এক শিল্পীর নিরন্তর পথচলার কাহিনি

হামিদ কায়সার
সঙ্গীত ও আমার জীবন
রামকানাই দাশ

নবযুগ প্রকাশনী
ঢাকা, ২০১১
২৫০ টাকা

হাওরের দেশ ভাটির দেশ সিলেট তথা সুনামগঞ্জের জল-হাওয়া-মাটি যে তার কত সন্তানকে সুরের বরমাল্য দান করেছে, তা সত্যিই আজ গবেষণার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। সুরমা নদীর ধারায় বেড়ে ওঠা হাছন রাজা অনেক আগেই কিংবদন্তি। জালাল শাহ, শাহ আবদুল করিমও রীতিমতো অবিস্মরণীয় হয়ে উঠেছেন। আরো কত গায়েন, কত শিল্পীর যে জন্ম হয়েছে সংগীতের সেই লীলাভূমিতে, আমরা তার কজনের নাম জানি? আমরা কি জানি একজন রামকানাই দাশের কথা? সাধারণ এক কৃষক পরিবারের সন্তান হয়েও যিনি নিজের নিরন্তর প্রচেষ্টা আর সাধনায় হয়ে উঠেছেন ক্লাসিক্যাল সংগীতের এক অনন্য গুণী শিল্পী। সেটা জানার জন্যই পাঠ নিতে হবে তার আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ সঙ্গীত ও আমার জীবনের।
কিছু কিছু মানুষের জীবন যে গল্পের চেয়েও ঘটনাবহুল থাকে আর রূপকথার চেয়েও হয় চমকপ্রদ, রামকানাই দাশ তাদেরই একজন। এই মহতী শিল্পীকে প্রথমেই বাড়তি ধন্যবাদ দিয়ে রাখতে হয় এজন্যে যে, তিনি তাঁর শিল্পী হয়ে ওঠা, বেড়ে ওঠার কাহিনি চমৎকার ভাষায় তুলে ধরেছেন। এ প্রবণতাটা আমাদের দেশের সংগীতশিল্পীদের নেই বললেই চলে। শিল্পীর জীবন সাধারণ মানুষের চেয়ে একটু ভিন্ন, তাঁর দেখবার চোখ অনন্য, ভাবনার শক্তিও গভীর। সে-কারণেই একজন রামকানাই দাশের আত্মজীবনী কেবল তাঁর নিজের থাকেনি, হয়ে উঠেছে সিলেট-সুনামগঞ্জ ভাটি অঞ্চলের সামগ্রিক এক জীবনচিত্র, সময়ের ছবি। ভাটির দেশের প্রকৃতিই যে ওখানকার মানুষের মনের মধ্যে সুরের মায়াজাল বিস্তার করে দিয়েছে তাতে সন্দেহ নেই। বছরের প্রায় ছয় মাস জলাবদ্ধতার কারণে সেখানকার জীবন থমকে থাকতো। তখন গান-বাজনা, যাত্রা-নাটক করে বিনোদন খোঁজার চেষ্টা করত ভাটি অঞ্চলের মানুষ। আর প্রকৃতির বৈচিত্র্যই তাদের মনকে করে তুলতো অনুভূতিপ্রবণ, সংবেদনশীল। ফলে সুর এবং গানই হয়ে উঠেছিল সেখানকার জীবনধারার এক অনন্য বৈশিষ্ট্য।
রামকানাই দাশের এই আত্মজীবনীতে আছে সে-সময়চিত্রেরই অন্তরঙ্গ বিবরণ, শিল্পীমানস তৈরি হওয়ার নৃতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ। ২৩টি অধ্যায়েই শিল্পীর এই গভীর অভিনিবিষ্টের চিত্র খুঁজে পাওয়া যাবে। যেমন, দ্বিতীয় অধ্যায় ‘জয় জয় মঙ্গলধ্বনি’ থেকেই তুলে ধরা যাক। শিল্পী লিখেছেন ‘মা জ্বলন্ত চুলায় নির্দিষ্ট লয়ে ধানের কুড়া দিচ্ছেন, কোলে স্তন্যপানরত আমি। মুখে তাঁর সুর, একই সঙ্গে হাতা দিয়ে তাঁর ভাত বা তরকারি নাড়াচাড়া। গান শুনতে শুনতে আমি ঘুমিয়ে পড়তাম একসময়। কিন্তু মাতৃস্তন্যের সঙ্গে মিশে যাওয়া লোকগীতির সুরগুলো যেন আজো জেগে আছে আমার সত্তায়।’ মাতৃস্তন্য পানের সময় গান শুনতে শুনতে যে-মানুষটি বেড়ে উঠেছেন, পরবর্তীকালে তিনি কি শিল্পী না হয়ে পারেন?
শিল্পী তো হয়েছেনই, হয়েছেন সেই দুর্লভ শিল্পীদের একজন, যিনি সামান্য কৃষক পরিবারের সন্তান হয়ে স্বশিক্ষায় অর্জন করেছেন ক্লাসিক্যাল গানের উচ্চাঙ্গ এক আসন, যার সম্পর্কে মূল্যায়ন করতে গিয়ে ওয়াহিদুল হকের মতো একজন বিদগ্ধ শিল্পরসিক বলেন, ‘আমাকে কেউ যদি বলেন, দেশের সবচেয়ে ভালো খেয়াল গাইয়ে কে? প্রশ্নটা ঠিক হবে না। তবু উত্তর করার আগে বেঠিক জেনেও আমার মন সঙ্গে সঙ্গেই উত্তর দেয়, রামকানাই। সিলেটের রামকানাই দাশ। সংগীতের সূক্ষ্মবোধ তাঁর মতো কারো মধ্যে দেখিনি। খেয়ালশৈলীর এই পরমগুরু বোধকরি একমাত্র উচ্চাঙ্গ সংগীতের ওস্তাদ, যিনি প্রকৃত রবীন্দ্রসংগীত মনস্ক। তিনি শেখানও তা এবং শেখাতে গিয়ে কেঁদে বুক ভাসান। আমাদের দেশীয় গ্রাম্য গানের বিষয়েও তার রুচি, অভিজ্ঞতা এবং অধিকার অতুলনীয়। রামকানাইকে সকলেই কেবল খেয়াল গায়ক বলে জানেন মাত্র। তিনি গ্রাম্য গান, তবলা বাদনেরও বড়মাপের শিল্পী।’
ওয়াহিদুল হকের আরেকটি মন্তব্য এখানে উদ্ধৃত করলে এই শিল্পীকে বোঝাটা আরেকটু সহজ হবে, ‘তার নায়ক তিনি নিজে। চাষী বাপের ছেলে, হাল বেয়ে দিন কাটে। কোথা থেকে মাথায় ঢুকলো সংগীতের পোকা। মানে যাত্রা। বাড়িতে তা সম্ভব নয় বলে বাবাকে বললেন, দূরবর্তী যে ক্ষেত খোলা আছে সেখানেই মাচা করে থাকবেন। বাপ ছেলের সুমতি দেখে মহাখুশি। ছেলে তো মাচা থেকে বেরিয়ে প্রতি রাতেই এলাকার সমস্ত যাত্রার আসর চষে বেড়াতে আরম্ভ করলো। ধরা না পড়বার জন্য সারাদিনমান ক্ষেতে খাটতে হতো। শরীর ভাঙলো, কিন্তু সংগীতের বোধ ও বুদ্ধি এতোটাই পাকলো যে, একদিন কৃষিকর্ম ও পিতৃদেবকে নমস্কার জানিয়ে যাত্রা দলেই নাম লেখালেন। ফাঁকে ফাঁকে যেখানেই সুযোগ পেয়েছেন ওস্তাদের পায়ে গিয়ে পড়েছেন।’
শিল্পী হওয়ার জন্যে প্রকৃতিই বুঝি সব আয়োজন করে থাকে। রামকানাই দাশকে শিল্পী হিসেবে গড়ে তুলেছে তার পুটকা গ্রাম, পেরুয়া গ্রামের নিসর্গ, মানুষ এবং পরিবেশ। পুটকা গ্রামের বাস চুকিয়ে বাবা-মায়ের সঙ্গে পেরুয়া গ্রামে এসে যেদিন তিনি স্কুলে যাবার জন্য সবে প্রস্ত্ততি নিচ্ছেন, তখনই বাবার এক মাসতুতো ভাই এলেন, তিনি বাবার কাছে প্রস্তাব দিলেন, ‘আমি একটা শখের যাত্রাদল করেছি। বাইরে থেকে অনেক লোক এনেছি, কিন্তু যদুপতি পালায় কিশোর সুবাহু চরিত্রের জন্য কাউকে পাচ্ছি না। তাই আমি রামকানাইকে নিতে চাই এ চরিত্রের জন্য।’ প্রস্তাবের আকস্মিকতায় বাবা যেন আকাশ থেকে পড়লেন; বললেন, ‘বলিস কী, আজ তো সে স্কুলে ভর্তি হবে।’ বাবাকে অনেক বুঝিয়ে-সুজিয়ে কাকু রাজি করিয়ে ফেললেন। হয়তো ভেতরে ভেতরে সায় ছিল আমারও। তবে সন্দেহ নেই যে সেটা ছিল আমার জীবনের ঊষালগ্নে সূচিত বিশাল এক বাঁক বদল। আমার প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়া সেখানেই চিরতরে সাঙ্গ হয়ে যায়।’
আজ কেউ ভাবতে পারেন, শুধু যাত্রাগানে অংশ নেওয়ার জন্য কেউ লেখাপড়ার পাট চুকিয়ে ফেলতে পারে বা সেটা সম্ভব? কাকু বাবার কাছে বলে গিয়েছিলেন ঠিকই, রামপুরে রামকানাই দাশের লেখাপড়াটা তিনি চালিয়ে নেবেন, কিন্তু রামকানাইয়েরই সেদিকে মন ছিল না। সে ওই যাত্রাগান-পালানাটক-তবলা বাদন এসব নিয়েই থাকতো। ভবিষ্যতে জীবন কীভাবে চলবে না চলবে না, এসব নিয়ে কারোর মধ্যেই কোনো ভাবনা ছিল না। গানের ভেলায় ভেসে ভেসে জীবন একটা সুর খুঁজে পাবেই – এমন একটা বিশ্বাসে আর ধ্যানেই যেন দিনগুলো তার কেটে যেতে লাগলো। রামকানাই নিজে যেমন গান পরিবেশন কিংবা তবলা বাজিয়ে আনন্দে বুঁদ হয়ে থাকতেন, তেমনি শেখার প্রতিও আগ্রহ ছিল প্রচন্ড।
গুরুস্থানীয় কাউকে পেলেই তার কাছে দীক্ষা নিতেন, এমনকি রেডিওর কাছ থেকেও নিয়েছেন সুরের দীক্ষা। রামকানাই দাশের অভিজ্ঞতা থেকেই শোনা যাক, যে-অভিজ্ঞতায় তাঁর শিল্পীসত্তার গভীর মর্মলোককেও খুঁজে পাওয়া যাবে, ‘আমার মায়ের বাবা যখন মৃত্যুশয্যায়, তখন অনেক আত্মীয়স্বজন মামাদের বাড়িতে জড়ো হয়েছিলেন। আমার মা-ও ছিলেন। ছিলাম আমিও। দাদু মারা যাবার সঙ্গে সঙ্গে বাড়িতে কান্নার রোল পড়ে যায়। আমার মা এবং বড় মাসি একে অন্যের গলা ধরে কাঁদছিলেন। মার সে মর্মস্পর্শী কান্নার সুরটি আমি আজো ভুলতে পারিনি। আশ্চর্যের কথা, আমি শুদ্ধকল্যাণ রাগ গাওয়ার সময় আমার গায়কীতে মায়ের সে কান্নার খানিক ছায়া পড়ে। দাদুর মৃত্যুর বছরদশেক পরে শাল্লার এক ধনী বন্ধু হরেন্দ্র চৌধুরীর বাড়িতে এক সন্ধ্যায় রেডিও শুনতে যাই। আমার বয়স তখন প্রায় ২০-২১ হবে। রেডিও তখন গ্রামাঞ্চলে এক আশ্চর্য বস্ত্ত। হঠাৎ শুনি এক শিল্পী খেয়াল গাইছেন। ঘোষকের ঘোষণায় জানতে পারলাম রাগের নাম শুদ্ধকল্যাণ আর শিল্পীর নাম এ টি কানন। সেদিনই অনুভব করি শিল্পীর গাওয়া উচ্চাঙ্গসংগীতের সাথে পল্লী মেয়ের পিতা হারানোর কান্নার সুর মিশে অপূর্ব সুন্দর এক আবহের সৃষ্টি হয়েছে।’ এভাবেই সমাজ-সময় এবং রামকানাই দাশের শিল্পীসত্তার বিকাশ একসঙ্গে চিত্রিত হতে থাকে।
গ্রামদেশে এই রেডিওর আবির্ভাব নিয়েও একটি মজার অভিজ্ঞতা তুলে ধরেছেন তিনি, ‘একদিন ফাল্গুন মাসের বিকেলে গ্রামের এক বাজারে গিয়েছি কী এক কাজে। হঠাৎ একজন লোককে তাঁর আশ্চর্য এক অভিজ্ঞতার গল্প বাজারের মানুষজনকে বলতে দেখলাম। লোকটি ভাটিপাড়ার ফয়জুননুর চৌধুরীর ছাগাইয়া বিলের খলায় একটা ছোট বাক্সের মতো একটা যন্ত্র দেখে এসেছে। সে বলছিল, যন্ত্রটির ভেতর থেকে কলিকাতার মানুষের গান পর্যন্ত শোনা যায়। বড় বড় বাজিয়েরা ঢোলক, করতাল, বাঁশি প্রভৃতি যন্ত্র বাজায়; আর কত রকমের গান যে গায় গায়কেরা। লোকটির গল্প শুনে তাজ্জব বনে যাই। তখন কলিকাতা নামটাই কেবল শুনেছি। বাজারের কাজ ফেলে ছুটে আসি বাড়িতে। বন্ধু অখিল রায় এবং রমতপুর নোয়াগাঁওয়ের সুরেশ দাশকে সঙ্গে নিয়ে তৎক্ষণাৎ রওনা দেই তেরো-চৌদ্দ মাইল দূরবর্তী ছাগাইয়া বিলের উদ্দেশে।’ তারা যখন ফয়জুননুর চৌধুরীর বাড়িতে পৌঁছালেন, ‘তখন যন্ত্রটির ভেতর সেতারে একটা বাজনা হচ্ছিল, মন ছিল সেদিকেই। জানলাম যন্ত্রটির নাম রেডিও।’
রামপুর থেকে আবার নিজের বাড়ি, বাড়ি থেকে নতুন করে আজমেরীগঞ্জে থিতু হওয়া। আজমেরীগঞ্জে এই থিতু হওয়াও ঘটে চমকপ্রদ এক ঘটনার ভেতর দিয়ে। আজমেরীগঞ্জে যেদিন প্রথম গেলেন সেদিনেরই বর্ণনা, ‘সন্ধ্যার পর বাজারে ঘোরাফেরা করছি, হঠাৎ শুনি কোথা থেকে গান-বাজনার শব্দ আসছে। ফার্মেসির নাম ‘মেসার্স রাজচন্দ্র ফার্মেসি।’ ফার্মেসির প্রধান চেয়ারে একজন সৌম্যদর্শন ডাক্তার বসে আছেন। মেয়েকণ্ঠের গান, দোকানের সামনের হেলান বেঞ্চে বসে স্বভাবদোষবশত টেবিলে তাল ঠুকছিলাম। ডাক্তার বললেন, ‘তাল বাজাইও না। এটা গদি, কী চাও তুমি?’ উত্তর দিলাম, আমি গান শুনছি। আমি একজন সংগীত শিক্ষক, কিঞ্চিৎ গান-বাজনা জানি। নামধাম জানালাম তাঁকে। মেঘ না চাইতেই জলের ন্যায় আমি তাঁর সস্নেহ দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হলাম নিমিষে। ডাক্তার বাবু নিজে আমাকে ভেতরে নিয়ে গেলেন। সেখানে গাইছিল তার বড় মেয়ে রেবা। এক ওস্তাদ গান শেখাচ্ছিলেন তাকে। তখন তবলায় আমার মোটামুটি ভালো নাম এলাকায়, বাজনা ছিল দাপুটে। গিয়েই তবলা হাতে নিলাম, প্রথমে বাজালাম ছাত্রীর সঙ্গে, বাজনা শুনে আশপাশ থেকে গণ্যমান্য বেশ কয়েকজন নারী-পুরুষ হাজির হলেন সেখানে। বাসাটি ছিল আজমিরিগঞ্জের সে সময়ের নামকরা ডাক্তার রমেশচন্দ্র রায়ের। পাশের বাসা থেকে এসেছিল যোগেন্দ্রচন্দ্র ডাক্তারের ছেলে ঝুনু, আমার বয়সের। কটি আধুনিক গান গাইল বেশ। রাত দশটা পর্যন্ত চললো আসর। যে নৌকায় গিয়েছিলাম, সে নৌকায় বাড়ি ফেরার কথা ছিল, কিন্তু ফেরা হলো না আমার।’
আজমিরিগঞ্জেই রয়ে গেলেন রামকানাই দাশ এবং এ-পর্যায়ে তার জীবনের উল্লেখযোগ্য একটা বাঁক পরিবর্তন হলো। আজমিরিগঞ্জের ঘরে ঘরে তখন রেডিও। তিনি এখানে জীবিকার নতুন সন্ধান পেলেন। প্রচুর টিউশনি পেলেন গান শেখানোর। পরবর্তী জীবনে এই টিউশনি বা গান শেখানোই তার জীবনের অর্থোপার্জনের প্রধান অবলম্বন হয়ে উঠেছিল। এখানে তিনি প্রাজ্ঞ কয়েকজন সংগীতরসিকের সান্নিধ্যলাভের মাধ্যমে নিজের সংগীতজ্ঞানকেও নতুন উচ্চতায় নিয়ে যাওয়ার সুযোগ লাভ করেন। বিশেষ করে রবীন্দ্রসংগীত সম্পর্কে স্বচ্ছ এবং প্রকৃত শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে ওঠেন, যে-রবীন্দ্রসংগীত তিনি টপ্পার মতো করে গাইতেন অথবা যেমন খুশি তেমন লয়ে।
এই আজমিরিগঞ্জ থাকাকালেই তিনি বিয়ে করেন সুবর্ণপ্রভা সরকার নামে এক সুন্দরী মেয়েকে। কিন্তু তা সত্ত্বেও গানের প্রতি প্রেমটাই তাঁর কাছে মুখ্য থাকে। নতুন বউকে বাড়িতে রেখে তিনি আবার ফিরে আসেন আজমিরিগঞ্জ, যেখানে গানই তাঁর জীবিকা, গানই তাঁর ধ্যানজ্ঞানপ্রেম সবকিছু। আজমিরিগঞ্জ থেকে মাঝে মাঝেই তিনি গান শেখার জন্য ওস্তাদের কাছে চলে যেতেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। সেই ব্রাহ্মণবাড়িয়াই হয়ে উঠল তাঁর গানচারণের নতুন ক্ষেত্র, ‘ব্রাহ্মণবাড়িয়া তখন বহুমাত্রিক সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের এক অনন্য কেন্দ্রস্থল। যাত্রাশিল্পের ক্ষেত্রেও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার খ্যাতি তখন সারাদেশে। বড় বড় পেশাদার যাত্রাপার্টি প্রায় সবই ব্রাহ্মণবাড়িয়ার। জয়দুর্গা, ভোলানাথ, ভাগ্যলক্ষ্মী প্রভৃতি দলের খ্যাতি তখন দেশজোড়া। সেসব দলে কাজ করা অনেক ভাগ্যের ব্যাপার ছিল। কলকাতা থেকেও অনেক অভিনেতা-অভিনেত্রী যোগ দিতেন সেসব দলে। প্রধান যাত্রাদলের মালিক ছিলেন বিখ্যাত যতীন চক্রবর্তী। প্রতি বছর আষাঢ় মাসে দল গঠন করা হতো। বন্দোবস্তমতে লোকজন যোগ দিত আষাঢ় মাসে। চৈত্র মাসে বাসন্তী পূজায় গান গেয়ে দল ছুটি।’ রামকানাই দাশ ভাগ্যলক্ষ্মী অপেরার সাথে নাম লেখালেন। তার এখনকার উপলব্ধি, ‘আজ বুঝি, চুক্তিটা আমার ভাগ্যলক্ষ্মী অপেরার সাথে হয়নি; হয়েছিল বোধ হয় প্রকৃত ভাগ্যলক্ষ্মীর সঙ্গেই।’ যাত্রাদলে তিনি সংগীত পরিচালনা করতেন, সংগীত বাদনেও অংশ নিতেন, গাইতেন হৃদয়ের সমস্ত দরদ ঢেলে। এই যাত্রাদলের প্রতি তাঁর প্রধান দুর্বলতার কারণ, যাত্রার সুবাদে সারাদেশ তাঁর ঘোরা হয়েছে চেনা হয়েছে, যাত্রা তাঁর দৃষ্টিকে বিশাল দিগন্ত অভিমুখে প্রসারিত করেছে, দেশের সংগীত পরিমন্ডলের অনেক জ্ঞানীগুণীকে চেনাজানার সুযোগ দিয়েছে।
বেশ কয়েক বছর যাত্রাদলের সঙ্গে কাটিয়ে তিনি সিলেট রেডিওতে যোগদান করেন। কিন্তু খুব বেশিদিন তিনি ভদ্রসন্তানদের সঙ্গে কাটাতে পারেননি। ক্ষুদ্র-সংকীর্ণদের ষড়যন্ত্র আর ঈর্ষার শিকার হয়েছেন, মানসিক নিগ্রহের শিকার হয়েছেন চরমভাবে। শেষে তিষ্ঠাতে না পেরে তিনি চরম অনিশ্চয়তায় পড়ার আশঙ্কা নিয়েও সিলেট রেডিওর চাকরিটা ছেড়ে দেন। এরকম ঈর্ষা এবং ষড়যন্ত্রের শিকার তিনি বারবারই হয়েছেন, যাত্রাদলে যোগ দেওয়ার সময় যা ঘটেছিল, তা তো সিনেমার চিত্রনাট্যকেও হার মানায়, যাত্রার কয়েকজন সদস্য যখন যাত্রাদলের মালিককে অভিযোগ করে জানালেন রামকানাই দাশকে দিয়ে কিছু হবে না, তখন ‘পান্ডে মশাই অতি রুক্ষস্বরে আমাকে উদ্দেশ করে বললেন, ‘কি এসিস্ট্যান্ড বাইন, চুক্তির সময় তো খুব বড় কতা বলেছিলেন, এখন কী শুনি?’ বিনীতভাবে আমি জবাব দিলাম, ‘বাবু, এখন পর্যন্ত কোনো যন্ত্রে আমাকে হাত দিতে দেওয়া হয়নি। আমার যোগ্যতার পরীক্ষা তো হলো না। আপনি স্বয়ং এসেছেন, অনুমতি দিলে আমি পরীক্ষার জন্য প্রস্ত্তত।’ সঙ্গে সঙ্গে যন্ত্র বের করা হলো। তবলা খুব ভালো করে টিউন করলাম। খুব কঠিন একটা নাচের গান ধরলো ছেলেরা, আমাকে সে গানের সঙ্গে তবলা বাজাতে হলো। গান শেষ হলে গোপাল বাবু কয়েক সেকেন্ড নীরব মৌন রইলেন। কক্ষে তখন পিনপতন নীরবতা। অতঃপর ম্যানেজারকে ডাকলেন। ম্যানেজার নরেন বণিক এলে তাঁকে বললেন, ‘রামকানাইদার মাইনে কত নরেন বাবু?’ ‘সত্তর টাকা।’ জানালেন নরেন বাবু। গোপাল পান্ডে আমার বেতন সত্তর থেকে বাড়িয়ে একশ কুড়ি টাকায় উন্নীত করার আদেশ দিলেন তাকে। এটা হেড বাইনের সমান বেতন হওয়ায় চন্দ্রমোহন বাবু অপমানিত বোধ করে দল ছেড়ে অন্যত্র চলে গেলেন।’
শুধু যাত্রাদলে নয়, রেডিওর চাকরির ক্ষেত্রে নয়, জীবনের প্রায় সর্বপর্যায়েই প্রায় রামকানাই দাশকে এইসব হিংসা-বিদ্বেষ-সংকীর্ণতা আর ক্ষুদ্রতার মুখোমুখি হতে হয়েছে, তাঁর সংবেদনশীল শিল্পীসত্তাকে আহত করেছে, সে-কারণেই তাঁর এই আত্মজীবনী অবশ্যই সবার পাঠযোগ্য হয়ে উঠেছে। কারণ, মানুষের ভবিতব্যই বোধ হয় এটা, তাকে নানা পরীক্ষার ভেতর দিয়ে উত্তীর্ণ হয়ে আসতে হয়, জীবনের হলাহলে পান করে নিতে হয় সুখ মদিরার স্বাদ। রেডিওর চাকরি ছাড়ার পর যে অনিশ্চিত অাঁধারে পড়তে হবে বলে তিনি কিছুটা চিন্তিত হয়েছিলেন, দেখা গেল সেই পরবর্তীকালটিই তাঁকে, তাঁর শিল্পীসত্তাকে নতুন উচ্চতায় পৌঁছাতে সাহায্য করেছে। তিনি এ-সময়ে সিলেট শহরে টিউশনি, গান শেখানোয় গভীরভাবে মনোনিবেশ করেন, ধীরে ধীরে গড়ে তোলেন সংগীত বিদ্যালয়। এই কাল পর্যায়েই তাঁর সংগীত প্রতিভা এবং সাংগঠনিক শক্তি তাঁকে সিলেটের বাইরে প্রায় সারাদেশে পরিচিত করে তোলে। বিশেষ করে রাজধানী ঢাকার সঙ্গে তাঁর একটি যোগসূত্র তৈরি হয়। তিনি ওয়াহিদুল হক, সন্জীদা খাতুনের মতো সংগীতের বিশাল সব প্রতিষ্ঠান এবং দিগ্বর্তিকা আলোকদর্শীর সুনজরে আসেন এবং শ্রদ্ধাও অর্জন করেন। যার পরিচয় ছড়িয়ে আছে এ বইয়ে সন্জীদা খাতুনের মূল্যবান ভূমিকাতেও, ‘আপন গন্ডি ভেঙে ক্রমাগত এগিয়ে চলবার ব্যাকুল তাড়না ছিল এই লোকগায়কের। কৃষিকাজ ছেড়ে কবিগান আর যাত্রাকে পেশা হিসেবে অবলম্বন করে, রাগসংগীতের শিক্ষাগ্রহণে প্রবৃত্ত হলেন যাত্রাদলের ওস্তাদজীর কাছে। লোকসংগীত আর শুদ্ধসংগীতকে আমরা পরস্পর দূরবর্তী ভেবে ভুল করি। মায়ের বিলাপ শুনে যে ব্যক্তি শুদ্ধ রাগের সরগম আর বেদনা চিনে নিয়েছেন, তার কাছে শুদ্ধসংগীত-লোকসংগীতের আত্মিক যোগ প্রতিভাত হয়ে ওঠাই স্বাভাবিক। তাই লৌকিক মাটির গান আর আকাশবিহারী শুদ্ধ রাগরাগিণীর পারস্পরিক আর সর্বাত্মক পরিচয় গ্রহণে নিবেদিত হন রামকানাই। উপস্থাপনার শৈলীতেও কিছু কম আগ্রহ ছিল না এই গীতিসাধকের। ওস্তাদজী কালীমোহন চক্রবর্তীর সঙ্গে আসরে ঘুরে তবলাসঙ্গত করতে গিয়ে সে-পাঠও আয়ত্ত করেছেন। দিনের পনেরো ষোলো ঘণ্টা ধরে চলতো সাধনা।’
রামকানাই দাশের সঙ্গীত ও আমার জীবন বইটি পড়ে এই শিক্ষাই লাভ করা যায় যে, প্রতিভা হতে পারে প্রকৃতিদত্ত, কিন্তু সে অনন্য ভান্ডারকে প্রস্ফুটিত করার জন্য পরিশ্রম সাধনার কোনো বিকল্প নেই। তিনি জীবনের প্রতিটি পর্বেই শিখেছেন, শেখার জন্য শুধু ওস্তাদজীর সান্নিধ্যে যাননি, সামনে যা পেয়েছেন, তা থেকেই নিজেকে সমৃদ্ধ করার চেষ্টা করেছেন – মানুষ, মাটি, প্রকৃতি, পরিবেশ, এমনকি রেডিও পর্যন্ত। রেডিওর ক্লাসিক্যাল গান তিনি প্রখর স্মৃতিশক্তির গুণে মনে রেখেছেন, আত্মস্থ করেছেন। তিনি লেখক নন, সংগীতের একজন মহীরুহ পুরুষ। লেখক না হয়েও যে এই স্মৃতিসঞ্চয় আমাদের জন্য লিখে গেলেন, সেটার জন্যও তিনি ধন্যবাদের পাত্র। বর্তমানে তিনি যুক্তরাষ্ট্রে আছেন, কন্যা কাবেরী দাশের সঙ্গে, কাবেরী দাশও সেখানে ছড়িয়ে চলেছেন সংগীতের মাধুরীর অনন্তধারা। শিল্পীর পথচলা তো থামে না, বয়ে নিয়ে চলে উত্তরাধিকার। ভালো থাকুন রামকানাই দাশ, সঙ্গীত ও আমার জীবন হোক বহুল পাঠ্য।