ম্যারিনা নাসরীন

এক 

নভেম্বর মাসের একুশ তারিখ বিয়ের দিন ধার্য হয়েছে। হাতে আছে মাত্র দু-মাস। পল্টনে আড়াই কামরার ভাড়া করা বাসায় শফিকের সঙ্গে নাদিয়ার যুগলজীবন সেদিনই শুরু হবে। আড়াই কামরা বলতে দু-বেড আর ড্রইং কাম ডাইনিং। বিয়ের এক মাস আগে শফিক মেস ছেড়ে এই বাসায় এসে উঠবে, তেমনটাই ঠিক হয়েছে। নাদিয়ার কথা, নতুন সংসারের প্রতিটি জিনিস হতে হবে নতুন, আনকোরা। বাসা সাজানোর নিমিত্তে তার মাথায় নানা কিসিমের পরিকল্পনা গিজগিজ করছে। প্রায় প্রতিদিন অফিসশেষে সে হন্তদন্ত হয়ে ফোন দিয়েই শুরু করে,  

‘শোনো, আজ কিন্তু অমুক মার্কেটে তমুক দোকানে যেতে হবে।’ 

বাস্তবে সে কোনো দোকানে ঢোকে না। ফুটপাতে নুনের কৌটা, তেলের বোতল টুকিয়ে বেড়ায় আর শফিক থাকে পেছনে ‘ধর হে লক্ষ্মণ’ সেজে। বাসায় এত্ত এত্ত জিনিসে বোঝাই করে ফেললো; কিন্তু শফিকের ব্যাচেলর লাইফের কোনো জিনিসই সে অনুমোদন করলো না। ভেবেছিল, খুব শখ করে বানানো আকাশমণি কাঠের সিঙ্গেল খাটটা, খাটের নিচে রাখা টিনের ট্রাঙ্কটা অন্তত স্মৃতি হয়ে থাকবে। কিন্তু নাদিয়ার সাফ কথা, রদ্দিমার্কা কোনো কিছু তার বাসায় ঢুকবে না। শফিক মিনমিন করে বলেছিল, 

‘অন্তত ট্রাঙ্কটা আনি। ট্রাঙ্কে আমার ছোটবেলার অনেক জিনিস রয়েছে।’ 

নাদিয়া ওর দিকে এমনভাবে তাকালো যেন কেন্নো দেখছে। বলল, 

‘ছ্যাঃ ওই পরদাদা আমলের টিনের ট্রাঙ্ক? কক্ষনো নয়। তবে ট্রাঙ্কের জিনিসগুলো একটা সুটকেসে ভরে নিয়ে আসতে পারো।’  

কী আর করা! নিউমার্কেট থেকে শফিক একটা সুটকেস কিনে এনেছে। সমস্যা হলো, ট্রাঙ্কের তালার চাবি কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। এই মেসে  প্রায় চার বছর হলো। এই চার বছরে একদিনের জন্য ট্রাঙ্কটি খোলা হয়নি। তালাটা মরচে পড়ে তামার রং ধারণ করেছে। তালা ভাঙা ছাড়া উপায় নেই। রান্নাঘর থেকে শিল এনে বাড়ি দিয়ে তালাটি ভেঙে ফেললো শফিক। ডালা তুলে অবাক। বাপ রে! মনেই ছিল না ট্রাঙ্কটিতে এতো কিছু রয়েছে! বই, ডাঙ্গুলি, গুলতি, এক বক্স কাচের বল, পেপার কাটিং, ভিউ কার্ড, নানা রঙের কাগজের নৌকা, হাবিজাবিতে ঠাসা। আহা শৈশব! সোনালি স্মৃতির আখর। কাগজের চিড়ে-চ্যাপ্টা নৌকায় ফেরি করা গান আর পলাশ-শিমুলের রং! শফিক স্মৃতিকাতর হয়ে পড়ে। খুব যত্ন করে প্রতিটি জিনিস ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখে। কাচের বলগুলো এখনো চকচকে। গুলতির রাবারে একটা বল নিয়ে টান দিতেই রাবারটা ছিঁড়ে গেল! 

ট্রাঙ্কের একপাশে কাগজে মোড়ানো কিরিচটা নিরীহভাবে শুয়ে আছে! অথচ কি ভয়ংকর ছিল তার রূপ! আজকের শফিককে দেখে কে বলবে ওর একসময়ের সার্বক্ষণিক সঙ্গী ছিল এই কিরিচ। শফিকের ডানহাতটা স্বয়ংক্রিয়ভাবে বাম বাহুতে চলে যায়। কৈশোরের শুকনো টিনটিনে হাতের জায়গায় এখন জিম করা দড়া পাকানো বাহু। কিন্তু সেই ক্ষত এখনো মিশে যায়নি। বরং মাংসপেশির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে। সেবার শিমুলপুর গ্রামের সঙ্গে ক্রিকেট খেলা চলছিল। হঠাৎ একটা আউটকে কেন্দ্র করে দুপক্ষে তুমুল মারামারি। একপর্যায়ে ওই পক্ষের কে একজন  শফিকের বাহুতে ছুরির তিনটা পোচ টেনে দিলো। ফিনকি দিয়ে রক্ত ছুটছিল। কিন্তু সেসব দেখার সময় কোথায়! পকেটে তখন এই কিরিচ। ছেলেটির  হাতের কব্জি কেটে ফালাফালা করে ফেলেছিল শফিক। অন্যরা যদি  জাপটে না ধরতো কী জানি সেদিন কী হতো। বাড়ি ফেরার পর বাবা বেদম মেরেছিলেন। সেই ঘটনার পরে আর কখনো কিরিচ হাতে নেয়নি। 

বেশ অনেকগুলো বই। রিক্তের বেদন, চিতা বহ্নিমান, দস্যু বনহুর! মাসুদ রানা। বইয়ের জগতের একসময়ের হার্টথ্রব নামগুলো পড়ে খুব হাসি পায়। সময় এমনই! বইগুলোর নিচে ভাঁজ করা আকাশি রঙের একটি শার্ট। ওপরের অংশ কেমন ছোপছোপ হলদেটে হয়ে গেছে। বুকপকেটে শ্যামপুর উচ্চবিদ্যালয়ের লোগো লাগানো। শফিকের স্কুল ইউনিফর্ম! এটি মা রেখেছিল, নাকি শফিক, মনে করতে পারছে না। শার্টটি ঝাড়া দিতে পকেট থেকে কিছু একটা বের  হয়ে ছিটকে দূরে গিয়ে পড়ল। বেশ কৌতূহল নিয়ে কালোমতো জিনিসটা হাতে তুলে নেয় শফিক। মেয়েদের চুলের রিবন। কালো ইলাস্টিকের সঙ্গে লালচে রঙের একটা ফুল। রিবনটা চোখের সামনে ধরতেই তুলকালাম ঝড় ওঠে শফিকের বুকের মধ্যে। দরদর করে শরীর ঘামতে থাকে। রিবন নয়, যেন চোখমুখে রাজ্যের অভিযোগ নিয়ে গোলগাল মুখের কোঁকড়া চুলের মেয়েটি ওর সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। নিশাত।  শফিকের প্রথম প্রেম! প্রথম বর্ষায় ভেসে যাওয়া সুগন্ধের রাজহাঁস! 

প্রায় নয় বছর! হিজলতলায় বসে নিশাতের সঙ্গে শেষ কথা হয়েছিল, শেষ দেখাও। তারপরের ঘটনাগুলো এমন দ্রুত ঘটে গিয়েছিল যে শফিক বুঝতেও পারছিল না আসলে কী হচ্ছে ওর সঙ্গে। 

এসএসসি পরীক্ষাশেষে শফিকের তখন স্কুল বা পড়ালেখা থেকে ছুটি। সারাদিন বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা আর আজ এ-মাঠ  তো কাল ও-মাঠে ক্রিকেট ম্যাচ। ক্রিকেট ছিল শফিকের নেশা। তার চেয়ে বড় নেশা ছিল নিশাত। ওইটুকুন বয়সে কাউকে এতোটা ভালোবাসা সম্ভব হয়েছিল কীভাবে সেটাই এখন শফিক ভেবে পায় না। সে-সময় একদিন কাকা বাজার থেকে ফিরে বাবাকে উদ্দেশ করে বললেন,  

‘মার্কাস মসজিদ থেকে তাবলিগের একটা দল ঢাকা যাচ্ছে, শফিকের তো পরীক্ষা শেষ, ওকে পাঠায়ে দেই ভাইজান?’ 

শফিক  প্রবল বেগে মাথা নাড়িয়ে অসম্মতি জানিয়ে বলেছিল, 

‘না না কাকা, এখন নয়, হাজিগঞ্জের সঙ্গে ম্যাচ আছে সামনের সপ্তাহে।’  

কিন্তু শফিকের সে-অজুহাত বাবা-মায়ের সামনে টিকল না। তারা সাফ জানিয়ে দিলেন,

‘সারাজীবন তো খেলাধুলাই করছ,  কলেজে ভর্তির আগে একটু আল্লাহ্‌র রাস্তায় সময় লাগাও। আখেরাতে আমরা জবাব দেব কী?’ 

শফিক খোঁজখবর নিয়ে দেখল ওর আরো দুজন ক্লাসমেট যাচ্ছে। জুনায়েদ আর রানা। যেতে যখন হবে ঝামেলা করে লাভ নেই। কদিনই তো। কিন্তু যাওয়ার আগে নিশাতের সঙ্গে দেখা করতেই হবে। শফিকের কারণেই তখন নিশাত প্রায় বন্দিনী। ফোনের যোগাযোগও বন্ধ। নিশাতের চাচাতো ভাই জাহাঙ্গীর শফিকের অন্তরঙ্গ বন্ধু। সে-ই ওদের মেসেঞ্জার, ডাকপিয়ন।  

তাবলিগে যাওয়ার আগের দিন সন্ধ্যার কিছু সময় পর ও সাইকেল নিয়ে নিশাতের বাড়ির পেছনে কড়ই গাছের নিচে অপেক্ষা করছিল। জাহাঙ্গীর গিয়েছে নিশাতকে আনতে। সময় যেন শেষ হতে চায় না। প্রায় আধাঘণ্টা পর দুটো ছায়ামূর্তি দেখা গেল। ওরা কাছে আসতেই শফিক নিশাতের হাত ধরে টেনে সাইকেলের সামনে বসিয়ে  জাহাঙ্গীরকে বলেছিল, 

‘তুই এইখানে অপেক্ষা কর। আধাঘণ্টা পরে আসছি আমরা। খবরদার এখান থেকে নড়বি না।’ 

জাহাঙ্গীর কিছু বলার আগেই ঝড়ের বেগে সাইকেল চালাতে শুরু করে শফিক। শফিকের আচানক এমন ভাবগতিক দেখে খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিল নিশাত। ভয়ার্ত গলায় বলেছিল, 

‘কী করছ? আস্তে চালাও। পড়ে যাবো তো। আর বাড়ির কেউ আমাকে খুঁজে না পেলে মেরে ফেলবে কিন্তু।’

‘চুপ থাকো। একদম কথা বলবে না।’

‘কী হয়েছে তোমার? এমন করছ কেন?’

‘আমাকে বাড়ি থেকে তাবলিগ জামায়াতে পাঠাচ্ছে । আমার ভালো লাগছে না।’

‘তুমি তাবলিগ জামায়াতে যাবে? কদিনের জন্য?’

‘সম্ভবত সাতদিন। আমি এখনো ঠিক জানি না। আমাকে না দেখে থাকতে পারবে?’

‘তোমাকে না দেখে সাতদিন থেকেছি তিন বছরে? যেও না প্লিজ।’

‘উপায় নেই, যেতেই হবে। তুমি সাবধানে থেকো আর ফোন করো।’

‘ফোন করব কীভাবে? আমাকে সবাই মিলে পাহারা দেয়। আমার খুব ভয় লাগছে গো। মা কাকাকে ছেলে দেখতে বলেছে। আমাকে বিয়ে দেবে।’

‘অতো সহজ না। তোমার কাকা জানে তোমাকে অন্য কোথাও বিয়ে দিলে আমি আগুন জ্বালিয়ে দেব। তুমি জাহাঙ্গীরের ফোন থেকে আমাকে ফোন করবে। মাত্র তো সাতদিন।’

হিজল বনের মধ্যে শফিক নিশাতকে নামিয়ে দিয়েছিল। পূর্ণিমার চাঁদের আলোয় হিজল বন তার সব সবুজ হারিয়ে তখন সোনার টাকার মতো ঝকঝকে। নিশাতের টলটলে চোখেও চোরাবালির  ঝিকিমিকি। ওর ফর্সা মুখ আর কালো চুল বেয়ে সোনালি জরির ফিতে পিছলে পড়ছে। শফিক অপার মুগ্ধতায় নিশাতের দিকে চেয়ে থাকে। এতো সুন্দর! এতো আপন! শফিক হুট করে নিশাতকে বুকের মধ্যে চেপে ধরে। পাগলের মতো চুমুতে চুমুতে ওর সমস্ত শরীর ভিজিয়ে দেয়। নিশাতও সম্মোহিতের মতো ওর বুকে মুখ গুঁজে থাকে। 

পরদিন শফিক মার্কাস মসজিদে চলে গিয়েছিল। সেখান থেকে ঢাকা কাকরাইল মসজিদ। ওর ধারণা ছিল, কাকরাইল মসজিদে সাতদিন থেকে ও বাড়ি ফিরে যাবে। কিন্তু জানা ভুল। কাকরাইলের মুরুব্বিরা বিভিন্ন দলে ভাগ করে একেক এলাকায় জামায়াতে মুসুল্লিদের পাঠাতে লাগলেন। শফিকদের দলের জন্য ভোলার কোনো এক গ্রামের মসজিদ নির্ধারণ করা হলো। এক চিল্লা মানে চল্লিশ দিন! শফিকের চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করছিল; কিন্তু কিচ্ছু করার ছিল না। ঢাকায় সেবারই প্রথম এসেছিল শফিক। একবার ভেবেছিল পালিয়ে যাবে; কিন্তু সাহস হয়নি। 

ভোলায় যাবার পথে রাতের লঞ্চ ছিল ওর তীব্র বেদনার একমাত্র সাক্ষী।  সেদিনের মতো অসহায় জীবনে আর কখনো অনুভব করেনি শফিক। ফোন আমিরের জিম্মায়। বাড়ি থেকে কেউ ফোন করলেই কেবল হাতে পাওয়া যায়। মা ফোন করলে  অভিমান করে খুব কেঁদেছিল শফিক। রাগ করেছিল। কেন তাকে এভাবে ফাঁকি দিয়ে চিল্লায় পাঠানো হলো? জোর করে ধর্মের কাজ হয়?

দুই

আঁধারে পানি কেটে কেটে লঞ্চ এগিয়ে যাচ্ছে। কখনো নিঃশব্দে, কখনো ভেঁপু বাজিয়ে। শফিক রেলিংয়ে হেলান দিয়ে পানির দিকে মাথা ঝুঁকিয়ে সারারাত ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থাকে। নিশাতের কথা ভেবে বুকের সমস্ত রক্ত যেন ছুটে বেরিয়ে আসতে চাইছে। আর কেউ নয়, মন খারাপের একমাত্র অনুষঙ্গ কেবল সে-ই। লঞ্চ যত এগোতে থাকে নিশাতও যেন শফিকের কাছ থেকে দূরে সরে যেতে থাকে। ওর স্পষ্ট মুখটা ক্রমশ ঝাপসা হয়। 

কত ছোটবেলায় ওদের দেখা হয়েছিল! শফিক তখন ক্লাস এইটে পড়ে আর নিশাত সেভেনে। ওর বাবাদের তিন ভাইয়ের এজমালি পরিবার। কাজিনেরা একসঙ্গেই বড় হচ্ছে। একদিন স্কুল থেকে বাসায় ফিরে শফিক দেখল ওর কাকির সঙ্গে সুন্দর ফুটফুটে একটা মেয়ে বসে আছে। ঝাঁকড়া চুলের মাঝে গোলগাল মুখে বড় বড় চোখ দুটো ঝকমক করছে। শফিক ওকে দেখে লজ্জা পেয়ে ঘরে চলে যাচ্ছিল। মা ডেকে বললেন, 

‘শফিক দেখে যা। এ হলো তোর কাকির  ভাগ্নি  নিশাত। আমাদের সঙ্গে থাকবে। গার্লস স্কুলে পড়বে।’ 

শফিক একটু তাকাতে মেয়েটা চোখে টিপ দিলো। আরে দারুণ ফাজিল তো! শফিকও চোখ বড় বড় করে শাসিয়ে ঘরে চলে যায়।

এরপর প্রতিদিন চোখাচোখি, খুনসুটি হতে হতে কবে যে প্রেম হয়ে গিয়েছিল! একজন অন্যজনকে চোখে হারায়। শফিক  সারাদিন বাইরে টো-টো করে ঘুরে বেড়ায়, ডাঙ্গুলি খেলে, ক্রিকেট খেলে। বাসায় ফিরলে নিশাতের হাজার অভিযোগ, 

‘যেখানে গিয়েছিলে যাও। সারাদিন বাইরে বাইরে থাকো, আমার খারাপ লাগে না?’ 

একই বাড়িতে তিন বছরে দুজনের কত কত স্মৃতি, কত কথা, কত প্রণয়, কত  প্রেম! আর পরিশেষে হিজল-তমালের বনে হারিয়ে যাওয়া লক্ষ কোটি দীর্ঘশ্বাস!

সম্ভবত ক্লাস নাইনের মাঝামাঝি সময়ে শফিক নিশাতকে প্রথম চিঠি লিখেছিল। ঘরের পেছনের জামগাছের গোড়ায় দুটো ইট ছিল ওদের পোস্টঅফিস। ইটের নিচে চিঠি রেখে শফিক বলেছিল, 

‘দেখে এসো একটা জিনিস আছে তোমার জন্য।’

এমনিতে সকলের সামনে শফিক নিশাতকে ‘তুই’ বললেও আড়ালে ‘তুমি’ বলত। কারণ নিশাত একদিন গিন্নির মতো মুখ গোল করে বলেছিল, 

‘জানো না প্রেম করলে তুমি বলতে হয়?’

সঙ্গে সঙ্গে দৌড়ে গিয়েছিল নিশাত। ফিরে আসার পর চোখ-মুখ লাল। শফিক তো ভয়েই অস্থির। চিঠির কথা যদি বাবা-মা বা কাকাকে  বলে দেয় তাহলে কাকা হাড্ডি গুঁড়ো গুঁড়ো করে দেবে। ছোট কাকাকে যমের মতো ভয় পেত শফিক। কিন্তু তেমন কিছু হলো না। শফিক টেবিলে বসে তখন  সমানে ঘামছে। নিশাত কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলে,  

‘জবাব রেখে এসেছি।’

নিশাতের  প্রথম  চিঠিতে গোটা গোটা অক্ষরে একটা লাইন লেখা ছিল, 

‘লাভ ইউ টু যুবরাজ।’

‘যুবরাজ’ কি শুধুই সম্বোধন ছিল? সেটি ছিল রাজকুমাররূপী এক কিশোরের রাজকন্যাসমেত রাজ্যজয়ের অনুভব। শফিক নাম দিয়েছিল ‘পরী’। সারাদিন সামনে সামনে ঘুরছে তবুও প্রতিদিন নিশাতের একটা চিঠি চাই-ই। না পেলে রেগেমেগে কথা বন্ধ। সেসব চিঠি ছিল টিনবয়সের ছেলেমানুষিতে ভরা। নিশাতের কোঁকড়া চুল, থুতনির খয়েরি রঙের টোল ছিল ভীষণ প্রিয়। ওর চুলে ল্যাভেন্ডারের মতো অদ্ভুত এক ধরনের ঘ্রাণ ছিল। কতদিন যে একলা পেয়ে ওকে জাপটে ধরে চুলে মুখ গুঁজে দিয়েছে! শফিক প্রায়ই বলত, 

‘দেখো পরী, তোমার কয়েক গাছা চুল চাই আমার।’

কী সর্বনেশে মেয়ে! একদিন সত্যি  এক থোকা চুল চিঠির সঙ্গে দিয়ে দিলো!  

কথায় বলে, চোরের দশদিন গৃহস্থের একদিন। এসএসসি পরীক্ষার মাসছয় আগে একদিন শফিক নিশাতকে চিঠি লিখে কেবল ভাঁজ করছে। খেয়ালই করেনি পেছনে কাকা দাঁড়িয়ে আছেন। উনি খপ করে হাত মুচড়ে চিঠিটা নিজের হাতে নিয়ে নিলেন। তারপর বাবা-মাকে ডেকে নিয়ে সে কী হেনস্থা!  

‘আমাগো পোলা বেডা হইয়া গেছে ভাবি, হেই প্রেমপত্র লেহে হুনো।’ 

কী লজ্জা! কাকা সেই চিঠি ভেঙিয়ে ভেঙিয়ে জোরে জোরে পড়ছেন আর শফিক যেন মাটির সঙ্গে মিশে যাচ্ছে। সেদিনই কাকা ওকে ওর বাড়িতে দিয়ে এসেছিলেন। এজন্য কাকি শফিকের ওপর আজো অবধি মনঃক্ষুণ্ন । 

লঞ্চে দাঁড়িয়ে এসব কথা ভাবতে ভাবতে শফিকের চোখ থেকে ক-ফোঁটা পানি সেদিন  নদীর পানিতে মিশে গিয়েছিল! সূর্য ওঠার আগে ছাই রঙের আলোতে ওরা ভোলা শহরে নামল। সেখান থেকে বাসে আরো বেশ খানিকটা গিয়ে তেঁতুলিয়া নদীর পাশের এক গ্রামের একটা বেশ বড় মসজিদে ওদের জামাত থিতু হলো। গ্রামের নামটা এখন আর মনে নেই। 

ধীরে ধীরে নানাভাবে জামাতের সঙ্গে মিশে গিয়েছিল শফিক। সারাদিন বয়ান, দাওয়াত, খেদমত। কিন্তু দিনশেষে রাতের সাক্ষাৎ ছিল শুকিয়ে যাওয়া অন্ধকারে নিমজ্জিত  নির্জন কূপের মতো। যেখানে শ্বাস নেওয়ার জন্য পর্যাপ্ত অক্সিজেন নেই। 

নিশাতের খবর পাওয়ার একমাত্র মাধ্যম ছিল জাহাঙ্গীর। নিশাতের জন্য শফিকের উৎকণ্ঠা দেখে জাহাঙ্গীর  হেসে বলত, 

‘তোর শরম লাগে না, বাপ-মায়ের খোঁজ না নিয়া খালি হ্যার খোঁজ নেস?’ 

‘বাবা-মায়ের সঙ্গে তো কথা হয়, ওর সঙ্গে একদিনও কথা হয় না যে! আমার সঙ্গে একবার কথা বলিয়ে দে না প্লিজ।’ 

‘বাপ রে! ওর ধারেও আমাকে যেতে দেয় না ওরা। তয়, ভালো আছেরে পাগলা। তর জন্য ওয়েট করতেছে।’ 

ভালোমন্দ যাই হোক সময় তো চলেই যায়। এক চিল্লা প্রায় শেষ। বাড়ি ফেরার তখন আর মাত্র সপ্তাহখানেক বাকি। নিশাতের কাছে ফেরার উত্তেজনায় ওর চোখে ঘুম নেই। রাজ্যের কথা জমিয়ে রেখেছে শফিক। সেগুলো দিনমান

ওলট-পালট করে ফের সাজিয়ে রাখে। একদিন সন্ধ্যায় জামাতের আমির শফিকের হাতে ফোন দিয়ে বললেন, 

‘তোমার বাড়ি থেকে ফোন এসেছে।’ 

স্ক্রিনে জাহাঙ্গীরের নাম ভাসছে।  ফোন কানে ধরেই শফিক চিৎকার দেয়, 

‘দোস্ত আর মাত্র সাতদিন। কতকাল তোর সঙ্গে দেখা হয় না!’

জাহাঙ্গীর চুপ। 

‘কিরে কথা বলিস না কেন?  নিশাতের সঙ্গে দেখা হয়েছে আর? ও কিছু বলে আমার কথা? এতোদিন ফোন করিসনি কেন?’

‘দোস্ত গতকাল রাইতে নিশাতের বিয়া হইয়া গেছে।’

শফিকের মাথার ভেতরে চক্কর দিয়ে ওঠে। চোখের সামনে অন্ধকার। কিচ্ছু দেখতে পাচ্ছে না, কিচ্ছু শুনতে পাচ্ছে না। 

‘দোস্ত, শফিক কী হইছে? শোন আমার কথা। আমরা কিচ্ছু জানতাম না। তুই আইসা যাতে গ্যাঞ্জাম না করতে পারস এর লাইগা হ্যারা চুপি চুপি বিয়া দিছে। কাউরে কয় নাই। নিশাতও আগে থেইকা জানতে পারে নাই বদয়, নাইলে তো আমারে কইত।’

‘চুপ থাক শুয়োরের বাচ্চা। তুই কি করলি আমার জন্য? তোর ভরসায় রেখে আসছিলাম। আমি আজই চলে আসতেছি। ওসব বিয়েটিয়ে আমি মানি না।’ 

ফোন কেটে দেয় শফিক। মসজিদে অন্যসকলে বসে আছে। সেখানে এই মুহূর্তে যাওয়া ঠিক হবে না। দৌড়ে সে তেঁতুলিয়া নদীর ধারে চলে যায়। সন্ধ্যা উৎরে গেছে বেশ আগে। চাঁদের জোয়ারে নদীর পানি চিকমিক করছে। নদীর বুক বেয়ে লণ্ঠন জ্বালিয়ে নৌকা যাচ্ছে। আলগোছে,

নিভৃতে। শুধু বৈঠার ছপছপ শব্দ। শফিকের হৃদপিণ্ডের মতো। শফিক নদীর ধারে ডাঁই করে রাখা সিমেন্টের ব্লকের ওপরে বসে  আকাশের দিকে তাকিয়ে কণ্ঠ ভেঙে কাঁদে। সেখানে শোনার কেউ নেই। মনে হয়েছিল নিশাত ছাড়া বেঁচে থাকা তার পক্ষে সম্ভব নয়। কোনোভাবেই সম্ভব নয়।

অনেকটা সময় পেরিয়ে যাওয়ার পর বেশ দূর থেকে ‘শফিক’ ‘শফিক’ ডাক ভেসে এলো। জুনায়েদের কণ্ঠ। শফিক জবাব না দিলেও জুনায়েদ খুঁজে খুঁজে কাছে আসে। জিজ্ঞেস করে, 

‘কী হয়েছে রে? আমরা সবাই তোকে খুঁজতে খুঁজতে হয়রান হয়ে গেছি। আমির  টেনশন করতেছেন। চল।’

‘তুই যা, আমি আসতেছি। বাড়ি যাব।’

‘কেন কী হয়েছে? আর তো মাত্র সাতদিন। এর পরেই তো নিশাতের সঙ্গে দেখা হবে।’

‘আর দেখা হয়ে কী লাভ? বিয়ে হয়ে গেছে কাল।’

‘কী? বিয়ে হয়ে গেছে? ইস্!’ 

এরপর জুনায়েদও আর কথা বলে না। এখানে একমাত্র জুনায়েদ শফিকের সব কথা জানে। দুই বন্ধু দুটো ব্লকের ওপর নদীর দিকে চেয়ে বসে থাকে। একসময় শফিকই বলে, 

‘চল।’

ওরা মসজিদে ফিরে আসে। শফিক সরাসরি জামায়াতের আমিরের কাছে গিয়ে বলে, 

‘হুজুর শেষ রাতের লঞ্চে আমি ঢাকা যাব।’

আমির খুবই অবাক হন।

‘কী বলছ তুমি? কী হয়েছে? বাড়িতে কোনো সমস্যা?’

‘জি । আমি আজই বাড়ি যাব।’

‘কী সমস্যা? বাবা-মায়ের অসুখ? আমি কথা বলে দেখছি।’

‘না হুজুর, কথা বলতে হবে না। অসুখ না। কিন্তু আমি বাড়িতে যাব।’

‘কী বলছ পাগলের মতো। বিনা কারণে চিল্লা থেকে কেউ এভাবে যায়? জুনায়েদ, কী হয়েছে শফিকের?’

জুনায়েদ আমিরকে একপাশে ডেকে কী বলেছিল শফিক জানে না। তবে হুজুর শফিকের একটা হাত ধরে বলেছিলেন, 

‘আমি বুঝতে পারছি তোমার কষ্ট। নিশ্চয় তুমি বাড়ি যাবে তবে আজকের রাতটা যাক। ইচ্ছে হলে তোমাকে সকালে আমি লঞ্চে তুলে দিয়ে আসব।’ 

শফিক চুপ করে থাকে। ঠিক আছে, সকালেই যাবে। সে রাতে কিছুই খায় না। যখন-তখন চোখ ভিজে উঠছে। সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে, শফিকের চোখে ঘুম নেই। কখন হুজুর পাশে এসে বসেছেন কে জানে। তিনি চুপিচুপি ডাক দিলেন, 

‘শফিক উঠে এসো। বাইরে দেখো কত বড় চাঁদ। চলো বাইরে একটু হাঁটাহাঁটি করে আসি।’

চারপাশ সুনসান। দূরগ্রামের দু-একটা বাড়ি থেকে হালকা আওয়াজে গানের সুর ভেসে আসছে। সম্ভবত রেডিও বাজছে। একটা করুণ রাগ শফিকের বুকের ভেতর মুচড়েই চলেছে। চাঁদের আলো শফিককে আরো বেশি বিমর্ষ করে তুলছে। হুজুর কিছু বলছেন না। আকাশের নিচে দুই ছায়ামানব যেন যুগের পর যুগ ধরে হাঁটছে। দীর্ঘক্ষণ পরে হুজুর মোলায়েম সুরে জিজ্ঞেস করলেন, 

‘শফিক বলো তো এই চাঁদ, আকাশ, গাছপালা, আমি তুমি কার সৃষ্টি?’ 

শফিক মৃদু স্বরে বলে,  ‘আল্লাহ্‌।’

‘তুমি কি জানো স্বামী-স্ত্রী, মা-সন্তান, প্রতিটি সম্পর্কে কে তৈরি করেছেন?’

‘জানি। আল্লাহ্‌।’

‘মেয়েটির যে বিয়ে হলো সেটা নিশ্চয় আল্লাহ-তায়ালার নির্দেশে?’

‘জি।’

‘তুমি আল্লাহর নির্দেশকে অমান্য করবে বা অশ্রদ্ধা করবে?’

শফিক জবাব দেয় না।

‘বলো শফিক, অমান্য করবে?’

‘না।’

‘আলহামদুলিল্লাহ! তাহলে মন থেকে সকল কষ্ট দূর করে দাও। আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করো। আল্লাহ্‌ যা করেন মঙ্গলের জন্য করেন। তুমি কাল বাড়ি যাবে না। আল্লাহ্‌ যা তোমার ভাগ্যে লিখে রেখেছিলেন সেটাই ঘটেছে। যার সঙ্গে মেয়েটির বিয়ের কথা ছিল তার সঙ্গেই হয়েছে। যদি সত্যি তুমি মেয়েটিকে ভালোবেসে থাকো তাহলে আল্লাহর কাছে দু-হাত তুলে মুনাজাত করে বলো সে যেন সুখী হয়।’

শফিক মাথা নিচু করে চুপচাপ হুজুরের সঙ্গে হাঁটতে থাকে। হুজুর বিশাল এক দিঘির পাশ দিয়ে শফিকের হাত ধরে ঘুরছেন আর নানাভাবে বোঝাচ্ছেন। মায়ের কথা, বাবার কথা। একজন নারীই জীবনের সব নয়। বাবা-মায়ের জন্যও ভাবতে হবে। ধীরে ধীরে শফিকের মনোবেদনা অনেকটাই  প্রশমিত হয়ে আসে। 

এরপর বাড়ি ফেরার কথা আর বলেনি শফিক। কিন্তু হুজুর যতই বোঝাক মনকে মানানো এতোই সোজা? পরের দিনগুলো ছিল অসহ্য রকমের বিষণ্নতায় ভরা। সুযোগ পেলেই গভীর রাত পর্যন্ত শফিক নদীর ধারে কোনো একটি ব্লক বেছে নিয়ে তার ওপর চুপচাপ বসে থাকত। তেঁতুলিয়া নদীর তীরে ব্লকের ওপর বসে থাকা টুপিমাথার সেই বিষণ্ন তরুণটি প্রেমের ইতিহাসে হয়তো অমর হতে পারত; কিন্তু প্রেমের জ্যামিতি সবসময় এক নয়, এটাই সত্য।

তাবলিগ জামাত থেকে ফেরার পর শফিক একদম অন্য মানুষে পরিণত হয়েছিল। যেদিকে তাকায় নিশাতের স্মৃতি। বেদনাভারে সবসময় ন্যুব্জ থাকতে থাকতে কুঁজো হয়ে গিয়েছিল শফিক। জাহাঙ্গীর বলেছিল নিশাতের কোথায় বিয়ে হয়েছে, কার সঙ্গে বিয়ে হয়েছে। কিন্তু কিছুই সে মন দিয়ে শোনেনি।  সদ্য এসএসসি পাশ করা ছেলের পক্ষে আর কিছু করাও তো সম্ভব ছিল না। শফিকের সামনে বাড়ির কেউ নিশাতের নাম উচ্চারণ করে না। শফিক নিজেও সচেতনভাবে নিশাতের বাড়ির রাস্তা এড়িয়ে চলে। কিন্তু শফিকের খুব মনে হচ্ছিল একটা কাঁধ দরকার, যেখানে মাথা রেখে সে নিজেকে হালকা করতে পারবে। কিন্তু সেরকম কাঁধ সে পায়নি। একদিন গভীর রাতে সাইকেল চালিয়ে চলে গিয়েছিল হিজল বনের সেই গাছটির নিচে। যেখানে নিশাতের সঙ্গে শেষ দেখা হয়েছিল। গাছটিতে হেলান দিয়ে অনেকটা সময় ধরে কেঁদেছিল। মূলত এরপর থেকেই সে সবকিছুকে ভাগ্য বলে মেনে নিয়ে নিশাতকে ভুলে যেতে চেয়েছিল। 

তিন 

শফিক রিবনটা হাতে নিয়ে নাকের কাছে ধরে। আহ! নিশাতের চুলের সেই ল্যাভেন্ডারের ঘ্রাণ! চোখ বন্ধ করে আরো গভীরভাবে নিশাতকে অনুভব করতে চায় শফিক। স্কুলে যাওয়ার সময় শফিকের সাইকেলের বেল ছিল নিশাতের জন্য সংকেত। বেল শুনলে সে যেখানে যে অবস্থায় থাকুক দৌড়ে চলে আসত। একদিন বেলের শব্দে কাছে আসতেই ওর চুল থেকে টান দিয়ে এই রিবন খুলে নিয়েছিল। তারপর  গন্ধ শুঁকে পকেটে রাখতে রাখতে  বলেছিল, 

‘আমার মৃত্যু পর্যন্ত আমার এই বুকে থাকবি তুই।’ 

‘ইস্ কচু থাকব!’ 

নিশাত ভেঙচি দিয়ে ছুটে চলে গিয়েছিল। তবে প্রায় প্রতিটি ধোয়া শার্ট পরার পর নিশাত চেক করে দেখত রিবনটা পকেটে আছে কি না। রিবনটার স্পর্শ পেলে ওর চোখে যে-খুশির ঝলক দেখা যেত সহস্র রকমের রং ছিল তার।  

পাশে রাখা মোবাইল বারবার গোঁ গোঁ শব্দ করে থেমে যাচ্ছে। নাদিয়া ফোন করেই যাচ্ছে। শফিক ফোন ধরে না। শফিক ঠিক বুঝতে পারে না এতো বছর পর চুলের সামান্য একটি রিবন দেখে বুকের মধ্যে এমন খাখা করছে কেন? নিজেকে এতো

উথালপাথাল অসহায় লাগছে কেন? তাহলে গত তিন বছর কি নাদিয়ার সঙ্গে অভিনয় করে গিয়েছে? বুকের ভেতরে নিশাতই এতোকাল ঘুমিয়ে ছিল যে আজ আচমকা জেগে উঠল? সেই ঘটনার পর শফিক এতোটা ইন্ট্রোভার্ট হয়ে গিয়েছিল যে, কোনো মেয়ের দিকে সে ফিরেও তাকাত না। ঠিক করেছিল সারাজীবনে আর প্রেম দূরে থাকুক, বিয়েই করবে না। কিন্তু ভার্সিটিতে পড়ার সময় নাদিয়া কীভাবে কীভাবে যেন ওর জীবনে চলে এলো। নাদিয়ার সঙ্গে ওর প্রেম এতোটা গভীরে চলে গিয়েছিল যে, গত তিন বছরে সে নিশাতের কথা তেমনভাবে মনে করেনি। 

বেশ অনেকদিন পর জাহাঙ্গীরকে ফোন করে শফিক। ফোন ধরেই ঝাড়ি দেয় জাহাঙ্গীর,

‘আবে হালা, এতোদিন পর আমার কথা মনে পড়ল?’

‘সরি রে দোস্ত, নম্বর হারিয়ে ফেলেছিলাম।’ 

‘হুম বুজছি। তো ফোন করছিস ক্যান ক। আমি জানি বিনা দরকারে ফোন করার বান্দা তুই না।’

‘দোস্ত,  নিশাতের ফোন নম্বরটা একটু দিতে পারবি?’

‘কস কি? এতোদিন পরে নিশাত কেন? নাদিয়া কি গেছে গিয়া?’

‘নারে, একটু দরকার, দে তুই প্লিজ।’

‘দেখ ভাই, অর বিয়ে হইছে নয় বছর হয়ে গেছে। দুই পোলাপানের মা। তুই নতুন কইরা ওর সংসারে আগুন লাগাইস না।’

‘ধুর কী বলিস এসব। আমি জাস্ট একটু কথা বলব, প্লিজ দে। আচ্ছা নম্বর না থাকে ওর ফেসবুক আইডিটা দে।’

‘প্রথম কথা, ওর ফোন নম্বর আমার কাছে নাই। আর ফেসবুকের আইডিও জানি না।’

‘আল্লাহর দোহাই লাগে যেভাবে হোক জোগাড় করে দে।’

‘ধুর শালা! ক্যান আবার পাগলাইছস কে জানে। এতোদিন তো কিছু জিগাইস নাই।  রাখ দেখতেছি।’

জাহাঙ্গীর প্রায় পনেরো মিনিট পরে ফোন ব্যাক করে। এই পনেরো মিনিট শফিকের কাছে পনেরো ঘণ্টা মনে হয়।

‘দেখ মেসেঞ্জারে ওর আইডি নেইম আর মেইল পাঠাইছি। হুন একটা কথা রাখিস। খবরদার কোনোরকম ক্ষতি যেন না হয় দোস্ত। হুনছি খুব সুখে আছে ও।’

‘আচ্ছা আচ্ছা। সেসব নিয়ে তোকে ভাবতে হবে না।’

মেইল অ্যাড্রেস দিয়ে সার্চ দেয় শফিক। আইডি নেইম ‘মেঘের দেশের পরী’। পরী নাম দেখেই বুকের মধ্যে ঢিপঢিপ করে। ডিপিতে ফুটফুটে দুটো বাচ্চার ছবি। মেয়েটা সম্ভবত বছরসাতের। হুবহু নিশাত। কভারে একটা পরীর ছবি। ঘণ্টা ধরে শফিক নিশাতের প্রোফাইল ঘাঁটতে থাকে। কোথাও নিশাত বা ওর স্বামীর  ছবি নেই। হয়তো পর্দানশিন। দুই বছর আগে খোলা প্রোফাইলের প্রথম করা একটা পাবলিক পোস্টে শফিকের চোখ আটকে যায়। ‘তুমি আমার প্রথম সকাল …’ গানটি শেয়ার করে ক্যাপশনে লেখা ‘কোনো এক যুবরাজকে’। শফিকের সমস্ত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ শিরশির করে ওঠে। নিশাত এখনো শফিককে ভোলেনি। এই গানটা ছিল দুজনের সব থেকে প্রিয়। দুজনে মিলে অসংখ্যবার শুনেছে। শফিক ইনবক্স ওপেন করে। কী লিখবে কী লিখবে ভাবতে ভাবতে লেখে, 

‘হ্যালো পরী। চিনতে পারছ? আমি সেই যুবরাজ।’ 

সেন্ড বাটনে চাপ দেওয়ার পর থেকেই চলতে থাকে অপেক্ষা। কখন জবাব আসবে। কতদিন পর ওর সঙ্গে কথা হবে! ফোনের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আসে শফিকের। কিন্তু জবাব নেই।   

এদিকে নাদিয়া ফোন করে করে না পেয়ে মেসেজ করতে থাকে। প্রথমে রেগে রেগে, তারপর অনুরোধ করে। এখন নাদিয়ার সঙ্গে কথা বলা মানে সম্পর্ক নষ্ট হওয়ার মতো ঝগড়া হয়ে যেতে পারে। তবুও রাতে ফোন ব্যাক করে শফিক। যা ভেবেছিল তাই, প্রশ্নের পর প্রশ্ন,

‘এই কী হয়েছে তোমার? কোথায় তুমি? সারাদিন ফোন ধরছ না, ব্যাক করছ না। অফিসেও যাওনি?’

‘কিছু হয়নি তো। শরীর একটু খারাপ ছিল। অফিস থেকে এসে ঘুমিয়ে গিয়েছিলাম।’

‘শরীর খারাপ? কী হয়েছে? আমাকে বললে না কেন? শরীর খারাপ হলে একটা ফোন দেওয়া যায় না?’

‘নাদিয়া, প্রচণ্ড মাথাব্যথা। সকালে কথা বলি প্লিজ!’

‘ঠিক আছে। তোমার ইচ্ছা।’

নাদিয়া রাগ করে ফোন কেটে দেয়। অন্য সময় হলে শফিক রাগ ভাঙানোর জন্য ফোন ব্যাক করত; কিন্তু আজ করে না। নিশাতের জবাবের অপেক্ষায় থাকতে থাকতে একসময় ঘুমিয়ে পড়ে। এভাবে তিনদিন চলে গেছে। অফিসে যাচ্ছে-আসছে; কিন্তু কোথাও যেন মন নেই। এর মধ্যে নাদিয়ার সঙ্গে দু-তিনবার কথা হলেও দেখা করার বিষয়টি নানা বাহানায় এড়িয়ে গিয়েছে। শফিক জানে, এই অবস্থায় নাদিয়ার সামনে গেলে সন্দেহ করবে এবং জেরা করে সত্যিটা টেনে বের করে আনবে। 

অফিস থেকে ফিরে সিলিংয়ের দিকে তাকিয়ে চুপচাপ শুয়ে ছিল শফিক। মাথার পাশেই ল্যাপটপে ফেসবুকে লগইন করা। টুংটাং আওয়াজে  ল্যাপটপের স্ক্রিনে একটা মেসেজ পপ-আউট হয়। শফিক কাত হয়ে দেখে লাফ দিয়ে উঠে বসে,

‘কোন যুবরাজ?’

শফিকের বুকের মধ্যে হাতুড়ি পেটাচ্ছে কেউ। কাঁপা কাঁপা হাতে লেখে,

‘তোমার যুবরাজ।’

‘শফিক?’

‘হুম।’

‘এতোদিন পর পরীকে মনে হলো?’

‘তুমিও তো মনে করোনি।’

‘করেছি কি না কী করে জানলে?’

‘এই পরী, কেমন আছো তুমি?’

‘কেমন আছি মনে হয়?’

‘ভালোই আছো হয়তো। ফুটফুটে দুই বাচ্চা তোমার।’

‘হুম ভালোই তো। তুমি কেমন আছো? বিয়ে করেছ?’

‘তুমি যেমন রেখেছ। বিয়ে তো হিজল বনে অনেক আগেই করেছিলাম।’

‘সে তো ছিল ছেলেখেলা। এই, সত্যি তুমি বিয়ে করোনি?’

‘উঁহু।’ 

‘প্রেম করেছ?’

‘করেছিলাম অনেক বছর আগে।’ 

‘ইস্! যে নায়কের মতো চেহারা তোমার। প্রেম তো অনেকগুলোই করেছ মনে হয়।’

‘সত্যি নায়কের মতো?’

‘হুম। ড্যাশিং মার্কা ছবি দিয়েছ দেখলাম প্রোফাইলে। আচ্ছা, আমাকে ভুলে গেছো না?’

‘ভুললে তোমাকে খুঁজে বের করতাম? আচ্ছা তোমার কোনো ছবিই দেখলাম না, একটা ছবি দাও না। ফোন করি?’

‘না, ফোন করা যাবে না। বাসায় সবাই আছে। আর তুমি তো পরপুরুষ, অন্যের বউয়ের ছবি দেখা পাপ।’

‘তুমি আগে আমার বউ, তারপর অন্যের। ভুলে গেছো সব কথা? তোমার শরীরের এমন কোনো জায়গা আছে যেখানে আমার স্পর্শ নেই?’

‘এসব কথা বলো না প্লিজ।’ 

‘ঠিক আছে বলব না। কিন্তু আমি তোমাকে দেখতে চাই এই মুহূর্তে।’

‘আজ নয় শফিক, অন্যদিন। এখন বাই।’

শফিকের জবাব না শুনেই নিশাত অফলাইনে চলে যায়। নিজের ওপর রাগ হয়, ফোন নম্বরটা কেন নিল না।

বেশ অনেক রাতে নিশাতই নক করে,

‘ঘুমিয়ে পড়েছো?’

‘না, ঘুম আসছে না। তুমি?’

‘আমারও ঘুম আসছে না …’

শুরু হয় কথা বলার সিলসিলা। দিন নেই রাত নেই শফিকের আঙুল আর চোখ মোবাইলে লেগে থাকে। মোবাইলের  প্রতি অত্যধিক প্রীতি দেখে অফিসের কলিগেরা মুখ টিপে হাসে। ঠোঁটকাটা রেশমি সেদিন বলেই ফেলে,

‘কী ব্যাপার শফিকভাই, সব কথা এখনি শেষ করে ফেলছেন, বিয়ের পরে কী বলবেন?’

শফিক মুচকি হাসে। নাদিয়া ফোন করে  খুবই বিরক্ত হয়, রেগে যায়, 

‘তোমার ফোন ইদানীং এতো ওয়েটিংয়ে থাকে কেন, কার সঙ্গে কথা বলো?’ 

শফিক একেক সময় একেকজনের কথা বলে। এসব কারণে একদিন ফোনে তুমুল ঝগড়া। শফিক ঝাঁজ নিয়ে বলে, 

‘দেখো এতো ডমিনেট করার চেষ্টা করো না। আমারও পার্সোনাল কোনো ইস্যু থাকতে পারে।’

‘ওহ, আজ মনে হচ্ছে আমি তোমাকে ডমিনেট করছি? এই পার্সোনাল ইস্যু এতোদিন কোথায় ছিল তোমার?’ 

‘দেখো আমি ঝগড়া করতে চাচ্ছি না। পরে কথা বলব, এখন রাখছি।’

‘পরে আর কথা বলতে হবে না তোমাকে। অনেক বলেছ।’

সেদিনের পর চার-পাঁচদিন হয়ে গেল নাদিয়া আর ফোন করেনি। শফিকও করেনি। তিন বছরে এটাই মনে হয় প্রথম যে এতোদিন ধরে ওদের মধ্যে যোগাযোগ নেই। শফিক বুঝতে পারছে, বিষয়টা একদম ঠিক হচ্ছে না। কিন্তু এরপরেও নিশাতের দিকে সে প্রবল পরাক্রমশালী চুম্বকীয় টানে ক্রমাগত ধেয়ে যাচ্ছে। নিশাতও যেন সবকিছু তুচ্ছজ্ঞান করে শফিকেই ধ্যানমগ্ন হয়ে আছে। 

নয় বছর আগে নিশাত এতো বেশি কথা বলত না। এখন সে যেন প্রগলভ হয়ে উঠেছে। ওর ব্যবসায়ী স্বামী দোকানের হিসাব-নিকাশ শেষ করে বাসায় ফিরতে ফিরতে রাত বারোটা-একটা বেজে যায়। বাচ্চারা ঘুমিয়ে পড়লে নিশাত কখনো ফোন করে, কখনো বা মেসেঞ্জারে নক করে।

‘আছো?’

‘হুম।’

‘কী করছো?’ 

‘অপেক্ষা। হাহাহা। তুমি?’

‘আমিও। আচ্ছা তোমার মনে আছে রোজার সময় সবাই যখন তারাবিহ পড়তে যেত তুমি ফাঁকি দিয়ে কী করতে?’

‘হুম, খুব মনে আছে। আমি তোমার ঘরের বাইরের জানালাঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকতাম, তুমি গ্রিলের ফাঁক দিয়ে আমার মাথার চুল টেনে দিতে। হাতের আঙুল ফুটিয়ে দিতে।’ 

‘হুম জানালার গ্রিলের মাঝের ফাঁকাগুলো খুবই ছোট ছিল। আমার খুব কষ্ট হতো, তবুও তুমি জিদ করতে। দস্যু টাইপ ছিলে। কিন্তু জানো, তোমার দস্যুপনাই আমার বেশি ভালো লাগতো।’  

‘ভাবো তো, তুমি ঘরের মধ্যে আর আমি ঘরের বাইরে। আকাশে আলোর বন্যা। গাছের মধ্যিখানে ঝিকমিক করতো রাতের রোদ। তোমার পেলব ছোট্ট হাত যখন আমার মাথা স্পর্শ করতো তখন অনির্বচনীয় এক সুখ! উফ্! ইদানীং আমি ওইসব দিন খুব মিস করি গো।’

‘ওহ ইদানীং মিস করো, আগে করোনি?’

‘আরে না সেটা নয়, তবে ইদানীং খুব বেশি মিস করি।’

‘তুমি আমার জন্য দোলনা বানাতে গিয়ে বুক ছিলে ফেলেছিলে। বাপ রে তোমার বুকের জমাট রক্ত দেখে আমি কি কান্না!’

‘তুমি তো আস্ত স্বার্থপর! গাছে ওঠার কথা ভাবলেই আমার পায়ের তলা ঘেমে উঠতো ভয়ে। আর তোমার দোলনা চাই-ই। কত কষ্ট করে তোমার জন্য খই ফল পেড়ে আনতাম। গাছের প্রথম পাকা আমটা তোমাকে খাইয়েছি আর সেই তুমি আমাকে ছেড়ে অন্য জায়গায় বিয়ে করলে। এমন কেন করেছিলে নিশাত?’

‘সে অনেক কথা। দেখা হলে বলব।’

‘কবে দেখা হবে আমাদের?’

‘খুব তাড়াতাড়ি। ইস্, তোমার সাইকেলে যদি আবার চড়তে পারতাম! কেমন আদর করে বুকের সঙ্গে মিশিয়ে রাখতে। আচ্ছা তুমি পেছনের সিটে না বসিয়ে সাইকেলের সামনের রডে বসাতে কেন? আমার ব্যথা লাগত; কিন্তু তোমার ভয়ে চুপ থাকতাম।’ 

‘কোথায় ব্যথা লাগতো? হাহাহাহ।’

‘যাহ। অসভ্য।’ 

‘শোনো  বুকের সঙ্গে মিশে থাকবে বলে রডের ওপর বসাতাম। আরেকটা কারণ ছিল।’ 

‘কী?’

‘তোমার চুল উড়ে আমার চোখে-মুখে লাগতো। কি সুন্দর ল্যাভেন্ডারের ঘ্রাণ, উফ্! আচ্ছা এখনো এমন ঘ্রাণ আছে?’

‘ওমা সে আমি কী করে বলব?’

‘কেন বর বলে না?’

‘হুহ! তার এতো সময় কোথায়?’

‘শোনো এখন একটা ছবি দাও না।

অথবা ভিডিও কল করি? তোমাকে দেখার জন্য আমার চোখ দুটো মরুভূমি হয়ে আছে।’

‘ইস্! কী প্রেম! এতো বছর ছিলে কীভাবে? আর কটা দিন। সামনা-সামনি দেখা হোক, সেদিনই আমাকে দেখে নিও।’ 

‘আগের চেয়ে অনেক সুন্দর হয়েছ এখন, তাই না?’

‘নিজের কথা কেউ বলে? দেখলেই বুঝবে।’

‘আচ্ছা, একটা কথা বলবো?’

‘বলো।’

‘এখন যদি আমি তোমাকে বলি চলে এসো। আসবে?’

‘আসবো।’

‘কী বলছো? সংসার ফেলে সত্যি আসবে?’

‘হুম আসবো শফিক। আমার বাচ্চাদের আপন করে নিতে পারো যদি আসবো।’ 

‘বাপ রে কী সাহস!’

‘হুম, সেদিন যদি এই সাহস দেখাতে পারতাম আমাদের আলাদা থাকতে হতো না।’

কি আশ্চর্য এসব কথা বলার সময় শফিক একটু ভাবছে না। নিজের কাছে নিজেকেই অচেনা লাগে শফিকের। নাদিয়ার কথা মনে এলো না? দুই সপ্তাহ আগেও নাদিয়াকে ছাড়া অন্য কোনো নারীর কথা ভাবতেই পারেনি। কোনো কারণে নাদিয়া অভিমান করে থাকলে দুনিয়াদারি বিস্বাদ হয়ে যেতো। রূপে-গুণে-স্মার্টনেসে নাদিয়াকে প্রেমিকা বা স্ত্রী হিসেবে পাওয়া যে-কোনো পুরুষের জন্য সৌভাগ্য। দেড় মাস পরেই নাদিয়ার সঙ্গে বিয়ে ঠিক হয়ে আছে। কার্ড পর্যন্ত ছাপানো শেষ। আর আজ কি না নিশাতকে ফিরে পেতে চাইছে? নিশাত নিজেও কেন তার  নিজের এতোদিনের সংসারকে তুচ্ছজ্ঞান করে ওর কাছে চলে আসতে চাইছে? তাহলে কি প্রথম প্রেমই প্রকৃত প্রেম! কোনটা সত্যি? নাদিয়া, নাকি নিশাত? এ কোন ঘোরের মধ্যে সে আটকে আছে! সবকিছু হাওয়ায় হাওয়ায় উড়ছে রঙিন প্রজাপতির মতো! 

ভালোই তো ছিল শফিক। হুট করে একটা রিবনের মধ্য দিয়ে নিশাত হাজির হয়ে এতো বছরের ব্যবধান ঘুচিয়ে দিলো। যেন কখনো ওরা সংযোগছুটই হয়নি। সবকিছু আগের মতো ঝকঝকে। অথবা হতে পারে, প্রথম প্রেমের সেই অবিন্যস্ত মাঠঘাটের সকাল-দুপুর-সন্ধ্যার অসমাপ্ত গল্পগুলোর সমাপ্তি ঘটাতে এই ব্যস্ততা বা উদগ্রতা। 

এসব আকাশ-পাতাল ভাবতে ভাবতে শফিক অফিস থেকে বের হতেই অনেকদিন পর নাদিয়ার ফোন।

‘শফিক আমি সরি ওইদিনের জন্য। প্লিজ তুমি রাগ করে থেকো না। কাল আসো, আগামীকাল খাট ডেলিভারি দেওয়ার কথা মনে আছে?’

‘সরির কিছু নেই নাদিয়া। আমি রাগ করিনি। আমার আসলে শরীর ভালো থাকে না। তাছাড়া তুমি তো সবকিছু দেখছো। রাজীবকে নিয়ে খাটটা এনে নাও। আমি কদিন রেস্টে থাকতে চাই।’

‘তুমি অফিস করতে পারছো আর আমার সঙ্গে বের  হতেই অসুবিধা? বিয়ের আর কদিন বাকি আছে? সবকিছু আমি একাই করবো?’

‘একা তো করতে বলছি না। আমি একটু সময় চাচ্ছি। আর বিয়ের এখনো অনেকদিন বাকি। আগেভাগে এতো বেশি ভাবো কেন তুমি? মানুষের জীবনেরই ঠিক নেই, কে কখন মরবে আর তুমি আছো বিয়ে নিয়ে।’

‘এসব কী বলছো তুমি? বিয়ে কি আমার একার?’

‘এতো কিছু আমি জানি না। বিয়ের কথা ভাবতে আমার ভালো লাগছে না।’

‘মানে?  সত্যি করে বলোতো কোনো কারণে কি তুমি বিয়ে করতে চাইছো না?’

‘আমি জানি না আমি কী চাই। এখন রাখছি।’ 

নাদিয়া কে? হুহ থোড়াই কেয়ার করে শফিক। নিশাতের সঙ্গে আগামীকাল দেখা হবে। প্রায় নয় বছর পর! ভাবতেই সমস্ত শরীরে বিটোফোনের ঝংকার। চোখের সামনে কোঁকড়া চুলের সুগোল একটা পবিত্র মুখের স্কেচ সেঁটে আছে। ড্যাবডেবে দুটো  চোখে অচিন নেশা। শফিক  বুঁদ হয়ে থাকে।     

বাসায় ফিরে ফ্রেশ হয়ে শফিক নিশাতকে নক করে,

‘কী করছো?’

‘কিছু না।’

‘কিছু করছো না কেন? কিছু একটা করো।’

‘হাহাহা। তুমি আগের মতোই দুষ্টু আছো। আচ্ছা শোনো।’

‘বলো।’

‘কাল আমার প্রিয় রঙের শার্ট পরে আসবে কিন্তু। তাহলে বুঝবো আমাকে তোমার মনে আছে কি না।’

‘হুম জনাবা। তুমিও আমার প্রিয় রং পরে আসবে। আমিও দেখি কেমন মনে আছে আমাকে।’

‘আমি জিতবো।’

‘উহু, মনে হয় না। আমিই জিতবো।’

‘দেখা যাবে। শোনো দেরি করবে না কিন্তু। আমি বেশি সময় বাইরে থাকতে পারবো না।’

‘কখনো দেরি হয়েছে আমার?’

‘হুম, এটা ঠিক, কখনোই আমি তোমার আগে যেতে পারিনি। এই তুমি কি এখনো আগের মতো কথায় কথায় রেগে যাও?’

‘বাহ, আমি খুব রাগী ছিলাম নাকি?’

‘বাপ েের! ছিলে না মানে? কতবার আমাকে মেরেছো তুমি, মনে আছে?’

‘সে তো তুমি অন্য ছেলেদের সঙ্গে কথা বললে শুধু মারতাম। তখন তো অতো বুঝতাম না, বাবা! তুমি কত কেঁদেছো। তার জন্য সরি।’

কে যেন কলিংবেল চেপেই যাচ্ছে। বাসায় আর কেউ নেই। মেসেজটা সেন্ড করে শফিক গিয়ে দরজা খোলে। সামনে নাদিয়া। চোখ-মুখ লাল টকটকে। বোঝা যাচ্ছে প্রচুর কান্নাকাটি করেছে। প্রমাদ গোনে শফিক। শফিককে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে ধাক্কা মেরে নাদিয়া শফিকের ঘরে ঢোকে। নাদিয়ার কণ্ঠ ভাঙা, চুল অবিন্যস্ত। অস্থিরভাবে প্রশ্ন  করে,  

‘কী হয়েছে তোমার? গত এক মাস ধরে এমন করছো কেন তুমি?’

শফিক একগ্লাস পানি এগিয়ে দেয়, 

‘সব বলছি, তুমি একটু শান্ত হও। পানি খাও একটু।’

‘মাই ফুট। তোমার পানি।’ 

এক ধাক্কায় পানির গ্লাস ছুড়ে ফেলে নাদিয়া। ঝনঝন শব্দে সারাঘরে কাচের টুকরো ছিটকে পড়েছে। শফিকের বেদম রাগ হয়; কিন্তু নিজেকে নিবৃত্ত করে। বিছানার ওপরেই শফিকের ফোনটা ছিল। হুট করে নাদিয়া ফোনটা হাতে তুলে নেয়। শফিক হাত থেকে ফোনটা কেড়ে নিতে এগিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু নাদিয়া বাঘিনীর মতো ফোঁস করে ওঠে, 

‘খবরদার, সামনে এগোলে ফোন ভেঙে ফেলব। আমি দেখতে চাই, কী এমন হয়েছে যে হঠাৎ করে তুমি এতোটা বদলে গেলে।’

শফিক দূরে হতভম্বের মতো দাঁড়িয়ে থাকে। নাদিয়া মেসেঞ্জারে স্ক্রল করছে। ধীরে ধীরে ওর মুখ আরো লাল হয়ে যাচ্ছে। ঘনঘন শ্বাস পড়ছে। এতোদিনে  নিশাতের সঙ্গে লক্ষ কথা হয়ে গেছে। কিছুক্ষণ দেখে নাদিয়া খুব শান্তভাবে ফোনটা আগের জায়গায় রেখে দেয়। শফিক কী বলবে কিছুই বুঝতে পারছে না। নাদিয়া বেশ খানিকটা সময় মাথা নিচু করে বসে থাকে। ওর চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়ছে। শফিকের বুক টনটন করে ওঠে। একবার মনে হলো ছুটে গিয়ে  জড়িয়ে ধরে নাদিয়াকে। পায়ে ধরে ক্ষমা চেয়ে নেয়। আগে বহুবার বহু অপরাধ করে নাদিয়ার পায়ে ধরেছে শফিক। বহু মেয়েকে নিয়েই নাদিয়া বিভিন্ন সময়ে অভিযোগ করেছে। শফিক ক্ষমা চাইতে মুহূর্ত দেরি করেনি। কারণ মাঝে মধ্যে ফ্ল্যাটারিং করলেও নাদিয়ার জায়গায় কখনো কাউকে চিন্তাও করেনি শফিক। কিন্তু আজ ওর কাছে ক্ষমা চাইতে আড়াল থেকে কেউ একজন বাধা দিচ্ছে। শফিক কিচ্ছু বলতে পারে না। নাদিয়াও আর কোনো কথা বলে না। চোখ মুছে ব্যাগ থেকে বিয়ের কার্ডটা বের করে। সেটিকে ছিঁড়ে কুচিকুচি করে পায়ের কাছে ফেলে দেয়। একবারও শফিকের দিকে না তাকিয়ে সেই ছেঁড়া টুকরোর ওপর দিয়ে হেঁটে বের হয়ে যায় নাদিয়া। শফিক দেখে তার ভালোবাসা, তার প্রেম, হবু স্ত্রী  চোখের সামনে থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। অথচ তাকে আটকানোর মতো কোনো শক্তিই সে নিজের মধ্যে খুঁজে পাচ্ছে না।

সারারাত দুই চোখের পাতা এক করতে পারে না শফিক। স্মৃতির ফিতায় বদলে বদলে দু-ধরন আর দুই সময়ের চিত্র ঘুরপাক খাচ্ছে। একদিকে নির্মল হাস্যোজ্জ্বল কিশোরী মুখের ঝিলমিল সুখ, পরমুহূর্তে বেদনাহত দুটো চোখের গভীরের দীর্ঘ বেদনা। কিশোর আর যুবক সত্তা দুজন আজ মুখোমুখি। কোনোটিকেই অস্বীকার করার সাহস পাচ্ছে না শফিক। এ এক অসহ্য রকমের অনুভূতি। এপাশ-ওপাশ করতে করতে সুবেহ সাদেকের আগে ঘুমিয়ে পড়ে শফিক। দুপুর নাগাদ যখন ঘুম ভাঙে তখন প্রথমেই মনে হয়, আজ নিশাতের সঙ্গে দেখা হবে।   

নিশাত বলেছে, বিকেল চারটার মধ্যে ধানমণ্ডি লেকের পাশে থাকতে। ওর বাসা  শ্যামলী। শফিকের বাসা বেশি দূরে নয়। শফিক বেশ আয়োজন করে প্রস্তুতি নেয়। গত সপ্তাহে মার্কেট থেকে নিশাতের প্রিয় রঙের হাফ হাতা শার্ট কিনে এনেছে।  অফিস থেকে ফেরার পথে জুতাগুলো পালিশ করে নিয়েছে। শফিক সম্পূর্ণ রেডি হয়ে ঘরের ছোট আয়নার সামনে দাঁড়ায়। ইস্! দাড়িগুলো আরেকটু ছোট করা দরকার ছিল। কিন্তু এখন আর সময় নেই। শফিক খুব যত্ন করে রিবনটাকে বুকপকেটে রাখে। এটা দেখিয়ে নিশাতকে সারপ্রাইজ দেবে।  

ছুটির দিন থাকায় রাস্তায় খুব একটা জ্যাম নেই। বাইকে পনেরো মিনিটেই পৌঁছে যায় শফিক। সরোবরের আট নম্বর ব্রিজের কাছে একটা বেদিতে রাস্তার দিকে মুখ করে বসে। এদিক দিয়েই নিশাতের আসার কথা। অপেক্ষা যেন শেষ হতে চায় না। পরপর কয়েকটা সিগারেট শেষ করে ফেলেছে। সাড়ে তিনটে নাগাদ নিশাতকে টেক্সট করে,

‘আরে কই তুমি? বসে থাকতে থাকতে  গাছ হয়ে যাচ্ছি।’ 

প্রায় আধাঘণ্টা পরে জবাব আসে, 

‘এই তো বেরিয়েছি, দশ মিনিট লাগবে। প্লিজ রাগ করো না।’

‘হুম, রাগ করেই বা কী।’

‘হুম তোমার প্রিয় রং পরেছি। চিনে নিতে হবে কিন্তু।’

‘সে তো নেবোই। তুমি চিনতে ভুল না করলেই হলো। শোনো আট নম্বর ব্রিজের কাছে আমি।’ 

‘আচ্ছা আমি তিন মাইল দূর থেকে দেখলেই চিনবো তোমাকে।’

‘দেখা যাক। কিসে আসতেছো?’

‘রিকশায়।’

‘নেমে ফোন দিও।’

‘ওকে।’ 

ছুটির দিন অসংখ্য কাপলের ডেটিং প্লেস এই লেক। রংবেরঙের পোশাকে মেয়েরা প্রজাপতির মতো উড়ে বেড়াচ্ছে।  শফিক খুঁজছে কালো রঙের শাড়ি পরা মেয়েটিকে। কিন্তু না, এখনো আসেনি কেউ। শফিক ফোন করে,

‘এই কই তুমি?’

‘আমি তো এসেছি তোমার ফোনে কানেক্ট হচ্ছিল না। আমি আট নম্বর ব্রিজের কাছে; কিন্তু কই তোমাকে তো দেখতে পাচ্ছি না।’

কথা বলতে বলতেই শফিক প্রায় সামনে নীল রঙের শাড়ি পরা মেয়েটিকে দেখে। মেয়ে বললে ভুল হবে, একজন পরিণত বয়সের নারী। ওর কথা শোনা না গেলে হয়তো শফিক বুঝতেই পারতো না এটাই নিশাত। কিন্তু নীল শাড়ি তো কখনোই শফিকের প্রিয় ছিল না। ওর প্রিয় রং কালো। গোলগাল মুখের জায়গায় ধারালো চেহারার এই নারীটিকে শফিক নিশাতের সঙ্গে একদম মেলাতে পারছে না। কোথায় সেই প্রিয় কোঁকড়া চুল? তার জায়গায় রিবন্ডিং করা স্ট্রেইট চুলে বাদামি আর বেগুনি রঙের ঝিলিক। ভারি মাশকারায় চোখের পাপড়ি নুয়ে পড়েছে, তার ওপর নীল-সবুজের পুরু শেড। ন্যুড কালার লিপস্টিক আর কড়া মেকআপের আড়ালে চিবুকের খয়েরি গর্ত হারিয়ে গেছে। চোয়ালে লাগানো রঙের মতো সুখ আর সচ্ছলতা ওর শরীর বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে। কৈশোরে যে মেয়েটিকে শফিক চিনতো তার সঙ্গে এই নারীর আকাশ-পাতাল তফাৎ। শফিক চট করে গাছের আড়ালে সরে যায়। ওর বুকের মধ্যে স্বপ্নভাঙার ধুপধাপ শব্দ। নিশাত ফোন কানে নিয়ে উ™£ান্ত চোখে চারপাশে খুঁজছে। শফিক মেসেজ পাঠায়,

‘সরি নিশাত, চলে যাচ্ছি।  দূর থেকে তোমাকে দেখে নিয়েছি। সুখে থাকো তুমি। আজকের পর আর কখনো আমাদের কথা হবে না।’ 

ফোনের সুইচ অফ করে দেয় শফিক। ব্রিজের অন্যধারে গিয়ে চুপচাপ বসে সিগারেট ধরায়। ধীরে ধীরে কোলাহল বাড়ছে। সামনের বেদিতে প্রেমিকার  কোলে মাথা রেখে লম্বা হয়ে  শুয়ে আছে প্রেমিক। মেয়েটির চুল ছেলেটির মুখ মাথা ঢেকে ফেলেছে।  ওদের গায়ে চাঁদের বাতি। এরকম বহু বহু সন্ধ্যা নেমেছিল শফিকের হাতে ধরা আরেকটি হাতে, বাহুতে আর সমস্ত অবয়বে। এখানেই বসে ঠোঁটে ঠোঁট ছুঁয়ে শফিক গাঢ় কণ্ঠে বলেছিল, 

‘প্রিয় নাদিয়া, তুমি আমার সন্ধ্যাবাতি, ভোরের সূর্য। তোমাকে ছাড়া আমি বাঁচবো না।’  

অথচ কালই তো ওর চোখ দিয়ে কত কত কান্না ঝরে পড়লো। 

শফিক পকেট থেকে রিবনটা বের করে লেকের পানিতে ছুড়ে দেয়। ছোট একটা জিনিস, তেমন আলোড়ন তুললো কি না বোঝা গেল না। ভাসতে ভাসতে একসময় পানির কোথাও তলিয়ে যাবে হয়তো, যেমন তলিয়ে গেছে কিশোরমনের দিনগুলো। 

রাত বাড়ছে। শফিক নিকোটিনের ধোঁয়ার মধ্যে বসে থাকে। কিছুটা দূরে কেউ  গাইছে, আজ জোছনা রাতে সবাই গেছে বনে …

কালকের ঘটনার পর নাদিয়া আর ক্ষমা করবে কি না জানে না শফিক, তবুও ফোনটা অন করে। নাদিয়ার নম্বর প্রেস করে। ওপারে করর্ােরেট কণ্ঠে কেউ একটানা বলেই চলেছে, 

‘এই মুহূর্তে আপনার মোবাইল সংযোগ দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না।’ 

‘আমাকে ক্ষমা করো নাদিয়া।’ 

স্বগতোক্তি করে শফিক। নিজের কণ্ঠস্বর নিজেকেই ব্যঙ্গ করে। ধাক্কা খায় লেকের ঝিকমিকে জলের গভীরে। সেখান থেকে সর্পিল গতিতে উঠে আসে আর এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের কোথাও হারিয়ে যায় হয়তোবা।  অথবা ঝুলে থাকে ব্যর্থ মানুষের  লাশ হয়ে।