শতবর্ষে ‘বিদ্রোহী’ কবিতা : ফিরে দেখা

সময় ও স্থান মাহাত্ম্য

ঠিক কোন দিনে ‘বিদ্রোহী’ কবিতা লেখা হয়েছিল! তা নিয়ে বিতর্কের শেষ নেই। তবে ‘বিদ্রোহী’ কোন সালে লেখা হয়েছিল – তা আজ স্পষ্ট হয়েছে। তারিখ নিয়ে যতই সমস্যা হোক – ‘বিদ্রোহী’ কবিতা লেখা হয়েছিল ডিসেম্বর মাসের শেষে। ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহ মানে ২৫ ডিসেম্বর থেকে ৩১ ডিসেম্বর। পরাধীন ভারতবর্ষে, ব্রিটিশশাসিত কলকাতায় তখন ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহের ছুটিকে বলা হতো ‘বড়দিনের ছুটি’। ‘বড়দিনের ছুটি’ বা ‘খ্রিষ্টমাস সপ্তাহে’ কবি কাজী নজরুল ইসলাম (১৮৯৮-১৯৭৬) তাঁর সবচেয়ে জনপ্রিয় কবিতা, সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ কবিতাটি লেখেন। বড়দিনের সময় মানেই শীতকাল ছিল। কনকনে ঠান্ডা পড়েছিল কলকাতায়। সেই হাড় হিম করা শীতের সকালে বৃষ্টি নেমেছিল। বর্ষার সৌন্দর্য শীতের শিশিরকে মøান করে দিয়েছিল ঠিকই কিন্তু কবি নজরুলের মানসপটে জেগে উঠেছিল নতুন সৃষ্টির উল্লাস। তাই সারারাত জেগে কলম চালিয়েছিলেন, সৃষ্টি হয়েছিল নতুন ধরনের বাংলা কবিতা – ‘বিদ্রোহী’ (১৯২১)।

একুশ বছরের তরতাজা যুবক। মনে-প্রাণে বিদ্রোহের সুর ও স্বরের প্লাবন। ১৯২১ খ্রিষ্টাব্দে ডিসেম্বরের শেষে, লিখে ফেললেন বাংলা কবিতার ভুবনে তেজোদীপ্ত – সমকালের শেকল ছেঁড়ার গান।

আর স্থান! কোথায় বসে লিখলেন এই বহুপঠিত কবিতাটি। পূর্ববঙ্গে নয়, পশ্চিমবঙ্গের কলকাতায়। কলকাতায় নানান স্থানে ঘুরে ঘুরে ভবঘুরের মতো – স্থান বদল করলেও কিছুদিনের জন্য স্থায়ী হলেন মধ্য কলকাতার ‘তালতলা’য়। সেই ঠিকানা আজো আছে। সেখানে নজরুল স্মৃতির ফলক বসানো হয়েছে। ৩/৪-সি তালতলা লেন, কলকাতা-১৪। ঠিকানাটি রাতারাতি বিখ্যাত হয়ে গেল। এখানেই থাকতেন মোজাফ্ফর আহমদ। ‘তালতলা’ অঞ্চলটি নানা কারণে স্থান মাহাত্ম্যে পরিণত হয়েছে। তালতলার গ্রন্থাগার থেকে সুফি সাধকদের সাধনস্থান। হিন্দু-মুসলমান-খ্রিষ্টান – সর্বধর্মের মিলনবীথিতে পরিণত। বিপ্লবীদের আশ্রয়স্থল হিসেবে, নিরাপদ ভূমিতে চিহ্নিত ছিল। আর আজ ইতিহাস এবং ভূগোল মিলে গেছে মিলন মোহনার মহাসমুদ্রে। ‘বিদ্রোহী’ (১৯২১-২০২১) কবিতার প্রাক্-শতবর্ষে যাঁরা এই চর্চা করার সুযোগ দিলেন তাঁরা থাকেন তালতলাতেই। নতুন গতির অফিসের ঠিকানা – ৮৮ তালতলা লেন, কলকাতা-১৪। ৩/৪-সি তালতলা লেন থেকে মাত্র তিন মিনিট। পায়ে পায়ে মেইন রোড থেকে ভেতরে গেলেই সাপ্তাহিক সংবাদপত্র গতির অফিসে বসে থাকবেন শ্রমশীল-সদাশয় সম্পাদক। যিনি মন খুলে হাসতে পারেন। দিল-দরাজে বুকে টেনে নিতে পারেন প্রান্তিক হৃদয়-সাম্রাজ্যকে। ‘সুফি-সরস্বতী’কে স্বীকৃতি দিতে পারেন। আর কী পারেন! সকাল থেকে সন্ধে পর্যন্ত পরিব্রাজক হতে পারেন। ‘তালতলা’ থাকুক তালতলাতেই। বেরিয়ে আসুক নীরব বিদ্রোহের এক নতুন সোপান। তালতলা থেকে জীবনতলার হাটে দীপ ক্রমশ দীপ্ত হবে – উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর পবিত্র মাহাত্ম্যে। কবির বিদ্রোহ আর ‘বিদ্রোহী’র কবিতাভুবন।

প্রথম শ্রোতা ‘আহমদ চাচা’

কবি ভগ্নমনোরথে ফিরে এলেন কুমিল্লা থেকে কলকাতায়। তখন কলকাতা মানে ৩/৪-সি তালতলা লেনের নিচের তলার দক্ষিণ-পূর্ব কোণের ঘরটি। যেখানে থাকেন কমিউনিস্ট পার্টির মহান নেতা ‘কাকাবাবু’। তালতলার বাড়িটি ছিল ভাড়ার ভাড়া। প্রথমে ভাড়া নিয়েছিলেন ত্রিপুরা জেলার নবাব ফয়নুন্নিসা চৌধুরানির দৌহিত্ররা। ওপরে-নিচে মোট চারটি ঘরের দুটি ঘর থেকে একটি ঘরে থাকতে হয়েছিল কাকাবাবুকে। একটি মাত্র ঘরে থাকতে হয়েছিল দুজনকে – কাকাবাবুর সঙ্গে একুশ বছরের কবিকে।

নার্গিসের সঙ্গে বিয়ে ষড়যন্ত্রে ভেঙে গিয়েছিল – কবির প্রথম প্রেমের পাপড়ি। বিচ্ছেদে-বিরহে একুশ বছরের কবি ঠাঁই পেলেন কাকাবাবুর একটুকরো ভাড়াবাড়িতে। নিজের আর্থিক কষ্ট সত্ত্বেও কবি নজরুলকে পক্ষীমাতার মতো আগলে, বুকের মধ্যে স্থান দিয়েছিলেন। অভাবী কাকার সংসারে সৃষ্টি করলেন আরো অনেক শ্রেষ্ঠ রচনার সঙ্গে ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটিও। ‘বিদ্রোহী’ কবিতার প্রথম শ্রোতা হয়েছিলেন সর্বহারার মহান নেতা ‘কাকাবাবু’।

‘বিদ্রোহী’ কবিতাটি লেখা হয়েছিল রাতের অন্ধকারে। অবশ্যই গভীর রাতের আঁধারে। শ্রমক্লান্ত ‘কাকাবাবু’ রাত দশটার পর ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। সকালে ঘুম থেকে উঠে শুনতে হলো ‘বিদ্রোহী’ কবিতার খসড়া। অভাবী দুই অসম বন্ধুর ফাউন্টেন পেন ছিল না। দোয়াতে বারেবারে কলম ডোবাতে হবে বলেই ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটি লেখা হয়েছিল প্রথমে পেন্সিলে।

‘বিদ্রোহী’ কবিতা শুনে কবির সামনে প্রশংসা করেননি ঠিকই কিন্তু কাকাবাবু বাইরে প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়েছিলেন। কাকাবাবুর মতো বিরল ব্যক্তিত্বের স্বভাব ছিল সামনাসামনি প্রশংসা না করে অনুপ্রাণিত করা আরো সৃষ্টির জন্য। মায়ের মতো, প্রেমিকের মতো স্নেহ-মমতায় একুশ বছরের দামাল কবিকে উৎসাহিত করে গেছেন আরো অজস্র সৃষ্টির বহুমাত্রিক ধারায়। ‘বিদ্রোহী’ কবিতার সৃষ্টি সূতিকাগারে, তাই কাকাবাবুর নাম একাত্ম হয়ে গেছে। ‘বিদ্রোহী’ কবিতার প্রথম শ্রোতা হিসেবে শুধু নয়, ‘বিদ্রোহী’ কবিতা সৃষ্টির জন্য সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে ছিলেন সাম্যবাদী নেতা মুজাফ্ফর আহমদ। শেষ রাতের সৃষ্টি – প্রথম সকালেই প্রথম শ্রোতা মুগ্ধ হলেন, মুখ খুললেন না।

বিজলী ও ‘বিদ্রোহী’

একেই বলে কবিতার ভাগ্য! একটি কবিতার এতো চাহিতা ভাবা যায়! শেষ রাতে কবিতাটি লেখা হলো। আর তার পরদিন দু-দুটো কপি করতে হলো। একদিনের মধ্যেই দুজন সম্পাদক ‘বিদ্রোহী’ কবিতা নিতে এলেন তালতলার ভাড়াবাড়িতে। বাংলা কবিতা কেন, ভারতীয় কবিতার ইতিহাসে একটি কবিতার, একদিনের মধ্যে এতোটা চাহিদার ঘটনা আছে কি? কবিতাটি ছাপা হওয়ার আগেই এতোটা গুরুত্ব আর কোন কবিতার ক্ষেত্রে হয়েছে? প্রথমে একজন সম্পাদক কবিতাটি শুনে খুব হইচই শুরু করে জোর করে কপি করিয়ে নিলেন। আর দ্বিতীয় পত্রিকার সম্পাদক অন্য সম্পাদককে উড়িয়ে দিয়ে তাঁর পত্রিকার জন্য আরো একটি কপি করালেন। দুজন সম্পাদক কে আগে ছাপাবেন – সেই প্রতিযোগিতায় প্রাক্পর্বেই কবিতাটি গুরুত্ব পেয়ে গিয়েছিল। ছাপার আগে, সাধারণ পাঠকের কাছে যাবার আগে দুজন সম্পাদকের উদ্যোগ অভাবনীয় সাড়ায়, নিশ্চয়ই সৃষ্টিকর্তার রাত জাগার শ্রম সার্থক হয়েছিল!

প্রথম সম্পাদকের নাম আফজালুল হক; দ্বিতীয় সম্পাদকের নাম অবিনাশচন্দ্র ভট্টাচার্য। সম্পাদকদের তো জাত-ধর্ম দিয়ে বিচার না করে শুধু এটুকু অনুভব করা যায় – ‘বিদ্রোহী’র সৃজনশীল বিদ্রোহ শোনামাত্রই সবাই এতোটা মুগ্ধ করেছিল, যা লিখে প্রকাশ করা যায় না। আফজালুল হকের পত্রিকার নাম মোসলেম ভারত। অবিনাশচন্দ্র ভট্টাচার্যের পত্রিকার নাম বিজলী।

‘বিদ্রোহী’ কবিতাটি লেখার মাত্র এক সপ্তাহের মধ্যে প্রথম ছাপা হয়েছিল। বাংলায় ছাপার তারিখ ছিল ২২ পৌষ ১৩২৮ বঙ্গাব্দ আর ইংরেজিতে ৬ জানুয়ারি ১৯২২ খ্রিষ্টাব্দ। প্রথম ছাপা হয়েছিল মোসলেম ভারত পত্রিকায় নয়, বিজলী পত্রিকায়। ‘বিদ্রোহী’ ও বিজলী যেন বাংলা কবিতার সাম্রাজ্যে একীভূত হয়ে গিয়েছিল।

শীতকালে অকাল বৃষ্টির মধ্যেও বিজলী পত্রিকার চাহিদা এতোটা বেশি হয়েছিল যে সম্পাদক অবিনাশচন্দ্র ভট্টাচার্যকে জানুয়ারির সেই সপ্তাহে দু-বার প্রকাশ করতে হয়েছিল বিজলী। বিজলীর বিদ্যুৎপর্ণা যেন বিদ্যুৎবেগে বাংলার পাঠকসমাজে দ্রুত ঝংকৃত হলো। সম্পাদক-পাঠক একই সঙ্গে এমন ধাক্কা খেল যে বাংলা কবিতার ইতিহাস ও ভূগোল একইসঙ্গে পাল্টে গেল।

আমি সাইক্লোন, আমি ধ্বংস

আমি টর্পেডো, আমি ভীম ভাসমান মাইন,

আমি … কলরোল-কল-কোলাহল।

‘বিদ্রোহী’ কবিতার চাহিদা বেড়ে গেল ঝড়ের মতো, তুফানের মতো, সাইক্লোনের মতো। পাঠকের কাছে আকর্ষণ বেড়ে গেল

‘কলরোল-কল-কোলাহলে’র। বেড়ে গেল ছাপার চাহিদা।

কবি নজরুল ইসলাম পরিচিত হলেন ‘বিদ্রোহী কবি’ হিসেবে। চারদিকে ধড়পাকড় শুরু হলো, ইংরেজ সরকারের অতিতৎপরতা বেড়ে গেল। সেইসঙ্গে একাধিক পত্রিকা এগিয়ে এলো। শুরু হলো ‘বিদ্রোহী’ কবিতার পুনর্মুদ্রণ। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হলো, যেসব পত্রিকা ‘বিদ্রোহী’ প্রকাশ করল, সেসব পত্রিকার সবাই প্রায় প্রথম শ্রেণির মান্য পত্রিকা। যেমন – প্রবাসী (মাঘ ১৩২৮), সাধনা (বৈশাখ ১৩২৯), ধূমকেতু (২২ আগস্ট ১৯২২)। এছাড়া আরো অনেক অনামিকায় প্রকাশিত হয়েছিল ‘বিদ্রোহী’ কবিতা। বিজলীর পর অসংখ্য নামী-অনামী পত্রিকায় বিদ্রোহীর বিদ্রোহ বাংলা তথা ভারতের আকাশ-বাতাস মুখরিত করে দিলো।

অগ্নি-বীণার বিদ্রোহবাণ : প্রতর্ক ও প্রতিক্রিয়া

‘বিদ্রোহী’ কবিতাটি কবি নজরুল ইসলামের প্রথম কবিতা নয়; কিন্তু  তাঁর প্রথম কাব্যের নাম অগ্নি-বীণা (১৯২২)। অগ্নি-বীণা কাব্যগ্রন্থে ‘বিদ্রোহ’ কবিতাটি সংযুক্ত হয়। ‘বিদ্রোহী’ অভিধাটি কবির নামের সঙ্গেও যুক্ত হয়েছে, যা আজো অমøান। আসলে কবি নজরুল ইসলাম যে চিরবিদ্রোহী। তাঁর বিদ্রোহ ছিল – শাসক থেকে শোষক, খোদা থেকে ভগবান। আবার এই বিদ্রোহ ছিল দ্বিমুখী বাণের মতো। কবি যেমন ধারাল বাণ নিক্ষেপ করেছেন শাসকের বিরুদ্ধে; তেমনি বাঙালি বুদ্ধিজীবী পাঠক-লেখকরা বিদ্রোহী কবির বিপক্ষে প্রতিক্রিয়া-ব্যঙ্গ-বাণ ফিরিয়ে দেন। যার ফলে বাংলার জনমানসে ‘বিদ্রোহী’ কবিতা ঘিরে জমে ওঠে প্রতর্ক ও প্রতিক্রিয়ার পুষ্পবাণ, যা এর আগে কোনো কবিতাকে ঘিরে হয়নি। অন্তত মাত্র একুশ বছরের একজন নবীন ও তরুণ কবির পক্ষে-বিপক্ষে বিচিত্র পাঠপ্রতিক্রিয়া আর কোনো কবির জীবনে ঘটেনি। পরাধীন ভারতবর্ষের সমকালের সাহিত্যাঙ্গনে এতো ব্যাপক আলোড়ন কোনো কবিতাকে নিয়ে হয়নি। শুধু ব্যতিক্রম বলে নয়, ‘বিদ্রোহী’ অভিনব বলেই। ‘বিদ্রোহী’ একক এবং অদ্বিতীয়। ‘বিদ্রোহী’র চিরবিদ্রোহ আজো অব্যাহত।

‘বিদ্রোহী’ কবিতাটি একদিকে যেমন স্বদেশি-বিপ্লবীদের বুকে শক্তি ও সাহস জোগায়; অন্যদিকে প্রতিক্রিয়াশীল বুদ্ধিজীবীদের বিদ্রƒপবর্ষণে অনুপ্রাণিত করে। শেষ পর্যন্ত ‘বিদ্রোহী’ দ্বিমুখী বাণ থেকে ত্রিমুখী ফলায় পরিণত হয়। ‘বিদ্রোহী’ প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে সর্বস্তরে বিপুল সাড়া পড়ে যায়। বেড়ে যায় বিজলীর বিক্রি। দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে ‘বিদ্রোহী’র বিদ্রোহবাণ। অনেক লেখক শুধু ঈর্ষান্বিত হয়েই লিখে ফেললেন ব্যঙ্গ কবিতা, প্যারোডি। ‘বিদ্রোহী’ কবিতাকে ঘিরে বিচিত্র কোলাহল-কলরোল-কল্লোল যেন বিপক্ষ গোষ্ঠীকে বিদ্রোহী করে তুলেছিল। বাংলায় রবীন্দ্রাচ্ছন্ন কবিতার পাঠক এবং অ-পাঠক সবাইকে প্লাবিত করল একুশ বছরের এক কবির একটি মাত্র কবিতা।

১।       ‘বিদ্রোহী’ – নজরুল ইসলাম (সাপ্তাহিক বিজলী, ৬ জানুয়ারি ১৯২২)।

          ‘বিদ্রোহী’ – নজরুল ইসলাম (মোসলেম ভারত, কার্তিক ১৩২৮)।

          পুনর্মুদ্রণ – প্রবাসী (মাঘ ১৩২৮)।

          পুনর্মুদ্রণ – সাধনা, (বৈশাখ ১৩৩৯)।

          পুনর্মুদ্রণ – দৈনিক বসুমতী, ১৩৪০।

          পুনর্মুদ্রণ – ধূমকেতু, প্রথম সংখ্যা, ২২ আগস্ট ১৯২২।

২।       ‘বিদ্রোহীর কৈফিয়ৎ’ – লীলা মিত্র, (ধূমকেতু, আশ্বিন ১৩২৯)।

৩।       ‘কবি-বিদ্রোহীর প্রতি’ – মোহিতলাল মজুমদার (প্রবাসী, আষাঢ় ১৩৩০)।

৪।       ‘ব্যাঙ’ – সজনীকান্ত দাস (সাপ্তাহিক শনিবারের চিঠি’,

৪ অক্টোবর ১৯২৪)।

৫।       ‘সর্বনাশের ঘণ্টা’ – নজরুল ইসলাম (কল্লোল,  কার্তিক ১৩৩১)।

৬।       ‘দ্রোণ গুরু’ – মোহিতলাল মজুমদার (সাপ্তাহিক শনিবারের চিঠি, ২৫ অক্টোবর ১৯২৪)।

৭।       ‘নিয়ন্ত্রিত’ – গোলাম মোস্তফা (সওগাত, মাঘ ১৩২৮)।

          পুনর্মুদ্রণ – সাধনা (বৈশাখ ১৩২৯)।

৮।      ‘যৌবন’ – সজনীকান্ত দাসের আত্মস্মৃতি গ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত।

৯।       ‘ধূমকেতু’ – নজরুল ইসলাম (ধূমকেতু, ১১ আগস্ট ১৯২২)।

১০।     ‘বিজয়িনী’ – নজরুল ইসলাম (মোসলেম ভারত, পৌষ ১৩২৮)।

১১।     ‘বিদ্রোহ দমন’ – মোহাম্মদ আব্দুল হালিম (ইসলাম-দর্শন)।

১২।     ‘প্রলয় ভেরী’ – মোহাম্মদ গোলাম হোসেন (ইসলাম-দর্শন)।

১৩।     ‘বিদ্রোহীর বাণী’ – নজরুল ইসলাম (ভারতী,

বৈশাখ ১৩৩১)।

১৪।     ‘চির-বিদ্রোহী’ – নজরুল ইসলাম (১৩৩২)।

১৫।     ‘বিদ্রোহী’ কবিতার প্রতিক্রিয়া – কল্লোল যুগের তিন সাহিত্যিক – বুদ্ধদেব বসু, প্রেমেন্দ্র মিত্র ও অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত।

ওপরে লিখিত-প্রকাশের তালিকা দেখলে বোঝা যায় ‘বিদ্রোহী’ কতখানি ঝড় তুলেছিল। বুদ্ধদেব বসু লিখলেন, ‘মনে হ’লো এমন কখনো পড়িনি – দেশব্যাপী উদ্দীপনার এ-ই যেন বাণী।’ প্রেমেন্দ্র মিত্র লিখলেন – ‘হঠাৎ একটা তীব্র প্রবল তুফানের ঝাপটা কাব্যের রূপ নিয়ে তরুণ মনকে উদ্বেল করে তুলেছিল।’ অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত লিখলেন, ‘এ কে নতুন কবি? নির্জীব দেশে এ কার বীর্যবাণী? বাংলা সাহিত্যে নয়, সমগ্র দেশ প্রবল নাড়া খেয়ে জেগে উঠলো।’ মতামত দিলেন ছন্দের জাদুকর সতেন্দ্রনাথ দত্ত। আশীর্বাদ করলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। একদিকে স্বদেশ প্রেমিকদের সাহস জোগালো, অন্যদিকে বন্ধুদের সঙ্গে বিচ্ছেদ ঘটাল। এই অসামান্য বৈপরীত্য – ‘বিদ্রোহী’ ছাড়া আর কী আছে? আছে কি?

‘বিদ্রোহী’ এবং ‘বিশ্বকবি’

‘বিদ্রোহী’ প্রকাশিত হলে চারদিকে প্রশংসার বন্যা বয়ে যায়। প্রকাশিত ১৯২২ খ্রিষ্টাব্দের ৬ জানুয়ারি, আর মাত্র ১০ দিনের মধ্যে ঠাকুরবাড়িতে গেলেন ‘বিদ্রোহী’ কবি। ১৭ জানুয়ারিতে ঠাকুরবাড়িতে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে দেখা করলেন চিরন্তন যৌবনের কবি। দেখা হলো দুজনের সঙ্গে। পড়ে শোনালেন বিশ্বকবিকে। শোনার পর নীরবে কাছে এলেন, কবি জড়িয়ে নিলেন বুকে। সাময়িক শুধু বুকে স্থান নয়, হৃদয়ের গভীরে স্থান দিলেন চির-বসন্তের কবিকে। স্থাপিত হলো রবীন্দ্র-নজরুল চিরায়ত সখ্য। গড়ে উঠলো নবীন-প্রবীণের আত্মীয়তা, হলো নতুন আর প্রাজ্ঞের মহামিলন। মিশে গেল বয়সের ব্যবধান। ‘বিশ’ আর ‘ষাট’ যেন এক বিন্দুতে সম্পৃক্ত হলো। উজ্জ্বল তারুণ্য গাম্ভীর্য পেল বিশ্বমননের আকাশে।

নজরুল – ‘গুরুজী’! গুরুজী!! কোথায় গুরুজী?

রবীন্দ্রনাথ – কাজী! ষাড়ের মতো চেঁচাচ্ছ কেন?

নজরুল – আপনাকে হত্যা করবো!

রবীন্দ্রনাথ – উপরে এসে শান্ত হয়ে বসো।

নজরুল – বসুন! শুনুন!

            (‘বিদ্রোহী’ কবিতাটি বিশ্বকবিকে শোনালেন)

রবীন্দ্রনাথ – তুমি আমাকে সত্যিই হত্যা করবে।

আমি মুগ্ধ।

তুমি বিশ্ববিখ্যাত কবি হবে।

আলোকিত হোক তোমার কবিতা।

এই সংলাপ কাল্পনিক নয়। সত্যিই দুজনের এ-ধরনের সংলাপ হয়েছিল। একাধিক জবানবন্দিতে আছে দুই কবির আলাপের স্মৃতিকথা। কবি নজরুল ইসলাম রবীন্দ্রনাথকে ‘গুরুদেব’ না বলে ‘গুরুজী’ বলতেন। আর রবীন্দ্রনাথও তাঁকে ‘কাজী’ বলে সম্বোধন করতেন। তাঁদের সম্পর্ক আজ ইতিহাস হয়েছে দুজনের দুটি বই একে অপরকে ‘উৎসর্গ’ করার মাধ্যমে। রবীন্দ্রনাথ তাঁর বসন্ত নাটকটি ‘বিদ্রোহী কবি’কে উৎসর্গ করেন আর নজরুল ইসলাম তাঁর সঞ্চিতা কাব্যসংকলনটি বিশ্বকবিকে উৎসর্গ করেন, যা বাংলা কাব্য-উৎসর্গের ইতিবৃত্তে এক স্মরণীয় পর্ব হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে। বা আজো প্রাসঙ্গিক।

সম্প্রীতির মিথ : মিথের সমন্বয়

‘বিদ্রোহী’ কবিতা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এক উজ্জ্বল মানচিত্র। যেখানে বেদ-পুরাণ-উপনিষদ-গীতা-মহাকাব্য থেকে ইসলামের অনুষঙ্গ অসামান্য দক্ষতায় চিত্রিত হয়েছে। শুধু হিন্দু-মুসলিম মিথ নয়, সেই গ্রিক মিথের মহাসমন্বয় ঘটেছে। যেন বেদ-পুরাণ-কোরান-বাইবেলের সহাবস্থানে উদার সুফিবাদের স্বতঃস্ফূর্ত প্রকাশ ঘটেছে। শুধু পুরাণ কিংবা মিথ নয়, দেশি-বিদেশি শব্দমালার সংমিশ্রণ এক নতুন মাত্রা দিয়েছে। গ্রিক পুরাণের হোমারের ‘ইলিয়াড’, ‘ওডিসি’, প্রাচীন ভারতের ‘রামায়ণ’, ‘মহাভারত’, বেদ-উপনিষদ-ভাগবত গীতা ছাড়া ইসলামের ইতিহাস ও ঐতিহ্য থেকে মিথের উপাদান ব্যবহৃত হয়েছে। সমন্বয়ের মিথ ব্যবহারের প্রধান উদ্দেশ্য হচ্ছে, সামাজিক বৈষম্য, অনাচার, অবিচার, অত্যাচার, ভণ্ডামি ও স্বার্থপরতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ। সমকালীন সাম্রাজ্যবাদ এবং স্বাধীনতার স্বদেশপ্রেমকে জাগরণের মন্ত্রে এই সম্প্রীতির মিথ প্রয়োগের প্রয়োজন ছিল।

‘বিদ্রোহী’ কবিতায় সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করা হয়েছে

হিন্দু-পুরাণ। সবচেয়ে বেশি বহুল পরিমাণে বারবার শিবের উপমা ব্যবহার করা হয়েছে। ভিন্ন ভিন্ন নামের শিবের কথা বলা হয়েছে – শিব এখানে নটরাজ, মহাদেব, নটেশ্বর, ধ্বংসের দেবতা, ঈশান, ত্রিলোচন, এ্যম্বক, ধূর্জটি, বিরূপাক্ষ, ব্যোমকেশ, পিনাকপাণি, শিবশম্ভু ও সর্বহর। শিব ছাড়া, রুদ্র, বিশ্বামিত্র, বিষ্ণু, দ্বাদশ রবি, পরশুরাম, বলরাম, ভৃগু, ইন্দ্রানী, বাসুকি, শনি, রাহুর গ্রাস, ধর্মরাজ, ঈশান, জমদগ্নি ও পুর্বাসা ব্যবহৃত হয়েছে। সেই সঙ্গে ইসলামি মিথও ব্যবহৃত হয়েছে। খোদার আরশ, ইস্রাফিল, জিব্রাইলের ডানা, তাজী র্বোরাক, হাবিয়া দোজখ মিথগুলোর এক অনবদ্য প্রয়োগ। আরো আছে গ্রিক মিথ – ‘অর্ফিয়ুস’ – গ্রিক মহাকাব্যের এক কিংবদন্তি কবি-বীর। দেবী অ্যাপোলো তাঁকে এক বীণাবাদ্য উপহার দিয়েছিলেন। সেই আশ্চর্য জাদুকরী বীণার সুরে মৃত মানুষও জীবন ফিরে পায়।

বিচিত্র মিথ ‘বিদ্রোহী’ কবিতায় প্রয়োগ করা হয়েছে – যেন একই সংস্কৃতির সঙ্গে একাত্ম হয়ে আছে। যেখানে একটি থেকে অপরটিকে বিচ্ছিন্ন করা যায় না। সর্বোপরি ঈশ্বরের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ কিংবা শোষকের বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে গেলে ‘মানুষ’কে – এক যৌথ মিছিল প্রয়োজন। একক শক্তি নয়, সম্মিলিত সম্পদের মহাঅভিযানের আহ্বান করেছেন বিদ্রোহী কবির মানবসত্তা।

‘আপনারে ছাড়া কাহারে করি না কুর্ণিশ’

‘বিদ্রোহী’ কবিতাটি সেই অর্থে সুদীর্ঘ নয়; আবার খুব ক্ষুদ্রও নয়। কবিতাটির শরীরে আছে ছোট-বড় ১৪টি স্তবক। পঙ্ক্তি আছে ১৪১টি। কবিতার প্রথম অংশের দিকে আছে – ‘বল বীর/ বল উন্নত মম শির!’ অংশটি পাঁচবার। আরো আছে – ‘আমি’

আছে। ‘আমি’ আছে কত বার? ‘আমি’ সর্বনামের ব্যবহার আছে ১৪৫ বার।

এখানে প্রাণধর্মের গতিবেগ আছে। প্রবল প্রাণশক্তির উচ্ছ্বাস মানুষের আমিত্বকে দীপ্ত করে। আছে প্রাণস্রোত আর

আত্ম-আবিষ্কারের উজ্জীবন। যেন উদ্দীপনায় ভরা জ্বলন্ত লাভার মতো জড়ত্বকে মুক্ত করার জীবনীশক্তি। মোহিতলাল মজুমদারের ‘আমি’র মতো নয়। নজরুল ইসলামে ‘আমি’ আরো বহুবিস্তৃত। যেখানে পরাধীন ভারতের মর্মন্তুদ-জ্বালা আর শোষকের বিরুদ্ধে জেগে ওঠার হাতিয়ার আত্মশক্তি জাগরণ শুধু নয়, মানুষের মহাশক্তির বিস্ফোরণ। স্বাধীনতার জন্য সাহসী বীরের প্রয়োজন। বীরপুরুষ আর বীরাঙ্গনা ছাড়া দেশ মুক্ত হতে পারে না। শুধু অর্থনৈতিক সংকটই নয়, অবক্ষয়ী সমাজের ভগ্নদশাতে সোচ্চার হতে হয় মানুষকেই। মানুষের মধ্যেই আছে বিরাট সম্পদ। বিরাট ‘আমি’র সঙ্গে কবি মানুষকে এক করে দেখেছেন। সেই বৃহৎ আমির মধ্যে লুকিয়ে আছে বিদ্রোহীসত্তা, যা শুধু পৃথিবীকে নয়, আকাশ-মহাকাশ বিদীর্ণ করতে পারে।

‘বিদোহী’ এখানে চিরদুর্দম, দুর্বিনীত ও নৃশংস। যেন নটরাজ শিবের মতো মহাপ্রলয়ের মূর্তি। ‘বিদ্রোহী’ এখানে বীররসের গাথা। বিদ্রোহী শুধু বিদ্রোহের জন্য বিদ্রোহী নয়, সেই বিদ্রোহ যেন বসন্তের নব কিশলয়ের মতো নব সৃষ্টির প্রত্যাশায় উন্মুখ। বিদ্রোহী কখনো শত্রুকে আলিঙ্গন আবার মৃত্যুর সঙ্গে জীবন বাজি রেখে পাঞ্জা লড়ে। বিদ্রোহী যেন সত্য ও ন্যায়ের চিরন্তন প্রতীক। শাশ্বত চলমান জীবনের অগ্রপথিক। বিদ্রোহী দুরন্ত। বিশ্বমানবের জীবন্ত প্রতীক।

বিদ্রোহী একাধারে সন্ন্যাসী, সুরসৈনিক ও তার যুবরাজ বেশ গৈরিক বর্ণের – অত্যাচারীদের ধ্বংস করবে। উৎপীড়িত, অত্যাচারিতদের উদ্ধার করবে। শিবের পিনাকপাণির মতো – মহাদেব যা এক ঢিলে দুই পাখি মারতে ব্যবহার করতেন। যেমন যুদ্ধের সময় শরনিক্ষেপ এবং অন্য সময় বাদ্যযন্ত্র হিসেবে ব্যবহৃত হয়। আবার একই সঙ্গে বিদ্রোহশক্তির বিস্ফোরণ, শাণিত বিদ্যুৎ শব্দের আলোকপর্ণা সত্ত্বেও রোমান্টিক। বলিষ্ঠ শক্তির প্রকাশেই ‘বিদ্রোহী’ রোমান্টিক। আর সেজন্যেই সমকালে ও বর্তমানেও প্রাসঙ্গিক।

বাংলা কবিতায় বিচার ও প্রকরণে, বিদ্রোহের প্রথম উচ্চারণ করেছেন, মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত। মধূসূদনের বিদ্রোহ চিরাচরিত বিশ্বাসের বিরুদ্ধে, অবতার মহিমার বিরুদ্ধে – নতুন মূল্যবোধের আলোকে নিহিত আছে। রবীন্দ্র-সাহিত্যে এই বিদ্রোহর স্বরূপ একেবারেই ভিন্ন প্রকৃতির। রাবীন্দ্রিক সৃষ্টির পর্ব-পর্বান্তরে বিদ্রোহের অন্তঃশীলা ও যা সশব্দ উচ্চারণে পরিস্ফুট নয় – শৈল্পিক পথে হার্দ্য উচ্চারণের গুণগ্রামে প্রতিফলিত। কিন্তু নজরুলের বিষয়টি সম্পূর্ণ ভিন্নরূপ। নোবেল প্রাপক রবীন্দ্রনাথের চূড়ান্ত আলোকবলয়ের মধ্যে বলদৃপ্ত আবেগের ঝড়ো গর্জন তুলে বাংলা কবিতার ঘুম ভাঙিয়ে দিলেন বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম। বিষয় ও প্রকরণে সামাজিক-রাজনৈতিক পটভূমিতে নজরুলের ‘বিদ্রোহী’ বাংলা সাহিত্যে এতোই সুস্পষ্ট, এমন ধ্বনি-গম্ভীর, যা সাধারণ পাঠকের হৃদয় ছুঁয়ে যায়, প্রাণে প্রাণে প্লাবিত করে, ঝংকার তোলে। চিরবিদ্রোহের দৃশ্যময়, ধ্বনিময় ও আবেগময় প্রকাশের কারণেই বাংলা সাহিত্যে একমাত্র নজরুল ইসলামই ‘বিদ্রোহী কবি’ নামে ‘সম্মানিত’। বিদ্রোহের সর্বাত্মক বিচারে তিনি অদ্বিতীয়, অতুলনীয়!

‘বিদ্রোহী’র অভিনব উদ্ভাস, নজরুল ইসলামের দেশজোড়া খ্যাতির অধিকার একমাত্র ব্রিটিশ-রাজরোষের জন্য নয়। যদিও অগ্নিবীণা ছাড়াও তাঁর পাঁচ-পাঁচটি কাব্য ইংরেজ সরকার নিষিদ্ধ ও বাজেয়াপ্ত করেছিল। যেমন – বিষের বাঁশী, ভাঙ্গার গান, চন্দ্রবিন্দু, প্রলয়শিখা ও যুগবাণী – যা বাংলা সাহিত্যে দ্বিতীয় নেই। তবুও বিদ্রোহের খ্যাতির প্রধান আকর্ষণ ছিল অন্য বিন্দুতে। নজরুলের সর্বাত্মক বিদ্রোহ – বিশেষ করে সমগ্র দেশের তারুণ্য ও যৌবনশক্তিকে উদ্দীপ্ত-উজ্জীবিত করেছিল। সন্ত্রাসবাসের সঙ্গে সাহসী কবির সংযোগসূত্রটি সেই পথে প্রবাহিত। ‘বিদ্রোহী কবি’ উপাধি দেশের সমস্ত মানুষের কাছে স্বতঃস্ফূর্তভাবে গড়ে উঠেছে। কবি সেখানে তাঁর সমস্ত মন-প্রাণ-সৃষ্টি ঢেলে দিয়েছিলেন। যেখানে তাঁর কোনো ফাঁক ও ফাঁকি নেই। সমস্তটাই অকৃত্রিম – অন্তরের অন্তস্তল থেকে উৎসারিত।

নজরুল ইসলামের ‘বিদ্রোহী’ কবিতা প্রসঙ্গে উনিশ শতকের আমেরিকার কবি ওয়াল্ট হুইটম্যানের (১৮১৯-৯২), ‘সং অফ্ মাইসেল্ফ’ কবিতাটির উল্লেখ করা হয়। এখানেও ‘আমি’ প্রাচুর্য আছে। ‘আমি’ প্রসঙ্গে সাদৃশ্য আছে। তবে ‘সং অফ মাইসেল্ফ’ কবিতাটি প্রধানত আত্মঘোষণামূলক আর ‘বিদ্রোহী’ কবিচিত্তের উল্লাস প্রকাশমূলক কবিতা। ‘সাম্যবাদী’ কবি, ‘সর্বহারা’র কবি তো ‘চির-বিদ্রোহী’ – শেষ পর্যন্ত শাসক ও শোষকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন। যতদিন মানুষের মধ্যে উৎপীড়ন, অত্যাচার চলতে থাকবে, ততদিন পর্যন্ত বিদ্রোহমূলক লেখনীও অব্যাহত থাকবে। ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটি সমকাল পেরিয়ে প্রায় শতবর্ষ অতিক্রম করে, একুশ শতকের আধুনিক পাঠকের কাছে বিবেক-বিদ্রোহ রূপে অব্যাহত আছে। বিদ্রোহ তো শাশ্বত – চিরকালীন, নতুনতর।