভেজ একটি শর্ত জুড়ে দেন যে, শাহজাদা আযমের প্রতিনিধি হিসেবে তার সঙ্গেই তাদের মসলিন কেনাবেচা করতে হবে। নবাব শায়েস্তা খান বিপন্ন। কেননা শাহজাদা আযম এসে সওদা-ই-খাস নিজের দখলে নিয়ে নিয়েছেন। দিল্লির সম্রাট আওরঙ্গজেব এক মাসের মধ্যে পাঁচ লক্ষ টাকা চেয়ে পাঠিয়েছেন শায়েস্তা খানের কাছে। রওশন বাঈয়ের নূপুর নিক্কণ, সুরমূর্ছনা আর শরাবের রেশে সকল দ্বিধা কেটে যায় চার্লের। তখন তার স্বপ্ন ‘সম্পদ চাই, ক্ষমতা চাই, লক্ষ লক্ষ স্বর্ণ মুদ্রার ঝঙ্কার বাজাতে বাজাতে পৌঁছে যেতে হবে নিজের গন্তব্যে।’ (পৃ ৭৬) আবে-রওয়াঁর নেশায় ধরে ফেলে তাকে। রওশন বাঈই যেন আবে-রওয়াঁ হয়ে ওঠে তার চোখের তারায়।
রওশন, তুমি জানো, আবে-রওয়াঁ কী? তোমার আবে-রওয়াঁ শুধুই প্রবাহিনী নদী নয়, সে সবাইকে সোনার সিংহাসনের দিকে ভাসিয়ে নিয়ে যায়, প্রবল শক্তিতে। তার শক্তিতে পরাজিত সবাই সে তো তোমারই মত এক অসাধ্য সাধনকারী সুন্দরী রমণী।
(পৃ ৭৬)
শুধু পণ্যের কারবারি হিসেবেই নয়, সুদের কারবারি হিসেবেও ভাগ্য ফেরাতে ঢাকায় এসেছে জলন্ধরের কুঞ্জিলাল ছত্রী আর মালাবারের লালাচাঁদ। ছোট-বড় দেশি-বিদেশি বিভিন্ন ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে নবাব শায়েস্তা খান, সম্রাট আওরঙ্গজেব – বহু মানুষের সঙ্গেই লালাচাঁদের গোপন কিংবা প্রকাশ্য সুদের কারবার। সম্রাটের উড়নচ-ী পুত্র শাহজাদা আযমের সঙ্গেও চলে তার গোপন শলাপরামর্শ। ‘সুবা-ই-বাঙ্গালের সাবাদারি তো এখন ঘোলাজলে শিকার করা মাছ। শাহজাদা সুবাদার সুজার পতনের পর থেকে এই শিকার তো থেমে থাকে নি। কত সুবাদার এল গেল। জল ঘোলা হয়েই চলেছে। ঘোলা করার লোক তো ক্ষমতাবানদের আশেপাশেই থাকছে। লালাচাঁদও পিছিয়ে নেই। বেশ আটঘাট বেঁধেই এগিয়ে চলেছে।’ (পৃ ৯৮) লালাচাঁদের কাছে টাকা ধার করে জমিদাররা নবাবের খাজনা পরিশোধ করছে। নবাব সেই টাকা দিয়ে দিল্লির সম্রাটের নজরানা পরিশোধ করছে। জমিদাররা শোধ তুলছে গরিব রায়তদের ওপর। চমৎকার এক অর্থচক্র ফেঁদে আছে লালাচাঁদ। অদৃশ্য এক পণ্যের বাণিজ্য করছে সে।

শতরঞ্জ পর্ব
ঢাকার জমিনে পাতা হলো এক শতরঞ্জ।
দিল্লিতে সম্রাটের কাছে খবর পৌঁছায় যে, সুপারি আর মসলিনের ব্যবসা করে ঢাকার নবাব শায়েস্তা খান প্রচুর টাকা-পয়সা জমিয়েছেন। সওদায় খাসের সকল আয় দিল্লিতে পৌঁছায় না। সম্রাট ভীষণ রুষ্ট হয়ে শাহজাদা আযমকে ঢাকায় পাঠান সওদায় খাসের লাভের টাকার হিসাব বুঝে নেওয়ার জন্য। শায়েস্তা খান এতকাল বিদেশি বণিকদের জাহাজভর্তি পণ্য খেয়ালখুশি মতো দামে কিনে চড়া দামে বেচে মোটা লাভ করেছেন। মসলিনের ব্যবসা নিজের কুক্ষিগত করার জন্য বসাতে চাচ্ছিলেন শাহি তাঁতখানা আর মিনাবাজার। শাহজাদা আযম সে সব বন্ধ করে দিলেন। এমনকি নবাবের নবাবিও বাতিল হওয়ার জোগাড় হলো। তখন শায়েস্তা খানের কন্যা পরীবিবি হয়ে ওঠে শতরঞ্জের চালের ঘুঁটি। ঘুঁটির যেমন নিজস্ব কোনো স্বাধীনতা থাকে না, খেলোয়াড়ের সিদ্ধামেত্মই পরিচালিত হয়, পরীবিবিও তেমনি বাবা-ভাইয়ের সিদ্ধামেত্ম, বাবা-ভাইয়ের স্বার্থে চালিত হলেন। পরীবিবির ভাষায় :
শাহজাদা আযমের সাথে আমার শাদি আসলে শাদি নয় সতরঞ্জের খেলা।
(পৃ ৫৬)
নবাবজাদিদের শাদি তাদের ইচ্ছায় হয় না। হয় মসনদের ইচ্ছায়।
(পৃ ১১০)
সম্রাট শায়েস্তা খানকে তলব করেছেন মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে দু-চারদিনের মধ্যে দিল্লি যেতে। শাহজাদা আযমের সঙ্গে পরীবিবির বিয়ে হবে দিল্লিতে। এতে চরম অপমানিত বোধ করেন নবাব। পরীবিবির বিয়ে দিল্লিতে সম্পন্ন করার কারণ মূলত এই সুযোগে সম্রাট-পুত্র আযমকে ঢাকা থেকে সরিয়ে নেওয়া। কেননা ইতোমধ্যেই আযম স্থানীয় চাটুকার এবং স্বার্থশিকারিদের চক্রামেত্ম জড়িয়ে পড়েছেন। তাছাড়া দূরদৃষ্টি এবং বিচক্ষণতারও অভাব রয়েছে তার। বিদেশি বণিকরা আযমের সঙ্গে গোপন বৈঠক করে বাণিজ্যের সুবিধা নিতে চাইছে। তারা চাইছে শাহজাদা আযমই হোক ঢাকার সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী, যা শায়েস্তা খানের স্বার্থের পরিপন্থি। তাছাড়া নবাবের অনেক দায়িত্বশীল উমরাহ এমনকি খোদ ওয়াকিয়া নবীশ পর্যন্ত নবাব পরিবারের বিরুদ্ধে কাজ করছে। আনুগত্য দেখাচ্ছে আযমের প্রতি। ফলে আযমের ঔদ্ধত্যের প্রকাশ ঘটছে। ‘শাহজাদা আযম যেভাবে বাড়াবাড়ি করছেন তাতে তিনি শাহজাদা খুররমের মতো দিল্লির তখতের আনুগত্য স্বীকার করে বসতে পারেন। মোগল শক্তির জন্য সেটা হতে পারে বড় ধরনের হুমকি। তাই সময় থাকতেই পরীবিবির বিয়ের অনুষ্ঠানটিকে সতরঞ্জের চাল হিসেবে প্রয়োগ করেছেন।’
(পৃ ১১২)
তবে শায়েস্তা খান মনে করেন, দিল্লির সম্রাট তার ওপরই নির্ভরশীল। তামাম হিন্দুস্থানকে কব্জা করতে গেলে অনেকদিন ধরে যুদ্ধ করতে হবে। সেই যুদ্ধের ব্যয়ভার বহনের যোগ্যতা ও সামর্থ্য সম্রাটের নেই। সে-ক্ষমতা কেবল নবাবেরই আছে। সুতরাং সম্রাটের পক্ষ থেকে তার আক্রান্ত হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। সম্ভাবনা না থাকলেও নির্বিঘ্নেণ নবাবি করতে হলে কিছু প্রতিপক্ষকে তো নিয়ন্ত্রণ করতেই হয়। নবাব গোপন বৈঠক করেন পুত্রদের নিয়ে। শাহজাদা আযমের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে আগা পারভেজ ও অঘটনঘটনপটিয়সী সুন্দরী রওশন বাঈয়ের মতো যারা প্রচুর অর্থবিত্ত করায়ত্ত করেছে তাদের দমনের প্রসঙ্গ ওঠে। আগা পারভেজ যেহেতু টাকায় বিক্রি হয় সেহেতু তাকে কব্জা করা নবাবের পক্ষে এমন কিছু কঠিন কাজ নয়। আর রওশন বাঈ? বুড়িগঙ্গায় ভাসমান আলোকসজ্জিত সৌখিন প্রমোদতরীর এক জলসায় গজল পরিবেশনের আমন্ত্রণে গিয়ে কীভাবে যেন নদীতে পড়ে গিয়ে চিরতরে হারিয়ে গেলেন।
কিন্তু শতরঞ্জের খেলায় শেষ পর্যন্ত হেরে গেলেন নবাব শায়েস্তা খান। ‘জান্নাত-উল বেলাত’ ঢাকার অধিকার নিয়ে নবাব শায়েস্তা খানের সঙ্গে শাহজাদা আযমের বিরোধ চূড়ান্ত রূপ পরিগ্রহ করে। বিরোধটিকে লেখিকা একটি প্রতীকী রূপ দিয়েছেন হাতির লড়াইয়ের মাধ্যমে। একটি হাতি নবাবপুত্র বুজুর্গ উম্মিদ খানের। অপরটি শাহজাদা আযমের। আযমই ছিলেন এই হস্তিযুদ্ধ খেলার আহবানকারী। পিলখানার একটি মাদি হাতিকে নারীসুলভ অলংকারে সাজিয়ে ময়দানে আনা হয়েছিল। ‘সুবেশা এই মাদি হাতির নাম রানী। রানী হাতি ময়দানে নেমে প্রথমে যোদ্ধা পুরুষ হাতিকে প্রলুব্ধ করে। সে এক উপভোগ্য দৃশ্য। রানীর অধিকার নিয়েই দুই হাতি ক্ষমতার যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়।’ (পৃ ১১৮) রূপকের আড়ালে ঢাকা কিংবা সুবা-বাংলা হলো সেই রানী হাতি। আর তাকে অধিকারের লড়াইয়ে মত্ত দুই পুরুষ হাতি – নবাবজাদা ও শাহজাদা। দখল-উন্মত্ত ক্ষিপ্ত হাতির লড়াই এক পর্যায়ে মাহুতদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে ছুটতে থাকে সেই হাতি। বহুমানুষ হাতির পদপৃষ্ঠে হতাহত হয়। ক্ষিপ্ত ‘রানী’ হাতি বুড়িগঙ্গায় ঝাঁপ দিলে তার আর হদিস মেলে না।
সম্রাটের আদেশ পেয়ে নবাব শায়েস্তা খান গোটা বিশেক হাতি, গোটা পঞ্চাশেক ঘোড়া, চিত্রল হরিণ, শস্যপাতি, কারুশিল্প, হাতির দাঁতের আসবাবপত্র, রেশমি ও মসলিনের কাপড়, অলংকার, কাকাতুয়া, লালটিয়া, মণিমুক্তো এবং দেড়শো গোলাম-বাঁদি নিয়ে সপরিবারে দিল্লি রওনা হন, তখন ‘মনে হয়েছিল একটি চলন্ত নগরীর অধিনায়ক যেন চলেছেন দূরামেত্মর পথ পাড়ি দিতে।’ (পৃ ১২৬) এসব ছিল মূলত সম্রাটের জন্য নীত উপহার। আর নবাব নিজের জন্য যা নিলেন তার কোনো সীমাসংখ্যা নেই। শাহজাদা আযমও দিল্লির পথে রওনা হলেন। আবে-রওয়াঁ উপন্যাস এখানেই সমাপ্ত হয়ে যায়।
রিজিয়া রহমানের আবে-রওয়াঁ উপন্যাসটির স্থানিক ব্যাপ্তি ঢাকা-দিল্লি-মধ্যপ্রাচ্য থেকে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে বিসত্মৃত। আর কালিক গ– মূলত মোগল শাসনামল। এই স্থান আর কালের মুকুরে প্রতিফলিত হয়েছে সমাজ-সংসার, অর্থনীতি, ইতিহাস আর রাজনৈতিক বাস্তবতা। সমাজের অমেত্ম বাস করা সাধারণ শ্রমজীবী মানুষ – সখিনা, হাতেম, মালেক, আসমানি, নিত্যপ্রসাদ, সত্যপ্রসাদ, আজিজ বোখারীর গৃহকোণ থেকে শুরু করে দেওয়ান, নবাব, বাদশাহর প্রাসাদ পর্যন্ত প্রসারিত এ-উপন্যাসের কাহিনিবলয়। ইতিহাসের উপাদানকে আশ্রয় করে লিখিত উপন্যাসটি সেই অর্থে ঐতিহাসিক উপন্যাস নয়। তবু পাঠককে ইতিহাস জিজ্ঞাসার কাছাকাছি এনে দাঁড় করাতে সমর্থ হয়েছেন লেখিকা। বিধৃত সময় যেন সমকালীন হয়ে পাঠকের সামনে এসে হাজির হয়েছে। বুড়িগঙ্গার তীরে দাঁড়িয়ে পাঠক যেন মনে মনে সেই যুগ ও সময়ের একজন মানুষ হয়ে ওঠেন। আর বুড়িগঙ্গা যেন তার বুকে আবে-রওয়াঁ বিছিয়ে জলস্রোতের প্রবহমানতায় সেই যুগ ও সময়ের ইতিহাস লিখে চলে আপন খেয়ালে।