শঙ্খ ঘোষের কবিতা : একটি অলীক সংলাপ

(আধুনিক বাংলা কবিতার অলোকসামান‍্য ব‍্যক্তিত্ব শঙ্খ ঘোষ করোনাকবলিত হয়ে বিদায় নিলেন। তিনি বেঁচে থাকবেন তাঁর সৃষ্টির মধ্যে। তাঁর কবিপ্রতিভার আলোচনা, বিশ্লেষণ বহু হয়েছে এবং ভবিষ্যতেও হবে। আমরা এখন শোকের ভার লাঘব করতে পরলোকে বিশ্বাস স্থাপন করে ফিরে যাব স্বর্গোদ‍্যানে, যেখানে তিনি তাঁর সতীর্থ, গুণমুগ্ধ কয়েকজনের দেখা পেয়ে সংলাপে মগ্ন হয়েছেন। চলুন, আমরা চুপ থেকে ওনাদের কথোপকথন উৎকর্ণ হয়ে শুনি।)

শঙ্খ ঘোষ (স্বর্গোদ‍্যানের অতিথিনিবাসের একটি ঘরে আরামকেদারায় হেলান দিয়ে স্বগতকথনে মগ্ন) : একটা বৃত্ত বুঝি শেষ হলো। শেষ হলো কি! নাকি শুরু? ভবিষ্যৎই এর উত্তর দেবে। জানি না ভবিষ্যতের পাঠক আমার কবিতা পড়বে কি না! পড়লেও কীভাবে পড়বে? কী হবে তাদের মূল‍্যায়ন? অবশ্য সেই ভাবনায় মগ্ন থাকার কোনো অর্থ হয় না। আসল তো সময়। সময়ই এর উত্তর দেবে। আপাতত তাই এই চিন্তায় ছেদ টানি। আমার আত্মা নশ্বর শরীর ছেড়ে অজানা লোকে এসে পৌঁছেছে কয়েকদিন হলো। এসে যাদের সঙ্গে প্রথম দেখা তারা হলো আলোক ও অলোকরঞ্জন। দুজনে মনের সুখে অপ্সরাদের নৃত‍্যগীত দেখছিল। তারপর একে একে শক্তি, অশ্রু, নীরেনদা, সুনীল, উৎপল, সৌমিত্র, দেবেশ, সুধীর, নবনীতা, উজ্জ্বলকুমার মজুমদারের সঙ্গে দেখা । ফলে সময়টা ভালোই কাটছে। কে জানত আশ্চর্য করোনা রোগে আমাকে ছাড়তে হবে মধুময় পৃথিবীর ধূলি!

প্রথমটায় বেশ মুষড়ে পড়েছিলাম। এখন পুরনো বন্ধু, চেনা মানুষগুলোর সঙ্গে মিলতে পেরে ভালোই লাগছে।‌ অলোক, অশ্রু, দেবেশ মিলে ঠিক করেছে আমাদের আড্ডায় আজ আমার কবিপ্রতিভা নিয়ে কথা হবে। ব‍্যাপারটা অস্বস্তিকর। আমার নিজের ঢাক পেটানো ঘোরতর অপছন্দের। কিন্তু অলোকরঞ্জন, দেবেশ, অশ্রুকে কে উপেক্ষা করবে? ওই ওরা সকলেই এসে পড়েছে।

অলোকরঞ্জন : শঙ্খদা সকলেই উপস্থিত এই প্রণত অপরাহ্ন বেলায়। বসন্তের নন্দনকাননের শোভা অপূর্ব! এমন পরিবেশে আড্ডা দিতে পারলে বুদ্ধদেব, অশোক মিত্র, নরেশ-দারাও পুলকিত হবেন। যাই হোক আপনিই শুরু করুন। আপনার জবানিতেই শুরু হোক যবনিকা উন্মোচনের চ‍্যালেঞ্জসঞ্চারী অধ‍্যায়।

শক্তি : হ্যাঁ, শুরু করুন।

নবনীতা : জানেন তো আমি চলি শঙ্খদা আপনার আর অলোকদার খুঁট ধরে। শুরু করুন। তারপর, আমি তো ফোড়ন দেবই!

শঙ্খ ঘোষ : কী আর করা যায়। গলা এখনো বসে আছে। তবু কিছু বলছি। নবনীতা, শক্তি একটু চুপ করে শোনো :

সেই কবে কৈশোরবেলায় নিভৃতে আমার কবিতা রচনার শুরু। স্বপ্ন দেখতাম কবি হবো। ভাবতাম, আমার তো কিছু বলার আছে। সেই বক্তব্য বলব কীভাবে? অন‍্য কোনো পথ আমার জানা ছিল না। অগত্যা কলম ধ‍রতেই হলো। শুরু হলো কবিতার জন‍্য রাতজাগা। তখনকার দিনে পরিচয় ছিল সবচেয়ে সাড়াজাগানো পত্রিকা। কে ছিলেন না সেখানে? সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, চিন্মোহন সেহানবীশ, গোপাল হালদার, বিষ্ণু দে, হীরেন মুখোপাধ্যায় ইত‍্যাদি আরো কত নাম। যাই হোক সেখানে আমার বেশ কয়েকটি কবিতা প্রকাশিত হয়। প্রকাশিত হয় ‘যমুনাবতী’ কবিতা। পূর্বে কবিতা ভবনে এক বন্ধু বুদ্ধদেব বসুর কাছে আমার কবিতা পাঠালেও একটি কবিতাও মনোনীত হয়নি। এর জন্য আর কোনোদিন রাগে, ক্ষোভে বুদ্ধদেব বসুর সঙ্গে আমি দেখা করিনি। এখন অবশ‍্য সেসব ভাবলে আফসোস হয়। যাক সে-কথা।

আমি যখন কবিতা জগতে আসি সময়ের বিচারে সেটা ছিল বিগত শতাব্দীর পঞ্চাশের দশক। এর পূর্বের দুটি দশকের বাংলা কবিতার পরিসর তো ছিল চাঁদের হাট। কে ছিলেন না সেখানে! জীবনানন্দ দাশ, বিষ্ণু দে, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, অমিয় চক্রবর্তী, বুদ্ধদেব বসু, প্রেমেন্দ্র মিত্র, সুভাষ মুখোপাধ্যায়, অরুণকুমার সরকার, নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, সঞ্জয় ভট্টাচার্য, নরেশ গুহ, রাম বসু, গোলাম কুদ্দুস প্রমুখ। আমার জন্ম ১৯৩২-এ। এখনকার বাংলাদেশের চাঁদপুরে আমার মামাবাড়িতে আমার জন্ম। পিতৃপুরুষের ভিটে অবশ‍্য বরিশালের বানারীপাড়া নামক গ্রামে। আমার পিতা দেশভাগের পরে এপার বাংলায় চলে আসেন। এই বঙ্গেই আমার উচ্চশিক্ষা। স্কুলের পড়াশোনা অবশ‍্য ওপার বাংলায়। দাঙ্গা, দেশভাগ এ-সবই দেখেছি। দেশভাগ যখন হয় তখন আমার বয়স ১৫ বৎসর। উদ্বাস্তু জীবনের বেদনা, তাদের লড়াই, সুখ-দুঃখের কথা আমার থেকে কে বেশি জানে! তখন বাংলা কবিতা এসবের প্রভাবে আলোড়িত হয়ে উঠেছিল। সুভাষদা, মঙ্গলাচরণ, রাম বসু, গোলাম কুদ্দুসের কবিতায় দিনবদলের স্বপ্ন স্পন্দিত হয়ে উঠছিল। তবে কবিতা সমসাময়িকতার ডাকে সাড়া দিতে গিয়ে হয়ে পড়েছিল বড়ো বেশি মুখর। কবিতা আর সেø­াগানের ভেদরেখা মুছে যেতে বসেছিল। এরকম সময়ে উঠে এলাম আমরা, অর্থাৎ পঞ্চাশের কবিরা। এই দশকের প্রথম কাব‍্যগ্রন্থ আলোক সরকারের উতল নির্জন। প্রকাশিত হয় ১৯৫০ সালে। এই দশকেই অলোকরঞ্জনের বিখ‍্যাত কাব‍্যগ্রন্থ যৌবনবাউল (১৯৫৯) প্রকাশিত হয়। আমার প্রথম কাব‍্যগ্রন্থ দিনগুলি রাতগুলিও এই দশকেই গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়। প্রকাশকাল ১৯৫৬। প্রকাশক ছিল এস রায় অ্যান্ড কোম্পানি। লক্ষ করলে দেখা যাবে, এ-দশকের অধিকাংশ কবি মগ্নসুরে কবিতা রচনা করেছেন। অনেকেই বলেন দেশভাগ, উদ্বাস্তু সম‍স‍্যায় মানুষের জীবন যখন ধ্বস্ত, দু-মুঠো ভাতের জন‍্য মানুষ যখন মিছিল করছে, পুলিশের গুলি খাচ্ছে তখন এঁরা আশ্চর্যজনকভাবে দেশকালকে ভুলে স্বনির্মিত রোমান্টিকতার সীমাস্বর্গে অবস্থান করলেন; কেউ রচনা করলেন ‘স্বীকারোক্তিমূলক কবিতা’, কেউ ঈশ্বরের দুয়ারে প্রণিপাত করলেন। তবে আমি মনে করি এই অভিযোগ পুরোপুরি সত‍্য নয়। অমিতাভ, তরুণ সান‍্যাল মানুষের কথাই তো বলেছেন। অলোকের প্রথম কাব‍্যগ্রন্থেই তো এসেছে প্রান্তিক মানুষের কথা। আমার কবিতা নিয়ে আমি কোনো কথা জীবৎকালে বলতে পছন্দ করতাম না। এখন বলি, আমি কিন্তু দু-ধরনের কবিতা তা প্রথম থেকেই রচনা করেছি। একদিকে যেমন লিখেছি ‘দিনগুলি রাতগুলি’র মতো আত্মনিষ্ঠ কবিতা, অন‍্যদিকে রচনা করেছি ‘যমুনাবতী’র মতো তীব্র সমাজবাস্তবতার কবিতা। আসলে আমি মনে করি দুইয়ের মধ্যে কোনো বিরোধ নেই। অলোকের ভাষায় বলি, এক তীব্র যন্ত্রণাসম্ভব আত্মসন্ধানী আমি। এরই তাগিদে কখনো  আমার ভিতর দিকে চলা, আবার এরই টানে আমি হয়ে উঠেছি প্রবলভাবে সামাজিক। রচনা করেছি বিস্তারধর্মী কবিতা।

আমি ঠিক কৃত্তিবাসী নই। অথচ কৃত্তিবাসের প্রথম সংখ‍্যাতেই আমার কবিতা প্রকাশিত হয়েছিল। এ-সম্পর্কে আমার অবশ‍্য বলা ঠিক হবে না। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় বেশ কয়েক বছর হলো স্বর্গের নন্দনকাননে শক্তিসহ সুরা, সংগীত আর কাব‍্যচর্চায় অলস সময় কাটাচ্ছেন বলে জেনেছি। যাক, ওই ও আসছে। ওকেই বলি, সুনীল বহুকাল পরে তোমার সঙ্গে দেখা। তা মর্তে‍্যর পাঠকদের একটু বলো তো তোমার কৃত্তিবাসের সঙ্গে আমার সম্পর্কের কথা।

এ-কথা শুনে সুনীল বলতে শুরু করেন :

– কৃত্তিবাসের প্রথম বছরে প্রথম সংখ‍্যায় শঙ্খ ঘোষের কবিতা প্রকাশিত হয়েছিল, এই তথ‍্য এখন অনেকেরই জানা। কিন্তু এর পেছনে আমাদের অতি তরুণ বয়সের যে আবেগের সঞ্চার ছিল, তা ঠিক লিখেও বোঝানো যায় না। আমরা একটা তরুণ কবিদের পত্রিকা প্রকাশের সিদ্ধান্ত নিই এবং প্রথম কবিতাটি কার হবে তা নিয়ে অনেক জল্পনা-কল্পনা হয়। সমসাময়িক অন‍্যান‍্য দু-একজন কবির নামও আলোচনায় উঠে আসে। কিন্তু আমরা বন্ধুরা শেষ পর্যন্ত সবাই মিলে একমত হয়ে সিদ্ধান্ত নিয়ে শঙ্খ ঘোষের কাছে যাই।

তিনি তখন পরিচয় এবং অন‍্যান‍্য কয়েকটি পত্রিকায় সম্পূর্ণ নতুন স্বাদের ও নতুন আঙ্গিকের কবিতা লিখে আমাদের মাথা ঘুরিয়ে দিয়েছিলেন। তাঁর কাছে কবিতা প্রার্থনা করার পর, তিনি একটি কবিতার বদলে তাঁর কবিতাভর্তি একটি খাতাই দিয়ে দিলেন আমাদের। অপূর্ব সুন্দর মুক্তাক্ষর, কোনো কাটাকুটি নেই, পুরো খাতাই আমরা বারবার পড়ে ফেললাম। এমনকি এ-কথাও আমাদের মনে হয়েছিল যে, প্রথম সংখ‍্যায় তাঁর পুরো খাতাই ছাপিয়ে দিলে কেমন হয়?

তবে এটা ঠিক যে বাস্তবে সম্ভব নয়, প্রথম সংখ‍্যায় আমরা নিজেরা কেউ লিখব না? নতুন কবিতার আঙ্গিক ও অভীষ্ট শঙ্খ ঘোষের কবিতাগুলিকেই পরিস্ফুটিত করে। অনেক বিবেচনার পর আমরা তাঁর খাতার দীর্ঘতম কবিতাটি বেছে নিই। সেই কবিতাটির নাম ছিল ‘দিনগুলি রাতগুলি’।

অশ্রুকুমার : আমরা জানি, শঙ্খ সংহত ভাষার শিল্পী। কিন্তু শঙ্খের প্রথম সংকলনের কবিতাগুলি অবশ‌্য নিঃশব্দ কবিতা নয়। তার মধ্যে শব্দবিলাস, শব্দের উল্লাস অনেক বেশি। ছন্দ নিয়ে, শব্দ নিয়ে সে এক তুমুল পরীক্ষার সময় – প্রথম পদক্ষেপের উত্তেজনা, অনিশ্চয়তা, উল্লাস, সবই তার মধ্যে আছে। আর আছে হৃদয়ের মধ্যে ধানে-গানে পরিপূর্ণ বসুধাকে, তার অপার ভালোবাসাকে টেনে নিয়ে আসা।

উজ্জ্বলকুমার : প্রথম কাব‍্যগ্রন্থেই শঙ্খদার মূল প্রবণতা – অর্থাৎ আত্মমগ্নতা এবং সমাজলগ্নতার সহাবস্থান – আমরা লক্ষ করি। এই প্রবণতাই পরবর্তীকালে সংহত রূপ পেয়েছে ।

দেবেশ রায় : এখানেই তো স্থান পেয়েছে ‘কবর’ কবিতাটি। ‘দিনগুলি রাতগুলি’ কবিতারও আগে লেখা। এখানে রয়েছে আত্মকেন্দ্রিকতাকে দূরে ঠেলে সামাজিক হয়ে ওঠার প্রথম সংকেত :

নিবেই যখন  গেলাম আমি, নিবতে দিয়ো হে পৃথিবী

আমার হাড়ে পাহাড় করো জমা –

মাটি আকাশ বাতাস যখন তুলবে দুহাত, আমার হাড়ে

অস্ত্র গোড়ো, আমায় কোরো ক্ষমা।

অলোকরঞ্জন : পরবর্তী কাব‍্যগ্রন্থ নিহিত পাতালছায়া (১৯৬৭)। শঙ্খদার স্বকীয়তার সন্ধানী এষণা নিজেকে পূর্ণ রূপে আবিষ্কার করেছে। শঙ্খদাও নিশ্চয় এ-বিষয়ে দ্বিমত পোষণ করবেন না ।

শঙ্খ : (স্মিত হেসে) তুমি যখন বলছ আমি ভিন্নমত পোষণ করি এমন সাহস কী আর আমার আছে (আবার স্মিত হাসি)!

আলোক সরকার : নিহিত পাতালছায়া এক কথায় book of utter solitude। দিনগুলি রাতগুলি কাবে‍্য ব‍্যক্তিমানুষের স্বপ্ন-আকাক্সক্ষার রূপায়ণ দেখে ভালো লেগেছিল, যদিও আবেগ-বিহ্বলতা নিয়ে আমার দ্বিধা ছিল। এই দ্বিধা কেটে গেল যখন নিহিত পাতালছায়া পড়লাম। বলতে দ্বিধা নেই, নিহিত পাতালছায়ার কিছু কবিতা পড়ে আমি শঙ্খ ঘোষের কবিতার সঙ্গে সখ‍্য স্থাপন করেছিলুম।

উজ্জ্বলকুমার : একটা কথা বলি, শক্তির সম্ভবত মনে আছে। শঙ্খদার আদিম লতাগুল্মময় বইটা ও-ই আমাকে পড়তে দিয়েছিল, আমার কাছ থেকে আমার এক ছাত্রের হাত হয়ে চলে যায় সৌমিত্রের কাছে। আমরা এক নির্জন দুপুরবেলা বইটা নিয়ে আড্ডায় বসেছিলাম। আমার মনে হয়েছিল, এই বইটা শঙ্খদার কবিজীবনকে দৃঢ় ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠা করল। সম্ভবত ১৯৭২ সালে প্রকাশিত হয় বইটি। কবি এখানে পথ হঁাঁটেন আদিমতার দিকে। কোন আদিমতা? নকশাল আন্দোলন, রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস ইত‍্যাদি সবকিছু মিলেমিশে এক দমবন্ধকর পরিস্থিতি। এমন পরিস্থিতিতে শান্তিকামী সংবেদী মানুষ বাইরের থেকে ভিতরের দিকে নিজেকে সংহত করছিল। আদিমতার দিকে কবির যাত্রায় রয়েছে এই বাস্তবতার ছাপ এমনটা মনে হতেই পারে। কিন্তু তা যে ঠিক নয় এর পূর্বতন কাব‍্য তুমি তো তেমন গৌরী নওয়ের ‘কখনো বা মনে হয়’ কবিতাটি পাঠ করলে আমরা বুঝতে পারি। কবিতাটির কথক একজন সংবেদী মানুষ। নকশাল আন্দোলনের ঝোড়ো দিনগুলিতে তিনি নিজেকে কিছুটা গুটিয়ে রেখেছিলেন। পরে বুঝেছেন, ওই সিদ্ধান্ত ছিল স্বার্থপরতা। সেদিন কত তাজা প্রাণ শোষণমুক্ত সমাজ গড়তে গিয়ে হঠকারিতার বশে ভ্রাতৃঘাতী লড়াইতে লিপ্ত হয়। তারা নতুনের স্বপ্নে বিভোর হয়ে নিজেদেরই শুধু ক্ষয় করেছে। সংবেদী কথক এর জন‍্য অনুতপ্ত। এই উপলব্ধিই কীর্ণ হয়েছে এখানে :

কখনো-বা মনে হয় সরে যাওয়া তত ভালো নয়

এসব তো বহুদিন হলো।

ওরা যে ঝড়ের দিনে অপমানে-শাপে

আমারই দু-হাতে রাখে হাত

ওরা যে আলোর দিনে ঘৃণাভরে ইস্পাত

পরস্পরের দেহে

ওরা যে বনের পাশে বসে ছিল আগুন জ্বালিয়ে

শরীরের সব পাতা একে একে খসে পুড়ে যায়

অথবা গোপন ঘরে দেয়ালে রেখেছে নীলা নারীদের শব

এইসব ক্ষতি সে তো আমারই দেহের ক্ষয়, আজ মনে হয়

প্রতিশ্রুত শেষ ভালোবাসা –

যতবার সরে যাই জেগে ওঠে বুদ্ধের দু-চোখ।

আমার মনে হয় আদিমতার দিকে যাত্রা বলতে সংবেদী মানুষের নিজের সত্তাকে পুনরাবিষ্কারের দিকটিকেও ধরতে হবে।

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় : উজ্জ্বলের এই বক্তব্যের সঙ্গে আমি একমত। লক্ষ করলে দেখা যাবে আদিম লতাগুল্মময় কাব‍গ্রন্থের মধ্যেও এই টানাপড়েন চলেছে। ‘দল’, ‘কলকাতা’ ইত‍্যাদির মতো সমাজলগ্ন কবিতা এই কাব্যে স্থান পেয়েছে। আবার এর পাশাপাশি আছে ‘ঠাকুরদার মঠ’, ‘কথা’, ‘বিরলতা’র মতো একান্ত ব‍্যক্তি-অনুভবের সংহত কবিতা।

নবনীতা : আমার খুবই পছন্দের মূর্খ বড়ো, সামাজিক নয় থেকে বাবরের প্রার্থনা, বন্ধুরা মাতি তরজায় – এই ত্রয়ী কাব‍্যগ্রন্থ। সত্তরের দশকের অগ্নিঝরা বাংলার সমাজসত‍্য এখানে চিরকালের ভাষায় উঠে এসেছে ‘thereness’ বা সমকালীনতা শঙ্খদার কবিতার ইউএসপি। এই সমকাললগ্নতা, যা প্রথম কাব‍্যগ্রন্থ থেকেই আমরা লক্ষ করি, তা বস্তুত এখান থেকেই ওনার কাব্যের প্রধান সুর হয়ে উঠেছে। ভাবুন ওই বিখ‍্যাত কবিতা ‘তিমির বিষয়ে দু-টুকরো’র পঙক্তিগুলো :

ময়দান ভারী হয়ে নামে কুয়াশায়

দিগন্তের দিকে মিলিয়ে যায় রুটমার্চ

তার মাঝখানে পথে পড়ে আছে ও কি কৃষ্ণচূড়া?

নিচু হয়ে বসে হাতে তুলে নিই

তোমার ছিন্ন শির, তিমির।

এখনো সত্যি বলছি অলোকদা, এই কবিতাটির কথা ভাবলেই আমি আজো শিহরিত হই। মৌন হয়ে বসে থাকি অনেকক্ষণ। তিমিরবরণ সিংহকে আমিও তো চিনতাম। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়েরই ছাত্র। ওর খুনকে কেন্দ্র করে রচিত এই কবিতায় গোটা সন্ত্রস্ত সময় যেভাবে উঠে এসেছে তা সত্যি এখনো ভাবলেই স্তম্ভিত হতে হয়।

শঙ্খ ঘোষ : এই কবিতাটির প্রেক্ষাপট সম্পর্কে আমি আমার কবিতার মুহূর্ত গ্রন্থে সবটাই বলেছি। এখানে এটুকুই বলব, একা তিমিরই তো নয়, কয়েক বছরের মধ্যে কতই তো এমন অবিশ্বাস্য নৃশংসতা ঘটে গেল আমাদের অন্ধ ইতিহাসে, আরো কত এমন কিশোর-যুবার কাহিনি চাপা পড়ে রইল সময়ের ডানায়। আমি এদের সকলের কথাই বলতে চেয়েছি এই কবিতায়।

অলোকরঞ্জন : তিমিরবরণ সিংহ তো আমারও ছাত্র ছিল। ও তো আমাকে বলে গিয়েছিল, দেখবেন বিপ্লব ঠিক আসছে।

উজ্জ্বলকুমার : আপনি তো তিমিরকে নিয়েই রচনা করেন বিখ‍্যাত ‘অমৃতধামযাত্রী’ কবিতাটি। শঙ্খদা আর আপনার এইসকল কবিতা পড়লে আমার মন পড়ে যায় লুই আঁরাগের সেই উক্তি : I go to my death and O friends, we will know the region why।

নীরেন্দ্রনাথ : তবে উজ্জ্বল, আমি মনে করি মূর্খ বড়ো, সামাজিক নয় – এই কাব‍্যগ্রন্থের কবিতাগুলি আরো সংবেদী। সমকালকে ব‍্যক্তিস্বরের সঙ্গে কীভাবে বুনে দেওয়া যায় এর নাম-কবিতাটি পাঠ করলে তবে বোঝা যায়।

অলোকরঞ্জন : এই কবিতাটির পাঠপ্রতিক্রিয়া শুধুই সান্দ্র স্তব্ধতা। মার্কসবাদী দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখলে এই কবিতাটি চমৎকারভাবে ব‍্যাখ‍্যা করা যায়। দেবেশ একদা জনান্তিকে বলেছিল বলে কর্ণগোচর হয়েছিল …

দেবেশ : হ্যাঁ, আমি বলেছিলাম ওই নাম-কবিতার ব‍্যাখ‍্যায়। কবিতাটির বয়ান লক্ষ করুন :

ঘরে ফিরে মনে হয় বড়ো বেশি কথা বলা হলো?

চতুরতা, ক্লান্ত লাগে খুব?

মনে হয় ফিরে এসে স্নান করে ধূপ জ্বেলে চুপ করে নীলকুঠিতে

বসে থাকি?

মনে হয় পিশাচ পোশাক খুলে পরে নিই

মানব শরীর একবার?

এখানে শঙ্খদা একজন এমন মানুষের কথা বলেছেন যিনি নিজের শর্তে, নিজের মতো করে বাঁচতে চান। কিন্তু বাইরের জগতে সেই ইচ্ছা প্রবলভাবে আহত হয়। তিনি বেশি কথা ভালোবাসেন না। চতুরতা তাঁর ঘোরতর অপছন্দের। আসলে পুঁজিবাদী সমাজে এটাই তো দস্তুর। কথাবেচা, চাতুর্যবৃত্তি এসব নিয়েই তো আজকের সমাজে যান্ত্রিক মানুষের টিকে থাকা। কিন্তু কোনো কোনো মানুষ তো সমাজে এখনো আছেন যাঁদের মধ্যে থেকে গেছে সংবেদনশীলতা, শুদ্ধতা। এই বিরল শ্রেণির মানুষের প্রতিনিধি এই কবিতার

কথক। তাদের ট্র‍্যাজেডিই এখানে শঙ্খদা নিজস্ব শৈলীর মাধ‍্যমে ফুটিয়ে তুলেছেন বলে আমার মনে হয়।

সুধীর চক্রবর্তী : শঙ্খদা আপনার পরবর্তী কাব‍্যগুলির ওপর আলোকপাত করুন না। আপনার মুখ থেকে আপনার কবিতার প্রকৃতি বিশ্লেষণ শুনতে বেশ ভালোই লাগে।

শঙ্খ ঘোষ : আমার কাছে পাঁজরে দাঁড়ের শব্দ এবং গান্ধর্ব কবিতাগুচ্ছ – এই দুই কাব‍্যগ্রন্থ অত‍্যন্ত প্রিয়। আমি যাকে নিঃশব্দের শিল্প বলি তা এই দুই কাব্যে তুঙ্গে উঠেছে। এখানে বেশ কয়েকটা লেখা আছে যাদের স্বপ্ন্ন থেকে শুরু, আবার কয়েকটি তো পুরোপুরিই স্বপ্ন। দীপকরঞ্জনকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে একথা প্রথম বলি, আজ আবারো বললাম। বলতে দ্বিধা নেই, এই একটি কাব‍্যগ্রন্থ যেখানে আমার মনোজগতের আভাস স্পষ্টভাবে অন্তত কিছু পাঠকের কাছে ঠিকঠাক পৌঁছেছে।

উৎপল : এবার গান্ধর্ব কবিতাগুচ্ছ নিয়ে কিছু বলুন। আচ্ছা লাইনেই ছিলাম বাবা তো এর আগে প্রকাশিত। ওইরকম সমাজলগ্ন, তীক্ষ্ন কবিতাগুলো লেখার পরে এরকম সান্দ্রস্বভাব কবিতাগুচ্ছ লিখলেন কীভাবে!

শঙ্খ ঘোষ : আসলে গান্ধর্ব কবিতাগুচ্ছের কবিতাগুলি আগেই লেখা। গ্রন্থাকারে পরে প্রকাশিত হয়। সিমলায় তখন আমি ছিলাম অপরূপ এক প্রাসাদশীর্ষে। রাতের বেলায় সম্পূর্ণ একা থাকতাম। ওইসময়কার অনুভূতিকে আমি এখানে ধরে রাখতে চেষ্টা করেছি।

উজ্জ্বলকুমার : আপনার শবের উপর শামিয়ানা (১৯৯৬), ছন্দের ভিতরে এত অন্ধকার (১৯৯৯), জলই পাষাণ হয়ে আছে (২০০৪) কবিতা সংকলনগুলি আমার খুব প্রিয়।

সৌমিত্র : এই কাব‍্যগ্রন্থগুলি প্রায় ক্লাসিকের পর্যায়ে চলে গেছে। বিশেষত শবের উপর শামিয়ানা। এখনো মনে পড়ে ‘আমরা মেয়েরা’ কবিতার পঙক্তি :

লিখে যাই জলের অক্ষরে

আমার মেয়েরা আজও অবশ ভিক্ষার

           হাতে পড়ে আছে সব ঘরে ঘরে।

কত কম কথায় কত বেশি বলা যায় শঙ্খদার এই কবিতা পড়লে বোঝা যায়। ব‍্যক্তিস্বরকে আশ্রয় করেও যে কবিতাকে বাইরের দিকে ঘুরিয়ে দেওয়া যায় এখানে শঙ্খদা কত সহজে দেখিয়ে দিলেন।

অশ্রুকুমার : আপনারা শঙ্খের গোধূলি লগ্নের কাব‍্যগুলি দেখেছেন? সমস্ত ক্ষতের মুখে পলি (২০০৭), মাটি খোঁড়া পুরোনো করোটি (২০০৯), গোটা দেশ জউঘর (২০১০), হাসি খুশি মুখে সর্বনাশ (২০১১), প্রতি প্রশ্নে কেঁপে ওঠে ভিটে (২০১২), শুনি নীরব চিৎকার (২০১৫), এ-ও এক ব‍্যথা-উপশম (২০১৮) ইত‍্যাদি। এগুলো পড়লে বুঝতে পারবেন ক্ষমতাতন্ত্র-বিরোধিতা কাকে বলে! শঙ্খ যদি নিজে এ-ব‍্যাপারে কিছু বলে।

শঙ্খ ঘোষ : এই বইগুলোকে নিয়ে আলাদা আলাদাভাবে আমি কিছু বলব না। শুধু বলব যে, কবির দায় থেকেই যায় ক্ষমতার বিরুদ্ধে বলার। সত‍্যকথন ছাড়া কবির আর কী কিছু কাজ আছে! আমি এখানে সেই দায়টুকুই শুধু পালন করার চেষ্টা করেছি।

অলোকরঞ্জন : এক্ষেত্রে আমি শঙ্খদার সঙ্গে একমত। নন্দীগ্রাম আন্দোলনের সময় শঙ্খদা তো বিবেকের ভূমিকা নিয়েছিলেন। আমি সুদূর প্রবাসী হওয়া সত্ত্বেও ওই আন্দোলনের সঙ্গে থাকতে চেয়েছি। লিখেছিলাম গোলাপ এখন রাজনৈতিক শীর্ষক একটি কাব‍্যগ্রন্থ। বাম সরকারের কাছের মানুষ হয়েও শঙ্খদা বারংবার দুরন্ত স্পর্ধায় তাঁদের বিচু‍্যতিকে বিদ্ধ করেছেন। সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম-লালগড় পর্বে ওনার শাণিত লেখনী যেভাবে ঝলসে উঠেছে তার সাম্প্রতিক কোনো তুলনা আছে কি?

দেবেশ : পরবর্তীকালে শঙ্খদা নির্বিকল্প। নতুন সরকার এলেও অন‍্য সকল সুশীলের মতো তিনি সরকারের প্রসাদ-ভিক্ষা নেননি। বরং বিচ্যুতি দেখলেই কলম তুলে নিয়েছেন। বীরভূমের রাজনৈতিক সন্ত্রাস নিয়ে তাঁর লেখা কবিতা তো প্রচারমাধ‍্যমেও জায়গা পেয়েছিল‌।

অশ্রুকুমার : কোনটা? ওই কবিতা মনে হয় : ‘দেখ খুলে তোর তিন নয়ন/ রাস্তা জুড়ে দাঁড়িয়ে আছে উন্নয়ন’।

শঙ্খ ঘোষ : (স্মিত হাসি চেপে) চলুন গা তোলা যাক। আড্ডা আজ অনেকক্ষণ হলো। এখানে এসেও যে একা হয়ে পড়িনি তার জন‍্য আপনাদের অনেক ধন‍্যবাদ।

দেবেশ : বিশ্রাম করুন। শিগগির দেখা হবে।

অলোকরঞ্জন : দেববিগ্রহের সঙ্গে বিরহের পালা শেষ। আমি পরানসখার সঙ্গে আড্ডায়, সংলাপে ঠিক তেমনভাবেই কাল কাটাবো যেমন কাটাতাম পঞ্চাশ বৎসর পূর্বে। শঙ্খ ঘোষ : অশ্রু, অলোকের কথার ওপর কী কথা চলে! (হাসতে হাসতে) আবার দেখা হবে। নমস্কার।‌