সময়ের আয়নায় নারীর কষ্ট-বঞ্চনার কথা

ক্ষুব্ধ সংলাপ l আনোয়ারা সৈয়দ হক l ইত্যাদি গ্রন্থ প্রকাশ l ঢাকা, ২০১১ l ২৮০ টাকা

আনোয়ারা সৈয়দ হকের ক্ষুব্ধ সংলাপ বইটি পড়ে যুগপৎভাবে আমিও ক্ষুব্ধ এবং বিস্মিত। বাংলার ঘরে ঘরে নারী-বধূ-মাতাদের প্রতি নিপীড়ন-নির্যাতনের ইতিহাস রয়েছে, যা নিয়ে মহাকাব্য লেখার মতো তথ্য-উপাত্ত এ দুর্ভাগা দেশে দুর্লভ নয়। বইটির শিরোনাম আমাকে বিশেষভাবে উৎসাহিত করেছে পড়ার জন্য। এর ভেতরে এমন কী যন্ত্রণা এমন কী মর্মবেদনা রয়েছে যা বইটির নামের আড়ালে ফুটে উঠেছে!

বইটি আত্মজীবনীমূলক। কোনো রকম রাখঢাক না করেই নিজের জীবনের সমস্ত গ্লানি ও কষ্টকর দিকগুলো অকপটে তুলে  ধরেছেন লেখিকা। পিতা কর্তৃক মাতার নিপীড়ন-নির্যাতনের নির্মম কাহিনি তাঁর জীবনকে যেমন বেদনায় বিক্ষুব্ধ  করেছে,  পাঠকের  চিত্তকেও  ঠিক  তেমনি ক্ষত-বিক্ষত করে তোলে। মায়ের প্রতি বাবার এমন আচরণের পুনরাবৃত্তি প্রায় প্রতিনিয়তই লেখিকাকে দেখতে হয়েছে, যা তাঁর হৃদয়কে বারবার ব্যথাতুর করেছে। তথাপি জীবন চলছে জীবনের গতিতেই। প্রতিকূল পরিবেশের মধ্যে চলতে  চলতে  গ্রন্থকার  নানা  বাধা  অতিক্রম  করে খ্যাতিমান সাহিত্যিক-চিন্তাবিদদের তালিকার নিজের স্থান করে নিয়েছেন। মৈত্রেয়ী দেবীর আত্মজীবনীমূলক বিয়োগান্তক প্রেমের উপন্যাস ন হন্যতে পড়ে পাঠক-পাঠিকার হৃদয়ে রক্তক্ষরণ ঘটেছে; কিন্তু তারপরেও তাঁর চারপাশের জগৎ ও জীবনের সমগ্রতা বইটিতে ফুটে ওঠেনি। এখানেই আলোচ্য লেখকের সঙ্গে তাঁর পার্থক্য। ক্ষুব্ধ সংলাপে আনোয়ারা সৈয়দ হকের সমগ্র জীবনের ছোট-বড় অনালোচিত-অনালোকিত ঘটনাবলি বিধৃত হয়েছে। ন হন্যতে পড়ে আমার উপলব্ধি, আমার চিত্তবেদনার কথা মৈত্রেয়ী দেবীকে জানিয়েছিলাম। তিনি জবাবে লিখেছিলেন, ‘একজন পাঠকের কাছ থেকে এ ধরনের একটি চিঠি পাওয়া ঈশ্বরের আশীর্বাদ বলে মনে করি।’

তসলিমা নাসরিন তাঁর নির্বাচিত কলাম বইতে পিতা কর্তৃক মাতার উপেক্ষিত-অবহেলিত হওয়ার বিস্তারিত বিবরণ দিয়েছেন। অসুস্থ মায়ের জন্য এক পোয়া দুধ সংসার থেকে বরাদ্দ দেওয়া হয়নি। মেয়েমানুষ বলেই মায়ের সুচিকিৎসা, সুখাদ্য জোটেনি। হাঁস-মুরগির জন্যে কিছু বরাদ্দ রেখে বাকি যেটুকু খাদ্য অবশিষ্ট থাকত তাই খেয়েই রাত যাপন করতে হতো মাকে। এমনকি তসলিমা নাসরিন নিজে চাকরি করে মাকে দুধ খাওয়াবেন বলে প্রতিজ্ঞা করেও পেরে ওঠেননি।

আনোয়ারা সৈয়দ হক বাল্যবয়সে ’৪৭-এর দেশভাগের করুণ পরিণতি দেখে ব্যথিত হয়েছেন, যার মর্মস্পর্শী চিত্র তিনি তুলে ধরেছেন এ-গ্রন্থে। এই ঘটনাবলি আমাকেও নিয়ে যায় সেই দূর অতীতের রোমহর্ষক দিনগুলোতে। আমি তখন ক্লাস সেভেনে পড়ি। কাজেই সেসব দিনের দুঃসহ স্মৃতি আমার হৃদয় থেকে মুছে যায়নি। ১৪ আগস্ট ’৪৭-এর এক প্রভাতে আমার প্রিয় হিন্দু সহপাঠীরা দেখল যে, দেশ ভেঙে সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রের জন্ম হলো, যাদের অনুকম্পায় তাদের বাঁচা-মরা নির্ভরশীল। একই স্কুলে একই বেঞ্চে পাশাপাশি বসে ক্লাস করেছি। পূজা-পার্বণে তাদের বাড়ি গিয়ে আনন্দ-কোলাহলে মেতে উঠেছি। সেই বন্ধুরা আজ কোথায়? মানবসৃষ্ট এই বিপর্যয়ের দৃষ্টান্ত বিরল। একবার দিল্লি থেকে কলকাতা আসার পথে ট্রেনে হরিদাস বাবুর সঙ্গে আলাপচারিতায় তিনি বলেন, বাংলাদেশে ফরিদপুর তাঁর আদি  নিবাস।   আমার   বাড়িও   ফরিদপুর   জেনে  আনন্দে-উচ্ছ্বাসে বিগলিত হয়ে উঠলেন। ভারতব্যাপী ’৪৬, ’৪৭-এর সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা-হাঙ্গামার মর্মস্পর্শী চিত্র তুলে আর্তনাদ করে ডুকরে কেঁদে উঠলেন। বললেন – ‘সাতচল্লিশে জীবনের মায়ায় জন্মভূমি ত্যাগ করে এসেছি; কিন্তু পরিতাপের বিষয় জন্মভূমির মায়ায় জীবনের ঝুঁকি নিতে পারিনি।’ আমি বললাম, ‘একবার চলুন মাতৃভূমি দেখে আসবেন।’ উত্তরে বললেন, ‘হাজার বছরের পিতৃভূমিতে যেতে হবে পাসপোর্ট ভিসা করে। এর চেয়ে বেদনা-বিড়ম্বনা আর নেই। যদি পুনর্জন্ম হয় ফরিদপুরেই যেন জন্মি, ফরিদপুরেই যেন মরি। সে-মৃত্যু যদি সাম্প্রদায়িক বিষবাষ্পের কারণে হয়, তবুও। মাতৃরূপী মাতৃভূমি তখন বলবে – ‘সন্তান আমার কোলে মাথা রেখে মরেছে, আমাকে ছেড়ে যায়নি।’’

এত বড়মাপের কথাসাহিত্যিকের লেখা নিয়ে কিছু বলা আমার সাজে না। আমি সাহিত্যিক নই। সাহিত্যের অনুরাগী একজন পাঠকমাত্র। চিত্তের অনুভূতি প্রকাশে, ভাষামাধুর্যে, সাহিত্যশৈলীতে আনোয়ারা সৈয়দ হক এত পারদর্শী, যা বলার অপেক্ষা রাখে না। বইটির ৭৪ পৃষ্ঠার কটি লাইন আমাকে মুগ্ধ করে, রোমান্টিক অনুভবে আচ্ছন্ন করে। একটু উদ্ধৃতি দেওয়া যায় – ‘দেশ কি বিদেশ কি, এই বয়সে দেশ এবং বিদেশ আমার আঁচলের নীচে এসে যেন খেলা করে। আমি পৃথিবীর রাস্তায় হেঁটে যাওয়া একজন পথিক – এই রকম এক মহৎ এবং রোমান্টিক ভাবে আমায় হৃদয় হয়ে ওঠে উদ্বেলিত।’ জীবনানন্দ দাশের ‘বনলতা সেন’ কবিতার একটি চরণের মতো যেন ‘হাজার বছর ধরে আমি পথ হাঁটিতেছি পৃথিবীর পথে।’

বাংলা একাডেমির গাছতলায় গুণীজনদের দেখার জন্য, তাঁদের কথা শোনার দর্শকের সারিতে গ্রন্থকার সতৃষ্ণ চোখে তাকিয়ে দেখতেন এবং শুনতেন তখনকার খ্যাতিমান সাহিত্যিক-শিল্পীদের আলাপচারিতা। খুব ভালো লাগত তাঁর এই গুণীজন-সাহচর্য। তাঁর ভাষায়, ‘আমার শিল্প পিপাসু বুভুক্ষু মন যেন এঁদের চারপাশ ঘিরেই আবর্তিত হত। আমার মনে হতো তাঁরা কতদূরের মানুষ। যেন আকাশে তাঁদের বসবাস, অথচ তবু কত স্বাচ্ছন্দ্যে তাঁরা বাক্যলাপ করছেন মাটির মানুষের সাথে।’ – লেখিকার এই উপলব্ধির মাঝে কোনো অতিশয়োক্তি নেই। গুণীজনদের চিন্তা-চেতনা এবং তাঁদের প্রতি অকুণ্ঠ শ্রদ্ধাবোধের আড়ালে তাঁর বড়মাপের লেখক হওয়ার, চিন্তাবিদ হওয়ার অপূর্ব ভাষামাধুর্যের চঞ্চল খেলার কথামালার জাদুকরী গাঁথুনি, তাঁর কাক্সিক্ষত অনাগত জীবনের গতিশীলতা তাঁকে লক্ষ্যে পৌঁছে দেবেই। সাহিত্যজগতে তো বটেই, কলামিস্ট হিসেবে পত্রপত্রিকায় স্থায়ী আসন করে নেবেন, তা জানতে পাঠকদের বেশিদিন অপেক্ষা করতে হয়নি। প্রকৃতপক্ষে এই সময়টা ছিল তাঁর অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছার উন্মেষকাল।

এক বৃদ্ধার ভিক্ষা চাইবার পর চালের মটকা শূন্য দেখে ঘরের সারা হাঁড়ি-পাতিল খুঁজে দেখার প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা ভিক্ষুকের দৃষ্টি এড়ায়নি। ভিক্ষুক হলেও তাঁর হৃদয়বৃত্তির ঔদার্য অসামান্য। বৃদ্ধা ভিক্ষুক মুগ্ধ হয়ে দেখলেন লেখিকার ভিক্ষা দেওয়ার অদম্য আগ্রহ, আকুতি এবং ভাঁড়ার শূন্য বলে ব্যর্থতার গ্লানি বৃদ্ধা ভিক্ষুকের চিত্ত স্পর্শ করে। তারই প্রকাশ ঘটেছে বৃদ্ধার হৃদয়নিঃসৃত আশীর্বাণীতে – ‘মা তুমি রাজরাণী হবে, মা।’ আমাদের দেশে কন্যা-বধূদের প্রতি প্রতীকী আশীর্বাণীর উত্তম ভাষা হলো – ‘মা, তুমি রাজরানী হবে’, এক মুষ্টি ভিক্ষা দেওয়ার অক্ষমতার আড়ালে লেখিকা বৃদ্ধার কাছ থেকে যে অনাবিল আশীর্বাদ লাভ করলেন, তা-ই হয়তো  তাঁর  জীবনপ্রবাহে  নানা  ঘাত-প্রতিঘাত অতিক্রম করতে অজান্তে প্রেরণা জুগিয়েছে।

বইটির ৯৭ পৃষ্ঠার প্রথম প্যারায় একটি সহিংস যুগের মর্মস্পর্শী প্রতিবেদন ফুটে উঠেছে। এই একটিমাত্র সংক্ষিপ্ত প্যারায় সংক্ষেপে যে-বর্ণনা তুলে ধরা হয়েছে তা যন্ত্রণাকাতর ও বেদনাবিধুর ইতিহাস। আমরা যারা সে-যুগের প্রত্যক্ষদর্শী, এখনো বেঁচে আছি, তারা কখনো ভুলতে পারব না সেই বর্বরতার, নিষ্ঠুরতার ইতিহাস – হিন্দু-মুসলমান রায়ট। ‘পাকিস্তান আমলে একতরফাভাবে হিন্দু নিধনের উৎসব। ছোটবেলা থেকে হিন্দু কাফেলাকে সীমান্তের ওপারে পাড়ি দিতে দেখা।’ কোনো যৌক্তিক কারণে নয়, কেবল সাম্প্রদায়িক রোষানলে পরে অখণ্ড ভারতের অখণ্ড দুটি প্রদেশ বাংলা ও পাঞ্জাবের বুক চিড়ে সীমান্তরেখা টানা হলো, যার ফলে সীমান্তের এপারের এক কোটি হিন্দু জনগোষ্ঠী স্ব-স্ব গৃহ ছেড়ে উদ্বাস্তু হয়ে কৃত্রিম সীমান্ত পাড়ি দিলো কেবল জীবনরক্ষার তাগিদে। অনুরূপভাবে সীমান্তের ওপারে সংখ্যালঘু মুসলিম জনগোষ্ঠীর ভাগ্যেও একই ঘটনা ঘটেছিল। জেমস সোজলে তাঁর Last days of British Empire বইতে লিখেছেন, ’৪৬-এর আগস্ট থেকে ’৪৭-এর সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ছয় লাখ মানুষ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় মৃত্যুবরণ করেছিল। সে-বছর ছিল শকুনিদের ইঁসঢ়বৎ ুবধৎ! শকুনের উদরপূর্তি হয়েছিল গলিত মানবদেহ ভক্ষণ করে।

১৯৪৬ সালের ১৬ আগস্ট জিন্নাহর ‘ডিরেক্ট অ্যাকশন’ দিবসে কলকাতার বুকে রক্তগঙ্গা বয়ে গিয়েছিল, যার ফলে পরবর্তী বছর ১৪ আগস্ট পৃথিবীর বুকে একমাত্র কৃত্রিম রাষ্ট্র পাকিস্তানের জন্ম হলো। একই সঙ্গে মৃত্যুর ঘণ্টাও গলায় ঝুলিয়ে আন্দোলন, অর্থাৎ বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের বীজ তখনই রোপিত হয়েছিল। এই বীজ ধাপে ধাপে বেড়ে উঠল এবং ’৭১-এ চূড়ান্ত পরিণতি লাভ করল স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের মধ্য দিয়ে।

‘মা’ এই এক অক্ষরের শব্দের চেয়ে মোহময় মায়াময় আর কিছু পৃথিবীতে নেই। লেখিকার বড়মা, বাবার প্রথম স্ত্রী (লেখিকার গর্ভধারিণী মা পূর্বেই ইন্তেকাল করেছেন), এই বড়মার স্নেহস্পর্শ তাঁর জীবনকে স্নিগ্ধ এবং মুগ্ধ করেছে। পূর্ণিমার চন্দ্রালোকের মতো তাঁর সমস্ত দেহমন অপূর্ব আনন্দে ভরিয়ে তুলেছে। এই আনন্দানুভূতির বর্ণনায় আছে শব্দের খেলা, যা ভাষার মহিমায় মোহনীয় করে তুলে পাঠকের হৃদয়গভীরে প্রবেশ করে এক অপূর্ব মোহাবেশ রচনা করে। সামান্য উদ্ধৃতিতে তা উপলব্ধি করার চেষ্টা – ‘তাঁর স্পর্শের ভেতর দিয়েই যেন আমি আমার মৃত মায়ের স্পর্শের পরশ পাই। আমার মাতৃহীনা খাঁ খাঁ অস্তিত্বের ভেতর আমার বড়মা যেন এক মুঠো বৃষ্টি দিয়ে আমাকে সর্বদা স্নেহের মায়া ভিজিয়ে রেখেছেন।’

২১৮ পৃষ্ঠার শেষ প্যারাটি চমৎকার মধুমাখা শব্দের গাঁথুনিজড়িত। শৈশবের স্বপ্নিল দিনগুলোর কথা স্মৃতিপটে এঁকেছেন যেন রবীন্দ্রনাথের ছন্দে – ‘দিনগুলি মোর সোনার খাঁচায় রইল না সেই যে আমার নানা রঙের দিনগুলি।’ শৈশবেই লেখালেখিতে তিনি অভ্যস্ত ছিলেন – ‘আর আমার চিন্তা চেতনায় চলত জগতের আবিলতাকে ধুয়ে মুছে কৌটায় ভরে তোলার আকুলতা। একটি বিদগ্ধতার জলে ধোয়া পরিবেশের খোঁজে আমার সারাটা জীবনই প্রায় ব্যয় করলাম।’ তিনি নিজেকে প্রশ্ন করেছেন ‘কিন্তু তা কি খুঁজে পেলাম?’ নিশ্চয়ই পেয়েছেন। তাঁর উপন্যাসসমগ্র, কলামিস্ট হিসেবে বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় সুচিন্তিত লেখনী এবং ভিন্নধর্মী আলোচ্য ক্ষুব্ধ সংলাপ গ্রন্থটি তাঁকে স্থান করে দিয়েছে বড়মাপের সাহিত্যিকদের, চিন্তাবিদদের সারিতে।

পিতার অসুস্থতার সংবাদ পেয়ে লন্ডন থেকে বাকি টিকিটে তড়িঘড়ি দেশে আসায় তাঁর অদম্য প্রয়াস লক্ষণীয়। এসে সুচিকিৎসার সর্বাত্মক প্রচেষ্টা ও পদে-পদে ব্যর্থতা ইত্যাদি লেখিকার মতো অসীম ধৈর্যশীল নারীর হৃদয়কে বারবার ক্ষতবিক্ষত করেছে। বেদনার গুরুভার বক্ষে ধারণ করা সাধ্যাতীত হয়ে উঠেছিল। তিনি নিজেও ডাক্তার হয়ে সব বুঝতে পেরেছিলেন। সঠিক রোগ নির্ণয়পূর্বক ওষুধ প্রয়োগ করতে এদেশের প্রায় ডাক্তারই অক্ষম। তথাপি ভুল চিকিৎসা করে ভুল ঔষধ দিয়ে রোগীর মৃত্যু ত্বরান্বিত করতে তারা সক্ষম। ডাক্তারের নির্দেশে মুহূর্তের ভেতর নার্স এন্ডিনালিন সিরিঞ্জে দেওয়ার মাঝপথেই বাবা ‘মঞ্জু মঞ্জু’ চিৎকার করে উঠলেন। তারপর মৃত্যুর মুখে ঢলে পড়লেন। পরের দৃশ্য বেদনাবিধুর। লেখিকা কাঁদতে কাঁদতে দৌড়ে চলেছেন রাস্তা দিয়ে মাকে বাবার মৃত্যুসংবাদ জানাতে। এ-শোকের ছুটে চলা যেন অনন্তকালের, শেষ হওয়ার নয়। এই শোক এই ছুটে চলার দৃশ্য তাঁকে তাড়িত করবে যতদিন না তিনি তাঁর জীবনের শেষ খেয়া পাড়ি দেন। পিতা পিতাই – তাঁর বাহ্যিক আচরণ যত রূঢ়ই হোক, সন্তানের প্রতি স্নেহের ফল্গুধারা নিরন্তর তাঁর অন্তরে বইতে থাকে। তাঁর বেঁচে ওঠার একান্ত আশা-ভরসা ছিল চিকিৎসক মেয়ে মঞ্জুকে (আনোয়ারা সৈয়দ হক) ঘিরে। তিনি যখন এসেছেন তখন নিবু নিবু জীবনপ্রদীপ আবার আলোকোজ্জ্বল হবে। মৃত্যুর কিনারা থেকে আবার জীবনে উত্তরণ ঘটবে; কিন্তু সে-আশা ধোঁয়াশায় পরিণত হলো ‘মূর্খ আত্মম্ভরী একজন ডাক্তারের হঠকারী সিদ্ধান্তে।’

সমুদ্রে ভাসমান মানুষ খড়কুটোয় আশ্রয় খোঁজে, সেক্ষেত্রে স্বীয় কন্যা ডাক্তার মঞ্জুকে দেখে তাঁর বাঁচার আশা শতভাগ জেগে উঠেছিল; কিন্তু ভুল চিকিৎসায় মৃত্যুর হিমশীতল স্পর্শ পেয়ে বারবার ‘মঞ্জু মঞ্জু’ বলে আর্তনাদ করে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করলেন পিতা।

আলোচ্য বইটি পড়ে লেখিকার জীবনের অনেক দুঃখ-বেদনার কথা জানা যায়। শুধু তাঁর আত্মকথনের মাঝেই বইটির বিষয়বস্তু সীমাবদ্ধ নয়, এতে পাঠকের অনেক কিছু জানার আছে। সমগ্র সমাজব্যবস্থার চিরন্তন রূপ বইটিতে ফুটে উঠেছে। বিশেষ করে অবহেলিত-উপেক্ষিত-নির্যাতিত-নিপীড়িত নারীসমাজের প্রতি আবহমান অবিচারের কথা উঠে এসেছে। সাম্প্রদায়িকতার উগ্র রূপ চল্লিশের দশকের শেষের দিকেই চরম আকার ধারণ করে এবং ’৪৭-এ দেশের বুকের ওপর দিয়ে সীমান্তরেখা টানার পরবর্তী দুর্গতির মর্মান্তিক কাহিনির কথা আগেই উল্লেখ করেছি; কিন্তু তারপরও পাকিস্তানি প্রেতাত্মা আমাদের ছেড়ে যায়নি। সাম্প্রদায়িকতা, ধর্মান্ধতা, জঙ্গিবাদ আমাদের কাঁধে পাকিস্তানিদের চেয়েও বেশি ভর করে আছে। এমন নানা বিষয় অকপটে বইটিতে স্থান করে নেওয়ায় পাঠকের দৃষ্টিপথে তৎকালীন ও বর্তমান কালের সমাজব্যবস্থার নানা কদর্য দিক উন্মোচিত হয়েছে, যা বইটি না পড়লে বোধগম্য হবে না।