সমর সেনের মনন ও কবিতাকৃতি

বেগম আকতার কামাল

উপনিবেশের বাবুসংস্কৃতির উত্তরাধিকার বহনে কবি সমর সেন ছিলেন ক্লান্ত, আত্মগ্লানিজর্জরিত, নিজের প্রতি বিদ্বিষ্ট এবং জীবন সম্পর্কে সংশয়াপন্ন। ঔপনিবেশিক নগর কলকাতায় বসবাসরত যুবকের যৌবনদ্বন্দ্ব ও কূটাভাসে, নিঃসঙ্গ পরিপার্শ্বে অতিবাহিত হয় তাঁর দিনরাত। তাই ‘আমি রোমান্টিক নই, মার্কসিস্ট’ – এই ঘোষণা দিয়ে সমর সেন নিজের দ্বান্দ্বিক চরিত্রবলকে প্রকাশ করেছিলেন কবিতায়, আর লিখনক্রিয়া থেকে ঝরিয়ে দিতে চেয়েছিলেন কাব্যমায়াবল। ঝরঝরে নির্ভার আর সংহত করতে চাইছিলেন কবিতার আঙ্গিককে। এক্ষেত্রে তাঁর মার্কসীয় মনন-মেধাকে আশ্রয় দিয়েছিল আধুনিকতার অবক্ষয়ী ধারার ইমেজিস্ট ধারা। মার্কস আর এলিয়টকে আবেগ-যুক্তির সমন্বয়ে মিলিয়ে দিতে চেয়েছিলেন কবি বিষ্ণু দে। সমর সেন সেক্ষেত্রে গ্রহণ করেছিলেন মার্কসীয় ভাবাদর্শের সঙ্গে ইমেজিস্ট আঙ্গিক। নিজের শ্রেণিচরিত্র আর সমকালীন পৃথিবীর সঙ্গে তাঁর ঘটেছিল প্রত্যক্ষ সম্পৃক্তি, যেন তিনি সময়ের সংকট-সংক্রান্তির মর্মসমুদ্রের ঢেউকে গুনতে পারছিলেন। তাই কবিতায় প্রথম পর্যায়ে শুধু প্রতীকায়িত হয় অন্ধকার, ধূসরতা, সংকট ও নৈঃসঙ্গ্যের স্তব্ধতা। স্বল্প তাঁর কবিতার সংখ্যা, কিন্তু তাঁর কবিতার পল্বলস্তরে ঘনীভূত অন্তর্চাপের প্রবলতা রয়েছে, আমাদের ঔপনিবেশিক প্রতিবেশের চাপ তাতে বহুগুণিত হয়েছে আর প্রকাশের ক্ষেত্রে দুটি প্রবাহ উৎসারিত করেছে। বহির্গত ক্ষেত্রে প্রতিবেশের অন্ধকার-কুটিলতা-বক্রতা, আর অন্তর্রূপে বন্দিচিত্তের গুহায়িত তিমির, একাকিত্ব – দুটোই উন্মোচিত।

আমরা ধরে নিই যে, যৌবনে ব্যক্তিমাত্রেই থাকে রোমান্টিক, সংবেদনশীল ও প্রাতিস্বিক বেদনায় উন্মনা, সমর সেন সেক্ষেত্রে আশ্লেষময়, কতকাংশে ত্রস্ত, গোপনচারী, অন্ধকার আর নিঃস্তব্ধতায় ‘বিষাক্ত সাপের মতো’ প্রেমের বাসনা নিয়ে তিনি দেখেছিলেন ‘আকাশে হলুদ রঙের অদ্ভুত চাঁদ’ উঠতে। ‘বাসনার বিষণœ দুঃস্বপ্ন’ শুধু নিজের মধ্যেই নয়, দেখতে পান প্রেমিকার চোখেও, সেখানেও পারহীন অন্ধকার, আবার যখন এই বাসনা ও অন্ধকার-বোধ নিয়ে ইতিহাসচেতনায় প্রভাতের রক্তিম আশার কাঁপন জাগে তখন তা হয়ে ওঠে বিপ্লবের ইশারা। এই ইতিহাস-সমাজজ্ঞানের বিশ্লেষণ বুদ্ধি তাঁকে অবশ্য নিয়ে গেছে বাঁকা, জটিল পথে, তাই প্রকাশ অর্গলমুক্ত হয়েছে প্রতিক্রম-বিন্যাসের মধ্যে, যেখানে যৌবনবন্দনার পরিবর্তে প্রবল হয় যৌবনদ্বন্দ্ব, জৈবিক এষণা হয়ে যায় যন্ত্রণার কু-লায়ন ও রুদ্ধরতির গ্রন্থিলতা। আত্মবিরুদ্ধবাদী কবি এ অবস্থায় নিজেই পরিহাস-ব্যঙ্গের নিষ্করুণ শরে বিদ্ধ করতে থাকেন – মননশীল আত্মসচেতন কবিমাত্রেই তা করেন, একপর্যায়ে নৈঃসঙ্গ্য-নৈঃশব্দ্যের গুহায় আত্মগোপনও করেন, বিপ্রতীপ চলনের সঙ্গে সংযোগ ঘটিয়ে অন্ধকার-বিষয়ক যাবতীয় অনুষঙ্গে হন সমর্পিত। তখন স্বতঃস্ফূর্ত গীতময়তা বদলে যায় গদ্যরীতিতে। সমর সেনের কবিতা গদ্যরূপাশ্রয়ী – এ-কথাটি আপতিক, নিহিত অর্থে তাঁর কবি আত্মায় কাব্যময়তাই অন্তঃশীলিত, গীতধর্ম আর ধ্বনি প্রতিধ্বনিময় আঙ্গিকই এখানে আধেয়।

অথচ চিন্তাশীল বিশ্লেষণ প্রবণতায় তাঁর মনোজগৎ স্থিত। অনিবার্য কালধর্মের সূত্রে সমর সেন কবিতায় রহস্যবিধুরতা, প্রতীকীবিশ্ব রচনা বা অতীন্দ্রিয়লোক সৃষ্টি করেন না। তাঁর জগৎ বস্তুবিশ্বচেতন বাস্তবতার বক্রতায়, ভঙ্গুরতায়, সংকোচনে ক্ষয়িত, ক্লিষ্ট। কোনো সমান্তরাল পরাবিশ্ব (জীবনানন্দের মতো) তৈরিতে তাঁর আগ্রহ নেই। মাতাল, বেকার, গণিকা, ভ- বুদ্ধিজীবী, প্রৌঢ়ের কামুকতা, নারীধর্ষণ, মধ্যবিত্ত যুবকের রুদ্ধরতি, টেরিকাটা মসৃণ যুবক – এইসব নাগরিক জনের ভিড়াক্রান্ত এক শহরকে তিনি ধারণ করেন চিত্রকল্পের আঙ্গিকে, গদ্যছন্দের মিত ব্যবহারে, মনে হয় এ-শহর যেন বোদলেয়ারের কবিতার সেই শহর, যেখানে ব্যক্তিমুখে কোনো প্রাতিস্বিক লাবণ্য ও মেধা নেই, সব যেন মুখোশে ঢাকা আর নিঃসহায়তা ও নিরাশ্রয়ের ছাপ দেহেমনে সর্বত্র ছড়ানো। সমর সেনের কবিতায় বিশ্লেষণ ক্ষমতার শক্তি প্রকাশিত, তিনি দৃষ্টি-ইন্দ্রিয়কে মুখ্য করেন, এতে কবিতার শরীর হয়ে ওঠে চিত্ররূপময়। অবশ্য এই দৃষ্টির মধ্যে তীক্ষèতা ও চিন্তা থাকে বলে তা জীবনানন্দের মতো মনোলোকী পরাভুবনের সৃষ্টিপথে যায় না, অথচ সমর সেনের কবিতা প্রজ্ঞাপথবাহী হয়েও চিত্রানুগম। কাট-কাট শব্দকল্প যখন বিরোধাভাস আর ইমেজের গর্ভে নিষিক্ত হতে থাকে তখন বাংলা কবিতায় নতুন ধারার উদ্ভাস ঘটতে থাকে। কয়েকটি দৃষ্টান্ত :

বরফের জ্বলন্ত স্তব্ধতায়

সূর্যের উজ্জ্বল বর্শা লাগল :            (‘স্বর্গ হইতে বিদায়’)

চাঁদের আলোয়

সময়ের শূন্য মরুভূমি জ্বলে।         (ঐ)

বাতাসে ফুলের গন্ধ

আর কিসের হাহাকার                   (‘একটি রাত্রের সুর’)

রক্তে যেন চঞ্চল বলাকা আসে

মাঝে মাঝে গভীর অন্ধকারে

যেন রক্তকরবী কাঁপে                   (‘রক্তকরবী’)

আসন্ন হেমন্তে

মৃত্যু সহসা ঝুঁকে পড়ে চারিধারে;

নিঃসঙ্গ বট

যেন পূর্বপুরুষের স্তব্ধ প্রেত।         (‘পলাতক’)

এরকম বহু ইমেজ তাঁর কবিতাদেহকে দাঁড় করিয়ে দেয় শক্ত মেরুদ-ের ওপর। কবিতার বাক্যাংশ, শব্দগুচ্ছে, এমনকি একটি মাত্র শব্দেও ইমেজ রচনা করেন কবি। ইমেজিস্টদের উদ্দেশ্য ছিল কবিতার শরীরকে নির্মেদ, কঠিন ও পৌরুষব্যঞ্জক করা। তার একমাত্র দৃষ্টান্ত বোধ করি সমর সেনের কবিতা। কাব্য বিষয়টি বস্তুগত বা ভাবগত যা-ই হোক না কেন, তাকে তিনি প্রত্যক্ষভাবে ব্যবহার করেছেন, নিরঙ্কুশ অনিবার্য শব্দ প্রয়োগ করেছেন; প্রয়োজনবোধে তাঁর ডিকশনে চলতি বাগ্ধারা উল্লিখিনও এসেছে। ছন্দস্পন্দনের পরম্পরায় নয়, শব্দ প্রযুক্ত হয়েছে ইমেজের নিবিড় রূপদানে। তাঁর কবিতা তাই ধোঁয়াটে বা দুর্বোধ্য নয়, স্পষ্ট ও দৃঢ়সংবদ্ধ। ঘনত্বই তাঁর কবিতার সারাৎসার; তিনি চেষ্টা করেছেন কবিতাকে অবধারিত, অনিবার্য করে তুলতে।

কাব্যরচনার প্রথম পর্বে তাঁর কয়েকটি কবিতা (১৯৩৭) ও গ্রহণ (১৯৪০) – এই দুটি কাব্যে তিনি আত্মাশ্রয়ী ছিলেন, আর মধ্যবিত্ত মানুষের অনুভবসর্বস্ব যৌবনরতি, প্রবল বুদ্ধিসত্তা এবং নিষ্করুণ ইটপাথরের অন্ধকার শহর কলকাতার রূপচিত্রণই ছিল মুখ্য। এ পর্যায়ে কবি ব্যবহার করেন বিভিন্ন রঙের ইমেজারি, যেগুলি শিল্পবোধ ও পরিচর্যাকৃতিতে উজ্জ্বল। ক্রমে কবির বিশ্লেষণদৃষ্টি আর চিন্তার প্রবলতা কবিতাকে গ্রহণ করে, কবিতা হয়ে ওঠে বর্ণনাত্মক তথ্যবাহী, কিছুটা শ্লথ। দ্বিতীয় পর্যায়ের কাব্যে খোলাচিঠি (১৯৪৩), তিন পুরুষে (১৯৪৩) তিনি প্রায় অনুজ্জ্বল। বহু রং আর চিত্রকল্প থেকে কবি সরে এসে তিনটি রঙে আর বর্ণনায় নির্ভরশীল হন। অন্ধকার অর্থাৎ কালো আর রক্তিমতা তথা লালের সঙ্গে চিত্তদাহ ও ব্যর্থতার আবহ হিসেবে নীলবর্ণ থাকলেও এ সময়ের সমর সেন সবুজ কথা জীবনবাদের রঙেই আমন্ত্রিত হন। এখানে ইতিহাসচিন্তাই বেশি। যেমন, ‘প্রথম পর্যায়ে ছিল এখানে হাওয়া নেই,/ মাটির উপরে গ্রীষ্মের পাতাগুলি কঠিন পাথর’। (‘অখ্যাত-নায়ক’), ‘খনির আগুনে সূর্যাস্ত আসে’ (‘সন্ধ্যা ও প্রভাত’), ‘আজ বহুদিনের তুষার স্তব্ধতার পর/ পর্বত চাহিল হতে বৈশাখের নিরুদ্দেশ মেঘ’ (ঐ)। এরকম ইমেজের অন্তর্বয়নে কবিতাগুলো হয়ে ওঠে উজ্জ্বল, ক্ষুধিত জাগুয়ারের মতো উদ্ধত, ক্ষিপ্রগতিময়, আরেকদিকে ‘স্নিগ্ধ বুকের মধ্যরাত্রে বন্দি’ করে রাখা রাতের গণিকার প্রেমে উজ্জ্বল পৃথিবীর বিপরীত দৃশ্যছবি – কেননা কবি জানেন, ‘আমাদের পিরীতি বালুর বাঁধ,/ গণিকার প্রেম আমাদের উজ্জ্বল পৃথিবী’ এবং দশ টাকা দর্শনী পেয়ে রাস্তার মোড়ে উর্বশীর ঘাগড়া দোলানো নাচ। বিষিয়ে ওঠা, শ্বাসরোধকারী; ক্লান্ত-ধ্বস্ত নগরজীবনের এইসব ছবি কিসের ইঙ্গিতবহ? একদিকে ‘বণিকের মানদ-ে পিঙ্গল প্রহার’, আরেক দিকে ‘ঝাপসাভাবে শুধু অনুভব করি/ চারিদিকে ঝড়ের নিঃশব্দ সঞ্চরণ।’ এই ঝড় বিপ্লবের আগমনধ্বনি; নেতি আর ইতির বিদিশা ও দিশায় সমর সেন মূলত অ্যান্টিথিসিসের কবি, এই অ্যান্টিথিসিসের গর্ভেই বীজ বুনে দেন সিনথিসিসের।

খোলা চিঠি কাব্যের ‘ক্রান্তি’ কবিতাটি তার দৃষ্টান্ত। বিষ্ণু দে-র স্থির বিশ্বাসের কেন্দ্রটি যে সিনথিসিসে শক্তিমান ও সুখোজ্জ্বল রূপ নেয়, তা নিয়ে সমর সেনের প্রশ্ন ছিল। চারিদিক যখন অশান্ত ও বিপন্ন, অলাতচক্রে চংক্রমণই শুধু সার, তখন কী করে বিষ্ণু দে রবীন্দ্রনাথের অস্তিতাবোধের মতোই দৃঢ়তা ও আশ্বাসদীপ্তি দিয়েছিলেন, কিন্তু সমর সেন তাঁর চরিত্রবলের দরুনই ওই রকম দীপ্তি পাননি। পাওয়ার কথাও নয়, কারণ মধ্যবিত্ত শ্রেণি তখন ক্ষয়িত ও আশাহীন – এ কারণেই কি সমর সেন বারো বছর কবিতাচর্চার পর কবিতা লেখা ছেড়ে দিয়ে সাংবাদিকতায় নিয়োজিত হয়েছিলেন, স্বল্প তাঁর কাব্যভূমি কিন্তু স্বকীয় সৃষ্টিপন্থায় সৎ, নির্ভীক, সুনিয়ন্ত্রিত চিন্তা প্রতিভায় স্বাভাবিক। উপরিউক্ত খোলা চিঠির ‘ক্রান্তি’ কবিতাটি নিয়ে ভাবা যেতে পারে। সাতটি পর্বে বিন্যস্ত কবিতাটি দীর্ঘ হলেও (দীর্ঘ কবিতা খুব বেশি লেখেননি সমর সেন) প্রতিটি পর্ব যেন স্বয়ংসম্পূর্ণ এক-একটি কবিতা। এলিয়টের পোড়ো জমির ইমেজ তিরিশি আধুনিকতায় বেশ খাপ খেয়ে গিয়েছিল বঙ্গীয় দেশের স্পেস হিসেবে এবং দুইয়ের মধ্যে কবিরা সাদৃশ্যও খুঁজে পেয়েছিলেন বা বিনির্মাণ করে নিয়েছিলেন। ‘ক্রান্তি’ কবিতাটির প্রথম পর্বে তেমনি একটি বন্ধ্যা-ঊষর প্রান্তরের উত্তরাধিকার বহনের কথা বলা হয়েছে – ‘এক অতিকায় তৃষ্ণার্ত মহিষের চোখ/ শূন্য থেকে একমনে জলাশয় খোঁজে,/ ব্যর্থ-নিঃশ্বাসের হাওয়ারা হঠাৎ দল বেঁধে চলে/ ছিন্নপত্রে বালুতে পাথরে, অনর্থক হিবিজিবি কেটে/ এ প্রান্তর আমাদের উত্তরাধিকার’।

পোড়ো জমির সঙ্গে কলকাতা শহরের এই বন্ধ্যত্বের চিত্রানুষঙ্গে বৈধতা পেয়েছে ঔপনিবেশিক সংস্কৃতি, মেকলের

শিক্ষানীতি-অনুসারী বাবুসমাজের  কালচার, মুক্তির দিগন্তে নতুন ইতিহাস চেতনার ইশারা, ‘অন্ধকারের পাশাপাশি সবুজ ধানক্ষেতের বিস্তার’। দ্বিতীয় পর্বে ‘অন্ধকার ভেঙ্গেছে বাঁধ,/ স্তরে স্তরে সমুদ্রে সমুদ্যত বজ্রপেশী মেঘ’ – তারা ক্রান্তিকালে এসে দাঁড়িয়েছে, বুঝে নিতে চাইছে নিজেদের দায়। মানুষের কল্যাণকে চরিতার্থ করা সমর সেনের ইচ্ছা নয়, তিনি চান ক্রান্তিকালের ভয়াবহ পরিবেশ ও স্বাভাবিক ভীষণতাকে আমাদের ভাবনায়, আমাদের অভিজ্ঞতার পাটে ‘কৃষ্ণপক্ষের সূর্যের  মতো’ পরিবেশন করতে, যাতে আমাদের মননপিপাসু স্বভাবটি পরিশুদ্ধতার প্রয়াস করে। সকল মার্কসবাদী কবিলেখকেরই এই চেষ্টা ছিল যে, তাঁরা সমাজ ও আমাদের চিত্তকে ‘ওরাকল’ উচ্চারণকারীর মতোই বাণীশুদ্ধতায় সঞ্চরণশীল করবেন, বোধের গভীরে চারিয়ে দেবেন সমাজতান্ত্রিক বাস্তবতা। এবং এই চারণায় সমকাল একটি বড় সত্য হয়ে ওঠে – ‘ভারতের হৃৎপি-ে হানা দেয় বিদেশী বণিক/ পূর্ব সীমান্তে জমে জমে চীত সৈনিক’। ১৯৪২-৪৩-এর ঘটনাতথ্য ও সময়কাল পেয়ে যাই আমরা, আর বর্তমানের সময়কাল নিয়ে ভাবিত হই। মধ্যবিত্তের চেতনায় জীবনযাপনের রূঢ়তা আর তাদের স্বপ্ন-কাক্সক্ষা-বাসনার উৎকণ্ঠা সমর সেনের কবিতাকে এমন এক গতি পরিণতির দিকে নিয়ে যায় যেখানে আমরা হৃদয়, ভাবনা ও অভিজ্ঞতাকে সজাগ ও শালীন করে নিতে পারি। আত্মদর্শনের আত্মনাশের সঙ্গে সকলের সর্বনাশকে জড়িয়ে নিয়ে ভাবতে পারি। কবিতাটির চতুর্থ পর্বে সেই চিত্রকল্পই এঁকেছেন কবি – ‘ঘুরে গম-বাজরার রুটি, কিছু পনির পরচর্চা,/ ঘুমের আগে ইতস্তত চিন্তন, অস্বস্তি/ বাইরের রাত্রি হয়তো নিটোল নিবিড়,/ আধো-ঘুমে, আধো স্বপ্নে আমার রাত্রি কাটে,/ অধিকাংশই উৎকণ্ঠার স্বপ্ন।’ কামপ্রেষণা যা মধ্যবিত্তের বাসনাকে নানা বিকল্পায়নে আবেগের নামে শরীরী-অশরীরী যে দার্শনিকতায়  নিয়ে যায় সেখানে ‘শরীরের প্রাকৃতিক আবেগ,/ তপ্ত মুহূর্তের খড়গ। আনে না অলীক স্বর্গ, মন্দির গোধূলিতে।’

১৯৪৩-এর দুর্ভিক্ষকে সাবজেক্ট করে বড়মাপের মার্কসবাদী সাহিত্যিকেরা তাঁদের বয়ান কালের কাছে রেখে গেছেন নানা

রূপে-রূপায়ণে। সমর সেনের উক্ত ‘ক্রান্তি’ কবিতাটিতে দুর্ভিক্ষের চিত্রকল্প নিরেট রূপ পায় শব্দগুচ্ছের পরম্পরায় – ‘নাসারন্ধ্রে বিস্তারিত দুর্ভিক্ষের ধূপে/ কৃষ্ণবর্ণ লোলজিহ্বা, করালবদন!/ পদপ্রান্তে নিরুদ্দেশ ধান আর গম/ আর পুঞ্জীভূত প্রাণহীন দেহ,/ ছিল শিশুর রক্তজবা।’ এবং দুর্ভিক্ষকে যুক্ত করে দেন মানবসভ্যতার দূর-ইতিহাসের সঙ্গে। এই সেই ইতিহাস, যেখানে মানুষ দেশান্তরিত হয় খাদ্যের সন্ধানে, মহাকাব্যের বীর নায়কদের মতো যুদ্ধ বাধিয়ে নারী উদ্ধারের জন্য নয় – এই যাত্রা কবে শুরু, কোথায় শেষ? একালে যুদ্ধ বা দেশান্তরিত মানবযাত্রা নিয়ে কোনো গাথা-মহাকাব্য আর কবিরা রচনা করেন না। জীবনানন্দের মতো তপতী-আশ্রয়ী অন্ধকার-চেতনার কবিকেও ১৯৪৩-এর দুর্ভিক্ষ দিশেহারা করেছিল, বিষ্ণু দে-কেও। মননশীল  বৌদ্ধিক কবিদের দুর্ভিক্ষকেন্দ্রিক

ভাবনা শুধুই কি কালবেলার সংকট নিয়ে ক্রান্তিকালের কালো সূর্যকে নিয়ে শিহরিত হয়? নাকি সভ্যতার দিশা নির্দেশ করে, চেতনার উত্তরণ ঘটায়? অন্তত মধ্যবিত্ত কবিসাহিত্যিকেরা ধ্বংস-মৃত্যুই দেখেন বেশি।

প্রতিরোধ বা বিধান দিয়েছেন খুব কম লেখক, যেমন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের আজ কাল পরশুর গল্প বা শিল্পী জয়নুল আবেদিনের  দুর্ভিক্ষের চিত্রকলা। এ নিয়ে আত্মসমালোচনা আর আত্মসাক্ষাৎকার সমর সেনের কবিতাকে আলাদা মূল্য দেয়, কারণ তিনিই তো লিখেছিলেন বাবু বৃত্তান্তের মতো তীক্ষèভাষিত ভর্ৎসনামূলক চরিত্রাখ্যান, তাই নিজেকে দেখেন ‘ঈগল কামের নিচে মূষিক

পৃথিবীতে/ দ্বিখ-িত সস্তা জীবনের উদ্বিগ্ন ক্লান্তি/ হাশিশ খোঁজে দ্বিধান্বিত নানা ক্রান্তিকে’। বিপরীত দিকে মার্কসীয় বীক্ষানুগ শ্রমজীবী মানুষের জমায়েতকে সংবর্ধিত করেন, যারা ক্রান্তিবীর কিন্তু বিভ্রান্ত নয়। ‘কারখানায় সংঘবদ্ধ জমে অনেকের ভিড়,/ হাতে বিপ্লবের রাখী।/ পোড়ো মাটিতে অস্ত্র হাতে প্রহরী জাগে ক্ষুধিত কিষাণ।/ ভয়াবহ রণক্ষেত্রে লাল সৈন্য ঢালে প্রাণের আধার।/ সহসা মধ্যদিনে বাজে কালের বিষাণ।’

মার্কসীয় তত্ত্বের যে একটি ত্রুটি নির্দেশ করে পরবর্তীকালীন সমাজতাত্ত্বিকরা শ্রমিকশ্রেণির পাশাপাশি কৃষকশ্রেণির বিপ্লব ও সংগ্রামকে সামনে এনেছিলেন, যেমন ইতালির তাত্ত্বিক আন্তনিও গ্রামসির তত্ত্ব, সে দিকেই ইশারা দিয়েছেন সমর সেন। শ্রমিক আর কৃষককে তিনি ‘অগ্নিময় বিপ্লবী চেতনার অখ- সত্তায় দাও অধিকার’-এর কথা বলেছেন। আজকের পণ্যভোগী ধনতন্ত্রের পোস্ট-মডার্নিজমে যে অধিকার ও ম্যাটান্যারেটিভকে বিশেষ করে মার্কসবাদকে তছনছ করা হচ্ছে, সেই প্রেক্ষাপটে কৃষিভিত্তিক এই ভূখ-ের জন্য বিশেষ করে কৃষকের মুক্তির জন্য এই ম্যাটান্যারেটিভ আবশ্যক। তাই রাবীন্দ্রিক অনন্ত, অখ- ইত্যাকার অধিবিদ্যক শব্দগুলি যখন সমর সেনের কবিতায় মানুষের সর্বশ্রেণির মধ্যে অখ- ঐক্যকে সন্ধান করে, সেতু বাঁধতে চায়, তখন আমাদের আরেকবার ইতিহাসের দিকে ফিরে তাকাতেই হয়, প্রাণের আশ^াসে দিশার খোঁজে। সমর সেনের কবিতা এই প্রয়োজনটাই জানান দেয়। ফসল নিয়ে তাঁর আঁকা ছবিটি হচ্ছে :

ঐশ^র্যসম্ভার জমে ফসলের মাঠে;

ধানগাছ মাথা তুলে কিশোর অধরে

সন্ধ্যার দিগন্তে ডাকে অনেক পাখিকে।

বিচ্ছিন্ন শহর প্রান্তে

দূরে দেখি মাঠে কত ধানের দুলাল

কিষাণের চষা নিমকহালাল। (‘আকলে’)

কিন্তু নিছক স্বপ্নীল আশাবাদের কুহকে কবি মজে থাকেননি। বরং এক চিরকালীন বৈপরীত্য মুদ্রিত করে দেন সময়ের কয়ালবৃন্তে। জীবনানন্দে কৃষি-সংস্কৃতির যে মনন হেমন্তের ক্ষয়িত রূপ দেখে চিত্ত ও সভ্যতার সংকট হিসেবে, প্রতীকরূপে, সমর সেন সেই হেমন্তকে দেখেন প্রত্যাশার প্রবীণ বিষণœতার রূপে – ‘হেমন্তের প্রবীণ বিষণœতা/ দিগন্তের মাঠে, জনহীন গ্রামে/ ভিটেতে ঘুঘু ডাকে;/চাষিরা পায়ে হেঁটে গেছে দূর দেশান্তরে/ প্রাণের সন্ধানে নগরের প্রেতলোকে।’

সভ্যতার পরম্পরায় প্রিক্যাপিটালিজমের পর্যায়ে স্বর্ণ আহরণ অর্থাৎ পুঁজি সংগ্রামের নাট্যলীলা তুলে ধরেছিলেন রবীন্দ্রনাথ তাঁর রক্তকরবী নাটকে। ঈশানী গ্রাম থেকে চাষিরা স্নিগ্ধছায়াঘন বটতল ও কুটির ছেড়ে কেন ছুটে আসে চিটাগড়ের কলে-কারখানায়, যক্ষপুরীতে? এই প্রশ্ন করে তিনি চাষিদের নগরযাত্রাকে রোধ করার আহ্বান জানিয়েছিলেন ‘পৌষ তোদের ডাক দিয়েছে/ আয় রে চলে আয় আয়।’ সমর সেনও কালের রাখাল, যে একদিন আপন বাটে ফেরার পথে ধানের হরিৎ দেখত আজ সে রাখাল ধূর্ত, কঠিন ‘রথচক্রে নির্বান্ধব প্রান্তরে’। তাই চাষিদের পায়ে হেঁটে শহরযাত্রার পালানাট্য আজো অব্যাহত; কিন্তু তাদের নেই কোনো কালের সারথি। গ্রামে এখন ‘নষ্টনীড় পাখি কাঁদে, রক্তমাখা হাড় দেখি সাজানো বাগানে।’

যে শাহরিক স্তব্ধতা-নিঃসঙ্গতা আর মধ্যবিত্তের পলায়নবাদী নিষ্ক্রিয়তা, যৌনতাকাম নিয়ে সমর সেন কবিতা শুরু করেছিলেন, যে তীক্ষè ব্যঙ্গ আর বিদ্রƒপ ছিল লেখনীতে, তা দিশা পেয়ে যায় মার্কসীয় প্রত্যয়ে সচেতনতার সরণি বেয়ে গ্রামভুবনের দিকে মোড় নেয়। রাত্রির অন্ধকার আর হলুদ চাঁদের বদলে প্রাণ ডুবে যেতে চায় ফসলের সবুজ বন্যায়। তাঁর জন্মের এই একশ বছর পরেও দেখি মধ্যবিত্ত আরো নিশ্চেতন, ভোগী, ধূর্ত ও কামকাতুরে হয়ে উঠেছে। সবুজ ফসল ভরা ক্ষেতের স্বপ্নাতুর বয়ান আজো মধ্যবিত্তের চেতনায় আলোড়ন তোলে – হয়তো তার নির্জ্ঞানের অতল থেকে, যেখানে আছে মানুষের সমুদয় প্রাকৃতিকতা, আর শুদ্ধ প্রাণের স্নিগ্ধ জলঝরনা যেমনটি চেয়েছিলেন জীবনানন্দ দাশ তাঁর ইতিহাসবোধিতে। সমর সেনের কবিতা আমাদের সেই ইতিহাসবোধেরই ইমেজিস্ট অন্তর্বয়ন হয়ে ওঠে।