সম্পাদকীয়

সম্পাদকীয়

কালি ও কলমের প্রতিষ্ঠাকাল থেকে এর সম্পাদক আবুল হাসনাত, কবি-নাম মাহমুদ আল জামান, ছিলেন একাধারে কবি, কথাসাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক, চিত্র-সমালোচক, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, প্রগতিচিন্তার নিরলস বাহক ও সর্বোপরি একজন সফল সম্পাদক। তিনি বিগত ১ নভেম্বর ২০২০ পরলোকগমন করেছেন। তাঁর বিদেহী আত্মা ও স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধাবনত কালি ও কলম পরিবার।

এদেশের সাহিত্যের পরিচর্যা ও নবীনদের সাহিত্যপরিমণ্ডলে প্রতিষ্ঠিত করার প্রয়াসে তিনি ছিলেন অক্লান্ত। অন্যসব পরিচয় ছাপিয়ে তাই তাঁর সম্পাদক পরিচয়ই সবার কাছে বড় হয়ে উঠেছে। কর্মজীবনের শুরুতে তিনি যোগ দেন দৈনিক সংবাদে, সহ-সম্পাদক হিসেবে। পরবর্তীকালে ‘সংবাদ সাময়িকী’র সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন দুই যুগেরও বেশি সময়। এ-সময়ে ‘সংবাদ সাময়িকী’ হয়ে ওঠে এদেশের সাহিত্যের দর্পণ। এছাড়া তাঁর সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়েছে গণসাহিত্য সাহিত্যপত্রিকা। অতঃপর সংবাদ ছেড়ে যোগ দেন কালি ও কলমে। ২০০৪ সাল থেকে তাঁর সম্পাদনায় প্রতি বাংলা মাসের ১ তারিখে নিয়মিত প্রকাশিত হয়ে আসছে পত্রিকাটি এবং অর্জন করেছে সুধীজনদের মনোযোগ। চিত্রকলাবিষয়ক পত্রিকা শিল্প ও শিল্পীরও সম্পাদক ছিলেন তিনি। নির্বাহী পরিচালক ছিলেন বেঙ্গল পাবলিকেশনসের। প্রচ্ছন্নে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন আরো পত্রপত্রিকা ও সাহিত্য সংকলনের। 

কালি ও কলমের শুরু থেকে সম্পাদক হিসেবে তিনি এর গুণ-মান উন্নয়ন ও অব্যাহত রাখতে এবং এপার-ওপার বাংলার সাহিত্যপ্রচেষ্টাকে এক ধারায় মিলিত করতে সক্রিয় ছিলেন। তাঁর দিকনির্দেশনা, পরিকল্পনা ও সময়ানুবর্তিতার কারণে কালি ও কলম দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়েছে ও বিরতিহীনভাবে এ-পত্রিকার প্রকাশনা অব্যাহত থেকেছে।

সম্পাদকের গুরুদায়িত্ব পালনের পাশাপাশি নীরবে-নিভৃতে তিনি তাঁর সাহিত্যচর্চাও অব্যাহত রেখেছিলেন। মৌলিক রচনা ও সম্পাদনাসহ তাঁর সত্তরটিরও বেশি বই প্রকাশিত হয়েছে। ১৯৮২ সালে টুকু সমুদ্রের গল্প বইয়ের জন্য পেয়েছেন ‘অগ্রণী ব্যাংক শিশুসাহিত্য পুরস্কার’। ২০১৪ সালে তিনি মনোনীত হন বাংলা একাডেমির সম্মানসূচক ফেলো। ২০২০ সালে তাঁর প্রবন্ধগ্রন্থ প্রত্যয়ী স্মৃতি অন্যান্য অর্জন করেছে ‘মুনীর চৌধুরী স্মৃতি পুরস্কার ২০২০’। এদেশের প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের সঙ্গেও ছিল তাঁর নিবিড় সম্পর্ক; যুক্ত ছিলেন ছায়ানটসহ বহু দেশীয় ও আন্তর্জাতিক সাহিত্য-সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে। আবুল হাসনাত তাঁর নানাবিধ কাজের মধ্য দিয়ে বাঙালির মনোগঠনের পরিচ্ছন্ন ভাবধারা, স্বরূপের অনুসন্ধান ও বহুত্ববাদী সংস্কৃতির ভাবনাচিন্তায় যে-মাত্রা সঞ্চার করেছিলেন তা এদেশের বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার ক্ষেত্রকে প্রসারিত করেছে। বিশেষত এদেশে শিল্পকলা বিষয়ে মানুষকে উৎসাহী এবং গ্রন্থপাঠে আগ্রহী ও পাঠরুচি তৈরিতে তাঁর ভূমিকা অনস্বীকার্য।

কৈশোর-উত্তীর্ণ কাল থেকে তাঁর সামাজিক দায় ও অঙ্গীকার গড়ে উঠেছিল। এই দায়ই তাঁকে সর্বদা চালিত করেছে বহুমুখিন সাংস্কৃতিক, সাহিত্যিক ও সামাজিক-রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক আন্দোলনের সাথে এতাত্ম হতে ও সে-আন্দোলনকে গতিসচল করার কাজে তৎপর হতে। এই দায় আমৃত্যু তিনি বহন করেছেন আপন জীবনজিজ্ঞাসা ও অন্তরের তাগিদে। গত শতাব্দীর ষাটের দশকে ছাত্রাবস্থায় তিনি যোগ দিয়েছিলেন এদেশের প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠন ছাত্র ইউনিয়নে এবং পরবর্তীকালে যোগ দেন বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টিতে। বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের প্রায় পুরোটা সময় পার্টির নির্দেশে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার অবিচল লক্ষ্যে কলকাতায় থেকে কাজ করে গেছেন নিরলসভাবে।

তাঁর চরিত্রমাধুর্য, স্বভাবধর্ম ও সৌজন্যে যে-বিনয় ছিল তা ব্যক্তি আবুল হাসনাতকে তুলে ধরেছিল এক অনন্য উচ্চতায়। এই মানুষটিকে হারিয়ে আজ আমরা শোকাভিভূত।

কালি ও কলম প্রয়াস নিয়েছে তাঁকে নিয়ে একটি শ্রদ্ধাজ্ঞাপক বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ করতে। আমরা চেষ্টা করেছি তাঁর লেখালেখির জগৎ এবং দেশের সাহিত্য, শিল্পকলা ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনে তাঁর অবদানকে স্মরণ করতে এবং তাঁর বোধ ও চেতনার স্বরূপ জানতে। আমাদের প্রয়াসে অনুকূল সাড়া দিয়ে যাঁরা এতে লিখেছেন তাঁদের কাছে আমরা কৃতজ্ঞ। প্রয়াত সম্পাদক আবুল হাসনাতকে শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করে কালি ও কলমের বর্ধিত কলেবরের এ-সংখ্যাটি একাদশ-দ্বাদশ/ পৌষ-মাঘ ১৪২৭, যুগ্ম সংখ্যা রূপে প্রকাশিত হলো।