শেকড়ে জেগে ওঠে প্রাণ

মৃত্তিকার প্রগাঢ় বেদনা কী তা বুঝিনি এখনো

কান পেতে পাখিদের কথাবার্তা শুনি, প্রাণ পাই

মেঘলোকে বাহারি শাড়ির প্রদর্শনী দেখে শুধু মূর্ছা যাই

তবু কেন ডাকো আত্মহনন। – (‘কেন ডাকো আত্মহনন’, মারুফ রায়হান)

 

পথের ধারে একটুকরো কাঠের বাকল খুঁজে পেয়ে তা আগলে রাখেন ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী। এখানে-ওখানে প্রতিদিন শত তুচ্ছের মাঝে তিনি ভাস্কর্যের কাঠামো খুঁজে পান। ধীরে ধীরে সেসব কাঠামোকে নির্দিষ্ট ভঙ্গির সঙ্গে মিলিয়ে গড়ে তোলেন এক নতুন মাত্রার শিল্পকর্ম।

প্রিয়ভাষিণী শুকনো গাছের ডাল, নারকেলের খোল, শেকড়-লতা-পাতা, পোড়াকাঠ, শ্যাওলাযুক্ত বাঁশ, পরিত্যক্ত মাটির পাত্র, ধাতব টিনের পাত, ভাঙা টিনের কৌটো সংগ্রহ করে তাতে গাছের চারা বোনেন। এসব কুড়িয়ে পাওয়া ডালপালায় শুধু যে প্রাণের সঞ্চার করেন তা নয়, কোনো কোনো গাছের অবয়বকে পরিবর্তন করে প্রাণীর অবয়ব গড়ে তোলেন। স্বপ্নে কিংবা বাস্তবে গড়তে থাকা এসব অবয়বকে তিনি উপস্থাপন করেন নির্দিষ্ট একটি কাঠামোর ওপর দাঁড় করিয়ে।

প্রিয়ভাষিণী একজন মুক্তিযোদ্ধা। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের মূল ভাবনা ছিল মানুষের চিমত্মার স্বাধীনতা, চেতনার স্বাধীনতা। তাঁর ভাস্কর্যগুলোতে মানুষের মুক্তির আনন্দের আভাস মেলে।

শিল্প ও শিল্পীর সম্পর্ক সৃজন ও স্রষ্টার। ভাস্কর্যে দৃষ্টিনির্ভর সৌন্দর্য সৃষ্টির জন্য প্রিয়ভাষিণী ফেলে দেওয়া গাছগাছালি, ভাঙা কৌটো, মাটির পাত্র, টিনের পাত, লতাগুল্ম এসবের মাঝে শিল্পগুণ খুঁজতে থাকেন। তাঁর গোটা জীবনের সংগ্রামী ও তিক্ত অভিজ্ঞতাকে কোনো কোনো কাজে হাজির করেন। প্রকৃতির মমতায় যে গাছগাছালি বেড়ে ওঠে, সে-গাছগাছালিই আবার পরিত্যক্ত হয়ে পড়ে থাকে অবহেলায়। প্রিয়ভাষিণী এই অবহেলাকে এড়িয়ে চলেন, প্রকৃতির মমতায় বেড়ে ওঠা গাছগুল্মকে নিজেই পরম মমতায় যত্নে নতুন এক ভাস্কর্যে রূপ দেন। ভাস্কর্যের গড়নে এক ধরনের মমতা লুকিয়ে থাকে। দর্শকের সামনে হাজির করা ভাস্কর্যে মানুষের মনের কোণে থাকা ছন্দময় ভঙ্গি প্রকাশ করতে থাকেন। প্রিয়ভাষিণী যত্নে ফেলে দেওয়া বা পরিত্যক্ত ডালপালা বা নানান জিনিসকে শিল্পে রূপ দেওয়ার জন্য তিনি প্রথমে বিষয় নির্বাচন করেন।

দার্শনিক পেস্নটোর মতামত আমলে নিয়ে উদ্ধৃতিটি আওড়ালে এরকম কথা বলা যায়।

‘সকল শিল্পকর্মই বাস্তবের অনুকৃতি’ – প্রায়ই অনুকৃতির   অনুকৃতি। প্রিয়ভাষিণীর কাজে অবয়ব তৈরির ভাবনা আসে বাস্তব থেকে যেমন – একটি কাজের শিরোনাম ‘ভালোবাসা’, নর ও নারীর আলিঙ্গনের মুহূর্ত এ-কাজটিতে দেখাতে চেয়েছেন। মানবশরীরের অস্থি, ভঙ্গি ও অঙ্গশৈলী সবটুকুই এ-কাজটিতে পাওয়া যায়। প্রথাগত অ্যাকাডেমিক রীতির ভাস্কর্য নির্মাণের ভাবনা থেকে আমাদের দর্শকদের এক ধরনের ভাস্কর্য দেখার অভ্যাস তৈরি হয়েছে। প্রিয়ভাষিণীর কাজে প্রথাগত ভাস্কর্য গড়ার স্বসিত্ম মিলবে না, দেখা যাবে এক ধরনের মানবমনের অন্তর্দৃষ্টির বহিঃপ্রকাশ। মূল্যহীন বস্ত্তকে অমূল্য করে রাখার যে-সাধনা সেটিকে ফেরদৌসী আরাধনার পর্যায়ে স্থান করে নিয়েছেন। একটি কাজের সঙ্গে অন্য আরেকটি কাজের বিস্তর পার্থক্য দেখা না গেলেও সব কাজে এক ধরনের ভাবনাগত মিল বা ঐক্য রয়েছে। প্রদর্শনীর মোট ৫৭টি কাজের মধ্যে অনেক উচ্চতর কিছু কাজের সঙ্গে নিচু কাজের সামঞ্জস্য খুঁজে পাওয়া যায়। ‘শ্রাবণ পাখি’ শিরোনামের কাজটিতে নারকেলের আস্তআকৃতির সঙ্গে জুড়ে দেওয়া গাছের ডালটি ঊর্ধ্বমুখে স্থাপন করা হয়েছে। আকাশের দিকে চেয়ে থাকা পাখির ভঙ্গিকে শিল্পী অবলোকন করেছেন যথার্থভাবেই। ভাস্কর্যটি দেখতে ফেলে দেওয়া ডাবের খোসা মনে হলেও প্রকৃত শিল্পীর হাতে গড়ে উঠেছে মায়াবী এক ভাস্কর্য। লোহা, তামা, ধাতুর পাত জোড়া দিয়ে আমাদের দেশে ভাস্কর্য নির্মাণের ইতিহাস খুব বেশিদিনের নয়। ভাস্কর আবদুর রাজ্জাক, হামিদুর রহমান, নভেরা আহমেদ, হামিদুজ্জামান খানের হাতে ধাতববস্ত্তর মাধ্যমে তৈরি ভাস্কর্য সমৃদ্ধ হয়েছে। প্রিয়ভাষিণী খানিকটা ধাতবপাতকে একটি আকৃতিতে রূপ দিয়ে তৈরি করেছেন দুটি ভাস্কর্য – একটি রাজা হর্ষবর্ধন, অন্যটি রাতের দেউল। এ দুটি ভাস্কর্যে তামার পাতকে চ্যাপ্টা করে অবয়ব গড়ে ক্যানভাস বা ভূমিতে এঁটে দিয়েছেন। অন্যদিকে কাঠের গুঁড়াকে জমিনে আটার সাহায্যে এঁটে দিয়ে তৈরি করেছেন ‘দুই বোন’ শিরোনামের শিল্পকর্মটি।

আবহমান বাংলার আনাচে-কানাচে চিরচেনা রূপ আমাদের সকলের মনে স্থায়ী আসন তৈরি করে নিয়েছে। প্রিয়ভাষিণী চিরচেনা সৌন্দর্যকে প্রত্যক্ষ করেন ভিন্ন ধাঁচে। যেমন – অপরাহ্ণে নৌকা, মিলন তিথি, শ্রাবণ পাখি, ক্ষুধার্ত বক, উই আর ইন সেইম বোট। এসব কাজ বাংলার চিরচেনা রূপের সন্ধান দেয়। প্রিয়ভাষিণীর কাজে বিষয়বর্ণন খুব বেশি না থাকলেও কাজের শিরোনাম বিষয়ের কথা বলে দেয়। দর্শক একধরনের গল্পে মেতে ওঠে। ভাস্কর্যগুলোর সঙ্গে দর্শকের মনের কথা বেজে উঠবে। মাঝে মাঝে এও মনে হতে পারে – এ তো আমাদের অতিচেনা বিষয়। প্রিয়ভাষিণীর প্রিয় মাধ্যম কাঠের সঙ্গে কাঠের গুঁড়া, রং, পাটখড়ি জুড়ে দিয়ে তৈরি করেছেন দুটি রিলিফ ভাস্কর্য, প্রতিদিন শত তুচ্ছের আড়ালে লুকিয়ে থাকা বিষয়কে শিল্প নির্মাণের জন্য তিনি যত্নে লালন করেন। জগতের কোনো কোনো বস্ত্ত অমূল্য মনে হলেও প্রিয়ভাষিণী মূল্যবান ভাস্কর্য তৈরির মাধ্যমে বোঝান যে, কোনো কিছুই ফেলনা নয়। শিল্পীমানসের অন্তর্গত চেতনায় যে-সৌন্দর্যবোধ লালিত হয়ে আসছে সেটি প্রিয়ভাষিণী চর্চা করেন দীর্ঘসময় ধরে।

বাংলাদেশের শিল্পকলায় নারীশিল্পীদের ভাস্কর্যচর্চা শুরু হয় নভেরা আহমেদের হাত ধরে। পরবর্তী সময়ে শামীম শিকদার, আইভী জামান, লালারুখ সেলিম, নাসিমা আহমেদ মিতু প্রমুখ ভাস্কর্য তৈরিতে মনোযোগী হন। এটি বলার কারণ হলো, একটি রক্ষণশীল সমাজ-কাঠামোয় ভাস্কর্য তৈরি এমনিতে ঝুঁকিপূর্ণ। তাঁর চেয়ে বেশি ঝুঁকি নিয়ে নারী-ভাস্কররা কাজ করে চলেছেন। আমাদের দেশের সে বন্ধ্যা সামাজিক অবস্থার অমানিশা কাটাতে প্রিয়ভাষিণী এক আলোকবর্তিকা হিসেবে কাজ করছেন।

প্রথাগত প্রাতিষ্ঠানিক শিল্পশিক্ষার বাইরে থেকে শুধু অন্তর্দৃষ্টির অনুভূতিকে সঙ্গে নিয়ে প্রিয়ভাষিণী যে-অবয়ব গড়ে তোলেন, সেটি আমাদের শিল্পকলার অঙ্গনকে সমৃদ্ধ করে তোলে।

বাংলাদেশে শিল্পচর্চার মাধ্যম, আঙ্গিক, শৈলী বহু রকমের। প্রিয়ভাষিণীর তৈরি করা ভাস্কর্য এক ধরনের ফ্যান্টাসি তৈরি করে, দর্শকদের মধ্যে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়, দর্শকের মনে লুকিয়ে থাকা বিষয়গুলো উসকে ওঠে। শিল্পীর কাজ তো মনে হয় লুকিয়ে থাকা অন্তর্জগৎকে প্রকাশ করে দেওয়া। এ-কাজটি করেছেন প্রিয়ভাষিণী।

রূপবন্ধ, কল্পলোকের সঙ্গে বাস্তবের সংযোগ তৈরি, উলস্নম্ব-আড়াআড়ি সবরকমের দৃষ্টিগ্রাহ্য বিষয়ের সঙ্গে মাধুর্য সৃষ্টি করে প্রিয়ভাষিণী দর্শকদের জন্য যজ্ঞ তৈরি করেন।

এভাবেই আজীবন লড়াকু, সংগ্রামী, সাহসী এক মানুষের হাতে সৃষ্টি হওয়া শিল্পকর্মগুলো আমাদের কাছে আপনের চেয়েও আপন হয়ে ওঠে।

‘মেঘের সঙ্গী’ শিরোনামের ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণীর এ-প্রদর্শনীটি সমকালীন চিত্রশালা শিল্পাঙ্গনে গত ৪ আগস্ট শুরু হয়ে শেষ হয়েছে ১৮ আগস্ট।